না দেখা জীবন। সাকিন সুন্দরবন

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০২/২০১১ - ৫:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কাঠ মধু মাছের উৎস আর বাঘের আস্তানার বাইরে সুন্দরবনকে নিয়ে আমাদের ভাবনা কতদিনের? ৭২ সাল পর্যন্ত বাঘকে আমরা জানতাম উপদ্রব; শিকার করলে পুরস্কার মিলত। হরিণ ছিল মৃগয়ার উপকরণ। তার বাইরে সুন্দরবনের বাকিটা ছিল মৌয়াল বাউলি কিংবা বনবিভাগের কর্মীদের নৈমিত্তিক পানসে জীবন...

তলোয়ার চালানো পূর্বপুরুষ কিংবা বীর কাহিনী কিংবা লড়াই কিংবা গানবাজনা কিংবা ভূগোল কিংবা সংগীতের বাইরে বনকে আমরা কতদিন থেকে ঐতিহ্যের অংশ ভাবি? পশু পাখি মাছকে কতদিন হয় আমরা ভাবতে শিখেছি ঐতিহ্যের অংশ?
বোধহয় বেশিদিন না। বোধহয় বড়োজোর দেড় দশক...

০২.
সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া হয়েছে বহুবার। শুধুই ঘুরে ঘুরে দেখা। কিন্তু ২০০৯ এ সুন্দরবন থেকে ফিরে আসার পর তৈরি করে ফেলি একটা গল্প আর একটা জার্নাল। তারপর ওইটুকুই। মাঝখানে আরো দুবার গেছি। তারপর আবার গেলাম গত ডিসেম্বর। ফিরতে ফিরতে মাথায় কাজ করতে থাকল সুন্দরবনের গল্প। কিছু ড্রাফট করলাম। অনেকটা জার্নাল টাইপ। কয়েকটা হয়ে গেলে মাথায় পোকা ঢুকল- শুধু সুন্দরবন নিয়েই তো একটা বই হতে পারে... কিন্তু বই হতে গেলে তো গল্প লাগবে। আমার লেখাগুলো তো নিজের বয়ানে অনেকটা খাপছাড়া প্রায় বাস্তব ঘটনা...

লেখাগুলো সচলে পোস্ট করা শুরু করলাম। শুরু হলো কমেন্ট আসা। একটা দুইটা কমেন্ট আসে আর একটু একটু করে বদলাই। কোনোটা নতুন করে নতুনভাবে লিখি। বদলাতে বদলাতে কিংবা নতুন করতে করতে মূল গল্পের একেবারে বাইরে চলে আসে গল্পগুলো। কিন্তু তারপরও কিছু বিষয় থেকে যায়; যা আর মেরামত করা যায় না। কারণ গল্পগুলোর চরিত্র সব পরিচিত বাস্তব মানুষ। গল্পগুলো নিজের বয়ানে লেখা...

মুস্তাফিজ ভাই পরামর্শ দিলেন পরিচিত চরিত্রগুলোকে অপরিচিত করে ফেলা। করে ফেললাম। দেখলাম হাত পা নাড়ানোর জায়গা এবার অনেক বেশি। গল্পগুলোও বদলে গেলো অনেকটা। পাণ্ডব দা আরব্য রজনির উদাহরণ টেনে মন্তব্য করলেন- গল্পগুলো আলাদা আলাদা কিন্তু তারপরও একটার সাথে আরেকটার মিল....

মিলের মধ্যে আলাদা আর আলাদার মধ্যে মিল করতে গিয়ে দেখি গল্পগুলো আরেকবার বদলালো। বদলানো গল্পের ড্রাফটটা পাঠালাম পাণ্ডবদার কাছে। পাণ্ডব দা ধরে ধরে কিছু এলাকা ধরিয়ে দিলেন। আবার কাটাছেঁড়া। আবার বদলে যাওয়া। মুস্তাফিজ ভাই আরেকটা পরামর্শ দিলেন; যারা এই লেখাগুলো সচলে পড়েনি তাদেরকে দেখান...

ড্রাফটটাকে মেইল করে পাঠালাম কয়েকজনের কাছে। বেশিরভাগই মন্তব্য করল খুব ভালো হয়েছে। আরেকটু নজর দিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় নজর দেবো?
- মানে নজর দেন আরকি...

আমার জিনিস আমার ঘাড়েই আবার ফেলে গেলো সবাই। আবার তাকালাম। হঠাৎ মনে হলো নিজের বয়ান বদলে তৃতীয় পুরুষে চলে যাই...

সবগুলো লেখা থেকে এইবার বসে বসে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। দেখি হাতপা আরো খুলছে। গল্পগুলো আবারও বদলে যাচ্ছে আর সাথে সাথে জন্ম নিচ্ছে চারটা চরিত্র...

এক.
আব্দুল ওহাব

আব্দুল ওহাব একটা চিৎকার দেয়। বাঘটাও একটা বিকট হুংকার ছাড়ে। একটু পরে দুজনেই আবার খাপ ছেড়ে দেয়। দুজনেই একসাথে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকায়। দুজনেই হয়ত পালানোর রাস্তা খোঁজে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর দুজনেই আবার একসাথে শরীর টানটান করে মুখোমুখি দাঁড়ায়। আব্দুল ওহাব কুড়াল বাগিয়ে ধরে। খাপ ধরে বাঘটাও চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। আব্দুল ওহাব একপা সরে আসে বামে- যা থাকে কপালে আজ...

বাঘটাও একপা সামনে বাড়ায়- যা থাকে কপালে আজ...

- আব্দুল ওহাব কেডা?

নয়নের এই প্রশ্নে গাজী সদরুল এবার থতমত খেয়ে যায়। তারপর হো হো করে হেসে উঠে- আব্দুল ওহাব কেউ না। আব্দুল ওহাব সুন্দরবনের এক ফালতু মানুষ...

দুই.
রতন সরকার

পদবি নৌকা চালক। প্রশিক্ষণ বন্দুক চালনায়। নাম রতন সরকার

যেখানে কোস্টগার্ড চলে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে। যেখানে স্থানীয় ফরেস্টের লোকজন সরে গেছে নৌকা নিয়ে। সেখানে সত্তরজন ডাকাতের বিরুদ্ধে একটা বন্দুক নিয়ে রতনের এরকম দাঁড়িয়ে থাকা বড়োই বেমানান। জাহাজ থেকে চিৎকার দিয়ে সবাই তাকে চলে আসার জন্য ডাকে। কিন্তু সে কোনো ডাকই শোনে না। দুবলার চরের অন্ধকারে রাইফেল তাক করে একা দাঁড়িয়ে থাকে তার সাহস আর অহংকারের ভরসায়...

রতনের এই একরোখা আর তেল চিকচিক কালো শরীরটা সুন্দরবনে সকলেই চেনে; এই অবয়ব বনের সাথে বেইমানি করে না তাই বন কিংবা বাঘও বেইমানি করে না তার সাথে শুধু সাপ ছাড়া। প্রাণী জগতে এই সাপ প্রাণীটার নিয়ম কিংবা অনিয়ম বলতে কিছু নেই বলে তার সামনে থেকে ওরে বাপরে বলে লাফিয়ে সরে এসে রতন একটা বন্দুক হাতে আবার একা ঢুকে যায় বাঘের মুখ থেকে লাশ ছাড়িয়ে আনতে। লাশের চারপাশে চক্কর দিয়ে লাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে আর লাশের আত্মীয়েরা লাশ তুলে নেয়। লাশ নিয়ে আত্মীয়েরা নৌকার দিকে ফেরে আর বাঘের চোখে চোখ রেখে রতন একটু একটু করে পিছু হেঁটে আগায়। রতন পেছায় নৌকার দিকে আর বাঘ আগায় রতনের দিকে। লাশ নিয়ে সবাই উঠে যায় নৌকায়। পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে রতন আর বাঘ। নৌকা চলতে শুরু করলে একসাথে লাফিয়ে উঠে দুজন। রতন পৌঁছে যায় নৌকায় আর ইঞ্চি দুয়েকের জন্য রতনের নাগাল না পেয়ে বাঘ লাফিয়ে পড়ে জলে...

তিন.
নয়ন

মৃত কচ্ছপের ছবি তুলতে তুলতে নয়ন জিজ্ঞেস করে- না মেরে জালে আটকানো কচ্ছপ জাল থেকে ছাড়ানোর উপায় কী?
- জাল কেটে দিলেই হয়
- জাল কেটে ফেললে সমুদ্রে আবার মাছ ধরবে কীভাবে?

পরিবেশবাদীরা এইবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে- কচ্ছপের সিজনে তাহলে জেলেরা মাছ না ধরে অন্যকিছু করবে
- যেমন?
- যেমন অন্যকিছু। মানে অন্য কোনো পেশা

নয়ন একটা হাসি দেয়- কচ্ছপের সিজনে তাহলে জেলেরা কচ্ছপকে সমুদ্র ছেড়ে দিয়ে মাছ ধরার নৌকা নিয়ে ডাকাতি করে তীরে এসে কচ্ছপের ডিমে তা দেবে। তাই না?

ক্যামেরাটা আবার চোখে তুলতে তুলতে নয়ন একটা হাসি দেয়- এখন পর্যন্ত বাঙাল বাঘেরই একটা বাংলা নাম ঠিক করা গেলো না; আর ঠিক করবেন ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের বাংলা। দরকারটাই বা কী? আপনারা তো সুন্দরবনকে আন্তর্জাতিক বানিয়ে জাতিসংঘের মানচিত্রে ঢোকাবেন। ইংরেজি থাকলেই আপনাদের চলবে। ম্যানগ্রোভের বাংলা নিয়ে না হয় সুন্দরবনের জেলে বাউলিরাই ভাবুক...

চার.
গাজী সদরুল

গোলপাতা কাটতে গেলে এক বাউলির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে বাঘ। সঙ্গের লোকজন তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে হাসপাতালে। হাসপাতালে শুয়ে সে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে গাজী সদরুলকে- মেজদারে সম্বাদ দেও। আমি তারে কিছু কতা বলি যাব...

খবর শুনে বাউলি মাওয়ালিদের মেজদা গাজী সদরুল হাসপাতালে পৌঁছালে বাউলিটা তার হাত জড়িয়ে ধরে- আমি বুঝদি পাত্তি মেজদা আমি আর বাঁচপো না। ঘরে আমার নাবালক ছেইলেপিলে; তাদের দেখার কেউ নি। সব জেনিশুনে ও আমারে মাইললো। তুমি তার বিচার কুরো মেজদা। তোমার কাছে নালিশ দে গেলাম...

- বাউলিটা সেদিনই হাসপাতালে মারা যায়। তারপর আমি কিন্তু সেই বিচার করিছি ভাই...

গাজী সদরুল উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাঙের লাফ দিতে দিতে নাচে- ভটভট ভটভট ভটভট। পুরা সুন্দরবনই এখন পর্যটন আর ভটভট...

নাচতে নাচতে গাজী সদরুল হাসে- আগে সুন্দরবনের পানিতে ভাসত মরা গাছ। এখন ভাসে পোড়া ডিজেল। ভটভট ভটভট ভটভট... সুন্দরবনের সব নদী এখন ভটভট ভটভট ভটভট। দিন রাত এখন সুন্দরবনে ট্রলার আর জাহাজের মিউজিক বাজে ভটভট। হরিণ পাতা খেতে এসে ট্রলারের শব্দ শুনে দৌড়ায়। বাঘ পানি খেতে এসে জাহাজ দেখে দৌড়ায়। কুমির রোদ পোহাতে ডাঙায় উঠে মানুষ দেখে নদীতে লাফায়। পুরা সুন্দরবনের মালিক এখন ভটভটিওয়ালা পর্যটকরা। বাঘ হরিণ বানর কুমির সবাইকে এখন ভটভটির আওয়াজ থেকে নিজেকে লুকিয়ে খেতে হয়- ঘুমাতে হয় এমনকি সংগমও করতে হয়...

০৩.
৯টা গল্পের এই বইটা হতো না যদি না তথ্যের জন্য সময়ে অসময়ে সুন্দরবনের মানুষ বাপ্পী ভাইকে ফোন করা যেত। বাপ্পী ভাই চেষ্টা করছিল তার বড়ো ছেলেটাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। কারণ তার ছেলে আর হয়ত সুন্দরবনকে পেশা হিসেবে নিতে পারবে না ভবিষ্যতে। গত ডিসেম্বরে শেষবার যখন সুন্দরবন থেকে ফিরি তখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়া ছেলেটা মটর সাইকেলে করে বাপ্পী ভাইকে ঘাট থেকে নিয়ে যেতে এসছিল। মটর সাইকেল দুর্ঘটনায়ই ১৭ বছরের ছেলেটা গত সপ্তায় মারা গেলো। একটা দুঃখ জড়িয়ে থাকল বইটার সাথে...

০৪
মুস্তাফিজ ভাইয়ের প্রচ্ছদে ৯টা ধারাবাহিক গল্প নিয়ে সাকিন সুন্দরবন বইটা ১৪ ফেব্রুয়ারি মেলায় এসছে শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে...

০৫

সাকিন সুন্দরবন বইটির মোড়ক উন্মোচন ১৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকেল ৫ টায় নজরুল মঞ্চে। সময় থাকলে চলে আসেন সবাই

সাকিন সুন্দরবন ৮। মালজোড়া

সাকিন সুন্দরবন ৭। জলদানো

সাকিন সুন্দরবন ৬। জলপ্রহরী

সাকিন সুন্দরবন ৪। বনপর্যটক

সাকিন সুন্দরবন ৩। ঘেরাটোপ

সাকিন সুন্দরবন ২। মরণখোর

সাকিন সুন্দরবন ১। বনমজুর


মন্তব্য

মুস্তাফিজ এর ছবি

বইটা ফিরে এসে দেখবো, আগামীকাল আবার সুন্দরবন যাচ্ছি কীনা চোখ টিপি

...........................
Every Picture Tells a Story

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

সুন্দরবন আপনার নামে লিখে দিলাম, মুস্তাফিজ ভাই। চোখ টিপি
বইয়ের জন্য শুভেচ্ছা।

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আফসোস! পরবাসে আছি!!!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

আগ্রহ পেলাম। অবশ্যই পড়ব।

_____________________________________
মেঘদুত

বইখাতা এর ছবি

আপনার বইটা কেনার ইচ্ছা আছে...তবে বইমেলায় যাওয়া হয় কিনা এই নিয়েই টেনশনে আছি...

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

দেশে এসে অবশ্যই কিনবো।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার বইটা কেনার ইচ্ছা আছে।অবশ্যই পড়ব।
------------------------------
Sad Stories
Sad Songs

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নিজের বোঝা নিজেকেই টানতে হয় মাঝি! অন্যের বুদ্ধিতে খালি হয়রানী বাড়ে, বোঝা হালকা হয় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাসিব এর ছবি

এই বইটা আমি কিনবো।

ফাহিম হাসান এর ছবি

লীলেনদা,

আপনার লেখার ঢং খুব পছন্দ হয়েছে। আপনার বই কি বের হয়ে গিয়েছে? আপনার সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই লেখা সংক্রান্ত কয়েকটা ব্যাপারে। আমি human-wildlife interaction নিয়ে একটা ছোট কাজ করছি।

আমার ইমেইল

শুভেচ্ছা

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

বইটা অবশ্যই কিনবো। এরকম বই না পড়লে চলে না।
লেখক আর বই দুজনের জন্য শুভ কামনা রইল।

তিথীডোর এর ছবি

শুভ কামনা লেখক আর বই দু-জনের জন্যেই।
বইটা অবশ্যই পড়ব। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।