আইচ্ছা কর্ণ কি আদৌ কুন্তীর পোলা?
সন্দেহ হয় আমার। কওয়া হইছে যে কুন্তী তারে ভাসাইয়া দিবার পর সন্তানহীন সূত অধিরথ তারে কুড়াইয়া আইনা পোষে। কিন্তু অধিরথের তো আরো পোলাপান আছে। কুরুযুদ্ধেই তারা যুদ্ধ করে। বলা হয় তারে স্তন্যদান করে সন্তানহীন রাধা। কিন্তু সন্তানহীন বন্ধ্যা নারী কেমনে স্তন্য পান করায়?
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী কন আরো বহু লোকই জানত যে কর্ণ কুন্তীর পোলা; কুন্তীর সন্তান দানের ক্ষমতা নিশ্চিত জাইনাই ভীষ্ম পাণ্ডুরে কুন্তীর স্বয়ংবরায় পাঠান। কারণ তার বংশটা আগের জেনারেশনে বহুত ভুগছে বংশের বাত্তি নিয়া; তাইলে প্রশ্ন হইল কৌরব আর পাণ্ডবরা এই কথা জানতো না ক্যান?
সেই কালের নিয়ম অনুযায়ী কুন্তীর কানীন সন্তান হিসাবে কর্ণ পাণ্ডুর পুত্র হিসাবে গণ্য হইবার কথা। এইটা প্রচলিত বিষয়। রাখঢাকের কিছু নাই। কিন্তু পাণ্ডুর অত সন্তানসংকট গেলেও একবারের লাইগাও কুন্তী কেন তারে কর্ণের কথা কইল না?
মহাভারতে বলা হইছে ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ বিদুর জানতেন যে কর্ণ কুন্তীর পোলা। ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ বিদুর বহুত চেষ্টা করছেন দুর্যোধনরে যুদ্ধ থাইকা ফিরাইতে। কিন্তু একমাত্র কর্ণের ভরসায় সে ফিরে নাই। তো ইনারা জানলে দুর্যোধন জানত না কেন? আর তারা যদি দুর্যোধনরে কর্ণের এই পরিচয়টা দিতেন তাইলেই তো কর্ণের উপর থাইকা তার বিশ্বাস আর ভরসা উইঠা যাইত। তাছাড়া তারা তারে বহুত গালাগালিও করছেন কিন্তু একবারের লাইগাও তো এই কথা কন নাই...
পোলাপাইন বয়সীগো মাঝে কৃষ্ণ জানত যে কর্ণ কুন্তীর পোলা; তাইলে কেমনে বিশ্বাস করা যায় যে যুধিষ্ঠির অর্জুন আর দ্রৌপদী তা জানে না?
একটা আখ্যান আছে যেইখানে কর্ণের পরিচয় গোপন রাখার লাইগা সম্রাট হইবার পরে যুধিষ্ঠির কুন্তীরে অভিশাপ দেয়- নারীজাতি কিছুই লুকায়ে রাখতে পারবে না কোনো দিন...
এই অভিশাপটা যুধিষ্ঠিরের মুখে কতটা মানায়? যে যুধিষ্ঠির জীবনে একবারের লাইগাও কুন্তীর চোখের দিকে চোখ তুইলা কথা কয় নাই। মায়ের সম্মান রক্ষার লাইগা বলতে গেলে যেকোনো কিছু যে করতে রাজি। সেই যুধিষ্ঠির হঠাৎ কইরা কুন্তীরে কেমনে অত তাচ্ছিল্য কইরা অভিশাপ দেয়?
আর সর্বশেষ ভীম। ভীম হইল মায়ের পোলা। মায়ের রান্নাবাড়া থাইকা মায়েরে কান্ধে নিয়া হাঁটা পর্যন্ত একলাই করছে ভীম। সেই ভীম কেন কর্ণরে কুন্তীর পোলা জানার পরেও পাপিষ্ঠ কইয়া তার শেষকৃত্যের লাইগা পয়সা দিতে রাজি হইল না? সে কেন কইল পাপিষ্ঠ কর্ণের শেষকৃত্য কুন্তী তার নিজের তহবিল থাইকা করবেন? ভীমের চরিত্রে ইতরামি মানায় কিন্তু কুন্তীরে ঠেস দিয়া কতা কওয়া মাইনা নেওয়া কঠিন...
ধৃতরাষ্ট্রের পোলাগো শেষকৃত্য হইল অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের ব্যক্তিগত পয়সায়। কিন্তু কর্ণের শেষকৃত্য কেন শেষ পর্যন্ত করল না কেউ? না পাণ্ডব না কুন্তী?
আমার খটকা লাগে। মনে লয় রাজ বংশ ঘরানার বাইরে সাধারণ পরিবারের এই সন্তানের উইঠা আসা যেমন তার আশপাশের লোকজন মানতে পারে নাই তেমনি কবিরাও মানতে পারে নাই যে সে কোনো সম্ভ্রান্ত বংশজাত নয়। তাই কাহিনি জুইড়া তারে কুন্তীর পোলা বানাইয়া দিছে। যেমন ষাইট সত্তুর দশকে সিনেমায় রাজার পোলারে ধুমায়ে বাইদানির লগে প্রেম করানোর পর বিবাহের সময় দেখানো হইত সেই বাইদানি কিন্তু মূলত আরেক রাজার হারাইয়া যাওয়া মেয়ে; মানে সমাজে সমাজে সমান রাখা। তো কর্ণরেও মনে লয় জোর কইরা এমন সম্ভ্রান্ত বানানো হইছে। কর্ণের চরিত্রও কেমন যেন খাপছাড়া। মাঝে মাঝে সে বহুত ভালো মানুষ আর মাঝে মাঝে চূড়ান্ত ইতর। একই সাথে তার মাঝে আছে যুধিষ্ঠিরের উদারতা; ভীমের ইতরামি আর অর্জুনের হিরোইজম। এই ভজঘটটা বোধ হয় হইছে কর্ণরে অভিজাত বংশজাত ভিলেন বানাইতে গিয়া। কিন্তু মূলত সে ভীষ্মের ঘোড়ার গাড়োয়ান অধিরথেরই পোলা; রাধাগর্ভজাত; যে তার নিজস্ব শিক্ষা শক্তি আর ক্ষমতায় রাজপুত্রগো ছাড়াইয়া উইঠা গেছিল বহুত উঁচায়...
[মহাভারত পাঠ আপাতত সমাপ্ত। যারা যারা আমার এই পাঠে সহায়তা করেছেন সকলরে কৃতজ্ঞতা]
মহাভারতের মহাভজঘট ০৬: ভূগোল ভগদত্ত ঘটোৎকচ শিখণ্ডী
মহাভারতের মহাভজঘট ০৫: জাতিবংশ ঘরবাড়ি পোশাক
মহাভারতের মহাভজঘট ০৪: অস্ত্রপাতি আর যুদ্ধ
মহাভারতের মহাভজঘট ০৩: সংখ্যা ও বয়স
মহাভারতের মহাভজঘট ০২: কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন
মহাভারতের মহাভজঘট ০১: ঘটনাকাল
মহাভারতের গল্পমালা
মন্তব্য
অধিরথের কর্ন ছাড়া আর কোন ছেলে ছিল না।যদি থাকতই,তাহলে রাধা নি:সন্তান কেম্নে হয় আর বন্ধ্যাই কেম্নে হয়।আর কর্নের জন্ম হয় পান্ডুর সাথে বিয়ের আগেই।তাই পান্ডুকে এই বিষয়টা জানানো যায় নি।আর জানালেই কি হইত? নদীতে ভাসিয়ে দেবার পর কুন্তি নিজেই কি জানত কর্ন বেচে আছে কি মরে গেছে?আর ভীমেরা কর্নকে ভাই জানার পরেও তাকে অবজ্ঞা করেছে এরকম কিছু শুনি নি।উল্টো তারা বড় ভাইকে অপমানের জন্য অনুতপ্ত ছিল বলেই জেনেছি।এই বিষয়ে উপযুক্ত রেফারেন্স চাচ্ছি।
নিটোল আরন্যক
কর্ণের যে আরো ভাই আছে সেইটা কইতে গেলেও যে রেফারেন্স দিতে হইব সেইটাতো বুঝি নাই;
আইচ্ছা যখন কইলেন তখন দেই; পুস্তক হিসাবে আপনার পছন্দ মতো যে কোনো মহাভারতই দেখতে পারেন। পুরাটা পড়া কষ্টের কাম তাই দ্রুত মিলাইয়া নিবার লাইগা একটু ধরাইয়া দেই:
ঘোষযাত্রায় যুদ্ধের সময় অর্জুনের হাতে কর্ণের এক ভাই মরা যায়; নাম সংগ্রামজিৎ;
দ্রোণপর্বে কুরুযুদ্ধের ১২ নম্বর দিনে অর্জুনরে হাতে কর্ণের তিন ভাই মারা যায়; নাম ভুইলা গেছি
চক্রব্যুহে ঢোকার পর অভিমন্যু কর্ণের এক ভাইয়ের মাথা কাটে; নামটা বোধহয় উল্লেখ নাই
স্মৃতি থাইকা এইখানে কর্ণের ৫ ভাইয়ের সন্ধান দিলাম; যদ্দুর মনে পড়ে আরো আছে;
এরা যদি কর্ণের ভাই হয় তবে অধিরথের পোলা না হইয়া আর কার পোলা হইতে পারে? রাধা ছাড়া অধিরথের আর কোনো বউয়েরও সন্ধান পাই নাই...
০২
ভাসাইয়া দিবার পর কুন্তী কর্ণের সংবাদ জানতো কি না তার লাইগা নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর 'কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয় বইখান দেখতে পারেন
০৩
কর্ণরে ভাই জানার পরেও ভীম (ভীমেরা নয়; খালি ভীম) কর্ণরে অবজ্ঞা করছে কি না তার লাইগা যুদ্ধের পরের অধ্যায়গুলায় একটু চোখ বুলাইলে পাইবেন (অনুতপ্ত আছিল যুধিষ্ঠির)
সমাপ্ত করে দিলেন, লীলেনদা?
স্বয়ম
...
কর্ণের এই ভজঘটের পিছনে আপনার যুক্তিটাও প্রকান্ড......বিষয়টা আমাকে ভাবিয়েছিল পূর্বে.......মহাভারতের মহাপাঠের সমাপনীতে কষ্ট পাচ্ছি, নতুন করে সমগ্র একটা ঐতিহাসিক অধ্যায়কে চিনিয়েছেন- এই অস্থির রকমের গবেষণার পাঠক হতে পেরে খুব ভালো লাগছে.....এভাবে মহাভারতকে উন্মুক্ত করার জন্য কৃতজ্ঞতা.........ভালো থাকবেন.....অপেক্ষায় রইলাম নতুন কোন সিরিজের
ধন্যবাদ
০২
নতুন সিরিজ? এইটা করতেই যে অবস্থা হইছে কয়েক বছর রেস্ট নেয়া লাগবে আমার
"মহাভারত পাঠ আপাতত সমাপ্ত।" - আপাতত-র পালা শেষ হয়ে আবার যেদিন শুরু হবে, তার প্রতীক্ষায় রইলাম।
"যারা যারা আমার এই পাঠে সহায়তা করেছেন" - হাজির ।
মনে পড়বে খুব।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হ। আপাতত সমাপ্ত
আলাদা একটা কাজ করার প্লান আছে কুন্তীকে নিয়ে/একটা নাটক
আর যদি পারি তবে ঘটোৎকচকে নিয়ে একটা আলাদা কাজ
এর পরে বাকি জীবনের জন্য বিদায় মহাভারত
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ইটা ক্যান বিছাইলেন? সিনেমাতো শ্যাষ
ভাবিনি তো আগে?
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
এইখানে তো মাত্র কয়েকটা উদাহরণ; ছোটখাটো আরো কিন্তু আছে
লীনেন দা , এইডা কিন্তু বালা না । রাগ কইচ্চি ।
------------
রাধাকান্ত
দাদা ভাই
শুরু থেইক্যা যুদ্ধ আরম্ভ হওয়া পর্যন্ত বেশ মহাকাব্য ষ্ট্যাইলেই ছিল এরপর আঁতকা ছোট গল্পের মত দৌড় দিয়া শেষ করলেন?!!!
ত্যাক্ত-বিরক্ত লাগলে আরো কয়দিন রেষ্টু কইর্যা লইতেন , হের পর আরামে শেষ করতেন।
যাউকগ্যা আপ্নে লেখক হেইটা আপ্নের ইচ্ছা কিন্তু মহাভারতের ঐতিহ্য কয় এইটাতে আরো যুগ-বিয়ুগ করন যাইব।
পেন্নাম রইলো গো
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি
নতুন মন্তব্য করুন