কবিতা বেশি দিন টেকে বলেই কি কবিতায় পুরোনো কথা বেশি বলা হয়? নাকি অনেক কবিই বর্তমানকে মেনে নিতে পারেন না বলে অতীতের সোনালি দিনকেই করে তোলেন স্বাপ্নিক বর্তমান? অথবা হয়তো মানুষ অতীতের দিনগুলো থেকে শুধু সোনালি সময়টাকেই ধরে রাখে স্মৃতিতে; তাই অতীত সবসময়ই কবিতার জন্য বড়ো বেশি উপযোগী অনুষঙ্গ হিসেবে উপস্থিত থাকে। আর বর্তমান যেহেতু অতি বাস্তব; আলু-ডিম-ডাল কিংবা তেল-নুন-মরিচের সাথে মিলে মিশে লেপ্টে থাকে। তাই সহজে তা সার্থক কবির পাতে উঠার যোগ্য হয়ে উঠে না; আমি জানি না। কিন্তু একটা বিষয় বারবারই আমাকে আমাকে ভাবায়। আর তা হলো যে বাংলাদেশের পরিচয় আমরা সাহিত্যে পাই। কিংবা যে বাঙালিত্বের চিত্র আঁকা হয় সাহিত্যে; গ্রাম-নদী-মাঠ। সে বাংলাদেশ বোধ হয় এখন আর নেই। অথবা তার সাথে এসে যুক্ত হয়ে গেছে নাগরিক-আধানাগরিক এক নতুন বাংলাদেশ ও বাঙালিত্ব। এবং বর্তমানের বাংলাদেশ বলতে এরকম এক নাগরিক-রাজনৈতিক বাংলাদেশই যেন সত্য। কিন্তু কবিতায় তার উপস্থিতি পাই না। শুধু শামসুর রাহমান এক্ষেত্রে যেন অন্য রকম। তার ক্লাসিকধর্মী সাম্প্রতিকতাই আমার মতে অন্য কবিদের থেকে তাকে আলাদা করে দেয়। তিনি যেন নাগরিক অক্ষরবৃত্তে কবিতা লেখেন। যেখানে গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষের শৈশবের আম কুড়ানোর স্মৃতির সাথে একাকার হয়ে মিশে যায় গুলিস্তানে দ্রুততার সাথে বাসে উঠার নাগিরক কৌশল
শামসুর রাহমান এখানেই আমার কাছে আলাদা হয়ে ওঠেন। কী ভাষায়- কী উপমায়- কী চিত্রকল্পে। এমনকি তার বাক্যের গতিও যেন পরিবর্তিত বাংলার গতির সাথে তাল মেলানো। যা অন্যদের কাছে পেতে আমার কষ্ট হয়। অন্য অনেকের কবিতা পড়ার সময় বারবারই মনে হতে থাকে যা পড়ছি তা আমার নয়; আমাদের কোনো এক কালের- কোনো এক জীবনের ছবি। কিন্তু শামসুর রাহমানে এলে তার কথাগুলো যেন নিজের জীবন দিয়েই বুঝি। যে গ্রাম ছেড়ে এসেছি আমি অথবা আমরা। আর যে নাগরিকতাকে মেনে নিয়েছি জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে। এ দুটোরই যেন সমন্বয় জানেন শুধু শামসুর রাহমান। একমাত্র শামসুর রাহমানই বোধ হয় সাম্প্রতিক বাংলাদেশের একটি বিষয়কে খুব স্পষ্ট করে ধরতে পেরেছেন। আর তা হলো যে বাংলাদেশে শহরের রাস্তাঘাটে সারা বছর মানুষের ভীড়ে মানুষ হাঁটতে পারে না। সেই বাংলাদেশের শহরগুলোতে উৎসবের বন্ধের সময় রাস্তায় নিশ্চিন্তে বিড়াল ঘুমায়। আর বাড়ি ফেরা মানুষের কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে গ্রাম। এই যে বার্ষিক ক্যালেন্ডার ধরে গ্রাম আর শহরের সমন্বয় করে চলেছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মানুষ। তাতে বদলে গেছে মানুষের অভ্যাস। মানুষের সংস্কৃতি। গেছে মানুষের ভাষা। এই ভাষা আলাদা। প্রচলিত গ্রামের ভাষা নয় এটি। আবার অতি শাহরিক যান্ত্রিক ভাষাও নয়। এ ভাষার ধরন আর গতি আলাদা। যা শামসুর রাহমান চেনেন। অন্যরা যখন এ নিয়ে কথা বলেন তখন হয় তা হয়ে ওঠে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক না হয় যান্ত্রিকতা নিয়ে কথোপকথন। শুধু শামসুর রাহমানই যেন আমার মতে বাংলাদেশ বাঙালি পরিচয়ের নতুন সূত্রটি আবিষ্কার করতে পেরেছেন তার কবিতার ভাষায় কিংবা ছন্দে...
...................................
লেখাটা লেখা হয়েছিল যখন তিনি জীবিত ছিলেন তখন। ২০০৪ এর কোনো এক সময় কোনো এক লিটল ম্যাগের জন্য। কিন্তু লিটল ম্যাগটাও যেমন ছাপা হয়নি তেমনি লেখাটার কথাও আর মনে ছিল না। হঠাৎ আজ শামসুর রাহমানের মৃত্যুদিনে লেখাটার কথা মনে হলো... মনে হলো এখনও হয়ত তার সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করি আমি। তার সম্পর্কে আমার ধারণার আরো কিছু সূত্র এখানে আছে। হয়ত অনেকের সাথেই কথাগুলো মিলবে না...
০২
আপনাকে শ্রদ্ধা শামসুর রাহমান আমাদের কবিতাময় তারুণ্যের জন্য
মন্তব্য
ভালো পাইলাম।
আমাদের সৌভাগ্য লিটল ম্যাগের জন্য লেখা হলেও ছাপা হয়নি লিটল ম্যাগে। তাহলে চোখ এড়িয়ে যেতো নিশ্চিত। আইজ আর পাইতাম না এখানে।
বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় কবি'কে।
অনুধাবনগুলো যথার্থ; প্রতিটি বাক্যে সহমত। মাঝে একটা বিশাল গ্যাপের পর আবার কিছুটা নিয়মিত পাচ্ছি আপনাকে লীলেনদা। লেখাটা অসাধারণ হয়েছে ।
_____________________
Give Her Freedom!
অকস্মাৎ দুপুরে চিলের ডাকে আমার শৈশব ফিরে আসে
শ্লেট, চকখড়ি আর বাদামি রঙের ব্যাগ হাতে।
গলিতে আবছা কন্ঠস্বর।
আরো কিছু প্রিয় স্মৃতি আলোড়নকারী শব্দ শোনার আশায় ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি...'
#ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই : শামসুর রাহমান
আপনাকে শ্রদ্ধা শামসুর রাহমান।
আর লেখাটার জন্য ধন্যবাদ লীলেন্দা।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
কবি শামসুর রাহমানকে শ্রদ্ধা।
অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়লাম।
ঠিক এরকম বিশ্লেষণধর্মী লেখা আপনার কাছে আরও চাই। অন্য কবিদের পাশাপাশি আপনার নিজের কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট, কি কি বিষয় ,কেন,কিভাবে আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে এগুলো আপনার লেখায় নিয়ে আসুন। আপনার লেখায় কেন কোন বিষয় সরাসরি না এনে প্রায় ই রূপকধর্মী করেন এসবও আসতে পারে। এরকম বিশ্লেষণমূলক লেখা পাঠকদের কবিতার পাশাপাশি কবির চিন্তা-ভাবনাকেও বুঝতে অনেক সাহায্য করবে মনে হয়।
আপনার নতুন কবিতা কই?
শামসুর রাহমান আমাদের উদ্বোধন ঘটাইছেন। বাংলাদেশের বাংলায়।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
একমত।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
সহমত, সহমত, সহমত।
কী প্রেমে, কি দ্রোহে, কি আটপৌরে জীবনে, কি মায়াবী কল্পনার যাদুজগতে - শামসুর রাহমান যেন সবকিছুর ছবি এঁকেছেন ঠিক বর্তমানে। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তাঁর শব্দচয়ন।
"জীবনানন্দীয় পরিবেশ" কিংবা "জয়নুলী কাক" শব্দগুলি ব্যবহার কর তিনি যেমন মূহুর্তেই কবিতার পটভূমি ছবির মতো তুলে ধরেছেন সামনে তেমনি ষষ্ঠ আঙ্গুলের নিপুণ শব্দ যোজনায় বাঙময় করে তুলেছেন "মাতাল ঋত্বিক" এর মতো অচেনা শব্দগুলিকে।
লীলেন ভাই, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা আঙ্গিকে আপনার বিশ্লেষন যেন এতদিন বন্ধ করে রাখা একটা জানালা খুলে দিল আমার মনের কুটিরে। খুব ভালো লাগলো লেখাটা।
-অয়ন
নতুন মন্তব্য করুন