ভীমেরে সামলাইতে পারে দ্রৌপদী কিন্তু সে এখন ভীমের কোয়ালিশন হইয়া যুধিষ্ঠিরের অপজিশন। ভীমরে কিছুটা সামলাইতে পারত অর্জুন কিন্তু অস্ত্র জোগাড়ের নামে সে পলাইছে বনবাস ছেড়ে। এই অবস্থায় দৌড়ের উপর না রাখলে ভীমেরে সামলানো কঠিন। তাই একদিন ভবঘুরে মুনি লোমশরে পাইয়া তার নেতৃত্বে যুধিষ্ঠির তীর্থ ভ্রমণের একটা পরিকল্পনা বানাইয়া ফালায়। কিন্তু তীর্থযাত্রায় দরকারি মালপত্র বহন করব কেডায়?...
পাণ্ডবগো রাজপুত্র পোলাপানরা রাজ্যনাশ হইবার পর বাপ-কাকারে বনে পাঠাইয়া এখন আদরে-মাখনে-আরামে থাকতাছে নিজেদের রাজা-মহারাজা মামাদের ঘরে। আর যে জীবনে রাজবাড়িতে থাকেও নাই; খায়ও নাই কিংবা নিজেরে রাজপুত্র বইলা পরিচয়ও দেয় নাই; দুঃসময়ে ভীম তারেই সংবাদ দিলো বনের পথে বাপ-কাকা আর সৎমায়ের মালপত্র টানার কামে। সে ঘটোৎকচ; পাণ্ডব বংশের প্রথম সন্তান; ভীম আর হিড়িম্বার পোলা...
ঘটা আইসাই যুধিষ্ঠিররে তাড়ায়- লও জ্যাঠা। তীর্থফির্ত বাদ দিয়া আমার ঘরে চলো। এই বয়সে তোমাদের বনে বাদাড়ে ঘুইরা কাম নাই। সবাইরে নিয়া আমার ঘরে চলো...
যুধিষ্ঠির ঘটারে বোঝায়- তোর বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না বাজান। কারণ আমরা যে প্রতিজ্ঞা করছি বনবাসে থাকার। এখন তোর বাড়ি গেলে তো সেই প্রতিজ্ঞা থাকে না
- হ। আমার বাড়ি গেলে তোমাদের প্রতিজ্ঞা ভাঙে কিন্তু বনবাসের প্রতিজ্ঞা কইরাও যে অর্জুন কাকু অস্ত্র জোগাড়ের নামে বনের বাইরে গিয়া রাজা-বাদশার বাড়িতে ঘি মাখন খাইয়া দিন কাটায় তাতে প্রতিজ্ঞার কিছু হয় না?
যুধিষ্ঠির ঘটার কথার উত্তর দেয় না কিন্তু ধৌম্য আগাইয়া আসে- শোনো ঘটোৎকচ। বাপ কাকা জ্যাঠারে এমন কওয়া ঠিক না। তাদের বিষয়-আশয় তাগোরেই দেখতে দাও...
ঘটোৎকচ পিটপিট কইরা ধ্যৌম্যের দিকে তাকায়- অ্যারে...। পরখাউকি বামনা দেখি এইখানেও আছে। তুমি অত চিন্তা করো ক্যান? বাপ কাকারে খাওয়াইতে পারলে তোমার খন্দকও ভরাইতে পারব আমি। এখন সইরা খাড়াও; আমি জ্যাঠার লগে কথা কইতাছি
এই অপমানটা ধৌম্যের লাগে- এইভাবে কওয়া উচিত না ঘটা। আমি তোমার মুরব্বি মানুষ। তাছাড়া আমি সম্রাট যুধিষ্ঠিরের পুরোহিত
- বালের পুরোহিত তুমি। সম্রাটের জুয়া খেলা ছাড়াইতে পারো নাই তো কোন বালটা ছিড়ছ তুমি পুরোতগিরি করে?
এইবার ভীমের মনে হয় পোলারে থামান দরকার। সে জায়গায় খাড়াইয়া ঘটারে দাবড়ানি দেয়- থাপড়াইয়া কইলাম তোর কান ফাটাইয়া ফালামু। বেশি বক বক করছ তুই
- হ আব্বা। কথা অবশ্য একটু বেশিই কই। কিন্তু মায়ে কয় আমার এই দোষটা নাকি বাপের থেকে পাওয়া...
