- বাবা সিটটা ইট্টু খুইজে দেও দিনি। চওয়াশমা আনি নাই; কিছু পড়তে পারি না...
খুলনা থেকে যশোর যাবার জন্য দুপুরে সাগরদাড়ি ট্রেনে উঠে বসতেই পাশে দাঁড়িয়ে টিকিট বাড়িয়ে দাঁড়ালেন বয়স্ক ভদ্রলোক। তার সিট আমার মুখোমুখি জানালায়। ছোট ব্যাগটা কোলে নিয়ে সিটে পা তুলে গুটিসুটি হয়ে বসলেন ভদ্রলোক- তোমাক দেখে পরিচিত মনে হতিছে তাই তুমি করে কলাম। তুমি কি আমার ছাত্র ছেলা?
আমি তার ছাত্র ছিলাম না জেনে তিনি কিছুটা বিব্রত হলেন- তালি তো তোমারে তুমি কওয়া উচিত হয় নাই; আপনে কলি মানাতো...
জানালায় ডান হাত রেখে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ বাইরে তাকান আবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাম হাতের ঘড়ি দেখেন- এরা মাঝে মাঝেই ট্রেন ছাড়তি দেরি করে
- এখনো বিশ মিনিট বাকি স্যার...
- হয়। তাড়া আমার থাকলিও সওকলের কি আছে?
শিক্ষকের পাশে এসে বসেন আউলাঝাউলা মধ্যবয়স্ক একজন; সাথে ঘোমটা দেয়া বিশ একুশের এক তরুণী। বাবা আর মেয়ে তারা...
ট্রেন সময়ের দুমিনিট আগেই ছেড়ে দেয়। শিক্ষক ঘড়ি দেখেন- টাইমের আগে ছাড়লিও মাঝে মাঝে এরা রাস্তায় লেট করে...
- আর তাড়াতাড়ি যায়ে কী হবি? কেউ তো আর বরণ করার জন্যি বইসে নাই....
আমার পাশের দুটো সিটে আর কোনো প্যাসেঞ্জার নেই। মেয়েটার নাম মণি। মণি কী যেন কেন একবার ফিক করে হেসে উঠে। বাবা একটা গুমট ধমক দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শিক্ষক বারবার ঘড়ি দেখেন- টাইমেই যাচ্ছে...
- না গেলেই বা কী?
দুজনই যশোর যাবেন। তাড়াতাড়ি গেলে একজনের সুবিধা। দেরি হলে হয়তো সুবিধা অন্যজনের। ধীরে ধীরে ট্রেনের টাইম কিংবা লেট করা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তারা গল্প শুরু করেন। শিক্ষক গল্প করতে করতে ব্যাগ থেকে একটা বনরুটি বের করে চাবাতে থাকেন। চানাচুরওয়ালা দেখে মণি ডাক দেয়- পাঁচ টেকার দেও... বাবা নিঃশব্দে চানাচুরওয়ালাকে টাকা দিয়ে পোঁটলা খুলে নিজে পান মুখে দেন। মাঝে মাঝে ট্রেন দাঁড়ায়। বাবা নির্বিকার; শিক্ষক অস্থির হয়ে ওঠেন। ট্রেন আবার ছুটতে শুরু করলে শিক্ষক খুশি হন আর বাবার বিমর্ষতা বাড়ে... ধীরে ধীরে থেমে থেমে গল্প করেন তারা। দুজনেই দুজনের গ্রাম চেনেন। দুজনের গ্রামেই দুজনের আত্মীয়-স্বজন আছে; গেছেনও দুয়েকবার...
যশোর স্টেশনে ট্রেন থামলে হুড়মুড় করে শিক্ষক উঠে দাঁড়ান। বাবা নির্লিপ্তভাবে সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকেন। মণি তাড়া দেয়- বাবা আইসে পড়ছি...
- তা তো দেখতেই পাচ্ছি
নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে বের হয়ে যান শিক্ষক। অ্যাকসিডেন্ট করে খুলনার হাসপাতালে পড়ে থাকা ছেলের জন্য বাড়ি বিক্রির টাকা নিয়ে আজই আবার খুলনা ফিরবেন তিনি। আর মণির পেছনে খুব ধীরে ধীরে নামেন বাবা। স্বামী তাড়িয়ে দেয়া মণিকে নিয়ে তিনি এখন বাড়ি ফিরে যাবেন....
আমি গিয়ে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াই- দুধ চিনি কম; লিকার কড়া এক কাপ চা...
২০১৩.১০.২৯ মঙ্গলবার
মন্তব্য
সুমনের গানের একটা লাইন মনে এলো, ''চেনা দুঃখ চেনা সুখ, চেনা চেনা হাসি মুখ, চেনা আলো চেনা অন্ধকার''
০২
গল্প এসেছে দেখে ভাল্লাগছে। গল্প হোক। 'নিম নাখারা' কিংবা 'সাকিন সুন্দরবন'-এর স্তুরের গল্পে ফেরা হোক, ঐ জঁনরায় আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে পদচারণা করেন বলেই আমার মনে হয়েছে। জীবনের চেনা ছন্দগুলিকে একত্রিত করা গল্পই ব্যাক্তিগতভাবে আমাকে বেশী টানে। এই গল্পেও সেই টিউন আছে। গল্পটা পরিচিত, আকারে ছোট, সম্ভাব্য পরিণতিও হয়তো খানিকটা অনুমান করাটা দুরহ নয়, তবুও একটা আকর্ষণ আছে। গল্পটা ধীর, যেন তাড়া খেয়েও দৌড়ানোর কোন তাড়া নেই। চেনা আপোষ, লজ্জা, ঘৃণা কিংবা পরিণতি কখনো অপরিণত হয়না কেন যেন। ঠিক 'প্রশ্নগুলি সহজ আর উত্তরও তো জানা'র মতো
ডাকঘর | ছবিঘর
টেরাই দিচ্ছি
খালি টাইম না। আমারে বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে মহাভারত
ওইটা শেষ না করে অন্যদেকি মনোযোগ দিতে চাচ্ছি না পারছিও না
আবার মহাভারতও সামলাতে পারছি না ঠিকমতো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কলা দেখান ক্যা?
আঙুল কেমনে দেখায়?
মাসুদ সজীব
আবারো কলা-আঙুল। মানুষের হাতে কি আর কোনো আঙুল নাই
৫ই ফ্রেবুয়ারি কাদের মোল্লার সেই বিখ্যাত দুই আঙুলের বিজয় চিন্থ দেখার পর সেই দুই আঙুলের চিন্থ আমার দেখাতে ইচ্ছে করে না । আঙুল দুটো একসাথে উচিয়ে ধরলেই সেই বিভৎস ছবিটি চোখে ভেসে উঠে তাই এই কলা আঙ্গুলকেই অনেক বেশি পবিত্র লাগে।
মাসুদ সজীব
আমরা দেখে যাই, দর্শকের মত।
আর কী করা
এই ভদ্রলোক এমন সহজ শব্দে, আটপৌরে ভাষায় লেখেন, আমি মাঝে মাঝে হতবাক হয়ে যাই, "এও কি সম্ভব!"
লিলেনদা, স্যালুট।
শব্দ বাক্য কঠিন করার বিদ্যা কই?
আশেপাশে তাকালেই এরকম অনেক ঘটনা চোখে পড়ে, কিন্তু এভাবে উপস্থাপন করে কে? চলতি পথের ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে জীবনের সমান গভীরতা নিয়ে লেখা গল্পটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
____________________________
যা কিছুই লিখি বা পড়ি; তার সবই তো কোনো না কোনো জীবন থেকে কুড়ানো
গল্প চলুক লীলেন দা।
চইলবে
পাঠক হিসেবে আমি আপনার দুই প্রকার গল্পের ভক্ত। এক, 'নিম নাখারা'র গল্পগুলোর মতো গল্প। কারণ, সেখানে আপনি অঙ্গ-তন্ত্র-যন্ত্র-কলা-কোষ সব ফালাফালা করে দেখান। পাঠকের কাছে আর কিছু অস্পষ্টতা থাকে না। পাঠক গল্পকারের নির্দেশিত পথে ভাবতে থাকে। দুই, সুমন-সুমনা'র বা লোপা নার্গিসের গল্পগুলোর মতো গল্প। কারণ, সেখানে আপনি মাঠটা পাঠকের হাতে ছেড়ে দিয়ে বলেন, "যা চইড়া খা"! এর মাঝামাঝি হলে (যেমন, এই গল্পটা) সেটাতে মাহ্বুব লীলেনকে চেনা কঠিন হয়ে পড়ে।
আপনি আমার সাথে একমত বা দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। তাতে কোন অসুবিধা নেই। তবে আমার বক্তব্যকে আপনার একজন পাঠক আপনার লেখাকে কীভাবে দেখে সেভাবে বিবেচনা করুন। তাতে আখেরে আমার লাভ হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমি একমত স্যার
এক্কেবারে তাব্দা খেয়ে বসে আছি বহুদিন
শুরু করার চেষ্টা করছি আবার
ভালো লেখা।
দীর্ঘশ্বাস জমা হয় বুকে।
মাহবুব ভাই, ভাল থাকবেন।
-----------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ধন্যবাদ
এক যাত্রায় দুই ফলের কথা অনেক সময় শোনা যায়, এক অযাত্রার ক্ষেত্রেও যে সেরকমটা হতে পারে, তা দেখলাম। মণির জন্য জন্য কোন করুনা হচ্ছে না, বরং ভালই লাগছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, তাকে তাড়িয়ে দেয়া স্বামীর বিষয়ে তার কোন পিছুটান নেই, বরং তার অতি চেনা পরম নির্ভরতার স্থানে আবার ফিরে আসতে পেরে সে চাপা আনন্দে উদ্বেলিত। সেই আনন্দটাই ছড়িয়ে গেল আমারও মনে।
এক দৃষ্টিতে দেখলে কোনো কিছুই করুণার নয়। সব কিছুই চলে তার মতো করে
লীলেন ভাই,মহাভারত আবার পড়ছেন যখন- মহাভারতনির্ভর আরেকটা সিরিজ করুন,আমাদের জন্য।
এই গল্পটা ভালো লেগেছে।
আমি গিয়ে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াই- দুধ চিনি কম; লিকার কড়া এক কাপ চা..
এই আমি টা শুধু দেখেই যায়, অদ্ভুত রকমের নির্লিপ্ত .... এটা না হলে হয়ত লেখক হওয়া যায় না।
আপনার আগের লেখার ফরম কি চেঞ্জ করছেন ? অনেকটাই আলাদা
লিপ্ত হইলে তামিল সিনেমার নায়কদের মতো ঘটনার সাথে কুস্তি ধরে কাদায় গড়াগড়ি যেতে হবে তাই নির্লিপ্ত থেকে বোম্বে সিনেমার নায়িকাদের মতো দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখে নিজের মতো নাচানাচি করি....
০২
আপনার ভয়ে বাঙাল বুলি বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা চর্চার চেষ্টা করেছি
আপনার লেখা এই প্রথম পড়লাম। আরো আগেই পড়া উচিৎ ছিল মনে হচ্ছে। বেশ ঝরঝরে লেখা, বিরক্ত লাগে না একদম। মনে হচ্ছিল চোখের সামনেই সব দেখছিলাম। ট্রেন, চানাচুরওয়ালা, টি-স্টল, মধ্যবয়স্ক বাবা, বৃদ্ধ শিক্ষক আর সদ্য বিতাড়িত তরুনী গৃহবধু!
কিন্তু একটা ব্যাপার। যখনি সবকিছু দেখা শুরু করলাম, একটু নড়েচড়ে বসলাম, গল্পটা তখনি শেষ হয়ে গেছে! অনেক ভালো থাকবেন।
একজন নতুন পাঠক পাওয়া নিঃসন্দেহে খুশির বিষয়
০২
গল্পটার তখইন শেষ হয়ে যাবার যে প্রয়োজন ছিল; আর আগালে তা নিউজ হয়ে যেত
অনবদ্য, লেখালিখি চলুক......
-আরাফ করিম
ধন্যবাদ
আপনার নানা পুরনো লেখায় এখন মজে রয়েছি। তাই, পান্ডব ভাইয়ের অনুভবের সাথে একান্তই একমত, যত ভালই হয়ে থাকুক, এ গল্প মাহবুব লীনেন-এর মনে রাখার মত লেখার মধ্যে রাখা মুস্কিল। তবে ভাল লাগছে ভেবে যে আপনার এই তাব্দা-খাওয়া দিনগুলোর শেষে মহাভারত নিয়ে লেখা ফিরে আসছে। কি আগ্রহ নিয়ে যে বসে আছি!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মনে রাখার মতো লেখা সারাজীবনে আর কয়টা লেখা যায়?
০২
মহাভারতে আবার কাজ শুরু করেছি
জানা যায়, সেই ক্ষণিকের আলাপেই সেই আউলাঝাউলা মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটির সাথে বৃদ্ধ শিক্ষকের দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। একসময় শিক্ষকের ছেলেটা সুস্থ হয়ে ওঠে। আর বাবার পরিচয় সূত্রে বিয়ে করে মণিকে।
মণিদের বাড়ি থেকে দুধ বেশি এবং লিকার কড়া এক কাপ চা খেয়ে এসে এই মন্তব্যটা করলাম।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
গল্পটা এমন ভাবে শেষ হলে ভালই হতো তানভীর ভাইয়া।
অন্যকোনোভাবে গল্পটা শেষ করা গেলে নিশ্চিন্তে করে ফেলেন
আহা জীবনটা যদি এইরকম হতো...
লীলেনিয় স্কেলে এই গল্পটার মাপ অনুগল্প হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে এরকম সাদামাটা গল্পও অসাধারণ লীলেনের হাতে ভালোই লাগে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
কি বলিচ যাদু!
- মহান বাবা ইউক্লিড
অনুগল্পের মাঝে অনেক কিছু। পাঠক কে ভাববার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে ।
Tselim_Rezaa
দৃশ্যপটটি সাধারণ, কিন্তু লেখকের চোখ দিয়ে দেখতে গিয়ে দুটো পরিস্থিতি দেখতে পেলাম। লেখনীতে স্বকীয়তা আছে। আপনার আরো লেখা পড়ার আশা ব্যক্ত করছি। রনীল জহির
নতুন মন্তব্য করুন