একটি সচলায়তন বিষয়ক রচনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/০৭/২০১০ - ১২:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রামায়ণের পরেও রাম-রাবণের ঘটনা আছে। গ্রামাঞ্চলের ঢপযাত্রায় সে ঘটনাগুলো দেখা যায়। কিন্তু রামায়ণোত্তর রাম-রাবণের ঘটনাটা আমাকে প্রথম বলেন সিলেটের দয়ামীরের এক থুত্থুরে দাদিমা। শাড়ি জিলাপি নিমকি আর চিটাগুড় মাখানো হুকার তামাক নিয়ে আমি তার কাছে গিয়েছিলাম কিচ্ছা সংগ্রহ করতে ৯২ সালে। এক ভিনদেশী লোকের কাছে কিচ্ছা জোগাড় করে বিক্রির চুক্তি করেছিলাম আমি...

দিদিমা ছিলেন কিচ্ছার ডিপো। কিন্তু তার তখন স্মৃতিগণ্ডগোলের সময়। এক কিচ্ছার রাজপুত্রের জৌলুস বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য রাজপুত্রের পোশাকবর্ণনায় চলে যান। এক রাজকুমারির রূপবর্ণনা দিতে গিয়ে মুদ্ধতা প্রকাশ করেন অন্য রাজকন্যার রূপে। ফলে শুরু করা কিচ্ছাটা শেষ করার জন্য প্রতিবারই তাকে আমার সূত্র ধরিয়ে দিতে হতো। কখনও তিনি সূত্রে ফিরে যেতেন; কখনও যেখান থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে ফিরে যেতে না পেরে অর্ধেক থেকে নতুন আরেকটা গল্প শোনাতেন...

গল্প শোনাতে শোনাতে একদিন ঝেড়ে ধমক লাগালেন আমাকে। বললেন- বলোতো রামের প্রতি রাবণের শেষ উপদেশ কী ছিল?
আমি বললাম জানি না

তারপর তিনি রামায়ণোত্তর রাম-রাবণের সেই গল্পটা শোনালেন; লঙ্কার যুদ্ধ যখন শেষ তখন রাম ঠিক করল সে লঙ্কার জঙ্গলেই থেকে যাবে। কারণ দেশে গেলে তাকে রাজা হতে হবে। কিন্তু সে তো কোনোদিনও রাজনীতি শিখেনি। ১২ বছর কাটিয়েছে বনেজঙ্গলে...

এই কথা শুনে ভাড়ুয়া লক্ষ্মণ (ঘরবাড়ি ছেড়ে বৌদির পেছনে ১২ বছর কাটিয়ে দিয়েছিল বলে তিনি লক্ষ্মণকে বরাবরই ভাড়ুয়া বলতেন) রামকে বলল- দাদা রে; রাবণ তো বহুত বড়ো রাজনীতিবিদ আর বিশ্বসেরা রাজা। চল তার কাছে গিয়া রাজনীতি শিখি...

রাম বলল- ঠিক

এই কথা বলে ভাড়ৃয়া লক্ষ্মণরে নিয়া রাম গেলো রাবণের কাছে রাজনীতি শিখতে। রাবণের তখন শেষ দশা। সব শুনে রাবণ বলল- আইলাই যখন তখন আরেকটু আগে আইতা; এখন তো আমার কথা বলারও শক্তি নাই। তয় ঠিক আছে। আমি এক কথায় তোমাদের রাজনীতি শিখাব...

তারপর কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে চোখ খুলে রাবণ বলল- রাজনীতি হইল শুভস্য শীঘ্রম...

রাবণ যখন দেখল রামলক্ষ্মণ আগামাথা কিছুই বোঝেনি তখন বলল- আমার যে ক্ষমতা ছিল তাতে আমি পাপীদের জন্য স্বর্গে মহাসড়ক বানাতে পারতাম। কিন্তু প্রতিদিনই ভেবেছি আইজ থাউক কাইল বানামু...
আমার যে ক্ষমতা ছিল তাতে লঙ্কা সমুদ্রের লোনাজলকে মিষ্টি শরবত বানাতে পারতাম। কিন্তু প্রতিদিন ভেবেছি আইজ থাউক পরে বানামু...

আমার যে ক্ষমতা ছিল তাতে আমি পুরা লঙ্কা জুড়ে এমন দেয়াল বানাতে পারতাম যা কোনো মানুষ কিংবা দেবতার পক্ষে লংঘন করা সম্ভব হতো না। কিন্তু প্রতিদিন ভেবেছি আইজ থাউক পরে দেখুম...

শেষ পর্যন্ত কিছুই আর করা হয়নি আমার। শুধু শেষ হয়ে গেলো আমার সময়....

তাই তোমাদের বলি যখন যা করতে ইচ্ছা করব সেইটা কইরা ফালাইবা; এইটাই রাজনীতি। রাজনীতিতে পরবর্তীকাল বলো কোনো কাল নাই....

কাহিনী শেষ করে দিদিমা আমারে বুঝিয়ে দিলেন গল্প বলায় মাথায় যখন যা আসে সেইটাই যেমন বলা নিয়ম তেমনি শোনাও নিয়ম। আগে পরে করতে গলে হয়ত আর কোনো গল্পই বলা হবে না তার....

দিদিমার ক্ষেত্রে মৃত্যু মেনেছিল শুভস্য শীঘ্রম নীতি। অনেকগুলো গল্প অর্ধে থেকে গিয়েছিল আমার...

আশি মণ ঘিও হবে না রাধাও নাচবে না....

শ্লোকটা প্রায়ই বলতেন আমার মা। তিনি লোকজ শ্লোকের খনি। বহুবার ভেবেছি সময় করে তার শ্লোকগুলোকে সংকলন করব। কিন্তু সেই সময় আর হয়নি। এখন তিনি দেশান্তরী। এখন ভালো আছেন কিনা জিজ্ঞেস করার আগে মোবাইলের ব্যালেন্স চেক করতে হয়...
এবং আমি জানি মোবাইলে কোনোদিন অঢেল ব্যালেন্সও হবে না আমার আর সংকলন করাও হবে না তার স্মৃতির সেই শ্লোকগুলা....

উপরের পুরা কাহিনীটাই সচলায়তন বিষয়ক রচনার ভূমিকা। বহুবার ভেবেছি এবং বলেছি যে সচলায়তন নিয়ে আমার মাথায় বড়ো একটা লেখা আছে। সময় করে সেটা আমি লিখব। কিন্তু আশি মণ ঘিও জোগাড় হয়নি আর রাধাও নাচেনি...

তাই রামায়ণোত্তর রাবণের শিক্ষাটাই গ্রহণ করলাম আজ- শুভস্য শীঘ্রম এই সচলায়তন বিষয়ক রচনা;...

সচলায়তনে না আসলে জানতাম না সচলায়তনের বহু দোষ আছে
সচলায়তনে না আসলে জানতাম না অনলাইনে লেখালেখি করা যায়
সচলায়তনে না আসলে জানতাম না নিজের লেখা নিজে মূল্যায়ন করা যায়
সচলায়তনে না আসলে জানতাম না পরষ্পর বিচ্ছিন্ন একটা গোষ্ঠী নিজের দৈনন্দিন জীবনে জড়িয়ে যায়...

সচলায়তন আমার প্রথম ব্লগ; অনলাইনে লেখালেখির প্রথম গেটওয়ে; নিজের লেখা মূল্যায়ন আর ধারা বদলানোর প্রধান পরীক্ষাগার....

আমাকে সচলাতনের খবর দেবার জন্য হাসান মোরশেদ এবং সুপারিশ করে সদস্য বানানোর জন্য আরিফ জেবতিককে আবারও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমি ঘোষণা করছি যে সচলায়তন নিয়ে এইটাই আমার সর্ব বৃহৎ রচনা...

শুভ জন্মদিন সচলায়তন

২০১০.০৭.০১ বিষুদবার


মন্তব্য

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

হ। (কপি: সুমঞ্চৌ)

তবে ডিটো না।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি

অসাধারণ উপলব্ধি, সমানুভূতির উচ্চারণ, সচলায়তনের কাছে কৃতজ্ঞতা এরকম একটা আড্ডার জায়গা তৈরির জন্য।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনি,নইলে কোন দিন নয়।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হাসি
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

স্পর্শ এর ছবি

চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

অনেকদিন পর আপনার এই চমৎকার লেখা পড়লাম।
তবে ভূমিকাটা বড় করে আমার মতে ১ম পর্ব লিখলেন। সচল নিয়ে আর ও পর্ব লেখা নিশ্চয়ই বাকী আছে। সেগুলো মনে করে দিয়ে দেন।
স্মৃতি থেকেই শ্লোকগুলো মনে করে করে সংকলন শুরু করা যেতে পারে। যেগুলো ভাল মনে পড়বে না সেগুলো না হয় মায়ের সাথে কথা বলে একটু ঝালিয়ে নিলেন।

বইখাতা এর ছবি

হুম! রাজনীতি বিষয়ক জ্ঞান লাভ করলাম। হাসি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

জ্ঞান শুনে আবার পড়লাম। রাজনীতি কিংবা জ্ঞান কোনোটাই পেলাম না।

ও, সব তো বইখাতা'র ব্যাপার স্যাপার চোখ টিপি

তিথীডোর এর ছবি

শুভ জন্মদিন সচলায়তন!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মুশফিকা মুমু এর ছবি

হুমম, অনেক রাজনীতি জ্ঞান হয়েছে। চলুক

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সচলায়তনের বড়ো একটা কৃতিত্বের কথা বাদ পড়ে গেছে
তা হলো: মুমুয়িত প্রশ্ন থেকে মুমুকে জ্ঞানী করে তোলা...

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

কেলাসিক।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

বাউলিয়ানা এর ছবি

লীলেন্দা, নতুন নতুন কিচ্ছা শুনতে মন চায়।

অম্লান অভি এর ছবি

আকতার- যা লেখা ছড়া আমার প্রথম পড়া এই ব্লগে- মনে পড়ে তোমাকে, মনে পড়ে সমরেশ (অসচল) যে জানিয়ে ছিল সচলায়তন'কে।
শুভ জন্মদিন সচলায়তন

মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....

Asish-আশিস এর ছবি

এতদিন পর মনের মতো ব্যতিক্রমী কিছু পাঠ করলাম।শুনলাম আর শিখলাম 'যখন যা ইচ্ছে হয় তা করে ফেলতে হয়'।আসলেই কথা শুধু কথাই থেকে যায়।।
কতজন তার ইচ্ছেমত কাজ করতে পারে, জানিনা।তবে চেষ্টা করা উচিত।।।

থার্ড আই এর ছবি

ব্লগ জীবনে সচলায়তন আমার প্রথম লেখালেখির ব্লগ না হলেও সচলের শুরু থেকেই এই ব্লগে লেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো।একেবারে অচেনা মানুষগুলোকে সচলায়তন কেমন করে যেন একান্ত আপনজন ও প্রিয় মানুষ বানিয়ে দিলো। লেখার মান বিচার, অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা, কঠোর নীতিমালা সব কিছু মিলে সচলায়তন অনন্য। আর সবচেয়ে বড় বিষয়- সচলায়তনের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।
শুভ জন্মদিন সচলায়তন।

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

শুভ জন্মদিন সচলায়তন।
এই কদিন আগেই এক সন্ধ্যার অন্ধকারে কাকরাইলের মোড়ে আজরাইলের মতো সিগারেট টেনে যাচ্ছিল এক লোক। একটু তাকিয়ে সিগারেটের লালচে আলোয় লোকটাকে ঠাহর করতে বেশি দেরি হল না। ঐ ছায়া আমি চিনি।
এইমাত্র গুলশান থেকে আসছেন তিনি। একটা চমৎকার ঘুম দিয়ে বাসের সিটে। মুহূর্তে আমরা আলাপে জড়িয়ে পড়লাম কোন বাসে কতটা সিট পাওয়া যায়, কতটা ঘুমিয়ে নেয়া যায়। দেখলাম, ভদ্রলোক সাহিত্য-শিল্পকলার পাশাপাশি এ বিষয়েও কম জ্ঞান রাখেন না!
আচমকা সেই সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা, একটু পরেই আবার উপযুক্ত এক বাসে উঠে তাঁর নাটকীয় প্রস্থান।
এরকম বিচিত্র চমৎকার এক চরিত্র মাহবুব লীলেনের সাথে এবং এরকম আরো অনেক আশ্চর্য মেধাবি এবং চমৎকার মানুষদের সাথে হয়ত আমার সেরকম করে কখনোই পরিচয় হত না, যদি না সচলায়তন থাকত। লীলেনের যুক্ত করা পয়েন্টগুলোর পরে আমি এই আরো একটা পয়েন্ট লাগালাম।
আর আমার কৃতজ্ঞতা আমাদের পান্থর কাছে। সেই আমাকে জানিয়েছিল, সচলায়তন নামে একটি ব্লগ আছে, আপনি চাইলে সেখানে লিখতে পারেন। যদিও পান্থ নিজে এসেছিল আমার পরে। হাসি
পান্থর কাছে আমার এই নীরব কৃতজ্ঞতা চিরকালই থাকবে।
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

তাসনীম এর ছবি

দারুণ ... চলুক

+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

ধুসর গোধূলি এর ছবি
কৌস্তুভ এর ছবি

শুভস্য শীঘ্রম - তাড়াতাড়ি আসুক আপনার সচলায়তন বিষয়ক বড়সড় রচনা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।