ঠাঠা কইরা হাইসা উঠে যুধিষ্ঠির- হা হা হা। তোরে আমি কইছি না ভীম; যে তুই বেশি কথা কস? এইবার নিজের পোলার মুখে শুনলি তো?
দ্রৌপদী হাসে। যুধিষ্ঠিররে জীবনেও এমন হাসতে দেখে নাই সে। ...ঘটা আবার গিয়া যুধিষ্ঠিররে ধরে- ও জ্যাঠা তোমার চ্যালাচামুন্ডা ঠাকুর কুকুর যা আছে সব নিয়া চলো। চিন্তার কিছু নাই। তোমার বামনার লাইগাও আমার ঘরে ঘাসপাতার অভাব হইব না
ধৌম্য চুপসাইয়া গেছে। ভীম ধৌম্যরে বাচাইতে আইসা পোলা আর ভাইয়ের ডবল টেক্কায় পুরাই বেকুব। এইবার দ্রৌপদী আগাইয়া আসে- এইভাবে কয় না বাপ। ব্রাহ্মণ মানুষ। মনে কষ্ট পাইলে অভিশাপ লাগব যে
- এইবার তুমি আমারে হাসাইলা ছুডু মা। যারে জন্ম দিয়া বাপে ফালাইয়া গেছে জঙ্গলে; সেই পোলারে তুমি ঠোলা বামনার অভিশাপের ডর দেখাও? এখন আমিও ডাঙর দুইটা পোলার বাপ। দশ-বিশজন মানুষও নাইড়া খাই। কোনো হালার আশীর্বাদ ছাড়াই যখন অতটুকু আসতে পারছি তখন অভিশাপে ডরানের কী আছে? চলো বাইত যাই...
ঘটার এই খোঁচাটা সরাসরি ভীমের দিকে। ভীম চামে চামে কাটে। দ্রৌপদী তাকায় যুধিষ্ঠিরের দিকে। ঘটা দ্রৌপদীরে ছাইড়া আবার আইসা খাড়ায় যুধিষ্ঠিরের সামনে- বুঝলা জ্যাঠা। তোমরা আশ্বিনে-কাত্তিকে কয়দিন রাজাবাদশা হইলেও জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটাইছ বনে জঙ্গলে। তাই এইসবে তোমাগের অভ্যাস আছে। কিন্তু ছুডু মা তো খাটি রাজকন্যা। তুমি তোমার সিংহাসন নিয়া যা ইচ্ছা করতে পারতা কিন্তু ছুডুমায়েরে এইভাবে বনে জঙ্গলে আইনা কষ্ট দেওন কিন্তু ঠিক হয় নাই...
- কপালে না থাকলে কী আর করব রে বাপ?
- কপাল কইও না জ্যাঠা। তোমার খাইসলতের দোষ। তুমি আসোলে নিজের বুদ্ধিতে কোনো বালও ছিড়তে পারো না। তোমারে রাজা বানাইছে দাদি কুন্তী আর সম্রাট বানাইছে কাগুকৃষ্ণ। কিন্তু যখনই তারা তোমারে একলা ছাইড়া দিছে তখনই তুমি করলা একটা আকাম...
- তোরে মাথার উপরে তুইলা কিন্তু একটা আছাড় দিমু ঘটা...
ভীম এইবার নাক গলায় যুধিষ্ঠিররে বাচাইতে। কিন্তু ঘটা নির্বিকার- তা দেও। কিন্তু তার আগে আমার যুক্তিটা খণ্ডাইতে পারলে ভাবতাম জীবনে পয়লাবারের মতো একটা বাপের কাম করলা
- তুই কিন্তু সত্যি সত্যি এখন মাইর খাবি...
ভীম থাবা বাগাইয়া আসলে যুধিষ্ঠির থামায়- ওরে কইতে দে। বংশের বড়ো পোলা। বাপ চাচার পরে সেই হইব এই বংশের রাজা। সে তো বাপ-জ্যাঠার একটু সমালোচনা করতেই পারে...
- তোমার নিজের রাজ্য থাকলে না উত্তরাধিকার নিয়া ভাববা। নিজেই এখন জঙ্গলে বইসা বাল ফালাও আবার আরেকজনরে দেও সিংহাসনের ভাগ...
পোলারে সামলাইতে গিয়া ভীম নিজেই খেইপা উঠে যুধিষ্ঠিরের উপর। যুধিষ্ঠিরও একটু গরম হয় ভীমের উপর- পোলাপানের সামনে মুখ খারাপ করলে কিন্তু পোলার সামনেই তোরে আমি একটা চটকনা দিমু ভীম...
এইবার ঘটা নেয় মধ্যস্থের ভূমিকা- আহা-হা জ্যাঠা। তুমিও দেখি রাগ করো। আসোলে যারা মারামারি করে তাগোর মুখ একটু খারাপই হয়। ধরো গিয়া তুমি করো ধর্মকর্ম। তোমার যা ডাকাডাকি তা সব ব্রহ্মা-বিষ্ণু শিব কিংবা সর্বনিুে দ্বৈপায়ন; এখন তুমি তো আর তাগোরে শালা বাইঞ্চত কইয়া ডাকতে পারো না। কিন্তু অর্জুন কাকায় যখন কর্ণরে মারতে যাইব তখন যদি- খানকির পোলা কর্ণ তোরে আমি খাইয়া ফালামু কইয়া আওয়াজ না দেয় তো আক্রমণের জোশ পাইব কই?
- কর্ণ আমাগের শত্তুর হইলেও তারে মা তুইলা গালি দেওয়া কিন্তু ঠিক না ঘটা....
যুধিষ্ঠিরের কথায় ঘটোৎকচ হাসে- হ। তা অবশ্য ঠিক। কারণ কার গালি যে কার পিঠে লাগে কে জানে। ...তো যা কইতাছিলাম জ্যাঠা। তোমাদের খাইসলতের যেমন দোষ আছে; হিসাব নিকাশেও কিন্তু ভুল আছে। ধরো আব্বায় ফালাইতাছে দুর্যোধন জ্যাঠারে মারার লাইগা আর অর্জুন কাকা আর কাগুকৃষ্ণ মিলা পিছলা পথ খুজতাছে কর্ণ জ্যাঠারে মারার...
- কর্ণ আবার তোর জ্যাঠা হয় কেমনে?
ভীমের ধামকিতে ঘটোৎকচ ত্যাড়া চোখে যুধিষ্ঠিররে সার্ভে কইরা আবার ভীমের দিকে ফিরে- শত্তুর হইলেও তিনি আমার মুরব্বি মানুষ আব্বা। নাম ধইরা ডাকলে তো আবার জ্যাঠায় আপত্তি করব। তাই তিনারেও জ্যাঠা কইলাম আরকি। তো যাই হোক তোমরা একজন ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর পোলা দুর্যোধনরে মারতে চাও আর আরেকজন মারতে চাও সূর্যপুত্র... ঠিক না জ্যাঠা? কর্ণরে তো মাইনসে সূর্যপুত্রই কয়?
- হ। সে সূর্যপুত্র হিসাবেই পরিচিতি
- তার মায়ের নাম যেন কী জ্যাঠা?
ভীম আবার বাগড়া দেয়- ওর মায়ের নাম রাধা ধোপানি
ঘটোৎকচ আবার যুধিষ্ঠিরের দিকে চাইয়া হাসে- কর্ণরে রাধার পোলা কইলে তো আর তারে সূর্যপুত্র কওয়া যাইব না। কইতে হইব অধিরথের পোলা। তাই না জ্যাঠা?
যুধিষ্ঠির এইবার একটু বিরক্ত হয়- এইটা নিয়া পরে তোর লগে কথা কমু আমি। যা কইতেছিল তা ক। কারো বাপমায়ের নাম দরকার নাই। নাম কইলেই ওগোরে আমরা চিনি...
- হ। কথা হইল- তোমরা মারতে চাও দুর্যোধন আর কর্ণরে। কিন্তু হিসাব কইরা কি দেখছ যে কার ঘাড়ে পা দিয়া মূল মাখনটা কার ঘটি থাইকা খাইতাছে কে?
- তুইই ক
যুধিষ্ঠিরের কথায় ঘটা আগে বাড়ে- আসোল মাখনটা কিন্তু খাইতাছে ভরদ্বাজের বাটপার পোলা চোট্টা বামুন; যারে তোমরা গুরু দ্রোণাচার্য কইয়া নম নম করো
- এমন কইরা কয় না বাপ। সে কিন্তু আমাগের গুরু আর বহু বড়ো সাধক
- ল্যাওড়ার সাধক আমার। আর তোমাদের গুরু হইলে আমার কী? চোররে চোর কইতে অসুবিধা কই? ওই হালায় কিন্তু একটা বাটপার আর মিচকা শয়তান। পানি না ছুইয়া খলুইতে মাছ তোলে। চিন্তা কইরা দেখো তো তোমাগের যে কুরু-পাণ্ডব-কর্ণে অত মারামারি; সেই কুরু-পাণ্ডব-কর্ণরে সে কিন্তু গুরুদক্ষিণা নিবার নামে এক কইরা ফালাইছিল ছুডুমায়ের বাপ দ্রুপদের রাজ্য কাইড়া নিবার সময়। তোমরা কিন্তু কুরু-পাণ্ডব-কর্ণ একলগে যুদ্ধ কইরা ঠিকই দ্রুপদের অর্ধেক রাজ্য কাইড়া নিয়া দিছিলা তারে। আবার দেখো সেই কুরু পাণ্ডবে পাশা খেইলা তোমরা যে রাজ্যটা হারাইলা; সেই রাজ্যের রাজা কিন্তু এখন শকুনিও না; দুর্যোধনও না- আবার কর্ণও না। তোমাদের ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্যের রাজা কিন্তু এখন তোমাগের সেই গুরু দ্রোণচোট্টা...
ভীম হা করে পোলার মুখের দিকে তাকায়- তুই অত হিসাব শিখলি কেমনে?
- আব্বা। আমি তো আর তোমার কোলে চইড়া বড়ো হই নাই। বড়ো হইছি একলা একলা মাইনসের কিলগুতা খাইয়া। হিসাবে ভুল করলে অত বড়ো হইয়া দুই পোলার বাপ হইতে পারতাম না আমি
পোলর খোঁচায় যতটা না আঘাত পায় তার চেয়ে পোলার বুদ্ধিতে বেশি খুশি হয় ভীম। সে আগাইয়া আইসা আসন গাইড়া বসে- আমিও তো কই হালায় লোভী বামুন। না হইলে বামুন হইয়া অস্ত্র চালায় ক্যান?
- হিসাব আরো আছে আব্বা; সেইটা হইল ক্ষতির হিসাব। ক্ষতিটা কার বেশি হইছে জানো? বেশি হইছে ছুডু মায়ের। তোমরা আসোলে কেউই কোনোদিন রাজপুত্র আছিলা না। আছিলা কুন্তীপুত্র। মাঝখানে কিছুদিন রাজবাড়িতে ছিলা এর বেশি কিছু না। কিন্তু ছুডু মায়ে জন্মের পয়লা দিন থাইকাই রাজকইন্যা। বিবাহের পরপরই সে হইছে রাজরানি। এখন সেই ছুডুমায়ের বাপের রাজ্যও নিছে দ্রোণ আবার তার স্বামীগো রাজ্যও ভোগ করতাছে দ্রোণ আর এখন তারেই ঘুইরা বেড়াইতে হইতাছে বনে বাদাড়ে... আর অপমান যা হইবার সেইটাও তো হইছে ছুডু মায়ে একলাই...
দ্রৌপদী দৌড়াইয়া আসে। তার অপমানের হিসাব দিতে গিয়া এখন আবার ঘটা কাহিনী বয়ান করুক তা চায় না সে। দ্রৌপদী দ্রুত আইসা কথা আগলায়- খালি গপ্প করলে হইব? আয় আগে কিছু খাওয়া দাওয়া কইরা নে...
লাফ দিয়া উঠে ঘটা- আরে। আমি তো ভুইলাই গেছিলাম। তোমাগো লাইগা কিছু খাওন নিয়া আসছি আমি। ...আব্বা আসো। তোমার লাইগা আস্ত একটা গরু মাইরা ঘিয়ে ভুনা কইরা আনছি; তোমার পোলার বৌ নিজের হাতে রান্না করছে
- তোর বৌয়ের হাতের রান্না আমি খামু না...
- ক্যান? সে আবার কী দোষ করল?
ভীম উইঠা যায়- খাই বেশি বইলা আমারে কি তুই ভুক্ষাসি পাইসছ যে যার-তার হাতের রান্না খামু?
ঘটা এইবার মেরুদণ্ড সোজা কইরা ভীমের সামনে গিয়া খাড়ায়- আমার বৌয়ের জাত নিয়া কথা কবা না কলাম আব্বা। তোমার সাক্ষাৎ দাদা দ্বৈপায়ন আছিল নমশূদ্র মাইমলের পুত আর তুমার নিজের বাপ তো বাতাস; ধরাও যায় না ছুয়াও যায় না; দেখার তো প্রশ্নই নাই... আমারে জাত দেখাইও না তুমি...
