তৃণতুচ্ছ উনকল্প

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: শনি, ১৪/০৩/২০০৯ - ৭:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তৃণতুচ্ছ উনকল্প

বর্ণমালা শেখার ফাঁকে তখন রূপকথা শোনার কাল। হাঁড়ির ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে হুংকার দেয় দাড়িয়ল ছাগল- সিংহের ভাগিনা আমি নমহরি দাস- আঠারো আঠারো বাঘে করি একেক গরাস...

সেই আওয়াজ শুনে পণ্ডিত শিয়াল দে দৌড় দে দৌড় দে দৌড়... মাঠ ঘাট প্রান্তর পেরিয়ে নিজের গর্তে কিংবা গুহায়। আর ওইখানে আড়াল থেকে বের হয়ে ছাগলের সে কী হাসি... ইঁহিঁহিঁ... ডঁরাইছে। ডঁরাইছে ডঁরাইছে...

এক পাতা হাতের লেখা শেষ করতে পারলেই আরেকটা গল্প শোনা যাবে মায়ের কাছে। হয় হাউ মাউ কাউ; ...রাক্ষসের গল্প। না হয়- ফুড়েদি আটইন ফুক্কা রাণী; ...কোনো এক দুষ্টু রাণীর গল্প

সেইসব গল্পে পশু পাখি মানুষ জীন ভূত পরি সব একাকার হয়ে যায়। আর গল্প শেষে তেড়িবেড়ি লোকগুলোর বেকায়দা অবস্থা দেখে আমরা হেসে উঠি খিলখিল করে। সবগুলো গল্পই এমন জায়গায় শেষ হয় যখন আর তারপর কী হলো বলার কোনো জায়গা থাকে না

ঠিক তখনই তিনি একটা গল্প বললেন। গল্পে একটাই মানুষ। এক নারী। রূপকথার পরিচয় পর্বে তাকে না বলা হলো দুখিনি রাজকন্যা। না বলা হলো ভিখারিনি। সে কোত্থেকে এলো কোথায় গেল কিছুই ছিল না সে গল্পে। এই একটাই গল্প তিনি শেষ করলেন সমাপনী ছাড়া। এবং এই একটাই গল্প যেখানে আমরা হাসির কোনো জায়গা পেলাম না আর বুঝলামও না এইটা গল্প হলো কী করে

- তারপর কী? কী হলো তারপর?

বারবার প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর দেন না। শুধু বিড়বিড় করেন- ও মাইও মাইও গো। মাইয়া লোকরে অত অত্যাচার...

০২

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি। তখন তুই পেটে। বিয়ানি বাজারের আশেপাশে একটা মেয়ে একা একা দৌড়াতো। কেউ কিছু জানত না তার সম্পর্কে। শুধু সবাই দেখত মাঝে মাঝেই সে মেয়েটা বিলাপ করে চিৎকার দিয়ে উঠে- ও মাইও মাইও গো। মাইয়া লোকরে অত অত্যাচার....

প্রতিবারই এসে মা গল্পটা এখানে থামিয়ে দেন। তারপর চাপাচাপি করলে বলেন দেশ স্বাধীনের পরে রাস্তায় বহু পাগলি দেখা যেত এরকম...

০৩

মুক্তিযুদ্ধপাঠের প্রথম পর্বে যখন আমরা বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ শিখে ফেলি তখনই গল্পটা আমার মাথায় ঘুরে আসে আবার। চোখে ভাসতে থাকে সিলেটের বিয়ানি বাজারে কোনো এক নারী বিলাপ করতে করতে দৌড়াচ্ছে- ও মাইও মাইও গো... আর তখনই বুঝে যাই বর্ণমালা শেখানো শেষ করে তিনি যেমন বলে দিয়েছেন- এখন নিজে নিজে পড়ো। তেমনি রূপকথা পর্যায়ের শেষ গল্প শুরু করে দিয়ে তিনি বলে দিয়েছেন- বাকিটা বানাও...

গল্পটা আমি তৈরি করতে বসি। নামধাম ঠিকানা বানাই। ঘটনার সাজাই। বহুদিন। বহুভাবে। বহু বছর ধরে। কিন্তু হয় না কিছুই। শুধু তার বিলাপের ভাষা ধরে আমি আবিষ্কার করি সেই নারী সিলেটের নন। তার বাড়ি কুমিল্লা কিংবা আশেপাশে কোথাও। কিন্তু তারপর? কিংবা আগে?

ঘটনাতো গল্প নয়। গল্পের জন্য দরকার কাহিনী। কিন্তু এই নারীর কাহিনী কী?

ঘটনার ঘাড়ে ঘটনা বসিয়ে আমি এই নারীর কাহিনী বানাতে বসি। কিন্তু চলতে চলতে কাহিনীটা চলে যায় অন্যদিকে। কিংবা কাহিনীর সুতোটা অতটা শক্ত হয় না যতটা হলে সেই নারী কুমিল্লা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে সিলেটে এসে বিলাপ করতে পারে- ও মাইও মাইও গো...

রূপকথা কে বানায় কেউ জানতে চায় না। রূপকথা যে বলে গল্পটা তারই। আমার এই রূপকথাটি আমি বানাব অন্যদেরকে দিয়ে...

০৪

এইবার আমি দরজায় দরজায় ঘুরি; দুটো শব্দ দেন। একটা বাক্য দেন। গল্পটাকে তৈরি করে দেন। কেউ জানলা খুলে উঁকি দিয়ে চলে যায়। কেউ শুনে পাশ কেটে যায়। কেউ বলে দেখি। আর কেউ কেউ বলে চলো বসি...

রূপকথাটা তৈরি হবে এবার...

০৫

চা বাগানের যে টিলায় মায়ের মুখে গল্পটা প্রথম শোনা। সেই টিলায় যখন হুড়মুড় করে উঠে পড়ে সবাই। নিমগাছ তলায় আমার মা হা করে তাকিয়ে থাকেন হাতে কবুতর খেদানো বাঁশের কঞ্চি নিয়ে

পেছন থেকে মুহম্মদ জুবায়ের আমার পিঠে একটা ঠেলা দেন। একই সাথে দ্বিতীয় সারিতে দাঁড়ানো স্নিগ্ধা আলি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে সামনে হাত বাড়িয়ে অছ্যুত বলাইকে সরিয়ে বলাই আর থার্ড আইয়ের মাঝখানে আমাকে জায়গা বের করে দেন। জুবায়ের ভাই এবার একটু জোরেই ধাক্কা দেন সামনে পৌঁছে যাবার জন্য

মা এইবার আমার দিকে তাকান। আমি কী বলব বুঝতে পারি না। পেছনে তাকাতে জুবায়ের ভাই চোখ দিয়ে কী একটা ইশারা করেন। আমি কিছু না বুঝেই সামনে তাকিয়ে বললাম- এরা আমার পরিচিত। সবাই লেখালেখি করে...

০৬

গল্পটা তাকে আবার বলতে বলা হয়। তার মুখ থেকে শুনলে হয়ত সবাই কোনো না কোনো কিউ পাবে যা আমি পাইনি। ...তিনি আবার বলেন। কিন্তু ওইটুকুই। বাড়তি কোনো ইনফরমেশন নেই। আর কোনো অনুমানও নেই। তার সাথে কোনো কাহিনীও পাওয়া যায় না আর...

০৭

ছোটবেলা লাগোয়া টিলার যে আমলকি গাছের নিচে আমরা বনভোজন করতাম। সবাই গিয়ে সেই গাছের নিচে জড়ো হয়। ভয়েজ রেকর্ডারটা আমি অন করে রাখি। যতটুকু তথ্য আছে তা শোনা হয়ে গেছে। এইবার শুরু হবে গল্পটা বানানো...

কিন্তু সবাই চুপ। কেউ বসা। কেউ দাঁড়িয়ে। পায়চারি করছেন কেউ। জুবায়ের ভাই আমলকি গাছে ধরে তাকিয়েছিলেন উপরে। কিন্তু তার দিকে আমার তাকানো তিনি টের পান। হাত ছেড়ে সোজা হয়ে আমার দিকে তাকান। গল্পটা শোনার আগে তার যতটা উৎসাহ ছিল এখন যেন অস্থিরতা বেড়ে গেছে তার থেকে বেশি

কিন্তু কেউ একজনকে শুরু করতে হবে। শুরু হলে সেটা এগিয়ে যাবে। অথচ শুরু করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারছে না কেউ। ...আমি জুবায়ের ভাইকে চেপে ধরি- আপনি শুরু করেন। যা ইচ্ছা তাই বলেন। মিলুক না মিলুক বলেন

সম্ভবত সবাই চাচ্ছিল সে ছাড়া অন্য কেউ শুরু ধরুক। আমি জুবায়ের ভাইয়ের নাম বলায় সবগুলো চোখ জুবায়ের ভাইকেই চেপে ধরে- শুরু করেন

জুবায়ের ভাই হাত তুললে সবাই থেমে যায়। আমি রেকর্ডারটা তার কাছে নিয়ে রাখি। জুবায়ের ভাই শুরু করছেন....

জুবায়ের ভাই হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে দূরের চা টিলাগুলোর দিকে চোখ গেঁথে কথা শুরু করেন- আমার পক্ষে এই বিষয়ে একটি অক্ষরও বলা সম্ভব নয়। কারণ, আমার কল্পনা তার অভিজ্ঞতা ও দুঃস্বপ্নের বেড় পাবে না কোনোদিন...

পুরো পাহাড় জুড়ে একটা বাজ পড়ে। যারা বসা ছিল তারা উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়ানোরা বসে পড়ে। জুবায়ের ভাই বিন্দুমাত্র ফাঁক রাখেননি কথার। তিনি শুরুও করছেন না; যোগও করছেন না কিছু গল্পটার ভেতর

যারা অপেক্ষা করছিল জুবায়ের ভাই শুরু করলে অনেক ডালপালা পাওয়া যাবে টেনে নেয়ার। তারা এবার একজন একজন করে জুবায়ের ভাইকে সমর্থন করতে থাকে ভেতরে ভেতরে। জুবায়ের ভাই যেন সবার কথাটাই বলে দিয়েছেন একা। সবাই নিজেদের চোখ বিভিন্ন জায়গায় রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যাতে অন্য কারো চোখে চোখ না পড়ে। যেন আমি আর কাউকে বলতে না পারি গল্পটা শুরুর জন্য

বীরাঙ্গনার কাহিনী বলতে গেলে কী কী বলতে হবে আর কোন স্মৃতি ঘেঁটে আনতে হবে সেসবে এখন হাবুডুবু খাচ্ছেন জুবায়ের ভাই। সেইসব কাহিনী তিনি তুলে আনতে চান না। তাই পরিষ্কার না করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি না করে দেয়া মানে আমার গল্পটা মায়ের মুখে শোনা কাহিনী থেকে এক পাও আর না এগোনো

কিন্তু গল্পটা আমাকে দাঁড় করাতেই হবে। আমি আবার জুবায়ের ভাইয়ের কাছে যাই গিয়ে রেকর্ডারটা তার সামনে ধরি- স্যার একটু বলেন। সে কোত্থেকে এলো। কেন এলো। কিংবা কোথায় গেল। এখানে আসার আগে সে কী করত। কোথায় থাকত। বলেন স্যার। যা মনে আসে বলেন

জুবায়ের ভাই মুখে কিছুই বলেন না। হাত বাড়িয়ে রেকর্ডারটা অফ করে দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করেন পাহাড়ের দিকে

তারেক বসা ছিল চুপচাপ। জুবায়ের ভাই উঠে যাওয়ার সাথে সাথে সেও উঠে পড়ে- গল্পটা লেখা হয়ে গেলে আমি এসে পড়ব

সবাই চুপ। রেকর্ডারটা আবার অন করে আমি সবার দিকে তাকাই। কেউ একজনের শুরু করা দরকার। জাহিদ হোসেন পারেন। তার দিকে তাকাতেই তিনি নড়েচড়ে বসেন। শুরু করেন নিজের অলসতার অজুহাত দিয়ে

অলসতায় আমার অসুবিধা নেই। আলসেমি করে হলেও আমার দরকার গল্পটা শুরু করা। আমি তাকে চেপে ধরি। কিন্তু তিনি উল্টা প্রশ্ন করে বসেন সারেন্ডারের ভঙ্গিতে- বাস্তবকে বর্ণনা করবার মতো অত শক্তিশালী কলম কোথায় পাব?

আমি এবার চিৎকার করে সবাইকে একটা বাক্যই শোনাতে থাকি- ও মাইও মাইও গো। মাইয়া লোকরে অত অত্যাচার... স্বাধীনের পরে একটা মেয়ে এই কথা বলে বলে বিলাপ করছে। আপনারা কেউ এখানে কোনো গল্প পান না? কোনো কাহিনী যোগ করতে পারেন না? কোনো কিছু কল্পনা করতে পারেন না তার সম্পর্কে?

কেউ আমাকে থামায়ও না। কেউ যোগও করে না কিছু। কিন্তু আমার চ্যাঁচামেচিতে স্নিগ্ধা আলির বোধহয় কিছুটা লাগল। তার হয়ত ধারণা হলো আমি ভাবছি তারা ইচ্ছা করেই আমাকে সহযোগিতা করছেন না

আমি তার কাছে রেকর্ডারটা নিয়ে দাঁড়ালাম। স্নিগ্ধা আপা গল্পটা বাদ দিয়ে কথা শুরু করলেন জুবায়ের ভাইয়ের রেফারেন্সে দিয়ে- আমি মুহম্মদ জুবায়ের এর সাথে একমত। মানুষের নিষ্ঠুরতার সাথে কল্পনার পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা সবসময় থাকে না

তিনি একটু থামেন। আমার দিকে তাকিয়ে হয়ত অনুমান করেন যে কথা বলে জুবায়ের ভাই চলে গেছেন সেই কথা আমি তার মুখে শুনতে চাই না। এটা অনুমান করে তিনি একটু সাপ্লিমেন্ট করার চেষ্টা করেন- এক বীরাঙ্গনা গুরু দাসীকে নিয়ে ইয়াসমিন হক এর একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আছে, আমি দেখিনি- কেউ দেখে থাকলে একটু জানাবেন ঠিক কি দেখানো হয়েছে?

কে দেখেছে কে দেখেনি কেউ আওয়াজ দেয় না। তিনি আর কাউকে জোরও করেন না। আর কোনো রেফারেন্স দেন না। নিজের মনেই একবার স্বগতোক্তি করেন- স্বাধীনতার পরপর রাস্তাঘাটে উন্মাদিনীর সংখ্যা নাকি বেড়ে গিয়েছিল...

আমরা সবাই তার দিকে তাকাই। হয়ত তিনি গল্পটা শুরু করছেন। অনেকক্ষণ ধরে স্নিগ্ধা আলি চুপ করে থাকেন। তিনি গল্প শুরু করছেন... কিন্তু না। অনেকক্ষণ পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি মাটির দিকে তাকান- মাঝে মাঝে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় না জন্মানোর জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছা করে...

কিছু না বলার জন্য একটা ঢাল তৈরি করে নিলেন তিনি। কিন্তু একে একে সবাই নিজেকে সরিয়ে নিলে গল্পটা জীবনেও শেষ হবে না। আমি তার কাছে গিয়ে তারই কমেন্ট রিপিট করি- বুঝলাম মানুষের নিষ্ঠুরতার সাথে কল্পনার পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা সবসময় থাকে না। না হয় বলেন সেই রকম কিছু নিষ্ঠুরতার সত্য কাহিনী

স্নিগ্ধা আপা একবার চোখ তুলে তাকান আমার দিকে। কিছুই বলেন না। শুধু তার চোখ বলে দেয় কিছুই আর বলবেন না তিনি। তিনি উঠে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকেন টিলার ঢালুর দিকে

ধূপছায়া অতক্ষণ ধরে উঠার রাস্তা খুঁজছিল। স্নিগ্ধা আপা উঠতেই সেও উঠে দাঁড়ায়। যাবার আগে আমাকে একটা ভদ্রলোকি কমপ্লিমেন্ট করে। সবাইকে শুনিয়ে ঘোষণা করে- একমাত্র মাহবুব লীলেনের পক্ষেই সম্ভব বীরাঙ্গনাদের করুণ কাহিনী সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা..

মনে হচ্ছিল রেকর্ডারটা ছুঁড়ে মারি মুখের উপর। আমার প্রশংসা শোনানোর জন্য কাউকে এখানে ডাকা হয়নি। ডাকা হয়েছে গল্প বানানোর জন্য

কিন্তু এখন ক্ষেপে গেলে গল্পটা মরে যাবে। তাই মাথা ঠান্ডা করে তাকে আবার পেছনের কাহিনীটা শোনাই- নিজে লিখতে পারিনি বলেই তো সবার কাছে হাত পাতলাম। দেন না ভাই কিছু তথ্য- উপাত্ত-কল্পনা- অনুমান-অভিজ্ঞতা-লোকশ্র“তি। যা সামনে আছে দেন। এটা আমার একার গল্প হবে না। সবার নাম থাকবে এই গল্পে। দেন

আমার কথাগুলো শুনল কি শুনল না কিছুই বুঝতে না দিয়ে ধূপছায়াও আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করল আমলকি গাছটা ছাড়িয়ে

পুরোটা আমলকি তলা থমথমে। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। আর সবাই চেষ্টা করছে আমার চোখ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে। অথচ এরা সবাই লেখক। গল্পকার। অতজন মানুষের একজনও গল্পটা শুরু করতে পারবে না এটা বিস্ময়কর

নাকি তারা করতে চাচ্ছে না কেউ?

থার্ড আইয়ের ভঙ্গি দেখে মনে হলো সে কিছু বলতে চায়। তার দিকে রেকর্ডারটা বাড়িয়ে দিতে সে হাত দিয়ে ওটা সরিয়ে দিলো। মেরুদণ্ড একটু সোজা করে বলল- আপনি যেভাবে ছবি সাজিয়েছেন সেটি একটি নির্বাক কাহিনী অলরেডি হয়ে গেছে

এবার সত্যি সত্যি মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ল আমার পক্ষে। চিঠিতে যে কাহিনীসূত্র দিয়েছি সেটাই যদি যথেষ্ট তবে তোদেরকে তেল মারতে গেছি কেন আমি? আমি আইডিয়া চাই আইডিয়া। আমি কাহিনী চাই। আমার প্রশংসা নয়

মুখে কিছুই বললাম না। বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো যতটা না যোগ না করতে পারার জন্য তার চেয়ে বেশি বিব্রত এরা এখানে চলে আসার জন্য। মনে হয় কেউই বোঝেনি কেন তারা এখানে এসেছে। অথবা এসে আফসোস করছে কেন আসলাম বলে

আদৌ কি গল্পটা দাঁড়ানোর আর কোনো উপায় আছে? মানুষকে জোর করে কী লাভ? গল্প তৈরি হলে তো সবাই দিতো। দেবার জন্যই তো এসছিল সবাই

রেকর্ডারটা অফ করে দিলাম। থাক দরকার নেই

০৮

কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু না। কাল সারাদিন ধরে যা রেকর্ড হয়েছে তাতে একটাও শব্দ নেই গল্পে দেবার মতো। বারবার শুনি। কিচ্ছু নেই। না একটা শব্দ না একটা কিউ। ফাইলটা ফেলে দেবার জন্য ডিলিট বাটনে চাপ দিতে গিয়ে আমার হাত থেমে যায়। ...এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে গল্পকাররা সবাই

কাউকেই আশা করিনি কালকের ঘটনার পর। কাউকেই আসতে বলিনি। ...আমি হাঁটতে থাকি। এক বীরাঙ্গনার গল্প লেখার জন্য আবার গিয়ে আমরা জড়ো হই আমলকি তলায়। গল্পটা তৈরি না করতে পারার অক্ষমতা আমাকে কামড়ায়। একই অক্ষমতায় আক্রান্ত এরাও। গল্পটা আর আমার একার নেই। গল্পটা ঢুকে গেছে সকলের ভেতর। গল্পটা হয় তৈরি হবে এখন। নাহলে আর হবেই না কোনোদিন

আমি শুধু রেকর্ডারটা অন করে মাঝখানে ঘাসের উপরে রেখে দেই। যার ইচ্ছা সে নেবে। যার ইচ্ছা সে যোগ করবে...

- ওকে। আমি শুরু করছি তাহলে...

রেকর্ডারটা তুলে নিয়ে সবার দিকে একবার তাকায় থার্ড আই। রেকর্ডারটা নাড়াচাড়া করতে করতে সে গিয়ে একপাশে দাঁড়ায়। টাইয়ের নটটা একটু ঢিলা করে কোনো ভনিতা ছাড়াই তার মুখ থেকে বের হয়ে আসে- নন্দিতা...

নামটা শুনে সবাই একটা ঝাঁকি খায়। সেই বীরাঙ্গনা তাহলে এক সংখ্যালঘু নারী?

থার্ড আই থেমে সবার উপর নন্দিতা নামের ধাক্কাটা দেখে নিয়ে আবার রিপিট করে- হ্যাঁ নন্দিতা। নন্দিতাকে যখন সোলেমান তার লোকজন দিয়ে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়, তখন নন্দিতার একমাত্র অপরাধ ছিল সে মুক্তিযোদ্ধা অলকের স্ত্রী

আরেকটা শিরশিরে চোখাচোখি ঘটে যায় আমাদের মধ্যে। নন্দিতা একজনের স্ত্রী ছিল। যার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা

গল্পের পিনগুলো শ্রোতাদের শরীরে কতটুকু বিঁধছে তা ভালো করে দেখে নেয় থার্ড আই। সবার চোখে তাকিয়ে বুঝে নেয় এই পর্যন্ত কারো কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া নেই। সে এবার গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড সাজায়- অলকের অবস্থান কোথায়, সে কোথায় মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করছে, সেই বিষয়টি সম্পর্কে নন্দিতার কাছ থেকে গোপন খবর নিয়ে অলককে খুঁজে বের করাই ছিল সোলেমান রাজাকারের উদ্দেশ্য

থার্ড আই একটু থামে। সে কাহিনীর সূতা খুঁজছে। এর ফাঁকে আমরা আমাদের মতো করে গল্পের শেকড় সাজিয়ে নেই। আমরা ধরে নেই যে এর মধ্যে সোলেমান নন্দিতাকে ধরে নিয়ে গেছে কিংবা নেবার পরিকল্পনা করছে। আর আমাদের দিকে তাকিয়ে থার্ড আই বুঝে নেয় গল্পের সেই অংশটুকু আর বলার দরকার নেই। তাই সে এক লাইনে এই পুরো পর্বটা শেষ করে ফেলে- নন্দিতা অলকের অবস্থান জানায়নি বলে ক্যাম্পে রাত্রি যাপন করতে হয়েছে দিনের পর দিন...

থার্ড আই থামে। সুযোগ পেয়ে আমরা অনুমান করি অলক কোথায় নন্দিতা জানে। সে যে জানে সেটা জানত রাজাকাররা। কিন্তু নন্দিতা কিছুই জানায়নি তাদের। এইটুক পর্যন্ত নিজের ভেতরে জোড়া দিয়ে আমরা আবার তাকাই থার্ড আইয়ের দিকে- তারপর? তারপর সে ক্যাম্পের বাইরে এলো কীভাবে?

এই অংশটা বোধহয় গুছিয়ে উঠতে পারেনি সে। কিংবা এটুকুকে অত দরকারি মনেও করে না। অথবা সে হয়ত ভাবে নন্দিতার ক্যাম্পের বাইরে আসার একটা চমকদার কাহিনী যে কেউ বানিয়ে নিতে পারবে। অথবা একটা কাটপিস ঘটনা বসিয়ে দিলেও ক্ষতি নেই। তাই এই অংশটাও থার্ড আই শেষ করে ফেলে একটা হয়ত দিয়ে- হয়ত কোনো এক সময় নন্দিতা ক্যাম্প থেকে পালিয়েছে ..

নন্দিতার পালিয়ে আসা নিয়ে আমাদের কারো মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। সবাই আগ্রহী সেইটুকু শুনতে। যেখানে নন্দিতা ঘুরতে ঘুরতে বিলাপ করছে। কিন্তু সেই বিলাপ শুরু হবার আগে আমাদের অলকের ঘটনা জানতে হবে। আমরা একসাথে জিজ্ঞেস করি- অলক? অলকের কী হলো?

থার্ড আই চশমা খুলে দূরের রোদপড়া চাগাছের টিলায় তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কারো দিকে না তাকিয়ে মুখটা নামিয়ে আনে রেকর্ডারের মাইকের কাছে- অলক যুদ্ধ শেষে ফিরেছে। সবকিছু জেনেছে

থার্ড আই থামে। সবার দিকে তাকায়। সবার চোখে একটা করে তারপর শুনতে চাওয়া প্রশ্ন। থার্ড আই কারো প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না। রেকর্ডারের কাছে মুখ নামিয়ে নেয় আবার- কিন্তু... সে তখন নন্দিতার পালিয়ে আসার চেয়ে নন্দিতার মৃত্যুটাকেই যৌক্তিক মনে করেছিল....

থার্ড আই আবার থামে। আরেকটা ধাক্কা আমাদের উপর দিয়ে বয়ে যাবার জন্য সময় দেয়। আমদের কাছে নন্দিতার বাকি কাহিনী পরিষ্কার হয়ে যায়। কাহিনীগুলো একেবারেই এক। শুধু ঘটনা আলাদা। মুক্তিযোদ্ধা অলকও মেনে নিতে পারেনি নন্দিতাকে। কিন্তু অলক অন্য যে কেউ হলে এইখানে আমাদের কোনো প্রশ্ন থাকতো না। কিন্তু থার্ড আই বলেছে অলক মুক্তিযোদ্ধা। ...আমরা থার্ড আইকে চেপে ধরি আরেকটু বিস্তারিতের জন্য

কিন্তু থার্ড আই গল্পের মাঝখানে কিছু ফাঁকা চলে আসে শেষ জায়গায়- যার জন্য এত অপেক্ষা, যাকে বাঁচিয়ে রাখতে নন্দিতার এই আত্ম বিসর্জন... সেই অলকই যখন তাকে আপন করে নিলো না তবে কেন আর বেঁচে থাকা...

নন্দিতার সিদ্ধান্তটা জানিয়ে থার্ড আই আরেকটু থামে। তাকে একটু আউলা মনে হয়। মনে হয় এখন সে গল্পটা শেষ করতে চাচ্ছে দ্রুত। সে আরেকটা ইনফোজাম্প দিয়ে এবার উপসংহারে চলে যায়- তাই হয়ত জীবনটাকে অর্থবহ করতে নন্দিতা ছুটেছে সাগরের কাছে। সাগরের বুকে অফুরন্ত ভালোবাসা, সে শুধুই গ্রাস করে... ভাসিয়ে নেয়... হয়ত নন্দিতাকেও নেবে

- নন্দিতা সাগরে গেলে সিলেটে আসবে কেন?
প্রশ্নটা সবার চোখে ঘুরলেও কেউ করে না। থার্ড আই গল্পটাকে যতদূর নিয়ে গেছে এখন বাকিরা ভেতরের ফাঁক সেলাই করে নিলেই গল্পটা দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু থার্ড আই একটা বিষয় একেবারে বাদ দিয়ে গেছে। মাইয়া লোকরে অত অত্যাচার। আমি তাকে পয়েন্টটা ধরিয়ে দেই- আরেকটু যোগ করা যায় কি না দেখেন

থার্ড আই আবার ভাবে। আগের রেফারেন্স দিয়ে শুরু করে- অলক তখন নন্দিতার পালিয়ে আসার চেয়ে নন্দিতার মৃত্যুটাকেই যৌক্তিক মনে করেছিল...

...নন্দিতা চুপ করেই ছিল এত দিন, ক্যাম্পের অত্যাচার তার কাছে মনে হয়েছে এটা একটা যুদ্ধ... তার কাছে মনে হতো অলক যুদ্ধ করছে থ্রি নট থ্রি দিয়ে আর সে করছে শরীর দিয়ে রাজাকারদের সাথে। শরীর দেয়ার সাথে মনের যেহেতু কোনো সম্পর্ক নেই তাই এই পরিণতিটা মেনে নিয়েছিল নন্দিতা।

থার্ড আই গল্পটা আর বুনতে পারছে না আমরা অনুমান করি। তাই এখন সে ক্যাম্পের অদরকারি ল্যান্ডস্কেপে তুলি নাড়াচাড়া করছে। গল্পটাকে যে জায়গায় এনে রেখেছে; সেখানে ক্যাম্পের কাহিনীর আর প্রয়োজন নেই। এখন জরুরি ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার পর অলকের সাথে নন্দিতার দেখা হওয়ার ঘটনা

হয়ত সে নিজেও বোঝে বিষয়টা। আমতা আমতা করে আবার শুরু করে- অলকের ফিরে আসার পর, নতুন একজন অলকের সাথে তার পরিচয় হয়... যে অলককে সে এতদিন দেবতা বলে পুজো দিত, যার জন্য ভগবানের কাছে বলত, শেষ দমটা যেন থাকে শুধু অলককে এক নজর দেখার জন্য... সেই দেবতার সামনে আজ নন্দিতা বড়ো বেশি অসহায়... কোনো আশ্রয় নাই তার।

আগুনে পুরো বাড়ি পুড়ে গেছে বলার পর আবার খাট পালং বিছানা পুড়ে যাবার আলাদা কাহিনীর কি কোনো দরকার আছে? আমরা জেনে গেছি অলকের জন্য নন্দিতা কী করেছে। জেনে গেছি অলক কী চিন্তা করেছে নন্দিতাকে নিয়ে। জেনে গেছি অলকের কাছে বঞ্চনা পেয়ে নন্দিতার আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের কথা। ...এখন আর এসবের দরকার নেই। এই গল্পে অলংকার নয়; ঘটনা দরকার আমাদের

কিন্তু আমরা কিছুই না বলে তাকিয়ে থাকি। থার্ড আই আবার শুরু করে- নন্দিতার অত্যাচারের যন্ত্রণাটা সেই থেকেই শুরু... তারপর সাগর পাড়ে যেতে যেতে অনেক অলকের সাথে দেখা হয় নন্দিতার... কেউ তার ক্ষত সারায়নি বরং কীভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে সেই গল্পটাই শুনতে চেয়েছে...

নন্দিতা সাগরে গেলে সিলেটে আসবে কেন এবারও সে তা এড়িয়ে গিয়ে পথে পথে আরো অনেক অলকের সাথে নন্দিতার দেখা করিয়ে দেয়। তাদের কথা শুনে নীলিমা ইব্রাহিমের লেখাগুলোর কথা আমার মনে পড়ে যায়। পয়েন্টটা আমি যোগ করে থার্ড আইয়ের দিকে তাকাই। এবার সে রেকর্ডারটা অফ করে ধুপ করে বসে পড়ে গাছের গোড়ায়- ধুর লীলেন ভাই কিছু হয় না... আর পারি না।

সাবাস। অনেক হয়েছে। এবার বাকিদের পালা
কথা শেষ করে আমি অন্যদের দিকে তাকানোর আগেই দেখি অছ্যুত বলাই উঠে এসে রেকর্ডারটা তার কাছে নিয়ে গেছে। সে কারো দিকে তাকায় না। রেকর্ড বাটন টিপ দিয়ে সরাসরি কথা শুরু করে-
হয়তবা সে একজন বীরাঙ্গনা
তার খালি পায়ে, উকুনে ভরা চুলে টোল বসায়... চৈত্রের রৌদ্ররা

বলাই একটু থামে। কাব্যিক ঢংয়ে করা বর্ণনাকে আগের ঘটনার সাথে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করে- হয়ত ঢিল হাতে ছুটে যায় অবুঝে মেতে ওঠা বালকের দল। দৌড়ায় পাগলিনি। কখনো অট্টহাসি। কখনো ভাবুক চোখ জ্যান্ত ছবি এঁকে যায়। তার সেলে থাকা মর্জিনার ক্ষতবিক্ষত যোনিতে বেয়নেট। সখিনার চুলে বেঁধে গ্লানিতে আত্মাহুতি। সে তবু মরেনি। দিনের পর দিন। রক্তের সমুদ্রে সে তবু মরেনি কোনোদিন

অছ্যুত বলাই এবার পুরোপুরি কবি হয়ে উঠে। নিজেকে নন্দিতার ঘটনার দর্শক নন্দিতার ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়- সেইসব ছবি চোখে মগজে অস্তিত্বের প্রতিটা সুতোয়। এখনও সাজায় সাজিয়েই চলে। হয়ত তার ভাবুক জীবনবোধে তিতিবিরক্ত আমি। হাহাকার করে উঠি - মরে না কেন অভাগী! হয়ত তার শ্যামল ভাবলেশহীন মুখে নখরের আঁচড়ে। তাকাতে কাঁপে আমার বুক। হয়ত কেমন করুণা করুণা ভাবও হয়

আমার একবার মনে হয় বলাই কি নিজেকে অলকের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে? পরক্ষণেই মনে হয়- না। বলাই পুরো একটা জাতি হয়ে গেছে। বলাই মিশে যাচ্ছে নিজের উপর নিজের ঘৃণায়- তবুও তার অট্টহাসি থামে না, সে মরে না। ভাবে গলে না আগুনেও পোড়ে না জলজ্যান্ত শরীর। আমার উদ্ধত ভাবনার আয়নায় হয়ত সে অকারণ খেয়ালেই। আমারই করুণাগুলো আমাকেই ফিরিয়ে দেয়

বলাই থেমে যায়। রেকর্ডারটা ফেরত রাখতে রাখতে অস্ফুটে উচ্চারণ করে- তাকে তিনি না বলে সে বললাম। তিনি বললে বড়ো পরপর মনে হয়

বলাই অনেক বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। হাসির ঘটনা যেমন হাসতে হাসতে বললে অন্য আর কারো হাসি পায় না। তেমনি দুঃখের ঘটনাও দুঃখের মধ্যে ডুব দিয়ে বললে বড়ো বেশি এলোমেলো হয়ে যায়

আমার চোখ পড়ে ধুসর গোধূলির উপর। এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি। থার্ড আই আর অছ্যুত বলাইয়ের কাছ থেকে গল্প পেয়ে আমি আবারও এগ্রেসিভ হয়ে উঠি। ধুসর গোধূলিকে ধরি। কিন্তু ধুগো কোনো ভনিতাও করে না। দেরিও করে না। সোজা হাতজোড় করে বসে- আমি ভুল বুঝেছিলাম। এটা নিয়ে তো বস গল্প লেখার সাধ্যি হবে না কখনো। তার চেয়ে প্লটটা বদলে দেন, ট্রাই করে দেখা যাক
- দেন আপনিই বরং প্লট বদলে দেন। যেহেতু আমরা তার সম্পর্কে কিছুই জানি না। সেহেতু তাকে আপনি যেভাবে দাঁড় করাবেন সেভাবেই হবে

একটু ভাবে ধুসর গোধূলি। হয়ত প্লট খুঁজছে। আমি রেকর্ডারটা তার সামনে রাখি। হাত বাড়িয়ে বাটন অফ করে দিয়ে মুখ তোলে- আমি ফাজিল মানুষ। এইসব সিরিয়াস বিষয়ে হালকা চালের কথা বললে নিজেকেই অসম্মান করা হয়

তার সমস্যাটা অনুমান করতে পারি। গল্প তৈরির অফার পেয়ে সে এসছিল মসলা দিতে। মসলা মাখানোতে তার জুড়ি নেই। কিন্তু এখানে এসে একেবারে সে থ বনে গেছে। জোরে শব্দ করে হাসা মানুষ কাঁদেও শব্দ করে। তিত্তিড়িং মানুষেরা যখন ঝিমায় তখন একেবারে ল্যাটা মেরে যায়। তার সমস্যা এইটাই

গল্প আবার থমকে যায়। কেউই মুখ খোলে না। কেউ কেউ নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্যকে খোঁচানো শুরু করলেন। অনিন্দিতা চৌধুরি এই দলে সবার আগে। একটু কেশে। একেবারে পরিশীলিত গলায় তিনি উৎসাহ দেয়া শুরু করেন সবাইকে- সবাই আরো একটু একটু চেষ্টা করেন। আপনারা ঠিকই পারবেন এ নিয়ে গল্প লিখতে।
- পরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার বাদ দিয়ে এবার নিজে কিছু আইডিয়া দেন। কমপক্ষে ১০টা পয়েন্ট দেন এই গল্পের। কোনদিক থেকে গল্পটা কোনদিকে এগোবে একটা একটা করে বলে যান

অনিন্দিতাকে বাঁচিয়ে দিলো স্নিগ্ধার আপার উঠে দাঁড়ানো- গল্প/কাহিনী ওসব লেখার জন্য যতখানি সৃষ্টিশীলতা লাগে আমার দাদা সেসব একদমই নেই টেই, তাই আপনাকে বড়োজোর সম্ভাব্য প্লট দিতে পারি। বীরাঙ্গনারা ফিরে আসার পরে সমাজ পরিবার ইত্যাদিতে গৃহীত না হওয়া নিয়ে তো অনেক কথা ইতোমধ্যে হয়েছে। এবার একটু অন্য দিক থেকে দেখি।

লেকচার শুনে মেজাজ আকাশে উঠে গেলেও রেকর্ডারটা এগিয়ে দিতে দিতে বললাম- ঠিক আছে আপনি যেদিকে দেখতে চান দেখেন

স্নিগ্ধা বসলেন না। দাঁড়িয়েই শুরু করলেন- ধরুন, নন্দিতা ফিরে আসল এবং অলক এবং অলকের পরিবার তাকে এমনকি গ্রহণও করল - সাদরেই। যুদ্ধ বা এ ধরনের কোনো বিশাল আকারের ক্রান্তির সময়ে মানুষ তার নিজের সীমাবদ্ধতাকে অনেক সময়ই অতিক্রম করে যায় - অতএব ধরে নিলাম সমাজও ভ্রƒ কুঁচকোয়নি। আপাত দৃষ্টিতে সব ঠিকই আছে। কিছুদিন তাই থাকল। কিন্তু আস্তে আস্তে সমস্যাটা দেখা দিতে লাগল নন্দিতারই মনে। না, নিজেকে অপবিত্র টবিত্র মনে করা না, শুধুমাত্র লম্বা সময় ধরে ত্রাস, শারীরিক কষ্ট আর এক ধরনের বিস্ময় মেশানো অবিশ্বাস - সে পাকিস্তানি হোক আর রাজাকারই হোক মানুষ যে এতখানি নির্মম হতে পারে - এই অনুভূতিগুলোর হাত থেকে কিছুতেই মুক্তি না পেয়ে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা?

গল্পের পুরো মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধা আলি থামলেন। তার সন্দেহ হলো তার কথাগুলো সবাই নিচ্ছে কি না। তিনি সবার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন- বেশি আবেগতাড়িত আবেদন বর্জিত হয়ে গেল?
- না বলে যান। ঠিকই আছে

স্নিগ্ধা আপা আরেকটু ভাবলেন। রেকর্ডারটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে শুরু করলেন- তাহলে আরেকটু এগোনোও যেতে পারে। ধরা যাক নন্দিতার একটা বাচ্চা হলো - '৭১ এর কারণে। মা হিসেবে ওই বাচ্চাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে না পারা এবং আস্তে আস্তে ঘৃণা করতে শুরু করা

ধুম করে গল্পের দুটো বাঁক ঘুরিয়ে দেবার প্ল্যান বোধহয় স্নিগ্ধা আলির নিজেরও ছিল না। নন্দিতার নিজে থেকে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা আর নিজের অবাঞ্ছিত বাচ্চার প্রতি ঘৃণা। প্রচণ্ড জটিল দুটো ইস্যু জুড়ে দিয়ে তিনি নিজেও বোধহয় থতমত খেয়ে গেছেন। কথা বন্ধ করে তিনি সবার দিকে তাকিয়ে থাকলেন হঠাৎ
- কিন্তু তারপর?

যেভাবে ধুম করে শুরু করেছিলেন সেভাবেই ধুপ করে বসে পড়লেন রেকর্ডারটা ঠেলে দিয়ে- আর পারব না। এবার অন্যরা এটাকে জোড়া লাগাবে

কিন্তু জোড়াটা লাগাবে কে? গল্পটা এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে গল্পটাকে এই আবহ থেকে বের করে নেয়াও প্রচণ্ড কঠিন

কঠিন বাস্তবতার সাথে হিউমারের ডিপো সংসারে এক সন্ন্যাসী দুদিন ধরেই ঝিমাচ্ছেন। তিনি জানেন তাকে ধরা হবে জোরে সোরেই। তাই স্নিগ্ধা আপা বসার সাথে সাথেই কাউকে কোনো সুযোগ না দিয়ে বলা শুরু করলেন- নিজের কল্পনার দারিদ্র্য নিয়ে আমি এমনিতেই খুব কুণ্ঠিত। তাই এ কাজ আমাকে দিয়ে হবার নয়। অন্যেরা কী বলছেন আমি মন দিয়ে শুনব

স্নিগ্ধা আপা আর সন্ন্যাসী নিজেদের পালানোর পথ বের করতেই সে পথে সরাসরি দৌড় লাগায় দ্রোহী- মাফ করবেন আমাকে। মাফ করবেন। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে গল্প লেখার সাধ্য আমার নেই। আমি শুধু চুপচাপ শুনতে এসেছি কে কী বলে

দিনটা যে স্পিডে শুরু হয়েছিল তা আবার থেমে যায়। আজ সকালেও ভেবেছিলাম গল্পটা আর তৈরি হবে না। কিন্তু থার্ড আই অছ্যুত বলাই আর স্নিগ্ধা আলির গল্পের ধারায় আবারও আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি গল্পটা হবে। তৈরি হবেই

আমি কারো দিকে তাকাই না। মাটিতে চোখ রেখে সবার সামনে ঘুরতে থাকি। এখন পর্যন্ত যা কাহিনী এসেছে সেগুলোর ফাঁকে প্রচুর চুন-সুরকি দরকার। কিন্তু কেউ নড়ছে না। সবাই চুপচাপ। ঘুরতে ঘুরতে শ্যাজার দিকে চোখ পড়ার আগেই শ্যাজা নড়েচড়ে বসে- বীরাঙ্গনা অনেক বড়ো বিষয়। গদ্যে আমার সবসময়ই ভয় কাজ করে। আমাকে দিয়ে হবে না কিচ্ছু

শ্যাজার নড়েচড়ে বসায় আমি যতটা লাফিয়ে উঠেছিলাম ততটাই চুপসে যাই কথা শুনে। ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকি অনেক্ষণ। ঝিম মেরে আছে সবাই। অনেকক্ষণ। বহুক্ষণ...

সবার নীরবতার মাঝখানে আস্তে করে রেকর্ডারটা টেনে নেয় এস-এস। কিন্তু রেকর্ড বাটন অন না করেই বলতে শুরু করে। একেবারে ফর্মাল একটা বক্তৃতার ভূমিকা। শুরুতেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার লেখালেখিতে ছেদ পড়ার বিশাল ফিরিস্তি। তারপরে তাকে আমন্ত্রণ করার জন্য কৃতজ্ঞতা

মেজাজটা সত্যিই খারাপ হয়ে যায় আমার। নিজের ফিরিস্তি দেবার জন্য রেকর্ডার হাতে নেবার কী দরকার ছিল? জায়গায় বসে পারব না বললেই তো হতো

কিন্তু এস-এস বসে না। আমি নিশ্চিত এবার সে বলবে এই বিষয় নিয়ে গল্প বানাতে হলে দরকার অসম্ভব লেখনি ক্ষমতার। তারপর বলবে- স্যরি

আমি রেকর্ডারটা তার হাত থেকে নিয়ে আসার জন্য যেই হাত বাড়িয়েছি তখন তার কথা কানে এলো- আপনার চিঠির কারণে লেখালেখিতে ফিরে আসার অন্তত একটা উসিলা তৈরি হলো...

আমি থেমে যাই। এস-এস এগোতে থাকে- আমার ইনপুট হয়ত ভিন্ন হবে। প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। আমি আশাবাদী মানুষ। এটা হয়ত খুব যুক্তিযুক্ত হবে তাও না। কিন্তু গল্প। শেষ অব্দি গল্পই
- আরে বাপ গল্প চাই গল্প। গল্পের ভূমিকা না

কথাটা মুখ দিয়ে প্রায় বের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এস-এসকে রেকর্ড বাটন অন করতে দেখে কথাটা গিলে ফেলে এক পা পিছিয়ে আসি। এক সেকেন্ডের মধ্যেই শুরু করে এস-এস। কাউকে শ্বাস ফেলারও সুযোগ না দিয়ে বলতে থাকে একটানা- আমেরিকার একটি পরিবারে দত্তক হিসেবে গৃহীত যুদ্ধশিশু রায়হান ও বাংলাদেশবাসী আমলাকন্যা উন্নয়নকর্মী আনিলা পরস্পরকে চেনে এবং পরিচিত হয় জাতিসংঘের কর্মশালায়; যেখানে বাংলাদেশের যুদ্ধকন্যাদের নিয়ে একটি প্রজেক্ট রীতিমতো হৈ চৈ লাগিয়ে দেয়। তারা দাবি করে ১৯৭১এ সিআই-এর প্ররোচনায় ‘বীরাঙ্গনা ধর্ষণ’ প্রকল্পের সৃষ্টি। তাদের গবেষণায় বের হয়ে আসে আমেরিকান কিছু ডিপ থ্রোটের থলের বেড়াল। এই নিয়ে সারা আমেরিকায় শুরু হয় তোলপাড়; সারা পৃথিবীতেও। সবার নজর আবার গিয়ে পড়ে বাংলাদেশ আর ৭১ এর নারী নির্যাতনের প্রতি। প্রশাসনের টনক নড়া - আনিলার নতুন প্রজেক্ট প্রাপ্তি এবং সেই সুবাদেই দুজনের বাংলাদেশে প্রত্যাগমন- রায়হান-আনিলার বিয়ে এবং রায়হানের জন্মদাত্রীর খোঁজ...

এস-এস একটু থামে নিজে শ্বাস নেয়ার জন্য। এবার গল্পটা বইতে শুরু করেছে অন্য এক খাতে। একেকটা বাক্যে একেকটা ঘটনাপর্ব শেষ করে দ্রুত চলে গেছে পরের পর্বে। সমস্যা নেই। যেহেতু সে শুরু করেছে নিজেকে আশাবাদী ঘোষণা দিয়ে তাই তার তাড়া আছে গল্পের শেষে পৌঁছানোর। মাঝখানে সময় বেশি দিলে কিংবা ডিটেইলে গেলে হয়ত গল্পটার মোড় ঘুরে যেতে পারে বলে তার ভয়

একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে এস-এস আবার শুরু করে- আনিলার আমলা পিতার সাহায্য - দক্ষিণপন্থী সেই আমলার স্বাধীনতা পরবর্তী সুবিধাবাদী রূপান্তর...

একটু থেমে পুরো প্রসঙ্গটাই বাদ দিয়ে সে আবার ফিরে যায় শুরুর ঘটনার ধারাবাহিকতায়- অবশেষে খুঁজে পাওয়া যায় সেই মাকে; যিনি নাম পরিচয় পাল্টে ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের একটা স্কুলে; দূরে পাহাড়ি এলাকায় আছেন। ৭১ এর বীরাঙ্গনা তিনি। কিছুদিন বারাঙ্গনা জীবনযাপনেও বাধ্য ছিলেন বাস্তবতার নির্মমতায়। তারপর ফাদাররা তাঁকে বাঁচান। ধর্মের বর্মের আড়ালে নিয়ে যান

গল্পটা কোত্থেকে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে কে জানে। বীরাঙ্গনার কাহিনীকে স্নিগ্ধা আলি নিয়ে গেলেন যুদ্ধশিশুতে। যুদ্ধশিশু ধরে এস-এস নিয়ে এলো ধর্ম। ...চলুক। দেখা যাক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়

এস-এস এবার এক লাফে চলে যায় ঘটনার অন্য এক ধাপে- ইতিহাস খুঁড়ে বের হয় আনিলার বাবা তাঁর ধর্ষকদের অন্যতম একজন। ...হতে পারে আনিলা এবং রায়হান আদতে একই পিতার ঔরসজাত...

ঘটনার এই টুইস্টের জন্য বোধহয় কেউই প্রস্তুত ছিলাম না আমরা। এস-এস নিজেও বোধহয় জানত না তার গল্পটা এইখানে এসে প্যাঁচ খাবে। সে কথা থামিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কিছু বলছে না। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবার চোখে তারপরের সঙ্গে তার আগে কী হলো প্রশ্ন

একটা মঞ্চ নাটকের কথা আমার মনে পড়ে যায়। শামসুল আলম বকুলের লেখা সেই নাটকটা সিলেটে আমরা করেছিলাম কথাকলিতে। পিঠাপিঠি বড়োবোন কথাকে নিয়ে মুশতাক বাবার সংগ্রহ বইপত্রে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ঘাঁটে; ঘুরে বেড়ায় বধ্যভূমিগুলোতে। এই যুদ্ধপাঠের মাঝখানে হঠাৎ একদিন কথা আর মুশতাক আবিষ্কার করে বিয়ের আগে যুদ্ধের দিনে তাদের মা ধর্ষিত হয়েছেন রাজাকার হবু শ্বশুরের কাছে। সেই ধর্ষণের ধারাবাহিকতা মুশতাকের বোন কথা...

মুশতাকের চরিত্রটা করতাম আমি। শেষ দৃশ্যে কোনোদিনও সেট লাইট কিছুই দেখতাম না আমি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠত আমার। ...মুশতাক গলা টিপে খুন করতে যায় মায়ের ধর্ষক নিজের দাদাকে। কিন্তু পারে না। দাদার চেলারা তাকে পিটিয়ে ছুঁড়ে ফেলে রাস্তায়। বিধ্বস্ত মুশতাকের যখন উঠে দাঁড়ানোরও ক্ষমতাও নেই তখন দেখে তার দিকে শূন্য চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার বোন কথা। একটা ঘোরের মধ্যে কথার দিকে হেঁটে যায় মুশতাক কিংবা আমি। ব্যাকগ্রাউন্ডে রানা কুমার সিনহার খালি গলায় রবীন্দ্র সংগীত- জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো...

যতবারই এই দৃশ্য এসেছে। কথার চরিত্রে যেই থাকুক না কেন; কুমু কিংবা হ্যাপি। দুজনের চোখেই তখন গড়িয়ে না পড়া নিঃশব্দ জল। এবং সেখানেই আমাকে জেঁকে ধরতো একটা ঘোর... ঝাপসা। ঝাপসা চোখ... কোনোদিনও চোখে হাত দিয়ে দেখা হয়নি সেই দৃশ্যে আমার চোখে পানি থাকত কি না...

নিজের মাথায় ঠাস করে একটা গাট্টা মেরে আমি ফিরে আসি এস-এস এর গল্পে। আমি তার কথা শুনছি না টের পেয়ে সে গল্প থামিয়ে দিয়েছিল। আমি তাকাতেই সে আবার শুরু করে- এই প্যারাডক্সের উদ্ভব যখন আনিলার গর্ভে রায়হানের সন্তান। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা বা না রাখার টানা পোড়েন। অদ্ভুতভাবে রায়হানের সব কিছু জেনেও আনিলার বিপক্ষে যাওয়া বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা - বাচ্চাটির পরিচয় কী হবে, এটি আদতেই ইনসেস্ট কিনা - ধর্ম ও সমাজের জটিলতা

একেবারে প্রবন্ধের স্টাইলে হড়বড় করে ঘটনাগুলো বলে একটু থেমে একটা বাক্য যোগ করে এস-এস- শেষ অব্দি রায়হানের মার প্রেরণায় বাচ্চাটির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা...

এস-এস এর ঘোষণা ছিল সে আশাবাদী গল্প বলবে। আমি জানি সে গল্পটা নিয়ে কুস্তি করছে নিজের ভেতর। যতবার সে ঘটনাগুলো সাজাচ্ছে ততবারই ঘটনাগুলো চলে যাচ্ছে হতাশার দিকে। তাই বারবার জোর করে তাকে ফিরে আসতে হচ্ছে আশাবাদিতায়। ...ঘোষণা দিলেই কি সব গল্প আশাবাদে গিয়ে শেষ করা যায়?

আমার কথাটা বোধহয় টের পেয়ে যায় এস-এস। অনেকক্ষণ থেমে ধুম করে স্টেটমেন্ট আকারে একটা ইনফরমেশন জুড়ে দেয় গল্পের সাথে- আগামী শতকের গোড়ার দিকে সেই বাচ্চাটি জাতিসংঘের প্রথম বাংলাদেশি নারী মহাসচিব...

কথাটায় অন্যরা যতটা না ধাক্কা খায়। সে নিজেই চমকে উঠে তার থেকে বেশি। একটু কি বেশি হয়ে গেল?

অনেকক্ষণ নিজের সাথে বোঝাপড়া করে সে আবার কথাটা সংশোধন করে শুরু করে- মহাসচিব... হতে গিয়েও হতে পারে না। কারণ নিজের জন্মের ইতিহাস জেনে সে নিজেই কিছুটা বিভ্রান্ত। নিজের নানাকে খুন করে সে

এইবার এস-এস আগাগোড়া ভড়কে যায়। অতক্ষণ সে চিন্তিত ছিল তার বলা ঘটনাগুলোর সংযোগসূত্র নিয়ে। কিন্তু এইবার সে বুঝে যায় আশাবাদী গল্পকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসছে যেখান থেকে হয়ত আর ফিরে যাওয়া সম্ভবই না আশাবাদে। ...মেয়েটা এখন জেলে পচে মরবে। এ তো সেই মধুসূদনের মেঘনাদ বধ হলো। বীর রসে গাওয়ার ঘোষণা দিয়ে করুণ রসে মহাকাব্যের সমাপ্তি...

কিন্তু গল্প যেখানেই যাক শেষ হতে হবে আশাবাদ দিয়ে। এস-এস একেবারে মরিয়া হয়ে উঠে নিজের ঘোষণায় স্থির থাকার। একেবারে শূন্যে দূরের চাগাছে ভরা টিলাগুলোর দিকে তাকিয়ে ইতিহাস বলার মতো ঘোষণা করে সে- তারপর... তারপর কারাগার থেকেই সে চালিয়ে যায় তার যুদ্ধ... যুদ্ধশিশুদের অধিকারে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে...

গল্প কোথায় গেছে পরে দেখা যাবে। আপাতত নিজের শর্ত অনুযায়ী শেষ করা গেছে গল্পটা। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে এস-এসএর। থাক বাবা। আর কথা বাড়াতে গেলেই আরো কোন না কোন বিপদ এসে জোটে। তাই সে এখানেই গল্পের সমাপ্তি ঘোষণা করে একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে- আপাতত এটুকুই থাক

- কিছু যুদ্ধশিশুর সাথে আমার একবার দেখা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৯৬এ দেশের বাইরে থাকা বেশ কজন ৭১এর যুদ্ধশিশু বাংলাদেশে এসেছিল। তাদের অনেকের সাথেই আমার কথা হয়েছে। এদের প্রায় কেউই বাংলা জানে না কিন্তু এদের বেশির ভাগেরই নামগুলো বিজয়- মুক্তি- সংগ্রাম- স্বাধীন... দুজনের হাতে দেখলাম ট্যাটু করে বাংলাদেশ লেখা

সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে প্রসঙ্গটা আমি এস-এসকে বলি। যদি এই সূত্রে সে কিছু যোগ করে। কিংবা যদি সে তার গল্পের মুখটাকে আরেকটু খুলে দেয়। কিন্তু সে নির্বিকার। মুখ তুলে আমার কথাগুলো শুনে আবার মুখ নামিয়ে নেয়। মনে হচ্ছে হাল ছেড়েই দিয়েছে সে। আমি এবার অন্যদের দিকে তাকাই। অন্য যে কেউ হয়ত এখান থেকে সূত্র পেলেও পেতে পারে। আমি আবার সবার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করার মতো বলি- আমাদের এক ফ্রেন্ড ছিল যুদ্ধশিশু। তার নামও ছিল মুক্তি

আমার ধারণা ছিল কেউ না কেউ সেই কাহিনীটা শুনতে চাইবে। কিন্তু কেউ কোনো আগ্রহ দেখায় না। আমি এবার প্রসঙ্গটাকে অন্যদিকে ঘোরাই। মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকি- স্বাধীনতার পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রক্ষণাবেক্ষণে অনেক যুদ্ধশিশু ভূমিষ্ঠ হয়। পরে রেডক্রস এবং কিছু মিশনারির সহায়তায় পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো থেকে যুদ্ধশিশুরা বাইরের বিভিন্ন দেশে চলে যায়। অনেক বীরাঙ্গনাও চলে যান বিভিন্ন দেশে। আবার ৭৫ পরবর্তী সময়ে অনেকেই গিয়ে উঠতে বাধ্য হন দেশের বিভিন্ন পতিতালয়ে। সেই সময়ে সমাজকল্যাণের যিনি মন্ত্রী ছিলেন তার পেছনে আমি বহুদিন ঘুরেছি শুধু সেই ডকুমেন্টগুলো এর পরে কোথায় গেল তা জানার জন্য। কিন্তু পাইনি....

ভেবেছিলাম এবার বোধহয় কেউ না কেউ প্রসঙ্গটাকে ধরবেন। যোগ করবেন নিজেদের অভিজ্ঞতা কিংবা জানা ঘটনা। কিন্তু ঘটনা দেখি পুরো উল্টো। সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে তার পরে কী ঘটল তা জানার জন্য। কিন্তু আমি তো এখানে সাবেক মন্ত্রীর কাহিনী শোনাতে চাইনি। এটা ছিল একটা টোপ

ধ্যাত্তেরি। এই টোপটাও মাঠে মারা গেল। সবাই মুখে স্টেপলার এঁটে বসে আছে

হঠাৎ মাথায় আসে কয়েকটা নাটকের কথা। দেখি নাটকের ঘটনাগুলো কাউকে টানে কি না। একপাশে দাঁড়িয়ে আমি সবার দিকে চোখ রেখে নাটকের ঘটনাগুলো বলা শুরু করি- আমার জানামতে বীরাঙ্গনা নিয়ে তিনটা সফল নাটক হয়েছে বাংলাদেশে। প্রথমটা এসএম সোলায়মানের লেখা ও নির্দেশনায় থিয়েটার আটের কোর্ট মার্শাল। দ্বিতীয়টা নীলিমা ইব্রাহিমের বই ভিত্তি করে মাসুম রেজার লেখা ও রেহানা সামদানীর নির্দেশনায় থিয়েটার সেন্টারের শামুকবাস। আর তৃতীয়টা শামসুল আলম বকুলের লেখা ও নির্দেশনায় দেশ নাটকের ঘর লোপাট

ইনফরমেশনগুলো দিয়ে একটু থামি। সবার দিকে তাকাই। কিন্তু কাউকেই দেখি না ইনফরমেশনগুলো সম্পর্কে আগ্রহী হতে। কিংবা কিছু যোগ করতে

আমি আরেকটু এগোই- এই তিনটা নাটকের সাথেই আমি নিজে যুক্ত ছিলাম। কোর্ট মার্শাল আর ঘর লোপাট সিলেটে কথাকলিও করেছিল। দুটোতেই অভিনয় করেছি আমি। আর থিয়েটার সেন্টার যখন শামুকবাস করে তখন নাটকটা তৈরি হওয়া থেকে শেষ মঞ্চায়ন পর্যন্ত আমি দেখেছি একটু একটু করে...

এইবার আমার চিৎকার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সবার মুখেই আঠা লাগানো। আমি একা একাই বকবক করে যাচ্ছি। অন্য সময় হলে এই কথাগুলোর সূত্র কেউ না কেউ ধরত আমি জানি। কিন্তু এখন আমার কথার সূত্র ধরা মানেই গল্প বলার ফাঁদে পা দেয়া। এটা সবাই বুঝে গেছে। বুঝে তাকিয়ে আছে নির্বিকার

ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দুরবস্থাটা বোধহয় জুবায়ের ভাই বুঝলেন। অসহায়ভাবে সবার দিকে তাকিয়ে থাকা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন- আমার একটা খসড়া উপন্যাস আছে। তার একটা পর্বে যুদ্ধশিশুদের একটা প্রসঙ্গ আছে...

লাফিয়ে উঠলাম আমি। এক সেকেন্ডের একশো ভাগের একভাগ সময়ে রেকর্ডারটা অন করে জুবায়ের ভাইয়ের সামনে রাখলাম। তিনি ওটার দিকে তাকালেনও না। গল্পও শুরু করলেন না। হাতব্যাগের চেন খুলতে খুলতে শুধু এস-এস এর রেফারেন্সটা টানলেন আরেকবার

জুবায়ের ভাই ব্যাগের ভেতরে কী যেন খুঁজছেন। আমি রেকর্ডারটা তার সামনে ধরে বললাম- আপনার গল্পটা বলেন জুবায়ের ভাই

জুবায়ের ভাই রেকর্ডারটা নিয়ে পাশে রাখলেন। ব্যাগ থেকে চুপকথা নামের বিশাল একটা পাণ্ডুলিপি বের করে ২০ নম্বর পর্বে এসে সবার দিকে তাকান
- পড়েন জুবায়ের ভাই

নড়েচড়ে জুত হয়ে বসে তিনি আবার সবার দিকে তাকান। জুবায়ের ভাই পড়া শুরু করা মানে কিছুক্ষণের জন্য হলেও গল্প বানানোর দায় থেকে সবার বেঁচে যাওয়া। তাই সবাই এবার নড়েচড়ে বসে আগ্রহ নিয়ে। আগ্রহের পরিমাণ যেন দরকার থেকে একটু বেশি বেশিই। একটু হাসলেন তিনি। তারপর শুরু করলেন- কয়েক মাস আগে একটি ভিডিও দেখেছিলাম। এ দেশে যাকে হোম ভিডিও বলে, সেই গোত্রের - একজন মানুষের অত্যন্ত ব্যক্তিগত আত্ম-অনুসন্ধানের সফল ও আনন্দদায়ক পরিণতির ছোট্টো দলিল। কিন্তু সব মিলিয়ে তাতে নিদারুণ এক কাহিনীর আভাস। ঘণ্টাখানেক দৈর্ঘ্যরে ভিডিও শুধু পরিণতির ছবিটি দেখায়, সম্পূর্ণ গল্প বলে না। পরে প্রাসঙ্গিক তথ্য, পেছনের গল্পটি জানা হয়।

জুবায়ের ভাইয়ের পড়ার ভঙ্গিটা অসাধারণ। যদিও তিনি কাগজের দিকে তাকিয়েই পড়ছেন। তবুও মনে হয় যেন গল্পটা বলেই যাচ্ছেন তিনি। পড়ার সময়ও যে শ্রোতাদের চোখে চোখে তাকানো যায় এটা তাকে না দেখলে বোঝা কঠিন

তিনি একটু থামেন। বুঝে নেন শ্রোতারা কীভাবে নিচ্ছে গল্পটাকে। ...কেউ মুখে বলে না কিছু। চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তিনি আবার পাণ্ডুলিপির পাতায় চোখ রাখেন- শুরুতে দেখা যায়, বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়ির একটি টেবিলে, সেটি ডাইনিং টেবিল বলে ধারণা হয়, দুটি চেয়ারে বসে আছে দুই নারী। একজন বয়স্ক - চেহারায়, পোশাকে গ্রামীণ মানুষের ছাপ, কথা বলে বগুড়া শহর বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ভাষায়। এই মুহূর্তে তার বয়স অনুমান করা সম্ভব হয় না, ধারণা করা যায় আনুষঙ্গিক কাহিনীটি জানা হলে। অপরজন বয়সে তরুণী, মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলগুলিই প্রথমে চোখে পড়ে। রং-চেহারায় পুরোপুরি বাঙালি ছাপ থাকলেও কথা বলে মার্কিনি ধাঁচের ইংরেজিতে। তার পরনের পোশাকটি অবশ্য কোনো তথ্য জানায় না, আজকাল বাংলাদেশে শহরের অনেক মেয়ে এ ধরনের পোশাক পরে। দুই নারী পরস্পরের ভাষা বোঝে না, তবু তাদের কথোপকথন চলে। একজন মহিলা দোভাষী, যাকে ক্যামেরায় দেখা যায় না, একজনের কথা অনুবাদ করে জানাচ্ছেন অন্যজনকে। অবিলম্বে জানা হয়ে যায়, এই ইংরেজি-বলা তরুণীটি ওই বয়স্কার কন্যা।

জুবায়ের ভাই আবার থামেন। আসরটি গল্প তৈরির। সেখান থেকে আমরা চলে এসছিলাম গল্প বলায়। সেখান থেকে লিখিত উপন্যাসের পাতায়। কিন্তু সেই উপন্যাসটাও আবার বলছে আরেকটা ভিডিও ডকুমেন্টারির কাহিনী। ...চলুক

এর মধ্যে জুবায়ের ভাই আবার সবার আগ্রহ সার্ভে করে নিয়েছেন। এবার সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে সবাই গল্পটায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। গল্প না হয় পরে তৈরি করা যাবে। এই গল্পটা শুনি আগে

মুহম্মদ জুবায়ের শুরু করেন আবার- এদের নাম জানা হয়নি। আমি মনে মনে বয়স্কার নাম দিই আমিনা এবং তরুণীকে সামিনা। তিরিশ বছর পরে দু’জনের এই প্রথম সাক্ষাত। তারা একজন আরেকজনকে ক্রমাগত স্পর্শ করে, অনুভব করার চেষ্টা করে। পরস্পরের অজানা অসম ভাষা তাদের হৃদয়ের যে আর্দ্রতা-ভালোবাসার পূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে পারে না, স্পর্শে তা সঞ্চারিত হতে থাকে। বস্তুত, প্রথমবারের সাক্ষাতে সারাজীবনের বিচ্ছেদ ও অদেখার তৃষ্ণা তবু অপূর্ণ থাকে বলে বোধ হয়। একসময় সামিনা ক্রমাগত চোখের পানি মোছে। মা তাকে বলে, ওঙ্কা কর্যা চোখ মুছপার থাকলে চোখ বিষ করবি রে মা...।

নিঃশব্দে চমকে উঠে আমলকি তলায় বসা শিক্ষিত ও যৌক্তিক চিন্তার সবগুলো মানুষ। জুবায়ের ভাই কি উপন্যাসে কিছু দরকারি কথা বলতে ভুলে গেছেন? প্রশ্নটা কেউই মুখ দিয়ে করে না। কিন্তু জুবায়ের ভাই যেন বুঝে যান সবার প্রশ্ন। মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে আবার তার উপন্যাসের পাতায় চোখ রাখেন। প্রশ্নের উত্তরটা আগেই তিনি দিয়ে রেখেছেন বইয়ে- মা ঠিক জানে, তাই তো সে মা। অনূদিত হয়ে কথাটি মেয়ের কাছে পৌঁছুলে কান্নাচোখেই হেসে ফেলে সে, আমার চোখ সত্যিই ব্যথা করছে, মা।

সবাই আবার রিল্যাক্স হয়ে বসে। আমার হঠাৎ করেই খেয়াল হয় ভাষাটা বোধহয় কোনো দরকারি কিছুই না। অনেক বোবা মা-ই তো একটা শব্দ ব্যবহার করতে না পেরেও সব কথা বুঝিয়ে দিতে পারে তার সন্তানদের। আবার অনেক বোবা সন্তানওতো ঠিকঠাকমতোই সবকিছু বুঝিয়ে দেয় তার মাকে। এখানে মা জানে না ইংরেজি। মেয়ে জানে না বাংলা। তাতে কী?

জুবায়ের ভাই পড়ে যাচ্ছেন- মায়ের মাথায়, কপালে, চুলে, গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেয়ে একবার হাসে, পরক্ষণেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বলে, এতদিন পর সত্যি তোমার দেখা পেলাম, মা গো! এই দিনের জন্যে আমি অপেক্ষা করেছি আমার সারাটা জীবন ধরে!

মেয়ের তুলনায় মায়ের আবেগ খানিকটা নিয়ন্ত্রিত মনে হলেও মুহূর্তে তার চোখও ভিজে ওঠে।

বাতাসটা যেন একটু ভারী হয়ে উঠে। খুশি আনন্দ আর দুঃখের এক মিশ্রণ সবার চোখেমুখে। এই অনুভূতিটা সবাইকে অনুভব করার জন্য অনেকক্ষণ থেমে থাকেন তিনি। তিনি কি এই উপন্যাস লিখেছেন পড়ে শোনাবার জন্য? নাকি পড়ার জন্য? পড়ার জন্য হলে তো শ্রোতাদের রিএকশনের জন্য এতো স্পেস থাকার কথা না

তিনি আবার ফিরে যান সেই ভিডিওর বর্ণনায়- আরো খানিকক্ষণ এই ধরনের কথোপকথন চলে। তাদের পরস্পরকে জানা হয় প্রধানত স্পর্শে ও দর্শনে - আনন্দ-বেদনার বিনিময় ঘটে। তারপর দেখা যায়, মা-মেয়েতে মিলে বগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। আমেরিকানিবাসী এই গ্রামেরই কোনোদিন-না-দেখা মেয়েটিকে প্রথমবারের মতো দেখতে মানুষ ভেঙে পড়ে। মায়ের হতদরিদ্র বাড়িঘর - হয়ত বাংলাদেশের বিচারে অত টা খারাপ নয়, কিন্তু মেয়েটির অনভ্যস্ত চোখে তাই মনে হবে বলে অনুমান হয় - দেখে মেয়ে। দেখে গ্রামের মানুষদের, কোনোদিন না-দেখা একটি ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। ভিডিওটি মোটামুটি এইভাবে শেষ হয়।

-শেষ?
আমার মুখ থেকে ধুম করে প্রশ্নটা বের হয়ে আসে। অন্যদের চোখও তাই বলে। কিন্তু জুবায়ের ভাইয়ের মুখ দেখে বোঝা যায় ভিডিও শেষ হলেও উপন্যাসের পর্বটা শেষ হয়নি। আরো কিছু বাকি আছে। তিনি আবার চোখ রাখেন উপন্যাসের পাতায়- অনেকগুলি অনিবার্য প্রশ্ন, এই দু’জন নারী, যারা পরস্পরের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত, আলাদা হয়ে গিয়েছিল কীভাবে? কেন তাদের প্রথম সাক্ষাতের জন্যে তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে হলো? ভিডিওতে দু’জনের সাক্ষাতের আবেগার্দ্র মুহূর্তগুলো দেখে কৌতূহল বেড়ে উঠতে থাকে। কাহিনীটি পরে জানা হয়। করুণ ও হৃদয়বিদারক সে গল্প, নিবিড় অনুসন্ধানী এক নারীর জয়ী হওয়ার ইতিবৃত্ত।

আমরাও একটু নড়েচড়ে তৈরি হই ভিডিওতে না দেখানো সেই কাহিনী শোনার জন্য। মুহম্মদ জুবায়ের এই অংশটা পড়তে থাকেন অনেকটা দ্রুত; কাগজের পাতা থেকে একবারের জন্যও চোখ না তুলে। যেন চোখ তুললেই তিনি ঘটনা হারিয়ে ফেলবেন- তিরিশ বছর আগে আমিনা ছিল গ্রামে বেড়ে ওঠা সাধারণ কৃষক পরিবারের এক সদ্য-তরুণী। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ পনেরো-ষোলো বছর বয়সী মেয়েদের জন্যে নিরাপদ জায়গা ছিল না। তাদের গ্রাম আক্রান্ত হয়, পাকিস্তানি উর্দিধারীদের হাতে পড়ে আমিনা। সদ্য-তারুণ্যের স্বপ্ন অবিলম্বে রূপান্তরিত হয় এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নে। যে বয়সে চারদিকের পৃথিবী রঙিন হয়ে থাকার কথা, আমিনার জগৎ সেই সময়ে ঘিরে ফেলে এক নিকষ অন্ধকার। পরবর্তী কয়েকটি মাস তার বদ্ধ পৃথিবীতে কালো ছাড়া আর কোনো রং ছিল না, যন্ত্রণা ও গ্লানি ছাড়া কোনো অনুভূতি ছিল না। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। নিজেকে সে আবিষ্কার করে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায়, তার নাম-ধামও জানা নেই। শুধু বোঝে, জায়গাটি নিজের গ্রাম থেকে অনেকদূরে।

পরিচিত আর জানা ঘটনাগুলোকে টুপটুপ করে টপকে যেতে থাকে উপন্যাসের একেকটা বাক্য। আমরা ধরে নেই সেই জানা ঘটনাগুলো এই উপন্যাসের বিষয় না। বিষয়টা আরো পরে। তিনি পড়ে যেতে থাকেন আমিনার সেই সময়ের অনুভূতি আর অনুভবগুলো- একদিক থেকে হয়ত ভালোই হয়েছিল, তখন তার ঘরে ফেরা সম্ভবও ছিল না। শরীরের ভেতরে আরেকজন ক্ষুদ্র মানুষের উপস্থিতির সমস্ত লক্ষণ প্রকাশ্য। অচেনা জায়গাই তার জন্যে স্বস্তিকর। অল্পদিন পরে একটি মেয়ে ভূমিষ্ঠ হলে শিশুটিকে রেডক্রসের লোকদের হাতে তুলে দিয়ে একসময় আমিনা ফিরে যায় নিজের গ্রামে। মেয়েটির জন্যে তার কোনো অনুভূতি বা ভালোবাসা তৈরি হয়নি, তাকে তো আমিনা ভালোবেসে জন্ম দেয়নি। যে বর্বরতার ফসল হয়ে শিশুটি এসেছিল, তার জন্যে সুন্দর অনুভূতি তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না! দুঃস্বপ্ন কোনো ভালো অনুভূতি দেয় না।
- এইটা কী বললেন জুবায়ের ভাই?

হঠাৎ করে আমার মুখ থেকে বের হয়ে আসে প্রশ্নটা
- আপনার একটু আগে বলা ভিডিওর সাথে তো এই কথাটা মেশে না?

জুবায়ের ভাই কোনো উত্তর দেন না। চোখ তুলে আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে আনেন উপন্যাসের পাতায়- এতকিছুর পরেও মানুষের বেঁচে থাকার সহজ প্রবণতাই হয়ত আমিনাকে আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। কালক্রমে নিজের গ্রামেই তার বিয়ে হয়, স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার হয়। তবু কখনো কোনো উদাস মুহূর্তে পরিত্যক্ত মেয়েটির কথা কি কখনো তার মনে পড়েনি? কিন্তু কোনোদিন কাউকে বলা যায়নি সে কথা। ভয়াবহ গোপন কাহিনীটি কারো সঙ্গে ভাগ করা যায় না, নিজের মনের গহিনে লুকিয়ে রাখতে হয়।

এইটুকু পড়ে আমার দিকে একবার চোখ তুলে তাকান তিনি। তার অর্থ হলো আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি কি না। আমি শুধু হাসি। উত্তরটা পরে দেয়া আছে জানলে কি আর প্রশ্ন করি? তিনি আবার চোখ নামিয়ে আনেন পাণ্ডুলিপির পাতায়- সামিনাকে সেই শিশুকালেই রেডক্রসের লোকেরা যুদ্ধশিশু হিসেবে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়। একটি মার্কিন পরিবার তাকে দত্তক নেয়। বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দত্তক নেওয়া পরিবারেরই একজন হিসেবে নিজেকে জেনে এসেছে সে। বড়ো হয়ে একসময় নিষ্ঠুর সত্যটি জেনেছে - সে আসলে যুদ্ধশিশু। তখন থেকে তার অনুসন্ধানের শুরু। সে বুঝে যায়, পৈতৃক পরিচয় কোনোদিনই আর উদ্ধার করা যাবে না, কিন্তু মায়ের সন্ধানে সে অক্লান্ত, একাগ্র হয়ে থাকে। বহু বছরের অনুসন্ধানের পর তার মায়ের পরিচয় ও গ্রামের নামটি সে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। রেডক্রসের কাগজপত্র ঘেঁটে নিশ্চিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী বাংলাদেশের এক বন্ধুর মাধ্যমে সে আমিনার কাছে এই মর্মে খবর পাঠায় যে, হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি তার সাক্ষাৎপ্রার্থী। আমিনা কোনো উৎসাহ দেখায় না, কোনো কথা বলতে আগ্রহী নয় সে, ব্যাপারটিকে সত্যি বলে স্বীকারও করে না।

পুরো পাহাড়ের বাতাস যেন নিশ্বাস বন্ধ করে কান পেতে আছে মুহম্মদ জুবায়ের দিকে। একেকটা প্যারাগ্রাফের পরে তিনি একটু সময় নিচ্ছেন। যারা শুনছে তাদেরকে বিষয়টা হজম করার সুযোগ দিয়ে আবার শুরু করছেন- আমিনার মৌখিক অস্বীকারের যুক্তি বোঝা দুরূহ নয়। যে সত্য এত বছর ধরে সে আড়ালে রেখে এসেছে, স্বামী-সন্তান-সংসারের বাস্তব পৃথিবীতে যে সত্যের কোনো অস্তিত্ব এতদিন ছিল না - সেই সত্য যাবতীয় অন্ধকার ও দুঃখস্মৃতিসহ এখন সামনে এসে উপস্থিত হলে তাকে মেনে নেওয়া সহজ নয়। তার সমস্ত পৃথিবী যে ওলটপালট হয়ে যাবে! জানাজানি হলে মানুষের কাছে মুখ দেখাবে সে কী করে? আরো কঠিন কথা, যে মেয়েকে জন্মের পরেই সে পরিত্যাগ করেছে, নিজের সন্তান বলে স্বীকৃতি দেয়নি মনে মনেও, মায়ের পরিচয়ে তার সামনে দাঁড়াবে কোন দাবিতে?

প্রশ্নটা কি তিনি আমাদের করলেন না উপন্যাসের পাতা থেকে পড়লেন? আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করি। তিনি আবার চোখ নামিয়ে নেন পাণ্ডুলিপির পাতায়- এই দোটানারও একদিন সমাপ্তি ঘটে। সামিনা আরো কয়েকবার চেষ্টা করেও আমিনার মন গলাতে সক্ষম হয় না। শেষমেশ সামিনা খবর পাঠায়, সে বাংলাদেশে আসছে এবং নিজে মায়ের সামনে দাঁড়াবে। তখন দেখবে, কেমন করে মা তাকে অস্বীকার করে, ফিরিয়ে দেয়!

আমিনার তখন সত্যের মুখোমুখি না হয়ে আর উপায় থাকে না। বুকভরা আকুতি ও চোখভরা জল নিয়ে সে ঢাকায় আসে মেয়ের সঙ্গে মিলিত হতে। তিরিশ বছর পর।

একবারের জন্যও পাণ্ডুলিপির পাতা থেকে চোখ না তুলে। কাউকে বিন্দু মাত্র সুযোগ না দিয়ে একশ্বাসে জুবায়ের ভাই পড়ে যান এই অংশটুকু। পড়ে সবার দিকে তাকান। তিনি খেয়াল করেন সবগুলো মুখে অনেকগুলো প্রশ্ন। এই অংশটিতে অনেকগুলো ইনফরমেশন গ্যাপ রয়ে গেছে। এবার আমি আর কোনো প্রশ্ন করি না। আমি বুঝে গেছি মুহম্মদ জুবায়ের আগের প্যারায় অনেক ইনফরমেশন ছেড়ে এসে পরের প্যারায় বলেন। আমি তাকিয়ে থাকি। তিনি শুরু করেন আবার- তার আগে এই লুকিয়ে রাখা কাহিনীটি স্বয়ং আমিনাকেই উন্মোচন করতে হয় স্বামী ও পুত্রের কাছে। গ্রামের প্রতিবেশী ও আত্মীয়-পরিজনের কাছে। বিস্মিত হয়ে সে দেখে, তার আশঙ্কা কিছুমাত্র সত্যি হয়নি। তার চেনা পৃথিবী উল্টে যায়নি। কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করেনি, অভিযোগের আঙুল তার দিকে তোলেনি, কলঙ্কের ছবিও কেউ আঁকতে বসেনি। বরং ভালোবাসা, সহানুভূতি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। আমিনা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে, মানুষ আজও মানুষ আছে। গ্রামের বয়স্কদের মনে সেই সময়ের স্মৃতি এখনো খুবই জাগ্রত। তারা জানে, মানুষের মতো দেখতে একদল অমানুষ আমিনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল, কিন্তু তাতে সে কিছুমাত্র অপবিত্র হয়নি। সেই মানুষেরা আরো জানে, সামিনার জন্মের ইতিহাসটি তার নিজের রচিত নয়, সেই ইতিবৃত্ত রচনায় তার কোনো ভূমিকা ছিল না। যে মানুষটি আমিনার স্বামী, সামিনাকে সে আপন কন্যার øেহ দিতে কার্পণ্য করে না, এবং তার পুত্র - সম্পর্কে সামিনার সৎভাই - সামিনাকে বোন বলে জড়িয়ে ধরে। দুই ভাইবোনে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদে।

সামিনা ও আমিনার প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটিতে ভিডিওর শুরু। বেদনাময় মধুরতায় পরিসমাপ্তি।

খুব ধীরে ধীরে। পজ দিয়ে এই অংশটা পড়েন তিনি। পড়া শেষ করে আবারও তাকান সবার দিকে। কিন্তু আমি নিশ্চিত হয়ে যাই। উপন্যাসে যে ভিডিওর বর্ণনা আছে সেরকম কোনো ভিডিও পৃথিবীতে নেই। ওই ভিডিওটা মুহম্মদ জুবায়েরের কল্পনায় তৈরি। সেই কাল্পনিক ভিডিওটাই দেখছে তার উপন্যাসের চরিত্র। আমার দিকে তাকিয়ে আমার অবিশ্বাসটা পুরোপুরি ধরতে পারেন তিনি। মুখে কিছু না বলে পাতা উল্টে গলাটা একটু উঁচু করে এক নাগাড়ে পড়ে যেতে থাকেন পরের অংশটুকু। যদিও আমি নিশ্চিত না তিনি সত্যি সত্যি উপন্যাসের পাতা থেকে পড়ছেন নাকি উপন্যাসের পাতায় চোখ রেখে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন- যুদ্ধ, বিপ্লব বদলে দেয় রাষ্ট্র ও সমাজ, তা হয় ইতিহাসের উপকরণ। তার প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তিমানুষের জীবন পাল্টে যায়, যুদ্ধের হিংস্র ও দয়াহীন নখর গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত রেখে যায় কতশত মানুষের জীবনে - তারই একটি অসামান্য গল্প-দলিল এই ভিডিও। এই দলিল ইতিহাস বটে, তবে তা ব্যক্তিগত। কেতাবি ইতিহাস ব্যক্তিমানুষের জীবন বা তার অনুভবের কারবারি তো নয়!

পাণ্ডুলিপি গুটিয়ে ব্যাগে রাখতে দেখে আমরা অনুমান করি মুহম্মদ জুবায়ের তার পড়া শেষ করেছেন। কেউ কিছু বলে না। আমার মাথায় শুধু ঘুরপাক খায় এর আগের গল্প এস-এস শেষ করেছিল আশাবাদ দিয়ে। সে শুরুতেই বলেছিল সে আশাবাদী। কিন্তু মুহম্মদ জুবায়ের কেন জোর করে এত আশাবাদী হলেন? তবে কি তিনি জানতেন যে এখানে জোর না করলে আশাবাদী হওয়া সম্ভব না? আশাবাদী কি হতেই হবে? আমি কিছু বলি না। তার দিকে আর তাকাইও না। প্রসঙ্গের গুমোট কাটাতে চেপে ধরি নজমুল আলবাবকে- বল এবার তুই বল। এখানে কাউকে শ্রোতা হিসেবে আনা হয়নি। বল

নজমুল আলবাব বলাবলির ধারে কাছেও যায় না। উল্টো রাজনীতিবিদদের মতো হাত উঁচিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুরু করে- এই লোক এইভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে নাটকের ঘরে। রোজ রোজ নানা কথা উপকথায় মাথায় গিট্টু লাগায়া দিত। এখন দেখি এইখানেও শুরু করছে!!!
- আমি আমার সম্পর্কে কমেন্ট চাইনি। কমেন্ট চেয়েছি গল্পটা সম্পর্কে। এইবার লেকচার বাদ দিয়ে তোমার একস্লিপ জার্নাল টাইপে দুয়েকটা পয়েন্ট দিয়ে দাও। তারপরে আমার পিণ্ডি চটকাও

আলবাব আরো চেতে উঠে আমার কথায়- কেন এইখানে দেবো কেন? পারলে নিজেই লিখুম, নিজের বাড়িতে। আইডিয়া দিছেন বইলা কি একেবারে টাসকায় উঠে গেলেন নাকি?

এ তো আরেক বিপদ। এ তো দেখি পলিটিশিয়ানদের মতো নিজে উঠার সময় রীতিমতো আন্দোলন করে বের হয়ে যাচ্ছে। কোন সময় না আবার অন্যদেরকেও উঠতে বলে। তাই তাড়াতাড়ি বললাম- ঠিক আছে তোর লেখা তুই বাড়িতে লেখ। তাতেও একটা কাজের কাজ হবে। কিন্তু এখন পয়েন্টগুলো জানা থাকলে কিছু সুবিধা হতো গল্পটা লেখায়

আলবাব উঠে হাঁটতে হাঁটতে বলল- সত্যি হলো খুব দৌড়ের উপরে এখন

সুলতানা পারভীন শিমুল সম্ভবত আগেই ধরে নিয়েছিল যে এবার তাকে ধরা হবে। কিছু বলার আগেই সে কৈফিয়ত দেয়া শুরু করে- আমার পেটে বোমা মারলেও এই প্রস্তাবনার উপযোগী কোনো গল্প বেরোবে কি না সন্দেহ। ভীষণ শ্রদ্ধা নিয়ে আমি শুধু তাঁদের স্মরণ করি আর...
- আঁতলামি করিস না মাইয়া। মাইর খাবি

রেকর্ডারটা ওর কাছে রেখে বললাম- আঁতলামি ছেড়ে তোর কল্পনার স্টক থেকে পোকায় খাওয়া কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ দুচারটা কল্পনা এখানে দে

ঝাড়িতে কাজ হলো। একটু গলা কেশে নিয়ে শিমুল শুরু করে- যুদ্ধ শেষে একে একে অনেকেই যখন ফিরে আসতে থাকে, ফিরে আসে রতনও। যুদ্ধে যাবার আগে পরাধীন ভূমিতে সে রেখে গিয়েছিল তার কিছু স্বপ্ন। কথা দিয়ে গিয়েছিল, যদি ফিরতে পারে, ছোট্ট একটা ঘরে সাজাবে তার সব স্বপ্ন। তার স্বপ্নের মানুষ পিয়ালিকে নিয়ে। সেই পিয়ালি তার সমস্ত চপলতা হারিয়ে যখন ওর সামনে দাঁড়ায়, বুকটা ভেঙে চুরে যায় রতনের। পিয়ালি ছলছল চোখে জানায়, তার প্রিয়তম মানুষটিকে দেবার মতো তার কাছে আর কিছুই নেই। তিন তিনটে মাস তার কেটেছে পাক হানাদারদের ক্যাম্পে। সেইসব সময়ের কথা মনে করে আতঙ্কে শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে পিয়ালি।

শিমুল চারপাশে তাকিয়ে আবার শুরু করে- পরম মমতায় ওকে কাছে টেনে নেয় রতন। “আমি একভাবে যুদ্ধ করেছি, আর তুই করেছিস অন্যভাবে। তোকে ছোট করে দেখার ক্ষমতা আমার নেই রে পিয়ালি। মন ছোট করিস না।

শিমুল একটু থেমে রতন আর পিয়ালির অনেকগুলো সময় পার হয়ে গিয়ে আবার অন্য ঘটনায় ঢোকে- ঘর বাঁধে ওরা। কিছুদিন পর পিয়ালির সারা দেহে ফুটে ওঠে মাতৃত্বের চিহ্ন। ক্রমেই বিষণœ হতে থাকে রতন। রাতের বেলা পিয়ালি যখন ঘুমিয়ে থাকে, বিছানা থেকে উঠে বাইরে এসে হু হু করে কাঁদে ও। কেন মেনে নিতে কষ্ট হয় ওর? কিন্তু কষ্ট যে হয়। পিয়ালিকে সব, সব কষ্ট থেকে আগলে রাখতে চায় ও। কিন্তু বাচ্চাটা...? যে শত্র“দের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে, সেইসব পিশাচদের কোনো একটার বাচ্চা...। কীভাবে সম্ভব?

ঢেকে রাখতে চাইলেও ঢাকে না সব। পিয়ালি টের পায় রতনের ভাঙচুর। আরো একবার নিজেকেই দায়ী মনে হয় ওর। ভালোবাসার মানুষটার কষ্ট সহ্য হয় না ওর। রতনের অজান্তেই ঘর ছেড়ে পথে নামে সে...

শিমুল হঠাৎ থেমে সবার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়- এটা কি আদৌ কিছু হলো?

- না হওয়ার কী আছে। পুরো একখান কাহিনী বলে দিয়ে আবার বলে আদৌ কি কিছু হলো? ইহাকে বাংলায় বলে বিনয়... থ্যাকংস ম্যাডাম। কিন্তু আরো চাই

কিন্তু শিমুলের কাছ থেকে আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। সে গল্পটাকে তার দিক থেকে শেষই করে ফেলেছে। তবে গল্পটা যেখানে অতক্ষণ বীরাঙ্গনা থেকে সরে গিয়ে যুদ্ধশিশুতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। শিমুল জোর করে হলেও তাকে আবার মূল জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে এসছে। মেয়েটাকে আবার নিয়ে গেছে রাস্তায়। যেখানে মায়ের দেখা সেই বীরাঙ্গনা দৌড়ে বেড়াত একা একা। যে রাস্তাতে তার মুখে আমার মা শুনেছিলেন- ও মাইও মাইও গো...

যদিও এই গল্প থেকে সেই রাস্তার দূরত্ব বহু বহু দূর। তবুও চলতে থাকলে হয়ত সেখানেই পৌঁছে যেতে পারব আমরা। কিন্তু আরো শক্ত কাঠামো দরকার। পিয়ালিই যদি সেই নারী হয় তবে তার সেই হাহাকারের জন্য আরো কিছু চাই। আরো। না হলে পিয়ালির কণ্ঠে সেই চিৎকারটা মানাবে না মোটেও...

০৯

তৃতীয় দিনটা শুরু হলো একটা বিশাল কনফিউশন নিয়ে। গতকাল অনেকগুলো গল্প জমা হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো গল্পই নন্দিতা কিংবা পিয়ালিকে নিয়ে যেতে পারেনি বিয়ানি বাজারের রাস্তায়। এমন কোনো ঘটনা এখনও দাঁড়ায়নি যে ঘটনা অনিবার্যভাবে নন্দিতার গলা থেকে সেই চিৎকারটা বের করে আনতে পারবে। আমার নিজের উপর সন্দেহ হয়। আমি কি সবাইকে মিস গাইড করছি? নাহলে সবাই তো আসছে গল্পটাতে কিছু না কিছু যোগ করার জন্য। তাহলে কেন মূল বিন্দুটাই সবাই মিস করছে?

রেকর্ডারটা বারবার বাজিয়ে শুনি আমি। অনেক অনেক গল্প। কিন্তু আমার গল্প কই?

আমাদের এখানে শিমুল দুইজন। সুলতানা পারভীন শিমুল আর আনোয়ার সাদাত শিমুল। গতকাল শেষ করেছিল সুলতানা পারভীন শিমুল। আজকের গল্প শুরু হতে পারে আনোয়ার সাদাত শিমুলকে দিয়ে। তাকে বলতেই সে হাত জোড় করে বসল- দুঃখিত। এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না আমি।

কথাটা বলেই শিমুল পকেটে মোবাইল হাতড়াতে লাগল। বাটন টিপে আবার আমার দিকে তাকায়- বারবার একটা ভিডিওর কথা মনে পড়ছে আমার। প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিন চোখ ভিজে উঠেছিল। আজও

ভিডিওটা প্লে করে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের উপর একটা ডকুমেন্টারি। ষোলো বছরের বিধবা তায়িফা। চৌদ্দ বছরের রওশন আরা আর তেরো থেকে বিশ বছরের আরো অসংখ্য বীরাঙ্গনার কাহিনী। কেউ থাকে নিজের বাড়িতে। বেশিরভাগই পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কেউ গর্ভবতী। কারো কোলে ছোট ছোট শিশু। কাউকে পরিত্যাগ করেছে বাবা মা। কাউকে তালাক দিয়েছে স্বামী

কিন্তু আমি এই গল্প থেকে আমার গল্পের কিছুই পাই না। তায়িফা- রওশন সবাই কোথাও না কোথাও আছে। কেউ ক্যাম্পে। কেউ নিজের বাড়িতে। কিন্তু আমার দরকার সেই ঘটনা। যে ঘটনায় তায়িফা কিংবা রওশন আরা পাগলের মতো রাস্তায় চিৎকার করে বেড়ায়- ও মাইও মাইও গো...

শিমুলকে তার মোবাইলটা ফিরিয়ে দিয়ে অন্যদের দিকে তাকাতেই দেখি কথা শুরু করেছে মৌরি নিষাদ। শুরুতেই একটা দ্বিমত- আপনার এই প্রস্তাবনার সাথে আমি পুরোপুরি একমত না। আমি বুঝতে পারছি না বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সাবই মিলে কল্পগল্প তৈরি করার আইডিয়াটা চমৎকার না ধৃষ্টতা?

- মানে কী? তিন দিন পরে এসে গল্প তৈরির প্রসঙ্গ নিয়েই প্রশ্ন তোলে?

কিন্তু মুখে আমি বলি না কিছুই। রেকর্ডারটা শুধু তার দিকে এগিয়ে দেই। মৌরি একটু থেমে হয়ত অনুমান করে গল্প তৈরি নিয়ে প্রশ্ন তোলার বোধহয় জায়গা নেই। তাই বাকি সবাইকে ছেড়ে পুরো বিষয়টা নিজের উপর নিয়ে নেয় এবার- বিশেষ করে আমার জন্য, যার মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা বাস্তবে নয়, গল্প থেকে; দৃষ্টিতে নয় স্মৃতিতে এবং অনুভূতির চাইতেও বেশি কল্পনায়

- হ। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ছাড়া গল্প লেখা যায় না? তাইলে মানুষ যে অত অত মরার কাহিনী লিখে; সেগুলো কি লেখকরা নিজের মরার অভিজ্ঞতা থেকে লেখে?

মৌরি আমার কথা শুনল নাকি মেনে নিলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। সে আমাকে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য কিছুক্ষণ থেমেছিল শুধু। আমি শেষ করতেই আবার শুরু করে আগের জায়গা থেকেই- ৭১ এর নির্মমতা, কষ্ট, গৌরব সবই আমি ধারণ করার চেষ্টা করি মাত্র, কিন্তু কতখানি করতে পারি তা জানি না। এরকম অভিজ্ঞতা নিয়ে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে আমি আসোলেই বেশ অনেকখানি বিব্রত...

ভূমিকাই তো দেখি শেষ হয় না। গল্প শুরু করবে কখন? কিন্তু মৌরি আমার চিন্তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে তার কথা সে বলেই যেতে থাকে- আমরা বোধকরি সবাই বিশ্বাস করি যে বীরাঙ্গনা আসোলে কোনো উপাধি বা নাম সর্বস্ব শব্দ না, বরং এটি একটি অনুভূতি। শুধু অনুভূতি না, এক গভীর অনুভূতি যার বিভিন্ন স্তরে আছে নির্মমতা, অসহায়ত্ব, গ্লানি বা ধিক্কার বা লজ্জা, আত্মত্যাগ, তৃপ্তি, আশা, অহংকার, গৌরব... আরো হয়ত অনেক কিছু। আমার পক্ষে শুধু গল্প পড়ে বা শুনে নিজের কল্পনাকে সাজিয়ে একই চরিত্রে এতগুলো বিষয়ের সম্মিলন ঘটানো সম্ভব না। আর যদি তা করতে নাই পারি তাহলে আমার প্রশ্ন- বীরাঙ্গনা বা তাদের অনুভূতিকে একটি কাল্পনিক গল্পের মধ্য দিয়ে অসমাপ্ত প্রকাশ ঘটিয়ে তাদেরকে অসম্মান বা ছোট করার অধিকার আমাদের কতখানি?

এতো মহা মুশকিলে পড়লাম। তিন নম্বর দিনে এসে ঘুরে ফিরে সে আমার গল্প তৈরি করার বিষয়টাকেই বারবার উড়িয়ে দিচ্ছে। এই দুইদিন ধরে যে অতটা লোক নিজের মতো করে গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে গেল তারা কি বিষয়টা ভাবেনি?

মৌরি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। সবার দিকে তাকিয়ে হয়ত অনুমান করল যে সে আবারও গল্প তৈরির বিষয়টাকেই বাতিল করে দিতে যাচ্ছে। অথবা হয়ত সে ছাড়া বাকি সবাই-ই বিশ্বাস করে যে এটা নিয়ে গল্প তৈরি হতেই পারে

এবার সে নিজের কথাগুলোকে ব্যালান্স করার চেষ্টা করে- তবে হ্যাঁ, যদি আমি মুক্তিযুদ্ধকে একটা সময়ের প্লট ধরে নেই আর ঘটনার মেয়েটাকে; যাকে আপনি পাগলি বলছেন, সমাজের সুফিয়া বা রহিমা বা নাসিমা নামের যে কোনো একটি চরিত্র হিসেবে নেই এবং তার পাশাপাশি তার ওই ডায়ালগ: ও মাইও, মাইও গো। মাইয়া লোকরে অত অত্যাচার’। ...একে যদি ৭১ আর ২০০৮ এর মধ্যকার একটি সেতু ধরে নেই তাহলে কল্পগল্পে চমৎকার কোনো ভিত্তি হয়ত পাওয়া যেতে পারে।

বিশাল লেকচারটা শেষ করে মৌরি বসে পড়ে। গল্পের ধারে কাছেও যায় না। সবাই ঘুরপাক খাচ্ছে বাইরের স্তরে। প্রচণ্ড হতাশ লাগে আমার...

হতাশ হয়ে আমার বসে পড়া দেখেই হয়ত অনিন্দিতা চৌধুরী কিছু একটা বলার চেষ্টা করে- সবাই এত চমৎকার আইডিয়া দিচ্ছেন যে চুপ চাপ শোনা ছাড়া আমার করার কিছুই নেই। এবিষয়ে বলার মতো কোনো যোগ্যতাই আমার নেই।

আবার সেই ভূমিকা। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে ব্যথায়। আমি কিছুই বলি না। শুধু তাকিয়ে থাকি। অনিন্দিতা আরেকটু এগোয়- এখানে দুয়েকটি মতামতও এসেছে - যুদ্ধ ফেরত স্বামী ঘরে ফিরে তার বীরাঙ্গনা স্ত্রীকে মেনে নিতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত স্ত্রী সমুদ্রের দিকে ছুটে যান আত্মাহুতির জন্য। আমি এ জায়গায় শুধু যোগ করতে চাই

এবার আমি রেকর্ডারটা অনিন্দিতার কাছে এগিয়ে দেই। যাক গল্পের দিকে ফিরে আসছি তাহলে আমরা

অনিন্দিতা আগের রেফারেন্স ধরে বলতে থাকে- সেখানে তার কিছু যুদ্ধশিশুর সাথে দেখা হয়ে যায় যারা কোনো চিলড্রেনস হোমে লালিত পালিত হচ্ছে। এদের দেখে তার নতুন উপলব্ধি হয়, বাঁচার ইচ্ছে জেগে উঠে। তিনি সেখানেই থেকে যান।

- তারপর। সেখান থেকে- ও মাইও মাইও গোতে আসবে কী করে?

প্রশ্নটা বেশ জোরেই আমার মুখ থেকে বের হয়ে যায়। কথাটা শুনে অনিন্দিতা একেবারে হাল ছেড়ে দেয়- এরপর ঘটনার ডালপালা ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেওয়া যেতে পারে এস-এস এর চমৎকার আইডিয়া অনুযায়ী
- কিন্তু কীভাবে?
- আর কল্পনায় কুলোচ্ছে না। এটাও কোনো নাটকের কাহিনীর মতো হয়ে গেল কিনা বুঝতে পারছি না। বরং আপনারা বলেন আমি শুনব। সবাই বললে শুনবে কে?

কিন্তু সবাই শুনলে বলবেটা কে? গল্পটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেয়া যেতে পারে। সমুদ্র পারে নেয়া যেতে পারে। এইসব অসংখ্য যেতে পারের বুদ্ধি আমিও দিতে পারি। কিন্তু কীভাবে?

নাহ
আজকের দিনটা প্রায় ফাঁকাই গেল প্রথম দিনের মতো...

১০

পরের দিন শুরুতেই ক্যামেলিয়াকে ধরে বসি গল্প বলার জন্য। বীরাঙ্গনা নিয়ে যে তিনটি নাটকের কথা পরশু বলেছিলাম তার একটা শামুকবাস। শামুকবাসের কেন্দ্রিয় চরিত্রটি করেছে ক্যামেলিয়া আলম। আমি ইচ্ছা করেই তাকে আগে ঘাঁটাইনি। আমার আশা ছিল যে কোনো জায়গা থেকে সে গল্পটার স্টিয়ারিং ধরবে। কারণ সেই নাটকটা তৈরির সময় সে যেমন বিষয়গুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। তেমনি মঞ্চে যখন অভিনয় করত তখন একেবারেই যেন আত্মমগ্ন হয়ে যেত চরিত্রের সাথে। কিন্তু এই কয়দিনে সে একটা কথাও বলেনি

ঠিক কোন জায়গায় আমি ক্যামেলিয়ার কমেন্ট আশা করি তা যেন সে আগে থেকেই অনুমান করতে পারছিল। রেকর্ডারটা বাড়িয়ে দিতেই সে অস্ফুটে প্রথমে উচ্চারণ করে- বীরাঙ্গনা... বীরাঙ্গনা হিসেবে মঞ্চে উঠেছি ক’বার। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হানা দিয়েছি পতিতার কাছে। ওর চোখ - ওর মুখ থেকে জীবনের কোনো গল্পই উঠে আসেনি। শুধুই ক্লান্তি ছাড়া।

সবাই তাকিয়ে আছে ক্যামেলিয়ার দিকে। তার নিজেকেও এখন মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ক্লান্ত এক মানুষ। গলায় সেই ক্লান্তিটা ধরে রেখেই ক্যামেলিয়া বলে যাচ্ছে- বীরাঙ্গনা শব্দটি আমার কাছে এক প্রকাণ্ড ক্লান্তি - যেখানে না আছে অনুভূতি- না আছে অবসাদ - না আছে স্মৃতি। পরম ধ্যানী হয়েও যার মস্তিষ্কের সুতার বাঁধনগুলো আর জোড়া লাগে না

- হতে পারে ক্লান্তি। আমি সেই ক্লান্তির কথাগুলোই জানতে চাই। বল

ক্যামেলিয়া আমার কথা হয়ত শুনলই না। সে তার মতোই বলতে থাকে- ওদের নিয়ে গল্প... এখনও সম্ভব না। আরও কম বয়সে হয়ত সম্ভব ছিল অথবা আরও পরিণত বয়সে। যেখানে সমস্ত জীবনের খাঁজগুলো হবে অনড় আর স্থবির। আমি অপেক্ষায় রইলাম নিজের কাছে।

ক্যামেলিয়া নিজেই শুধু শেষ করল না। পুরো উদ্যোগটাকেই শেষ করে দিলো এক কথায়। সারা দিনে আর কেউ একটা শব্দও বলল না। আমিও চাপাচাপি করলাম না কাউকে। করে কী লাভ। বলতে না পারলে জোর করে কি আর বলানো সম্ভব?

১১

পাঁচ নম্বর দিনে আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবার কথাগুলো শুনি বারবার। অনেকগুলো ঘটনা। অনেকগুলো গল্প। কিন্তু আমার গল্পটা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। অতগুলো ঘটনার নিয়েও গল্পটা পৌঁছাতে পারছে না রাস্তায় দৌড়ানো সেই মেয়েটির কাছে। কোনো সংলাপই পৌঁছাতে পারছে না- ও মাইও মাইও গো বিলাপের কাছাকাছি

একটা মানুষও আর এলো না আজ। ছয় নম্বর দিনও না। সাত নম্বর দিনও গেল ফাঁকা

অত কিছু করেও যে গল্পটা দাঁড় করানো যায়নি সেটা কি আদৌ আর দাঁড়াবে?

১২

গল্পগুলো নাড়তে নাড়তে থার্ড আইয়ের দেয়া নন্দিতা নামটা কানে বাজতে থাকে বারবার। হঠাৎ করে একটা শোনা কাহিনী মনে পড়ে যায়। কাহিনীটা কোনো এক নন্দিতার... এক সংখ্যালঘু নারীর... কোনো এক বীরাঙ্গনার

কিন্তু সে কাহিনীর সাক্ষী কে? সেই গল্প বলবেটা কে?

একজন বলতে পারেন। হয়ত পারেন... তিনি পঁচিশে মার্চ রাতের গণহত্যার প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদকারী নিজাম উদ্দিন লস্কর ময়না

১৯৭১ এর পঁচিশে মার্চ রাত সাড়ে বারোটায় সিলেটের বিশ্বনাথ থানার রায়কেলি গ্রামে চলন্ত মঞ্চ নাটক থামিয়ে দিয়ে নাটকের কুশলী অভিনেতা আর দর্শকদের নিয়ে গণহত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেন নির্দেশক নিজাম উদ্দিন লস্কর ময়না...

গণহত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ আর কি কেউ করেছিল তার আগে? আমার জানা নেই

আমার এই গল্পের সাক্ষী হতে পারেন তিনি। কিন্তু তিনি কোথায়? তাকে তো এখানে আসার কথা বলা হয়নি। তাহলে?

আমি ময়না ভাইকে ফোন করি। গল্পের কথা কিছুই বলি না তাকে। আমি তার সাথে তার লেখা যুদ্ধের স্মৃতিকথার বই- একাত্তরে রণাঙ্গনে’ নিয়ে কথা বলি

বালাটা সাব সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা নিজামউদ্দিন লস্করের চোখের উপর ঘটে যাওয়া নয় মাসের কাহিনী এই একাত্তরে রণাঙ্গনে বইটা। তার বই থেকে আমি তাকে টেলিফোনে কোটেশন শোনাই-ইতিহাস তৈরি হয়, লেখা হয় না। একজন সতীর্থের ফেরার অপেক্ষায় গোটা ক্যাম্প উদ্বিগ্ন; এই চিত্র কি মহান মুক্তিযুদ্ধের নয়? এই চিত্র কি শুধু বালাটের? সমগ্র বাংলাদেশের এগারোটি সেক্টরের, প্রতিটি সাব সেক্টরের একই চিত্র।’

এই একটা সূত্রই ময়না ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট। আমি অপেক্ষা করি। ময়না ভাই লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে শুরু করেন সেই সময়ের আরো ঘটনা; যেগুলো বইয়ে লেখা হয়নি। যেগুলো লিখে কুলানো সম্ভব না। সেই ঘটনাগুলোর আরো কিছু ঘটনা

কিন্তু ময়না ভাইয়ের কাছ থেকে আমি সেই কাহিনীগুলো শুনতে চাই না। আমি অন্য কিছু শুনতে চাই। আমি এবার তার বই থেকে তাকে আরেকটা অংশ মনে করিয়ে দেই- ময়না ভাই স্বাধীন হবার মাত্র কিছুদিন আগে যখন আপনি হাসপাতাল থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে আবার ব্যারাকে ফিরে আসার পথে আপনার এক খালার সাথে দেখা করেন। তখন যুদ্ধে আপনার আহত হওয়া। আপনার স্বপ্ন। দেশে ফিরে যাবার আকুতি। সবকিছুকে বাদ দিয়ে তিনি বলে উঠেন- দেখে নিস। ওরা দৌড়ে যাবে তোর আগে, আর তুই যাবি ওদের পেছনে; খোঁড়াতে খোঁড়াতে...

তিনি কাদের কথা বলছিলেন ময়না ভাই? কেন বলেছিলেন এমন কথা?

টেলিফোনের ওপাশে ঝিম মেরে যান ময়না ভাই। তার স্মৃতির তোলপাড় আমি অনুমান করি। যে কথাগুলো তিনি বইয়ে লিখতে চাননি। একটা কথার সূত্র ধরে আমি সেই জায়গাটাতে টোকা দিয়েছি

ময়না ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আমি আর কোনো সময় দেই না তাকে। প্রশ্নটাকে আরেক ধাপ সামনে নিয়ে যাই- ময়না ভাই। আপনার যে বন্ধুরা একই ব্যারাক থেকে। একই বিপদের মধ্যে যুদ্ধ করেছে একাত্তরে। স্বাধীনের পরে আপনার সেই বন্ধুদের কয়জন কয়জনের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে ধরেছে সেই কথাগুলো কি আমাকে বলবেন?

এই প্রশ্নটায় ময়না ভাই হাসেন। কোনো উত্তর দেন না। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে ফোনের ওপাশে শুনি ময়না ভাইয়ের বিষণœ গলা- লীলেন। তোমাকে শুধু এইটুকু মনে রাখতে বলব; তুমি যতটুকু জানো। আমি জানি তার থেকে বেশি। আর এগুলো তোমাকে যতটুকু পোড়ায়। আমাকে হয়ত পোড়ায় তার থেকেও অনেক বেশি
- তাহলে?
- তাহলে শেষ পর্যন্ত যদি আমরা কিছু বলতে না পারি; তোমাদের জানা থাকল। তোমরা বলো...

ময়না ভাইকে কথা গুছিয়ে ওঠার সময় দিতে চাই না আমি। প্রথম প্রশ্নটা আবারও করি অন্যভাবে- আপনার খালা কাদের কথা বলছিলেন? তাদের অনেককেই আমরা আপনার মতো মুক্তিযোদ্ধা বলে চিনি তাদের দাবির কারণে। আপনি কি বলবেন তারা কারা? তাদের মধ্যে কি আপনার বন্ধুরাও আছে? অথবা না থাকলেও কি তাদের দলে এরপরে আপনার কোনো মুক্তিযোদ্ধা যোগ দেয়নি?

ময়না ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন- হয়ত চিনি। হয়ত না। অথবা হয়ত চিনতে চাই না তাদের

কিন্তু ময়না ভাই যদি ওদের চিনতে না চান তাহলে আমার গল্প শেষ হবে না। আমি আরেক ধাপ এগিয়ে ময়না ভাইকে সিলেট শহরের একটা হোটেলের কথা মনে করিয়ে দেই। ময়না ভাই চমকে উঠেন টেলিফোনের ওপারে- এসব থাক এখন

আমি তার কথা শুনি না। আমি বলে যেতে থাকি- গুলি খাওয়া পা নিয়ে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে আপনি যখন স্বাধীন দেশে ঢুকলেন তখন আপনার সতীর্থ যোদ্ধাদের অনেকেই গুছিয়ে নিয়েছে অনেক কিছু। আপনি এসে দেখলেন আপনার বন্ধুরা শহরের একটা হোটেলে দখল করে আড্ডা দেয়। নিজেদের যুদ্ধ বিজয় উদযাপন করে...

আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি ময়না ভাই বুঝতে পারছেন না আমার কথায় হ্যাঁ কি না বলবেন। তিনি কথা খুঁজে বেড়ান। কিন্তু আমি তাকে কোনো কথা খুঁজতে দিতে চাই না। এই উত্তরগুলো আমার জানা দরকার নেই। আমি তাকে এসব মনে করিয়ে দিচ্ছি তাকে আমার গল্পের জায়গায় নিয়ে যাবার জন্য

আমি এবার তাকে কিছুটা রিলিফ দেই- ক্রাচে ভর দিয়ে দিয়ে আপনি নিশ্চয় সেই হোটেলটাতে গেছেন দুয়েকবার? নিশ্চয় সেখানে গিয়ে আপনার সাব সেক্টরের বন্ধুদের মাঝে স্মৃতিচারণ করছেন সতীর্থ শহীদ মজলিশ কিংবা রফিকের কথা? আবার মাঝেমাঝে হই হুল্লোড় করে বর্ণনা করছেন কোনো সাকসেসফুল অপারেশনের কাহিনী?

ময়না ভাই অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন- তুমি এসব কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
আমি কোনো উত্তর দেই না। পাল্টা প্রশ্ন করি তাকে- সেই হোটেলটাতে তখন আর কী কী হতো ময়না ভাই? ওখানে আর যারা যারা যেত তারা সবাই কি মুক্তিযোদ্ধা ছিল?

ময়না ভাই এবার ধমক দিয়ে উঠেন- দেখো তুমি যা জানো সেটা নিয়েই তুমি থাকো। আমার স্মৃতি কথায় আমি যা লিখিনি সেটা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস না করাই ভালো

আমি তাকে মনে করিয়ে দেই- আপনিতো শুধু যুদ্ধের স্মৃতিকথা লিখেছেন। এগুলো যুদ্ধের পরের ঘটনা

ময়না ভাইর বোধহয় হঠাৎ করেই খেয়াল হয়। সত্যিই তো। যুদ্ধের স্মৃতিকথার বইয়ের প্রসঙ্গে আমি তাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছি যুদ্ধ পরবর্তী ঘটনা নিয়ে। ময়না ভাই এবার পরিষ্কার করে আমাকে বলেন- তুমি আমার বইটা সম্পর্কে বলো

আমি তার বইটা সম্পর্কে কিছুই বলি না। আমি বলি- ময়না ভাই আপনি বইটার দ্বিতীয় খণ্ড লেখেন। আপনার মুক্তিযুদ্ধকালীন বেশিরভাগ বন্ধু আর সতীর্থরাই এখনও সক্রিয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তাদের অনেকের বিবর্তনগুলো আপনার চোখের উপর দিয়ে ঘটে গেছে। আপনি সেই কাহিনী দিয়ে এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডটা লেখেন

ময়না ভাই এবার বেশ শব্দ করে হেসে উঠেন- তুমি কি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিতে চাও না? তুমি কি চ্ওা সেইসব লিখে আমি নিজের বিপদ ডেকে আনি?

আমি আবারও খুব দ্রুত প্রসঙ্গ ঘোরাই তাকে কোনো চিন্তার সুযোগ না দিয়ে- ময়না ভাই স্বাধীনতা ঘোষণার বিশ দিন পরে ১৪ এপ্রিল যে শহর আপনি ছেড়ে গিয়েছিলেন; ফিরে এসে নিশ্চয়ই তার অনেক খবর নিয়েছেন আপনি?
- তাতো অবশ্যই। তখন কারো সাথে কারো দেখা হলে সবাই অন্যদের খবর জিজ্ঞেস করত
- কিছু কিছু খবর তো জিজ্ঞেস না করলেও আপনা আপনি সবাই পেয়ে যেত
- সেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ তখন তো সবার আলোচনাই ছিল একটা

আমি ময়না ভাইকে তার লামাবাজারের বাসা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের একটা জায়গার নাম বলে জিজ্ঞেস করি সেই পাড়ার খবরও নিশ্চয়ই আপনার অজানা থাকার কথা না?
- ওটাতো শহরের হার্টের কাছে। কী ঘটনা বলোতো?
- একটা সংখ্যালঘু পরিবার। একটা ব্রাহ্মণ পরিবার যুদ্ধের পুরোটা সময় ওই এলাকায় বেশ নিরাপদ ছিল। সেই পরিবারটাকে পাকিস্তানিরা নিরাপত্তা দিয়েছিল। এই খবরটা নিশ্চয়ই আপনি শুনেছেন?

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ময়না ভাই জিজ্ঞেস করেন- তুমি কোন ঘটনার কথা বলছ বলোতো?
- আমি সেই পরিবারের কথা বলছি। আপনাদের সময়ের সবচে সুন্দরী মেয়েটা ছিল যে পরিবারের সদস্য। মনে পড়েছে ময়না ভাই?

ময়না ভাই একেবারে ঝিম মেরে যান। একটাও কথা বলেন না। কিন্তু এই জায়গাটাতেই ময়না ভাইর কথা আমার দরকার। তিনি একটা কথা বললেই পরের প্রশ্নে পা আমি পৌঁছে যাব আমার গল্পের উপসংহারে

কিন্তু ময়না ভাই ব্যস্ততার কথা বলে ফোন রেখে দেন হঠাৎ। আমি জানি ব্যস্ততা নয়। যে কথাগুলো তিনি মনে করতে চান না সেই কথাগুলো আমি তাকে মনে করিয়ে দিয়েছি বলে তিনি ফোন রেখে দিয়েছেন...

১৩

ছয়টা মাস গেল একা একা ঝিমুনিতে। গল্পটা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। রেকর্ড করা কণ্ঠগুলো নেড়েচেড়ে হঠাৎ মনে হলো- এই মানুষগুলো এসছিল আমাকে গল্প দিতে। ব্যর্থতায়-বিষণœতায়-কষ্টে তারা সরে গেছে। যদি আবার গিয়ে তাদেরকে বলি গল্পটা দাঁড় করাতে? তারা কি আসবে?

আসলে আসুক না আসলে নেই। দাঁড়াই না গিয়ে আবার সকলের কাছে

১৪

পুরোনোদের মধ্যে শুধু স্নিগ্ধা আলি আর অনিন্দিতা চৌধুরী এলেন। বাকিরা নতুন। শুরুর আগে সবাইকে আগাগোড়া রেকর্ডটা বাজিয়ে শোনালাম। গল্পের সূত্র মনে করিয়ে দিলাম। কিন্তু ময়না ভাই সম্পর্কে কিছুই বললাম না কাউকে

মুজিব মেহদী শুরু করলেন প্রশ্ন দিয়ে- কত পাগলি এল-গেল, কয়জনের কোষ্ঠী-পরিচয় জানি আমরা?

মুজিব ভাই এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত আশা করেন না কারো কাছে। কিংবা নিজেই পরে উত্তর দেবেন বলে প্রশ্নটা শুনিয়ে নিচ্ছেন। ঠিক তাই। নিজেই এবার প্রশ্নের উত্তর দেয়া শুরু করেন- এই যে ঈদের পরদিন ময়মনসিংহ শহরের বলাশপুর শ্মশানঘাটের মুখে পুরান ব্রহ্মপুত্রের দিকে ফিরে বসে কেবল ঊর্ধ্বাঙ্গে বস্ত্রধারিণী পাগলিটা অনবরত কথা বলে যাচ্ছিল, তার কয়টা কথা মন দিয়ে শুনেছি আমি?

এ প্রশ্নের উত্তরও কেবল তারই জানার কথা। সেই উত্তরগুলোও তিনি বর্ণনা করেন- সে যখন বলছিল যে, ‘তেচপাতা তর হুগা দিয়া ঢুকামু’ কিংবা ‘আসমানের দিগি চাইয়া থাহস ক্যাল্যাইগ্যা, তর কি বাপ মরছে, লাঙ মরছে, চইদ্দগুষ্ঠী মরছে? কিংবা ‘খেতার তলে আয়, তরে খেইল দেহাই’; তখন কি আমি একটা বাক্যের সাথে আরেকটার জোড়াতালি দেবার চেষ্টা করতে করতে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে হাঁটা দেইনি নিজের ডেরার দিকে?

শেষ পর্যন্ত মুজিব মেহদী কোনো উত্তরই দিলেন না। প্রশ্নের পরে প্রশ্ন সাজিয়ে সেই রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বীরাঙ্গনাকে মিলিয়ে দিলেন আজকের আরো অসংখ্য পথউন্মাদিনীর সাথে। সেইসাথে হয়ত মনে করিয়ে দিলেন তাদের বিচ্ছিন্ন বাক্যগুলো আমাদের পক্ষে মিলানো কঠিন কিংবা প্রায় অসম্ভব...

মুজিব ভাই থামার পরে পরেই দময়ন্তী রেকর্ডারটা টেনে নিয়ে নিজে থেকেই গল্পটা ধরে। একেবারে সরাসরি কিছু ঘোষণা দিয়ে শুরু করে সে- আমি গল্প লিখতে পারি না আর কল্পনাশক্তিও খুব দুর্বল। কিন্তু পুরোটা জেনে আমি খুব সংকোচের সাথেই নিজের পড়া, দেখা জানা ক’টা ঘটনা উল্লেখ করতে চাইছি। আপনার গল্পের জন্য নয়, এমনিই কথাগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে... তাই

কোনটা যে গল্পের ঘটনা আর কোনটা নয় গল্প তৈরি হবার আগে তার কটা আমরা খেয়াল করি? ক্ল্যাসিক্যাল কোনো বই পড়ার পরে হঠাৎ করেই আবিষ্কার করি কোথাকার কোন লেখক কবে কোন কালে লিখে ফেলেছে আমার পাশের কিংবা আমারই নিজের ঘটনা। যে ঘটনাটা এতই তুচ্ছ ছিল যে কাউকে বলার দরকারও মনে করিনি আমি

দময়ন্তী গল্পটা শুরু করে একেবারে স্টেটমেন্ট আকারে- ঘটনা ১: ১৪ই মার্চ, ২০০৭ নন্দী গ্রামের সেই ভয়ংকর রাতে বহু মহিলা গণধর্ষিতা হন সিপিএমের ক্যাডারদের দ্বারা। তারা কেউ কেউ পুলিশ, সিবিআই সাংবাদিক সকলকেই বারেবারে বলেন সেই কথা

দময়ন্তী থামে। হয়ত ১৯৭১ এর সাথে মেলাতে চেষ্টা করে ২০০৭। আবার শুরু করে- ধর্ষণ কিন্তু প্রমাণ হয়নি

ঘটনাগুলো আমাদের সবারই জানা। সব উচ্ছেদ আর অত্যাচারই এক ব্যাকরণ মেনে চলে। হোক তা বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের। কিংবা পাহাড়িদের উপর বাঙালিদের। কিংবা নন্দী গ্রামের উপর সিপিএমের

দময়ন্তী আরেকটু এগিয়ে যায় জানা ঘটনাগুলো থেকে এই গল্পের জন্য আরো কিছু ঘটনা তুলে আনতে- নিজেদের কাজকর্ম মেটানোর পরে ঐ মানবেতর জীবগুলি তাঁদেরই একজনের যৌনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে ঘুরিয়েছিল। ভারতীয় আইন ও দণ্ডবিধির নির্দিষ্ট সংজ্ঞা অনুযায়ী ইহা ধর্ষণ নহে...

হাহ। শরীরে ধর্ষিত হয় যত মেয়ে কাগজে তাদের কয়জন পারে ধর্ষণের প্রমাণ দিতে? ধর্ষণ প্রমাণ করতে অনেককে আবারো প্রায় ধর্ষিত হতে হয় ধর্ষণ পরীক্ষাকারীদের কাছে। সবাই তা পারে না বলে বহু ধর্ষণই প্রমাণ হয় না আর

দময়ন্তী বলে যাচ্ছে- এঁদেরই একজন ২০০৮ এর ১৮ই এপ্রিল, মেদিনীপুরের গোকুলনগর গ্রামে পুনরায় গণধর্ষিতা হন এবং এবারেও জানা যায় ধর্ষণ নয়, তাঁকে নাকি ‘১০ ১২ জনে মিলে ধাক্কাধাক্কি করেছিল’ মাত্র। এঁরা সেই অর্থে উন্মাদিনী হননি এখনও

দময়ন্তীর কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই আমার মনে হয়; একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের যদি বলা হতো ধর্ষণের প্রমাণ দাও। তবে কয়জন সেই প্রমাণ দিতে পারতেন? যদিও বাংলাদেশে এখন ধর্ষণের প্রমাণ করা ভারত থেকে মোটেও আলাদা নয়। তবু ধন্যবাদ দিতে হয় সেই সময়ের মানুষদের। যারা বীরাঙ্গনাদের কাছে ধর্ষিতা হবার কোনো প্রমাণ চাননি

দময়ন্তী অনেকক্ষণ থেমে প্রায় অস্ফুটে উচ্চারণ করে গল্পের মূল লাইনটা- মাইয়ালোকরে অত অত্যাচার...

অনেকক্ষণ ধরে বাক্যটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। হয়ত কিছু সূত্র মিলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু হয় না। হয় যে না তা বোঝা যায় তার অস্থিরতায়। তারপর একটু থেমে ঝট করেই চলে যায় আরেকটি ঘটনায়। আরেকটি স্টেটমেন্টে- ঘটনা ২: এক দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন উত্তরপাড়া মাকলায় একটি কিশোরী ধর্ষিতা হয়। উত্তরপাড়া জেনারেল হসপিটালে ভর্তি থাকাকালীন তাকে প্রথমে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয় এবং অনবরত ব্লিডিং হওয়ার জন্য স্রেফ একটি স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করা হয়। অন্য কোনোপ্রকার চিকিৎসা বা পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। কী করে জানি ১টা মানবাধিকার সংগঠন খবর পায় ও চ্যাঁচামেচি শুরু করে। তখন আরেক রোগীর সাথে একত্রে একটি বেড দেওয়া হয় তাকে

হাসপাতালে ভর্তির পরই পুলিশকে খবর দেওয়া ও ডায়েরি করার চেষ্টা হয়েছিল। পুলিশ নেয়নি, কারণ কানাঘুসোয় যাকে/যাদের অভিযুক্ত বলে ধরা হচ্ছে, সে স্থানীয় সিপিএম নেতা, পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে ও তার বন্ধু

ঘটনা কলকাতার। কিন্তু আমার মনে হয় দময়ন্তী যেন বাংলাদেশেরই যে কোনো অঞ্চলের ঘটনা বর্ণনা করছে। এর বাকি অংশটা দময়ন্তী না বললেও আমি বলে দিতে পারি। এতে হয়ত লোকজনের নাম মিলবে না। কিন্তু সবগুলো ঘটনা মিলে যাবে একটার সাথে আরেকটা

আমি কিছুই বলি না। একটু একটু করে থেমে থেমে দময়ন্তী বলে যেতে থাকে- এই মেয়েটি ও তার মা, স্থানীয় একটি এনজিও পরিচালিত সংস্থায় আচার, জেলি ইত্যাদি বানায়। মেয়েটির মা মানসিক ভারসাম্যহীন, মেয়েটিও কিছুটা তেবুদামতো। ঐ মানবাধিকার সংগঠনটির চ্যাঁচামেচির ফলে পুলিশ একটি ডায়েরি নেয় বটে, কিন্তু তাতে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ লেখা হয় না। জেনারেল ডায়েরি

দময়ন্তী একবার থেমে সবার দিকে তাকিয়ে আবার শুরু করে- পুলিশ মেয়েটির জামাকাপড় পরীক্ষার উদ্দেশ্যে চায়। মেয়েটির অবোধ মা অত রক্ত দেখে সেগুলি কবে’ই ধুয়ে দিয়েছে। সেই নবমীর সকালেই। কোনো প্রমাণ নেই। ইতোমধ্যে প্রায় ৭ দিন কেটে গেছে। তাই মেয়েটির দেহেও আর কোন প্রমাণ নেই

ঘটনাটা আর শোনার কোনো দরকার নেই। নিয়মটা এমন যে তুমি একবার ধর্ষিত হও ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তারপর আরো যত্ন করে ধরে রাখো ধর্ষণের চিহ্নগুলো। যতক্ষণ পর্যন্ত না পরীক্ষকরা তোমাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন ধর্ষিতা হিসেবে ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি তাদেরকে তোমার শরীর খুলে দাগ দেখাও। পোশাকের ভাঁজ খুলে শুকনো রক্ত দেখাও। আর মুখে মুখে বর্ণনা করো কীভাবে কী হলো। তারপর তুমি স্নান করতে যাও। তারপরেই তুমি ধুয়ে ফেলতে পারো সমস্ত রক্ত-চিহ্ন-অপমান...

দময়ন্তী থেমে গিয়েছিল। হয়ত আমার ভাবনাটা সে বুঝতে পারছে। তার দিকে তাকাতেই সে আবার শুরু করে- ঐ সংস্থাটির উদ্যোগেই মেয়েটিকে নিয়মিত রক্ত দেওয়া হয়, বেঁচে যায় মেয়েটি। কিন্তু তার তেবুদাভাবটি প্রচণ্ড বেড়ে যায়। সে সর্বদাই থুম ধরে থাকে। আর মোটর বাইকের আওয়াজ শুনলে, কিংবা যুবকবয়সী কাউকে দেখলে আঁ আঁ করে চিৎকার করে দৌড়াতে চায়

মোটর বাইকে চড়ে যুবক বয়সী কোনো ধর্ষণকারী আসে এই তেবুদা মেয়েটির কাছে। একাত্তরের সিপাহিরাও ছিল যুবক বয়সী আর তারাও চড়ে আসতো মোটরগাড়ি। আমি কিছু সূত্র পাই। কিছু সূত্র ঝাপসা। দময়ন্তী আবার সেই বাক্যটা নিয়ে একবার নাড়াচাড়া করে- মাইয়া লোকরে অত অত্যাচার...

আমরা সবাই তাকিয়ে থাকি দময়ন্তীর দিকে। সে মাটির দিকে তাকিয়ে বাক্যটা নাড়তেই থাকে বিড়বিড় করে। হয়ত আরো কঠিন কোনো ঘটনা সে বলবে। কিন্তু কীভাবে কথাগুলো বলতে হবে সাজিয়ে নিচ্ছে নিজের ভেতর। আমরা কেউ তাকে তাড়া দেই না। সবাই মুখিয়ে থাকি। দময়ন্তী বলবে। এই মুহূর্তে সে যা বলবে তাই হয়ে যাবে গল্পের মূল সূত্র। সে কাছাকাছি চলে এসেছে গল্পের

কিন্তু হঠাৎ করেই দময়ন্তী রেকর্ডারটা অফ করে দেয়- নাঃ বড্ড বড়ো হয়ে যাচ্ছে। এই দুটো ই থাক

ধুপ করে আমি সম্বিত ফিরে পাই। শেষ পর্যন্ত দময়ন্তী আর সাজাতে পারল না ঘটনাগুলো? এইসব ঘটনা বলার জন্য আগে থেকেই শব্দ বাছাই করে রাখতে হয়। কোন ঘটনাটা কোন প্রতীক দিয়ে বলতে হবে সেইসব প্রতীক বাছাই করে রাখতে হয়। দময়ন্তী অতক্ষণ ধরে সেইসব শব্দ আর প্রতীক খুঁজে বেড়াচ্ছিল। ঠিকঠাক মতো না পেয়ে পুরো ঘটনাটাই বাতিল করে দিলো

কিন্তু তারপরও আমরা তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের সবার চোখের দিকে তাকিয়ে দময়ন্তী মেরুদণ্ড সোজা করে একেবারে ডিফেন্সিভ ভঙ্গিতে বসে- জানেন, গল্পগুলো আসোলে প্রায় একই। দেশ, কাল, সময়, জাতি, ধর্ম যাই আলাদা হোক না কেন ...গল্পগুলো খুব একটা তফাত হয় না...

একটু থেমে গলাটা নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে দময়ন্তী নিজেকেই যেন কিছু কথা বলে- তাই তো আমি বলি- ‘ভগবান কত ভালো/ অপরের চোখ অন্ধ করেও/ আমাকে দিলেন আলো/ ভগবা-আ-ন কতো ভা-আ-লো-ও’

মানে কী? চমকে উঠে অনেকেই। দময়ন্তী কোন গভীর থেকে কথাগুলো বলছে? দময়ন্তীর দিকে তাকাই। দময়ন্তীর বসার ভঙ্গি আমাদের জানিয়ে দেয় আর একটাও বাক্য সে বলবে না এই বিষয়ে। সে দূরে চলে গেছে। বহু দূরে। গল্পের ঘটনা ছেড়ে অন্য কোনো ঘটনায়। যে ঘটনায় চলে গেলে মানুষ মুখে শব্দ খুঁজে পায় না। শব্দগুলো বুকের ভেতরে তোলপাড় করতে করতে শ্বাসকষ্ট আর বুকের ব্যথা বাড়িয়ে দেয়; সেইটুকু দূরত্বে...

থাক দময়ন্তী। আর বলার দরকার নেই। এই গল্পগুলো আসোলেই তফাত হয় না। ...কিন্তু তারপরেও তো আমাদেরকে প্রতিটা গল্পের জন্য আলাদা ঘটনা বের করে নিতে হয়। এইসব ঘটনার অনেকগুলো আমিও জানি। কিন্তু বছরের পর বছর চেষ্টা করেও বাছাই করতে পারিনি কোনো ঘটনা। যখনই নিজে নিজে সাজাতে গেছি তখনই দেখেছি হয়ে উঠছে না কিছুই। আর তখনই মনে পড়ে যায় ছোটবেলা ধারাবাহিক গল্প বলা কম্পিটিশনের কথা। একটা গল্পের কিউ ধরে নিজের মতো করে গল্পটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া। অদ্ভুত ছিল বিষয়টা। দেখতে দেখতে গল্পটা কোত্থেকে কোথায় চলে যেত কেউ অনুমানও করতে পারত না। অথচ সূত্র একটাই। একটাই থিম। অথচ তার ঘটনা ছাড়িয়ে পড়ত নতুন একেকটা মোড়ে

সেই ভরসাতেই মনে হয়েছিল এই গল্পটাও দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু কম্পিটিশনের গল্প বলা আর গল্প তৈরির জন্য বলায় যে এত ফারাক কে জানত আগে

অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ। বুঝতে পারছি না আর কী করলে গল্পটা শেষ করার মতো কাহিনীতে গিয়ে পড়বে। মনে হচ্ছে দ্বিতীয়বারের মতো সবাইকে না ডাকলেও পারতাম। প্রথমবারে যা হয়েছিল এখনও ঘটতে যাচ্ছে সেই ঘটনা। ঘটনা আছে কিন্তু জট খোলে না ঘটনার

পুতুল একটা কাগজের বান্ডিল খুলে কী যেন নাড়াচাড়া করছে। সেদিকে তাকাতেই বলল- এখানে আমার একটা উপন্যাসের একটা পর্ব আছে। যদি বলেন তো পড়ে শোনাই। এই মহিলার ছবিটা আপনার বীরাঙ্গনার মতো হতের পারে ভবিষ্যৎ-এ

- অবশ্যই। কোনো কিছুই ফেলনা নয় এই গল্পে। প্লিজ...

রেকর্ডারটা পুতুলের সামনে রাখি অন করে। শেরালী উপন্যাসের এগারো নম্বর অধ্যায়- মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ থেকে পড়তে শুরু করে পুতুল-

আগুন লাগলে মন পুড়ে যায়/ দেখে না তো কেউ।
পানি ঢালে দুই নয়নে/নিভে আগুন কৈ!

পুতুল শুরু করে একটা কাব্যিক ভনিতা দিয়ে। সবার দিকে তাকায়। তারপর ঢুকে যায় টানা গদ্যে- কাঁচা সোনার মতো শোল মাছের পোনা, ভরা যৌবনে, ভাদ্রের গলায়, সোনার হারের মতো অলংকার হয়ে, বর্ষার শোভা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শেরালী সুন্দরের বন্দনা করতে শেখেনি। বিনাশেই মুক্তির আনন্দ খোঁজে। এত সুন্দর মাছের পোনাগুলো বড়ো হয়ে কালচে সাপের রং ধারণ করে কেন! সব জীবনই কী পরিণত বয়সে শৈশবের মাধুর্য হারিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এমন কঠিন কঠোর হয়ে উঠে? হয়ত এ কারণেই শেরালী নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে গেঁথে ফেলছে বঁড়শিতে একটার পর একটা সোনালি মাছের পোনা। জট বেঁধে থাকে বলে, জটলার ভেতর আদার ছাড়া বঁড়শি ফেলে টান দিলেই গেঁথে যাচ্ছে একটার পর একটা। কেরামত মাওলা বেঁচে থাকলে শেরালী এ বঁড়শি হাতে নেয়ার সাহস কখনই সঞ্চয় করতে পারত না। তবে রতনের সাথে হয়ত ছল-চাতুরী করে জিততেও পারত। বাবার সাথে কখনো তেমন খাতির তৈরি হয়নি শেরালীর। তাই তার মৃত্যুতে তেমন আফসোসও নেই। তবে রতনের জন্য মনটা মাঝে মাঝে মোচড় দিয়ে উঠে। ঈর্ষা ছিল রতনের শক্ত সমর্থ শরীরের উপর। কিন্তু ভরসাও ছিল। সেবার দবার সাথে চাড়া-খেলা নিয়ে লেগে গেল। দবা সমানে কিল ঘুসি চালিয়ে শেরালীকে প্রায় তক্তা বানিয়ে ফেলছিল। এমন সময় চিৎকার শুনে রতনের আবির্ভাব। দবার ঘাড়টা ধরে কুত্তার ছাওয়ের মতো শূন্যে তুলে ছেড়ে দিলো রতন। দবা মরি কি বাঁচি দৌড়। শেরালীর খুব মজা লাগছিল দেখে। আর মনে মনে বলছিল; জানো না জাদু, আমি কার ভাই? আমার সাথে লাগলে খবর আছে! কিন্তু এখনতো রতন নেই, শেরালী একা। যার যা খুশি শেরালীকে করতে পারে। টু শব্দটিও করতে পারবে না। একটু অসহায় বোধ করছে শেরালী।

একেবারে ক্ল্যাসিক্যাল উপন্যাসের বর্ণনা ঢং। একটা ছোট পরিস্থিতিকে ধীরে ধীরে বিস্তার করে নিয়ে ঘটনার দিকে এগোনো। শেরালীর বর্তমান অবস্থা যথেষ্ট রকম বর্ণনা করে পুতুল এবার মোড় নেয় শেরালীর মায়ের দিকে- মায়ের তিন কূলে কেউ নেই। শেরালী দাদা-দাদি, নানা-নানি কাউকে দেখেনি। এই ভিটেয় কোনো আত্মীয়ের পা পড়েনি কখনো। নানির ঘরে ছুইকা (নব জাতক) অইলেই টাহুইরায় (ধনুষ্টংকার) ধরত। ছুইকা অইয়া বাঁচত না। এর জন্য মা যখন বেঁচে রইলেন, পাঁচ দিন বয়সে নাম রেখেছিলেন হুরুনি (ঝাড়–দার)। অবহেলায় যেন টাহুইরায় হুরুনিরে ফালায়া যায়! হুরুনিকে ‘টাহুইরায়’ ফেলে গেছে ঠিকই কিন্তু নিয়ে গেছে হুরুনির মাকে। অভিশপ্তের জীবন হুরুনির অসহনীয় হলো। বাবা রামচন্দ্রপুর বাজারে নাওঘাটে কুলির কাজ করত। নাওয়ের মাল রেল গাড়িতে তুলত। ছয় পারি বোঝা বাঁ হাতে উঠাত। এমন জোর ছিল গায়ে। পাক ভারত যুদ্ধের সময় রামচন্দ্রপুর বাজারেও হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার ঠেলা লাগে। সে দাঙ্গা মেটাতে পুলিশের গুলিতে এতিম হয় হুরুনি। দশ-বারো বছর বয়সে, আরেক এতিমের সাথে পাড়ার লোকের ঘটকালিতে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধেন। সবাই বলল ‘হুরুনি, তর কেউ নাই, মাওলারও কেউ নাই। দুইজনের দুঃখ কষ্ট দুই জনে বুঝবি।’

মজার ল্যান্ডস্কেপ। ছোটছোট বাক্যে চিত্রকল্পে একেকটা ঘটনাপর্ব পার হয়ে আসা। পুতুল একটু থেকে আবার কন্টিনিউ করে- মাঝে মাঝে যখন কেরামত নিজের কষ্ট বোঝানোর জন্য মায়ের পিঠে আইল্লাফাজন (গরু তাড়ানোর বাঁশের দণ্ড) ভাংতো তখন লাজে, দুঃখে, কষ্টে অভিমানে মায়ের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। ফোলা পিঠ নিয়ে বাড়ির পেছনের শেওড়া গাছটার তলায় বসে বসে বিলাপ করত। আর বাপ মাকে অভিশাপ দিত।
টাহুইরায় আমারে কেন ফালায়া গেল!

বাবার তাতে কিইবা আসে যায়।
শেরালী আর রতন গিয়ে সাধাসাধি করত।
মা বলতেন; তগো মরণ নাই? তগো লাইগ্যাই আমি এই অসুরের ঘর ছাইরা যাইতে পারি না।
ওরা বুঝে নিতো, সাধাসাধিতে কাজ হয়েছে।
ম্লান মুখে রান্না চড়াতেন, না হলে বাছারা কী খাব!
এখন মায়ের আর সেই মার সহ্য করতে হবে না।

আমি এখনও বুঝতে পারছি না ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে। পুতুলের লেখার স্টাইল দেখে মনে হয় এ সেই গোত্রের লেখক যারা ভাবেন পাঠকরা আস্তে আস্তেই তার সাথে চলুক। কীসের অত তাড়াহুড়া। ঘটনাতো এক সময় না এক সময় জানাই যাবে। লেখক পুতুলের সাথে পাঠক পুতুলেরও খাপে খাপে মিল। সে ধীরে ধীরে পড়েই যাচেছ- রতনের সাথে সুযোগ পেলেই নিজের বাবার চেহারাটা মিলিয়ে নিতেন মা। শেরালী ঈর্ষা করত। এখন আর তা করতে হবে না। পাড়ার লোকে বলত রতনের মা, তর পোলায় বলিষ্ঠ হইছে ঠিক তোর বাপের মতো। মা বলত; দোয়া কইরেন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বাঁ পায়ের কানি আঙুলের ধুলা বাঁ হাতের কানি অঙ্গুলে নিয়ে রতনের কপালে ছুঁয়ে দিতেন। এখন থেকে হয়ত তা আমার কপালে জুটবে।

পুতুল আকস্মিকভাবে এইখানে এসে থেমে যায়। বোধহয় পরের প্যারায় যাবার জন্য একটু শ্বাস নিয়ে নেয়। অতক্ষণ পর্যন্ত একটা সাদামাটা ব্যক্তি ইতিহাস সে শেষ করেছে শেরালী আর তার মায়ের। একটা শ্বাস নিয়ে ধুম করে আবার শুরু করে পুতুল। তার গলাটা এখন অনেকটা চড়া- ‘আজ এত দিন পরে, ফাঁসির দড়ি গলায় পরে, এ সব কথা বলে কোনো লাভ নেই। আমিই বা মায়ের জন্য কী করেছি। পোড়া জীবনটার কলঙ্ক হয়ত আরো বাড়িয়ে দিচ্ছি। মায়ের ‘গৌরব’ শান্ত সুবোধ ছেলে না হয়ে, প্রতিশোধের বিষ বুকে নিয়ে বিষাক্ত করেছি আপনাদের সুন্দর সাজানো সমাজ সংস্কার। প্রতিশোধের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করেছি আরো কত মানুষের জীবন, সংসার। হয়ত বেঁচে থাকলে আমার রক্ত পিপাসা নষ্ট করত আরো কত সুখের নীড়! তার চেয়ে এখন শৈশবেই ফিরে যাই, সেই ভালো।’

শেরালীর সাফল্যে আজ মায়ের এতটুকু আনন্দ নেই। অবহেলায় সোনালি মাছের পোনাগুলো দেখে নিয়ে, আবার দৃষ্টি প্রসারিত করলেন অজানায়। পিঁড়িতে বসে শূন্য দু’চোখ শূন্যেই মিলিয়ে দেন অনাদরে। আকাশের কিনারায় আজ শকুনের আনাগোনা অনেক বেশি। নীল বেদনার সমুদ্র ঢেকে দিতে, কাশ ফুলের মতো ধবল মেঘ, ব্যর্থ চেষ্টা করছে। দিনটি মায়ের মতোই নির্লিপ্ত, বড়ো শান্ত।

শরৎ -এর দিনগুলি এমনই, বিরহিণীর বসন্তের মতো। প্রিয়ার অভিসারে গোপন প্রণয়ে বিলাসিনী বালিকার মনের মতো অবাধ্য ব্যাকুলতার কুসুম প্রস্ফুটিত করে না।

মানে কী? হড়বড় করে কোত্থেকে কোথায় চলে এলো? কীসের ফাঁসি?

শ্রোতা হিসেবে আমি খুব সুবিধার না। প্রায় সময়ই আমি অন্যদের কথার মাঝখানে ঢুকে যাই। একটা বাক্যের অর্থ পরিষ্কার না হলে পরের বাক্য শুনতে চাই না। কিন্তু দাঁত কামড়ে আমি অপেক্ষা করতে থাকি পুতুলের পরের বাক্যগুলো শোনার জন্য- এদিকে দিন দিন মুক্তি ফৌজের অতর্কিতে আক্রমণ বেড়েই চলেছে। আগে শুধু রাতেই হামলা চলত। কিন্তু সেদিন, প্রকাশ্য দিবালোকে বোয়ালমারী বাজারে পেঁয়াজ কেনার ভান করে, লুঙ্গির খুঁট থেকে গ্রেনেড বের করে, পাকা পেয়ারার মতো আস্তে গড়িয়ে দিলো, টহলদার পাক বাহিনীর ট্রাকের নিচে। দু’দিন না যেতেই ধানের ডোলে লুকিয়ে থাকা মন্টু রাজাকারকে বিড়ালের বাচ্চার মতো চ্যাংদোলা করে সবার চোখের সামনে দিয়ে ধরে নিয়ে গেল। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবেলায়; রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটি পাক প্রভুদের সাথে যুক্তি করে, বালুচর গ্রামে বাবুদের পরিত্যক্ত দালানে সম্মিলিত বাহিনীর অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিল।

শেরালীদের শোকের সাথে যুক্ত হলো ক্ষুধা। নিরাপত্তার কথা এখন মনে নেই। আর নিরাপত্তা দিয়ে হবেই বা কী! আপাততঃ ক্ষিধেই বড়ো শত্র“। কয়েকজন পাকসেনা সাথে নিয়ে লোকমান রাজাকার ওদের এই পরিস্থিতির কথা ভেবেই বাড়ি এসে উদ্ধারের সংকল্প ব্যক্ত করল।

লোকমান রাজাকার: বইন, মুক্তি ফৌজের কীর্তিকলাপ দেখতাছেন তো! হেরা কহন কারে ধরে ঠিক নাই। আমনের কামাই করুন্যা পোলাডা খাইল, জামাই খাইল। শেষ সম্বল এই (শেরালীর দিকে ইঙ্গিত করে) দুধের ছাওয়ালডা যদি যায়!

পুতুলের ঘটনাটা একটু একটু করে আমার গল্পের দিকে এগোচ্ছে বুঝতে পারি। কিন্তু বুঝতে পারছি না কোথায় গিয়ে শেষ হবে। আমি কিছুই জিজ্ঞেস করি না। পুতুল পড়তে থাকে- পাক হানাদারের একজন ওদের দুঃখে দুঃখী হয়ে আবেগ সামলাতে না পেরে উর্দুতেই বললেন: বহিনজি, পাকিস্তান কা লিয়ে আপকা কোরবান হামলোগ কাভি নিহি ভুলেঙ্গে। ইহাপর আপকা হেফাজত করনে ওয়ালা কুই নেহিহে। আপ চলিয়ে হামারা সাথ। যবতক হাস লোগ জিন্দাহে আপকা কুচ নিহি করসাক্তা ইয়ে হারামিকা বাচ্চা মুক্তি ফৌজ। লোকমান ভাই আপ বহিনজিকে আপনা জবানমে থোরা সামঝাইয়ে!

এদের বিনীত অনুরোধ, বর্বরতার অলঙ্ঘনীয় নির্দেশে পরিণত হওয়ার আগেই মা সুবোধ বালিকার মতো কাপড়ের পুটুলি এক হাতে আর একহাতে শেরালীর হাত ধরে নৌকায় উঠলেন। এমন শক্ত করে মা বুঝি আর কখনো শেরালীকে ধরেননি। অজানা ভবিষ্যতের আশংকা, এই রমণীর একমাত্র ভরসা, শেরালীর দুর্বল কচি হাত কতটুকু দূর করতে পেরেছে!

মাকে ওদের রাঁধুনি নিয়োগের বড়ো কারণ: ওদের ধারণা মুক্তি যোদ্ধাদের প্রতি মায়ের এক ধরনের ঘৃণা জন্মেছে। ওদের ধারণা হয়ত ঠিক। কিন্তু এদের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মানোর কোনো কারণও এই হায়েনার দল জীবিত রাখেনি।

পরের দিন মায়ের লজ্জিত মুখ প্রচণ্ড রোদে চুপসে যাওয়া রক্তজবার মতো দেখাল। ছেলের দিকে তাকাতে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিলেন। বায়তুল মালের মতো চেটেপুটে খেয়েছে হায়েনার দল মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ। কাঁচা মাংস দেখে বিড়ালের শিকারি প্রবৃত্তির মতো জ্বলে উঠল শেরালীর চোখ। মায়ের আশংকা তাতে আরো বাড়ে। শেষ সম্বল শেরালী এই হায়েনাদের বিষদাঁতে উচ্ছিষ্টের চেয়ে বেশি কিছু না। জাপটে ধরে চোখের জলে শেরালীর প্রতিশোধের আগুনে আপাতত ছাইচাপা দিলেন।

সামান্যের জন্য পুতুল সরে গেল গল্পটা থেকে। এই গল্পটা হতে পারত আমার চাওয়া একেবারেই হুবহু গল্প। কিন্তু গল্পটা মাকে দিয়ে শেষ না হয়ে শেষ হলো শেরালীকে দিয়ে

কিন্তু কম কী? হয়ত সেই নারীর জীবনেও এমন কোনো ঘটনা ছিল। হয়তবা সেই ছিল শেরালীর মা। যে মায়ের কোনো খবর আর পুতুল নেয়নি তার উপন্যাসে? কিংবা শেরালী করেনি স্মৃতিচারণ...

পুতুল তার উপন্যাসের পাতা গুটিয়ে রাখা শুরু করতেই জুলিয়ান সিদ্দিকী উঠে দাঁড়ালেন একটা ঘোষণা দিয়ে- আমি এই দলে নাই। কারণ পাগলদের কেউ আমার সঙ্গে পাগলামি করতে দেখিনি

দলে এসে সারাদিন দলে বসে যারা ঘোষণা দেয় দলে নেই; তাদের সেই নেইএর মধ্যেও থেকে যায় অনেক কিছু

আমরা তাকিয়ে থাকি তার দিকে। তিনিও চোখ বুলিয়ে নেন সবার দিকে। তারপর আগের কথার রেশ থেকেই শুরু করেন- তবে আমাদের গ্রামে ‘তিতিক্ষা’র নুরির মতো এক শীতকালীন পাগলি ছিল। আমাকে দেখলেই বলত, ‘আমি কই, তুই আমারে ছাড়বিনি!’

- আমি কই। তুই আমারে ছাড়বিনি

এই বাক্যটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া যেত অনেক দূর। কিন্তু কেউই ধরল না সেই সূত্রটা। জুলিয়ান সিদ্দিকীও বলেন না আর কিছুই। গল্পের অনেকগুলো শুরু থাকতেও কেমন করে যেন ধুপধুপ করে পড়ে যাচ্ছে আজকের গল্পগুলো। কারো কিউ কাউকে টাচ করে না। উপসংহারবিহীনভাবেই শেষ হয়ে যায় আরেকটা মনমরা দিন

১৫

দিনটা শুরু করে নদী। সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে- শোনা গল্প। গল্প নাকি?
- শোনা গল্প। জানা গল্প। পড়া গল্প। অথবা বানানো গল্প। গল্প হলেই হবে আমাদের

নদী একটা স্টেটমেন্ট ছাড়ে সবার উদ্দেশ্যে- ১৯৭১। মধুপুর। ছিল এক পাগল বা পাগলি। চারদিকে যুদ্ধ। খাবার পায় না প্রায়ই। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধি দিলো- ক্যাম্পের কাছে গিয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিতে; এতেই নাকি খাবার মিলবে। পাগলটা তা-ই করেছিল।

এরপর বাকিটুকু বলার দরকার পড়ে না।

এবং নদী আর কিছু বলেও না। বসে পড়ে সব গুটিয়ে। কিন্তু আমার যে বাকিটুকুও লাগবে। দ্বিতীয়বারের মতো গল্প তৈরি করতে আসা স্নিগ্ধা আপা আর অনিন্দিতা এই দুই দিনে একটা কথাও বলেননি কেউ। হয়ত তারা অপেক্ষা করছেন উপসংহার দেবার জন্য। দুই আসরের গল্পগুলোকে শেষ মাথায় এসে উপসংহার টানবেন তাদের কেউ

কিন্তু স্নিগ্ধা আপা শুধু কিছু শব্দ দিয়ে তার উপস্থিতিটা প্রমাণ করলেন এবার- আমার কিছু যোগ করার নেই, বলার মতো কোনো কাহিনী জানি না বলে। কিন্তু গভীর আগ্রহে আপনার এই গল্পটা শেষ হবার অপেক্ষা করছি!

- গল্পটা শেষ হবার অপেক্ষা আমারও। কিন্তু কীভাবে শেষ হবে এই গল্প? কে করবে? অনিন্দিতা?
অনিন্দিতার দিকে তাকানোর আগেই অনিন্দিতা স্নিগ্ধা আলির কথাটাই রিপিট করে শুধু- আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ার অপেক্ষা করছি।

আগেরবার এসছিলেন আঠারোজন। এইবার আট। সাত গিয়ে বাকি সাইফুল আকবর খান। সে কি কিছু বলবে?

সে নিজেই বুঝে যায় বাকি এখন একমাত্র সে-ই। সে শুরু করে দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘটনা শোনার রেফারেন্স দিয়ে- বেশ দেরিতেই জানলাম। তবু যে জানলাম!
চমৎকার বিষয় এবং আইডিয়া।

গল্প বলার জন্য সাইফুল প্রস্তুত। রেকর্ডারটার তার সামনে নিয়ে রাখলাম। সাইফুল কথা বলছে অন্যদের দিকে তাকিয়ে- দেখি, ওখানে কখনও কোনো ছাপ রাখতে পারি কি না।

সাইফুল একটু থামে। আমার দিকে তাকায়- তবে, সেটা পারি আর না-ই পারি, গল্পটির সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে রইলাম।

হা করে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। শেষ? তারও বলা শেষ? বলা শেষ সবার?

১৬

আবার আমি একা পড়ে থাকি একটা বাক্য নিয়ে- ও মাইও মাইও গো...। সদ্য স্বাধীন দেশে এক নারী বিলাপ করতে করতে দৌড়াচ্ছে বিয়ানি বাজারের রাস্তায়। মায়ের মুখে শোনা সেই তথ্যটুকুতেই পড়ে থাকি আমি। মাঝখানে বহু মানুষের বহু গল্প। বহু চেষ্টা। তবু সেই নারীর বিলাপের স্তর স্পর্শ করার মতো কোনো ঘটনা আবিষ্কার করতে পারি না আমরা

আমার আবার মনে পড়ে ময়না ভাইয়ের কথা। একটা প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি আমাকে। সেই উত্তরটা আমার দরকার

ময়না ভাইকে আমি মনে করিয়ে দেই- আপনাদের সময়ের সবচে সুন্দরী মেয়েটা। যাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা পুরো নয় মাস নিয়ে রেখেছিল নিজেদের ক্যাম্পে। তার বিনিময়ে তারা নিরাপত্তা দিয়েছিল তার পরিবারকে...

আমি তাকে আবার সেই হোটেলটার কথা মনে করিয়ে দেই; যে হোটেলে তার বন্ধুরা আড্ডা দিতো

ময়না ভাই নিঃশব্দে শোনেন। ফোনের ওপাশে একটা শ্বাসও ফেলেন না। ময়না ভাইকে আমি তার সময়ের ঘটনা বলতে থাকি- দেশ স্বাধীন হলে সেই মেয়েটা ফিরে আসে নিজের পরিবারে। সবকিছু ভুলে পরিবারটাও গুছিয়ে নিতে থাকে আবার

হয়ত অত কিছু আপনি জানতেন না। কিন্তু জানত অনেকেই। জানত আপনার বন্ধুরাও...

ময়না ভাই এবার কথাটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য কিছু বলেন। কিন্তু কিছুই শুনি না আমি। তার কথা ছাপিয়ে তাকে আমি জিজ্ঞেস করে বসি- ময়না ভাই। নয় মাস পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে থাকা সেই মেয়েটাকে স্বাধীন দেশে আপনার বন্ধুদের ডাকে সেই হোটেলে যেতে হয়েছিল। থাকতে হয়েছিল বহুদিন...

...আপনি নিশ্চয়ই জানেন?

টেলিফোনের ওপাশে বাজ পড়ার শব্দে ময়না ভাইয়ের চমকে উঠা আমি টের পাই। আমি টের পাই তার স্মৃতিকথার দ্বিতীয়খণ্ড লিখতে না চাওয়ার কষ্ট। শ্বাসকষ্ট। টেলিফোনের ওপাশে ময়না ভাইকে আমার স্পষ্ট এক শ্বাসকষ্টের রোগী মনে হয়

আমি তার কাছে এবার শেষ উত্তরটা জানতে চাই- নয় মাস পাকিস্তানি মিলিটারির সেবা করেছ। এইবার আমাদের সেবা করো কিছুদিন’

- ময়না ভাই আপনি কি বলতে পারেন মেয়েটিকে এই কথাটি হোটেলে দখল করে থাকা আপনার পরিচিত ঠিক কোন মানুষটি বলেছিল?

আমি জানতাম ময়না ভাই আমার প্রশ্নের উত্তরটা দেবেন না। উত্তরের দরকারও নেই আমার। আমার শুধু নিশ্চিত হবার দরকার ছিল আমি যা জানি তার পুরোটাই ভুল নয়। ভুল হলে আমাদেরকে কথা বলতে শেখানো নাটকের শিক্ষক নিজাম উদ্দিন লস্কর কথা না বলে থাকতেন না...

ফোন রেখে দিয়ে আমি থার্ড আইয়ের দেয়া নন্দিতা নামটা নিয়ে পুরো গল্পটার দিকে ফিরে তাকাই; পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যা কিছু ঘটেছিল নন্দিতা তার সবকিছুকে নিয়েছিল নির্যাতনের নামে। আর স্বাধীন দেশে তার উপর যা ঘটল নন্দিতা সেটাকেই নাম দিলো- ধর্ষণ... এবং নন্দিতার এই আবিষ্কারের চিৎকারটাই শুনতে পেয়েছিলেন আমার মা বাহাত্তর সালে...

হোক সে নন্দিতার উচ্চারণ বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলের কিংবা পৃথিবীর যে কোনো ভাষায়

২০০৮.০৩.২৮ শুক্রবার- ২০০৯.০১.১৯ সোমবার


একুশে বইমেলা ২০০৯য়ে প্রকাশিত
শুদ্ধস্বর প্রকাশক
নজরুল ইসলাম প্রচ্ছদ শিল্পী
আশি টাকা দাম


তৃতীয় পাতা উৎসর্গ

নাম না জানা অগুনতি বীরাঙ্গনা
যারা না পেয়েছেন সম্মান
না পেয়েছেন জীবন


পঞ্চম পাতা স্বীকারোক্তি

এই গল্পের চরিত্রেরা সবাই বাস্তব। পটভূমিটা কাল্পনিক

যে তিনটি বই এই গল্পের অংশ

মুহম্মদ জুবায়েরের খসড়া উপন্যাস চুপকথা
মিথুন কায়সারের খসড়া উপন্যাস শেরালী
নিজামউদ্দিন লস্করের স্মৃতিকথা একাত্তরে রণাঙ্গনে

কৃতজ্ঞতা

বাংলা ব্লগ সচলায়তন এবং তার সকল সদস্য


প্রথম ফ্ল্যাপ

অন্দরঘাট

ও মাইও মাইও গো
মাইয়া লোকরে অত অত্যাচার...

সদ্য স্বাধীন দেশের রাজপথে থেমে থেমে
এক অচেনা নারীর বিলাপ শোনা যায়

না জানা হয় তার নাম
না শোনা হয় তার কাহিনী

কাহিনীর জট খুলতে খুলতে কাহিনী বাড়ে
ঘটনা খুঁজতে খুঁজতে বাড়ে ঘটনা

তবু সেই বিলাপ থেকে যায় বিলাপের স্তরেই
গল্পটা হয়ে উঠে গল্প না হবার প্রমাণ


শেষ ফ্ল্যাপ

সদরপাট্টা

মোজার দুর্গন্ধে সমাজের নাক সিঁটকানি এড়াতে
পায়ের তলায় জুতার গজিয়ে উঠা
পেরেকের খোঁচা নিয়ে হাঁটি

রক্ত দেখালেও ক্ষরণ দেখাতে নেই কাউকে
হাসিমুখ দেখানোই সমাজে নিয়ম

পেরেকের খোঁচায় যে গোঙানিটা হয়
সেই আওয়াজের সাথে দাঁত কেলিয়ে দিলেই
সমাজ তাকে হাসি বলে মেনে নেয়

কোনো এক আদিপিতা আমার
হাসির চুক্তিতে দাসখত করে গেছে
সমাজের সাথে


গল্প তৈরির পেছনের গল্প

প্রথম চেষ্টা

দ্বিতীয় চেষ্টা

বই সংক্রান্ত প্যাঁচাল


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পুরো বইটা তুলে দিলাম পড়া প্রায় অসম্ভব জেনেও

মাঝে মাঝে দুয়েক জায়গায় যদি কারো ঢু মারা পড়ে তবে একটু জানাবেন;
কনভার্সন লস থাকতে পারে অনেক জায়গায়

শ্যাজা এর ছবি

খুব ভাল কাজ করেছেন একটা।
যাঁরা এখনো বইটা হাতে পাননি কিন্তু পেতে চান তাঁদের আশা খানিকটা হলেও পূরণ হবে।

...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- স্যার, এইটা কী লেখলেন!
ঘুমানোর আবশ্যিকতায়ও ঘুমাতে পারছিলাম না পুরোটা শেষ না করে! একেবারে, লাইন বাই লাইন, এক টানে পড়ে গেছি। আপনাকে বড় একটা স্যালুট বস। চলুক
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সুযোগ আর সময় হলে বইটার দুর্বলতাগুলো একটু ধরিয়ে দিয়েন স্যার
বইটা নিয়ে আমার প্রচণ্ড কনফিউশন আছে
এটার স্টাইল আর ধরন নিয়ে

এই বইটা যদি একেবারে আবর্জনাও প্রমাণিত হয় তবু্ও এই গ্রাউন্ড ওয়ার্কটার উপর নির্ভর করছে আমার আরো দুটো বড়ো বড়ো লেখার প্লট

০২

রিয়েল কারেক্টার নিয়ে এর আগে কিছু কিছু গল্প লিখলেও অতো বড়ো লেখা লিখিনি। আর সেইসব লেখায় চরিত্রদের মুখের সংলাপগুলো ছিল তাদের বলা কথার অনুলিখন (বাক্যগঠন গুলো ছিল আমার)আর মুভমেন্ট কিংবা এ্যাকশনগুলো ছিল অরিজিনাল

কিন্তু এই লেখায় জীবন্ত সবগুলো চরিত্রের সংলাপই হুবহু কোটেশন অথচ মুভমেন্ট আর এক্টিভিটিগুলো আমার করা এনিমেশন

এই জায়গাটা নিয়ে আমার কনফিউশন আছে আগাগোড়া

০২

আরেকটা কনফিউশন হলো
সচল কিংবা ব্লগ জগতের বাইরে যারা কিংবা এই জগত যাদের কাছে অপরিচিত তারা চরিত্র হিসেবে নিকগুলোকে কীভাবে নিতে পারে

একবার মনে হয় কোটেশন মার্ক ছাড়া পেলগেয়া নিলভনা কিংবা কুন্টা কিন্টে নামগুলোকে এই যদি পাঠক ঠিকই নাম হিসেবে নিতে পারে তাহলে বোধহয়

সংসারে এক সন্ন্যাসী কিংবা ধুসর গোধূলি- কেও দুয়েকবারের পরে নাম হিসেবেই অনুমান করে নিতে পারবে

আবার মনে হয় এই শব্দগুলো বাংলা হবার কারণে এগুলোর প্রচলিত অর্থ পাঠককে কিছুটা খটকায় ফেলতে পারে

০৩

গল্পটাতে চরিত্রগুলোকে আলাদাভাবে তৈরি করা হয়নি
সংলাপের ধরন থেকে একেকটা চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু ধারণা পাওয়া যায় তার বাইরে চরিত্র তৈরির জন্য একটা শব্দও ব্যবহার করা হয়নি কোথাও
(কিছু কিছু এনিমেশন থেকে কিছু আচরণ অনুমান হয়তো করা যাবে)

এই জিনিসটা নিয়েও খটকা আছে আমার

এতে আদৌ চরিত্রগুলো কতটা চরিত্র হিসেবে দাঁড়াবে

০৪

পারলে এই জায়গাগুলোর ঝামেলাগুলো একটু ধরিয়ে দিয়েন
আর অন্য জায়গাগুলোও

আমার ধারণা বইটা আবার লিখতে হবে আমাকে আগাগোড়া

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- লীলেন্দা, একটু সময় নিয়ে এই লেখাটা নিয়ে কথা বলা যাবে। আপাততঃ জানিয়ে রাখি, আমার কাছে দারুণ পছন্দ হয়েছে স্টাইলটা।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

একটা ড্রাফটে সব নিকওয়ালাদের চরিত্র আলাদা করে বানিয়েছিলাম একেবারে মনের মাধুরি মিশিয়ে
পরে পাবলিকের মাইর খাওয়ার ভয়ে সব নিককেই চরিত্রহীন করে দেই
নাহলে আপনার যে চরিত্রটা বানিয়েছিলাম... আহারে

আফসোস হয়
আমার গল্পে ওরকম একটা চরিত্র রাখতে পারলাম না বলে

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

সব নিককেই চরিত্রহীন করে দেই

অ্যাঁ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বলেন কী!
এখন তো আমার ভয়ানক আগ্রহ জাগছে আমার চরিত্রহীন হওয়ার আগের চরিত্রটা দেখতে। কোনোভাবে আমাকে দেখানো যায় না লীলেনদা?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

আলমগীর এর ছবি

আপনার পাগলামি নিয়া যত সন্দেহ ছিল, আজকে পালাইল।
পইড়া শেষ করতে পারব না।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

নেগেটিভ দিক গুলো ধরিয়ে দিয়েন

এনকিদু এর ছবি

পুরো বইটা তুলে দিলাম পড়া প্রায় অসম্ভব জেনেও

কাজটা ভাল করেন নাই । মাইনষের সময় নষ্ট করার ফন্দি ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বস... পুরাটা একবারে দিলে তো পড়া মুশকিল হবে। সিরিজ করে দিতেন।

তবে আপনার ভুল থেকে শিক্ষা নিছি, দেখি, আমি একটু সময় বাইর করতে পারলে সিরিজাকারে ছেড়ে দিবো...
গালিগালাজ ধারাবাহিকভাবে খাইতে মজাই লাগবে সম্ভবত...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সিরিজে কিছু ঝামেলা আছে স্যার
প্রকাশের আগে সুযোগ থাকলে সিরিজ করেই দিতাম

কিন্তু এই গল্পটা বোধহয় টুকরা টুকরা করে দিলে আগামাথা একেবারে গুলিয়ে যাবার আশংকা আছে

এটা হয় পুরোটা পড়তে হবে একসাথে
না হয় পড়া বাদ দিতে হবে

০৩

আপনারটার চ্যাপ্টারলো ইন্ডিভিজুয়ালি একেকটা ইউনিট
পর্ব আকারে পড়লেও গল্প পাওয়া যাবে

তবে যেহেতু এখন একটা অখণ্ড বই
সেহেতু এক জায়গায় থাকাটাই বোধহয় ভালো

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

ভালই হলো। প্রিন্ট ভার্সনটা কেজি দরে বেঁচে কটকটি খাোয়া যাবে।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হেই !
বুদ্ধিটা আমারো খুব পছন্দ হয়েছে, টুটুল ভাই। দেঁতো হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মুশফিকা মুমু এর ছবি

ভাইয়া আপনার বইটাতো পইড়া ফেললাম দেঁতো হাসি সচলে এই প্রথম আমি এত বড় পোস্ট পুরোটা পড়লাম।
দারুন লিখেছেন! এখনতো বইটা কিনতেই হবে। চলুক

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কিনতে হবে না
এখন তো চাকরি করো
বড়োসড়ো কিছু অনুদান পাঠাও
বইটা আমি এমনিতেই তোমাকে পাঠিয়ে দেবো

(সম্ভাব্য প্রশ্ন: অনুদান কী?
উত্তর: অনুদানের বাংলা ডোনেশন)

মুশফিকা মুমু এর ছবি

ভাইয়া আপনি এত কষ্ট করে বইটা পোস্ট করে এমনি এমনি পাঠাবেন আর আমি সামান্য অনুদান করব না, অবশ্যই করব। হাসি
(সম্ভাব্য প্রশ্ন: কত টাকা অনুদান করছ?
উত্তর: আশি টাকা দেঁতো হাসি )

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মাহবুব লীলেন এর ছবি

নাহ

মুমুকে আর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না
এক বছরে যে মানুষের এতটা বিবর্তন হতে পারে মুমুকে না দেখলে কল্পনাই করা যায় না

তা আশি টাকা করে কি প্রতিদিন দেবে না প্রতি ঘণ্টায়?

মুশফিকা মুমু এর ছবি

হাহাহা আসলেই আমার কাছেও অবাক লাগে আমি এখন কত ইষমার্ট দেঁতো হাসি
প্রতি ঘন্টায় বা দিনে না, কি যে বলেন আপনার মত লেখকে এভাবে অনুদান করা যায় নাকি, আমি প্রতি লাইফটাইমে আশি করে দিব দেঁতো হাসি

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্রকাশ্যে স্বীকার করছি মুমু এখন আমাদের ওস্তাদ শ্রেণীর লোক
কোনোভাবেই আর মুমুর সাথে টক্করে যাওয়া যাবে না

তবে একটা প্রশ্ন ছিল
তোমার লাইফ টাইম কয় সেকেন্ডে হয়?

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অ্যাঁ
পুরাটা একসাথে !!
আগেই বলি, আমার কাছে বিশ্লেষন চেয়ে লাভ নেই, জনাব।
আমি শুধু ভালো বা মন্দ লাগাটা বুঝতে পারি।
কিসের জন্য কোনটা লাগে, জানি না। দেঁতো হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

পুরোটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। সময় করে পড়বো এক বসায়। বাকিরা দেখে শেখেন!! লীলেন দা'র জয় হোক! খাইছে

পুতুল এর ছবি

পোষ্টটা দেখে ভেবেছিলাম "প্রথম বই প্রকাশের বেয়াক্কেল মুহূর্তে"-র মত কোন কিছু হবে। রাত্রিভর রামায়ন পাঠের মত লেখাটা শেষ করে বুঝলাম এটাই বীরাঙ্গনার গল্প!
বলতে চাচ্ছি বইটা একটানে পড়া যায় এমন সুখপাঠ্য।

আমি আপনার তৃতীয় বারের আহ্বানে শেরালীর লিংকটা দিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবতে পারিনি আপনি আপনার কথা রাখবেন! ঘোষণা দিয়েছিলেন দাড়ি-কমা সহ আমাদের সব মন্তব্য গল্পে যোগ হবে। আপনি এমন এক কথার মানুষ সেটা জানলে অনুরোধ করতাম কিছু জায়গা এবং বানান ঠিক করে নিতে।

ঘোষনা দেখে একটু ভয়ও পেয়েছিলাম। একটা গল্প মাথায় ঢুকে গেলে সেটাকে সংশোধন করা বা পরিনতিটা ঘুড়িয়ে দেয়া খুব কঠিন মনে হয়, নিজের লেখা গল্পেই।
লোকটা যার যা মন্তব্য সেটা সেভাবে রেখেই একটা গল্প কি ভাবে সাজাবে! একবার নিজেই বীরাঙ্গনা নামে একটা গল্প লিখেছিলাম। বিষয়টা এমন যে পুকুরের পারে দা‌ড়িয়ে জেলেকে নির্দেশ দেয়া, কোথায় জাল ফেললে মাছটা জালে উঠবে। কাজেই সেটা আর গল্প হয়ে উঠেনি। কিন্তু আপনার হাতে একটা গল্প হয়ে গেল!

পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্ষণ (প্রথম বৃহৎ "চার লক্ষ" দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান চীনের উপর, রাষ্ট্রীয় ভাবে জাপানও চীনের কাছে ক্ষমা চায়নি বা স্বীকার করেনি), শুধু ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা, ধর্ষণের সংখ্যা নয়। একবার ধর্ষণের জন্য পৃথিবীর অনেক (জার্মনী) দেশে খুনের শাস্তির সমান যাবৎজীবন শাস্তির বিধান।

আমাদের গল্প বলার ধরণ দেখেই বোঝা যায়, আমরা ব্যাপারটা নিয়ে তেমন কাজ করিনি। সমাজে থাকতে হবে এই ভয়ে কত বীরাঙ্গনার কথা অশ্রুত থেকে গেল!

দেশ নাটকে এক সময় ছিলাম। হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে দেশে গেলাম। দেশে গিয়ে দেশ নাটক না দেখে কি করে দেশ দেখি! সে সুবাদে বকুল ভাইয়ের নাটকটা দেখেছিলাম। জুবায়ের ভাইয়ের চুপ কথা পড়লাম এখানেই।

আপনার কাজটাকে নমস্য মনে করি। লেখার ব্যপারে আপনাকে পরামর্শ দিতে পারি সে যোগ্যতা আমার নেই। এক সাথে দিয়েছেন, খুব ভাল হল। এই গল্পটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়া যায় না।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

লেখাটা শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়িয়েছে কিংবা দাঁড়াবে জানি না
আমি নির্লজ্জের মতো সবার কাছে কমেন্ট চাচ্ছি লেখাটাকে বোঝার জন্য
এই লেখাটা মুলত বেশ কিছুদিন ধরে একটু একটু করে চর্চা করা আমার দুটো ইনটেনশনের একটা প্লাটফর্ম

প্রথমটা হলো: একসময় আমি গদ্য এবং প্রবন্ধও লিখতাম; যেখানে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বলা যেত
কিন্তু একসময় শ্রেফ নিজের পড়াশোনা আর সময়ের ঘাটতির জন্য প্রবন্ধ লেখা একেবারে বাদ দিয়ে দিলাম
তখন শুরু করলাম গল্পের মধ্যেই একেবারে তথ্য এবং মতামত জুড়ে দেবার প্রাকটিস
দেখলাম কিছু কিছু বিষয় গল্পের ভেতরেই বলে দেয়া যায় একেবারে কোনো ধরনের ম্যানিপুলেশন না করে

দ্বিতীয় বিষয়টা হলো; নিজের সীমাবদ্ধতার কারণেই এক সময় আবিষ্কার করলাম কল্পনা করে আমি খুব একটা ভালো ঘটনা যেমন সাজাতে পারি না তেমনি ভালো চরিত্রও সাজাতে পারি না; অথচ আমরা প্রতিদিন আড্ডায় শত শত গল্প বলি একে তাকে নিয়ে
এরা সবাই আমাদের পরিচিতি এবং সম সাময়িক
সেইসব আড্ডার গল্পে যেসব বাস্তব চরিত্র নিয়ে আমরা গল্প করি তাদের কথাগুলোকেই হয় হুবহু না হয় তাদের মতো করে কিংবা কিছু অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করি

মনে হলো এই স্টাইলটাকেও লেখায় আনা যায়
একটু একটু করে শুরু করলাম রিয়েল চরিত্রকে গল্পের চরিত্র বানানো

এই লেখাটা ওই দুটোরই একটা সংকলন
এই লেখাটা যাই হোক না কেন
আমার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে প্রচুর
আরেকটা ফেলে রাখা প্লট হয়তো এই লেখার কারণে এখন লিখে ফেলতে পারবো বেশ সহজেই

০২

আমার এই টেকনিকটা মোটামুটি সফল হলে এটা গল্পের একটা সর্বগ্রাসী টেকনিক হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে
যেখানে যে কোনো বিষয় যেকোনো বই যেকোনো তথ্য ঢুকিয়ে ফেলা যাবে অনায়াসে

দেখি
পুষ্টিহীনতায় ভোগা আমার চিন্তা আমাকে কতদূর সাপোর্ট করে

নদী এর ছবি

আপনার গল্প বলার ভংগিমাটা অসাধারণ।
মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা কাহিনী হিসাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। আপনার হাত আরো শক্তিশালী হোক ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখায়।

যখন আমরা আশা হারিয়ে ফেলি যাপিত জীবনের অন্ধকার-পারিপার্শ্বকতায়, তখন এই লেখাগুলোই আলো দেখায়। আমি বিস্মিত হই যখন দেখি ৫২-ভাষা আন্দোলনের একজন মহিয়সী নারী যে আলোর দীপ্তি নিয়ে কথা বলেন, সেই আলো দেখতে পাইনা বর্তমানের অনেক "শিক্ষিত" নারীর মাঝে। আপনার লেখা থাকুক বাতিঘর হিসাবে ।

নদী

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি দুটো গল্প লিখব
দুটো গল্পই খুবই ছোটবেলায় শোনা দুটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে
কিন্তু সেদুটো গল্প লেখার জন্য আমার প্রস্তুতি দরকার আরো অনেক বেশি

প্রস্তুতি হয়ে গেলে হয়তো আবারও এসে সবার কাছে হাত পাতবো-দেন গল্প দেন

দময়ন্তী এর ছবি

আপনি একজন ভযংকর লোক মাহবুব লীলেন৷ আপনি একজন সাংঘাতিক লোক৷
নিজে গল্পের মধ্যে ঢুকে যাওয়াটা কিরকম আনক্যানি লাগে যেন৷
লেখার ফর্ম্যাটটা বেশ পছন্দ হল৷

কিন্তু .......... কিন্তু ...................... খুব একটা অতৃপ্তি থেকে গেল ৷ দেখি আরো ক'বার পড়ে আরো দু চার কথা লিখব৷

------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দেশ বিভাগের উপর একটা গল্প লিখব প্লান করা আছে
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের- হবিগঞ্জের জালালি কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া...

আর কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের- এপার বাংলা ওপার বাংলা মধ্যে বহতা নদী

এই দুটো গানের উপর

আপনি ঠেসে কমেন্ট দেয়া লাগবে

ওটাতে সবাইই থাকবে বর্তমানের মানুষ; কালিকাপ্রসাদসহ
তাদের সঙ্গে একই টাইমে এসে জুটবে ঋত্বিক ঘটক- হেমাঙ্গ বিশ্বাস নির্মলেন্দু চৌধুরী

আর একটা ভয়ানক মন্তব্য; দেশ স্বাধিন হলো। কিন্তু সিলেটটা বিদেশ হয়ে গেলো...

আপনি রেডি থাকেন
আপনার কাছে দেবার মতো অনেক মশলা আছে

অনিন্দিতা এর ছবি

আপনার বই এবং সচলে দেয়া গল্প দুটোই পড়েছি। এখানে আমার অন্যরকম একটা অনুভূতির কথা জানাই।
পড়েই মনে হলো আমার মধ্যে একটা কনফিউশন কাজ করেছে যেটা আগে বুঝতে পারিনি।
সচলের পোস্টে যখন আপনার দেয়া সূত্র ধরে অনেকে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন আমি ও একটু সংযোজনের চেষ্টা করেছিলাম। আপনি বার বার যেমন খুশী যেকোন দিকে গল্পকে টেনে নিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। আমার মধ্যে কেন জানি এই জায়গায় সংশয়ের সৃষ্টি হলো। আমি আগের জনের লিংক ধরে গল্প খানিকটা এগিয়ে ছেড়ে দিলাম। বুঝতেই পারলাম না এটাকে সেই রাস্তায় দৌড়ে যাওয়া এক পাগলিনীর কাহিনীর মধ্যে আসতে হবে। আপনিও কিছু বুঝতে না দিয়ে এমন প্রশংসা করলেন যে ভাবলাম আর চিন্তা করা লাগবেনা। আমার দায়িত্ব শেষ। এবার অন্যরা করবে।
বই পড়ে তো আক্কেল গুড়ুম! আপনি আপনার বলা জায়গাগুলোতে কিছু চেঞ্জ করেছেন হয়ত গল্পের মূলসূত্র ধরে রাখার স্বার্থে। সেখানে আপনি আসল জায়গায় কিভাবে ফিরব জানতে চাচ্ছেন আর আমি বা আমরা সেটা না পেরে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি। অথচ মূল ঘটনার সময় আমি অন্তত টের পাইনি যে এভাবে ফিরতে হবে।।
এই ব্যর্থতাটুকু নিঃসন্দেহে আমার।
আর একটা বিষয়-

গল্পটাতে চরিত্রগুলোকে আলাদাভাবে তৈরি করা হয়নি
সংলাপের ধরন থেকে একেকটা চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু ধারণা পাওয়া যায় তার বাইরে চরিত্র তৈরির জন্য একটা শব্দও ব্যবহার করা হয়নি কোথাও

আপনার এধরণের এক্সপেরিমেন্টে দুধরণের ব্যাপারই ঘটতে পারে।
১.হয়ত এখানে সব চরিত্রকে (অতটা সামনা সামনি চেনেন না বলে) যেভাবে তুলে এনেছেন এতে আমাদের সচল বা ব্লগের লোকজনের তেমন অসুবিধা হবেনা। গল্পের কৌশলটাই এমন যে আমরা যারা অনেককে নামে আর কমেন্টের ধরণ থেকে চিনি তাতে এগিয়ে যেতে অসুবিধা হয়না।
২. আবার এসব চরিত্রকে আর একটু ডিটেইলে তৈরী করলে হয়ত খুটিঁনাটি অনেক ব্যাপার চলে আসত।
এটা হবেই এমন বলছি না শুধুই সম্ভাবনার কথা বললাম।
তবে আমার মনে হয় আপনার এই কনফিউশনটা এড়ানোর উপায় হতে পারে সচল বা ব্লগের বাইরের পাঠকের কিছু মতামত নেয়া। পরে আবার সেটা সচলে আমাদের জন্য তুলে দিতে পারেন । তখন এর অন্য দিকগুলোও আমরা জানতে পারব।
আসলে আমরা তো সবাই আপনার গল্পে ঢুকে গেছি । তাই হয়ত অনেক কিছুই চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

বইটা এসে পড়বে আমার হাতে। নইলে কম্পু-পর্দাতেই বিশাল এই লেখাটি পড়ে ফেলতাম। সত্যিই পড়তাম!

পাঠোত্তর মতামত জানাবো সচল মেইলে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কথাটা মাঝে মাঝে আপনাকে সচল মেইলেই মনে করিয়ে দেবো

আলমগীর এর ছবি

লীলেন দা
আমি পাঠক হিসাবে মোটেই কোন দরের না। অত বড় একটা লেখা আস্ত তুলে দিয়েছেন এখানে, সবার কাছেই মন্তব্য চাচ্ছেন, তাই সাহস করে পুরোটা পড়ে ফেল্লাম। গল্প উপন্যাস পড়ার সময় আমার একটা বাতিক আছে। সেটা হলো, উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করা। লেখক কী বলতে চান? যদি না পাই (যেমন ধরুন হুআ) তা হলে আর আগ্রহ পাই না। আপনার লেখায় টান টান আগ্রহ ছিল।

কিছু মনে করবেন না, এই শর্তে কিছু কথা বলি:

০১.
সচলের চরিত্রগুলো ০৪ থেকে ০৫ এ হঠাৎ করেই আসল। তার আগে পর্যন্ত আমার ধারণা হচ্ছিল যে লেখক তার শিশুবেলা এবং পরে যুবককাল নিয়ে কথা বলছে। প্লটে সচলদের আগমনটা খুব বেশী আকস্মিক লেগেছে আমার কাছে।

আবার ০৮ এ বলাইয়ের পর ধুগো হঠাৎ করে আসলো। ধুগোর ব্যপ্তিও খুব কম।

০২.
সচল চরিত্রদের সম্বোধন। স্নিগ্ধাকে কখনও শুধু 'স্নিগ্ধা', 'স্নিগ্ধা আলি' বা 'স্নিগ্ধা আপা' সম্বোধন করা হয়েছে। একই ভাবে 'মুহম্মদ জুবায়ের' কখনও 'জুবায়ের ভাই'।
এটা একটু ভেবে দেখতে পারেন।

০৩.
খুব বেশী ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে ০৮ অধ্যায়ে। অনেক শব্দের সাথে আমাদের পরিচিতি থাকলেও, কিছু শব্দ মাথায় বাড়ি দিয়েছে। যেমন:
ইমোশনাল
এগ্রেসিভ
ল্যান্ডস্কেপে
ট্রাই
স্পিডে
ডিটেইলে
প্যারাডক্সের
স্টেটমেন্ট
ইনফরমেশন
ফ্রেন্ড
সার্ভে
রিএকশনের জন্য এতো স্পেস
ইনফরমেশন গ্যাপ
পজ

এ শব্দগুলো কপি করে নেয়া। কিছু শব্দের খুব ভাল বাংলা শব্দ পাওয়া যাবে।

একটা বাক্য ধরুন:
"এর মধ্যে জুবায়ের ভাই আবার সবার আগ্রহ সার্ভে করে নিয়েছেন"। এটাকে শ্রেফ
"এর মধ্যে জুবায়ের ভাই আবার সবার আগ্রহ মেপে নিয়েছেন" বললে কি ভালো শোনায়? বা একটু গভীর ভাব দেয়ার জন্য:

"এর মধ্যে মুহম্মদ জুবায়ের আবার সবার আগ্রহ মেপে নিয়েছেন"।

আমি জানি না, কেবলই মনে আসল বলে বলা।

০৪.
নজমুল আলবাবের সাথে কথোপথনের ভাষারীতি একটু কেমন যেন লাগছে।

"- এই লোক এইভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে নাটকের ঘরে। রোজ রোজ নানা কথা উপকথায় মাথায় গিট্টু লাগায়া দিত। এখন দেখি এইখানেও শুরু করছে!!!"

এখানে একটু নজর দিতে হবে মনে হয়।

০৫.
পুতুলের অংশটুকু খুব দুর্বোধ্য (সরি ভাই)। বিপরীতে, ময়না ভাইয়ের সাথে কথোপকথন খুবই সাবলীল। সারা উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মন টানে ময়না ভাইয়ের অংশটুকু (১২) ।

০৬.
বানান আপনার ভুল হওয়া সম্ভব না, তবু 'ভনিতা', আর 'কেন্দ্রিয়' বানান দুটো আমার চোখে লাগল। ভণিতা, কেন্দ্রীয় হবে কি? ভুল কিনা নিশ্চিত না, আশে পাশে অভিধানও দেখি না। (ণত্ব ছড়ার মধ্যে ভণিতা ছিল যদিও, অর্থ এক কিনা জানি না)।

দু'এক জায়গায় বানান এদিক সেদিক হয়েছে, সেটা কনভার্টারের দোষেই হবে।

আর কিছু বলতে পারছে না এই নাদান বান্দা।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

গ্রেট

আমার জন্য এরকম আলোচনাই খুব বেশি দরকার এই বইটা নিয়ে

০১.

প্লটে সচলদের আগমনের ব্যাপারটা নিয়ে আমি সম্পূর্ণ একমত
জায়গটা ঠিকমতো গোছানো নয়

ধুগোর আসার ব্যাপারটা কয়েকবার কয়েকভাবে লিখে ফেলে দিয়েছি
তার কমেন্টের সাইজ এবং বক্তব্যের কারণে তাকে আসোলে এখানে ঢুকিয়ে আমিও খুব একটা আরাম পাইনি

০২.
স্নিগ্ধাকে কখনও শুধু 'স্নিগ্ধা', 'স্নিগ্ধা আলি' বা 'স্নিগ্ধা আপা'
মুহম্মদ জুবায়ের' কখনও 'জুবায়ের ভাই'।

এটা করেছিলাম বর্ণনার একঘেঁয়েমি কাটাতে
এতে খটকা লাগছে কি না বুঝতে পারছি না

০৩.

সম্পূর্ণ একমত ইংরেজি শব্দের ব্যাপারে
এগুলোর অনেকটাই বাংলায় করা যেত
লেখাটা এডিট করার সময় চেঞ্জ করে দেবো

"এর মধ্যে মুহম্মদ জুবায়ের আবার সবার আগ্রহ মেপে নিয়েছেন"।

এই লাইনটা অসাধারণ

আপনার আপত্তি না থাকলে এই লাইনটা আমি এডিট করে জুড়ে দেবো বইয়ে

০৪.

আমি সবার কমেন্টগুলোকেই ডায়লগ বানিয়েছি
কমেন্ট একটুও এডিট করিনি
যার ফলে যার কমেন্ট যেমন ছিল তেমনটাই রয়ে গেছে
নজমুল আলবাবেরটাও তাই

এখানে আসোলে আমার কিছু করার ছিল না
এখনও বোধহয় নেই

০৫.
পুতুলের উপন্যাসের অংশটাকে গল্পে জুড়তে বেশ বেগ পেতে হয়েছে
ওটা ছিল বিশাল একটা উপন্যাসের একটা পর্ব
যেখানে বিশাল বিশাল একেকটা পটভূমি বর্ণনা করে একেকটা ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে

(মূল লেখাটা চেঞ্জ করার সুযোগ আমার নেই)

এই অংশটা নিয়ে আবার কাজ করব
দেখি এটাকে অন্যভাবে বিন্যাস করে আকেটু স্মুথ করা যায় কি না

ময়না ভাইয়ের অংশটাতে আমার সুবিধা ছিল
ঘটনা ছাড়া আমাকে প্রায় কিছুই কোট করতে হয়নি হুবহু
এবং তার সাথে আমার আলাপ কিংবা তার বই থেকে রেফারেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে আমার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল

আমার যা দরকার মনে হয়েছে সেটা আমি নিয়েছি
যেটা দরকার পড়েনি পুরোটা বাদ দিয়েছি

যে ঘটনায় তার সংলাপ আমার দরকার মনে হয়েছে সেই সংলাপগুলো তার মুখের উপোযোগী করে আমি বানিয়েছি

যার কারণে ঘটনাটাকে অবিকৃত রেখে এই অংশটাতে সংলাপ এবং সংলাপের পটভূমি সাজানোতে আমার স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি

০৬.

বানানটা ভণিতাই হবে
বইয়ে ভুল আছে

আর কেন্দ্রিয় এখন এভাবেই লেখা হয় হ্রস্বইকার দিয়ে

কনভার্সন সমস্যাগুলো রয়ে গেছে অনেকটা

........................

অসংখ্য ধন্যবাদ আলমগীর
এই গ্যাপগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য

এর কতগুলো আমি এখানেই ঠিকঠাক করে ফেলব
আর কতগুলো আমাকে পরের লেখা তৈরি করায় সাহায্য করবে

আলমগীর এর ছবি

০৩. অনুমতির দরকার কী? আপনার জন্যই তো বলা।
সম্বোধনে পুরো নাম ব্যবহার করলে একটা পছন্দের ভারিক্কি ভাব আসে হাসি

০৪. আমি মনে হয়, ঠিকমতো বোঝাতে পারিনি:
"- এই লোক এইভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে নাটকের ঘরে। রোজ রোজ নানা কথা উপকথায় মাথায় গিট্টু লাগায়া দিত। এখন দেখি এইখানেও শুরু করছে!!!"

দিয়েছে
লাগায়া
করছে

এই তিনটা ক্রিয়াপদের মধ্যে প্রথমটা বেখাপ্পা। হওয়া উচিৎ ছিল 'দিছে'। আপনার মতো আমিও নিশ্চিত না এখন এভাবে পরিবর্তন করলে উনি বেজার হবেন কিনা।

syed Afsar এর ছবি

লীলেন ভাই, আছেন কেমন?
অনেক দিন হলো আপনার কবিতা পড়া হয়নি।
ভিনদেশে থেকে দেশের কথা খুব মনে পড়ে।

ভাল থাকুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।