মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৪

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/১২/২০১৩ - ৯:১৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তেরোটা বচ্ছর পর ভাতিজার কাছে ভাইঙা পড়ে কুন্তী- কৃষ্ণরে; পুতুল খেলার বয়সে নিজের বাপ মোরে দান কইরা দিছিল ভিনগ্রামে। বড়ো হইয়া বিবাহ করলাম এক সম্রাটরে কিন্তু রাজনীতির খপ্পরে পইড়া জঙ্গলে সংসার করলাম ষোলোটা বছর। বিধবা হইবার পর ভাসুরের চক্রান্তে আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুইরা নাবালক পাঁচটা পোলারে বড়ো কইরা বানাইলাম রাজা। তারপর নাতি নাতনি লইয়া খেলার বয়সে পোলাদের অপকর্মে আরো তেরোটা বচ্ছর আমার বাচতে হইল দেবরের ভাতে...। কৃষ্ণরে পিতা-স্বামী-ভাসুর-পুত্র; এমন কেউ নাই যে আমার লগে অবিচার করে নাই। এইবার ক দেখি বাপ; যে কারণে ক্ষত্রিয় নারী পুত্র জন্ম দেয়; সেইকাল কি উপস্থিত হইছে আমার?... কেমন আছে হতভাগি দ্রৌপদী? কেমন আছে পোলারা সবাই?

কৃষ্ণ কুন্তীর কাছে সকলের কুশল সংবাদ দিয়া তারে সান্ত্বনা দেয়- দুঃখ কইরা না পিসি। ক্ষত্রিয় যাদব বংশের মাইয়া তুমি; কুন্তীভোজের বংশে গিয়া রাজকন্যা হইছিলা তুমি। তারপর সম্রাটরে বিবাহ কইরা তুমি যেমন সম্রাজ্ঞী হইছিলা তেমনি বীরপুত্র জন্ম দিয়া পাইছিলা রাজমাতার সম্মান। দুঃখ কষ্ট ক্ষত্রিয় জীবনে থাকেই পিসি; কিন্তু আবার সেই সময় উপস্থিত তোমার। শিগগিরই তোমার পোলাগোরে আবার দেখতে পাইবা পৃথিবীর অধিপতিরূপে। সেই নিমিত্তেই আমার হস্তিনাপুর আসা; কাইল সকালে প্রস্তাব নিয়া যাব ধৃতরাষ্ট্রের কাছে...

পাঁচ ভাইয়ের লাইগা যুধিষ্ঠিরের পাঁচটা গ্রামের অনুরোধও প্রত্যাখ্যাত হইলে কার্তিক মাসের এক সকালে দূতিয়ালির উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ রওয়ানা দেয় হস্তিনাপুর। যুধিষ্ঠির চায় নাই কৃষ্ণ হস্তিনাপুর আসুক; কিন্তু এটাও সে জানায়ে দেয়- কৃষ্ণ তুমি ভিন্ন এখন আমাদের উদ্ধারের আর কেউ নাই। তবে তোমারে অনুরোধ করি; শান্তির চেষ্টাই বেশি কইরো তুমি...

ভোরবেলা উপপ্লব্য নগর থাইকা রওয়ানা দিয়া একরাত্রি বুকস্থল গ্রামে কাটাইয়া পরের দিন সন্ধ্যায় কৃষ্ণ আইসা হাজির হয় হস্তিনাপুর। আসার আগে যুধিষ্ঠিররে পরিষ্কার জানায়ে আসে- শান্তিপূর্ণ সমাধানের বেশি আশা না কইরা যুদ্ধের লাইগা তৈয়ারি থাকেন...

কৃষ্ণ আসার সংবাদে এক বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করেন ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধন। বেশুমার খানাখাদ্যের লগে কৃষ্ণরে উপহার দিবার লাইগা রেডি রাখা হয় অঢেল স্বর্ণ-মণিমুক্তা-হাতিঘোড়া আর হাজারে হাজার দাসদাসী। এইসব দেইখা বিদুর ধৃতরাষ্ট্ররে কয়- আপনের মতিগতি বোঝা মুশকিল মহারাজ। পাণ্ডবগো আপনে পাঁচটা মাত্র গ্রাম দিতে নারাজ অথচ অঢেল ঘুস দিয়া কৃষ্ণরে কিনতে চান...

ভীষ্ম সবাইরে সতর্ক কইরা দেন- সংবর্ধনা দেও আর নাই দেও; কৃষ্ণের লগে যেন খারাপ ব্যবহার করে না কেউ খবরদার...

দুর্যোধন কয়- খারাপ ব্যবহার করব না তার সাথে। তয় আসলে তারে আমি বাইন্ধা থুমু কইলাম। তাইলেই আর পাণ্ডবরা লোম নাড়াইতে সাহস করব না...

ধৃতরাষ্ট্র পোলারে ধাতানি দেন- বেকুবি কইরো না দুর্যোধন। কৃষ্ণ দূত আর তোমার বেয়াই

ভীষ্ম কন- ধৃতরাষ্ট্র তোমার পোলারে সামলাও। কৃষ্ণরে খালি সে বেয়াই হিসাবেই দেখছে; জীবনেও প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখে নাই... কোনো বেয়াদবি যেন না হয় তার লগে...

নগর দুয়ার থিকা কৃষ্ণরে আউগাইয়া আনতে শত শত লোকের সাথে স্বয়ং উপস্থিত হন ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপের মতো মানুষ। দূতিয়ালির লাইগা আসছেন কৃষ্ণ; কিন্তু সে সম্পূর্ণ সশস্ত্র আর বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়া তার লগে আছে তার ডাইন হাত দুর্ধর্ষ বৃষ্ণিবংশীয় সেনাপতি সাত্যকি। ভীষ্ম মনে মনে হাসেন। দূতিয়ালি করতে সঙ্গে সেনাবাহিনী নিয়া আসার মানে তিনি বোঝেন। রাজা সুবলের কাছে আন্ধা ভাতিজা ধৃতরাষ্ট্রের লাইগা তার মেয়ে গান্ধারীর বিবাহ প্রস্তাব নিয়া যাওয়ার সময়ে তিনি নিজেও সাথে নিয়া গেছিলেন বিশাল এক সেনাবাহিনী। সুবল সেনাবাহিনীর দিকে তাকাইয়া তার আন্ধা ভাতিজার লগে নিজের মাইয়ার বিবাহে এক বাক্যে রাজি হইছিলেন সেদিন...

কৃষ্ণ কিছুই নিলো না হাতে। না উপহার না খাবার। খালি পা ধোয়ার পানি নিয়া আর সকলের লগে সালামালকি বিনিময় কইরা গিয়া হাজির হইল রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সামনে। ধৃতরাষ্ট্র চেয়ার ছাইড়া উইঠা অভিবাদন জানাইলেন কৃষ্ণরে। কৃষ্ণ তার লগে শুভেচ্ছা বিনিময় কইরা সোজা গিয়া হাজির হইল বিদুরের ঘরে পিসি কুন্তীর লগে দেখা করতে...

কুন্তীরে দেইখা কৃষ্ণ যায় বেয়াই দুর্যোধনের ঘরে। সেইখানে দুঃশাসন কর্ণের লগে আরো বহুদেশের রাজারা উপস্থিত। দুর্যোধন তারে আপ্যায়ন করে- বেয়াই খাও...

কৃষ্ণ খায় না। কয়- বেয়াই আমি এখন তোমার প্রতিপক্ষের দূত। দূতিয়ালি সফল না হইলে যেমন দূতের পক্ষে খানাপিনা গ্রহণ করা সম্ভব না তেমনি সম্পর্ক ভালো থাকলে কিংবা বিপদে পড়লেই শুধু অন্যের খাদ্য গ্রহণ করা যায়। তুমি আত্মীয় হইলেও যেহেতু পাণ্ডবদের শত্রুপক্ষ তাই তুমি এখন আমারো শত্রুপক্ষে আছে। তাই আমি সম্পর্কের খাতিরে যেমন তোমার খাবার খাইতে পারি না; তেমনি আমি এইখানে আইসা বিপদে পড়ছি সেইটাও মনে করি না। আপাতত মাফ করো আমারে। আমি হস্তিনাপুরে খালি বিদুরের দেওয়া খাবারই খামু; কারণ আমার পিসি আছেন তার ঘরে আর মানুষটাও নিরেট আর নিরপেক্ষ...

কৃষ্ণ বিদুরের ঘরে গেলে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আইসা কন- তোমার থাকা খাওয়ার লাইগা আমরা বহুত আয়োজন করছি কৃষ্ণ আইসো আমাগো লগে। কৃষ্ণ কয়- আপনারা আমারে দেখতে আসছেন তাতেই সম্মানিত হইছি আমি। বিদুরের ঘর ছাড়া আর কোথাও খাবার নিতে অনুরোধ কইরেন না আমারে...

খাইতে বইসা বিদুর কন- তোমার এইখানে আসা বোধহয় ঠিক হয় নাই কৃষ্ণ। যত যাই হোক; ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ সকলেই কিন্তু যুদ্ধ করব দুর্যোধনের পক্ষে। সে কারণে তোমার কোনো প্রস্তাবই মানব না দুর্যোধন। তাছাড়া যাদের যাদের লগে তোমার শত্র“তা আছে তারা সবাই আইসা হাজির হইছে হস্তিনাপুর আর কালকের সভাতেও তারা থাকব। আমি দুশ্চিন্তায় আছি কাইল এইসব শত্রুদের মাঝে তোমার যাওয়া ঠিক হবে কি না...

কৃষ্ণ কয়- আপনের কথা ঠিক আছে। কিন্তু বিপদের আশঙ্কা যতই হোক; আমি না গেলে পরে কথা উঠবে যে কৃষ্ণ পারলেও পারত কিন্তু তারপরেও কুরু পাণ্ডবের যুদ্ধ থামাইতে সে চেষ্টা করে নাই। ...আর বিপদ নিয়া চিন্তা কইরেন না; সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়াই আসছি আমি...

পরদিন সকালে বিদুরের বাড়ি থিকা কৃষ্ণরে সভায় আউগাইয়া নিতে আসে শকুনি আর দুর্যোধন। কৃষ্ণ রওয়ানা দেন বিদুর আর সাত্যাকির লগে আর তার পিছে পিছে যায় তার সেনাদল। সভায় প্রবেশ করলে রাজা ধৃতরাষ্ট্রসহ ভীষ্ম দ্রোণ আর যারা যারা ছিল তারা সকলেই খাড়াইয়া কৃষ্ণরে সম্মান জানাইয়া বসতে অনুরোধ করলে কৃষ্ণ কয়- আমার লগে দ্বৈপায়ন-পরশুরাম-নারদসহ বেশ কিছু মুরব্বি আসছেন যারা আজকের সভায় থাকতে চান। তারা বাইরে খাড়াইয়া আছেন। তাদেরকে আমন্ত্রণ দিয়া বসার আসন না দিলে তো আমার পক্ষে এই সভায় আসন গ্রহণ করা কঠিন....

ধৃতরাষ্ট্র বড়োই টাসকি খান এই কথা শুনে। গতকাল তিনি শুনছিলেন কৃষ্ণ বিশাল একটা সেনাবাহিনী নিয়া আসছে সাথে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন নাই যে সালিশদার হিসাবে এতগুলান মুনিঋষিও সাথে নিয়া আসছে সে। মনে মনে কৃষ্ণের বুদ্ধির তারিফ করেন ধৃতরাষ্ট্র। এমন লোকদের সাথে নিয়া আসছে কৃষ্ণ যাদের সামনে কোনো উল্টাপাল্টা করা সম্ভব না। বিশেষ করে সর্বজনশ্রদ্ধেয় তার নিজের ঔরসদাতা পিতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। দুর্যোধনরা যেমন তার পোলার ঘরের নাতি তেমনি পাণ্ডবরাও তার নাতি। ...কৃষ্ণ তারে সভা শুরুর আগেই বেশ চিপায় ফালাইয়া দিছে তিনি বুঝতে পারেন। বিষয়টা নিয়া পোলার লগে আগে কিছু আলোচনা কইরা নিলে সুবিধা হইত। কিন্তু এখন আর করার কিছু নাই। এখন চুপচাপ খালি শুইনা যাইতে হইব; দরকার পড়লে দুর্যোধনের বিপক্ষেও কইতে হইব। যা করার পরে করা ছাড়া আপাতত কোনো উপায় নাই....

দ্বৈপায়নের লগে অন্য ঋষিদের কথা না হয় বোঝা গেলো; তারা নিরপেক্ষ মুনি ঋষি মুরব্বি মানুষ; সভাসমাবেশে গিয়া বসতে খাইতে বলতে কিংবা দান-প্রণাম নিতে পছন্দ করেন। কিন্তু পরশুরামরে কেন নিয়া আসছে কৃষ্ণ? তিনি তো সভা এইসব সভা-সমাবেশ যান না। ...ভাবতে ভাবতে কৃষ্ণের বুদ্ধিতে আরেকবার মুগ্ধ হন রাজা ধৃতরাষ্ট্র- কর্ণ...। কর্ণরে দমাইয়া রাখতেই পরশুরামরে ধইরা নিয়া আনছে কৃষ্ণ। পরশুরাম সব সময়ই শিষ্য কর্ণরে পাতলা পোলা বইলা বকাঝকা করতেন। আইজ অতবছর পরে নিশ্চয়ই কর্ণ গুরুর কাছে নিজেরে আর মাথাগরম পাতলা-পোলা হিসাবে প্রমাণ করতে চাইব না। ....পরশুরাম জ্যাঠা ভীষ্মেরও গুরু। জ্যাঠা ফাঁক পাইলেই নাতির বয়েসি কর্ণের লগে খামাখা ঠোকাঠুকি করেন; জিনিসটা পছন্দ না হইলেও ধৃতরাষ্ট্র কিছু কইতে পারেন না। আইজ গুরুর সামনে ওমন কিছু কইরা নিশ্চয়ই ধাতানি খাইতে চাইবেন না ভীষ্ম। ...দ্রোণেরও গুরু পরশুরাম। তিনিও নিশ্চয়ই আইজ অর্জুনের প্রশংসা করতে গিয়া কর্ণরে গালাগাল করবেন না ভুলেও...। ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে হাসেন- পরশুরামের তিন জাতের তিন শিষ্য আছেন ধৃতরাষ্ট্রের সভায়; ব্রাহ্মণ দ্রোণ; ক্ষত্রিয় ভীষ্ম আর শূদ্র কর্ণ... তিনজনরেই আইজ এক লাইনে নিয়া আসছে কৃষ্ণ পরশুরামরে সভায় হাজির কইরা... আর একইসাথে এই সভায় দুর্যোধনরে বড়ো একলাও কইরা ফালাইছে এই যাদব কূটনীতিবিদ....

ভীষ্ম আর বিদুর গিয়া মুরুব্বিদের আমন্ত্রণ কইরা সভায় নিয়া আসলে সকলে খাড়াইয়া সালামালকি দিয়া তাগোর বসার ব্যবস্থা করেন। তারপর রাজা ধৃতরাষ্ট্ররে সম্বোধন কইরা কৃষ্ণ শুরু করে ধর্ম আর অধর্ম নিয়া শাস্ত্রসম্মত বয়ান। ধৃতরাষ্ট্র অধৈর্য হইলেও চাইপা যান; বহুত চালাক এই কৃষ্ণ। পয়লাই ধর্ম-অধর্ম নিয়া কথা কইয়া মুরুব্বিগো পটাইতাছে হালায়... বেটা আসল কথা ক কী কইবার চাস?

ধর্ম অধর্ম বয়ান শেষে কৃষ্ণ শুরু করে স্বয়ং রাজা ধৃতরাষ্ট্ররে তেলানি- মহারাজ চিন্তা কইরা দেখেন তো কুরুগো লগে আছেন ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ কৃপ আর পাণ্ডবগো লগে আছে সাত্যকি আর পাঞ্চাল। কুরুরা আপনার পোলা আর পাণ্ডবরা আপনার ছোটো ভাইয়ের পোলা; পিতার অবর্তমানে আপনি নিজেই যাগো পিতা। একটু ভাবনা কইরা দেখেন তো মহারাজ এই কুরুপাণ্ডব যদি তাগোর মিত্রদের নিয়া একসাথে আইসা আপনার ছাতার নীচে খাড়ায় তবে জগতে আপনার থাইকা শক্তিশালী রাজা আর থাকব কি না কেউ? আমার হিসাবে কারোপক্ষে আপনার থিকা বড়ো রাজা হওয়া সম্ভব না তখন। ...আমার এই হিসাবে যদি কোনো ভুল থাকে তো এইখানে উপস্থিত মুরব্বিয়ানরা আমারে সংশোধন করবেন...

মুরুব্বিরা সকলে কৃষ্ণের কথায় সমর্থন জানাইলে কৃষ্ণ পরের প্রসঙ্গে যায়- আমার আগমনের মূল উদ্দেশ্য মহারাজ; একটু চেষ্টা কইরা দেখা যাতে আপনার নেতৃত্বে থাকা মহান ভারতবংশটা যেন ধ্বংস না হয়। ...যার সারকথা হইল শান্তি...

মুরুব্বিরা এইবার সশব্দে কৃষ্ণরে সমর্থন করেন। ধৃতরাষ্ট্র কোনো কথা কন না। শুরুতেই তারে কৃষ্ণ প্যাঁচ মাইরা ধরছে। এখন সভার সকলের সমর্থন আদায় কইরা অজগরের লাহান আস্তে আস্তে সেই প্যাঁচ টাইট দিতাছে জাউরা যাদব... কিন্তু এখন কিছু কওয়া যাইব না। কান খাড়া কইরা ধৃতরাষ্ট্র খালি রেডি থাকেন কৃষ্ণের পরের কথা শোনার ...

কৃষ্ণ এইবার সকলের দিকে তাকায়- এইখানে যারা আছেন। ময়মুরুব্বি-মুনিঋষি-অস্ত্রগুরু-যোদ্ধা আর রাজনীতিবিদগণ। তারা কেউই অশান্তির পক্ষে না। একলা সমস্ত দুনিয়া ধ্বংস কইরা দিবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পরশুরাম যেমন শান্তি চান তেমনি পাণ্ডব-পাঞ্চাল-যাদবদের ধ্বংস করার ক্ষমতা থাকার পরেও গঙ্গানন্দন ভীষ্মও চান শান্তি... আর আপনার ভাতিজা পাণ্ডবেরা যে শান্তিকামী তাতো আপনিও স্বীকার করবেন মহারাজ। কারণ আপনার আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানাইয়াই তারা তেরো বচ্ছর বনে জঙ্গলে কষ্ট করছে কিন্তু আপনার আদেশের লঙ্ঘন করে নাই। অথচ চাইলে তো তারা আরো আগেই আইসা হাঙ্গামা বাধাইতে পারত। ...তো এখন মহারাজ আপনার পিতৃহীন ভাতিজারা আপনের কাছেই প্রার্থনা করতাছে শান্তির বিধান। তাগো পিতার বড়ো ভাই হিসাবে আপনারে অভিভাবক মাইনাই তারা আপনার কাছে প্রার্থনা করতাছে তাগো ন্যায্য পাওনা আদায়ের বিচার... কারণ তারা মনে করে একমাত্র আপনেই পারেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাগো ন্যায্য পাওনা দিতে। অন্য কারো কাছ থিকা সেই পাওনা আদায় করতে গেলে যে ক্ষয় হইব তা মূলত আপনারই বংশের ক্ষয়। কারণ সকলে শান্তির পক্ষে থাকলেও আপনি জানেন যে আপনার পোলা দুর্যোধন সেই পক্ষে নাই। এখন আপনার পোলাদের সাথে যদি সম্পত্তি নিয়া আপনার ভাতিজাদের খুনাখুনি হয় তবে কি তাতে আপনের শান্তি হইব মহারাজ?

নিজেরে বড়োই কোণঠাসা অবস্থায় আবিষ্কার করেন ধৃতরাষ্ট্র। সকলের কাছ থিকা সমর্থন আদায় কইরা এইবার তার কাছ থিকাও সমর্থন আদায়ের জাল ফালাইছে কৃষ্ণ। সভার একটা মানুষও কোনো কথা কইতাছে না। কৃষ্ণ সরাসরি এইবার দুর্যোধনের নাম ধইরা অভিযোগ করল কিন্তু তারপরেও কর্ণ চুপ। অন্য সময় হইলে অতক্ষণে কর্ণ লাফ দিয়া ধইরা ফালাইত কৃষ্ণের কথা। কিন্তু পরশুরামরে হাজির কইরা সেই কর্ণরেও এক্কেবারে নিঃশব্দ কইরা ফালাইছে কৃষ্ণ। ...কৃষ্ণ পোলাটা জানে কোন সাপের ফণা কোন জড়ি দিয়া ঠান্ডা করা লাগে...

ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণের কৌশল বুইঝা চুপ কইরা থাকেন। আন্ধা চোখে তিনি কিছু না দেখলেও বুঝতে পারেন সভার সকলেই এখন তার দিকে তাকাইয়া আছে। তার কাছ থিকা কোনো উত্তর না পেয়ে কৃষ্ণ তার আগের কথাটারে আরেকটু বিস্তার করে- মহারাজ আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে পাণ্ডবরা কোনোদিনও আপনার সাথে কোনো বেয়াদবি করেন নাই। জতুগৃহ দাহের পর ফিরা আসলে আপনি যখন তাগোরে অনাবাদি ইন্দ্রপ্রস্থ পাঠাইলেন; বিনা বাক্যেই তো তারা আপনের বিচার মাইনা নিছে। তারপর দীর্ঘদিন মেহনত কইরা সেই রাজ্য বিস্তার কইরা আশপাশের সকল রাজারে আইনা তো আপনারই অধীন করছিল তারা। তারা তো কোনোদিনও আপনার ক্ষমতা লঙ্ঘন করে নাই। এমনকি যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে আপনারে যে সম্মান তারা দিছে তার সাক্ষীতো এখানে উপস্থিত অনেক মুরুব্বিয়ানই আছেন; বিশেষত মহাঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন.... তো এখনো তারা আপনার উপরে সেই শ্রদ্ধা রাখেন আর সারা জীবনই আপনেরে সেই শ্রদ্ধা দিতে রাজি। কারণ তারা বিশ্বাস করে পিতার অবর্তমানে আপনিই তাগো পিতা। তারা মনে করে; যে পিতার আদেশে তারা একদিন বনবাসে গেছে; বনবাসের শর্তপালন শেষে সেই পিতার উদ্যোগেই ন্যায্য পাওনা আর অধিকার নিয়া ঘরের ছেলেরা আবার ফিরা আসবে ঘরে। ...আপনেই এখন তাগো একমাত্র সহায় মহারাজ...

কৃষ্ণ বোঝে ধৃতরাষ্ট্র এইবারও উত্তর দিবেন না। তাই সে এইবার ধৃতরাষ্ট্রের দিক থেকে চোখ ফিরাইয়া সভাজনদের দিকে তাকায়- এইখানে অনেক ময় মুরব্বি আর রাজা বাদশা আছেন। আপনারাই কন আমি যা কইলাম তার মধ্যে অন্যায্য কিছু কইলাম কি না যাতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অসম্মান হয়?

সভাজনরা মাথা নাইড়া কৃষ্ণরে সমর্থন করলে কৃষ্ণ আবার ধৃতরাষ্ট্রের দিকে ফিরে- এই সভায় এমন একজন আছেন মহারাজ; যিনি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়া এককালে একলাই সমস্ত ক্ষত্রিয়কূল নির্বংশ কইরা দিছিলেন; পরে নিজের পিতামহ ঋষি ঋচীকের আদেশে একলাই আবার শান্তি স্থাপন করছেন দুনিয়ায়। কারণ তারে বাধ্য কইরা শান্তিচুক্তি করার মতো দুনিয়াতে দ্বিতীয় কেউ আগেও যেমন ছিল না এখনো নাই। যোদ্ধা হিসাবে তিনি যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ তেমনি একইসাথে ঋষিপুত্র আর নিজেও ঋষি। তিনি রাজা ছিলেন; চাইলে এখনো দুনিয়ার রাজত্ব করতে পারেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় রাজত্ব ছাইড়া তিনি এখন সন্ন্যাস জীবন যাপন করেন। এই সভাতেই যার তিন তিনজন মহারথী শিষ্য ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ রয়েছেন; আমি সেই ভার্গব ব্রাহ্মণ জমদগ্নিপুত্র পরশুরামরে এইবার অনুরোধ করব আমার বক্তব্য বিচার কইরা কিছু কথা কইতে- ভগবান পরশুরাম। আপনে কন; আমি যা কইলাম তাতে ভুল কিছু কইছি কি না...

ধৃতরাষ্ট্র উসখুস করেন। ঠাইসা ধরছে তো ধরছে তার উপরে এখন এমন একজনরে তার সামনে খাড়া কইরা দিছে যার সাথে বেদ-ব্রাহ্মণ-অস্ত্র-যুদ্ধ-রাজত্ব কোনোকিছুতেই দ্বিমত করার সাহস রাজা ধৃতরাষ্ট্রের নাই। ....রাজা ধৃতরাষ্ট্র চুপ কইরা অপেক্ষা করেন পরশুরামের কথার। পরশুরাম সংক্ষেপে সরাসরি কন- কৃষ্ণের যুক্তি আর ব্যাখ্যায় কোনো ফাঁক নাই; পক্ষপাতিত্বও নাই। অসাধারণ কইছে সে। শান্তির পক্ষেও এর থিকা বড়ো কোনো উপায় যেমন নাই তেমনি আপনার লাইগাও এর চেয়ে বেশি সম্মানজনক কোনো পন্থা নাই মহারাজ। যুদ্ধ আমি বহুত করছি। রক্তক্ষয় কোনো বড়ো সমাধান না। শান্তিই সব থিকা বড়ো। তাই আমিও কই; আপনি ভাতিজাগো তাদের ন্যায্য পাওনা দিয়া মিটমাট কইরা শান্তিতে থাকেন...

ধৃতরাষ্ট্র এইবারও কিছু কন না। পরশুরামের কথা শেষ হইলে ঋষি কণ্ব সরাসরি দুর্যোধনরে কন- আমিও ঋষি পরশুরামের লগে একমত দুর্যোধন। খামাখা যুদ্ধ কইরা জীবন ক্ষয় করার কোনো মানে নাই। তুমি বরং কৃষ্ণের প্রস্তাব মাইনা নিয়া পাণ্ডবগো লগে আপোসরফা কইরা ফালাও...

এইবার নিজের উরু থাবড়াইয়া গলা খাকারি দেয় দুর্যোধন- আমি কী করব না করব সেই বুদ্ধি আপনের কাছ থিকা নিতে হইব আমার? আপনে চুপ থাকলে ভালো হয়...

নারদ দুর্যোধনরে থামান- অত রাগ আর জিদ কোনোটাই ভালো না দুর্যোধন। ময়মুরুব্বি আর শুভাকাক্সক্ষীদের কথা তোমার শোনা উচিত। আমিও মনে করি জিদ ছাইড়া তুমি যদি মুরব্বিগো কথামতো পাণ্ডবগো লগে মিটমাট কইরা ফালাও তাতে সবারই মঙ্গল হয়; বিশেষ কইরা তোমার নিজের....

আর চুপ কইরা থাকার উপায় নাই। দুর্যোধন ঋষি কণ্বের লগে বেয়াদবি কইরা ফালাইছে। এখন না সামলাইলে অবস্থা বেগতিক হইতে বেশিক্ষণ লাগবো না। আর মুরুব্বিগো লগে বেয়াদবি করলে কৃষ্ণ হয়তো এই সভাতেই দুর্যোধনের মাথা নামাইয়া ফালাইব সকলের সমর্থন নিয়া। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে শিশুপালের মাথাটা যেমনে কৃষ্ণ ভরা সভায় সকলের সামনে ফালাইয়া দিলো সেইটা মনে কইরা ভয়ে কাইপা উঠেন ধৃতরাষ্ট্র। ধৃতরাষ্ট্র দেরি না কইরা গলা খোলেন- আমি ঋষি কণ্ব আর নারদের কথা সম্পূর্ণ সমর্থন করি। কিন্তু আমি আন্ধা মানুষ। নামে রাজা হইলেও রাজত্বের কাম তো চালায় আমার পোলা দুর্যোধন। আমি কৃষ্ণের ব্যাখ্যা আর প্রস্তাবও সমর্থন করি। কিন্তু কী আর কমু; আমার যে হাত পা বাধা। আমার পোলা আমার কথা যেমন কানে তোলে না তেমনি তার মা গান্ধারী- কিংবা বিদুর কিংবা জ্যাঠা ভীষ্মের কথাও শোনে না সে.... আমি কইকি; কৃষ্ণ। তুমি ঠান্ডা মাথার বুদ্ধিমান মানুষ। দুর্যোধনের আত্মীয়ও বটে। আমি তোমারেই অনুরোধ করি তুমি তোমার বেয়াই দুর্যোধনরে কথাগুলা একটু বোঝাও...

কৃষ্ণ বোঝে ধৃতরাষ্ট্র একটা চাল চাইলা দিলেন। অন্য কেউ দুর্যোধনরে কিছু কইতে গেলে সে যদি উল্টাপাল্টা কিছু কয় তবে বিষয়টা অন্যদিকে চইলা যাইব। তাই তারেই দিলেন দুর্যোধনের ভার আর তার লগে দুইজন যে আত্মীয় সেইটা স্মরণ করাইয়া বুঝাইয়া দিলেন যাতে দুর্যোধন কিছু কইলে কৃষ্ণ মাইন্ড না করে... ঠিকাছে। কৃষ্ণ বুঝাইতে চেষ্টা করে দুর্যোধনরে- দুর্যোধন। তোমার বাবা-কাকা-দাদাসহ সকল মুরব্বিদের কথা তো জানোই। অন্যদিকে তোমার সঙ্গীদের মধ্যে অশ্বত্থামা-সঞ্জয়- তোমার ভাই বিকর্ণ আর বিবিংশতি; তোমার মিত্র সোমদত্ত- বাহ্লীকরাজ সকলেই কিন্তু সন্ধির পক্ষে। আমিও কই; তুমিও তোমার বাবার কথা মাইনা লও...

দুর্যোধন কোনো কথা কয় না। কৃষ্ণ আরো আগে বাড়ে- পাণ্ডবগো লগে যুদ্ধে কী ফল হইতে পারে তা তো কিছুদিন আগে বিরাট নগরে অর্জুনের লগে যুদ্ধেই টের পাইছ তুমি। আমি তোমারে নিশ্চয়তা দিতাছি পাণ্ডবগো লগে ভাগাভাগির পরও ধৃতরাষ্ট্রের মহারাজ পদ যেমন থাকবে তেমনি যুবরাজ পদও হারাইতে হইব না তোমার। তুমি বহুদিন তাগো অংশও ভোগ করছ; এইবার তাদের পাওনাটা তাদের দিতে রাজি হও....

এইবার ভীষ্ম মুখ খোলেন- কৃষ্ণের কথাটা রাখ দুর্যোধন; আখেরে লাভ হইব তোর। এমন প্রস্তাব পায়ে ঠেইলা আন্ধা বাপ মায়েরে কান্দাইস না...

দ্রোণও দুর্যোধনরে তেলান- গুরু হিসাবে কই; কৃষ্ণ আর ভীষ্মের কথাটা মাইনা ল। ঘাউড়ামি কইরা আত্মীয় স্বজন আর বংশের সকলের মরার ব্যবস্থা করিস না। অর্জুনের লগে যেখানে কৃষ্ণ থাকব সেইখানে যুদ্ধ কইরা মরা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না আমি...

বিদুর কয়- তোমার জন্য আমি ভাবি না ভাতিজা। কিন্তু তোমার বৃদ্ধ বাপ মায়ের ভবিষ্যৎ দুঃখের কথা ভাইবা আমার বড়ো দুশ্চিন্তা হয়। তুমি মাইনা লও সকলের কথা...

ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর ঘুরাইয়া ফিরাইয়া আরো বহুক্ষণ দুর্যোধনরে তেলান- মিটমাট কইরা ফালা সব। মাইনা নে সকলের প্রস্তাব...

অনেকক্ষণ সকলের কথা শুইনা দুর্যোধন কৃষ্ণের দিকে তাকাইয়া বেশ ঠান্ডা মাথায় শুরু করে- আচ্ছা কৃষ্ণ। তুমি তো পাণ্ডবগো পক্ষে কইতে গিয়া আমারে গালাগালই করলা। আমার বাপ-দাদা-কাকা আর উস্তাদেও দেখি খালি আমারই দোষ দেখেন; পাণ্ডবদের যেন কোনো দোষই নাই। কিন্তু আমি তো বহুত চিন্তা কইরাও আমার কোনো দোষ বাইর করতে পারি না। আমার দোষটা কোথায় কওতো? যুধিষ্ঠির পাশা খেলা পছন্দ করে; সেইটা খেইলা সে শকুনির কাছে হারছে; তাতে আমারে তুমি কেমনে দোষ দিবা? আমি তো তাগো রাজ্য ছিনাইয়া নেই নাই। একবার পাশা খেলায় রাজ্য হারাইবার পর যখন বাবা তাগোরে আবার সবকিছু ফিরাইয়া দিলেন তখনও তো আমি কোনো বাধা দেই নাই; ভাবছি আচ্ছা ঠিকাছে; বাবা মহারাজ; তিনি তার ভাতিজাগো রাজ্য ফিরাইয়া দিছেন। সেইখানে আমি আর কিছু না কই। কিন্তু এতেও যেমন যুধিষ্ঠিরের শিক্ষা হয় নাই তেমনি তার লোভও কমে নাই। সে পাশা খেইলা কুরুরাজ্য জিতার লোভে নিজের রাজ্য আর বারো বছর বনবাসের লগে এক বছর বাড়তি অজ্ঞাতবাসের বাজি রাইখা আবার খেলতে আসছিল মামা শকুনির লগে এবং শর্তমতো খেলায় হাইরা বনবাসে গেছে ভাইবেরাদর নিয়া... সেইখানে আমার কী দোষ? আমিও তো একই বাজি ধরছিলাম; যদি যুধিষ্ঠির বাজিতে জিতা যাইত তবে আমিও তো আমার ভাইবেরাদর নিয়া বনবাসে যাইতাম এবং শর্তমতে বারো বছর বনবাস আর এক বছর অজ্ঞাতবাস শেষ কইরা ফিরা দেশে। কিন্তু পাণ্ডবরাতো পাশার শর্ত পুরা করতে পারে নাই। তাদের বারো বছর বনবাস শেষ হইছে ঠিক। কিন্তু অর্জুন বাহাদুরি দেখাইতে গিয়া অজ্ঞাতবাসের এক বছর পুরা হইবার তিন দিন আগেই ধরা খাইছে। নিয়ম অনুযায়ী এখন তারা আরো বারো বছর বনবাস আর এক বছর অজ্ঞাতবাস না কইরা রাজ্যের দাবি করতে পারে না। আমার যুক্তি সেইখানেই। এখানে আমার কী দোষ তুমি দেখো? পাণ্ডবরা নিজের দোষে শর্ত পুরা না করতে পাইরা এখন কেনই বা রাজ্য ফিরত চায় আর আমার বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধ করতে চায় সেইটা তুমি আমারে একটু বুঝাইয়া কওতো কৃষ্ণ...

কৃষ্ণ কয়- তাজ্জব বিষয়। তুমি কইতাছ নিজের কোনো দোষ দেখো না তুমি। কিন্তু কওতো ভাইয়ের বৌ দ্রৌপদীরে রাজসভায় যে লাঞ্ছনা করছিলা সেইটা কি তোমার দোষ না?

দুর্যোধন কয়- বা রে। দাসীর লগে সবাই যেমন ব্যবহার করে আমিও তেমন করছিলাম। সেইখানে দোষটা কোথায়? যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীরে বাজিতে হারার পরে সে তো আর আমার ভাইয়ের বৌ থাকে নাই। দাসী হইয়া গেছিল। কিন্তু তার লগে রাজ্য ফিরত চাওয়ার কী সম্পর্ক?

কৃষ্ণ কয়- ঠিকাছে। তাইলে বারণাবতে কুন্তীসহ পাণ্ডবগো যে পুড়াইয়া মারার ব্যবস্থা করছিলা তুমি সেইটারেও কি তুমি তোমার দোষ কইতে নারাজ?

দুর্যোধন কয়- বারণাবতে ঘর পোড়ানোর দায় তুমি আমারে কেমনে দেও কৃষ্ণ? পাণ্ডবরাই তো বরং বারণাবতে রাজকর্মচারী পুরোচনের লগে আরো ছয়জন গ্রামবাসীরে পুড়াইয়া পলাইছিল। এইরকম একটা অপরাধ করার পরেও যখন তারা বিয়া শাদি কইরা ফিরা আসল তখন নিয়ম অনুযায়ী মানুষ হত্যার দায়ে তাগো শাস্তি দেয়ার বদলে বাবায় দয়া কইরা তাদের অর্ধেক রাজ্য দিছিলেন। আমি কি একবারো পুরোচনসহ সাতজন মানুষ হত্যার লাইগা তাগো শাস্তি দাবি করছি? তারপর তারা রাজসূয় যজ্ঞসহ বহু বছর এইখানে থাইকা বহুকিছু করল; আমি কি বাধা দিছি? তাইলে সেইখানে আমি নিজের দোষ কেমনে খুজি?

কৃষ্ণ হতাশ হয়- ঠিকাছে। তুমি যদি তোমার কোনো দোষ দেখতে না পাও তবে আমিও আর দেখাইতে চাই না। তবে কথা হইল পাণ্ডবরা তো তোমার সম্পত্তির ভাগ চাইতাছে না। তারা তোমার দখলে থাকা তাগো বাপের সম্পত্তিটাই ফিরত চাইতাছে...

দুর্যোধন হাসে- বাপের সম্পত্তি বিক্রি কইরা দিলে কি তার উপর আর কারো কোনো অধিকার থাকে কৃষ্ণ? তুমিই কও দেখি? যুধিষ্ঠিরে তো তার বাপের সম্পত্তি আমার কাছে হাইরা ফালাইছে। ওইটা এখন আর তার বাপের সম্পত্তি কেমনে থাকে?

কৃষ্ণ এই বিষয়ে আর কোনো কথা কয় না। শুধু কয়- দুর্যোধন। তোমার অবস্থা দেইখা মনে হয় তুমি সব কিছু ধইরা রাখতে গিয়া পাণ্ডবগো কাছে সবকিছু হারাইতে রাজি। তবু সবার অনুরোধ সত্ত্বেও সমোঝতায় তোমার মত নাই...
- থাকার কথাও না কৃষ্ণ। যখন আমি ছোট ছিলাম তখন একবার বাবায় রাজ্যের অর্ধেক তাগোরে দিছিলেন। আমি কিছু কই নাই। তারপর পাশা খেলায় একবার সব আমার হইবার পরও বাবায় আবার সব তাগোরে ফিরাইয়া দিছিলেন। কিছু কই নাই। কিন্তু এখন অন্ধ পিতার এই রাজত্ব রক্ষার দায়িত্ব আমার। আমি একবিন্দু মাটিও দিমু না কাউরে। আমারে শত ভয় দেখাইলেও এইরকম অন্যায় শর্তে নত হমু না আমি। তোমরা যুদ্ধ করতে চাও তো করো; আমি রাজি। এর লাইগা যদি আমার মরতে হয় তবে মরব...

কৃষ্ণ কয়- সেইটাই হয়তো হইতে যাইতাছে দুর্যোধন। পাণ্ডবরা তাগো রাজ্য ফিরা পাইব এইটা নিশ্চিত। তুমি প্রস্তাব মাইনা নিলে পাইব তোমার জীবিত অবস্থায় আর না মানলে পাইব তোমার মৃত্যুর পর...

দুর্যোধনের এইসব যুক্তি ধৃতরাষ্ট্রের মনে ধরলেও তিনি পরিষ্কার বোঝেন এইখানে কারো দোষগুণ বিচারে কারো আগ্রহ নাই। সকলেই এখন পাণ্ডবগো রাজ্য ফিরাইয়া দেওয়া না দেওয়ার এক পয়েন্টে আইসা খাড়া হইছে। তিনি কিছু বলেন না। কিন্তু সবকিছু বিবেচনা কইরা দুঃশাসন দুর্যোধনরে কয়- ভাইজান। অবস্থা যা দেখতাছি তাতে তো মনে হইতাছে সবাই মিলা এখন তুমি আমি আর কর্ণের হাত পা বাইন্ধা নিয়া পাণ্ডবগো হাতে তুইলা দিব...

দুঃশাসনের কথায় দুর্যোধন ধুম কইরা উইঠা চইলা যায় সভার বাইরে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাইড়া ভীষ্ম কন- এই জেদেই খাইব পোলাটারে...

এইবার কৃষ্ণ ভীষ্মরে ঝাড়তে শুরু করে- ঝামেলাটা আপাদের মতো মুরব্বিরাই পাকাইছেন। একটা মূর্খরে আপনারা দিছেন রাজার ক্ষমতা কিন্তু এখন আর তারে সামলাইতে পারেন না। এখন তো আমারও মনে হইতাছে যে সবাই মিলা দুর্যোধন কর্ণ শকুনি আর দুঃশাসনরে বাইন্ধা পাণ্ডবগো হাতে না দিলে শান্তির আর কোনো উপায় নাই। অথবা অন্তত একলা দুর্যোধনরে বান্ধা তো একান্তই ফরজ...

ভীষ্ম কিছু কন না দেইখা কৃষ্ণ এইবার ধৃতরাষ্ট্রের উপর কড়া হয়- মহারাজ। পোলার প্রতি আপনার ব্যক্তিগত দুর্বলতার লাইগা যেন বংশক্ষয় না হয় সেইটা দেইখেন। কারণ শাস্ত্রে কয়- কুলরক্ষার লাইগা একজনরে ত্যাগ; গ্রামরক্ষার লাইগা কুলত্যাগ; দেশরক্ষার লাইগা গ্রাম ত্যাগ আর আত্মরক্ষার লাইগা দুনিয়া ত্যাগ বুদ্ধিমানের কাজ...

কৃষ্ণের কথায় ময় মুরুব্বিরা আবার সায় দেন। ধৃতরাষ্ট্র বুঝতে পারেন কৃষ্ণ আস্তে আস্তে কড়া হইতাছে তার উপর। তার মুখ থাইকা একটা সিদ্ধান্ত বাইর কইরা ফালাইতে পারলে দুর্যোধনরে সে বাইন্ধাই নিয়া যাইব পাণ্ডবগো কাছে। সেই ক্ষেত্রে এই সভায় দুর্যোধনরে রক্ষার কেউ নাই কারণ পরশুরামের কারণে কর্ণ স্থবির হইয়া আছে.... আপাতত দুর্যোধন যদি প্রস্তাবটাতে মিনরাজিও হয় তবু সব দিক রক্ষা। বহুক্ষণ চিন্তা কইরা ধৃতরাষ্ট্র বিদুররে পাঠাইলেন গান্ধারীরে নিয়া আসতে দুর্যোধনরে বোঝানোর লাইগা। কিন্তু সব শুইনা গান্ধারী উল্টা খেইপা উঠেন ধৃতরাষ্ট্রের উপর- অবাধ্য আর বেয়াদব লোকের রাজ্য পাওয়াই উচিত না তবু সে পাইছে। এর লাইগা আপনে নিজেই দোষী মহারাজ। কুসঙ্গী পোলার বিষয়ে সব জাইনাই আপনি তারে ক্ষমতা দিয়া এখন তার ফল পাইতাছেন...

ধৃতরাষ্ট্ররে ঝাড়লেও বিদুর যখন আবার গিয়া দুর্যোধনরে সভায় নিয়া আসে তখন গান্ধারী চেষ্টা করেন তারে বুঝাইতে- বাপ। তোর আব্বা- তোর দাদা- তোর গুরু আর ময়মুরুব্বিগো কথাটা রাখ। পাণ্ডবগো লগে মিললে তোর শক্তি কমব না বরং আরো বাড়ব। তুই সবার কথা মাইনা নিলে কৃষ্ণ দুইপক্ষের মাঝেই সমোঝতা কইরা দিবেন। যুদ্ধে মঙ্গল নাই বাপ আর সব সময় জয়ী হওয়া যাবে এমন কথাও নাই। তাছাড়া কুরুরাজ্যের পোষ্য হিসাবে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ তোর পক্ষে যুদ্ধ করলেও পাণ্ডবগো তারা শত্র“ মনে কইরা অস্ত্র চালাইবেন না এইটা নিশ্চয়ই তুই বুঝস। বেশি লোভ করিস না বাপ। শান্ত হ। সকলের কথা মাইনা ল...

দুর্যোধন গান্ধারীর কথায় কান না দিয়া শকুনি দুঃশাসন আর কর্ণের সাথে কানাকানি কইরা আবার বাইর হইয়া যায়। সাত্যকিও দৌড়াইয়া বাইরে গিয়া সভাঘরের দরজায় নিজের সৈন্য সমাবেশ ঘটাইয়া ভিত্রে আইসা কয়- মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। এই দিকে সবাই আলোচনা করতাছেন আর ওইদিকে আপনের পোলা দুর্যোধনে ধান্দা করতাছে কৃষ্ণরে বন্দী করার। অবস্থাটা একটু বুইঝা দেখেন মহারাজ...

সাত্যকিরে থামাইয়া কৃষ্ণ কয়- মহারাজ। দুর্যোধন যদি আমারে বন্দী করতে চায় তবে তারে অনুমতি দেন। তাইলে হয় সে আমারে বন্দী করবে না হয় আমি তারে। তাতে অন্তত একপক্ষের সমস্যা সমাধান হইব...
- আরে না না। এইটা কোনো কথা হইল। তোমার যদি দুর্যোধনের লগে মারামারিই করতে হয় তয় অত ময়মুরুব্বি এইখানে আছেনই বা ক্যান? খাড়াও দেখতাছি আমি...

ধৃতরাষ্ট্র আবার দুর্যোধনরে ডাইকা আইনা ঝাড়ি দেন- বেকুবি কইরো না দুর্যোধন....

কৃষ্ণ কয়- হ দুর্যোধন। বেকুবি করা ঠিক হইব না। আমারে একলা মনে কইরা তো বাইরে গেছিলা। বাইরে গিয়া দেইখা আসছো তো যে আমি এইখানে একলা আসি নাই? তয় যা দেখছ তা একাংশ মাত্র; ভীষ্ম-দ্রোাণ-সঞ্জয়-বিদুর পুরাটা দেখছেন গতকাইল; যদি চাও তয় তোমারেও পুরাটা দেখাইতে আমার আপত্তি নাই...

সকলে তেলাইয়া কৃষ্ণরে ঠাণ্ডা করলেও কোনো মীমাংসা ছাড়াই সভা শেষ হয়। পুরা সভায় একটাও কথা কয় না দুইটা মানুষ; দ্বৈপায়ন আর কর্ণ। সকলেই বারবার তাদের দিকে তাকায় কিন্তু প্রতিবারই তারা এড়ায়ে যায়। ভালোই হইছে একদিকে- দ্বৈপায়ন যদি কোনো প্রস্তাব রাখতেন আর সেইটা অমান্য করত দুর্যোধন তবে দুর্যোধনরে সত্যি সত্যিই বন্দী কইরা ফালাইত বাকিরা। আর পরশুরামের কারণে কর্ণ যে কিছু কয় নাই তাতে মঙ্গল হইছে সকলেরই; কারণ এই পোলাটাও কম বেয়াদব না....

সভা থিকা বাইর হইয়া কৃষ্ণ রথে উঠবার আগে ধৃতরাষ্ট্র তার হাত ধরেন- আমারে ভুল বুইঝ না কৃষ্ণ। পোলাদের উপ্রে আমার কতটা নিয়ন্ত্রণ তা তো তুমি দেখলাই। যুধিষ্ঠিররে কইও আমি শান্তির পক্ষে কিন্তু আমি যে নিরুপায় মানুষ তাও তারে বুঝাইয়া কইও...

রথে উঠতে উঠতে কৃষ্ণ ভীষ্ম আর দ্রোণের দিকে ফিরে- সভায় যা হইল তা আপনেরা সকলেই দেখলেন। দুর্যোধন আমারে বন্দী করার চেষ্টা করছিল তাও দেখলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্রও পরিষ্কার জানাইলেন দুর্যোধনের উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। এইবার আমারে অনুমতি দেন আমি যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়া যা হয় একটা সিদ্ধান্ত নেই...

বিদায় নিয়া কৃষ্ণ ফিরা যায় কুন্তীর কাছে। এইবার পুরা কাহিনী বিস্তার কইরা কয় কুন্তীরে। পাণ্ডব-পাঞ্চালী কে কী প্রস্তাব করছিল আর আইজ কী ঘটল কুরুসভায়...

কুন্তী কয়- যুধিষ্ঠিররে গিয়া কইবা তোর মায়ে তোরে ব্রাহ্মণ কইরা জন্ম দেয় নাই। জন্ম দিছে ক্ষত্রিয় কইরা। ব্রাহ্মণ কিংবা কাপুরুষের মতো কথা তোর মুখ থাইকা শুনতে চায় না তোর মায়। আর ভীম- অর্জুন- নকুল; এই তিন কুলাঙ্গাররে কইবা পাচ পোলার মা হইয়াও আইজ তাগো মায় পরের ভাত খায় পাচটা গ্রাম ভিক্ষা পাইবার আশায় না। কইও তোগো মায়ে তোগোরে রাজ্য দিছিল; সেই রাজ্যে তোগোরে সে আবার দেখতে চায়...

কৃষ্ণ কয়- পিসি সবই ঠিক আছে। এইটাই পাঞ্চালী- সহদেব আর আমার মত। খালি যদি দুর্যোধনের লগে যুদ্ধ হইত তবে আমি আজকেই যুদ্ধ ঘোষণা কইরা দিতাম। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। যুদ্ধ তো খালি ধৃতরাষ্ট্রের পোলাগো লগে তোমার পোলাগো হইব না। য্দ্ধুতো হইব তোমার এক পোলার বিরুদ্ধে তোমার অন্য আরেক পোলার... এর লাইগাই তোমার মতামত জানতে আসা। যুদ্ধ শুরু হইলে তোমার নিজের পোলারাও যে পরস্পরের মুখোমুখি খাড়াইব সেইটাতো জানো পিসি। ...যুদ্ধ ঘোষণার আগে তোমার বড়োপোলা কর্ণের বিষয়ে আমি তোমার মতামত জানতে চাই পিসি। দুনিয়ার সবাই দুর্যোধনরে ছাইড়া গেলেও তোমার পোলা কর্ণ কিন্তু তারে ছাড়ব না। ...এইবার তুমি কও কী কর্তব্য আমার...

কুন্তী অনেকক্ষণ ঝিম মাইরা থাইকা মুখ খোলে- কৃষ্ণ। যারে আমি একবার ভাসাইয়া দিছি সে যদি আবার উল্টাস্রোতে ভাইসা আসে তয় তারে আমি কোলে নিমু। কিন্তু তার লাইগা সাঁতার দিমু না আমি...
২০১২.১১.২৯ শুক্রবার

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৮
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৭
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৬
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৫ [ঘটোৎকচ ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৪: ঘটোৎকচ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৩: ঘটোৎকচ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ২
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ১
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী


মন্তব্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

"জাউরা যাদব" - হে তো দেহি সবচেয়ে বড় পন্ডিত। যা একখান কূটনীতিবিদ আছিল!!

" যারে আমি একবার ভাসাইয়া দিছি সে যদি আবার উল্টাস্রোতে ভাইসা আসে তয় তারে আমি কোলে নিমু। কিন্তু তার লাইগা সাঁতার দিমু না আমি.." কর্ণের লাইগা পরাণডা বড্ড পোড়ে আমার। খালি মনে অয় এই পোলাডা যদি এট্টু মায়ের, ভায়ের আদর পাইতো তাইলে পুরা কাহিনিডাই অন্যরকম হইয়া যাইতো!!

____________________________

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কর্ণ না থাকলে মহাভারতটা অর্ধেক পানসে হয়ে যেত

পাব্লিকের হাতে কাটাছেড়া হতে হতে মহাভারতে আছে খালি হয় দেবতা না হয় শয়তান
কর্ণ ছাড়া স্বাভাবিক মানবিক বৈশিষ্ট্যের মানুষ প্রায় নেই-ই

০২
পোলাডা মায়ের আদর পাইলে পানসে মহাভারতে আমরা বড়োজোর দুইটা অর্জুন পেতাম
আর ৫০% যুধিষ্ঠির+৫০% কৃষ্ণ= অর্জুন। এই জিনিস দুইটা দিয়ে কী করত পাব্লিক?
মহাভারতে ভীম বরং সবচে বেশি স্বকীয় মানুষ এবং স্বতন্ত্র (দুর্যোধন বোধহয় এক্ষেত্রে প্রথম)

তারেক অণু এর ছবি

সব শেষ হোক, আরাম করে পড়ুম নে! এই জন্যই অপেক্ষায় আছি-

মাহবুব লীলেন এর ছবি

শেষ হইয়াও হইবে না শেষ

আজরফ এর ছবি

চলুক চলুক।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আশা করি

শান্ত এর ছবি

সভাতে দ্বৈপায়ন ঠিক কি কারণে শান্তির প্রস্তাবে আলোচনা করেন নি সেটা ক্লিয়ার না।

__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

করেন নাই মানে করেন নাই
আপাতত এর বেশি কিছু বলা যাবে না
তার বেশি জানতে হলে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর 'মহাভারতের ছয় প্রবীণ' পড়া লাগবে

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আমি নিজেই খানিকটা বিভ্রান্ত!
দুই পক্ষেরই তো ভালো যুক্তি আছে।

অপেক্ষায় থাকলাম।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সক্কলেই বিভ্রান্ত
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন এর জন্যই তো কথা বলেননি সভায়

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন, খুব ভাল লাগে আপনার এই সিরিজটা পড়তে =DX। কৃষ্ণ তো পুরাই কূটনীতিক
ইসরাত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কৃষ্ণ হচ্ছে সমস্ত আম্রিকার প্রেসিডেন্ড আর জাতিসংঘের সমস্ত মহাসচিবদের পূর্বপুরুষ
কিংবা এরাই হলো বর্তমান 'কৃষ্ণাবতার'

হাসিব এর ছবি

বই বানায় ফেলেন এইটারে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

২০১৫ সাল

অতিথি লেখক এর ছবি

রাজনৈতিক নারী হিসেবে কুন্তীকে কখনো ভাবিনি। আপনার চোখে কুন্তীকে নতুন করে দেখছি।

শব্দ পথিক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কুন্তী বহু বড়ো এবং কঠিন রাজনীতিবিদ

ওয়াইফাই ক্যানসার এর ছবি

মহাভারতের কর্ণের কাছাকাছি সমকক্ষ একমাত্র হেক্টর ছাড়া আর কাউকে পাইনাই মনেহয়। কর্ণকে নিয়ে একটা আর দুর্যোধনকে নিয়া একটা পর্ব পরে কোন এক সময় হলে খুব ভাল হয়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমি বোধহয় দ্বিমত করব এক্ষেত্রে
প্রথমত মহাভারত আর ইলিয়ডের ঘটনার কাঠামো সম্পূর্ণ আলাদা
দ্বিতীয়ত ইলিয়ডের পক্ষ- বিপক্ষ সম্পূর্ণ পরিষ্কার; যা মহাভারতে জিলাপির প্যাচ থেকে জটিল

০২

ইলিয়ডেটা শুধুই যুদ্ধ; কিন্তু মহাভারতেরটা যুদ্ধের চেয়ে বেশি রাজনীতি আর সম্পর্কের মনস্তত্ব আর 'করা উচিত কি উচিত না' তার টানাপোড়ন

০৩
সেনাপতি হিসাবে হেক্টরের বরং বেশি মিল দুর্যোধনের সাথে আর রামায়ণের মেঘনাদের সাথে
যেখানে প্রিয়াম-ধৃতরাষ্ট্র-রাবনের মধ্যেও কিছু মিল চোখে পড়ে

০৪
কর্ণ একেবারেই আলাদা একটা চরিত্র
বিশ্বসাহিত্যে ইডিপাসের যেমন দ্বিতীয় কোনো রেপ্লিকা নেই; কর্ণেরও নেই

বিধান এর ছবি

এই সভায় তিন দিনের ভ্যাজাল এর বিরুদ্ধে কৃষ্ণের কোন বক্তব্য ছিল না অ্যাঁ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কৃষ্ণের কোনো বক্তব্য নাই। কারণ দ্রৌপদী পর্ব ৮ এ সাত্যকির কথাই তার সিদ্ধান্ত

কৌরবরা যতই বলুক না কেন অজ্ঞাতবাসের তিন দিন থাকতেই পাণ্ডবগো তারা খুইজা বাইর কইরা ফালাইছে; কিন্তু এইখানে আমাদের সকলের সিদ্ধান্ত হইল কথাটা আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা সকলেই মনে করি পাণ্ডবরা পাশাখেলার সবগুলা শর্তই অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। তাই এখন আমাদের দায়িত্ব হইল পাণ্ডবগো তাদের ন্যায্য মাটি ফিরা পাইতে সাহায্য করা। দুর্যোধন যদি ভালোয় ভালোয় ফিরাইয়া দেয় তয় ভালো। আর যদি না দেয় তয় আমরা সকলেই যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যুদ্ধ করব। এইটাই সারকথা...

এক লহমা এর ছবি

চমৎকার চলছে। চলুক
মহাভারত-এ যেটা আমার খুব আকর্ষণীয় লাগে - কত যে মুহুর্ত সেখানে, যেখানে সিদ্ধান্তটা একটু ভিন্নরকম হলেই পুরো গল্পটা চূড়ান্ত অন্যরকম হয়ে যেতে পারত!
এখনো পর্যন্ত আপনি যতদূর অতিক্রম করে ফেলেছেন, তার মধ্যে -
ভেসে যাওয়া কর্ণকে যদি বড় ঘরের কেউ কুড়িয়ে পেত!
কর্ণর প্রতি যদি গুরু পরশুরাম অমন অদ্ভুত আচরণ না করতেন!
পাঞ্চালী যদি কর্ণকে বরণ করতেন!
কর্ণ যদি সেই জ্বালায় দ্রৌপদীকে রাজসভায় ধ্বংস করার চেষ্টা না করতেন!
ভীষ্ম যদি কর্ণকে যুদ্ধের প্রথম দিনগুলো থেকে সরিয়ে না রাখতে পারতেন!
- আরো অনেকই আছে নিশ্চয়, কিন্ত যে কটি তুললাম, সব সেই একটি চরিত্রকে ঘিরে, অবাক লাগে!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

শত শত যদির মূলে কুন্তী নিজেই
সেই সময়ের শর্তমতে শুধু কুন্তী যদি কর্ণকে নিজের সন্তান হিসাবে স্বীকার করত তাহলেই সে পরিচিত এবং পরিণত হতো 'পাণ্ডবে'। মানে পাণ্ডুর সন্তান হিসাবে আর সেই হিসাবে পাণ্ডুর বড়ো ছেলে হিসাবে রাজ্যের উত্তারাধিকারে। কারণ নিয়ম অনুযায়ী কুমারী মেয়ের কানীন সন্তান (বিয়ের আগে জন্ম) তার স্বামীর সন্তান (পরে বিয়ে করলেও) হিসাবে পরিচিত

যাউক গা। এরকম কানীন সন্তানের বহু কাহিনী প্রাচীন পুরাণগুলোতে আছে। সেগুলো আমরা পড়ি না কিংবা অমন আগ্রহ দেখাই না কারণ সেইসব জায়গায় মানুষগুলো -অতপর সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকে....

কিন্তু মহাভারত একটা জটিল বুননের কাহিনী
যুদ্ধের সময় আরো দুইটা জটিল বিষয় হলো (১) নকুল সহদেবের মামা শল্য কেন দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করে?
আর (২) কৃষ্ণের সৈন্যরা কেন দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করে?

এই দুইটা ঘটনার ক্ষেত্রে যে ব্যাখ্যাগুলো আছে তা মানতে আমার কষ্ট হয়। আমার হিসাবে শল্য নিজেকে কৃষ্ণের সমান মনে করে এইটাই তার মূল ঘটনা দুর্যোধনের পক্ষে যাবার। কারণ পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করলে তার মাতব্বরি থাকে না (অথবা কৃষ্ণের অধীনে যুদ্ধ করতে হয়)

আর কৃষ্ণের সৈন্যদের দুর্যোধনের পক্ষে যাবার ঘটনা বোধহয় অন্যখানে। যাদবরা বংশগতভাবে যোদ্ধা। সম্ভবত পেশাদার/বেতনভোগী যোদ্ধা। পাণ্ডবদের পক্ষে কৃষ্ণের সৈন্যদের বেতনভাতা দেয়া সম্ভব ছিল না (পাণ্ডবদের বাকিসব সৈন্য কোনো না কোনো রাজকীয় আত্মীয়ের দেয়া; যেখানে তারা নিজেরাও যুদ্ধ করেছেন। সেক্ষেত্রে নিজেদের সৈন্যদের বেতনভাতা তারাই বহন করেছেন (পাণ্ডবরা করেননি) কিন্তু কৃষ্ণের সৈন্যদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ছিল। কৃষ্ণের পক্ষে ওদের ভরণপোষণসহ পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেয়া সম্ভব ছিল না তাই সে একাই পাণ্ডবদের সাথেে যোগ দেয় কিন্তু ভরণপোষণের দায়ভার সহ দুর্যোাধন তার সৈন্যদের ভাড়া করে নিয়ে যায়....

০২
কাহিনীতে যেরকম বলা আছে; কুন্তী কর্ণকে ভাসিয়ে দিয়েছিল; আমার মনে হয় না ঘটনা তা
মনে হয় কুন্তী সরাসরি অধিরথের কাছেই কর্ণকে দিয়েছিল জন্মের পরে
কারণ কর্ণের ঘটনাটা আগেই জানে। আর নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতে বংশ সংকটে ভোগা হস্তিনাপুরের রাজপরিবার বৌ হিসাবে সব সময় সেই মেয়েকেই খুঁজত যার সন্তান হবার সম্ভাবন কনফার্ম (গান্ধারী; ১০০ পুত্রের আশীর্বাদ পা্ওয়া (২) কুন্তী সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা প্রমাণিত) আর এজন্যই ভীষ্ম দুই ভাতিজার জন্য এমন বৌ খুঁজে বের করেন/করতে বলেন

অতিথি লেখক এর ছবি

কুন্তী বহু বড়ো এবং কঠিন রাজনীতিবিদ
কিন্তু আমার মনে হয় কুন্তী বহু বড়ো কুটিল, নিষ্ঠুর, রাজনীতিবিদ যার কাছে নিজের স্বার্থের কাছে আপন সন্তানও মুল্যহীন।

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

রাজনীতিবদ হিসাবে ধরে নিলে বাকিগুলা প্রয়োজনের অংশ হয়ে যায়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।