ছাইরং মানুষের মুখ। ৩। পরেশ নাট

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: শুক্র, ০৬/১১/২০০৯ - ১১:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পু...য়া এক ঠুসি মারি নাকর বল্টু খুলিলাইমু। চিনচিনে গলায় কথাটা কারো কানে আসলো কি আসলো না তার আগেই ধুড়ধাড় পড়া শুরু হলো ক্লাসের বেঞ্চ বইখাতা টিফিনের বাটি। ডেস্কের তলা দিয়ে বেঞ্চের চিপা দিয়ে দুইজনের ফাঁক দিয়ে সামনে দৌড়াচ্ছে টিংটিংয়ে পরেশ নাট আর ধাক্কা মেরে ডেস্ক ফেলে ঠেলা দিয়ে তিনচারজনকে মাটিতে ফেলে পেছনে দাবড়াচ্ছে মিজান

এক টিচার যাবার পরে আরেক টিচার আসার ফাঁকে এটা আমাদের ক্লাস্ সিক্সে নৈমিত্তিক ঘটনা। লম্বায় তার সাইজে বাজারে যতগুলো ফুলপেন্ট পাওয়া যায় তার সবগুলোই মাজার দিক থেকে পরেশ নাটের তিগুণের সমান। তাই সে বেল্টকে দড়ি বানিয়ে প্যান্টগুলাকে মাজায় গিটঠু মেরে রাখে। আর তার বাবা যেহেতু বলেছেন তার স্বাস্থ্য ভালো হবে তাই মাজা বড়ো হবার অপেক্ষায় কোনো প্যান্টেরই মাজা সে দর্জি দোকানে নিয়ে যায় না কেটে চিকন করে দেবার জন্য। আর মিজানের সমস্যা হলো যে সাইজের প্যান্টে তার মাজা ঢোকে সেই প্যান্টের পা লম্বা করলে তার তিনগুণ দৈর্ঘ্য হয়ে যায়। কিন্তু সেও একদিন বড়ো হলে লম্বা হবে আশায় প্যান্টের পা না কেটে গোড়ালির কাছে গুটিয়ে রাখে দড়ির বাণ্ডিলের মতো

নাম পরেশ নাথ। কিন্তু তার ত আর থ দুটোই টএর মতো শোনায় বলে আমাদের হুজুর মনসুর প্রথমে তাকে পরেশ নাট ডাকা শুরু করে। আর মাদ্রাসা থেকে এসে আমাদের সাথে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়া বড়ো ভাই বয়সের হুজুর মনসুর যতদিনে পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি তারপর খালি পাজামা-পাঞ্জাবি আর তারপর পাঞ্জাবি-ফুলপ্যান্ট এবং সবশেষে তিনমাসের মধ্যে ফুলশার্ট-ফুলপ্যান্ট পরে ক্লাস করা শুরু করেছে ততদিনে পরেশ নাথকে স্যাররাও পরেশ নাট ডাকা শুরু করেছে আর পরেশ নাটও সম্পূর্ণ রিএ্যাকশন বন্ধ করে এটাকেই তার নাম হিসেবে মেনে নিয়েছে

- কবুতরের বাচচা কেটে রান্না করলেও এক তরকারি হয়। কিন্তু তোরে কেটে রান্না করলে তো আলু মিশিয়ে এক তরকারি বানাতে হবে...

পরেশ নাটের দৈর্ঘ প্রস্থ ওজন সম্পর্কে এটা হুজুর মনসুরের মূল্যায়ন। আর- তোর যদি রে বাপ খালি একটা শুঁড় থাকতো তাহলে তোরে পাহাড়ে নিয়ে মর্দা হাতি হিসেবে গাছ টানানো যেতো...

মনসুরের এই মূল্যায়নটা মিজানের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ওজন বিষয়ে। স্যার আসার আগে আমাদের ক্লাসটা শুরু করে মিজান খপাস করে পরেশ নাটের বইপত্র মাটিতে ফেলে দিয়ে। খুবই নিরীহ ভঙ্গিতে পরেশ নাট বইপত্র কুড়িয়ে একটু দূরে নিয়ে রেখে গিয়ে দরজায় দাঁড়ায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিরাপত্তা বুঝে নিয়ে তার ডায়লগটা ছাড়ে মিজানের দিকে- পু...য়া এক ঠুসি মারি নাকর বল্টু খুলিলাইমু

ব্যাস। শুরু হয়ে যায় পরেশ নাটের এ্যাক্রোবেটিক দৌড় আর মিজানের হস্তিপদ দাবড়। কোনো কোনোদিন মিজান ইন্দুরের বাচচার মতো ঘাড়ে ধরে প্রায় শূন্যে তুলে টানতে টানতে মেয়েদের বেঞ্চের সামনে এনে পরেশ নাটকে দিয়ে কান ধরে উঠবস করায়। আর কোনো কোনোদিন স্যার চলে এলে এক দৌড়ে- স্যার আমারে মারে বলে স্যারের পেছনে লুকিয়ে পড়লে মিজানের ভাগে পড়ে স্যারের দুতিনটা বাড়ি

আর দুই ক্লাসের মাঝখানে দুই স্যারের ফাঁকের সময়টায় এক স্যার যাবার সাথে সাথে হয়তো শোনা যাবে টুনুত করে পরেশ নাট হুজুর মনসুরের কাছে এসে বলছে- ও হুজুর। তোমরা মুসলমানরা অত রাম বুদাই কেন বলোতো?
- কেন? মুসলমানরা তোমার কী করল
- না কিছু করেনি। তবে তোমরা কোন বুদ্ধিতে বলোতো অত বড়ো সাইজের হাতি বাদ দিয়ে দুধের গরু কুরবানি করার নিয়ম বানালে? হাতি কুরবানির নিয়ম থাকলে তো আমাদের ক্লাস থেকেই একটারে কেটে সারা টাউন খেতে পারতো...

অন্য কথা যত আস্তেই বলুক না কেন। পরেশ নাট হাতি আর হাতি কুরবানির কথাটা বেশ জোরেই বলে আর সঙ্গে সঙ্গেই- মুসলমানরা কিন্তু ইন্দুরের বাচ্চা খায় না তবে সামনে পেলে কীভাবে মারে সেইটা তোরে দেখাই’ বলেই উঠে পড়ে মিজান আর সঙ্গে সঙ্গেই পুরো ক্লাস লণ্ডভণ্ড

মেজরটিলা বাজারের সাথেই আমাদের হজরত শাহজালাল স্কুল একটা ছোট্ট টিলার উপরে। স্কুলের ঠিক নিচেই সিলেট তামাবিল মহাসড়ক। সড়ক জুড়েই বাস ট্রাক আর সুযোগ পেলেই আমাদের টিলা থেকে নেমে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি...

- দেখ দেখ দেখ। বেক্কলের ঘরে বেক্কল। আকাশ পরিবহণ রাস্তা দিয়া চলে

পরেশ নাটের বিস্ময় ছিল এই বাসটা। হুজুর মনসুর যতই তাকে বোঝাক আকাশে উড়তে না পেরেও মানুষের নাম যদি পাখি হতে পারে তাহলে রাস্তায় চলা বাসের নাম আকাশ হলে দোষ কী? কিন্তু আকাশ পরিবহণ সামনে দিয়ে গেলেই পরেশকে তাকতে হয় আর কাউকে না কাউকে খোঁচা মেরে দেখাতেই হয়...

বারোয়ারি বারোটা প্রাইমারি আর মাদ্রাসা থেকে এসে আমরা ততদিনে একেবারে একই ক্লাসের হয়ে গেছি। কার সাথে কার খাতির। কার সাথে কার ঠুনাঠুনি তা স্যাররাও জেনে গেছেন। অন্য সব ক্লাসে মাঝে মাঝে মেয়েদের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকলেও ইসলাম ধর্ম শিক্ষায় পরেশ নাট বুক ফুলিয়ে সামনের বেঞ্চে এসে বসে এটাও সবার জানা হয়ে গেছে। কারণ ইসলাম ধর্ম শিক্ষায় স্যাররা তাকে কোনো পড়া দেনও না আর ধরেনও না। তাই পরেশ নাট ঘুরে ঘুরে মিজানের দুরবস্থা দেখে

ততদিনে আমাদেরকে আর সিনিয়র কেউ প্রাইমারির গন্ধ যায়নি বলে খোঁটা দেয় না। পরীক্ষা প্রায় কাছাকাছি। টিফিন পরের ঘণ্টা শুনে দুড়দাড় করে এসে ক্লাসে ঢুকছে সবাই। হঠাৎ একটা ঘ্যাচাং ব্রেক আর সাথে সাথে মানুষের হৈচৈ। ক্লাসে না ঢুকে আমরা টিলার কোনায় গিয়ে উঁকি দেই। হৈচৈ তখন ভীড় হয়ে গেছে। হঠাৎ কেউ যেন চিৎকার করে উঠে- ছাত্র ছাত্র...

দৌড়টা শুরু করে হুজুর মনসুর। ভীড়ের মধ্যে ঢুকে গিয়েই আবার বের হয়ে আসে। টিলায় দাঁড়ানো আমাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে- পরেশ আমাদের পরেশ...

আমরা। আমাদের পেছনে স্যাররা...

গাড়িটাকে লোকজন থামিয়ে দিয়েছে। মিজান গিয়ে একটানে পরেশকে তুলে ফেলে। কেউ একজন মিজানকে ছাড়িয়ে নেয়। তাকে ধাক্কা মেরে পরেশকে কোলে তুলে স্কুলের দিকে দৌড় লাগায় হুজুর মনসুর। কারা যেন ভেতর থেকে একটা টেবিল বের করে আনে উঠানে। পরেশকে টেবিলে শোয়াতে শোয়াতেই হুজুর মনসুরের মুখ থেকে বের হয়ে আসে- ইন্নালিল্লা...

হঠাৎ করে ছুটি হয়ে যাওয়া স্কুলে পরেশের বইগুলো হাতে নিয়ে ক্লাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে মিজান। মনসুর কোরান তেলাওয়াত করতে করতে হাঁটতে থাকে পরেশের লাশের সাথে আর আমরা টের পাই সমস্ত হৈচৈ ভুলে গিয়ে বড়ো মানুষের মতো গম্ভীর হয়ে গেছি সবাই....
২০০৯.০৬.০৯ মঙ্গলবার


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

আকাশ পরিবহন নামটা আসতেই কেন যেনো মনে হয়েছিলো বিচ্ছিরি একটা কাণ্ড আপনি ঘটিয়ে দিতে পারেন। হলোও তাই !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

লীলেন ভাইর এই একটা দোষ, গল্পের শেষে মন খারাপ করে দেয়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই সিরিজটা গল্প না রে ভাই
চোখের সামনে নেই হয়ে যাওয়া মানুষকে স্মরণ

মজনুভাই [অতিথি] এর ছবি

মিজান গিয়ে একটানে পরেশকে তুলে ফেলে

সবসময় ঝগড়া করার পরও ছোটদের এই মায়া সম্ভবত মানুষ বলে।

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

স্যার,লেখাটার শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল এরকম কিছু ঘটবে।
মনে হয় এখন থেকে আপনার লেখার শেষটা আগে পড়ে পরে শুরুটা পড়তে হবে।
হা.হা.হা

সাফি এর ছবি

পড়ে খুব ভালো লাগলো,

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

চলুক
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

চলুক
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল।

স্বপ্নদ্রোহ

তুলিরেখা এর ছবি

আপনার লেখাগুলো কেমন একটা জালে জড়িয়ে ফেলে। মায়াজাল। না পড়ে পরিত্রাণ থাকে না।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।