প্রতিকৃতি

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৯/০৯/২০১০ - ৯:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছেলেটি এসে দাঁড়াল সরাসরি সামনে- মিথিলা পাঠিয়েছে এটি

হাতের প্যাকেটে নয় আমি ছেলেটির দিকে তাকাই। একটা চোখ নেই। ওখানে গর্তে থিক্ থিক্ নোংরা পানি। অন্য চোখ ট্যারা। কটকটে পিঙ্গল তারকাটা চুল। ঝুলন্ত ঠোঁটের ফাটায় উঁকি দেয়া রক্তের রেখা। অগোছালো দাড়ির আড়ালে থুতনিতে গভীর কাটা একটা দাগ। সাবানের বিজ্ঞাপনওয়ালা সাদা টিশার্টে ময়লার তেলচিটে রং। দুমড়ানো প্যান্ট ঝুলে আছে ছ-ফুটি তালঢ্যাঙা দেহে গোড়ালির বেশ কিছু উপরে। স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতায় কাপড়ের গিঁট

এরকম মানুষের সাথে মিথিলার যোগাযোগ আমার মাথায় ঢোকে না। ছেলেটিও নিশ্চুপ প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে আছে। আমি কথা না বলেই প্যাকেটটা নেই। পলিথিনের ব্যাগে একটা আধহাত স্কয়ার বক্স। গহনার বক্স। কালো ভেলভেটে মোড়া। পাড়ে সোনালি জরির কাজ। এর মানে কী?

বক্স খালি। আরেকটা বক্স। সাদা পেপার কার্ডের। চিনতে পারি মিথিলার লেখা- একটা প্রতীক’। ছেলেটির নির্লিপ্ত চোখ আমার কাঁধে। সাদা বক্সটি খোলার কোনো পথ নেই। ছিঁড়ে ফেলি টান মেরে। হাতের ঝাঁকুনিতে বক্স থেকে ছিটকে গায়ের উপর এসে পড়ে একটা জীবন্ত তেলাপোকা

ছেলেটা হাসছে। ওর সামনের পাটিতে দাঁত নেই- মিথিলাও বলছিল তুমি চমকাবে না
-    মানে?

উত্তর না দিয়ে সে ঘুরে হাঁটতে থাকে

দুই বক্সে আর কিছু নেই। কিন্তু দেড়শো কিলো দূর থেকে এরকম একটা লোককে দিয়ে জীবন্ত তেলাপোকা কেন? কী বলতে চায় মিথিলা? ...আমি তেলাপোকা দেখলে চমকাব না। এর অর্থ কী? তেলাপোকা কিসের প্রতীক?

হতে পারে তেলাপোকা টিকে থাকা অস্তিত্বের প্রতীক। বিলুপ্তিহীন। ভীষণ অস্তিত্ববাদী। কোনো বিষক্রিয়ায় পৃথিবীর সব প্রাণী মরে যদি একটাও বেঁচে থাকে হয়ত সে তেলাপোকা। পানির নিচে- কমোডেও বাঁচে এই জীব। কিন্তু তেলাপোকা মরলে পচে যায়। টিকে থাকার কিছুই যদি হবে তবে সে আমাকে কয়লা পাঠাতে পারত। কিন্তু তেলাপোকা কেন?

তেলাপোকার ঠিকানা নেই। আছে গন্তব্য। অন্ধকার। অন্ধকার কোণ। গর্ত। তবে কি আমি প্রান্তর ভয় পাই? গর্ত খুঁজি? অন্যের তৈরি গর্ত? সাময়িক আড়াল?

তেলাপোকা খোলস বদলায়। যখন সে নিজেকে আরো বড়ো করতে চায় তখন পুরনো পরিচিতি পোশাক ফেলে দেয়। ধবধবে নতুন পবিত্র পোশাকে আলাদা হয়ে যায় দল থেকে; যেন দলের কাউকে কোনোদিন দেখেনি সে। চেনে না। অথচ আবার দলেই আশ্রয় নেয়। যখন প্রয়োজন পড়ে। তবে কিছুটা অন্য। কিছুটা আলাদা। এই জন্য কি তেলাপোকা দিলো?

আমার কি খোলস আছে? আমি কি আগের থেকে আলাদা? হতেই তো পারি। সময় তো আমার ভূগোলে স্থাপন করবেই নতুন কিছু চিহ্ন। কিছু নতুন রেখা। আবার প্রলেপের আড়ালে ঢেকে দেবে অনেক পুরনো দাগ

তেলাপোকার বদনাম আছে সব কিছু খায়। আমি কী খাই? খাবার মধ্যে শেষ কণাসহ খাই তো মাত্র নিজের ভবিষ্যৎ। তবে?

