বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সমাজের লোকমুখে প্রচলিত শ্লেষাত্মক বা হাস্যরসাত্মক উপমা বা তুলনাগুলোকে পৌরেই বলা হয়। পৌরেইগুলোকে বাংলা প্রবাদ প্রবচন বা বাগধারার সাথে মেলানোর একটা চেষ্টা করা যায়, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণত মিলবে না। পৌরেই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে আগেকার কাহিনী। মানে ইতিহাস। প্রতিটি পৌরেই এর পেছনে কালিক ও স্থানিক নানান প্রেক্ষিত যুক্ত আছে। সম্পর্কিত আছে এক একটি ইতিহাস। পৌরেইগুলোকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জাতির লোকইতিহাস বলা চলে। ইতিহাসের কোন এক সময়ে ঘটে যাওয়া বিশেষ কোন ঘটনা কালক্রমে পৌরেই হিসাবে রূপ নিয়েছে। যেমন "স্বরূপার কীর্তন" - পৌরেইটি সেই ঘটনার কথা স্মরন করিয়ে দেয়, যখন স্বরূপা নামের এক ব্যক্তি কীর্তন (বৃহাদাকারের ধর্মীয় উৎসব) আয়োজন করেছে বলে সবাইকে নিমন্ত্রন করে শেষে দেখা যায় কোন আয়োজনই নেই। এখনও এরকম সমান্তরাল কোন ঘটনাকে "স্বরূপার কীর্তন" বলা হয়।
পৌরেইগুলোকে পরম্পরায় পাওয়া সমাজের অভিজ্ঞতা বলা যায়। এগুলো সাধারন ভাষায় বলা সাধারন মানুষের কথা নয়, অসাধারন মানুষগুলোর অসাধারন কথাগুলোকে সাধারন করে সহজ করে বলা হয়েছে। রচয়িতারা একেকজন বড় মাপের শিল্পকার। দীর্ঘ একটি গল্প বা বক্তৃতা দিয়ে যা বুঝানো সম্ভব নয় একলাইনের একটি পৌরেই তাকে পৌঁছে দেয় মগজে ও মননে। "দরায় লাম লইলা, চাকালায় বনে হমেইলা" ( ঢোরা সাপ রাজত্ব কিনলো, গোখরা বনবাসী হলো) - এই পৌরেইটি মণিপুরীদের আদিভুমি মণিপুরের আদিইতিহাসের একটি গুরুত্তপুর্ণ অধ্যায়ের কথা স্মরন করিয়ে দেয়, যখন খুমল রাজ্য ও রাজবংশ বেদখল হয়ে যায় নিংথৌজা রাজ্যের নিকট, যারা বরাবরই যুদ্ধে পরাজিত হত। পৌরেইগুলোতে ব্যপক সমাজচেতনার নিদর্শন পাওয়া যায়। যেমন " মি থাইতে মিয়াঙগই কিয়া বকসা বয়া হিমপেইতইতা" - এখানে নিজের হীনমন্যতাকে বিদ্রুপ করা হয়েছে, উদ্দেশ্য আঘাত দিয়ে সমাজকে সচেতন করা। এভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৌরেইগুলো দর্পনের মতো সমাজের নানান কাহিনী, ঘটনা, দর্শন, অভিজ্ঞতা, চেতনা ও রুচিবোধকে প্রতিফলিত করেছে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাটি কতখানি প্রাচীন, কতখানি ব্যবহারিক ছিল তার পরিচয় আমরা পাই পৌরেই থেকে।
বহুমাত্রিক লেখক ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ ও কথাসাহিত্যিক বিমল সিংহ যৌথভাবে মণিপুরী জনপদগুলো চষে এসব পৌরেই সংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজটি হাতে নিয়েছিলেন। তাদের সংগ্রহ করা প্রায় দুই সহস্রাধিক পৌরেই থেকে নির্বাচিত কয়েকটি এখানে মুল ভাষায় পেশ করা হলো। সাথে বাংলা অনুবাদ এবং সমার্থক বাংলা প্রবাদ অথবা অর্থ। আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে।
ইমফামে দুকগাস উঠানি
অনুবাদঃ ভিটায় দুর্ব্বাঘাস গজানো
সমার্থকঃ ভিটায় ঘু ঘু চড়া
কৃষ্ণরে পেইলেউ লেইসি খানা
অনুবাদঃ সামনে পেলে শ্রীকৃষ্ণকেও ফর্মাস খাটানো
অর্থঃ চরম ধান্দাবাজি
এগদে আনলে হৌগতে নেই
অনুবাদঃ এদিকে আনতে ওদিকে খালি
সমার্থকঃ নুন আনতে পান্তা ফুরোয়
বলর বাকপর লাইমংসিং ঠেলানি
অনুবাদঃ বলর বাপের রবিবার দেখানো
অর্থঃ টাকা কর্জ নিয়ে দেবার সময় গড়িমসি করা
অঙার বার নঙারাং সেচানি
অনুবাদঃ অঙার দোষ নঙার উপর চাপানো
সমার্থকঃ উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে
হরপগো দেখলেউ বিনি বুলানি
অনুবাদঃ সাপ দেখলেও দুলাভাই ডাকা
অর্থঃ অর্থলোভে অপাত্রে বিয়ে দেয়া
ইনচেল হানলো পানি থেৎকরানি
অনুবাদঃ জাল দিয়ে পানি আটকানো
অর্থঃ ভ্রান্ত নীতি গ্রহন করা
কাকাড়া ধরতেগা হরপ দরানি
অনুবাদঃ কাকড়া ধরতে গিয়ে সাপের গর্তে হাত
সমার্থকঃ কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুনো
ধবারে ফুতিসুপানি বাগাদেনা
অনুবাদঃ ধোপাকে কাপড় কাঁচা শেখানো
সমার্থকঃ মার কাছে মামাবাড়ীর গল্প
বরনর ফুটার হাদিয়েদে দাপদানি
অনুবাদঃ বৃস্টির ফোঁটার মাঝখান দিয়ে পলায়ন
অর্থঃ চরম চালাকি
গরগো লেপ নেই দুয়ারর কৌলি
অনুবাদঃ ঘর ঠিক নেই, দরজা নিয়ে যুদ্ধ
অর্থঃ অকারণ আস্ফালন
কুকুরগই দলেইহাত চরলেউ গুচারি দেহিয়া ফালদের
অনুবাদঃ কুকুরকে পালকিতে উঠালেও মল দেখলে নামতে চায়
সমার্থকঃ কয়লা ধুইলেও ময়লা যায় না।
ডুফাই রাজা ডুফাই মন্ত্রী
অনুবাদঃ ডুফা (কল্পিত চরিত্র)র রাজা মন্ত্রী উভয় পদ গ্রহন
অর্থঃ এক ব্যক্তির সর্বময় ক্ষমতা
.
সহায়তাঃ
পৌরেই। ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ ও বিমল সিংহ সম্পাদিত। আগরতলা, ১৯৮৬
প্রবন্ধ-মালা (৩য় খন্ড)। ড. কালীপ্রসাদ সিংহ। শিলচর, ১৮৮৪
মন্তব্য
চমৎকার কিছু পৌরেই শিখলাম।
উইকিপিডিয়ায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় নিবন্ধ দেখেছি। ঠার বলতে ভাষা বোঝায়, কিন্তু ওখানে 'ইমার ঠার' শব্দগুচ্ছের অর্থ বুঝতে পারি নি। পৌরেই পড়ে ভাল লাগল, এবং উইকিতে এই ভাষায় কাজ দেখে মনে হচ্ছে এই ভাষাটি বেশ সমৃদ্ধ। আমাদের প্রতিবেশিদের একটা ভাষা হলেও আমরা খুব কমই জানি এর সম্বন্ধে। মণিপুরী বুঝলাম, বিষ্ণুপ্রিয়া নামটির কি কোন বিশেষ অর্থ আছে?
উইকি থেকে শিখেছি যুক্তরাষ্ট্র মানে 'তিলপারাষ্ট্র'। এটা দিয়ে কি খিলগাঁও তিলপাপাড়ার অর্থ করা যায়, যার অর্থ দাঁড়াবে - অনেকগুলো পাড়া নিয়ে একটা পাড়া। আমার আগ্রহের আরও একটা কারণ এই ভাষায় বাঙলা বর্ণমালা ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই পড়তে পারছি কিন্তু সব বোঝা যাচ্ছে না।
___________________________________________
সহজ করে বলতে মোরে কহ যে, সহজ কথা যায়না বলা সহজে।
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
এ ভাষায় যারা কথা বলে তাদের কাছে ভাষাটি ‘ইমার ঠার’ নামে পরিচিত যার অর্থ হলো ‘আমার মায়ের ভাষা’। ভাষাটি উত্তরপূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যে সৃস্ট এবং সেখানে প্রধানত বিষ্ণুপুর অঞ্চলে এই ভাষা প্রচলিত ছিল যেকারণে ভাষাটি বিষ্ণুপুরিয়া>বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বলে পরিচিত হয়েছে। আর্য-ভারতীয় ভাষাশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে এর বাক্যরীতির সাথে বাংলা, অসমীয়া, হিন্দী ও উড়িয়া ভাষার মিল পাওয়া যাবে। কিন্তুএর ব্যাকরন বিশেষ করে ধ্বনিতত্ত ও শব্দকোষ মণিপুরের অন্যতম প্রধান ভাষা মণিপুরী মৈতৈ দ্বারা প্রভাবিত। উচ্চারন/শব্দরূপ সুবিধার কথা বিবেচনা করে বর্তমানে ইস্টার্ন নাগরি লিপি যেখানে বাংলা হরফ রয়েছে তার একটি সংস্করণ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা লেখার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই লিপিটি অসমীয়া এবং মণিপুরী মৈতৈ ভাষায়ও ব্যবহৃত হয়।
আগ্রহ থাকলে এই লিংকগুলো দেখতে পারেন -
বাংলাদেশে মণিপুরীদের অভিবাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মাতৃভাষার মাসে শিখুন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী (প্রথম পাঠ)
পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
___________________________________________
প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি
ধন্যবাদ। তথ্যগুলো জেনে ভাল লাগল।
আগ্রহ আছে আমার।
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
পৌরেই ভাল লাগল।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
ভাল লাগলো।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
বেশ ভালো লাগলো।
চালিয়ে যান কুঙ্গ থাঙ।
০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
বেশ ব্যতাক্রমধর্মী লেখাগুলো আপনার। সচলায়তনকে সমৃদ্ধ করছে।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
দারুণ..!
নিয়মিত লিখে যান ভাই ! চমৎকার ব্যতিক্রমী উদ্যোগী আপনাকে সচলে নিয়মিত চাই..।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন