আমার এক ফুপু। যুদ্ধে স্বামী হারানোর পর বিয়েশাদি না করে দেড় বছরের ছেলেটাকে বড়ো করে তুললেন। পড়াশোনা রাজনীতি নাটক আর চাকরি করতে করতে একদিন জন্ডিস বাঁধিয়ে ধুপ করে ছেলেটা মরে গেলে ফুপু একদম ঝিম মেরে গেলেন। তার এই অবস্থায় সবাই ঠিক করল ফুপু যদি ঘুরে ঘুরে সবার বাড়িতে কিছুদিন করে থাকেন তাহলে হয়ত ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন...
প্রথমেই তিনি গেলেন তার মায়ের কাছে। সেখানে গিয়ে নিজের মাকে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার ছয়টা মেয়ের মধ্যে একটাও মরল না কিন্তু আমার মাত্র একটা কেন মরে গেলো? একই প্রশ্ন তিনি জিজ্ঞেস করেন তার অন্য মাকে। তারপর তিনি তার ভাইয়ের বাড়ি যান। ভাইয়ের বাড়ি থেকে অন্য ভাই কিংবা বোনের বাড়ি গিয়েও তিনি দেখেন তার ভাইবোনদের চারটা পাঁচটা সাতটা করে ছেলেমেয়ে হৈ হুল্লুড় করে। তিনি ক্ষেপে উঠেন- ও ভাই- ও ভাবী- ও আপা- এই অমুক তোমাদের এইগুলা মরে না কেন? আমরা শুধু একটাই কেন মরে?
তার মায়েদের ছেলেমেয়ে দেখে ফুপু কাঁদেন। তার ভাইবোনদের ছেলেমেয়ে দেখে তিনি কাঁদেন। তার ভাতিজি ভাগ্নিদের ছেলেমেয়ে দেখে তিনি কাঁদেন তার একেবারে একা একটা একাকিত্ব নিয়ে...
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। ফুপু তার নিজের একাকিত্বকে হজম করে নিয়েছেন বহুদিন। এই কয় বছরে তার ভাইবোনদের সংখ্যা ১৫ থেকে নেমে এসেছে ১২তে। আট ভাই সাত বোনের জায়গায় এখন তারা ছয় ভাই ছয় বোন। কিন্তু ভাতিজা-ভাতিজি-ভাগ্নে-ভাগ্নির সংখ্যা একটাও কমেনি; ক্যাঁচরম্যাচর করতে করতে বড়ো হয়ে সবগুলাই কাজকর্ম বিয়েশাদি পর্যায়ে চলে গেছে এখন। এবং এখনও সেই ফুপু তার ভাইবোনদের বাড়িতে যান। কিন্তু এখন গিয়ে তিনি বেশ অবাক হন- ও ভাবী। তোমার না সাত ছেলেমেয়ে। কই একটাকেও তো দেখি না? গেলো কই সব?
- যাবে আবার কই?
কথাটা বলে আমার মা একটা লিস্টি নিয়ে বসেন। বড়ো ছেলে থেকে ছোট মেয়ে। কে কোন জায়গায় আছে তার ফিরিস্তি দিতে থাকেন। কিন্তু ফুপু তাকে থামিয়ে দেন- কে কোথায় আছে তা দিয়ে আমার কী হবে? আমি তো দেখতে পাচ্ছি একটাও না থেকে আমার যে অবস্থা সাতটা থেকে তোমার অবস্থাও তাই...
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার মা স্বীকার করেন- বাড়িতে তারা এখন একা একা দুইজন মানুষ...
একা বাড়িতে একা একা দুইজন মানুষের তালিকায় এখন আছেন আমার ষষ্ঠ আর সপ্তম ফুপু। আর বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্বামী আর ২৭ বছর পর্যন্ত বড়ো করে ছেলে হারিয়ে একেবারে একা হয়ে যাওয়া আমার এই ফুপুর তালিকায় ছেলেমেয়ে জীবিত থেকেও এখন যুক্ত হয়েছেন আমার বড়ো চাচি আর দ্বিতীয় ফুপু। একই প্রক্রিয়ায় নানার বাড়িতে একা বড়ো মামা আর মামি। বড়ো খালা একেবারে একার দলে। একেবারে একার দলে আমার বড়ো ভাই আমি আর আমার ছোটবোনের তিন শাশুড়ি; বাড়িতে কেউ নেই। একা একা তারা বাড়িগুলো পাহারা দেন...
০২
আমার মা মাঝে মাঝে ক্ষেপে উঠেন- তোদেরকে তো আমি কোনোদিন সময় দিতে কম দেইনি। এখন প্রত্যেকে একঘণ্টা করে আমাকে দিলে প্রতিদিন আমার সাত ঘণ্টা হয়...
অঙ্কটা খুবই সোজা আর দাবিটাও সামান্য। সাত ছেলেমেয়ের মা সন্তানদের কাছে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে সময় চাচ্ছেন তার ডাক্তার ওষুধ টুকটাক বাজার আর এদিক সেদিক নিয়ে যাবার জন্য। বাবা একজন দাবিহীন মানুষ। তিনি কিছুই চান না। তার বয়স ৭৩। হাঁটলে শরীর কাঁপে; দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হতে পারেন না তিনি। শ্রবণশক্তি কমে এসেছে তার; রিকশার বেল কিংবা গাড়ির হর্ন সব সময় তার কানে যায় না। মুখকাটা মায়ের একঘণ্টা করে দাবি শুনে মনে হয় দাবিহীন বাবারও বোধহয় ছেলেমেয়ের কাছে কিছু সময় পাওনা হয়ে গেছে এখন...
কিন্তু সময় এখন ভাগ হয়ে আছে দেশের বাইরে আর বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। সময়ের খোঁজে তারা দেশের বাইরে গিয়ে দেখেন সেই সন্তানের সময় অন্য জায়গায় বন্ধকি দেয়া। তাদের জন্য সে রেখে যায় ফাঁকা একটা ঘর। সেই ঘরে তারা বসে থাকেন একা একা দুইজন মানুষ। উদ্বাস্তু নগরী ঢাকায় এসে তারা দেখেন তাদের অন্য সন্তান থাকার ঠিকানাতেও ফাঁকা একটা ঘর। সিলেটেও ফিরলেও তাদের জন্য থাকে আরেকটা ফাঁকা ফাঁকা ঘর যেখানে একা একা দুইজন মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই...
০৩
কথায় কথায় একবার বলেছিলাম ভবিষ্যতে একজন নার্স রাখার কথা। বাবা কিছু বললেন না। মা বললেন- দেশে কি বিষের অভাব যে সাত কুলাঙ্গার রেখে নার্সের হাতে পানি খেতে হবে?
তাকে বোঝানো সম্ভব হয়নি মরার সময় কুলাঙ্গারের পক্ষে মুখে পানি দেয়া সম্ভব হলেও উদ্বাস্তুরা তা পারে না...
০৪
৩ বিয়েতে ১৫ সন্তানের জনক আমার দাদা নাকি চাইতেন বাড়ি সব সময় হৈ হুল্লুড়ে থাক। এজন্য ছুতানাতায় তিনি সব ছেলেমেয়ে বৌজামাই নাতিনাতনিকে নিয়ে বাড়িতে জড়ো করতেন। তিনি মরে যাবার পর বড়োচাচা দেখলেন বাড়িটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তিনি হাঁটা শুরু করলেন তার ভাইবোনদের বাড়িতে বাড়িতে- তোরা বাড়ি আয়। অত বড়ো বাড়ি রেখে এইভাবে কেউ থাকে?
ভাই আর ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের তো অবশ্যই; তিনি তার বোন আর বোনজামাইদেরও বহু ফুসলিয়েছেন বাড়ি ফেরার জন্য। ভাইবোনদের বাড়ি ফেরার জন্য টানাটানি করতে করতে হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করেন তার ঘর খালি করে ছড়িয়ে পড়ছে তার নিজের ছেলেমেয়েগুলা। এইবার তিনি থামেন। এইবার তিনি বাড়িচলো নীতি বাদ দিয়ে তার সব ছোট মেয়ের বিয়ের সময় অন্য এক পরিকল্পনা নিয়ে বাড়িবাড়ি গিয়ে সবার মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে অনুরোধ করেন- সবাইকে আসতে হবে কিন্তু। মরার আগে বংশের সবাইকে নিয়ে একটা বেলা একসঙ্গে ভাত খেতে চাই। কিন্তু বিয়ের দিন যখন দেখলেন তার নিজের ছেলেই আসতে পারল না বোনের বিয়েতে আর জড়ো হলো মাত্র দশভাগের একভাগ মানুষ তখন মরার আগে পর্যন্ত কাউকেই তিনি আর বললেন না বাড়িতে যাবার কথা। কিন্তু আমার মনে হয় তিনি যদি এখন এসে আবার বাড়ি যাবার কথা বলতেন তবে তার বহু ভাইবোন বিনা তর্কে বাড়ি ফিরে যেত; কারণ তাদের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই...
কিন্তু জমজমাট সেই বাড়িটা কি সহ্য করতে পারবে একসঙ্গে অতগুলো মানুষের একাকিত্ব?
২০১১.০৭.২০ বুধবার
মন্তব্য
নিজের মা-বাবার কথা মনে পরে গেলো, বাড়ী জুড়ে দু’জন মানুষ কিভাবে যে সময় কাটান! বাবা বই পড়েন, তার সময় কাটে, আর আমার মা’র হচ্ছে গল্প করার শখ, আড্ডা দেয়ার শখ, একমাত্র বোনটা কিছুদিন হলো চট্রগ্রামে থাকে। আমি চিরকালই বাউন্ডুলে কিন্তু রাতটাতো অন্তত দেখতেন। এই সপ্তাহে ঢাকা যাবোনা, কাজ নিয়ে ফেলেছি, মনটা খারাপ হয়ে গেলো
আপনার লেখা খুব সপর্শ্ব করে যায়!!
ভয় পাই , বড় ভয় পাই... নিজের বাবা মার কথা ভেবে ...
নিজের বাবা-মার কথা মনে হল। আহারে...
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
অসাধারণ।
....আরেকটু বুড়ো হোন। তারপর দেখুন, নিজের কি হয়...
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
এই তো জীবনের ভবিতব্য...
একটা মন খারাপ করা কিন্তু নিদারূণ সত্যি লেখা। মায়ের নেতৃত্বে এখনও জয়েন্ট ফ্যামিলিটা টিকে আছে। কাজের জন্যে শুধু আমিই বাইরে থাকি কিন্তু সময় সূযোগ পেলেই বাড়ি যাই। আর রোজ অন্তত একবার তো বাড়িতে কথা বলা চা'ই।
কিন্তু মাঝে মাঝেই ভাবনা জুড়ে বসে, আগামীতে কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। তবে মাথায় আমার শয়তানীতে ভরা। সহায় সম্পত্তি যেটুকু করেছি তার সবই আম্মার নামে করেছি। ভাইগুলো যেনো সম্পত্তির লোভে হলেও আম্মার কমাণ্ডে থাকে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
নগর-সভ্যতায় আমাদের অনিবার্য গন্তব্য এটাই, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা ! আমরা সেদিকেই এগুচ্ছি..., রোধ করার উপায় হাতে নেই !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
এসব রোধ করার পথ খুঁজে বের করতেই হবে, আমাদের বাঁচতেই হবে আড্ডায়, ঐক্যতানে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
সেইই...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
এমন লেখাগুলো মাঝে মাঝে চাবুক মেরে আমাদের বোধকে জাগিয়ে তোলে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
পারিবারিক বৃদ্ধাশ্রম......ভবিতব্য...
নাড়া দিলো।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
আমি বোধ করি লিলেন ভাইয়ের বড় কোনো লেখা এই প্রথম পড়লাম। এক টানে পড়া শেষ করে মনে হল, যাহ, এত্তো ছোট?! আরেকটু বড় হলে কি ক্ষতি হত?
মূলতঃ আমরা সবাই একা। শুরুতে এবং শেষেও।
@বন্দনা কবীর,
মানতে পারলাম না।
আসলে আমরা নিজেরাই নিজেদের একা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি, "শুরুতে এবং শেষেও" এবং সার্থকও হই। জীবনে এটা চাই, ওটা চাই, এই চাই, সেই চাই করতে করতে নিজেদের কখন যে একা করে ফেলি নিজেরাও টের পাই না।
এখন বাইরে থেকে মা'কে ফোন করলে খালি আফসোস করে, বলে "দেশে তো ভালই চাকরি করতি, কোন কিছুর অভাব তো ছিলা না, তারপরও যে কেন তোর মাথায় বিদেশ যাওয়ার ভূত চাপল!!!"
আসলে নিজের চাহিদার সাথে একটু (খুব বেশি না, একটু) আপোস করলেই খুব সুখি হওয়া কঠিন কিছু না।
পৃথিবীর সবাই সুখি হউক।
============
আমি জানি না
গণ একাকিত্ব - শব্দটাই বলে দিল সব। মন খারাপ করা লেখা।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ভালো লেখা। দেশে ফিরবোই ফিরবো।
বড় কষ্টের জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছেন মাহবুব লীলেন। এরকম একটা লেখা আমার মাথায় ছিল, কিন্তু আমি জানি এইরকম করে আমি জীবনেও এই কথাগুলো তুলে আনতে পারতাম না।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
যান্ত্রিক জীবনের বড় নিষ্ঠুর সত্য।
অলস সময়
নাগরিক জীবনের আষ্টে-পৃষ্টে আমাদের ছুটে চলার এই নিরানন্দ গতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে আমরা হাঁরিয়ে ফেলছি আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে। ....... আপনার লেখাটা মন ছুঁয়ে গেল।
অসহ্য!
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
..............
নিষ্ঠুর বাস্তবতা
শুধু যে বিচ্ছিন্ন হয়েই মানুষ একা তাতো নয়, একসাথে থেকেও অনেকেই একা হয়ে যায়। যেন একেক জন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ! মাঝে মাঝে মনে হয় আলাদা হয়ে ,দূরে থেকে একা হওয়া ও ভাল। কী জানি, সব সময় বুঝতে পারিনা। তবে এটাই হয়ত শেষ পর্যন্ত ভবিতব্য!
মর্মান্তিক বাস্তবতা লীলেনদা...............
মা বাবার জন্য কষ্ট হয় কাছে থাকতে পারিনা তাই, সাথে নিজের জন্য অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কা। লীলেনদা খুব ছুঁয়ে গেলো লিখাটা।
নগর-সভ্যতায় আমাদের অনিবার্য গন্তব্য এটাই, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা ! আমরা সেদিকেই এগুচ্ছি..., রোধ করার উপায় হাতে নেই !
খুব সুনদর একটি পোসট, ধন্যবাদ।
লেখাটা এখন পড়লাম । নিষ্ঠুর বাস্তবতা
নতুন মন্তব্য করুন