রাজা দশরথ মইরাই গেলেন। পোলার লাইগা কানতে কানতে মাত্র চাইর দিন টিকলেন তিনি। সুমন্ত্র রামরে ফালাইয়া আসছে দুই দিনের পথ দূরে। ফিরতেও লাগছে দুইদিন। রাম যাইবার কালে পথে পড়া রাজারে কুড়াইয়া আইনা যে বিছানায় শোয়ানো হইছিল; সেই বিছানা তিনি আর ছাড়তে পারেন নাই। থাইকা থাইকা কানছেন আর এরে তারে জিগাইছেন- সুমন্ত্র ফিরছেনি?
হয়ত তার আশা আছিল যাইতে যাইতে রামের মনে হইব ক্যান যামু? আর সুমন্ত্রের রথ ঘুরাইয়া ফিরা আসব ঘরে। কিন্তু সুমন্ত্র ফিরা আইসা শ্রদ্ধাভক্তি জানাইয়া বিছানার বগলে খাড়াইয়া রাজারে কয়- তিনারে গঙ্গার তীরে ফালাইয়া আসছি আমি...
দশরথ বিবিধ প্রশ্নে সুমন্ত্রর কাছে আরো কিছু শুনতে চান। সুমন্ত্র খালি কয়- তিনি শ্রেণিমতো সকলরে শুভেচ্ছা আর পেন্নাম দিয়া আশীর্বাদ চাইছেন...
রানি কৌশল্যা চিক্কুর দিয়া উঠেন- পুতেরে যেইখানে রাইখা আসছ আমারেও সেইখানে নিয়া যাও সুমন্ত্র। আমি আমার পোলার লগেই যামু...
সুমন্ত্র কয়- তাগোরে তো আমি নদীঘাটে নামাইয়া দিছি। নদী পার হইয়া তারা কোথায় গেছে না গেছে সেইটা তো আমার জানা নাই মহারানি...
কৌশল্যা বিলাপ করেন। দশরথ কান্দেন। কানতে কানতে মাঝ রাত্তিরে কান্দন থামাইয়া দেন তিনি। মারা যান রাজা দশরথ...
রাজার মরণে পয়লা কান্দেন রানি কৌশল্যা। তারপর আস্তে আস্তে কান্দে সারা রাজবাড়ি। কান্দনের ধাক্কা হাল্কা হইলে গালাগালি বাড়তে থাকে কৈকেয়রি নামে। কান্দাকাটি আর গালাগালি দুইটাই থিতু হইয়া পড়লে মন্ত্রী-আমাত্যরা নইড়া বসেন- কী করা এখন?
এই মন্ত্রণায় নেতা পুরোহিত বশিষ্ঠ। বিভিন্নজনে বিভিন্ন কথা কয়। সবচে বেশি কথা হয় রামেরে ফিরাইয়া আনার। কিন্তু চাইরদিন আগে পর্যন্ত বশিষ্ঠ রামের পক্ষে থাকলেও এখন তিনারে বড়োই নিয়মনিষ্ঠ দেখায়। রাজার লাশখান ঠিকঠাকমতো তেলের মইদ্যে ডুবাইয়া রাইখা তিনি মুখ খোলেন- রাজা নির্বাচন হইয়া গেছে অযোধ্যায়। মরার আগে প্রয়াত রাজা ভরতরে রাজ্য দিয়া গেছেন আর রামের হইছে নির্বাসন। সুতরাং দশরথের অবর্তমানে এখন ভরতই অযোধ্যার আইনত রাজা...
ভরত আর শত্রুঘ্নরে নিয়া আসতে ভরতের নানাবাড়ি কেকয় দেশে চাইরজন মানুষ পাঠান বশিষ্ঠ। কেউ কেউ মিন মিন কইরা আওয়াজ তোলে- মহারাজে তো এইটাও কইয়া গেছেন যে ভরত যেন তার শেষকৃত্য না করে...
মূর্দা রাজার রাগের কথা কইয়া জেন্দা রাজারে রাগাইবার মতো বেকুব না বশিষ্ঠ। চোখ রাঙানি দিয়া তিনি সব মিনমিন থামাইয়া দেন...
ভরত অযোধ্যায় আইসা পৌঁছায় সাত দিন পরে। অতদিনে সাধারণ সমীকরণও টাইনা ফালাইছে অযোধ্যার জনসাধারণ; রাজা মরছেন রামের বনবাসের লাইগা আর রাম বনবাসে গেছে ভরতের লাইগা। ক্ষেপা মাইনসেরে সামলানো যায় কিন্তু দুঃখিত মানুষ দুঃখ পুইষা রাখে ভিতরে আর আস্তে আস্তে তা বাহির করে অনাস্থায়-অসম্মানের ইঙ্গিতে। বাতাস বুইঝা তাই ভরত দুঃখিত হইয়া দুঃখী মানুষের ভিতর মিশা যায়। সিংহাসনে বসার আগে মাইনসের অভিশাপ আর গালাগালিগুলা সামাল দেওয়া অতীব জরুরি বিষয়...
মহলে আইসা ভরত কিছুই জানে না ভাব লয়। বাপে কই; ভাই কই এইসব জিগায়। তারপর ঘটনা শুইনা শাস্ত্রমতে নারীজাতির মূর্খতা আর পাপিষ্ঠতার রেফারেন্স দিয়া নিজের মায়েরে গালাগালি দেয়। তারপর সর্বজনে গিয়া কয়- এই রাজ্য নিমু না আমি। ভাইজানের বনবাস কিংবা বাপজানের মরণ কোনোটার লাইগাই যে আমি দায়ী না সেইটা কিন্তু আপনেরা জানেন। তারপর শুরু করে পর্বে পর্বে বিলাপ। ভরত যা করে শত্রুঘ্নও রিপিট করে সব। ভরতের বিলাপের তোড়ে ভাইসা যায় রাজ্যের সকলের বিলাপ। এমনিক রাম জননী কৌশল্যাও অবশেষে নিজের দুঃখ ভুইলা ভরতরে সান্ত¡না দেন। আর পুরোহিত বশিষ্ঠ আইসা কন- বাপের লাশ যে সৎকারের অপেক্ষায় পইড়া আছে পুত...
দশরথের শেষকৃত্যে যারা আসে সকলেই জাইনা যায় রাজ্য চায় না ভরত। সৎকার শেষ হইলে ভরত-শত্রুঘ্ন আবারো শুরু করে বিলাপ। বিলাপ করতে করতে শত্রুঘ্ন গিয়া কৈকেয়ীর দাসী মন্থরারে শুরু করে মাইর- সকল দোষ এই বেটির। এই বেটি বুদ্ধিতেই রাজ্যনাশ হইছে অযোধ্যার...
ভরত গিয়া শত্রুঘ্নরে থামায়- খালি ভাইজান আমারে মাতৃঘাতক কইয়া গোস্বা করবেন। নাইলে কিন্তু আমি এই আকামের লাইগা স্বয়ং আমার জননী কৈকেয়ীরে খুন করতাম। ...এরে ছাইড়া দেও। তুমি যদি এরে মারো তাইলে কিন্তু নারী নির্যাতনকারী কইয়া তোমার লগে গোস্বায় কথা কইবেন না বড়োভাই...
আরো দুই সপ্তা পার হয় বিনা রাজায়। ভরত কয়- রাজা হইবে বংশের বড়ো পোলা। এইটাই আমাগো বংশের নিয়ম। আমি বনে গিয়া অভিষেক করাইয়া ভাইজানরে অযোধ্যায় নিয়া আসব। তোমরা আমার বনযাত্রার আয়োজন করো...
বনযাত্রার প্রস্তুতি ছাড়া অযোধ্যায় এখন আর জরুরি কোনো কাম নাই। সকলেই ভরতের কথা মাইনা প্রস্তুতি নেয় বনযাত্রার। সকলের আগে বন যাত্রার সুবিধা অসুবিধা বুইঝা নিজের পছন্দমতো সেনাদল সাজায় ভরত। বহুত বেহুদা কামেও সে নজর দেয় একেকটা গোষ্ঠীরে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়া আসতে। বনযাত্রার লাইগা জাহ্নবী নদীর তীর পর্যন্ত বাড়িধর সেতু কূপ তৈয়ারি হয়; জঙ্গল কাইট্টা যেমনন সাফ করা হয় তেমনি ন্যাড়া জায়গায় বৃক্ষরোপণও হয় রাজার হুকুমে। সময় যায়। ভরতরেও রাজা বাইলা মাইনাও নেয় সকলে। এমনকি একদিন বন্দনাকারীরা তারে রাজা বইলা বন্দনা কইরা স্তূতিও গাইয়া ফালায়...
বনযাত্রার আগে রাজসভা বসলে সকলে ভরতরে দশরথের মতোই সংবর্ধনা করে। এখন সকলেই তার অনুগত বলা চলে। সেই সভাতেই কথাখান পুরোহিত বশিষ্ঠ আবারো তোলেন- প্রয়াত রাজা তোমারে সজ্ঞানে রাজা নির্বাচন কইরা গেছেন বৎস। আর তোমার ভাইজান নিজ প্রতিজ্ঞার কারণেই বনবাসী। তোমার উপর কারো কোনো অভিযোগও নাই। তাই আমরা কই কি; তুমি রাজা হইয়া রাজ্য শাসন করো...
ভরত বিনয় করে- রামের রাজ্য আমি কেমনে ছিনতাই করি পুরোহিত? আপনে তো জানেন যে এখন আমার একমাত্র সাধনা তিনারে বন থাইকা ফিরাইয়া আনা। যদি তিনারে ফিরাইতে না পারি; তয় মনে রাইখেন আমিও তিনার লগে বনবাসী হমু। এই পাপটা আমার মাথায় চাপাইছেন আমার জননী; দয়া কইরা সেই পাপের ভাগিদার হইতে আমারে কইয়েন না কেউ...
দশরথের যে মন্ত্রী সুমন্ত্র সব থিকা বেশি ক্ষেইপা আছিল ভরতের উপর সেও এইবার গইলা পড়ে ভরতের কথায়। ভরত এইবার সুমন্ত্ররে আদেশ করে - তুমি আমার আদেশে যাত্রার আয়োজন আর সৈন্য সমাবেশ করো...
ভরত রাজা বনে যায়; লগে যায় পুরা রাজবাড়ি। দশরথের রানিগণ আছেন। আছেন স্বস্ত্রীক সকল সেনাপতি। অস্ত্র নির্মাতার দল আছে। আছে স্বর্ণকার-কামার-তাঁতী-প্রকৌশলী-ভূমিতত্ত্ববিদ-স্থপতি-মাটি কামলা-নট-নটী-নর্তকী-মেছোয়া মাইমল- সকল পুরোহিত আর বিশাল এক সৈন্যের বাহিনি...
গঙ্গার অন্য তীর নিষাদরাজ্য শৃঙ্গবেরপুরের রাজা গুহ। বনবাসে যাইবার কালে রামের খাতির যত্ন সে যেমন করছে তেমনি পুরা কাহিনিও সে শুনছে। নদীর অন্যপারে ভরতের বাহিনি দেইখা সে চিক্কুর দিয়া নিজের মাইনসেরে কয়- এই লোক নিশ্চয়ই রামেরে বিনাশ করতে যাইতে আছে বনে। তোমরা অস্ত্র নিয়া রেডি থাকো আর নদীর সমস্ত নৌকা বন্ধ কইরা দেও যাতে কোনোভাবেই গঙ্গা না পার হইতে পারে সে...
২০১৬.০৪.১০ রোববার
নোট: এই গল্পের ঘটনা-পরম্পরার লাইগা রাজশেখর বসুর রামায়ণ অনুসরণ করা হইছে
সহজিয়া রামায়ণ ৩
সহজিয়া রামায়ণ ২
সহজিয়া রামায়ণ ১
.....
রামায়ণের শোলক সন্ধান ২: সীতার সতীত্ব পরীক্ষা
রামায়ণের শোলক সন্ধান ১: সীতা কার মেয়ে?
মন্তব্য
তেলে চুবায় রাখার বিষয়টা কী?
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
সংরক্ষণ?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
তেলে চুবানোর বর্ণনা পাই নাই। তবে এর উদ্দেশ্য যে লাশ সংরক্ষণ সেইটা পরিষ্কার। লাশরে পুরা তেলের মইদ্যে ডুবাইয়া রাখা হইছিল
আচ্ছা, ' এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে?' -মন্থরার নামে এই জাতীয় একটা ডায়লগ আছে না?
আর, ভরতের মাথায় বুদ্ধি আছে। যাই হোক, দেখা যাক নদী তীরে কি ঘটে।
হ। সেইরাম কথা তো আছেই
০২
রাজা হইব; বুদ্ধি থাকব না এইটা হয়?
এই পর্বটা কিঞ্চিৎ পিচ্চি সাইজের হয়ে গেল না? যাই হোক, মনে হয়
"ভরতের কাছে আমাদের এরশাদের অনেক ঋণ আছে রে ঋণ আছে!"
হ। ইতিহাস থাইকা শিক্ষা নিয়াই তো ছোট মানুষগুলান বড়ো হয়। তয় এরশাদের রাজ্যের সাইজ কিন্তু ভরতের রাজ্য থাইকা যেমন বহুগুণ বড়ো আছিল তেমনি ভরতের যেখানে মাত্র একজনরে সরাইতে হইছে সেইখানে এরশাদরে সরাইতে হইছে বহুজনরে; সেই দিক দিয়া এরশাদ কিন্তু ভরত থাইকা বড়ো
চমৎকার, চমৎকার। পরের পর্বের অপেক্ষায়।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
অতি সম্প্রতি আপনার লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আপনার এই চলিত ভাষার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি এবং আমার মা, দুজনেই গোগ্রাসে গিলেছি। মহাভারত শেষ করে রামায়ণে এসে দেখছি চতুর্থ পর্বের পরে কাহিনী আর এগোয়নি। আমি কি খুঁজে পাচ্ছিনা, নাকি সত্যিই আপনি এরপর আর লেখেননি?
ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র
পরের পর্ব আর আসেনি। এখন মোটামুটি সীতা হরণ পর্যন্ত দ্রুত যাবে; নোট আর লাইনআপ হয়ে গেছে। তারপর লংকায় গিয়ে আরেকটা বিরতি পড়তে পারে
অনেক ধন্যবাদ। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম। বিশেষ করে ঐরকম একটা নতুন ধরণের মহাভারতের পরে রামায়ণের গল্পে আপনার কাছ থেকে প্রত্যাশাটা অনেক বেশি।
এই ফাঁকে বলে নি, মহাভারতে ঘটোৎকচ চরিত্রকে অন্যমাত্রায় তুলে নিয়ে আসা আর যুধিষ্ঠিরকে কুশলী রাজনীতিবিদ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে একটা 'যুধিষ্ঠির-কৃষ্ণ আঁতাত' দেখানো, এগুলো আমার খুবই আকর্ষণীয় লেগেছে! আর প্রচলিত মতের একেবারে বিরুদ্ধে গিয়ে কর্ণের জন্ম সম্বন্ধে যে সংশয় তৈরী করেছেন সেটা অনন্য।
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র
নতুন মন্তব্য করুন