সর্বশেষ ইমনের করা কাজ দেখেছিলাম আমাদের বসার ঘরের টিভিতে, সেটা ছিল আরএময়াইটি-র ফিল্ম কোর্সের জন্যে ওর বানানো একটা শর্ট ফিল্ম। ইমন আর তন্বীর মেলবোর্নে থাকাকালীন একটা বছর আমাদের জন্যে উল্লেখযোগ্য একটা সময় হয়ে থাকবে আজীবন, সেটা নিয়ে লিখেছি আগে এখানেই, নাম ছিল ‘গগন আজ দেশে ফিরছে”। সে দিন সকাল বেলা আমাদের বাসায় বসে দুইজনে ব্যাগ গোছাচ্ছে, আর পাশের ঘরে বসে আমি ভীষণ মন খারাপ করে লিখে চলেছি সেই ব্লগ, অতঃপর রাতে যখন ওদের প্লেনে তুলে দিয়ে আসলাম, মনে আছে তারপরের অনেকগুলো দিন আমার আর তিথি-র চারপাশ জুড়ে ছিল একটা অদ্ভুত শূন্যতা।
সেই প্লেন উড়ে চলে যাবার বছর চারেক বাদেই যে আমি আবু শাহেদ ইমনের পরিচালিত সিনেমা বড় পর্দায় দেখার জন্যে এই মেলবোর্নেরই এক সিনেমা হলের টিকেটের লাইনে দাঁড়াবো, সত্যি বলছি, এই কথা সেদিন ঘুর্নাক্ষরেও ভাবিনি!
কিন্তু এই ছেলে আসলে চমকে দিতে জানে! প্রতিবার ওর সাথে কথা বলার সময় নতুন কোন চমকের জন্যে প্রস্তুত থাকি, চমকে দেয়াটাকেই একরকম নিয়মে পরিণত করেছে সে!
জালালের গল্প- নিয়ে ওর ভাবনার কথা জানি অনেকদিন। শুরুর দিকের একটা স্ক্রিপ্ট রয়েছে আমার কাছে, যখন এই গল্পের নাম ছিল জালালের পিতাগণ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু ছেলেমেয়ে ছিল গল্পের গুরুত্বপুর্ন চরিত্র। কিন্তু ইমনের মজা হল এই, ওর মাথায় গল্পেরা সারাক্ষণই বদলে বদলে যায়। এই অভ্যাস দেখেছিলাম ইমন যখন এখানে ছিল, তখুনি। তাই ওর জালালের গল্প দেখতে গিয়ে যখন দেখি শুরুর সেই গল্প একেবারে আগাগোড়া বদলে গেছে, একেবারেই অবাক হইনি, মনে হয়েছে, এটাই আসলে ইমন, ওর ট্রেডমার্ক।
সিনেমার শুরুটা দুর্দান্ত! একটা রান্নার হাঁড়িতে করে ভাসতে ভাসতে আমাদের জালাল এসে পড়ে গ্রামের মিরাজের ঘরে। সেখানে ঘটনাক্রমে সে হয়ে যায় শিশু-পীর। তার পা ধোয়ানো পানি খেয়ে রোগ সেরে যাচ্ছে দুরারোগ্য রোগীর, এইরকম এক গুজব রটে যায় গ্রামে গ্রামে, ভাগ্য ফিরে যায় মিরাজের। সেখান থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয় গ্রাম্য-রাজনীতি। সেই রাজনীতির চাপে পড়ে জালালকে আবার ভেসে যেতে হয় হাঁড়িতে করে।
শৈশবের এই অংশটুকুর নাম দি এরাইভাল। এভাবে এমনি করেই আরও দুটি পর্বে আমরা দেখি জালালের কৈশোর ও যুবক বয়সের গল্প।
পুরো গল্প এখানে বলে দিতে চাইছি না আসলে, তারচেয়ে বরং সিনেমার অন্য কিছু দিক নিয়ে কথা বলি।
পুরো সিনেমাটাই চমৎকার গতিময়। কোথাও এতটুকু থেমে যায়নি, প্রতি মুহুর্তেই অপেক্ষা করে ছিলাম পরমুহুর্তে কী হবে তা দেখার জন্যে। জালাল হিসেবে কিশোর ও তরুণ বয়েসী দুজনের অভিনয় খুবই ভাল ছিল। প্রয়োজনমত মজার কিছু সংলাপ দর্শকদের হাসিয়েছে নিয়মিতই। মিরাজের বউ যখন মিরাজকেই পানিপড়া খেতে বলে, সেই সংলাপ শুনতে শুনতে এটা যে ইমনেরই লেখা সংলাপ সেটা মিলিয়ে নিয়েছি মুহুর্তেই। অথবা যেখানে নিঃসন্তান তৌকির তার নবপরিণীতা স্ত্রীকে বলে, ‘কালো হয়ে যাবা তো’, বা সেই স্ত্রী যখন তার দেবরতুল্য তরুণটিকে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘তুমি খাইবা না?’ - পুরো সিনেমা হল জুড়েই দর্শকেরা হা হা শব্দ করে হেসে উঠেছিলো!
পরের দু’পর্বে গল্প বদলে যায় যদিও। কখনো কখনো বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে, কখনো হাসির নির্ভারতা, কখনো গল্পের গতিপথ হঠাত বদলের চমক!
মিউজিক খুবই ভাল লেগেছে পুরো ছবিতেই। চিরকুট খুব যত্ন নিয়ে করেছে মিউজিকের কাজ, বেশ বোঝা যায় সেটা। লোকেশান বাছাই অপূর্ব ছিল। বিশেষ করে নদী-পাড়ের কিছু দৃশ্য, সাথে মাছ ধরার জাল, এরকম অতুলনীয় কিছু ছবি এখনও মাথায় গেঁথে আছে।
তৌকির, মৌসুমি, শর্মীমালা, মিতালি দাশ এরা প্রত্যেকেই অসাধারণ অভিনয় করেছেন। মোশাররফ করিম যদি তার নিজস্ব অভিনয়ধারা থেকে বেরিয়ে এসে গল্পের সাথে আরেকটু মিশে যেতে পারতেন, তবে আরও ভালো হতো। মিরাজের শ্যালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যিনি, আমি সম্ভব হলে তাকেই পুরস্কৃত করতাম। এরকম দুলাভাই ভক্ত শ্যালক পাওয়া দুষ্কর। ছবিটি দেখতে দেখতেই মনে মনে ইমনকে বাহবা দিয়েছি এই চরিত্রটি নিয়ে আসার জন্যে। তেমনি করে বিভিন্ন রঙের হাঁস কিংবা ঘরভর্তি গাছপালা-র ডিটেইল পরিচালকের প্রতি মুগ্ধতা বাড়িয়েই দেয় কেবল।
একটা চমৎকার গল্পের সাফল্য নির্ভর করে তার সমাপ্তির ওপরে। শুধু এইটুকু বলি, এর শেষটার জন্যেই জালালের গল্প-কে মনে থাকবে অনেক অনেক দিন। ব্রাভো ইমন!
যতদূর শুনলাম, জালালের গল্প- ইতিমধ্যেই দিগ্বিজয়ী বীরের ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে। ভারতের সপ্তম জয়পুর চলচ্চিত্র উৎসবে এটি আবু শাহেদ ইমন-কে এনে দিয়েছে সেরা নবাগত নির্মাতার পুরস্কার। পর্তুগালের আভাঙ্কা উৎসবে এটি একেবারে সেরা ছবি-র পুরস্কারই জিতে নেয়। ওর ছবি নিয়ে ইমন ইতিমধ্যেই জার্মানির পথে রয়েছে শুনলাম, সেখানকার বিভিন্ন উৎসবে ছবিটির প্রদর্শনী হবে। এবং সবচেয়ে দুর্দান্ত খবর হল, এবারের অস্কারেও বাংলাদেশ থেকে অংশ নিতে যাচ্ছে এই ‘জালালের গল্প’ই, এর চেয়ে দারুণ খবর আর কীইবা হতে পারে!
চার বছর আগের লেখাটি শেষ করেছিলাম ইমনের জন্যে শুভকামনা দিয়ে, আজকে তার সাথে রইলো উঠে দাঁড়িয়ে ওর জন্যে একটা জোরসে করতালি! বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আবু শাহেদ ইমনদের হাত ধরে আরও পরিণত হয়ে উঠুক, বিশ্ব-চলচ্চিত্রে মাথা উঁচু করে থাকুক, এটাই প্রত্যাশা আমাদের।
তারেক নুরুল হাসান
মেলবোর্ন, ২০/১০/২০১৫
মন্তব্য
আগ্রহ বোধ করছি জালালের গল্প দেখার জন্য। রিভিউ ভালো লেগেছে।
রিভিউ বলার মত উপযোগী নয় লেখাটা, কিন্তু সিনেমাটা অবশ্যই দেখার মত।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
সিনেমাটি দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। ডিভিডি রিলিজ না হলে হয়তো দেখা হবে না।
বেড়ে ওঠার গল্পগুলো দারুণ লাগে। আপনার লেখাও দারুণ হয়েছে। জালালের গল্পের জন্য শুভ কামনা।
ধন্যবাদ
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
প্রচারণায় মোশাররফ করিমের উপর্যুপরি উপস্থিতি দেখে দেখতে আগ্রহ পাইনি। আজই জানলাম এতে আরও অভিনয়শিল্পীরা আছেন। এখন দেখতে আগ্রহ পাচ্ছি, সুযোগ পেলে দেখে ফেলব।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মোশাররফ করিম ছাড়া বাকি প্রত্যেকের অভিনয়ই সিনেমার সাথে সংগতিপূর্ণ হয়েছে।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দেখতে হবে তো।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
অবশ্যই!
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
কৌতূহল বোধ করছি। এটার ট্রেইলার আছে অনলাইনে কোথাও?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
শাহেদের জন্য হাততালি। গল্পটা দেখার ইচ্ছে তীব্রতর হলো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আপনাদের ওখানে শো হবে কি না জানি না এখনো
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
দেখার আগ্রহ জাগ্লো! দা দিয়ে কোপাকুপি আছে মনে হচ্ছে!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
তা আছে একটু
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
দেখব। এখানে হলে গিয়ে দেখার সুযোগ হবেনা, তাই অনলাইনে কবে আসে সেই অপেক্ষা করতে হবে।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
আপনি কি কানাডায়? শুনেছিলাম কিছু একটা যে ওখানে কোন একটা ফেস্টিভালে যাবে। আমি খবর পেলে জানাবো আপনাকে।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
মুভিটা দেখার ইচ্ছে আগে থেকেই ছিল। আপনার লেখা পড়ে আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল। ধন্যবাদ।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
ধন্যবাদ
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
নতুন মন্তব্য করুন