শ্রোতার আসরের দশ বছর পূর্তির পরিবেশনা দেখে একটা চমৎকার সুখানুভূতি নিয়ে শনিবারের রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম আমার মেলবোর্ন জীবনেরও দশ বছর হয়ে গেলো। দশ বছর, একটা লম্বা সময় আসলে।
এই দূর পরবাসে একটা বাংলা গানের দলের দশ বছর পূরণ করে ফেলাটা কিন্তু মুখের কথা নয়।
প্রবাসে বসে বাংলা ভাষা, সঙ্গীত বা সংস্কৃতির চর্চা করা কী পরিমাণ কষ্টসাধ্য একটা কাজ, এটা যারা না করেছেন, তারা আসলেই জানেন না। ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়ানো - এটা অনেকের কাছেই কেবলই একটা কথার কথা, কিন্তু এই কথাটির একদম শত ভাগ বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় এধরনের দলগুলোয়। নিজেদের চাকরি, সংসার, ছেলে পেলে, অন্যান্য সামাজিকতা এই সব কিছু করে তারপরে একেকটা প্রোগ্রামের জন্যে সময় বের করতে হয়। কাজের পরে প্র্যাকটিস, সবার সময় মিলানো, গায়কদের সাথে যন্ত্রশিল্পীদের সমন্বয়, মঞ্চের যোগাড়যন্ত্র, কখনো আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্যে ছোটা, কখনো সেটা ছাড়াই...। এই সব মিলিয়ে একটা এলাহি কারবার আসলে।
এই এত কিছু করে করে একটা গানের দল আজকে দশ বছর পূর্ণ করে ফেললো, তাদের শুভেচ্ছা না জানিয়ে উপায় নেই। শ্রোতার আসরকে তাই শুভেচ্ছা জানাই।
মেলবোর্নে গান শুনতে গিয়ে নিদারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রায়ই। কখনো পুরো অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়েছে সপ্তম শ্রেণির শিশুকিশোরের ট্যালেন্ট শো দেখছি, যে যা পারছে, অথবা যা পারছে না, সব কিছু নিয়েই মঞ্চে উঠে যাচ্ছে। কেউ কেউ এক সময় গাইতেন, এখন মঞ্চে মাইক দেখে ভাবলেন দিই না একটা গান গেয়ে- এরকম মনোভাব নিয়ে গেয়ে দিলেন একটা গান, এমনও হয়েছে। এক অনুষ্ঠানে একবার আবেগতাড়িত এক ভদ্রলোক হারমোনিয়াম টেনে হঠাত ‘এবার একটা পুজোর গান শোনাই’ বলে গেয়ে উঠলেন ‘আমার পূজার ফুল ভালবাসা হয়ে গেছে... ’! বিশ্বাস করুন, আমার হৃদযন্ত্র তার ক্রিয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল সেদিন!
এই এত কিছুর মাঝখানে শ্রোতার আসর অনেকটা সুবাসের মতন। ওদের সবচেয়ে যেটা বেশি ভাল লাগে, তা হচ্ছে অভিনবত্ব। একটা পুরো অনুষ্ঠান সলীল চৌধুরীকে নিবেদন করে করা, এই প্রবাসে বসে ভাবা যায় এরকম? অথবা কখনো শচীন দেব বর্মনের গান দিয়ে সাজানো, কখনো থিম বেছে নেয়া হয় চিঠি, কখনো বাদল দিনের গান। এরকম চমৎকার সব অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের শ্রোতার আসর।
চমৎকার সব যন্ত্রশিল্পী রয়েছে এই দলটায়। পরিচিত গান, কিন্তু নতুন নতুন এরেঞ্জমেনটে গেয়ে কী শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে শেষমেশ।
ইউটিউবে গিয়ে গিয়ে পছন্দের গান শুনি আমরা প্রায় সবাইই। কিছু গান বারবার শোনা হয়। দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই গানগুলো হয় সুপরিচিত শিল্পীদের গাওয়া। অথচ শ্রোতার আসরের অনুষ্ঠান দেখে এসে এমন হয়েছে, আমি ইউটিউব ঘুরে ঘুরে বার বার হয়ত শুনছি আমার অসম্ভব ভাল লাগা গান ‘কে যাস রে’, কিন্তু অবাক হয়ে দেখি, আমি হয়ত শুনছি শ্রোতার আসরের সিমিনের গাওয়া ভার্সনটাই। একই ভাবে বার বার শুনি কাঁকনের গাওয়া ‘কেউ কোন দিন আমারে তো’। এই ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেও ভাল লাগে, মনে হয়, একজন শিল্পীর এটাই তো সত্যিকারের প্রাপ্তি, শ্রোতার মনের ভেতরে ঢুকে পড়াটা।
আজকের অনুষ্ঠানটাও এক কথায় চমৎকার হয়েছে। অনেক ভাল লেগেছে শমী-র ‘তখন তোমার একুশ বছর...।’ গায়কদের মঞ্চে নিয়ে এসে তাদের সাথে কথা বলে বলে দর্শকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রচলন অন্তত এই প্রবাসে খুব বেশি দেখিনি। এ ব্যাপারটা কত যে হয়েছে, একটা লম্বা অনুষ্ঠান দেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভেবেছি, আচ্ছা ওই গানটা খুব ভাল লেগেছিল, কে যেন গেয়েছিল? দেখি সেটা আর মনে নেই। এত কম মানুষদের মাঝেও গানের শিল্পীরাই কেমন করে যেন আড়ালে থেকে যায়। তাই, এভাবে শিল্পীদের সামনে নিয়ে আসা, দর্শকদের মাঝে নিয়ে আসার ব্যাপারটা প্রশংসার যোগ্য। এই খানে বলে ফেলি, অন্তত আজকের পরিবেশনার স্টাইলের জন্যেই, গায়ক বা বাদ্যযন্ত্রীদের সাথে সাথে প্রায় সমান কৃতিত্ব দিতেই হবে উপস্থাপক আতিক রহমানকে। ওনার সাবলীলতা এবং রসবোধ আজকের অনুষ্ঠানের প্রাণ ভোমরা হয়ে ছিলো।
আরও ভাল লেগেছে মালা-র একদম হৃদয় নিংড়ানো গান ‘বলি মা তোর চরণ ধরে...’। কী যে ভাল লাগে কেউ যখন একদম অন্তর থেকে গায়! ভাল লেগেছে মৌলী, হিমানী, অনিন্দ্য, চঞ্চল ও জাকি আমানের গানও।
শ্রোতার আসরকে বলি, দশ বছর পরে আপনাদের প্রাপ্তি আসলে কী জানেন? আমরা গান-প্রেমীরা মেলবোর্নের প্রায় সব অনুষ্ঠানেই হাজিরা দেই। সব অনুষ্ঠানে যাই এক ধরণের জুয়া খেলার মত করে, হয়ত গান ভাল লাগবে, হয়ত লাগবে না। হয়ত সন্ধ্যাটা সুন্দর কাটবে হয়ত কাটবে না। কিন্তু শ্রোতার আসরের অনুষ্ঠান দেখতে যখন যাই, আমরা সেই আশা নিয়ে যাই যে আজকে একটা ভাল অনুষ্ঠান দেখতে যাচ্ছি, ভাল কিছু গান শুনতে যাচ্ছি।
সেই আশা দিনে দিনে আরও বেড়ে উঠুক, আপনাদের জন্যে রইলো শুভকামনা।
-------
তারেক নূরুল হাসান
১০ অক্টোবর ২০১৫
মন্তব্য
ইউটিউব থেকে গানগুলি শুনে নিলাম। সত্যি চমৎকার।
শ্রোতার আসরের জন্য অনেক শুভকামনা।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
শুভকামনা
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ইউটিউবে যতটুকু দেখলাম, সত্যিই চমৎকার আয়োজন মনে হলো। সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আয়োজন আসলেই দেখার মত হয় প্রতিবার।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
অনেকদিন পর হিমানীর গান শুনলাম আবার। এত সুন্দর একটা আয়োজন বাংলা মুলুকের এত বাইরে থেকেও যে করতে পেরেছে ' শ্রোতার আসর' তার জন্য অজস্র ধন্যবাদ তাদের।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
হিমানী-কে মেলবোর্নের ব্যস্ততম শিল্পী বলা যায়, খুব সুন্দর গলা।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
চমৎকার কিছু গান শোনা হলো। এরকম আয়োজন যে কতখানি পরিশ্রমসাধ্য তা দেখেই বোঝা গেলো। শুভকামনা থাকল যেন আরও ভালো আয়োজন হয় সামনে।
আপনার খবর কী?
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
নতুন মন্তব্য করুন