এককালে বড়ো বেশি ভূতের বেগার দিয়েছি জ্ঞানী হবার জন্য। তবে বেগার খাটনিটা জ্ঞানী হবার জন্য ছিল নাকি নিজেরে জ্ঞানী প্রমাণ করার জন্য ছিল তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। কারণ একপিস জ্ঞান সংগ্রহের জন্য যতটা খাটনি দিতাম তার থেকে বেশি খাটনি দিতাম সেই একপিস জ্ঞানকে এক বালতি ঘোলা জলে মিশিয়ে পাব্লিকের মাথায় ঢেলে দেবার জন্য। সেই যুগে নিজেরে বিদ্বান প্রমাণ করার জন্য একবার পড়া শুরু করলাম জেমস জয়েস। আমি নিশ্চিত আমি তার কিছুই বুঝিনি। শুধু বুঝেছিলাম লোকটা সারা জীবন ডাবলিন ফিরে যাবার কথা বলতে চায় বলেই কোনোদিনও সে ডাবলিন ফিরতে চায় না। সে যেতে চায় এমন কোনো জায়গায় যেখানে কেউ তাকে ভালোবাসবে শুধুই তার দুর্বলতার জন্য...। লোকটা জানত ডাবলিন ফিরে গেলে বাস্তব ডাবলিন গুণে গুণে শুধুই তার সবলতাগুলো নেবে। আর দুর্বলতার জন্য দেবে ঘৃণা... তাই সে জীবনেও ডাবলিন যায় না আর...
’জয়েসের দুর্বলতার জন্য ভালোবাসা’ বহুদিন ভূতের মতো চেপেছিল আমার মগজে। কমপক্ষে শ’খানেক মানুষের ঘাড়ে সেই ভূত চাপানোরও চেষ্টা করেছি আমি বহুদিন ধরে। তারপর এক সময় ‘জ্ঞানী হওয়ার চেয়ে বুদ্ধিমান হওয়া ভালো’ এই মন্ত্র জপতে জপতে জ্ঞানী হবার চেষ্টা ছাড়ার সাথে সাথে জয়েসকেও সালাম দিয়েছি বহুদিন...
কবিতা সব সময়ই অজ্ঞানের বিষয়। জ্ঞানগুণ দরকার পড়ে না কবিতার জন্য। কিন্তু কবিতা লেখার জন্য অনিবার্যভাবে এদিক-সেদিক তাকাতে হয়। যেতে হয়। উল্টাপাল্টা কিছু করতে হয়। না হলে কবিতা আর দৈনিক পত্রিকার কলামের মধ্যে তেমন একটা ফারাক থাকে না। কিন্তু গত চার বছর ধরে বৌম্যাডাম আমার এদিক-সেদিক যাওয়া-আসা তাকানো সব আইন করে বন্ধ করে দিলেন। তার ভাষ্যমতে- বাপ-ভাই-পুত্রের এদিক-সেদিক কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য হলেও গৃহপালিত স্বামীর এদিক-সেদিক তাকানো কস্মিনকালেও গ্রহণযোগ্য নয়। তো আমার মা আছেন; দুইটা বোনও আছে। বহুবার বহু চেষ্টা করলাম মায়ের কাছ থেকে পুত্রকোটা আর দুইটা বোনের কাছ থেকে ভ্রাতাকোটা নিয়ে কবিতার জন্য এদিক-সেদিক হাঁটাচলার কোনো সুযোগ বের করা যায় কি না। কিন্তু তারা সকলে বাস্তব জগতের মানুষ। কবিতা থেকে সংসার তাদের কাছে উচ্চমূল্যের জিনিস। তাই কোটা থাকা সত্ত্বেও মা-বোনের কোটা আমার কপালে যেমন জোটে না তেমনি গত চার বছর ধরে কবিতাও বের হয় না এক লাইন...
শেষ ভরসা হিসাবে এখন তাকিয়ে আছি নিজের তিনমাস বয়েসি কন্যার পিতৃকোটার দিকে। যদি সে আমাকে তার বাপকোটার অধিকারে এদিক-সেদিক তাকানোর অধিকার দেয় তবে নিশ্চয়ই আমার লেখা একদিন আবারও পুতুপুতুময় হয়ে উঠবে কবিতায়....
কিন্তু ঝামেলা বাঁধিয়ে দিলো তাপস শর্মা। বহুদিন থেকে বেরহমভাবে আমার কবিতাই আমাকে পড়ানোর চেষ্টা করছে সে। যখন তাতে সুবিধা হলো না তখন শুরু করল আমার কবিতা আমাকেই পড়ে শোনানোর কাজ...
আত্মক্ষয়ী সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। মাঝে মাঝেই দাড়িগোঁফ ভিজিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেন- আমি আর কবিতা লিখতে পারি না এখন...
এক বইমেলায় তাকে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম তার নিজের কবিতা পড়ার জন্য। বলেছিলাম- একমাত্র আপনার কবিতাই হয়তো আপনাকে আবার কবিতায় ফিরিয়ে আনতে পারে...
