সাকিন সুন্দরবন ৭। বঙ্গ শার্দূল

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/০১/২০১১ - ৬:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সামনের পা দুটো পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে টানটান করে পুরো শরীরের ভার লাফ দেবার জন্য পেছনের পায়ে নিয়ে শণ ঝোপের মধ্যে খাপ ধরে বসেছিল বাঘটা। বছর দশেকের পূর্ণ পুরুষ বাঘ। আমাকে দেখে শরীরটা আরো গুটিয়ে লাফ দেবার জন্য সামনের পা দুটো তুলতে তুলতে হঠাৎ করে থেমে গেলো। মাত্র হাত দশেক দূরত্ব। আমি কী করব না করব বুঝে উঠার আগেই দেখলাম বাঘটা খাপ ছেড়ে শরীর নরম করে পেছনের পায়ের উপর বসে পড়ল। মুখটা একটু হায়ের মতো ফাঁক হয়ে এলো- ভাগিনা সালাম...

আমি এখনও ভাবছি দৌড় দেবো কি না। এমন সময় আবার শুনলাম- দাঁড়িয়ে রইলি কেন? আয় এদিকে আয়

যাব কি না বুঝতে পারছি না। কথাটা বলেই ফেললাম। শুনে গ্যাওক গ্যাওক করে হেসে উঠল বাঘটা- দুর ব্যাটা। বেইমান তো ভাগিনা কুটুম। মামার বাড়িতে তোর আবার কিসের ডর? আয় এদিকে আয়

যাই কিংবা দৌড়াই। আমি তার নাগালের মধ্যেই আছি। ইচ্ছে করলে জায়গা থেকেই আমাকে এক লাফে পেড়ে ফেলতে পারে। আমি সামনেই আগালাম। দু পা এগোতে না এগোতেই শরীর টানটান করে বাঘটা আবার খাপ ধরে দাঁড়াল। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার পিঠের ব্যাগের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল- সাথে বন্দুক টন্দুক নাই তো? দেখিস বেইমানি করলে কিন্তু ঝামেলা হবে...

এইবার আমার হাসি পেল। কে কারে ডরায়। বললাম- পাঁচ হাত দূরে থেকে তোমার দিকে বন্দুক বাগালে আমার কী হতে পারে সেটা আমি ভালো করেই জানি মামা...
বাঘটা আবার শরীর নরম করে হেলেদুলে আমার কাছাকাছি এসে ডান হাত তুলে মাজায় একটা থাবা দিয়ে বলল- গুড। বুদ্ধি থাকা ভালো

এক থাবায় ব্যালেন্স হারিয়ে আমি থুবড়ে পড়লাম কাদায়- হেই মামা। মারেন ক্যান?

আমার পেটের নিচে একটা হাত ঢুকিয়ে আমাকে শূন্যে দাঁড় করাতে করাতে গ্যাওক গ্যাওক করে হাসতে থাকে বাঘটা- আরে বেটা মারি না তো। একটু আদর করলাম

আমি আবার চিৎকার করে উঠলাম- আদর লাগবে না মামু। পেটের নিচ থেকে হাত সরাও। নখ ঢুকে যাচ্ছে তো...

আমাকে আধা আছাড় দিয়ে ছেড়ে দিলে ঠিকঠাক মতো দাঁড়িয়ে শরীর থেকে কাদা ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম- আমি তো ভাবলাম তুমি না আমারে শুয়ায়ে ফেললা

বাঘ এবার তার পেট দিয়ে অমার শরীরে একটা ধাক্কা দেয়- ওই থাপ্পড় কি তোর কাছে শোয়ানোর থাপ্পড় মনে হইল? শোয়ানোর যে থাপ্পড় তার একটা দিয়ে আমরা গরু-মহিষের মাথা থেঁৎলাই। সেইটা দিলে অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতি তুই?
- তোমরা না ঘাড় মটকে মারো? গরুর মাথা কিমা করার দরকার পড়ে কেন?
-ঘাড় মটকাই হরিণ পর্যন্ত সাইজের শিকার হলে; যাদেরকে পেছন থেকে দৌড়ে ধরি। কিন্তু গরু-মহিষ তো দড়িতে বাঁধা থাকে। আমাদের দেখলেই খুঁটির চারপাশে ধুমা চক্কর লাগায়। গলা-ঘাড় কোনোটাতেই ধরা যায় না। তখন দুই হাতে দুই থাপ্পড় দিয়ে মাথা থেঁৎলে ফেলি...

বাঘটা চারপাশ ভালো করে তাকায়- মাঠ পার হয়ে পুকুরের ওই পাশেই কিন্তু জঙ্গল অফিস। এইখানে তোর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলা আমার জন্য নিরাপদ না। কে কোন দিকে গুড়–ম করে দেয় কে জানে। তার চেয়ে চল বনের ভেতরে যাই...

বাঘের পেছনে পেছনে শণবন পার হয়ে শ্বাসমূল গাঁথা কাদাকাদা মাটির মধ্যে দিয়ে আমি হাঁটি। বাঘটা দাঁড়িয়ে আমার হাঁটার কসরত দেখে- এইভাবে হাঁটলে তো একটা কাঁকড়া দাবড় দিলেও তুই দৌড়াতে পারবি না
- এইখানে আর কীভাবে হাঁটে?

বাঘ এবার একটা থাবা তুলে আমাকে দেখায়- এই দেখ। আঙুলগুলারে গুটিয়ে একটার সাথে আরেকটা টাইট করে চেপে ধরে প্রথমে মাটিতে আঙুল ঢোকাতে হবে। এতে আঙুলের চাপে কাদাপানি আর বাতাস চলে আসবে পেছনের দিকে। তখন পায়ের পাতা কাদার মধ্যে বিছালে পানি- বাতাস আর আঙুলের চাপ খাওয়া মাটি পায়ের পাতাকে ঠেলে উপরের দিকে উঠিয়ে রাখবে। কাদায় দাববে কম...