তেলাপোকা চকচকে। পিচ্ছিল। আঁশ নেই। গায়ে কোনো দাগ নেই। দাগ লাগে না। পিছলে বেরিয়ে যায় হাতে সুড়সুড়ি দিয়ে। আঙুলে রেখে যায় বিশ্রী আঠালো রস। দুর্গন্ধ। দাঁত নেই। বিষ নেই। কামড়ায় না। কিন্তু চিমটে চিমটে বিকৃত করে দেয় ত্বক। মানুষের নরম মাথা। তারকাটাওয়ালা পায়ের স্পর্শ শিরশিরে। খোঁচা খোঁচা। তীè। খিনখিনে

আর আমি? নিজের জীবন ছাড়া আর কোথাও থেকে তো পিছলাতে পারিনি। আর আমার তো কোনো পা-ই নেই

তেলাপোকা একটা চোর। উড়তে পারে না। উড়ার চেষ্টায় লাফালাফি করে। দেখাতে চায় সে মূলত পাখি। পতঙ্গ নয়। তাও ঝড়ের আগে। অথবা তার অহংকারী আস্ফালনই ডেকে আনে ঝড়। কিন্তু তখন সে লুকিয়ে থাকে অন্ধকারে চুপচাপ। নিরাপদ। যেন সে জানে না কিছুই। সে নিষ্পাপ আমি... আমি ...। আমি কি ওরকম?

তেলাপোকা মরে। ঠ্যাং উপরে দিয়ে মরে তেলাপোকা। আমি তো মরিনি এখনও। তবে কি মিথিলা আমার ওরকম একটা মৃত্যু চায়?

আর কী? কিচ্ছু না। তেলাপোকা একটা পতঙ্গ। শিকারির পাখি মারার টোপ। একটা করুণ প্রাণী। এই প্রাণী কিসের প্রতীক? কিচ্ছু না। ঘোড়ার ডিম। একটা আবর্জনা প্রাণী। আর কী? কারা যেন তেলাপোকা খায়। তবে কি মিথিলা আমাকে খেতে দিয়েছে? হয়ত  তাই। পোকাটা এই যে। টেবিলে ঝিমুচ্ছে। নড়ছে না। হয়ত  মিথিলা তাকে বলে দিয়েছে না নড়তে। মিথিলা অনেক কিছু পারে। এই তো হাতে। চুপচাপ। .. আচ্ছা তেলাপোকা কি ঠ্যাংশুদ্ধ খায়? পাখনাগুলো কী করে? শুঁড়? ধ্যাৎ। পাখনা- ঠ্যাং- শুঁড় ফেলে দিলে ওটা কি তেলাপোকা থাকে? ...আমি সবশুদ্ধই খাব। ...ফ্রাই করে নেব? না। তাহলে মরে যাবে। জ্যান্তই খাব...

মা... আ... রে । পোকাটা নড়ছে মুখের ভেতর। এই। এই তো যাদু। ঠান্ডা। কচ-কচ-কচ। উঁ। নামছে। গলায় শিরশিরে। এই... । চলে গেছে প্রায়। ...এই-এই... ওয়াক...

টেবিল নোংরা। আঠালো। ঘিনঘিনে রসালো। মৃত। উল্টো। আসোলে তেলাপোকা একটা উদ্ভিদ। স্বর্ণলতা। থেঁতলানো উপহাস
 

১৯৯৭.০৪.২৪-২৫ বিষুদ-শুক্রবার


মন্তব্য

জাহামজেদ এর ছবি

ভালো লাগলো লীলেন ভাই

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

রাশু [অতিথি] এর ছবি

"হয়ত মিথিলা তাকে বলে দিয়েছে না নড়তে। মিথিলা অনেক কিছু পারে।"

"তেলাপোকা মরে। ঠ্যাং উপরে দিয়ে মরে তেলাপোকা। আমি তো মরিনি এখনও। তবে কি মিথিলা আমার ওরকম একটা মৃত্যু চায়?"

"আসোলে তেলাপোকা একটা উদ্ভিদ। স্বর্ণলতা। থেঁতলানো উপহাস"

খুবই ভালো লেগেছে।
চেনা তেলাপোকাকে আবার চিনলাম। এ লেখা কি আরো আগাবে?

রাশু
ghumontoshohoreঅ্যাটgmail.com

অতিথি লেখক এর ছবি

টেবিল নোংরা। আঠালো। ঘিনঘিনে রসালো। মৃত। উল্টো। আসোলে তেলাপোকা একটা উদ্ভিদ। স্বর্ণলতা। থেঁতলানো উপহাস

[ইয়] ভাল হইছে লীলেনদা। অনেক আগে লিখছিলেন।
মানুষের চিন্তার জগৎ বড়ই বিচিত্র।

পলাশ রঞ্জন সান্যাল

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

তেলাপোকা খায়ে হজম করতে পারেননাই, এইটাও বুঝলাম
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পড়া শেষ করে আবার উপরে উঠে শিরোনামটা দেখলাম... 'প্রতিকৃতি'...
ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

আসলে তেলাপোকা একটা উদ্ভিদ। স্বর্ণলতা। থেঁতলানো উপহাস।

অসাধারণ একটা লাইন।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

তেলাপোকা হচ্ছে 'তবুও টিকে থাকা' ভালোবাসার নাম।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অমিত আহমেদ এর ছবি

শেষ-মেষ শ্বাপদ, নাকি তাও নয়!
দারুণ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।