- জাতের গুষ্টি মারি আমি। কিন্তু তোর বৌয়ের হাতের রান্না আমি খামু না...
ভীম সইরা যায়। ঘটা গিয়া আবার তার সামনে খাড়ায়- ক্যান? খাবা না ক্যান?
- খামু ক্যান? তুই যে বিয়া করছস আমারে কইছিলি?
ঘটোৎকচ এইবার ভীমেরে ভালো কইরা দেইখা আস্তে আস্তে গিয়া দ্রৌপদীর সামনে খাড়ায়- তুমি কওতো ছুডুমা; আব্বারে গিয়া কি আমার কওয়া উচিত ছিল যে; আব্বাজান আপনার পোলার বিবাহে আপনার নিমন্ত্রণ? নাকি তারই গিয়া মাইনসেরে কওয়া দরকার ছিল যে; আমার পরথম পোলার বিবাহে আপনাগের নিমন্ত্রণ? তুমি একটু ন্যায্য বিচার করোতো ছুডু মা; কামলা খাটার দরকার না পড়লে যে বাপে একবার সংবাদও নেয় না পোলায় বাইচা আছে কি মরছে; আমি বিয়া করতে হইলে সেই বাপের পারমিশন না নেওয়া কি খুব অন্যায় হইছে?
দ্রৌপদী এই প্রশ্নের উত্তর খুইজা পায় না। ভীম আঙুল দিয়া মাটি খামচায়। যুধিষ্ঠির ঘটার দিকে আগাইয়া আসে- মনে কষ্ট নিস না বাপ। দোষ আমারই বেশি। পরিবারের মুরুব্বি হিসাবে আমারই উচিত ছিল নিজে খাড়াইয়া তোর বিবাহ তদারকি করা... কিন্তু পারি নাই; সেইটা খালি তোর বাপের না; আমাগের সবার অন্যায় হইছে মানি...
যুধিষ্ঠিরের কথায় ভীম এইবার গলা খাকারি দেয়- হ। অন্যায় হইছে আমিও মানি। কিন্তু তুই তো একবারের লাইগা তোর বৌটারে দেখাইলিও না। অথচ তুই বৌ নিয়া ইন্দ্রপ্রস্থ আইসা মায়ের লগে দেখা করস আমি খবর পাই...
যুধিষ্ঠির কথা কাটে- বৌমার লগে কিন্তু আমার দেখা ্হইছে ভীম। আমি কিন্তু তারে আশীর্বাদও করছি। বৌটা খুবই লক্ষ্মী; দাদি সত্যবতীর লগে তার চেহারা আর ব্যবহারেও খুব মিল...
- হ জ্যাঠা। তুমি যে তারে আশীর্বাদ করছ তাতে অহিলা খুবই খুশি হইছে। তোমার লাইগা সে আলাদা কইরা পায়েস রাইন্ধা পাঠাইছে। কইছে- জ্যাঠারে নিয়া দিও; জ্যাঠায় মিঠা জিনিস খুব পছন্দ করে...
ঝেংটি মাইরা এইবার ভীম সইরা যায়- তাইলে তোর জ্যাঠারেই মাংসগুলান খাওয়া। আমি খামু ক্যান? আমারে কি বৌ দেখাইছস?
দ্রৌপদী মিটিমিটি হাসে। যুধিষ্ঠির আস্তে গিয়া ভীমের কান্ধে হাত রাখে- তোরে না কইছি সবখানে লাফাবি না? পোলার খোঁজ নিস নাই জীবনেও একবার। এতে পোলার মনে দুঃখু থাকতেই পারে। হের লাইগা পোলায় ইন্দ্রপ্রস্থ আইসা দাদির লগে দেখা করছে কিন্তু অভিমান থাইকা বাপ কাকারে বৌ দেখায় নাই। সেইটা সে করতেই পারে। এইটা নিয়া তর্ক করলে তুই কিন্তু বেকায়দায় পইড়া যাবি...
- কিন্তু তোমারে তো দেখাইছে
ঘটা কিছু কইতে গেলে যুধিষ্ঠির হাত তুইলা থামাইয়া হাসে- তোর পোলায় আমারেও বৌ দেখায় নাইরে বেকুব। সে বৌপোলা নিয়া মায়ের কাছে আসছে শুইনা আমিই গেছিলাম তাগোরে আশীর্বাদ করতে...