সত্যি সত্যি এখন কাদায় হাঁটা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। প্রথমে আঙুল বিছিয়ে পরে পা। আর তোলার সময় প্রথমে গোড়ালি তুলে তারপর বাকি অংশটা টেনে তোলা...

হাঁটতে হাঁটতে আমাকে দাঁড় করিয়ে বাঘটা একটা গাছের গোড়ায় গিয়ে আবার ফিরে আসে। আমি জিজ্ঞেস করি- ওখানে কী মামা?
- এইদিকে ওইটা আমার সীমানা। দেখলাম কেউ এদিকে ঢুকেছে কি না
- দেখি তো? তোমার সীমানার কী চিহ্ন চলো দেখে আসি

বাঘটা হাত তুলে আমাকে থামায়- আরে দুর। তুই বুঝবি না। আমরা তো আর তোদের মতো নামটাম লিখি না। আমরা গাছের গোড়ায় পেশশাব করে চিহ্ন দেই। ওইটার গন্ধ পেলেই আরেকজন বোঝে এই জায়গাটা আমার। তখন আর এদিকে আগায় না
- তোমাদের তো আবার সমাজে দেখা সাক্ষাত নিষিদ্ধ। দেখা হলেই মাইর

বাঘ একটু থামে- কথাটা কিন্তু পুরাপুরি কিন্তু সত্য না ভাগিনা। আমরা একটু নিজের মতো থাকি সত্য। কিন্তু তোর মামিরা তো প্রায়ই আমার এদিকে আসে। আমিও যাই। প্রায় সময়ই তো আমি কিছু ধরলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এসে তোর মামিরা একসাথে খায়
- সেইটা তো সমাজ হলো না মামা। বড়োজোর এরে পরিবার বলা যায়। সমাজ মানে কিন্তু অনেকগুলা নারী আর অনেকগুলা পুরুষ বোঝায়
- দূর বেটা। ওইরকম থাকতে গেলে তো কারো না কারো কাছে মাথা নামিয়ে থাকতে হবে। আর মাথা নামিয়ে ফেললে সেটা কি আর বাঘ থাকে রে বেটা? তবে... মাঝে মাঝে কিন্তু কেউ কেউ রায়ত থাকে। হয় মাইরে হেরে গিয়ে না হয় অভাবে কেউ কেউ কিন্তু অন্যের কাছে মাথা নামিয়ে তার এলাকায় থাকে। তখন কিন্তু আমরা তারে ফালাই না। তারে নিয়েই খাই

বাঘটা আবার হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতেই বলে- কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমার একটা রায়ত ছিল। আসছিল আমার সাথে লড়াই করতে। কিন্তু হেরে গিয়ে আর কোথাও যাবার জায়গা না পেয়ে শেষে আমার দাস হয়ে থেকে গেলো। তা আমিও তারে থাকতে দিলাম। আমি শিকার ধরলে সে খেতো। মাঝে মাঝে সেও শিকার ধরে আমারে খাওয়াত
- সেই মামা এখন কই?
- তাড়িয়ে দিয়েছি
- কেন?

এইবার হাঁটতে হাঁটতেই নিঃশব্দে হাসে বাঘ- আরে বেটা। বাঘ রায়ত হলেও কি আর সারাজীবনের গোলাম হয়? সে তো অপেক্ষায় আছে আমি দুর্বল হবার। দুর্বল হলেই সে আমারে তাড়িয়ে এই জায়গার মালিক হবে। এইজন্য দিলাম খেদিয়ে...
- তোমাদের এইসব খেদাখেদিটা কিন্তু আমার ভাল্লাগে না মামা
বাঘটা থামে। তা না লাগতে পারে। কিন্তু আরেকজনরে খেদিয়ে নিজের সীমানা ঠিক না করতে পারলে যে কোনো বাঘিনিই কাছে ঘেঁষতে দেবে না তারে?

শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে কাদার মধ্যে পিছলে যেতে যেতে তাল সামলে আমি হাঁটি আমি। আমার পাশে সাবলীলভাবে হাঁটে বাঘ। আমার দুরবস্থা দেখে গ্যাওক গ্যাওক করে দাঁড়িয়ে হাসে- খালি বুদ্ধিটা না থাকলে একটা হরিণও বোধহয় গুঁতিয়ে তোদেরকে সিধা করে দিতো... আয় ভাগি না। আমার পিঠে আয়
- না মামা। তোমার কষ্ট হবে। আমি পারব
- কী আমার ভাগিনারে। আমরা গ্রামে ঢুকে তোর থেকে কত বড়ো বড়ো গরু-মহিষ নিয়ে আসি তুই জানিস?
- সেইটা আনলে তো তোমার। তাই কষ্ট টের পাও না। একটা ধরতে পারলে তোমার কয়েকদিনের খাবার হয়। কিন্তু আমারে তো তুমি খাবা না। নাকি ভুজুং দিয়ে বনের ভেতরে নিয়ে ঘাড় মটকাবা?

বাঘটা আবার পেছনের পায়ের উপর আসন পেতে বসে পড়ে- তোদের এই একটা সমস্যা। তোরা কারো সাথে চলবিও আবার তাকে বিশ্বাসও করবি না
- বিশ্বাস কি আর চাইলেই করা যায়? এই বন থেকে তোমরা প্রায়ই মানুষ নিয়ে যাও। আমি তো আর তাদের থেকে আলাদা না

বাঘ একটু চিন্তিত হয়। থাবা দিয়ে মুখ মুছে আমার দিকে তাকায়- আচ্ছা বলতো। আজ থেকে যদি আমরা মানুষ মারা বাদ দিয়ে দেই। তাহলে কি সুন্দরবনের কোনো অস্তিত্ব থাকবে?
- থাকবে না কেন?
- থাকবে না ভাগিনা। থাকবে না। আজকে যদি পাবলিক জানে যে বাঙাল বাঘেরা আর মানুষ ধরে না তবে কালকেই দেখবি বাচ্চা বুড়া ল্যাংটা লুলা সবাই এসে হরিলুট করছে সুন্দরবনে। হাতে হাতে সাফ করে নিয়ে যাবে বন- কারেন্ট জাল দিয়ে ছেঁকে নিয়ে যাবে মাছ... আসোলে বুঝলি। সুন্দরবনের বাঙাল বাঘেরা মানুষ খায় বলেই বনটা এখনও টিকে আছে...

হাঁটতে হাঁটতে আমি হাঁপিয়ে উঠি। একটা গাছের গুঁড়ির উপরে বসে বলি- বনে ঢুকলে না হয় মানুষ ধরলা। কিন্তু তোমরা তো গ্রামে ঢুকেও গরুবাছুর মারো। সেইটার কী বলবা?
বাঘ এইবার খেপে যায়- গ্রামে ঢুকব না কেন? তোরা যদি বনে ঢুকে আমার খাবার নিতে পারিস তবে আমি গ্রামে ঢুকলে সমস্যা কোথায়?

আমিও এইবার একটু গলা চড়াই- মামা ভুলে যাবে না দুনিয়াটা কিন্তু মানুষের। মানুষেরা চাইলে কিন্তু তোমাদের চিহ্ন মুছে দিতে পারে...
- আরে দূর। তোদের ওইসব মানুষগিরি সুন্দরবনে খাটে না

- তুমি কিন্তু মানুষের ক্ষমতায় চ্যালেঞ্জ করলা মামা...

বাঘ এইবার মুখোমুবিসে পড়ে আমার। আমার মুখের কাছে থাবার নাড়িয়ে বলে- করিই তো। করলামই তো চ্যালেঞ্জ। তোর কি ধারণা সুন্দরবনে বাঙাল বাঘেরা টিকে আছে মানুষের দয়ায়? ... মোটেও না। আমরা টিকে আছি বঙ্গপসাগরের জোয়ার ভাঁটার কারণে। এইসব জোয়ারে ডোবা মাটিতে কোনোদিনও তোরা থাকতে পারবি না তাই তোদের নিয়েও আমাদের কোনো চিন্তা নাই

বাঘটা আবার উঠে দাঁড়ায়- থাক এইসব কথা। তোরা গুলি করে বিষ খাইয়ে দুই চারটা বাঘ মারবি আর আমরাও থাবা দিয়ে মারবো দুচারটা মানুষ। এইটাই সুন্দরবনের নিয়ম। এইটা নিয়া আর কথা বলে লাভ নেই। তার চেয়ে মামুর পিঠে আয়। একটু ওদিকে যাই

আমি দুপাশে পা ছড়িয়ে বাঘটার পিঠে বসি। অবলীলায় সে আমাকে নিয়ে হাঁটে- একটা হরিণ থেকে তো তোর ওজন বেশি না ভাগিনা
আমি কোনো কথা বলি না। পিঠে চড়ে চোখে পড়ে ডান কানের পেছনে একটা বড়ো ক্ষত। মাছিতে ভনভন করছে। আমি জিজ্ঞেস করি- ওটা কিসের মামা?
- আর বলিস না। ওই রায়ত ব্যাটারে তাড়ানোর সময় ওর থাবা লেগেছে
- ওটাতে তো ঘা হয়ে গেছে
- এইটাই তো ভয়ের কারণ রে ভাগিনা। বাঘের শরীরে যতই ঘা হোক; বাঘ যদি জিব দিয়ে সেই জায়গা চাটতে পারে তবে তা সেরে যায়। কিন্তু ঘাড়ে আর পিঠে যেখানে জিব দিয়ে নাগাল পাওয়া যায় না সেখানে কিছু হলেই আর রক্ষা নেই। কোথাও কাটা দেখলেই সেখানে এসে বসে সুন্দরবনের মাছি। তারপর শুরু হয় পচন। সেই পচন থেকে সুন্দরবনের বাঘের আর কোনো রক্ষা নাই ভাগিনা। ...পা দুইটা একটু তুলে রাখ। কুমির শালারা তোরে দেখলে আবার কামড়াতে আসতে পারে

একটা নদীর সামনে এসে আমাকে সতর্ক করে দেয় বাঘটা। আমি বলি- কুমিরকে তোমরাও ভয় করো?
- আরে না। কুমিরকেই তো মাঝে মাঝে নদী সাঁতরে আমরাই ধরে আনি

আমি তার পিঠ থেকে সরে গিয়ে ঘাড়ের উপরে বসে পা দুটো শূন্যে তুলে রাখি। বাঘটা আমাকে নিয়ে শুধু ঘাড়টা পানির উপরে রেখে ভেলার মতো ভাসতে ভাসতে নদী পার হয়ে যায়। আমাকে পাড়ে নামিয়ে ঝাঁকি দিয়ে শরীর শুকিয়ে আবারও আমাকে কাঁধে চড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছ দেখায়- এই দেখ। আমরাও কিন্তু মাঝেমাঝে ফলটল খাই। এইটা কিন্তু আমাদের হজমি ফল। এইটা খেলে হজমে সুবিধা হয়...

হাঁটতে হাঁটতে বাঘটা আমাকে আবার ঘাড় থেকে নামায়- তোকে তো কিছু খাওয়ানো হলো না ভাগিনা। খাড়া একটা হরিণ মেরে খাওয়াই
- আমি কাঁচা মাংস খাই না মামা। তোমার লাগলে তুমি হরিণ মারো
বাঘটা ফিরে আসে- আমার খাবার আছে। পরশুদিনের হরিণটা এখনও আছে। কিন্তু তুই তো আর বাসি মাংস খাবি না
- আমি কিচ্ছু খাবো না এখন। তোমার লাগলে তুমি খাও

খপাস করে বাঘ মাটিতে একটা থাবা দেয়। থাবাটা মাটিতে রেখেই বলে- কিছুই খাবি না তা কেমনে হয়- নে ধর এই কাঁকড়াটা খা

থাবা সরিয়ে মুখ দিয়ে মাটি থেকে থেঁতলানো কাঁকড়াটা তুলে এগিয়ে দেয়। হাতে নিয়ে দেখি খোলস ভেঙে ভেতরের নরম মাংসগুলো বের হয়ে এসেছে। আমি ভেতরের সাঁসগুলো খেয়ে খোলসটা ফেলে দেই। বাঘ আবার সেটা কুড়িয়ে নেয়- এইগুলা ফেললি কেন? এইটাও খা
- না মামা। মুখে চুলকায়। কাঁচা জিনিস খাবার অভ্যাস নেই তো
- ও আচ্ছা। তাই বল

কাঁকড়ার খোলস কুড়িয়ে বাঘ মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে চাবায়। আমি হেঁটে হেঁটে একটু দূরে যাই। বাঘটা পেছনে পেছনে আসে। সামনে বিশাল একটা নদী। নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে জোড়বাঁধা তিনটা জেলে নৌকা। আমি বলি- আচ্ছা মামা। তোমরা মানুষ না মারলে কী হয়?
বাঘটা এসে আমার পাশে দাঁড়ায়- ভাগিনা। আমাদের নামে মানুষ মারার যত বদনাম; ততটা মানুষ কিন্তু আমরা মারি না। অনেক সময় মানুষেরাই মানুষ মেরে বনের ভেতরে ফেলে যায়। তারপর সেই লাশ পেয়ে আমরা একটা দুইটা কামড় দিলাম কি দিলাম না; অমনি ফরেস্টের বন্দুক টন্দুকসহ এসে লাশ তুলে নিয়ে গিয়ে রটিয়ে দেয় যে বাঘে মেরেছে তারে। আসোলে এই বনে মানুষের হাতে যত মানুষ মরে বাঘের হাতে কিন্তু অত মানুষ মরে না...

বাঘটা একটু থামে। নদীর পাড় ধরে হাঁটে- তবে মানুষেরা বিরক্তও করে খুব। সময় নাই অসময় নাই ভটভটি চড়ে- বন্দুক উঁচিয়ে চলে আসে বনের ভেতর। সব সময় মেজাজ ঠিক রাখা যায় বল? তাছাড়া তোদের তো আবার হরিণ থেকে শুরু করে গাছ-পাতা সবটাই কাজে লাগে। একবার গাছ- একবার মধু- একবার মাছ- একবার কাঁকড়া- একবার পাতা; সারা বছরই বনের ভেতরে তোদের খাইখাই চলে। তখন দুচারটা থাবা না দিলে পরের সিজনে তো ছাগলের দড়ি নিয়ে আসবে বাঘ বেঁধে নিয়ে যেতে...

বাঘটা কথা বলতে বলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকায়- ভাগিনা তোর চলে যাওয়া দরকার। জোয়ার আসলে তুই টিকতে পারবি না

বাঘের কথা সত্য। নদীতে পানি বেড়ে গেছে অনেক। আমার নৌকা বনের অন্যপাশের নদীতে। আমি বলি- মামা জোয়ার আসতে আর কতক্ষণ লাগবে?
- জোয়ার এসে গেছে ভাগিনা। এক ঘণ্টার মধ্যে এই বন ডুবে যাবে
- কিন্তু নৌকার কাছে পৌঁছাতে তো তিন ঘণ্টার বেশি লাগবে আমার
- তিন ঘণ্টা পরে এখানে তোকে সাঁতরাতে হবে

আমি একটা গাছের দিকে তাকাই। বাঘ আমার দিকে তাকিয়ে হাসে- গাছে উঠবি? যদি সাপে কামড়ায়?
- তাহলে?

গ্যাওক গ্যাওক করে হাসতে হাসতে আবার একটা ঠ্যালা মারে আমাকে ডান হাত দিয়ে। এবার অনেকটা আস্তে। আমি আর পড়ি না। হাসতে হাসতে বলে- তোকে আমি পৌঁছে দেবো। উঠ। পিঠে উঠে শক্ত করে বস

আমাকে পিঠে নিয়ে বাঘটা দৌড়াতে শুরু করে বনের অন্যপাশে হিরণ পয়েন্টের দিকে। ওর পায়ের নিচে পানির ছোপছোপ শব্দ পাই। অনেক জায়গাতেই পানি উঠে গেছে। তার গোড়ালি পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছে পানিতে। যাবার সময় শুকনা পাওয়া ছোট ছোট অনেকগুলো খাল পার হতে আমাকে নিয়ে বাঘটাকে সাঁতরাতে হচ্ছে এখন। দৌড়াতে দৌড়াতে বাঘটা হাঁপায়। পানি বাড়ে। এই দিকটা একটু উঁচু। নৌকা থেকে বেশি দূরে না আমরা। বাঘটা একটু থেমে জিরায়- আমাদের শক্তি যতই বেশি হোক না কেন। আমরা কিন্তু একটানা বেশি দৌড়াতে পারি না। শরীর ভেঙে আসে
- তোমার আর যাবার দরকার নেই মামা। আমি একাই এইটুকু চলে যেতে পারব

বাঘটা হাঁপরের মতো হাঁপায়- পারবি না। সুন্দরবনে তোর জন্য তিন হাত জায়গাও বিপজ্জনক। ...উঠ দেখি। আরো কিছুদূর যাই

আমাকে নিয়ে বাঘটা আবার দৌড়াতে শুরু করে। হঠাৎ আমার পা গিয়ে লেগে যায় বাঘের কানের পেছনের ক্ষতটায়। ঘ্যাক করে আর্তনাদ করে উঠে বাঘ। ঘাড়টা কাৎ করে আবার আমাকে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নামিয়ে দেয় নৌকার একেবারে কাছে একটা গাছের আড়ালে। নামিয়ে দিয়েই ঘুরে দাঁড়ায়- আমি যাই। ডাক দিলে তোর লোকরা এখন এসে নিয়ে যাবে তোকে
আমি বলি- আমার ব্যাগে একটা এন্টিসেপটিক আছে। এইটা মানুষের কাটা ছেঁড়ার ওষুধ। তোমার ঘায়ে ওগুলা লাগিয়ে দিলে মনে হয় ওখানকার মাছির ডিমগুলা মরবে। তুমি ভালো হয়ে যাবে

বাঘটা আমার দিকে তাকায়- ভাগিনা। ঘাটের কাছে এসে তুই আমার ঘায়ের মধ্যে বিষ দেয়ার চিন্তা করছিস না তো?

আমি কোনো উত্তর দেই না। বাঘ অনেকক্ষণ তাকায় আমার দিকে। আমার চোখে তাকিয়ে বিশ্বাস করার চেষ্টা করে। তারপর বলে- তোদের এন্টিসেপটিকে আমার কাজ হবে কি না জানি না। তবে তুই যদি জায়গাটা পরিষ্কার করে আমার মুখ থেকে লালা নিয়ে ওখানে লাগিয়ে দিতে পারিস তাহলে কিন্তু আমি ভালো হয়ে যাব...

বাঘটা ঘাড় কাৎ করে কানের পেছনটা এগিয়ে দেয়। আমি ব্যাগ খুলে তুলা আর এন্টিসেপটিক বের করে ঘায়ের মধ্যে লাগাই। তিনবারে তুলায় ঘষে ঘষে জায়গাটা পরিষ্কার করি। একদম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাঘ। এইবার আমার মুখোমুখি হয়ে হা করে তার জিব বের করে দেয়- নে আমার জিহ্বা থেকে লালা নিয়ে ওখানে লাগিয়ে দে

আমি বাঘের মুখে তুলা ঢুকিয়ে লালা তুলে আনি। তুলা দিয়ে লাগিয়ে দেই কানের কাছের পচা ঘায়ে। তারপর ব্যাগ থেকে গামছা বের করে লম্বালম্বি মাঝখানে ছিঁড়ে ক্ষতটা ঘিরে কান আর গলা প্যাঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধি- এখন আর মাছি বসবে না। তবে সপ্তাখানেক কিন্তু পানি লাগাতে পারবে না। লবণ পানি লাগলে কিন্তু ঘা বেড়ে যাবে...

বাঘ গ্যাওক গ্যওক করে হাসে- মাছি বসলেও ঘা বাড়বে। পানি লাগলেও ঘা বাড়বে। কিন্তু পানি না লাগিয়ে সুন্দরবনে কীভাবে থাকে ভাগিনা?
আমি কোনো উত্তর দেই না। বাঘটা ঘুরে দাঁড়িয়ে আরো কিছু বলতে গিয়েও না বলে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে ফেরার পথে। হাঁটতে হাঁটতে বনের গভীরে একেবারে মিলিয়ে গেলে নিজের অজান্তে আমি কপালে হাত ঠেকাই- মামা সালাম...

সাকিন সুন্দরবন ৬। জল প্রহরী

সাকিন সুন্দরবন ৫। ঘেরাটোপ

সাকিন সুন্দরবন ৪। ভাতারখাগী

সাকিন সুন্দরবন ৩। মরণখোর

সাকিন সুন্দরবন ২। বনপর্যটক

সাকিন সুন্দরবন ১। বনমজুর


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হাঁটতে হাঁটতে বনের গভীরে একেবারে মিলিয়ে গেলে নিজের অজান্তে আমি কপারে ঠেকাই- মামা সালাম...

আপনাকেও সালাম এবং অভিনন্দন এতো সুন্দর একটা গল্প লেখার জন্য।
যাক এতোদিন পরে আপনি জাত দেখালেন।
এত সাবলীল লেখা যে এক নিমেষেই পড়ে শেষ করে ফেললাম।
এই ধারা অব্যাহত থাকুক এক কামনা রইল।

--
কালো ও সাদা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

লাইনটা আপনি কোট করার পর চোখে পড়ল ওখানে একটা শব্দ নেই আর একটা বানান ক‌্যাঁচে গেছে
লাইনের শেষটা হবে: কপালে হাত ঠেকাই

০২

ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য
কিন্তু ভাইজান আমার অভিজ্ঞতা হলো বাঙাল লেখকদের সবচে বড়ো অভাবের নাম সমালোচক
সমালোচক নাই বলে বাঙাল লেখকরা এক চক্করেই ঘুরপাক খায়
মাঝে মাঝে আঙুল দিয়ে কিছু ধরিয়ে দিলে লেখাগুলো মেরামত করা যায়

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখায় প্রথম মতামত দিতে গিয়ে একটু সংকোচ এ ছিলাম, কারন বাঙালী লেখকই হোক বা রাজনীতিবিদ- কেউ সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, এই জন্য লোকে জেনে বুঝেও পাম দেয় এবং যথারীতি তার পতন দেখেও মুচকি হাঁসে।
আপনি একটু উলটাপালটা লিখে দেখেন না, সমালোচনা কারে বলে দেখায় দিব নে... দেঁতো হাসি

--
কালো ও সাদা

অতিথি লেখক এর ছবি

এইবার বাঘের সাক্ষাতকার নিতেও বাকি রাখলেন না দেঁতো হাসি । আপনার বসগিরি দেখে আবারো একবার পুলকিত হইলাম। গুরু গুরু
আর একটা কথা, এইখানে বাঘ-বাঘিনির সমাজ ব্যবস্থা, খেদাখেদি- রায়ত রাখা, এইসব কি আসলেই জুওলজিক্যাল ট্রুথ?

ধৈবত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সাক্ষাতকার নিমুই যখন বিলাইর নিমু ক্যান? বড়োটারেই তাই ধর্লাম

০২

বাঘের ভিডিও বাঘের বই বাঘের উপর নেট এবং বাঘদেখা সুন্দরবনের মানুষের কথা যদি কিছুটা সত্য হয় তবে এখানকার বাঘের সমাজব্যবস্থাটাও সত্য

বইখাতা এর ছবি

জ্ঞানী বাঘের সাথে আলোচনা। চিন্তিত
এই পর্বটা আগের পর্বের মতো ততটা ভালো লাগে নাই। তবে এই পর্বটাও পছন্দ করলাম, এর কিছু অংশ ছোটদের গল্পের মতো করে বলা যাবে বা পড়ে শোনানো যাবে। হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই পর্বটা নিয়ে আমিও টেনশনে আছি
বাঘের তথ্যগুলো গল্পের আকারে কীভাবে বলা যায় তার উপায় হাতড়াতে হাতড়াতে মামাবাড়ি বেড়ানোর এই কৌশলটা নিলাম
অন্যভাবে গেলে সেটা লেকচার হয়ে যায়

০২
অন্য কোনো আইডিয়া থাকলে একটু বলেন
আরেকটা ট্রাই দেই অন্যভাবে

বইখাতা এর ছবি

এটাও কিন্তু আমার কাছে একটু লেকচার টাইপেরই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, লেখক নিজের কথাগুলো বাঘকে দিয়ে বলাতে উদ্গ্রীব ছিলেন। অন্যান্য পাঠকের অন্য রকমও লাগতে পারে। পাঠক হিসাবে বলবো, বাঘকে দিয়ে বলানোর এই অ্যাপ্রোচ আমার ভালোই লেগেছে। তবে লেখক যে নিজের লেকচার বাঘকে দিয়ে দেয়াচ্ছেন, এটা টের পাওয়া গেছে, আমার কাছে স্পষ্ট লেগেছে। লেখাটা তো এভাবেই থাকতে পারে, শুধু জায়গায় জায়গায় যদি একটু পলিশ করা যায় আর কি......যেন লেখকের তাগিদটা স্পষ্ট মনে না হয়ে পুরো কনভারসেশনে কোথাও কৃত্রিম ভাব না আসে...স্বাভাবিক, সহজাত মনে হয়......। বেশি পন্ডিতি টাইপ কথা বলে ফেললাম মনে হয়... মন খারাপ

যাইহোক...আপনিই ভাল বুঝবেন কীভাবে লিখলে এটাকে আগের পর্বের মতো আকর্ষণীয় করা যায়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই ফর্মে রেখে অবশ্যই আরো ঘষামাজা করব
কিছু জায়গায় জোর করে বাঘকে দিয়ে বলিয়ে ফেলেছি সত্য
দেখি আর কীভাবে চিন্তা করা যায়

মুস্তাফিজ এর ছবি

এমেম কে সাথে নিয়ে মামার সাথে স্বপ্নে ঘুরে আসেন না কেনো?

...........................
Every Picture Tells a Story

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

বাঘের সাথে ঘুরতে ঘুরতে বাঘের সুলুক জানা হলো! এইটা একটা ভালো স্টাইল হইছে!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এমএমকে সাথে নেবো বইলছেন? দেখি মামারে ফুন করি। মামা যদি অনুমতি দেয় তো নিয়ে যাবো। মামার কিছু ফটুও তোলাব

আইডিয়াটা খারাপ না

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি যখন সচলে কাউরে চিনি না... শুধু আপনার একটা গল্প পড়ে বইটা কিনতে আজীজে গেছিলাম...
তার পরে আপনার বেশ কিছু গল্প পড়ে মুদ্ধতার চরমে ছিলাম...
কিন্তু এইটা আমার ভালো লাগে নাই...
ডিটেইল হয়তো পরে কমু... কিন্তু আমার ধারণা এরচেয়ে অনেক ভালো গল্প লেখার ক্ষমতা আপনে রাখেন.. সেটা আমার ধারণার কিছু নাই.. সেই প্রমাণ আপনি আগে অনেকবারই দিছেন...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ডিটেইলটা ধরাইয়া দেন স্যার
কাইলই ফোন দিমু

অতিথি লেখক এর ছবি

এর মানে সুন্দরবনের বাঘ ধ্বংস করা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। বাঘেরা যেমন টিকিয়ে রাখে সুন্দরবন। তেমনি সুন্দরবনও টিকিয়ে রাখবে বাঙাল বাঘের বংশ

আপনার কথাটা যেন সত্যি হয়।
খুবই ভাল লাগলো। -রু

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কথাটা শেষ পর্যন্ত সত্য হবে কি না জানি না
তবে কথাটার মধ্যে যুক্তি আছে এইটুকু জানি

সজল এর ছবি

ভালো লাগছে। তবে মামীদের সাথে দেখা করলেন না যে? কিছু কিছু জ্ঞান তাদের মুখ দিয়েও বের হতে পারত।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এক মামারেই সামলাতে পারি না আবার মামী?
তবে মামাতো ভাইবোন (কিংবা মামাতো ছোট মামা)দের সাথে দেখা হলে বোধহয় পাঠ্যবই কিছুটা এড়ানো যেত

দেখি
দরকার হয় আবার যাব। আমি একা গেলে যদি না হয় তবে দল বেঁধে যাব

ফারুক হাসান এর ছবি

লীলেন ভাই, আপনার এই সিরিজটা মুগ্ধ হয়ে পড়ছি। এমন চমৎকার সিরিজের জন্য অভিনন্দন!

এই পর্বটার শুরুর দিকে একটু আড়ষ্ট লেগেছে, বোধহয় অন্য পর্বগুলির সাথে একটু খাপছাড়াও মনে হয়েছে। পাঠক হিসেবে আমার অনুভূতি হচ্ছে- অন্য পর্বগুলিতে বাস্তবতার যে টোনটা ছিল, সেটা এই পর্বে আসে নাই। দ্বিতীয়ত, শুরুতে একটু হলেও মনে হয়েছে যে লেখক জোর করে কিছু জ্ঞান দিয়ে দিলেন খাইছে । টাইগ্রিস টাইগ্রিস ব্যাপারটাতে হিউমার ছিল, কিন্তু সাইবেরিয়াকে টেনে আনায় আমার রাডারে ব্যাপারটা ঝুলে গেছে। বাঘের সাথে সিংহ কিংবা অন্যদের শিকার প্রক্রিয়ার পার্থক্যের নানান খুঁটিনাটি, বাঘ শুমারি, কলার লাগানো বাঘের ছয় মাসের মাথায় মৃত্যু, ইত্যাদি বর্ণনা যত না গল্পের কাঠামোতে উঠে এসেছে তার চেয়ে বেশি মনে হয়েছে আরোপিত, কম সাহিত্য রস কিন্তু বেশি পাঠ্যবই পাঠ্যবই ভাব।

সুন্দরবন নিজেই পাঠকের মনে যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি করে, এর গভীরতা নিয়ে, বৈচিত্র নিয়ে, রহস্য নিয়ে। সাকিন সুন্দরবনের প্রতিটা পর্বেই পাঠকের নিজস্ব জানার বাইরে অনেক অজানা ব্যাপার আপনি তুলে এনেছেন। তাদের অনেক কিছু নিয়ে পাঠক নতুন করে ভেবেছেন, উদ্বেলিত হয়েছেন। সেটা ছিল পাঠক হিসেবে দারুণ এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু নতুন কিছুর উন্মোচন তো এই সিরিজের প্রাণ নয়। এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হচ্ছে সুন্দরবন থেকে উঠে আসা ছোট ছোট গল্পগুলো। কিশোরের গল্প, আব্দুল ওহাবের গল্প, ডাকাতের গল্প, সুমনের গল্প, বিধবার গল্প, বনের গল্প। এই গল্পগুলোই লেখাটার প্রাণ। বই পড়ে, সচক্ষে দেখে, সুন্দরবন ঘুরেও যে গল্পগুলোকে ধরা যায় না।

কিন্তু এই পর্বে সেই গল্পগুলো কোথায়? রায়তের গল্প ছিল, বাঘের ক্ষতর গল্প ছিল, কিন্তু তার চেয়ে প্রকট ছিল কল্পনা। অন্য পর্বের গল্পগুলি কিন্তু কাল্পনিক মনে হয় নি। এই সুতাটা এই পর্বে কেটে গেছে বলে মনে হয়েছে।

এই মন্তব্য কেবলই পাঠকের আবদার, লেখকের স্বাধীনতাটুকু আলাদা করে রেখে ভাববেন আশা করি। যে নির্মোহ ভাব নিয়ে আপনি আব্দুল ওহাবকে সুন্দরবন থেকে বর্ণনায় তুলে এনেছেন, সেই একই নির্মোহ ভাবটা বাঘের ক্ষেত্রে ঘটেনি। এমনকি যে সুন্দরবনের বিশাল ক্যানভাসে এই লেখা জেগে উঠছে, সেই সুন্দরবনকেও আপনি যথেষ্ট পারঙ্গমতার সাথে ব্যক্ত করেছেন। অথচ, বাঘ মামার পর্বে সেই অসামান্য নির্মোহ ভাবনার সুর কেটে গেছে। মনে হয়েছে, আপনি মামার ক্ষেত্রে পূর্বাপর বাই ডিফল্ট মুগ্ধ হয়ে ছিলেন।
সমালোচনা আসলে আমার ক্ষেত্র নয়। কেবল একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার পাঠ অনুভূতি জানিয়ে গেলাম। সুন্দরবনের এই গল্প প্রিন্ট মাধ্যমে না এসে সর্বপ্রথম ব্লগে এসেছে- সাধারণ ব্লগার হিসেবে এই ব্যাপারটিতেও আমরা ব্লগাররা গর্বিত হতে পারি।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্রথমেই অসংখ্য ধন্যবাদ খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ধরিয়ে দেবার জন্য

এই পর্বটা নিয়ে আমার সত্যিকার অর্থে জোরালো কোনো স্ট্যান্ড নাই
বইয়ের পরিকল্পনা হচ্ছে আলাদা আলাদা কয়েকটা গল্পে বইটাকে সাজানো
যেগুলোর মধ্যে এক ধরনের ধারাবাহিকতা থাকবে আবার প্রতিটা গল্পই হবে স্বতন্ত্র
সুন্দরবনের সব ধরনের কেন্দ্রবিন্দুর মধ্যে অন্যতম একটা হলো বাঘ
দুনিয়ার অন্য বাঘ থেকে এর কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্যও আছে
মনে হচ্ছিল সুন্দরবন নিয়ে লিখতে গেলে কোথাও না কোথাও বাঘের বিষয়টা কিছু আসা দরকার
অন্য গল্পগুলোতে একটু আধটু করে টাচ করে গেছি। কিন্তু অনেক কিছুই টাচ করা যায়নি অন্যগল্পগুলোর বিষয়ের জন্য
তাই একবার ভাবলাম বাঘকে নিয়ে আলাদা একটা গল্প লেখা যায় কি না
ভাবনার সাথে এটাও মাথায় ছিল যে এই গল্পটার ফাউল হবার আশংকা সবচেয়ে বেশি
কারণ এর প্রধান বিষয় তথ্য আর দ্বিতীয় বিষয় বাঘকে গল্পের মধ্যে নিয়ে আসা
পরিকল্পনা ছিল বাঘকে নিয়ে গল্পটা উৎরে গেলে অন্য গল্পগুলো থেকে বাঘের ইনফোগুলো বাদ দিয়ে দেবো

০২

অনেক কিছুই আরোপিত মনে হওয়া স্বাভাবিক। কারণ আরোপই করা হয়েছে
তথ্যের তালিকা দেখে দেখে সেই তথ্য আনার জন্য আগের সংলাপগুলো সাজানো হয়েছে
কিছু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে কিছুটা উৎরে গেছে
বেশিরভাগ জায়গায় নিজেরই মনে হয়েছে পাঠ্যবই রয়ে গেছে

কিন্তু তারপরও প্রথম খসড়ায় বেশি বাদ দেইনি। সচলে ছেড়ে দিলাম সবার মতামত জানার জন্য
মূলত মতামতের চেয়ে বেশি দরকার এর বিকল্প কোনো উপস্থাপনা কৌশল
কারণ তথ্যগুলো ঠিকঠাকই আছে। গল্পের কাঠামোটা বানানো
কিন্তু এই তথ্যগুলো দেবার জন্য এর বেশি ভালো কোনো কাঠামো কল্পনা করতে পারছি না এখনও

০৩

আমি নিজে এখনও নিশ্চিত না যে এই গল্পটা বইয়ে যাবে
এইটাকে যদি পাঠ্যবই থেকে গল্প পর্যন্ত নিয়ে যেতে না পারি তা হলে বাদ দিয়ে দেবো
আপনার কমেন্ট থেকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। কোন কোন তথ্য গল্পের সাথে মিশে গেছে আর কোনটা এখনও রয়ে গেছে খাপছাড়া
এগুলো থেকে কাটছাট করে। কমিয়ে বাদ দিয়ে আবার একটা ট্রাই দিয়ে দেখব কিছু দাঁড়ায় কি না

যদি দাঁড়ায় তাহলে বইয়ে জুড়ে দেবো
না দাঁড়ালে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তথ্যগুলো নিয়ে সুন্দরবনের বাঘের পরিচিতিমূলক একটা গল্প বানাবো শিশুদের জন্য
আর কিছু তথ্য চেষ্টা করব এই বইয়ের অন্য গল্পগুলোতে ঢুকিয়ে দেবার জন্য

বিশেষত বাঘ আর সুন্দরবনের অস্তিত্বের পরস্পর নির্ভরশীলতার অংশটা

০৪

সচলে যুক্ত হবার পর থেকে আমার সবগুলো লেখাই কিন্তু বই হবার আগে সচলে এসে মন্তব্য নিয়ে ঠিকঠাক হয়ে তারপর বই হয়েছে
এবারও ব্যতিক্রম নয়

০৫

মনে হয়েছে, আপনি মামার ক্ষেত্রে পূর্বাপর বাই ডিফল্ট মুগ্ধ হয়ে ছিলেন।

এটা ঠিক। কারণ আমি বিশ্বাস করি বাঘ না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না এবং সুন্দরবন আর বাঘ পরস্পরকে টিকিয়ে রাখে পরস্পর...

মাহবুব লীলেন এর ছবি

একটা রিভিশন দিলাম
পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো বাদ দিয়ে দিলাম
এইবার কতটা গল্প হয়েছে দেখা যাক

অতিথি জলতরঙ্গ এর ছবি

এখন তো বেশ ছিমছাম লাগ্সে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অমাবস্যার অন্ধকার থেকে রৌদ্রজ্জ্বল দিনে বের আসার জন্য অভিনন্দন জানাই। -রু

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আমার কাছে এই পর্বটি বেশী সম্পূর্ণ মনে হয়েছে। আগের পর্বগুলোতে লেখকের বর্ণনা থেকে লেখক কী বলতে চান সেটা আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল না। মানে লেখকের মতামত ধরতে পারছিলাম না।

Onindita এর ছবি

এটা পড়তে দেরী হয়ে গেল।
প্রথম ৪টা গল্পের প্রত্যেকটাই আলাদা গল্প । খুব ছুঁয়ে যাওয়া গল্প প্রত্যেকটাই।তবে ঘেরাটোপ আর জলপ্রহরী পড়ে টেনশনে পড়ে গেছি- ইশ্ শেষ পর্যন্ত কী হবে? এটা নিশ্চয়ই পরের গল্পে আছে। কিন্তু না, পরে সেটা না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ হয়েছি:-)
আর আমার ও মনে হয় বাঘের গল্পের (বঙ্গ শার্দুল)ধরণটা আপনার এই বইয়ের বাকী গল্পগুলোর সাথে ঠিক যেন যাচ্ছে না। অন্য গল্পে আপনার অবজারভেশন, উপলব্ধি যেভাবে উঠে এসেছে বঙ্গ শার্দুলে তেমনটা যেন পাচ্ছিনা।
তবে পরে কোন তথ্যমূলক বই করলে এই ফর্মেটে গল্পটা বলতেই পারেন।আর প্রায় সত্যের কাছাকাছি ঘটনাটা কি এখানে দেয়া যায় না?
এগুলো সবই অবশ্য ব্যক্তিগত মতামত। শেষ পর্যন্ত লেখকের সিদ্ধান্তইতো চূড়ান্ত:-)

অতিথি লেখক এর ছবি

লীলেনদা, মামার পিঠে উঠতে উশখুশ করতাছে দেঁতো হাসি

পুরাডা পড়ার পরে মনে হইল, মামা আর আপ্নের মাঝে না এমদাদ ছিলো এলার্ট! হে গ্যালো কই?

-অতীত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।