সমান্তরাল

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
লিখেছেন এস এম মাহবুব মুর্শেদ (তারিখ: মঙ্গল, ১৯/০৬/২০০৭ - ৭:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৷
মাঝে মাঝে এমন হয় যে, গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে চোখ দুটো না খুলেই যখন অন্ধকারের গায়ে কান পাতি, নিস্তব্ধ রাতের ভিতরের কোন একটা উত্স থেকে খুব মৃদু ভাবে তবলার বোলের মত শব্দ ভেসে আসতে থাকে৷ একটা বা দুটা আঙুল দিয়ে খুব আদুরে ভঙ্গিতে যদি বাজানো হয় - সেটা ঠিক তেরে কেটে ধিন হয় না, বদ্ধ ঘরের দরজার এপাশ থেকে ভেতরের গুম-গুম শব্দ শুনতে পেলে যেমন লাগে, অনেকটা সেরকম৷

প্রথম প্রথম হত্পিন্ডের শব্দ ভেবে ভুল করতাম; পরে বুঝেছি, ওটা আসলে রাতেরই নিজস্ব শব্দ৷ দেয়ালের গায়ে অবিচল বসে থাকা টিকটিকি যেমন শুধু রাত হলেই টিকটিক করে উঠে; অথবা দেয়াল ঘড়িটা, সারাদিন চুপচাপ অবিরাম ঘুরে যায়, শুধু রাত গভীর হলেই যেন সেটাও টিকটিকির সাথে গলা মেলায়, তেমনি করে শুধু রাত হলেই যেন অন্ধকারের শব্দ শুনতে পাই আমি৷

এখন যদিও বিকেল, আকাশে মেঘ তাই সন্ধ্যে বলে ভুল হয়৷ অবিরাম ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে- থামবার লক্ষণ নেই দেখে খানিকটা অপেক্ষা করার পর হাল্কা পায়ে দৌড়ে আমরা ক'জন প্রায় ধ্যানমগ্ন মানুষ এই গাছটার তলায় এসে আশ্রয় নিয়েছি৷ সামনে তাকালে কেবলই বৃষ্টি, চেয়ে থাকার কোন মানে হয় না, তবু আমরা সবাই সেদিকে তাকিয়ে থাকি৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় হঠাত্ করেই বৃষ্টির ফোঁটা গুলো খুব বড় মনে হয়৷ আমার এমনও মনে হতে থাকে, যেন অনেক ওপর থেকে আমি একটা বিশেষ কোন ফোঁটাকে চোখে চোখে রেখে নীচে নামতে দেখছি, খানিকপর সেটা মাটিতে পড়ে ছিটকে উঠছে যেন৷ আমি ঠিক এমন করেই অনেক- অনেকগুলো বৃষ্টির ফোঁটাকে অনুসরণ করতে থাকি, এব ংএমনটা করতে করতে যেন এর মাঝেও সেই নিস্তব্ধ রাতের তবলার বোলের শব্দের যে ছন্দ, আমি সেটা খুঁজে পাই৷

আমি আনমনে, বৃষ্টি বাঁচিয়ে ঠোঁটে একটা সিগারেট গুঁজে দেই, তারপর লাইটারটা বের করবার জন্যে পকেট হাতড়াই৷ ঠিক সেই সময় আমার বন্ধু দীপু হঠাত্ করে আমার কাঁধে হাত রাখে৷ কখন যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কোন ফাঁকে, আমি টেরই পাইনি৷ ওর মাথায় একটা লালটুকটুকে রুমাল বাঁধা৷ আমি একটু থমকে যাই৷ লাইটার হাতে নিয়ে বৃষ্টি বাঁচিয়ে আমি যেই মুহুর্তে আগুন ধরাই - ঠিক তখুনি গভীর পানির তলদেশ থেকে ক্রমশ বড় হতে হতে উপরে উঠতে থাকা বুদবুদের মত অনেক আগের একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে যায়৷

আমি আর দীপুই ছিলাম সেবারও৷ দুজনেরই বয়স তখন দশ, কিংবা এগারো হবে৷ ছাদের পাশের সিঁড়ির ঘরটায় গিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া আধ-খাওয়া একটা সিগারেটের টুকরাতে আগুন ধরিয়ে টানছিলাম আমরা৷ একেকবার টান দেবার সাথে সাথে ঐ সিগারেটের চেয়েও বেশি লাল হয়ে উঠছিল আমাদের মুখ৷ কাশির দমক আটকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘরটায় আমরা দুই কিশোর যখন অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে একের পর এক টান দিয়ে চলেছি সিগারেটে- আর ফিসফিস করে ঠিক করছি- বন্ধুদের কাছে কেমন করে এই বীরত্বের গল্প করা যায় - ঠিক সেই মূহুর্তে বাবা এসে দরজা খুলে দাঁড়ান৷

বাবাকে সেদিন শীতের কুয়াশা কেটে কেটে নদীর ওপার থেকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসা ডিঙি নৌকার মাঝির মত লাগছিল আমার কাছে - মনে আছে৷

দীপু একটুও দেরি করে নি৷ ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল ও৷ আর বাবা, চোখে অবাক দৃষ্টি নিয়ে আমার কাছে এসে হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে গিয়েছিলেন৷ তারপরে আচমকাই প্রচন্ড জোরে চড় মেরেছিলেন আমাকে৷ আমি ছিটকে পড়েছিলাম মেঝের ওপর৷ কোনো কথা না বলে তিনি নীচে নেমে গিয়েছিলেন সেদিন৷

আগে পরে অনেকবারই মার খেয়েছি, কিন্তু সেদিনের কথা মনে আছে বেশ৷ খুব ব্যথা পেয়েছিলাম এটা ঠিক, তবু সেদিন একটুও রাগ করিনি বাবার ওপর - কারণ, বাবা আমার এই কীর্তির কথাটা মাকে কখনো বলেন নি৷

২৷

আমার মা৷ প্রায় সারাটা জীবন দেখেছি তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন৷ কি একটা অসুখ ছিল মায়ের - তিনি খুব বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না৷ এমন নয় যে সারাদিন কাশতেন বা খুব জ্বরে ভুগতেন- সেরকম কিছু নয়৷ প্রায় সুস্থ মানুষের মতনই দেখাতো তাকে৷ পার্থক্য এই যে তিনি বিছানা শুয়ে থাকতেন সারাদিন৷

ভীষন ফর্সা ছিলো তার গায়ের রঙ- চোখ দুটো- মনে আছে- ছিল আশ্চর্য রকমের গভীর আর কালো৷ মা যখন মাঝে মাঝে কাছে ডাকতেন আমাকে, আমি বিছানার পাশটিতে চুপ করে বসে থাকতাম আর শুরু হত তার রাজ্যের সব গল্প৷ আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকতাম সেসব, আর মনে মনে ভেবে যেতাম আজগুবি সব ভাবনা৷

কখনো কিছু লুকোতে চাইলে মায়ের চোখের দিকে তাকাতাম না কখনো৷ অন্যদিকে চেয়ে থাকতাম৷ মা কেমন করে যেন বুঝে যেতেন, মায়েরা যেমন করে বুঝে যান৷ আমাকে বলতেন তার দিকে তাকাতে৷ আমি তাকিয়ে দেখতাম- পাথরের মত কালো দুটি চোখ, কিন্তু কি গভীর আর কি স্বচ্ছ তারা! খানিক তাকিয়েই মা বুঝে যেতেন কোথাও গোপন কোন কথা আছে আমার, সযত্নে লুকোনো৷ তারপর গলায় আদর নিয়ে তিনি কেমন করে যেন আমার কাছ থেকে সে খবর ঠিকই বের করে নিতেন৷

মায়ের বিছানার পাশে দেয়াল ঘেষে একটা মাকসার জাল ছিল, মাঝে মাঝে সেখানে কালো রঙের একটা মাকড়সা এসে বসতো৷ মা সেটাকে বলতেন তার বন্ধু৷ আমরা যখন থাকি না বাসায়, মা নাকি সেই মাকড়সার সাথে গল্প করেন৷ আমাদের কাজের বুয়া সেসব শুনেছে মাঝে মাঝে৷

মাকড়সার চোখ কোথায় থাকে জানি না, কিন্তু প্রায় প্রতিবারই মনে হত, মাকড়সাটা যেন আমার দিকেই কঠিন মুখ করে চেয়ে আছে৷ যেন বা আমার এখানে, এই ভাবে মায়ের কোল ঘেষে বসে থাকাটা তার পছন্দ হচ্ছে না৷ কখনো কখনো শিউরে উঠে আমি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে মনে মনে ভাবতাম, আচ্ছা, ও কি বাবার দিকেও একই চোখ করে তাকিয়ে থাকে?

৩৷

বাবা চিরকালই খুব নির্বিবাদী মানুষ ছিলেন৷ শহরের একমাত্র সরকারী কলেজে পড়ান৷ সারা দিনের পর বাসায় ফিরলে মাঝে মাঝে দুএকজন ছাত্র তার কাছে টিউশান নিতে আসে, তিনি তাদেরকে ঘন্টা দুই সময় দেন, তারপরে পেপার নিয়ে বসে পড়েন - একেবারে রাতের খাওয়ার আগে পর্যন্ত- যতক্ষন না মা তাঁকে তার ঘরে ডেকে পাঠান৷

বাবা ও মায়ের মধ্যে নাকি একসময় গভীর প্রেম ছিল - এ কথা আমার কেন যেন বিশ্বাস হতে চায় না৷ মা বিছানায় শোয়া থাকলেও ভীষন ছটফটে স্বভাবের মানুষ৷ প্রায় সারাক্ষণই কথা বলে যাচ্ছেন- অথবা কাজের বুয়াকে এটা ওটা বলে যাচ্ছেন৷ সেই তুলনায় বাবা একেবারেই মৃদুভাষী৷ কেমন করে যে তাদের মিল হলো!

বাবা মা প্রায়শই বসে বসে অনেক গল্প করেন৷ গল্প মানে- মা একাই বলে যেতে থাকেন, বাবা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন সেসব৷ মানুষের চোখ থেকেও যে কখনো ভালবাসা ঝরে পড়ে, এ ব্যাপারটা তখন বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিলাম৷ প্রায় প্রতিটি কথার মৃদু স্বরে জবাব দিতেন - কিন্তু গলার স্বরেও সেটা টের পাওয়া যেত৷

আমার পনের বছর বয়সে যেদিন মা মারা যান- বাবা সেদিন একদম স্থির হয়ে বসেছিলেন সারাদিন৷ বারান্দার এক কোনায় চেয়ার পেতে৷ আমাদের নিকট আত্মীয়স্বজনেরা এসে মায়ের দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন, বাবাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি৷

সারাদিন একঠায় বারান্দায় বসে থেকে- সন্ধ্যার পরে তিনি প্রথম কথা বলে ওঠেন৷ ক্লান্ত স্বরে আমাকে ডেকে বলেন, আজকের পেপারটা একটু দিয়ে যাবি আমাকে?

আমি সেদিন কোনো এক ফাঁকে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখি - মাকড়সাটি নেই আর ওখানে৷ তারপরে আর সেটাকে কখনো দেখিনি আমাদের বাসায়৷

৪৷

বৃষ্টি ঝরতে থাকে৷ একটু বাড়ে, আবার কখনও কমে যায়৷ ভিজে চলা দাঁড়কাকের মতন R্ষিসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে আমরা ক'জন প্রায় ধ্যানমগ্ন মানুষ এই গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে থাকি৷ দীপু আমার কাঁধে হাত দিয়ে থাকে, এইটুকু স্পর্শকেও যেন ভীষন প্রয়োজনীয় মনে হয় তার৷ সামনে তাকালে কেবলই অবিরাম বৃষ্টি, চেয়ে থাকার কোন মানে হয় না, তবু আমরা সবাই নিদারুন আলস্যে সেদিকেই তাকিয়ে থাকি৷ খানিকটা দূরে, প্রায় অস্বচ্ছ অবয়বের অজানা অচেনা কিছু লোক নির্বিকার মনোযোগে মাটি খুঁড়ে চলেছে৷ তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই, শুধু কান পাতলে ঝুপ ঝুপ করে একটা ভোঁতা আওয়াজ পাওয়া যায়৷ আমি সেই আওয়াজের প্রতি আরও বেশি মনোযোগি হই, অল্প প্রচেষ্টার পরেই সেটাও আমার কাছে সুরময় হয়ে ওঠে, আর তখন আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়৷

মা চলে যাবার পরে বুকের মধ্যে একটা শূন্যতার মত তৈরি হয়েছিলো৷ ঠিক সেই সময় মনে হয়েছিল সেটা আসলে কখনৈ পূরণীয় হবার নয়৷ কিন্তু তেমনটা হলো না আসলে৷ কলেজে থাকার সময়টা বা যতক্ষণ বন্ধুদের সাথে থাকা হয়, মাকে মনে পড়তো না৷ বাড়ি ফিরলেই শুধু একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগতো৷ আমাদের বাড়ির চেহারাও তেমন একটা বদলালো না৷ সেই পুরোনো বুয়াই বহাল রইলেন৷ শুধু বাচ্চা মতন একটা ছেলেকে এনে রাখা হলো ছোটখাট ফাই-ফরমাশ খাটার জন্যে৷

বাবার সাথে দেখা হওয়া কমে গিয়েছিল আরও৷ তিনি আরও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন৷ আরও বেশি পত্রিকা-প্রিয়৷ দেখতে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন৷ বাবার কয়েকজন বন্ধু এসে তাকে নিয়ে নানা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইতেন, বাবা তেমন একটা পাত্তা দেন নি সেসবে৷ দু'একজন মুখ ফুটে আবার বিয়ে করার কথাও বললেন, কিন্তু বাবার চোখের পলক পড়ছে বলে মনে হয়নি কখনও৷

বছর গড়িয়ে যায়৷
আমি তখন সদ্য যুবক৷ প্রিয়তির সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে ততদিনে৷ ক্লাশের ফাঁকে খানিকক্ষণ কথা বলা, অথবা কথা না বলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, সবই আমার কাছে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ৷ রিকশায় পাশাপাশি বসলে যখন আমাদের দুজনের গা ছুঁয়ে থাকে, আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে যাই৷ ততদিনে গাঁজা টানাও শিখে গেছি৷ কিন্তু গাঁজার ঘোরের চেয়েও আমার কাছে প্রিয়তির গা ছুঁয়ে থাকাটা আরো বেশি মধুময় মনে হয়৷

একদিন ক্লাশ শেষে - আমরা দুজন বসে আছি৷ প্রিয়তি কি একটা গল্পের বই পড়ছে আমার সাথে কথা না বলে ৷ আমি সেটা টুক করে কেড়ে নিতে চাইলাম, ও দিলো না, সেটাকে চেপে ধরলো একদম বুকের সাথে৷ আমি আবারও জোর করতে যেতেই কি যে হলো, আমার হাতের দুটো আঙুল হঠাত্ ওর বুক ছুঁয়ে গেল৷ দু'জনেই একটু চমকে উঠলাম- তারপর -কিছুই হয়নি - মত করে ও আবারও বই পড়া শুরু করলো৷ কিন্তু আমার মধ্যমা আর তর্জনীর চমক তখনো কাটেনি৷ আমি অবাক দৃষ্টিতে আমার আঙুলের দিকে তাকিয়ে রইলাম- কি আশ্চর্য একটা সুখানুভুতি সেখানে৷

সেদিন রিকশায় করে ফিরবার সময় কেউ কোন কথা বলিনি৷
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়েছি- আর খানিক পর পর হাত চোখের সামনে তুলে আঙুল দুটোকে দেখেছি৷ হঠাত্ খুব বেশি আপন মনে হচ্ছিল ঐ দুটোকে, এমনকি ভাত খাবার সময় যখন খাবার মুখে তুলছিলাম, বারবার মনে হচ্ছিল, এই দু'জন বেশি কষ্ট পাচ্ছে না তো!

রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না সেদিন৷ বিছানায় এপাশ ওপাশ শুধু একসম খুব তৃষ্ঞা পেলে উঠলাম পানি খেতে৷ রান্না ঘরে যাবার প্যাসেজটায় এসে দাঁড়াতেই হঠাত্ গোঙানির মত একটা শব্দ শুনলাম যেন৷ আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম কোত্থেকে আসছে সেটা৷

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বুঝতে বুঝতেই দেখি বাবা বের হয়ে আসছেন হন্তদন্ত হয়ে, এ পাশে আলো না থাকায় আমাকে দেখেন নি - ঘাম দেয়া শরীরে ছুটতে ছুটতে চলে গেলেন নিজের ঘরে৷ আমি খানিকটা এগিয়ে রান্না ঘরে উঁকি মেরে দেখলাম- আমাদের কাজের ছেলেটা উঠে বসে হাঁটুতে মুখ গুজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে৷ পাশেই পড়ে থাকা লুঙিটায় চোখ মুছছে শুধু একটু পর পর৷

এরকম করেই ঠিক একদিনে দুবার আমার পৃথিবী বদলে গেল৷

৫৷

নিউমার্কেটের সামনের বড়ো রাস্তাটা পার হবার জন্যে প্রিয়তি যখন নির্বিঘ্নে আমার হাত ধরে, আমার ইচ্ছে করে এই হাতটা, এই নিউমার্কেটটা, এই সময়, এই জায়গা, সবকিছুকে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখি!

কিন্তু বাড়ি ফিরলেই আবারও সেই বিচ্ছিরি বোধ৷ বাবাকে দেখলেই একটা বমি-মতন অনুভূতি দলা পাকিয়ে উঠতো গলার কাছটায়৷ কখনৈ আমাদের চোখে চোখ পড়তো না৷ আমি চাইতাম, হয়ত ঠিক যেমন করে মা তাকাতেন আমার দিকে, আমার গোপন কথা জানবার জন্যে, কিন্তু বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলতেন সবসময়৷ আমি তীব্র দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করতাম কখন তিনি আমার দিকে তাকাবেন- আর আমি আমার সবটুকু ঘৃণা ঢেলে দিব সেখানে৷

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে আমি চলে এলাম আমাদের শহর ছেড়ে৷ একই বিষয় নিয়ে পড়তে প্রিয়তিও চলে এল৷ আমরা দুজনেই হলে থাকতাম, একসাথে পড়তাম, ঘুরতাম, ফিল্ম সোসাইটি করতাম৷ মিছিল, মিটি, ংআন্দোলন আর ভালোবাসাবাসি- সব চলতে লাগলো একসাথে৷

ছুটিছাটায়ও বাড়ি যেতে চাইতাম না আর৷ অনেক দিন বাদে বাদে বাবার সাথে হঠাত্ হঠাত্ ফোনে কথা হতো৷

একবার তিনি ভীষন অসুস্থ হয়ে গেলেন৷ হার্টের অসুখ৷ বাইপাস করাতে হলো৷ হাসপাতাল- ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি, সবই একা প্রিয়তি করলো, আমি কেবলই তাকে সঙ্গ দিলাম৷
অপারেশনের পরদিন আমি বাবার বিছানার পাশে বসা৷ প্রিয়তি বাইরে গেছে কিছু একটা কাজে৷ বাবা ঘুমাচ্ছিলেন৷ হঠাত্ করে তিনি চোখ মেলে তাকালেন৷ এব ংঅনেক অনেকদিন পরে আমাদের চোখাচোখি হলো৷

বাবার চোখ দেখে আমি চমকে উঠলাম৷ কি গভীর ক্লান্তি, লজ্জা আর আকুতি সেখানে! কিছু না বলে তিনি আমার হাত ধরতে চাইলেন, আমি চট করে উঠে দাঁড়ালাম৷ অনেকদিনের পুষে রাখা ঘৃণাটুকু ঢালতে গিয়ে দেখি- সেটুকু গ্রহন করবার ক্ষমতা আর তার নেই৷ অঝোরে পানি পড়ছে তাঁর চোখ থেকে৷

ঘৃণা করতে না পারার অক্ষমতায় আমি সেখান থেকে ছুটে বের হয়ে এলাম৷

৬৷

আবারও বছর গড়ায়৷ গড়িয়েই চলে৷
প্রিয়তি আর আমার ছোট্ট সংসার৷ প্রিয়তি এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ায়৷ আর আমি পুরোপুরি সিনেমাওয়ালা৷ হলে চলে না- দর্শকে দেখে না- এমন সব ছবি বানাই৷ বছর বছর নিয়মিতভাবে পুরস্কার এনে দেয় সেসব সিনেমাগুলো, আর আমি সেই আনন্দে প্রতিদিন প্রিয়তিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকি৷

এমনি করেই চলছিল আমাদের৷ গতকাল পর্যন্ত৷
কাল রাতেই হঠাত্ ফোন এলো বাড়ি থেকে৷ জরুরী তলব৷ আর আমরা আজ সকালে এসে পৌঁছাই আমাদের ছোট্ট শহরে- এক ঝাঁক কালো মেঘ মাথায় নিয়ে৷

*

সিগারেটটা শেষমেষ ধরাতে পারি৷ ওটার মাঝামাঝি আসতে আসতে বৃষ্টির মধ্যে খুঁজে পাই সেই তবলার বোলের ছন্দ৷ শেষ হবার আগেই দীপু আমার কাঁধ ধরে ইশারা করে৷ বৃষ্টি থেমে গেছে, আমরা কয়েকজন নিশি পাওয়া মানুষের মতন হেঁটে এসে দাঁড়াই সেখানে৷

কবরে লাশ নামানো হয়৷ বাবাকে মাটি চাপা দেয় সবাই মিলে৷ দেখি চেনা অচেনা সব লোকজন গভীর মনোযোগে বাবার কবরে মাটি ফেলতে থাকে৷ আমি এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকি৷ হঠাত্ বড় চাচা বলে ওঠেন, বাবা রে, মাটি ফেলবি না একটু?

আমি মাথা নাড়ি৷ হাতের সিগারেটটা শেষ প্রায়৷ কোথায় ফেলবো বুঝে পাই না৷ তারপর কি ভেবে ফেলে দেই সেটা কবরের ভেতর৷ এরপর নিচু হয়ে এক গাদা মাটি মুঠো করে ছড়িয়ে দিতে থাকি সেটার উপরে৷

বৃষ্টি গুমোট বেঁধে থাকে আকাশে, মেঘ ডেকে ওঠে৷ আমার হাত থেকে মুঠো মুঠো মাটি বৃষ্টির মত ঝরে পড়তে থাকে, সেখানে - একটা সিগারেটের সাথে আমার বাবা ক্রমশ চাপা পড়তে থাকেন৷


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

কনফু, মিয়া ধন্যবাদ গল্পটা জুড়ে দেবার জন্য। হাসি

টাইটেলের ড্যাশ কি অবিচ্ছেদ্য? নেভিগেশনে কেমন কেমন লাগছে।

====
মানুষ চেনা দায়!

কনফুসিয়াস এর ছবি

ওহ, আমি আবার জায়গা বেজায়গায় ড্যাশ দিই খালি!
মুছে দিবো?

-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

একেবারেই তোমার ইচ্ছে। টেইক ইট ইজি।

====
মানুষ চেনা দায়!

কনফুসিয়াস এর ছবি

দিলাম মুইছা!
-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

মাঝের কমেন্টগুলো কোথায় গেলো?

s-s এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।