ভীম আরো কিছু কইতে গিয়া যুধিষ্ঠিরের চোখে চোখে তাকাইয়া ঘটনাটা বোঝে। সাথে সাথে এই প্রসঙ্গ ছাইড়া সে অন্য প্রসঙ্গে মোড় ঘোরায়- হ হ। সেইটা তো আমিও করছি। ওর বড়ো পোলা অঞ্জনরে আমি কিন্তু ছুডু একটা গদাও উপহার দিছি...
- হ আব্বা তা দিছ। কারণ নাতিরে খাতির না করলে দরকারে অদরকারে তোমার পাশে লাঠি নিয়া খাড়াইব কেডায়?
যুধিষ্ঠির ঘটারে থামাইয়া দেয়- যা হইবার হইছে। কই খানা বাইর কইরা তোর আব্বারে খাইতে দে। ঘিয়ে ভুনা মাংস সে খুব পছন্দ করে...
কুন্তী ছাড়া কারো সামনে যুধিষ্ঠির আর ভীমেরে এমন বিলাই হইতে দেখে নাই দ্রৌপদী। সে ঘটারে জিগায়- তুই এত কথা জানস তা তো জানতাম না। তোরে তো ইন্দ্রপ্রস্থেও দেখছি। কিন্তু তোর মুখে তো এত কথা শুনি নাই...
- কথা কেমনে শুনবা? এখন তোমরা জঙ্গলে আছ তাই তোমাগোরে পরিবারের মানুষ মনে হইতাছে। ইন্দ্রপ্রস্থে তো তোমরা আছিলা রাজা মহারাজা। তোমাগোর লগে কথা কওয়া তো দূরের কথা; কাছে যাইতেই ডর লাগতো। কত কাজ তোমাগের...। আমার মতো জংলি পোলার দিকে তাকানোর কি সময় আছিল কারো? আমার তো আর মণিমুক্তার হার নাই; মাথায় মুকুটও নাই...
যুধিষ্ঠির আবার থামায়- রাগ করিস না বাপ। বুঝসই তো রাজনীতিতে অনেক মাইনসেরে সময় দেয়া লাগে। অনেক কাম...
- কী রাজনীতি তোমরা করতা সেইটা তো দেখতেই পাইতাছি; বিচি পর্যন্ত জুয়ার দানে বন্ধক দিয়া এখন বনে আইসা আঙুল চোষো...
যুধিষ্ঠির কথাটা গায়ে মাখে না- যতবারই গেছস আমি কিন্তু তোর সংবাদ নিছি। আমারে তুই দোষ দিবার পারস না
- তোমারে দোষ দেই না জ্যাঠা। তুমি আমারে খাতির করতা সত্য। কিন্তু জীবনে একবার মাত্র মায়েরে নিয়া গেলাম তোমার রাজসূয় যজ্ঞে। তাও যাইচা যাই নাই; গেছিলাম তোমার আর দাদির নিমন্ত্রণ পাইয়া মা আর আমার লোকগুলারে নিয়া। কিন্তু তোমার তিন পয়সার দারোয়ান আমারে দরজায় আটকাইয়া দিলো- কয় জংলিফংলির রাজবাড়িতে ঢুকার পারমিশন নাই...
সেদিন হিড়িম্বার লগে আছিল ঘটোৎকচ আর তার মায়াযুদ্ধের সম্পূর্ণ বাহিনী। তারা জানে সম্রাট যুধিষ্ঠিরের সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী এই ঘটা। ঘটার লগে ঢোল নাকাড়া বাজাইয়া ভবিষ্যৎ সম্রাটের লগে যখন তারা আইসা খাড়াইল দরজায় তখনই ঘটল এই ঘটনা- জংলিদের ভিতরে যাওয়া নিষেধ...
বলতে দেরি কিন্তু চোক্ষের পলকে দারোয়ানের চিৎ হইয়া পড়তে দেরি হয় নাই। পাশ থাইকা কেউ একটা আওয়াজ দিলোÑ ভাঙ...
সঙ্গে সঙ্গে হিড়িম্বা দৌড়াইয়া আসেÑ ঘটা এইগুলারে থামা। আমরা আসছি তোর দাদির নিমন্ত্রণে...
বহুত কষ্টে ঘটা তার বাহিনী থামায়। ঘটার যেখানে অপমান সেইখানে যজ্ঞের অধিকার কারো নাই। মায়াযুদ্ধের কাহিনী শুনছে অনেকেই। কিন্তু চোক্ষের পলকে একপাল মায়াযোদ্ধার খেইপা উঠা দেখে ঘাবড়ে যায় দারোয়ান দল। নিজের দলেরে সামলাইয়া ঘটা গিয়া বড়ো দারোয়ানের সামনে খাড়ায়- সম্রাট যুধিষ্ঠিররে গিয়া কও; হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ আসছে। তার সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত আমি এইখানে শান্ত হইয়া খাড়ামু। যা করার তা করব সংবাদ পাওয়ার পর...
সকল রথী মহারথী থুইয়া যুধিষ্ঠির দৌড়াইয়া আইসা জড়াইয়া ধরে ঘটারে- রাগ করিস না বাজান। তোরে চিনতে পারে নাই... যুধিষ্ঠির হিড়িম্বার কাছে গিয়াও জোড় হাত করে- রাগ কইরো না বইন..
হিড়িম্বারে নারীমহলে কুন্তীর কাছে পাঠাইয়া যুধিষ্ঠির ঘটারে নিজের পাশে বসাইয়া ঘোষণা দেয়- এই পোলা হইল ভীম আর হিড়িম্বার ছেলে ঘটোৎকচ; আমাগো বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান। সেই হিসাবে জ্যাঠা আর বাপ কাকার পরে এই ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্রাট এই ঘটোৎকচ। আপনেরা সকলে তারে আশীর্বাদ করেন...
যুধিষ্ঠির ঘটার কান্ধে হাত রাখে- সেইদিন দারোয়ানটা তোরে চিনতে পারে নাই বাজান। আসোলে আমরা ভাইদেরই দায়িত্ব ছিল দরজায় খাড়াইয়া অতিথিদের চিনা বাড়ির ভিতরে নিয়া যাওয়া। কিন্তু কী কারণে যে সেই সময় আমাদের কেউই দরজার সামনে আছিল না; সেই সুযোগে দারোয়ানটা তোর লগে বেয়াদবি কইরা ফালাইছে... কিন্তু পরে তো সকলের সামনে বুক ফুলাইয়াই আমি তোরে পরিচয় করাইয়া দিছি পাণ্ডব বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান কইয়া
- হ। জ্যাঠা। তুমি তা করছ। সমবেত সকলের সামনে ঘোষণাও দিছ যে বংশের বড়ো পোলা হিসাবে জ্যাঠা-বাপ- কাকার পরে সিংহাসনের উত্তরাধিকারও আমি... তোমার উপর কোনো রাগ নাই জ্যাঠা। যার যা পাওনা তা দিতে তুমি কোনোদিন কিপটামি করো না... কিন্তু মায়েরে যে অন্দরে পাঠাইয়া দিলা; সেইখানে তোমাদের বৌয়েরা কী ব্যবহারটা করল মায়ের লগে সেইটা খেয়াল আছে তোমার?
পাণ্ডবগো মোট নয় বৌয়ের লাইগা নয়খান আসন সাজাইয়া রাখা ছিল অন্দরের ভিতর। হিড়িম্বারে স্বাগত জানাইয়া কুন্তী বংশের বড়ো বধূ হিসাবে তারে নিয়া হাতে ধইরা বসায় মধ্যের আসনে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়া উঠে দ্রৌপদী- জংলি রাক্ষুসিরে ঘরের ভিতরে আসতে দিছে কেডা?
পাণ্ডবগো বাকি বৌরাও দ্রৌপদীর লগে তাল মিলায়। কুন্তী যখন দৌড়াইয়া যায় দ্রৌপদীরে থামাইতে তখন দাদি কুন্তীর লগে দেখা করবার লাইগা ঘটোৎকচও গিয়া হাজির হইছে অন্দরমহলের দরজায়। ঘটা কয়েক মিনিট থ মাইরা বুইঝা ফালায় ঘটনা; হিড়িম্বারে কেউই পাণ্ডবগো অন্য বৌদের লগে বসতে দিতে নারাজ...। এক লাফে ঘটা গিয়া খাড়ায় সকলের মাঝখানে- আমার মা এই বংশের বড়ো বৌ। সকলের মাঝখানেই হইব তার আসন...
- এই তুই কেডা? জংলি রাক্ষুসি ভীমের লগে পেট লাগাইয়া তোরে বিয়াইছিল দেইখা তুইও কি নিজেরে পাণ্ডব মনে করস নাকি?
- খবরদার। আমার মায়ের নামে বাজে কথা কবা না কেউ
- আ-রে-রে। রাক্ষুসি সতিনের পোলা দেখি রাজপুত্রের মতো গরম দেখায়
- মুখ সামলাইয়া কথা কবা। আমার মায়ে তোগোর সতিন হয় নাই। তোরাই সতিন হইছস আমার মায়ের। তোরাই আমার বাপ-কাকা-জ্যাঠারে রাজা বাদশা দেইখা পেট লাগাইতে আসছস। আমার মায়ে যখন বাপেরে বিবাহ করে তখন ভালোবাইসাই রাস্তার এক ফকিররে বিবাহ করছিল...
- ফকিররে বিবাহ কইরা জন্ম দিছে তোর মতো ফকিন্নির পুত... তাতে হৈছে টা কী?
ঘটা খাড়াইয়া থাকে ভীমের মতো- তোরা হইলি পাণ্ডবো দাসিবান্দী। দাসিবান্দীগো কাছে নিজের পরিচয় নিয়া আলাপ করার দরকার মনে করি না আমি...
কুন্তী দৌড়াইয়া আইসা ঘটারে জড়াইয়া ধরে- দাদা ভাই থাম। তোরে আমি কিরা দেই ভাই পাগলামি করিস না। এরা সবাই তোর কাকী জ্যাঠি। তোর সম্মানের মানুষ...
ঘটা থামে। কিন্তু খুব ধীরে কুন্তীরে জানাইয়া দেয়- তুমারে একটা কথা কইয়া দেই দাদি। আমার মায়েরে কেউ অপমান করলে কে বাপের বৌ আর কে জ্যাঠার বৌ তা কিন্তু দেখব না। চুলের মুঠা ধইরা আছড়াইয়া কইলাম মাইরা ফালামু সব বান্দিগুলারে...
কুন্তী যখন ঘটারে থামানোয় ব্যস্ত তখন এক ভয়ংকর অভিশাপ নাইমা আসে দ্রৌপদীর মুখে- তোরে আমি কর্ণরে দিয়া খুন করামু কইলাম সতিনের পুত...
২০১২. ১১.১৯ সোমবার
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ২
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ১
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী
মন্তব্য
খুব ভালো লাগল। ভাগ্যিস কালিপ্রসন্নের পন্ডিতদের দলে ছিলেন না।
মাথা খারাপ। পণ্ডিত হতে পারলে কি আর এই বাঙাল স্টাইলে মহাভারত বয়ান?
০২
কালিপ্রসন্ন কিন্তু অনেক বেশি অথেনটিক। অন্যদেরগুলো অনুবাদের সাথে আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে রচনা
শুধু অথে্নটিকই নয়, গুরুভারও বটে! কয়েক হাত উপর থেকে ফেলে দিয়েই দূর্যোধনকে কূপোকাত করা যেত।
তবে আপনার মনের মাধুরী মেশানো এই ইন্টারপ্রিটেশন দারুন। প্রতিটা পর্বই দম ফাটানো হাসি এবং বোম ফাটানো "আরে তাইতো!!" এর সুষম মিশ্রণ।
চমৎকার লাগল মহাভারতের নারীকে কেন্দ্র ককরে রাজনৈতিক ক্ষিস্তিখেউর।
-অনিন্দ্য অনি
কী আর করা। পুরা মহাভারতখানই যে নারী আর রাজনীতি নিয়ে কায়কারবার...
হ। দেখি আবার হাজিরা নিয়মিত করতে পারি কি না
অনেক দিন পরে !
অপেক্ষায় ছিলাম আপনার এই লেখার।
ফাডাইয়ালসেন
কেডা? ভীম না ঘটা?
কিশোর বেলায় মাসুদ রানা প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘটোৎকচের নাম শুনে এবং তাকে হাস্যকর ভাবে হেনস্থা হতে দেখে খুব মজা পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে জেনেছি, মাতৃকূলে সে আমাদেরই সন্তান, হয়তো পিতৃকূলেও।
আব্দুল্লাহ এ.এম.
বোল্ড অক্ষরে লেখা প্রশ্নের উত্তর পরের পর্বে আসিতেছে...
এই সিরিজটার একটা ইংলিশ ভার্শন পিটার ব্রুক কে পড়ানো যেত!
চলুক উস্তাদ!
অনুবাদ করব কেডায়?
যাচ্ছেতাই!
হ
দারুন বস দারুন
ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন