জন্মসূত্রে আমি বাগানি মানুষ হবার কথা যদি না আমি বাঙালি হতাম। চা বাগানে একদল মানুষ গোত্র হিসেবে নিজেদের বাগানি মানুষ বলেন। এই পরিচয়ের একটা অংশ প্রকট একটা প্রচ্ছন্ন। প্রকট অংশটা বলে তারা কেউই বাঙালি নন আর প্রচ্ছন্ন অংশে দেখা যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এরা ভূমি আর ভিটেহীন মানুষ...
আমার জন্ম চা বাগানে। জীবনের প্রথম বন্ধু পাওয়া; প্রথমবার নিজের মতো করে খেলা কিংবা পরিবারকে লুকিয়ে নিজস্ব জগৎ তৈরি করা; সবই বাগানে। এই পর্যন্ত আমি বাগানি মানুষ। কিন্তু যখনই আমি বাগান ছেড়ে চলে আসলাম তখনই বাগানি মানুষ থেকে আমি আলাদা হয়ে গেলাম। কারণ বাগানি মানুষদের বাগান ছেড়ে যাবার কোনো জায়গা নাই। অথচ আমার তা ছিল...
চা বাগানগুলোতে বহুত বাঙালি শ্রমিকও আছেন। তারা কিন্তু নিজেদের বাগানি মানুষ বলেন না। তাদের নিজেদেরকে পরিচয় করানোর জন্য বরিশাল কিংবা কুমিল্লা আছে। কিন্তু বাগানি মানুষদের মাঝে বহুবিধ নিজস্ব পরিচয় থাকলেও শেষ পর্যন্ত নিজেদের জন্য বাগানি মানুষ ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় তারা দাঁড় করাতে পারেন না। কারণ তাদের পরিচয়ের নিজস্ব অংশটার শেকড় বাংলাদেশে নয়; রয়ে গেছে ভিন দেশে। ভারতে...
বাংলাদেশের বাঙালি সমাজকাঠামোয় মূলত ভিন্নগোত্রকে স্থান দেবার কোনো জায়গা নেই। এখানে ভিন্নগোত্রের স্থান পাবার একমাত্র উপায় হলো মুসলমানদের পেটের ভেতরে ঢুকে গিয়ে বাঙালি মুসলমান হয়ে যাওয়া। যেমন করে বহুত আফগান পাঠান তুর্কী হাবসিরা হজম হয়ে গেছে বাঙালি মুসলমানের ভিতর। আর দ্বিতীয় উপায়টা হলো নিজেদের হিন্দু দাবি করে নমশূদ্র গোত্র হিসেবে স্থানীয় হিন্দুদের সেবকে পরিণত হয়ে তাদের আশপাশে থাকা। কিন্তু হিন্দু হলেই হিন্দু সমাজে এক ছাতার তলে ঢোকা যায় না। গৌতম বুদ্ধকে দশম অবতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ বৌদ্ধদের হিন্দুত্বের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেও হিন্দুদের কাছে বৌদ্ধরা এখনো দূরের ন্যাড়া। সিলেটি বামুনরা পুরা মণিপুরি জাতিটারে হিন্দু বানায়ে ফেললেও ক্ষত্রিয় পরিচয়ধারী মণিপুরীরাও কিন্তু হিন্দু সমাজের না-মেশা অংশ। আর তৃতীয় উপায় হচ্ছে মিশনে গিয়ে খ্রিষ্টান হয়ে আরো গুটিয়ে সুঁটিয়ে থাকা...
খ্রিস্টান মিশনগুলো সবাইরে সমানভাবে যিশুর ছায়াতলে ডাকলেও যীশু অনুসারী বানিয়ে ফেলার পর আবার কঠোর বর্ণবাদী। খ্রিস্টান সাঁওতাল ছেলের সাথে খ্রিস্টান গারো মেয়ের বিয়েতে তারা আবার লাঠি নিয়ে খাড়ায়। বাংলাদেশে অন্তত তাদের নীতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোকে আলাদা রাখা; আলাদা আলাদা হাতের মুঠোয়...
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় একশোর বেশি জাতিগোষ্ঠির মানুষকে বাগানি মানুষ বানিয়ে সিলেট অঞ্চলে সম্পূর্ণ নতুন এক শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিক বানিয়ে এনেছিল বৃটিশরা। বৃটিশরা সিলেট অঞ্চলে চা বাগান গড়ে তুললেও শ্রমিক হিসেবে বাংলা কিংবা সিলেট অঞ্চলের বাঙালি কিংবা আদিবাসী মানুষদের নেয়নি। নিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অঞ্চল- উড়িষ্যা- উত্তর প্রদেশ- তামিলনাড়ু- অন্ধ্র প্রদেশ আর তুলনামূলক কাছের বিহার- সাঁওতাল পরগনা কিংবা পশ্চিমবঙ্গ থেকে। যার দূরত্ব সে যুগে সাধারণ মানুষের কাছে ছিল প্রায় অনতিক্রম্য। নতুন এই শিল্পক্ষেত্রে স্থানীয়দের দাপট কিংবা জোটবদ্ধতা এড়ানোর জন্যই দূরবর্তী অঞ্চল থেকে ভিন্ন ভাষার ভিন্ন জাতির মানুষকে এনে জড়ো করেছিল তারা। এই শ্রমিকরা ভিনভাষী আর ভিনদেশী হবার কারণে যেমন না পারবে স্থানীয়দের সাথে জোট পাকাতে; তেমনি দূরত্বের কারণে পারবে না নিজ দেশের মানুষদের সাথে যোগাযোগ করে সহায়তা নিতে...
বৃটিশদের ছকটা একশোভাগ কার্যকর হয়েছে বলা যায়। এই মানুষগুলো মূলত হিন্দু কিংবা মূর্তিপুজারি। বৃটিশরা জানত মুসলমান আনলে স্থানীয় মুসলমানদের সাথে মিশে হাইব্রিড হয়ে শক্তিশালি হয়ে যাবে তারা। কিন্তু হিন্দুয়ানীতে হাইব্রিড সিস্টেম না থাকার কারণে ভিন্ন ভিন্ন গোত্র বরাবরই আলাদা আলাদা থাকে। হয়েছেও তাই। এইসব বাগানি মানুষদের ভেতর ভরদ্বাজী তেওয়ারি/ত্রিবেদীর মতো ব্রাহ্মণ থাকা সত্ত্বেও পাত্তা পায়নি স্থানীয় হিন্দুদের কাছে। আর মূর্তি পূজারি হিসেবে সর্বদাই থেকেছে বাঙালি মুসলমান থেকে দূরে। মূলত বৃটিশরা সিলেট অঞ্চলের গারো-হাজং-খাসিয়া-পাত্র-মিগামের মতো মঙ্গোলয়েড আদিবাসী- বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমানদের তৈরি মানব খোঁয়াড়ের ভেতরেই কুলি বানিয়ে বন্দী করেছিল দ্রাবিড়বংশজাত এই মানুষগুলোকে। যে খোঁয়াড় থেকে বের হলেই সমস্বরে আদিবাসী কিংবা হিন্দু-মুসলামান সব দলের কাছ থেকেই তাদের শুনতে হতো ঘেন্না ঘেন্না সর সর দুর দুর...
এরা তাই থেকে গেছে সেই জাতিগত খোঁয়াড়ের ভেতর। চা বাগানে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। স্বাধীনতার পর থেকে এই মানুষগুলা বাংলাদেশের নাগরিক এবং ভোটার। কিন্তু অদ্ভুত সত্য হলো এরা আগাগোড়া ভূমিহীন আর ভিটেহীন মানুষ। বাংলাদেশের প্রায় সব ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োজনীয় স্থায়ী ঠিকানা বস্তুটা এদের নেই। এবং সেই জিনিসটা তৈরির সুযোগ কিংবা সংস্কৃতিটাও প্রায় অনুপস্থিত শত-জাতির সমন্বয়ে তৈরি এই বাগানি মানুষগুলার মাঝে। এর কারণ বোধহয় সর্বগ্রাসী সংখ্যাগুরুর সামনে ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কৌশল কিংবা সংস্কৃতি...
চা বাগানগুলোতে বাঙালি শ্রমিকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বিশেষত স্বাধীনতার পর এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। একই সুযোগ-সুবিধায় তারাও থাকেন বাগানি মানুষদের সাথে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তারা কেউই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাগানে থাকেন না। বাগানে থেকেই হয়ত আশপাশের গ্রামে ঘর গেরাস্থালি কিনে থিতু হয়ে যান কৃষি কিংবা অন্য ব্যবসায়। তাদের শিশুরা বাগান থেকে বের হয়ে যায় শিক্ষা কিংবা অন্য কাজের উদ্দেশ্যে এবং আর বাগানে না ফিরে বাংলার অন্য কোথাও অন্য ব্যবস্থায় থিতু হয়ে যায়। কিন্তু বাগানি মানুষগুলা বাগানেই থেকে যায়। কারণ বাগান ছেড়ে বাইরে বের হলেই তাদের জন্য তা বিদেশ। ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ; সেখানে না আছে তাদের সাবলীলতা না আছে গ্রহণযোগ্যতা। ফলে নিজের মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য তাদেরকে বাগান থেকে বাগানেই ঘুরে বেড়াতে হয়। বাগান থেকে বাগানেই করতে হয় আত্মীয়তা আর বাগান থেকে বাগানে ঘুরেই টিকিয়ে রাখতে হয় তাদের নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতির অবশেষটুকু...
অনেক দূরেরর ভূগোল থেকে মানুষগুলোকে বাগানে এনে আটকানোর মূল উদ্দেশ্যই ছিল যেন এরা বাগান ছেড়ে যেতে না পারে। আর পারছেও না। এবং পারবেও না। বাংলাদেশে এক সময় হয়ত চা বাগান বন্ধই হয়ে যাবে। কারণ এক সময়ের যেসব অব্যবহৃত পাহাড়ি অঞ্চলে চা বাগান তৈরি হয়েছিল সেগুলোর প্রচুর অংশ এখন পাঁচ-সাত লাখ টাকা ডেসিমেল মূল্যের শহুরে মাটি। বর্ধিত শহরে জমি ব্যবসার লোভনীয় প্লট। সিলেট শহরের কোল ঘেঁষা বাগানগুলোর প্রচুর মাটি এর মধ্যে চলে গেছে ভূমিখোরদের পেটে। শহরের বাইরে বাগাানের অংশগুলা ধীরে ধীরে যাচ্ছে নামে বেনামে কর্পোরেট খাতে...
যেতেই পারে। কারণ বাগানের মালিকরা বাগানের জমির মালিক না। তারা জমির ইজারাদার। ইজারার শর্তমতে সরকার বাগানের অব্যবহৃত অংশ অন্য কোনো কাজের জন্য ফিরিয়ে নিতে পারে। আর বাগানের অব্যবহৃত অংশ মানে মূলত যেখানে কোনো চা গাছ নাই কিংবা লাগানো হয় না। আর এই জিনিসটা প্রমাণ করা খুবই সহজ। সামান্য অযতেœই চা গাছকে মেরে ফেলা যায়। দেখিয়ে দেয়া যায় ওই অংশ অব্যবহৃত; অলাভজনক। সুতরাং তা অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়...
চা বাগান যদি না থাকে তবে আমি নিশ্চিত বাগানি মানুষেরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে না গেলেও বিলুপ্ত হয়ে যাবে তাদের নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতির অবশেষটুকু। কারণ ভাষা আর সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার মূল উপাদানই হলো একই সংস্কৃতি আর ভাষার মানুষের এক সাথে থাকা। কথা বলা আর একই সাথে উদযাপন করা একই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যেটা এই মানুষগুলা পাবে না বাংলাদেশের কোথাও। তাই তারা একসাথে থাকে। আর বাগানের মালিকেরাও চায় তারা একসাথে থাকুক। যদিও রাজনীতির মানুষেরা সচেতনভাবে ভোটের সময় তাদের প্রতিবেশী বাগানটাকে সংযুক্ত করে দেয় অন্য কোনো ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা উপজেলা কিংবা সংসদীয় আসনের সাথে...
নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণের সময় সব দলের বাঙালিরা আবার একদল হয়ে পড়ে চা বাগান প্রশ্নে। সবারই চেষ্টা থাকে যেন সব বাগান কিংবা বেশিরভাগ চা বাগান কোনোভাবেই একটা ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা কিংবা একটা সংসদীয় আসানের মধ্যে না পড়ে। যদি পড়ে যায় তাহলে কিন্তু বাগানের ভোটেই বাগানি মানুষ নির্বাচিত হয়ে যেতে পারে চেয়ারম্যান কিংবা সাংসদ। তাই এক বাগানের মানুষ এক সংসদীয় আসনের ভোটার তো পাশের বাগানের মানুষ ভোট দেয় আরেক সংসদীয় আসনে...
এতে সকলেরই সুবিধা। রাজনীতিবিদদের যেমন; তেমনি সুবিধা চা শ্রমিক নেতাদের। চা শ্রমিক নেতারা বাগানি মানুষ এবং মোটামুটি বংশ পরম্পরায় চা শ্রমিকদের নেতা। তারা বেশ নাদুস নুদুস মানুষ। দেশে-বিদেশে উচ্চ শিক্ষিত উকিল ব্যারস্টিার মানুষ। বিশেষায়িত শ্রমিকদের নেতা হিসেবে সরকার জাতিসংঘ কিংবা আইএলওতে অতি সমাদৃত আর সুবিধাপ্রাপ্ত। তারাও চান না বাগানের মানুষরা এক হয়ে মূল ধারার রাজনীতিতে চলে আসুক। তাতে মূল ধারার নেতাকর্মীরা যেমন এসে হামলে পড়বে তাদের বাগানি নেতৃত্ব দখলে তেমনি চা বাগানের মানুষগুলা পেয়ে যাবে মূলধারার সাথে যোগাযোগরে বিকল্প মাধ্যম। সুতরাং চা শ্রমিকরা তাদের মতোই থাকে...
অনেককেই চা শ্রমিকদের অতি সামান্য মজুরি নিয়ে কথা বলতে শুনি। এই সূত্রটা ধরে অনেক সময়ই বলা হয়। কিন্তু আদতে সব হিসাব করলে তাদের মজুরি সাধারণ কৃষি মজুর থেকে কম না বরং এর একটা নিয়মিতি এবং নিশ্চয়তা আছে। তারা ঘর বাড়ি আশপাশের ক্ষেত খামার যেমন বিমামূল্যে পান। তেমনি পান চিকিৎসা। তার সাথে এখানো আছে রেশন হিসেবে পাওয়া আটআনা কিংবা একটাকা কেজিতে আটা কিংবা কেরোসিনের লিটার। তার চেয়ে বড়ো কথা; প্রায় সবার জন্য কাজের সুযোগ এখনো আছে চা শ্রমিকদের। এই একই সুযোগ সুবিধায় থেকে বাঙালি শ্রমিকরা যেখানে কয়েক বছর পর জমিজমা কিনে বাড়িঘর করে সরে যেতে পারেন। সেইখানে বাগানি মানুষদের ছেঁড়া কাপড় আর বদলায় না। তার কারণ আবার সেই অবাধ মাদক। যা শুরুতে বৃটিশরা মাগনায় দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছিল খাওয়া। এখন তাদের মধ্যেই কেউ সেই ব্যবসা করেন আর বেশিরভাগ বাকিরা সপ্তার বেতনের দিন গিয়ে সেইগুলো ঢেলে আসেন শুঁড়িখানায়। এই শুঁড়িখানাগুলো রাজনীতিবিদ বাগানের মালিক কিংবা শ্রমিকনেতা সকলের জন্যই আশীর্বাদ। কাজ করো। মদ খাও। পরের দিন চোখ কচলাতে কচলাতে আবার ছেঁড়া কাপড় পরে যাও চা গাছের গোড়ায়...
শ্রীমঙ্গলে ধানিজমি আন্দোলনের সুবাদে বর্তমানে চা শ্রমিকরা তুমুল আলোচনার বিষয়। শ্রীমঙ্গলে চা বাগানের জমি স্পেশাল ইকোনোমিক জোন হিসাবে বরাদ্দ দেবার প্রতিবাদে দেশের রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবি-সাংবাদিক এনজিও-ফড়িয়ালরা গিয়ে হামলে পড়ছেন চা শ্রমিকদের ঘাড়ে- ধানের জমি দেবো না কিন্তু...
কিন্তু জমির মালিক তো সরকার। চা শ্রমিকরা বাগানে কাজের বাড়তি সুযোগ হিসেবে অতদিন সেখানে ধান চাষ করতেন। বাংলাদেশে কৃষিজীবী আদিবাসীরাই তো উত্তরাধিকার ভিত্তিতে চাষ করা জুম্ম জমির অধিকার পাননি। তাহলে যারা আদিবাসী নন; কৃষিজীবীও নন; জমির দখলদারও নন। বরং বাগানের বেতনভুক্ত শ্রমিক; যারা অতদিন প্রাপ্য মজুরির বাইরে বাগানের পতিত জমিতে চাষ করে বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন; যা চুক্তিমতে চা বাগানের কাজ ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করলে সরকার ফিরত নিতে পারে। সেখানে কতটুকু টিকবে তাদের অধিকারের দাবি?
অধিকারের দাবি যদি তোলা হয় তবে জন্মসূত্রে বাগানি মানুষ হিসেবে আমি দাবি করব চা শ্রমিকদের জন্য গ্রাম বরাদ্দ দিতে। বাংলাদেশে বহুবার ভূমিহীনদের জন্য বহু ভূমি দান করা হয়। কিন্তু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভূমিহীন এই নাগরিকরা কোনোদিনও তার ভাগ পান না। আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন বাঙালি সেটেলার বসানো হয় তখন বাগানের বহু বাঙালি শ্রমিক জমি পেয়ে বাগান ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে গেছেন। কিন্তু একটা বাগানি পরিবারকেও আমি সেখানে যেতে বা জমি পেতে শুনিনি...
কিন্তু একটা ক্ষয়িষ্ণু শিল্পে কয়েক প্রজন্ম ধরে আটকে পড়া মানুষগুলোর জন্য স্থায়ী ঠিকানার কোনো দাবি তুলছেন না কেউ। না রাজনীতিবিদেরা- না শ্রমিক নেতারা না নবাগত চা শ্রমিকদের অবতারগণ...
বাগানের মানুষকে মালিকানাহীন জমিতে আবার ধান চাষের সুযোগ দিলে তাদেরকে বাগানেই আটকে রাখা হবে আরেক প্রজন্ম। রুদ্ধ করে দেয়া হবে বাগান ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নেবার পথ। তারপর? বাগান থাকবে আর কতদিন? কিংবা চা উৎপাদন সত্যি আর কতদিন লাভজনক থাকবে বাংলাদেশের জন্য? বাংলাদেশে বহু চাবাগান বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হবার পথে বহু বাগান। বহু বাগানের মাটি চলে গেছে আবাসিক এলাকায়। আর বাণিজ্যবুদ্ধির অভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ক্রমশই ভারত আর শ্রীলঙ্কার কাছে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের চা। এর ধারাবাহিকতায় হয়ত এক সময় বাংলাদেশে আর কোনো চা বাগানই থাকবে না। কিন্তু যে মানুষগুলা বাগানের সাথে এসছিল তাদের তো এখানেই থেকে যেতে হবে। তাদের তো আর কোনো দেশ নেই; গ্রাম নেই। কিন্তু বাগান বন্ধ হয়ে গেলে যখন বাগানের মাটি বরাদ্দ হয়ে যাবে অন্য কোনো কাজে তখন এই বাগানি মানুষগুলার ঠিকানা হবে কোথায়?
আন্দোলনের ইসুহীনতার সময়ে চা বাগান এখন একটা আনকোরা ইসু। বারোজনের বারো ধান্দায় শ্রীমঙ্গল এখন নেতা সাংবাদিক আর মানবাধিকারের প্রদর্শনী ক্ষেত্র। এই প্রদর্শনী থেকে সব ধান্দালরাই কিছু না কিছু বাগিয়ে নেবে। ধানের জমি শ্রমিকরা পাবে না। আমি নিশ্চিত পাবে না। আর তারপর প্রদর্শনী বন্ধ করে যার যার পকেটের কড়ি গুনতে গুনতে ধান্দালরা ফিরে যাবার পর কাজ হারিয়ে জেলে পচে মরবে কিছু ভূমিহীন দেশহীন মানুষ। তীর ধনুক আর লাঠি কুড়াল দিয়ে সাজিয়ে যাদের ছবি তুলে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে পত্রিকায়; বাগানের মালিক কিংবা ইকো জোনওয়ালারা কি সেই পেপার কাটিংগুলা জমিয়ে রাখছে না?
ধান্দালার সরে যাবার পরের দিন এরা কাজ হারাবে। নেহাত ছোটখাটো চুরির মামলায় পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে তাদের। তারপর কাজ যাবে তাদের পরিবার সদস্যদের। বাগানে থাকার অধিকার হারাবে পরিবারগুলা। এক বাগান থেকে অন্য বাগানে যাবে ইনফরমেশন। কোনো বাগানেই আর জায়গা পাবে না এই পরিবার। পরিবারের পুরুষরা থাকবে জেলে আর নারী কিংবা শিশুরা ভিক্ষা করবে রাস্তায়। চা বাগানের শ্রমিক আন্দোলন থামানোর অব্যর্থ এই কৌশলটা আমার নিজের চোখে দেখা...
বাগানে মানুষগুলার বহু সুবিধা আছে। শুধু নাই শিশুদের শিক্ষার কোনো ভালো সুযোগ। শিক্ষাহীনতার অভাব তারা বিশ্বাস দিয়ে পুরণ করে। তারা বিশ্বাস করে। যে তাদের সাথে মিঠা কথা কয় সবাইরে তারা বিশ্বাস করে। আর সেই বিশ্বাসই তাদের ঠকায়। আর সেই বিশ্বাসই তাদেরকে শতাব্দি ধরে করে রাখে ভূমিহীন দেশহীন ভবিষ্যৎহীন বাগানি মানুষ...
২০১৬.০২.০৫ শুক্রবার
মন্তব্য
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বাগানি মানুষ কলিন্স রোজারিও আর রাজু প্রসাদ করি'র চাকুরি না-পাওয়ার খবরের লিঙ্ক দিলামঃ
ভূসম্পত্তি নেই বলে পুলিশে চাকরি হলো না দুই তরুণের
একটু রূঢ় শোনাবে, কিন্তু একটা সত্য কথা হচ্ছে অন্য জাতি এসে কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবে না। অন্য জাতি আসে শাসন করতে, শোষণ করতে। বাঙালী (হিন্দু বা মুসলিম) বা মিশনারীরা আগে যেমন বাগানি মানুষদের মূল স্রোতে মিশতে দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। বাগানি মানুষদের নিজ উদ্যোগে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে মূল স্রোতে অভিযোজিত হতে হবে। আর অভিযোজিত হওয়া মানেই স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দেয়া নয়। বাগানি মানুষের অরিজিন শতাধিক। আজ তাদের সেই শতাধিক অরিজিনের অবশেষদের মধ্যে পার্থক্য কোথাও চুল পরিমাণ, কোথাও কী পার্থক্য সেটা নিজেরাও জানে না। বাগানি মানুষেরা না পেরেছে নিজেরা একাট্টা হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইতে নামতে, না পেরেছে অভিযোজিত হয়ে নিজেদেরকে মেরুদণ্ড সোজা করে টিকিয়ে রাখতে। সংস্কৃতি বদ্ধ কোন জিনিস নয়। সেখানে নিয়ত সৃষ্টি বা নির্মাণ আছে। আর সৃষ্টি বা নির্মাণ থাকলে সেখানে পুরাতনের ধ্বংসও অনিবার্য। যে সংস্কৃতি অভিযোজনে অক্ষম পুরাতনকে ধ্বংস করে নতুনকে সৃষ্টি বা নির্মাণ করতে পারে না তার বিলুপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আপনার লিংকের নিউজটা দেখলাম পত্রিকায়। তবে এই প্রসঙ্গটাকে আমি আলাদাভাবে দেখি। সবক্ষেত্রে স্থায়ী ঠিকানা একটা অত্যাচার বাংলাদেশে। আর স্থায়ী ঠিকানা মানেই ভূমিভিটা। যতদিন পর্যন্ত না এটা উঠে যাচ্ছে ততদিন এটা পুলিশের পয়সা খা্ওয়ার একটা উপলক্ষ্য। এর শর্তই হলো ভিটেমাটির মালিকানা। যার ভিটে নাই তার জন্য হয় মিথ্যা কথা বল্তে হয় না হলে টাকা দিতে হয় পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময়...
আমার নিজের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে। আমার পরিবার বহুযুগ ভিটেহীন মানুষ ছিল। স্থায়ী ঠিকানায় ভূয়া ঠিকানা ব্যবহার করতে হতো আমাদের...
চা বাগান যেহেতু শ্রমিকদের কোয়ার্টার। কোনো স্থায়ী আবাসন নয়। সেহেতু এটা সূত্রমতে স্থায়ী ঠিকানা হতে পারে না। কারণ কোনো কোনো পরিবারের সদস্যরা চাকরি না করলে/চাকরি চলে গেলে এই কোয়ার্টারে থাকার অধিকারও হারাবেন। সেক্ষেত্রে এখানে পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ নাই। বরং সমস্যাটা চাকরিবিধির
০২
বাগানি মানুষদের আসোলে কয়েকটা সিস্টেম দিয়ে আটকে ফেলা হয়েছিল। তার একটা ছিল জাতিগত বেড়া। দ্বিতীয়ত এই অল্পসংখ্যক মানুষ আনা হয়েছিল প্রায় একশোর বেশি জাতিগোষ্ঠী থেকে। তাদের ভাসা সংস্কৃতি সব ছিল আলাদা। এরও উদ্দেশ্য ছিল জোট পাকাতে না দেয়া। এখন একশোর বেশি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মূলত খুব বেশি পার্থক্য নেই। ভাষাও মনে মাত্র কয়েকটা হাইব্রিড বাগানি ভাষায় গিয়ে ঠেকেছে। সাংস্কৃতিক উপদান্ও কয়েকটা
নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখার কারণে/কিংবা অস্তিত্ব রক্ষার কারণে এরা কেউ আগে বাগানের বাইরে চিন্তা করেনি হয়ত। দেশ বিভাগের সময় বাগান থেকে কাউকে ভারত পাড়ি দিতে শুনিনি। যদিও তাদের সবার আদি নিবাস ভাগরে পরে ভারতে পড়েছে। তার মানে হলো দেশ বিভাগের আগেই এরা মূলত নিজেদের জাতি আর ভূখণ্ড থেকে পুরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন...
পাকিস্তানে এরা না ছিলেন নাগরিক না ছিলেন শত্রুপক্ষ/হিন্দুপক্ষ/ইন্ডিয়াপক্ষ। তারা ছিলেন স্রেফ বাগানি মানুষ
০৩
বাংলাদেশে শুরু থেকেই তারা নাগরিক আর ভোটার। কিন্তু মূলধারা তাদেরকে না টেনেছে কোনোদিন। না তারা মূলধারায় উকি দিয়েছেন কোনোদিন। তাদের দিকের বিষয়টার জন্য বোধহয় তাদেরকে পুরাপুরি দোষ দেয়া যায় না। বরং ভূমিহীন পুনর্বাসনের সময় সরকারি ভাবেই এই গোষ্ঠীটাকে আলাদা নজর দেয়া উচিত
পাসপোর্ট করতে যাবেন, স্থায়ী ঠিকানায় পুলিশ গিয়ে হাজির হবে। আপনার চোদ্দপুরুষ ওখানে বসে থাকলেও লাভ নেই নগদ না নিয়ে তারা কাগজ ছাড়বেন না।
কাগুজে ঝামেলার কি আর শেষ আছে?
হাস্যকর 'চারিত্রিক সনদ' বলে একটা জিনিসের অত্যাচার ছিল একসময়, এখন এটা কমে এসেছে যদিও। প্রাইভেট সেক্টরে অন্তত এটা আর চায় না।
ধইন্না পাতায় নাকি মাইনসের আয়ু কমায়? নতুন গবেষণা পড়লাম
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হ
চায়ের কাপে যে এতখানি বিষাদ মাখা মানুষ গুলোর গল্প লুকিয়েছিল জানতামনা। লেখককে ধন্যবাদ।
হ। চায়ের মইদ্যে বহুত কষ...
শোষণের সরলরেখাটাকে ধরে রাখে নানা জটিল, বক্র ঠেকনা। ঠেকনাগুলো ভালো ধরেছেন এ লেখায়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ঠেকনা আছে। আরো আছে স্যার। আর তার উপরে নতুন ঠেকনা তৈরি করতাছেন মিডিয়া পান্ডারা
গত মাসেই শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ আর সেখানে কিছু চা-বাগানের 'কান্দাত' ঘুরতে গিয়ে এরকম কিছু বাগানি মানুষের সাথে পরিচয় হওয়াতে তাদের কথাই ভাবছিলাম। এর মধ্যেই আপনার এই লেখা। একটা বিষয় তখন আমাকে অবাক করেছিল - স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা, যেমন খাসিয়া, মনিপুরী, ইত্যাদিরা মনে হয় এইসব বাগানিদের থেকে অনেক ভাল আছেন। পাহাড়ের উপর খাসিয়াদের ছবির মত টিপটপ, ফিটফাট পুঞ্জী (কালিঞ্চি) বা তাঁদের তুলনামূলক স্মার্টনেস দেখে অবাক ও মুগ্ধ হয়েছি, তেমনি একই অঞ্চলে বাগানিদের ছন্নছাড়া অবস্থায় হতাশ। পার্থক্যের কারনটা এখন বুঝলাম। একটা কৌতুহল - আদিবাসীদের জন্য মিশনারীদের মনে হলো অনেক ভালবাসা - বাগানিরা এই 'ভালবাসার' কোন ভাগ পায় না?
****************************************
স্থানীয় আদিবাসীরা ভালো আছেন কারণ তারা স্থানীয়। তাদের অভিযোজন ঘটছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। তাছাড়া তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সাথে তাদের যোগাযোগ আছে। করা সম্ভব; যা বিচ্ছিন্ন বাগানিদের পক্ষে সম্ভব না
০২
বাগানিদের জন্যও মিশনারিরা ভালোবাসা দেখায়/দেখিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো কনভার্টেড হবার পর তারা পরিণত হয় আরো বেশি সংখ্যালঘুতে। তখন আর বিয়েশাদি জাতীয় সামাজিকতায় পায় না বাগানিদের সহায়তা আবার বাইরে গিয়ে বাঙালি কিংবা অন্য জাতির (খাসিয়া/গারো) খ্রিস্টানদের সাথে মিশতেও পারে না...
০৩
বাগানি অনেকে খ্রিস্টান হয়েছেন। কিন্তু সমাজ পাননি। মিশনারিদের আমি বাগানি খ্রিস্টানদের মামলা মোকদ্দমায় সহায়তা করতে দেখেছি। কিন্তু সামাজিক উন্নয়নে কিছু করতে দেখিনি/চোখে পড়েনি
বাগানে কাজ করলে যে মজুরি পাওয়া যায় তা কি আসলেই চলনসই? আমি জানতাম অনেক চা বাগানে এখনও পাতা তোলার সময় দৈনিক ৬৯ টাকা আর অন্য সময়ে ৪০ টাকা করে দেয়া হয়, বেতনের দিন রবিবার হাট বসে, আর ওইদিনই এইটাকার বড় অংশ চলে যায় নেশার পেছনে।সপ্তাহ কাটে রেশনের রুটি আর চাপাতার ভর্তা খেয়ে। অনেক বাড়িতে তিন বেলা খাবারের প্রচলন নেই বলেই শুনেছি ।
এই ব্যবস্থায় কিন্তু বাঙালিরা ম্যানেজ করছে। আবার বাগান ছেড়েও যাচ্ছে। পরিবারের সবাই না গেলেও একটা অংশ বাইরে যাচ্ছে। যার প্রবণতা বাগানি মানুষদের মধ্যে খুবই কম
০২
নেশায় টেকা খাইলে তো সেইটা সমাজবিদ্যার বিষয়; অর্থনীতির না
আগেই পড়েছিলাম লীলেনভাই।
অসাধারণ লেখা।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন