যুদ্ধ শেষ হইয়া গেছে। বাকিসব খুচরা আবেগ আর হিসাব নিকাশও শেষ। ভাই আর পোলাদের দুঃখ সামলাইয়া উইঠা দ্রৌপদী এক দফা দাবি জানাইছিল পাণ্ডবগো কাছে- অশ্বত্থামারে হত্যা কইরা তার মাথার মুকুটের মণি আইনা দিতে হবে তারে। অন্যথায় সে আত্মঘাতী হইয়া পোলা আর ভাইদের সাথে যাবে...
কিন্তু অশ্বত্থামাতো রাত্তিরের আকাম কইরা পলাইছে গভীর জঙ্গলে। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীরে বহুত বোঝায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদী তার দাবিখান জানায় তার সারা জীবনের ভরসা ভীমের কাছে আর ভীম গদা নিয়া রওয়ানা দেয় বনে...
ভীম রওয়ানা দিলে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিররে কয়- ভুইলা যাওয়া উচিত না যে অশ্বত্থামা দ্রোণের পুত্র আর শিষ্য। একলা ভীমের গদায় তার নাগাল পাওয়া কঠিন...
কৃষ্ণের কথায় সকলেই গিয়া যখন অশ্বত্থামারে খুইজা পায় তখন দেখে সে গেরুয়া আর ছাইপরা সাধু হইয়া বইসা আছে দ্বৈপায়নের ডেরায়। ভীমের কাছে আশ্রম টাস্রম কিছু না। সে সোজা দাবড়াইয়া যায় অশ্বত্থামার দিকে। কিন্তু আশ্রমে বসলেও অশ্বত্থামা নিজের অস্ত্র ফালায় নাই। সেও পাল্টা আক্রমণ কইরা বসে পাণ্ডবদের...
ভীম বাইচা যায় কিন্তু অর্জুন তীর নিয়া খাড়ায় অশ্বত্থামার সামনে। অশ্বত্থামা গিয়া লুকায় দ্বৈপায়নের পিছনে- ভগবান। ভীমের ভয়ে অস্ত্র চালাইলেও আমি কিন্তু যুদ্ধ ছাইড়া এখন সাধু হইয়া গেছি। আমারে বাঁচান...
দ্বৈপায়নের সামনে অস্ত্র চালায় না অর্জন। কৃষ্ণ আগাইয়া আসে সামনে। অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণ; তার উপরে মুনি ভরদ্বাজের নাতি; ঋষি অঙ্গিরা আর বৃহস্পতির বংশধর। এখন তওবা কইরা দ্বৈপায়নের আশ্রমে সাধু হইয়া আছে। তারে মারলে যুধিষ্ঠিরের প্রজারা ভালোভাবে নিবে না এই কাম। ব্রাহ্মণ হত্যা আর দ্বৈপায়নরে অসম্মানের দায়ে রাজা যুধিষ্ঠিররেই অস্বীকার কইরা বসতে পারে তারা। কিন্তু দ্রৌপদী কইয়া দিছে অশ্বত্থামার মুকুটের মণি তার চাই...
কৃষ্ণ সালিশে বসে দ্বৈপায়নের লগে। অশ্বত্থামা আত্মসমর্পণ কইরা মাথার মণি দিব পাণ্ডবদের আর অস্ত্র ছাইড়া বাকি জীবন সন্ন্যাসী হইয়া কাটাইব দ্বৈপায়নের সাথে; এই শর্তে পাণ্ডবেরা প্রাণভিক্ষা দিব তারে...
গাইগুই করলেও শেষ পর্যন্ত শর্তগুলা মাইনা নেয় অশ্বত্থামা আর ভীম ফিরা আইসা অশ্বত্থামার মুকুটের মণিটা দেয় দ্রৌপদীর হাতে...
কুরুপক্ষে অশ্বত্থামা কৃপাচার্য আর কৃতবর্মা; পাণ্ডবপক্ষে পঞ্চপাণ্ডব কৃষ্ণ আর সাত্যকি; কুরুযুদ্ধ শেষে দুইপক্ষের হাতেগোণাদের মধ্যে বাইচা থাকে মোট এই দশজন...
যুদ্ধ শেষ হইবার পরে অবশ্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস আইসা হস্তিনাপুরে তার আন্ধাপোলা ধৃতরাষ্ট্রের সম্মান আর নিরাপত্তা দুইটাই নিশ্চিত কইরা গেছেন পাকাপোক্তভাবে- পাণ্ডবেরা তোমারে নিজের বাপের মতোই শ্রদ্ধা আর সম্মানে রাখব; চিন্তা কইরো না তুমি...
এইসব খুচরা বোঝাপড়ার পর রাজ-অরাজ মাতা-ভগিনী-পত্নী-কন্যারা অনুমতি পাইয়া কুরুক্ষেত্রে আসেন স্বজনদের লাশগুলা দেখতে। দুই চোখ বান্ধা মহারানি গান্ধারী কিছু না দেখলেও মৃত শতপুত্রের জননী হিসাবে বিধবা পুত্রবধূগো দলে থাকেন অগ্রগামী নেতা...
মাঠে কারো পোশাক দেইখা শরীর চিনা যায় তো খুইজা পাওয়া যায় না তার মাথা। কারো মাথা পাওয়া গেলে শরীরটা যে কই কে জানে। আঘাত খাইয়া মরার পর শরীরগুলার উপর দাঁত চালাইছে অসংখ্য শিয়াল আর শকুন। চিনা বড়ো দায় নিজের মানুষটারে। চিনতে পারলেও কাছে যাওয়া আরো দায় গন্ধে আর বীভৎসতায়। কেউ কান্দে কেউ হয় অজ্ঞান কেউ করে হাহাকার আর এর মাঝে গান্ধারী গিয়া খাড়ান কর্ণের সামনে। শিয়ালে শকুনে তার দেহের বেশিটাই নিয়া গেছে। খাবলানো মাথাটা পইড়া আছে দূরে...
গান্ধারী কর্ণের মাথাটা কুড়ান। কোলে তুইলা হাত বোলান। কর্ণ তার পোলাগো একমাত্র বন্ধু; যার ভরসায় যুদ্ধ গেছিল তারা। কর্ণ তার পোলাগো মৃত্যুরও কারণ। কারণ কর্ণ না থাকলে এই যুদ্ধ হইত না আর মরতোও না অতগুলা মানুষ...
গান্ধারী কর্ণের মাথাটা তার ছিড়াখোড়া দেহের পাশে রাখেন। তারপর উইঠা অন্য দিকে যান নিজের পোলাগো খুঁজতে। আর তার পিছনে নিঃশব্দে আসা আরেক রাজমাতা নিঃশব্দেই রওয়ানা দেন বিজয়ী পাণ্ডব শিবিরের দিকে। কারণ তার আর দেখার কিছু নাই। তিনি কুন্তী...
কেউ জানল না কুন্তী কেন গান্ধারীর লগে আসছিলেন আর কেনই বা ফিরা গেলেন হঠাৎ। কিন্তু যেদিন পাণ্ডবেরা সকল আত্মীয়ের সৎকারের পর ধৃতরাষ্ট্ররে সামনে রাইখা গঙ্গায় রওয়ানা দিলো মৃতদের উদ্দেশ্যে তর্পণের লাইগা; তখন কুন্তী গিয়া খাড়াইল পাঁচ পাণ্ডবরে সামনে- কর্ণের লাইগাও তর্পণ কইরো তোমরা...
যারা মারা গেছেন তারা সকলেই কুরুবংশের আত্মীয় কিংবা গুরুজন। সকলের লাইগাই তর্পণ করা যায় কিন্তু যে গাড়োয়ানের পোলার লাইগা অতটা ভোগান্তি; তার স্মৃতির লাইগা কেন তর্পণ?
অর্জুন বেকুব হয়। ভীম বিরক্ত হয়। যুধিষ্ঠিরের মুখে প্রশ্ন- এমন শত্রুর লাইগা কেন আমাগো প্রার্থনা করতে কও মা?
কুন্তী এই প্রশ্নটা আশা করে নাই যুধিষ্ঠিরের মুখে। যুধিষ্ঠির কর্ণের পরিচয় জানে। যুধিষ্ঠির কোনোদিনও কুন্তীরে প্রশ্ন করে না। কিন্তু যুধিষ্ঠির এখন সম্রাট আর কুন্তী এখন কেবলই এক গর্ভধারিণী...
কুন্তী দাঁতে দাঁত কামড়ায়। বহুত হইছে যুধিষ্ঠির। বহুত কিছু করা গেছে তোমার লাইগা। কুন্তী তোমারে সম্রাট বানাইছে। যুদ্ধ জিতাইছে। সেই কুন্তীর কথায় গঙ্গার এক আঁজলা পানি যদি তুমি বিনাপ্রশ্নে কর্ণের নামে গঙ্গায় ঢালতে আপত্তি জানাও তবে আর কী থাকে বাকি? তবে আর কীসের লাইগা কুন্তীর অত গোপনতা...
কুন্তী গিয়া খাড়ায় সকলের সামনে। অতি ধীর কিন্তু অতি উদাত্ত- যে কর্ণ মারা গেছে অর্জুনের তীরে। যারে তোমরা জানতা রাধার গর্ভজাত গাড়োয়ানপুত্র বইলা। সেই কর্ণ জন্ম নিছিল আমারই গর্ভে; তোমাগো সকলেরই আগে। কর্ণ তোমাগো বড়ো ভাই...
শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হইয়া মাটিতে বইসা পড়ে অর্জুন। ভীম পাথর। ভাইঙা পড়ে যুধিষ্ঠিরের মহাযুদ্ধ জয় আর সাম্রাজ্যের অহংকার- মাটিতে হাঁটু গাইড়া নিজের হাতে মুখ লুকায় সম্রাট যুধিষ্ঠির- কী আগুন যে তুমি আঁচলে লুকাইয়া রাখছিলা জননী আর কী আগুন দিয়া যে ছারখার কইরা দিলা সব...
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৯
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ১০ [দুর্যোধন]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৯ [কর্ণ ৪]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৮ [দ্রোণ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৭ [কর্ণ ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৬ [কর্ণ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৫ [কর্ণ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী। পর্ব ৪
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৮
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৭
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৬
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৫ [ঘটোৎকচ ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৪: ঘটোৎকচ ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৩: ঘটোৎকচ]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ২
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ১
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী
মন্তব্য
হায় হায়! এইটা কি শুনলাম! মহাভারত সম্পর্কে "হালকার উপর ঝাপসা" জাতীয় ধারণা ছিল। কর্ণ যে এদের ভাই এইটা জানতাম না। এতো কঠিন টুইস্ট!
হায় হায়। বলেন কী? মহাভারতের সবচে জটিল প্যাচটাইতো কর্ণরে নিয়া
কিমাশ্চর্যম! আরো খুশি হবেন জেনে, ১৫ ফাল্গুন ১৩০৬ বাংলায় আমাদের সবার প্রিয় বুড়ো ঠাকুরদাদা 'কর্ণ কুন্তী সংবাদ' নামে একখানা আস্ত লেখা নামাইছিলেন। নেটেও পড়তে পারেন এটা। দেখুন নিচের লিঙ্কে।
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।
রাজর্ষি
হ। কর্ণরে নিয়া বাঙালির অত কান্নাকাটির মূল কারণ কিন্তু এই ঠাকুরের কর্ণ...
কিছুদিন আগে রাজশেখর বসুর অনুবাদ করা মহাভারত পড়লাম । অশ্বথামার আত্মসমর্পনের এই অংশটা পড়া হয় নাই । কূরূক্ষেত্রের মারামারি আর ড্রামা শেষ হওয়ার আর অল্প খানিকটা পড়ছিলাম । আপনার লেখা মহাভারত পাঠ সবসময়ই আনন্দের ।
দস্যু ঘচাং ফু
অশ্বত্থামারে নিয়া একটা লোক কাহিনি আর লোকাচার কিন্তু দেখতে পাওয়া যায়;
লোক কাহিনিমতে ৫টা বাচ্চা পোলারে ঘুমের মধ্যে মারার কারণে তার সমস্ত শরীর দাউদ বিখাউজ খোস পাচড়ায় ভরে যায়। এবং মানুষ গোসলের আগে যখন শরীরে তেল মাখে তখন তেল হাতে নেবার পর কনে আঙুল দিয়ে এক ফোটা তেল বাতাসে ছুঁড়ে মারে; এইটার উদ্দেশ্য হইল এই তেলটা গিয়া অশত্থামার শরীরে পড়লে সে কিছুটা আরাম পাবে....
অশ্বত্থামা মনে হয় একবারেই আত্মসমর্পণ করে নাই, আগে তার বাপের দেয়া কি যেন ভয়ঙ্কর এক অস্ত্র ছুড়ে বসছিলো (নামটা ভুলে গেছি)। সে কইছিলো, পান্ডবেরা ধবংস হউক বা এমন কিছু, পরে সেইটা ঠেকানের জন্যে অর্জুনও ছুড়ে (খালি এই দুইজনেরই এই অস্ত্র ছিলো), দেবতারা মাঝে আইসা দাঁড়ায় থামায়। একজনে নিজগুণে পাইসিলো, আরেকজনে আবদার কইরা। যে আবদারে পাইছিলো, সে ফিরাইতে জানতো না। তাই অভিমন্যুর গর্ভে থাকা পুত্র এতে মারা যায় (পরে কৃষ্ণ তারে বাঁচায় দেয় অবশ্য)। আর এর বদলে তার মণি দিতে বাধ্য হয় অশ্বথামা।
ভুল কইলাম কি? শেষের এই অংশটা খুব আগ্রহ নিয়া পড়ছিলাম এককালে।
আর আপ্নের লেখা বরাবরের মতই অছাম!
ভুল না; পুরাই ঠিক। তার অস্ত্রখানের নাম আছিল ব্রাহ্মাস্ত্র
মহাভারত আগেও পড়েছি তবে আপনার উপস্থাপন কৌশল ভালো লাগলো ।
-নাজিয়া ফেরদৌস
ধন্যবাদ অনেক
আপনার সিরিজ পড়তে পড়তে ভাবছিলাম। মহাভারত ছিল ধর্মাধর্মের মোড়কে রাজনীতির খেলা।আমাদের যাপিত জীবনের স্তরে স্তরে দেখেছি রাজনীতি।তবু কালনীর ঘোলাজলে তাকিয়ে থাকা আজন্ম উদাসী বাঙ্গালীর মত আমার/আমাদের ভাবনা ছুয়ে যায় জীবনানন্দ বা রামপ্রসাদের মতো ধর্মাধর্মের অপারের মানবিক আবেগে,
আমার ধর্মাধর্ম হলো কুদন্ড স্বরূপ
উলু ক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ
সে কূপে বেরিল কাল রূপ জল
কালো মনোরমা......
(দুঃখিত অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য লিখে ফেললাম হয়ত!)
রাজর্ষি
অপ্রাসঙ্গিক হবে কেন? তবে আমি ধর্মরে ভয় পেয়ে পাশ দিয়ে চলে গেছি আরকি
একটা বিষয় ক্লিয়ার না।
যুধিষ্ঠির কর্ণের ব্যাপারটা জানতো কিভাবে? আর আগে থেকে জানলে, এখন ভেঙ্গে পড়ল কেন? দুঃখে, না লজ্জায়?
-সো।
এইটাতো কঠিন প্রশ্ন; এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমি বইয়ের ভূমিকায় পুরা একপাতা জুড়ে অনেকগুলা প্রশ্ন করে বসছি; তবে আমার হিসাবে যুধিষ্ঠির জানত
নতুন মন্তব্য করুন