গত দুইদিন ধরে তাপসের এই লেখাটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাড়া খেতে খেতে হঠাৎ মনে হলো- কিশওয়ারকে যা বলেছিলাম সেটাই হয়তো আমারও একমাত্র পথ। ...বহুদিন পর আর্কাইভে পড়ে থাকা নিজের অক্ষরগুলো খুলতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম জেমস জয়েসে। জয়েস আক্রান্ত যুগে জয়েসেরই একটা গল্পকে আমি সাজিয়েছিলাম নিজের কথায়..
প্রত্যাবর্তনগ্রামীণ নিয়মে ভালোবাসা পেলে
আমি ছেড়ে দেবো সব ভণ্ড বেসাত
ভোরে জেগে উঠে ফুলের বাগানে কাটাব সময় কৃষি চর্চায়
ছেঁড়া ঘুড়ি তালি মেরে সরল স্বপ্ন ওড়াব আকাশে ও মেঘে
দুর্বলতার জন্য কুড়াব øেহ ভুলের জন্য প্রেমগ্রামীণ নিয়মে ভালোবাসা পেলে
সহজ মানুষের মতো আমিও আবার গাইতে পারি আশাবাদী গান
[১৯৯৭.১১.২৫ মঙ্গলবার]
কবিতাটা আমার বাজারিবাটু বইয়ে আছে। মনে হলো আর কিছু পড়ার দরকার নেই। মনে হচ্ছে আমি মূলত আর কিছুই লিখিনি। শুধুই জয়েসকে আওড়েছি আমি বিভিন্নভাবে- দুর্বলতার জন্য ভালোবাসা; ভুলের জন্য প্রেম....
যখন তা ছিল তখন কবিতাও ছিল। কবিতা আবারও ফিরবে; যদি কোনোদিন আবারও কারো কাছে দুর্বলতার জন্য হয়ে উঠি অনন্য আর ভুলের জন্য আপন...
এই লেখাটা থাকল তাপসের পাগলামিকে নমস্কার কিংবা উপহাস করার জন্য...
২০১৩.১০.২৩ বুধবার
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হ। মাইনসের কান্দন দেইখা আপনে হাসেন
কিছু মনে করবে না, আপনার লেখার বিষয়ে কিছু বলছি না।
''জয়েসের দুর্বলতার জন্য ভালোবাসা''
ব্যাপারটা দারুন!!
ঠিক। দুর্বলতার জন্য ভালোবাসা। যেমন গোলাম আযমের বয়সের দুব্বলতাকে ভালোবেসে ফাঁসির বদলে হসপিটাল নিবাস
লেখা হয়েছে দুর্দান্ত।
আপনার মতোই নিজেকে জ্ঞানী করতে গিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম গ্রীক মিথোলজি। পড়লাম কিন্তু কিছুই বঝলাম না, আর ভালোও লাগেনি। হয়তো বুঝার মতো জ্ঞান এখনো হয়নি।
এই কারণে বোধহয় কবিদের সংসারী হতে নেই , যেমন হননি হেলাল হাফিজ ( উনি অবশ্য এমনিতে কবিতা অনেক কম লেখেন) । কবি থেকে কবিতা দূরে সরে যেতে থাকে, বাস্তবতা নামক দায়িত্বের বোঝা চাপতে হয় গাড়ে। দুর্ভাগ্য যেহেতু জড়িয়ে গেছেন সংসারের গোলক ধাঁধায় তাই এরি মাঝে কোটা কোটা দেখিয়ে কিছু কবিতা তো আসতে হবে আমাদের মতো বুভুক্ষ পাঠকদের জন্যে। কম লিখেন আপত্তি নেই, কম লেখে যদি উৎকৃষ্ট কবিতা পাই তাহলে আমাদের আপত্তি নেই কিন্তু কবিতাকে বিদায় বলবেন এটা মানা যাবে না। ভালু থাকুন কবি, ধন্যবাদ তাপস দা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গা খোঁচা টা দিয়েছেন বলে।
মাসুদ সজীব
গ্রিক আমারও খুব প্রিয়। তবে সব পুরাণেই ঘটনা এবং ঘটনা প্রক্রিয়ার এক ধরনের পুনরাবৃত্তি থাকে বলে এক সময় একঘেয়ে লাগে
০২
কবিতা ছাড়ল কেডায়?
কবিতাই তো বোধহয় ছেড়ে গেলো
০৩
খোঁচায় কবিতা বের হলে রাস্তায় যারা মানুষের কান পরিষ্কার করে পয়সা নেয় তারা খোঁচা দিয়ে কানের ময়লার বদলে কবিতাই বের করত
দেহের মৃত্যুর আগেতো কবিকে কবিতা ছেড়ে যায়না জানতাম।
কবিতায় ফিরে আসুক কবি মাহবুব লেলিন।
মাসুদ সজীব
ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ
যাক, আর কারো কথায় না হোক তাপসের কথায় যে কাজ হয়েছে এতেই আমরা পাঠক কূল খুশী দুর্বলতাই হোক বা ভুল প্রেমই হোক ফিরে আসাটাই বড় কথা । আবার আসুক কবিতা ।
ওয়েলকাম ব্যাক
সালাম স্যার
ফিরে আসা পাইলেন কই?
