বাঙালি সংস্কৃতির দুই দিগন্তের দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ আর লালন একটা বিষয় নিশ্চয় অন্য সবার থেকে বেশি করে উপলব্ধি করেছিলেন। তা হলো- নিজেদের অবর্তমানে নিজেদের সৃষ্টি কতটা অসহায় হয়ে পড়তে পারে বারোজনের হাতে পড়ে। এজন্য রবীন্দ্রনাথ এমন ব্যবস্থা করে গেলেন যাতে তার বাক্যের দাঁড়ি- কমা পর্যন্ত ঠিক করে দেয়ার একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে থাকল তার পক্ষে তার সৃষ্টিকে সুরক্ষার জন্য। আর লালন এমন এক শ্রেণী তৈরি করে গেলেন যারা শত শত বছর শুধু তারই গান গাইবে। বিশ্বভারতীবিহীন রবীন্দ্রনাথ আর ছেউড়িয়ার ভক্তবিহীন লালনকে কল্পনা করলেই অনুমান করা যায় তারা নিজেরাই যদি নিজেদের সৃষ্টির ভবিষ্যত সুরক্ষা করে না যেতেন তা হলে কী অবস্থা দাঁড়াত তাদের। কিন্তু বেশিরভাগ শিল্পীর জীবনে সম্ভবত সবচেয়ে বড়ো ট্রাজেডিটাই হলো নিজের সৃষ্টিকর্মের ভবিষ্যত বারোবাজারিদের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নেয়া। অথবা নিজের শিল্পকর্মের ভবিষ্যত বিষয়ে কিছুই চিন্তা না করা। গিয়াস উদ্দিন আহমদ সেই দলেরই একজন গীতি কবি। একজন গীতিকার। গান লিখেছেন হাজার তিনেকের বেশি। গত চার দশক জুড়ে তার গান সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা থেকে শুরু করে হাল আমলের আনুশা পর্যন্ত অসংখ্য শিল্পী গেয়েছেন তার গান। কেউ কেউ স্বীকার করেছেন তার নাম। কেউ স্বীকার করেননি। আর কেউ চালিয়ে দিয়েছেন নিজের নামে কিংবা সংগ্রহ বলে। গীতিকার গিয়াস উদ্দিনের পক্ষে তার খোঁজ রাখা হয়ে ওঠেনি কিংবা অন্য কেউও গরজ দেখায়নি এই ব্যাপারে।
তার জন্ম এবং বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকে। তার সবগুলো গানই ধারণ করে সিলেট অঞ্চলের গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে। সিলেট অঞ্চলের গানগুলোতে কাজ করে প্রধানত পাঁচটি প্রভাব। শ্রী চৈতন্যের সন্ন্যাসী, শাহজালালের মারফতি সুফি, মাজারকেন্দ্রিক মজুফি মতবাদ, পাহাড়ের অন্তর্মুখিতা এবং হাওরের আর্দ্রতা। এই অঞ্চলের গানগুলো খেয়াল করলে অদ্ভুতভাবে একটা বিষয় লক্ষ করা যায় তা হলো কীর্তনি ঢংয়ে মারফতি গান কিংবা মারফতি ঢংয়ে কীর্তন। আর সব বিষয়েই ঘুরে ফিরে পাশাপাশি দুটো ভৌগোলিক প্রভাব থেকেই যায়। সিলেট অঞ্চলের সবগুলো গানই হয় আত্মকেন্দ্রিকতা বিষয়ে, এক ধরনের মগ্নতার মধ্য দিয়ে। আর সিলেটের কোনো গানের বাণি কিংবা সুরে রুক্ষতার কোনো চিহ্নও থাকে না কোথাও। বিষণœতা এবং নিঃসঙ্গতা সিলেট অঞ্চলের গানের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। হয়তো শাহজালালের সন্ন্যাসবাদী সুফি ধারা এবং শ্রী চৈতন্যের সন্ন্যাসের প্রভাবই এর কারণ। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার, তা হলো সিলেট অঞ্চলে শ্রী চৈতন্যকে নিয়ে যত গান তার সবগুলোর বিষয়ই শ্রী চৈতন্যের সন্ন্যাসী যাত্রা বিষয়ক। শ্রী চৈতন্যের গৌরাঙ্গ লীলা নিয়ে কোনো গান নেই সিলেট অঞ্চলে। এর একটা প্রধান কারণ হতে পারে শ্রী চৈতন্য সন্ন্যাসী যাত্রা করেছিলেন সিলেট থেকে। এবং সিলেট অঞ্চলের মানুষ নিজেদেরকে মনে করেন চৈতন্যের মাতৃপক্ষের মানুষ। তাই তাদের সবগুলো গানেই ঘুরে ফিরে আসে সন্তানের সন্ন্যাসী যাত্রায় দুঃখী মায়ের বিলাপ ‘ও নিমাই যাইও না যাইও না নিমাই রে’। সিলেটের গানে শ্রী চৈতন্য শুধু এক তরুণ নিমাই সন্ন্যাসী। যে ছেড়ে যাচ্ছে তার মাকে।
গিয়াস উদ্দিন আহমদ সাম্প্রতিক সময়ের লোক। কিন্তু তার গান বহন করে চলেছে তার অঞ্চল আর পূর্বসূরিদের যোগ্য উত্তরাধিকার। তিনি লিখেছেন মুর্শিদি, মারফতি, সরি, মর্সিয়া, কীর্তন, বিয়ের গান, মজুফি গান (পীর আউলিয়া কেন্দ্রিক গান)। অবশ্যই তার সবগুলো গানই লোকগান ঘরানার। সব লোকগানের মতোই তার গানগুলোর মধ্যেও রয়েছে সহজ বাক্য বিন্যাস আর সাম্প্রতিকতার ছোঁয়া। কিন্তু জন্মগত কিংবা বৈশিষ্ট্যগত কারণে লোকগানের একটা সমস্যা রয়েছে। তা হলো লোকগান মুখ থেকে মুখে বদলে যায়। পাল্টে যায় কথা। পাল্টে যায় সুর। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে এর কারণ লোকগানের কোনো ঘরানা নেই। লোকগানের আছে ‘বাহিরানা’। এটা সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকে বলেই মানুষ নিজের মুখের সাথে মিলিয়ে নেয় বাণী। নিজের কণ্ঠের সাথে মিলিয়ে নেয় সুর। হয়তো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করলে কথাটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু যখন বাণীর শুদ্ধতার প্রশ্ন আসে তখন মানতে একটু অসুবিধা হয়। কারণ লোক ঘরানার গানগুলো প্রধানত লেখা হয় আঞ্চলিক শব্দে। গানগুলোতে এমন কিছু শব্দ থাকে যার অর্থ অন্য অঞ্চলে বোধগম্য নয় কিংবা অন্য অর্থ প্রকাশ করে। আবার এর শব্দ উচ্চারণ পদ্ধতির কারণেও বদলে যায় বাণীর অর্থ। একই কারণে কুষ্টিয়া অঞ্চলের যে কোনো মানুষই অন্য কারো মুখে লালনের গান শুনলে ক্ষেপে উঠেন ভুল উচ্চারণের জন্য। আবার সিলেট অঞ্চলের মানুষ হাসন রাজা কিংবা শাহ আব্দুল করিমের গান যখন সিলেটের বাইরের কোনো শিল্পীর মুখে শোনেন তখন উসখুস করেন। আপত্তি করেন। এর কারণ অনেক শিল্পীর দায়িত্ব হীনতা। শব্দ না বুঝেই গান করা। ঠিক এই পরিস্থিতির শিকার গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমদও। তার একটি গান ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ এই গানটি বর্তমান সময়ের শিল্পী আনুশাহ গেয়েছেন। কিন্তু তিনি ‘দায়’ শব্দটি এমনভাবে উচ্চারণ করেছেন যাতে তার অর্থ বদলে যায়। সিলেটে ‘দায়’ শব্দটি ‘জন্য’ অর্থে ব্যবহৃত হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আবার মান বাংলার মতো দায়িত্ব অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যখন শব্দটি ‘জন্য’ অর্থে ব্যবহৃত হয় তখন তা ঠিক আগের শব্দের সাথে জড়িত হয়ে উচ্চারিত হয়। যেমন ‘আমার দায়’ (আমার জন্য) এর উচ্চারণটা হয় ‘আমার্দায়’ আর ‘আমার দায়িত্ব’ অর্থে যখন ব্যবহৃত হয় তখন মান বাংলার মতোই তা উচ্চারিত হয় আগের শব্দ থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে ‘আমার দায়’। এবং উচ্চারণে একটা ‘দীর্ঘ আ’ ব্যবহৃত হয়। আনুশা যেভাবে গেয়েছেন তাতে ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ কথাটির অর্থ ‘মরিলে আমার জন্য কাঁদিস না’ বোঝায়নি। অন্য কিছু হয়ে গেছে।
এ পর্যন্ত গিয়াস উদ্দিন আহমদের মোট দুটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’- ১৯৯৬ এবং ‘শেষ বিয়ার সানাই’-২০০৫। দুটি বইয়ে রয়েছে তার বিভিন্ন ধরনের প্রায় হাজারখানেক জনপ্রিয় গান। এর মধ্যে তার দ্বিতীয় বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করেও এর প্রকাশন দেখে যেতে পারেননি গিয়াসউদ্দিন আহমদ। তার আগেই তাকে চলে যেতে হয়েছে পৃথিবী ছেড়ে। (এই ১৬ এপ্রিল ২০০৫)
একজন কবিকে যেমন টিকিয়ে রাখেন তার পাঠকরা। গীতিকারকে ঠিক সেইভাবে শ্রোতারা টিকিয়ে রাখতে পারেন না। গীতিকার আর শ্রোতার মাঝখানে থেকে যান শিল্পীরা। আর শ্রোতারা একজন গীতিকারকে পান শিল্পীর মাধ্যমেই। কিন্তু সেই শিল্পীরা যদি যতœবান না হন তাহলে শ্রোতাদের কাছে গীতিকার গিয়ে পৌঁছান খণ্ডিত কিংবা বিকৃতভাবে। শুধু গিয়াসউদ্দিন আহমদ কেন। তার গানের অন্যতম যে প্রধান অনুপ্রেরণা কবি জসিমউদ্দিন। সেই জসিমউদ্দিনের বহু গানও এখন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। গিয়াস উদ্দিন আহমদের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে একটাই প্রত্যাশা- লোকগানের ‘বাহিরানা’র কথা মেনে নিলেও বিকৃতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। যারা সংগীত চর্চা করেন এই বিষয়টা তারাই দেখতে পারেন সবচেয়ে ভালভাবে। আর আমরা সংগীতের বাইরের মানুষ। শ্রোতা। আমরা শুধু অনুরোধ করতে পারি- প্লিজ কারো সৃষ্টিকর্ম নিজে ব্যবহার করার সময় অন্তত তার প্রতি সামান্য একটু সম্মান দেখানোর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করুন। প্লিজ
মন্তব্য
আমাদের রাজধানীকেন্দ্রিক মিডিয়া এবং মানুষেরা মফস্বলের মানুষকে ভাবে হরিজন সম্প্রদায়
মনে করে তাদের নাম নিলেই তারা ধন্য হন। তাদেরকে আবার বাড়তি যত্ন দেবার দরকার কী?
মাত্র দুইদিন আগে এবছর একুশে পদক পাওয়া কবি দিলওয়ারের নাম এবং ঠিকানা বিকৃতির সাথে সাথে রাজধানীকেন্দ্রিক দেশের মিডিয়াগুলো তাকে মৃত হিসেবে প্রচার করে
এর একটাই কারণ- কবি দিলওয়ার মফস্বলের মানুষ
গিয়াস উদ্দিন আহমদও একজন মফস্বলের মানুষ
লেখাটি গত বছরের। কোথাও দেয়া হয়নি। হঠাৎ করে মনে পড়লো লেখাটির কথা
ধন্যবাদ।
এই লেখাটা আমাদের দিতে পারতেন। তার জন্মদিনে করা স্মরনীকায় দিতে পারতাম।
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এটা অনেক বড়ো করে লেখার প্লান করেছিলাম
অর্ধেকে এসে আটকে আছে তাই দেইনি কোথাও
এই লেখাটার সাথে তার গানের একটা রিভিউ যুক্ত করব
তার পরে ছাপতে দেবো কোথাও
গীতিকারেরা এভাবেই হারিয়ে যান কালের স্রোতে। স্মরনিকাটা কি আছে আপনাদের কাছে?
পড়লাম।
ধন্যবাদ, লীলেন ভাই।
ধন্যবাদ সময়োপযোগী লেখার জন্য।
দায়িত্বশীল ,গুণী শিল্পীদের কাছে আমাদের সব সময় প্রত্যাশা থাকে তারা গীতিকার, সুরকারের নাম ,শব্দের উচ্চারণ সঠিকভাবে জেনে গান গাইবেন। প্রচার করবেন। অনেকে করেন ও। তবে আজকাল তো অনেককিছুর মতো সঙ্গীত ও কিছু সংখ্যক দায়িত্বহীনের দখলে চলে যাওয়ায় যার যেমন খুশী গায়।ফলে গিয়াস উদ্দীন আহমদ,বাউল আব্দুল করিম সহ অনেক গুণী গীতিকার, সুরকারের সঠিক মূল্যায়ন হয়না। আর মফস্বলের মানুষরা এজন্য বেশী অবহেলার শিকার হন।
ভাল লাগল।
আনুশেকে ধন্যবাদ অন্তত গিয়াস উদ্দিনের একটা গানকে নবীন প্রজন্মের কাছে পৌছানোর জন্য। শিশুরা ভুল করেই, কবি নিশ্চই আনুশের ভুল নিজ গুনে ক্ষমা করতেন।
আপনা কে ধন্যবাদ কবির পক্ষ নেয়ার জন্য।
এতো কথা! কিছুই তো জানতাম না!
লীলেন ভাই, ধন্যবাদ।
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
ভালো লাগল ... আসলেই শ্রেনীবিভেদটা চোখে পড়ার মতো ,,,
একটা প্রশ্ন, লালন কি নিজেই ইন্সটিটিউশন (বাউল শ্রেনী বোঝাচ্ছি) গড়ে দিয়ে গেছেন, না স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে?,,, লালনের সময়ে গড়ে উঠলেও তাতে লালনের এই "টিকে থাকার প্ল্যান"টা আসলেই কি ছিল?
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেনি
লালন নিজেই গড়ে গেছেন
এটা আসোলে আমাদের ট্রাডিশনাল ভারতীয় গুরুকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান
যা একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে এবং তাকেই প্রচার ও সংরক্ষণ করে
গিয়াস ভাই ছিলেন আমার খুব কাছের মানুষ।
সিলেট শিল্পকলা একাডেমীতে যখন আরেক গীতিকবি সৈয়দ
মুফাজ্জিল আলীর সাথে আমরা আড্ডা দিতাম , তখন স্বপ্না গাজী-জেসমীন গাজীরা মাতিয়ে রাখতো আসর।
'' সিলেট পরথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়াছে '' এটা তাঁরই বিখ্যাত
গান।
খুব সাদাসিদে , মাটির মানুষ ছিলেন আমাদের গিয়াস ভাই।
তাঁর গান গুলো জাতীয়ভাবে সংরক্ষিত হওয়া দরকার, নিখুঁতভাবে।
ধন্যবাদ লীলেন পোষ্টের জন্য।
আমি বড়ো আকারে একটা লেখা তৈরি করতে যাচ্ছি তার উপর
এই বিষয়ে আপনার সাহায্য লাগবে আমার
এ গান কেউ শু্নাতে পারবেন?
...........................
Every Picture Tells a Story
রবি বুড়োও এখন দেউলিয়া হয়ে গেছে মনে লয়!
যাই হোক গীতি কবি গিয়াস উদ্দিন আহমদ সম্পর্কে খুব বেশী ধারণা আমার নাই। কস্মিনকালে বোধ হয় কোন খোমাখাতা বন্ধু মারফৎ কিছু জেনেছিলাম। আজ আপনার আলোচনা থেকে উনার সম্বন্ধে একটা ভালো ধারণা হল। অবশ্যই শোনা ইচ্ছে রাখি উনার গানগুলি এবং জানার ইচ্ছে রাখি উনার সম্পর্কে, বিস্তারিত ভাবে।
ডাকঘর | ছবিঘর
নতুন মন্তব্য করুন