এইটা তো ফিরে আসার বিজ্ঞাপন
আপনি যে এতকাল পরে এলেন এজন্য ই তো বিজ্ঞাপন দিয়ে আসতে হবে স্যার। ঠিক আছে এবার পুরোপুরি ই ফিরেন
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
বেজার ক্যা?
মাহবুব লীলেন ভাই, আর কোন কৈফিয়ত না; দারুণ সব কবিতা চাই।
কবিরা কোন কৈফিয়ত দিতে পারবেন না, শুধুই কবিতা দেবেন।
আর, কৈফিয়ত যদি দিতেই হয়, সেটাও দিতে হবে কবিতার পংতিতে।
সেইটা কি এইরকম দিলে চলবে?
আমার চলবে
অত কবিতা দিয়ে কী হবে?
লীলেন ........ প্রায়-ফিরলেন!
তাপস ......... তুমি একটা বস!
হ
?
আমিও "এইদিক ঐদিক" তাকাইতে চাই।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বিজ্ঞানীরা এইদিক-ওইদিক তাকাইলে যে চিকিৎসা বিদ্যা থেকে জুকার নায়েক পয়দা হইব? আর পদার্থ বিদ্যা থিকা ধর্মবেত্তা?
কবিতা চাই! কবিতা চাই!! মাহবুব লীলেনের কবিতা চা্ই!!!! চাই-ই চাই।
____________________________
পার পিস কত দিবেন?
কবিতার কোয়ালিটির উপর নির্ভর করে একটা থেকে শুরু করে অজস্র শুভকামনা। চলবে?
____________________________
আমার কিছুই বলার নেই। আসলে কিছু বলার ছিলও না। কারণ কথাগুলি আমার ছিলই না কোনদিন। এগুলি সব আপনারই কথা, আমরা পাঠকরা শুধু অনুরণন করি
০২
কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারকে জানতে পারি প্রথম সেই 'ছায়ামুখ' গল্পের মধ্যে দিয়েই। তারপর সেই কবিতার মধ্যে দিয়ে। দেখেন তো কবিতাটা চেনেন কিনা? --
০৩
অ-ফেরা চাই এবং সুস্পষ্ট প্রত্যাবর্তনই চাই০৪
একটু ফিরে তাকান তো এই লাইনগুলির দিকে --
''নতজানু হও
নতজানু হও লীলেন শাশ্বত বিস্মৃতির কাছে
নতজানু হও নিজস্ব ভুল আর মানুষের চলে যাবার শিল্পিত কৌশলের কাছে
নতজানু হও জীবনে করে আসা স্বপ্নীল ভুলগুলো এই জীবনে আর করা যাবে না বলে"
--- 'ময়' কবিতায় নিজের সাথে নিজেই কথা বলেন নি আপনি? এই স্ববার্তা থেকে খুঁজে পাওয়া হোক একটা মূর্ত মুহূর্ত
০৫
ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। তাই নত হলাম ভাষার কাছে। এবং ''গ্রামীণ নিয়মে ভালোবাসা পেলে
সহজ মানুষের মতো আমিও আবার গাইতে পারি আশাবাদী গান''
ডাকঘর | ছবিঘর
হ
আমি কোন বিচারেই কবিতার পাঠক না। কবিতা পড়েছি শুধু রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ দাশের।মোটের উপর কবিতা তেমন বুঝি না। জেমস জয়েসে ৪-৫ টা গল্প পড়েছিলাম বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের এক বইতে।
তবু আপনার প্রত্যাবর্তন কবিতার ছত্রগুলো অনুভূতির ভেতর কিছু একটা নড়েচড়ে উঠলো।
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।
তার মানে তো আপনি একজন বিখ্যাত উত্তরাধুনিক কবি
বাহ বাহ, ব্রেশ বেশ !
ডাবলিন যাইতে চাইতাম শুধু বাসে ট্রামে ঘুরতে ঘুরতে জয়েস পড়ার জন্য
facebook
আর জয়েস পড়ে আমার মনে হয়েছে দুনিয়ার সব জায়গায় গেলেও ডাবলিন যেতে নাই
ফেরা হোক!
ফেরাটাই একান্ত কাম্য, অফেরা মোটেই নয়।
কবিতা না হোক, গল্প অন্তত দেন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনার লেখা ভাল লাগে। কবিতাই হতে হবে এমন দাবী আমার নেই। কবিতা পেলে ভাল। না পেলে অন্য কোন লেখা পাব, তা'ও ভাল। আপনার লেখার প্রতীক্ষায় থাকি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন