পৌলস্ত্য বধ কাব্য নামে বাল্মিকীর হাতে যখন রামায়ণের আদি পুস্তকটা রচিত হয় তখন এর শত্রু-মিত্র-নায়ক সকলেই আছিল রক্ত মাংসের মানুষ। কালে কালে এর নায়ক রাম যতই অবতার হইতে থাকেন ততই তার মিত্ররা হইতে থাকে নখ-ল্যাঞ্জা-লোমওয়ালা জন্তু জানোয়ার আর শত্রুপক্ষ পরিণত হয় রাক্ষস খোক্কস কিংবা ভূতুমের রূপকথায়। আর পৌলস্ত্য বধ থাইকা পুস্তকখান রামায়ণ হইবার পথে রাম-রাবণ-বামুন-বান্দর সকলেই হইয়া উঠেন বেসুমার অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী; শুধু একজন মাত্র থাইকা যায় রক্ত-মাংস-আবেগের মৌলিক মানুষ। সেইটা হইল বাপে ফালায়া দেওয়া- শত্রুতে টাইনা নেওয়া- স্বামীতে খেদাইয়া দেওয়া সীতা...
হয়ত শুধু নারী হইবার কারণে রাম-রাবণ-বান্দর-বৈষ্ণব কেউই তারে স্বতন্ত্র মানুষ না ভাবায় একমাত্র এই চরিত্রখানই এখন পর্যন্ত টিকা আছে আদি বাল্মিকীর মানবিক মানুষ হিসাবে। যদিও রাম অবতার পদ পাইবার পর রামের সম্মান বাঁচাইতে গিয়া রামায়ণে আস্ত একটা নতুন কাণ্ড যোগ কইরা সীতারে যেমন সতীত্বের পরীক্ষা পাশ করাইছেন ভক্তকূল তেমনি বহুত অলৌকিক হিজাব-বোরখাও পরাইছেন অবতারের বৌয়ের ইজ্জত ঢাকার লাইগা। মূলত এগারো-বারো শতকের তামিল কবি কম্বনের হাতে রাম পাইছেন অর্ধদেবত্ব আর ১৬ শতকের তুলসিদাসের হাতে পাইছেন পূর্ণ দেবত্ব কিংবা ভগবানত্ব। এর ধারাবাহিকতায় তামিল কবি কম্বন তার রামকথাই আখ্যানে তন্ত্রমন্ত্র জুইড়া দিয়া বুঝাইতে চাইছেন কান্ধে তুইলা নহে; আস্ত কুঁড়েঘরশুদ্ধা সীতারে তুইলা নিয়া গেছে রাবণ; মানে অবতার রামের বৌরে ছুঁইতেও পারে নাই ব্যাটা। আর এর থাইকা আরেকধাপ আগাইয়া ভক্ত তুলসি দাস তার রাম চরিত মানস-এ আবিষ্কার করছেন মায়া সীতার উপাখ্যান; যেই উপাখ্যান অনুয়ায়ী সীতারে নিতেই পারে নাই রাবণ; নিয়া গেছে ভগবানের বৌয়ের ছায়ামূর্তি মাত্র। অথচ বাল্মিকী রামায়ণে সীতারে নিবার সময় রীতিমতো কুস্তাকুস্তি কইরা নিয়া যায় রাবণ...
এই সকল কারিগরিই হইছে ভগবান রামের ঘরের ইজ্জত রক্ষার লাইগা; সীতার লাইগা না। অথচ রাবণের আগে রাম-লক্ষ্মণের সামনেই একবার বিরাধ রাক্ষস সীতারে কোলে তুইলা দৌড় দিছিল। ঘটনাখান ছোট বইলা যেহেতু মানুষ মনে রাখে না; হয়ত সেই কারণেই কম্বন বা তুলসি দাস কেউই বিরাধ রাক্ষসের ছোঁয়া থাইকা ভগবানের বৌয়ের ইজ্জত রক্ষার দরকার মনে করেন নাই। কথাটা সইত্য; যারা ভক্তি ভইরা রামায়ণ নিয়া জীবন পার কইরা দেন তাগোরেও যদি জিগান- কওতো বাপ বিরাধ কিডা? তারা আকাশের দিকে তাকাইয়া কন- বিরাধ নামে আমার পরিচিত যে কেউ নাই। অথচ সীতার প্রথম অপহরণ ঘটনা ঘটে এই বিরাধেরই হাতে...
মূল পুস্তকে লঙ্কা যুদ্ধের শেষে রাম নিজের মুখে সীতারে জানাইয়া দেন- তোমার লাইগা যুদ্ধ করি নাই আমি। আমি যুদ্ধ করছি আমার বাহাদুরি দেখাইতে আর বংশগৌরব রাখতে। কিন্তু এখন তোমারে ঘরে নিলে নিজের বংশের মুখে চুনকালি পড়ব আমার। তাই যেইখানে ইচ্ছা সেইখানে তুমি যাইতে পারো। লক্ষ্মণ- ভরত-শত্রুঘ্ন-সুগ্রীব বা বিভীষণ যারে ইচ্ছা তারে তুমি নতুন স্বামী বইলা গ্রহণ করতে পারো। তোমারে আমার আর প্রয়োজন নাই। ...মানে রামে-রাবণে-বান্দরে কোথাও সীতার কোনো আলাদা অস্তিত্ব নাই। রামে তারে বিয়া করায় সে রামের বৌ হইলেও রাক্ষসের ভাইয়ের বৌ কিংবা বান্দরবধূ হইতেও তার কোনো অসুবিধা নাই। কারণ নারীর জাত তার স্বামীর জাতেই নির্ধারিত হয়; বামুনে বিয়া করলে বামনি; চাষায় করলে কিষাণী আর চাড়ালে করলে চণ্ডালিকা...
সীতারে ভরতের কাছে দান কইরা দিতেও আমার আপত্তি নাই; কথায় কথায় রামের মুখে এই রকম কথা দিয়া রামায়ণে সীতার যে জীবনী শুরু হয় সেইটা গিয়া শেষ হয় সীতারে কুত্তায় চাটা ঘি কইয়া। আদি পুস্তকের পরতে পরতে সীতার এইরকম গঞ্জনা-অপমান গ্রন্থিত করলেও বাল্মিকী অন্তত সীতার আত্মসম্মানরে এক চুল পরিমাণও নীচে নামান নাই। এই কামটা করছেন মূলত অবতারবাদী ভক্তের দল। তিনারা রাবণের ছোঁয়া থাইকা রামের স্ত্রীর ইজ্জত বাঁচাইতে গিয়া রীতিমতো নরক ঢাইলা দিছেন সীতার আত্মমর্যাদার উপর। বাল্মিকী রামায়ণে যোগ হওয়া উত্তরকাণ্ড নামের বেহুদা পুস্তকটায় এইসব ভক্ত লেখকদের মূল কর্মকাণ্ডখান কেন্দ্রীভূত আছিল ইনাইয়া বিনাইয়া রামের রামগিরি রক্ষা। রামেরে ভগবান বানাইবার ক্ষেত্রে ভক্তগণের সব থিকা বড়ো সম্যা আছিল রাবণের ঘরে সীতার দীর্ঘ বসবাস। যেইটারে স্বয়ং রামই সন্দেহ করছেন। পরিষ্কার কইয়া দিছেন- তোমার মতো মাইয়ারে বচ্ছরব্যাপী ঘরে পাইয়াও রাবণ কিছু করে নাই; সেইটা অন্তত আমি বিশ্বাস করতে পারি না...
ভগবান না হয় বিশ্বাস করতে পারেন যে তার স্ত্রী ধর্ষিত হইতে পারেন। কিন্তু ধর্ষিতা নারীর স্বামীরে ভগবান বানানো তো ভক্তের লাইগা কঠিন। তাই ভক্তরা পয়লা রাবণের উপর রম্ভা কাহিনি চাপাইয়া ব্রহ্মার অভিশাপ যোগ কইরা বুঝাইতে চাইলেন যে নিজের জানের ডরেই রাবণ সীতারে ছুঁইতে পারে নাই। তারপর যোগ করলেন অশোকবনে সীতার ব্রতর কথা। কিন্তু অতসবের পরেও যখন স্বয়ং রাম সীতারে কুত্তায় চাটা ঘি কইয়া ফালইয়া দিলেন। তখন ইনারা দায়িত্ব নিলেন সীতারে অগ্নী পরীক্ষায় পাশ করাইয়া রামের ঘরে ফিরাইয়া দিবার মিশনে...
উত্তরকাণ্ডের কারণে অবতারের বৌয়ের হয়ত সতীত্ব প্রমাণ হইছে। কিন্তু শূন্যের কোঠায় নাইমা আসছে সীতার আত্মসম্মান। সতীত্ব ছাড়া নারীর সম্পদ নাই; স্বামী ছাড়া নারীর গতি নাই; এই কনেসেপ্টে বিশ্বাসী সকলেই সীতার মাথা নত করাইয়া তারে নিয়া তুলছেন একটার পর একটা পরীক্ষায়। ব্যক্তি সীতার দিকে কেউই তাকায় নাই একমাত্র বাল্মিকী ছাড়া। রামে রাবণে বান্দরে ব্রাহ্মণে সকলেই যখন সীতারে অপবিত্র কইতে আছেন তখন একটা মাত্র মানুষ হুঙ্কার দিয়া উঠে- সীতা যদি অপবিত্র হয় তবে আমার সমস্ত ঋষিত্বের পূণ্য যেন শূন্য হইয়া যায়...
মানুষটা অনার্য বংশজাত মহাকবি বাল্মিকী। কিন্তু এই অনার্যপুত্ররে ঋষি হিসাবে মাইনা নিলেও তার সমস্ত পূণ্য বাজিতেও ভরসা করতে পারে না কেউ...
কিন্তু এই তথাকথিত বাল্মিকী মূলত কে? ইনি কি ভার্গব বংশজাত স্বয়ং বাল্মিকী চ্যাবন; যিনি নিজের মায়ের কাহিনি দিয়া বানাইছেন সীতার চরিত্রখান?
রামায়ণ রচয়িতা বাল্মিকীরে তথাকথিত না বইলা উপায় নাই। কারণ তিনার সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক তথ্য প্রায় নাই। যদিও বাঙাল কৃত্তিবাস বাল্মিকী সম্পর্কে একখান গাঞ্জাগপ্প জুইড়া দিছেন তিনারে দস্যু রত্নাকর বানাইয়া। অবশ্য বাল্মিকীর রত্নাকর নাম ভিল রামায়ণেও আছে। কিন্তু কৃত্তিবাস মূলত নিজাম ডাকাইতের নিজামউদ্দিন আউলিয়া হইবার গল্পটারে ভারতীয় পুরাণের চেহারা দিয়া রত্নাকর দস্যু থাইকা ঋষি বাল্মিকী হইবার কাহিনি ঝাইড়া দিছেন। লগে আবার যোগ কইরা দিছেন যে পাপী রত্নাকর মরা মরা জপতে জপতে উল্টা উচ্চারণে রাম নাম জপ করা শিখছেন। কিন্তু বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষাতেই; বিশেষত সংস্কৃতে ‘মরা’ শব্দ উচ্চারণ করতে করতে মইরা গেলেও সেইটা উল্টাইয়া রাম হইবার কোনো সুযোগ নাই। আর বিন্ধ্য অঞ্চলের বাল্মিকী অন্য যেই জাতের মানুষই হন না কেন; অন্তত রাম নাম কইবার লাইগা যে বাঙাল হইতে আসেন নাই সেইটাতো নিশ্চিত...
কৃত্তিবাসের এই গপ্পরে উড়াইয়া দিতে দিতে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি কন- খাড়াও। রামায়ণ রচয়িতা ছাড়াও কিন্তু আরেকজন বাল্মিকী আছেন। তিনি ভৃগুপুত্র চ্যাবন। ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী চ্যাবনই হইলেন আদি বাল্মিকী। আর অনেকেই কন যে রামায়ণ গ্রন্থের রচনা নাকি শুরু হইছিল সেই আদি বাল্মিকী চ্যাবন মুনির হাতেই। এই যুক্তির লগে তিনি জোড়া দেন অশ্বঘোষের রেফারেন্স। অশ্বঘোষের মতে রামায়ণের বাল্মিকী হইলেন সরাসরি চ্যাবন অথবা চ্যাবনপুত্র অথবা চ্যাবন বংশজাত ভার্গব...
চ্যাবন যে বাল্মিকী আছিলেন; মানে উই পোকার ঢিবি বা বল্মিক আকৃতির মাটির ঘরে বাস করতেন সেই কাহিনি কিন্তু আরো বহুত জায়গায় পাওয়া যায়। আর এই কারণেই সেই চ্যাবন ঋষি নাকি বাল্মিকী নামে পরিচিত আছিলেন। আরেকটা সূত্রমতে আজকের বলখ অঞ্চল; ইংরেজিতে যেইটারে কয় প্রাচীন শহর ব্যাকট্রা; বৈদিক সাহিত্যে সেই জায়গাটারে ডাকা হইত বহ্লীক। এই বহ্লীক জায়গাটা আবার দাবি করা হয় জরথ্রুস্টের জন্মস্থান হিসাবে। এবং বংশগতভাবে জরথ্রুস্ট আছিলেন পশুরজন বা পার্শিয়ানগো মাঝে স্পিতামা গোত্রের মানুষ। অন্যদিকে অথর্ব বেদের ভার্গব সংহিতামতে ভার্গব বামুনেরা; মানে ঋষি ভৃগুর সন্তান শুক্রচার্য আছিলেন স্পিতামাগোত্রের মানুষ। আর চ্যাবন মুনি ভৃগুর বড়ো পোলা; শুক্রাচার্যের ভাই। সেই হিসাবে হইলেও হইতে পারে বলখ-ব্যাকট্রা বা বহ্লীক অঞ্চলের মানুষ বইলা চ্যাবন মুনিরে মানুষ উচ্চারণ ভেদে বাল্মিকী কইয়া ডাকত; যেমনভাবে চ্যাবনের ভাই ঋচিকের নাতি রাম বর্তমানের পেশোয়ার বা বৈদিক পরশুপুরী অঞ্চলের মানুষ আছিলেন দেইখা সকলেই তিনারে পরশুরাম কইয়া চিনে...
নৃসিংহপ্রসাদ ভাঁদুড়ী বামুনবাদী মানুষ। তিনি বাল্মিকীর শৈশব আর যৌবন বনে বাদাড়ে নিম্নবর্গের মানুষগো লগে কাটছে কইয়া বাল্মিকীরে ভার্গব বামুন প্রমাণ কইরা থাইমা যান। কোনোভাবেই তিনি কইতে রাজি না যে বাল্মিকী স্বয়ং এক আদিবাসী বংশজাত বনবাসী মানুষ...
ব্রাহ্মণগো সম্মান সুরক্ষা কইরা নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি যেইখানে থামেন সেইখান থাইকা যদি ভারতের ভিল উপজাতির আখ্যানে যাওয়া যায় তাইলে কিন্তু বাল্মিকী বিষয়ে আরেকটা অধ্যায় পাওয়া যায়। ভিলগো একটা নিজস্ব রামায়ণ আছে। সেই রামায়ণে বাল্মিকীর নাম রত্নাকর ভালিও। সেইটা বড়ো কথা না। বড়ো কথা হইল ভিলরা দাবি করে তারা মহাকবি বাল্মিকীর বংশধর। মানে বাল্মিকী আছিলেন ভিল গোত্রজাত মানুষ...
ভিলগো দাবি অনুযায়ী রামায়ণের আরেক চরিত্র শবরীও ভিল নারী; গণ্ড উপজাতিও দাবি করে তারা শবরীর বংশধর। তবে এতে বেশি কিছু প্রমাণ হয় না। কিন্তু রামায়ণী দক্ষিণ কোশল বা বর্তমান মধ্য প্রদেশ এর ছত্রিশগড়ের যে অঞ্চলে বাল্মিকীর আশ্রম আছিল বইলা দাবি করা হয়; সেই অঞ্চলটারেই ঐতিহাসিকেরা রামের পদচারণা অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করেন; আর এই এলাকাটাই মূলত ভিল জাতির আদি বাসস্থান বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চল। আর রমিলা থাপারসহ অনেকেই বলেন যে- রামায়ণের রাম-রাবণের যুদ্ধের মূল কাহিনিটা আসছে বিন্ধ্য পর্বতমালা অঞ্চলের কোনো দুইটা গোষ্ঠির লাড়াইর ইতিহাস থাইকা। লঙ্কাফঙ্কা কিংবা সমুদ্রজয় এইগুলা বহু পরের ক্রিয়টিভ ইনজেকশন। মূলত রামায়ণ রচনার সময় পর্যন্ত আর্যরা সমুদ্র দেখেই নাই; জয় করা তো বহুত দূর...
এইবার এইটার লগে আরো দুয়েকটা আদিবাসী দাবি মিলাইয়া নিলে কিন্তু একটা সমীকরণ খাড়ায়া যায়। রামায়ণ উত্তরাধিকার নিয়া মুণ্ডা উপজাতির দাবি দুইটা। তাগো পয়লা দাবি হইল তারা হনুমানের বংশধর। রামায়ণে হনুমানের যে ল্যাঞ্জা সেইটা বায়োলজিক্যাল ল্যাঞ্জা না বরং ধুতি বা নেংটির বাড়তি খুঁট; কথাটা বেকুব ভক্তের দল ছাড়া সকলেই স্বীকার করেন। আর মুণ্ডাদের দিকে তাকাইলে দেখা যায় ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে এখনো তারা উৎসবে অনুষ্ঠানে সেই ল্যাঞ্জা বাইর করা ধুতিই পরিধান করে...
মুণ্ডাগো দ্বিতীয় দাবি হইল তারা রাবণেরও বংশধর। তার মানে এই দাবি অনুযায়ী রাবণ আর হনুমান মূলত একই গোত্রের মানুষ। এবং রমিলা থাপার বা অতুল সুরের হিসাবমতো সেই বিন্ধ্য অঞ্চলেরই মানুষ। যাদের একদল বনে বাস করত বলে বন-নর বা বানর নামে পরিচিত আর আরেকদল গর্জনশীল ঝর্ণা বা সরব নদী মোহনার কাছে বা কিংবা দ্বীপে থাকত বলে বলে রাবণ...
ভিল উপজাতির মানুষেরা মরা পুরুষরে তোলে চিতায় আর মরা নারী বা শিশুদের দেয় কব্বর। রামায়ণের কাহিনি অনুযায়ী সীতার পাতাল প্রবেশ যতই রঙিন হউক না কেন; সেইটা যে মূলত মাটির নিচে কবরে যাওয়া তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হইবার কথা না কারো। তবে কি বাল্মিকী নিজে ভিল আছিলেন বইলা ভিলগো রীতি অনুযায়ীই তার পালিতা কন্যা সীতারে কবর দেন?
একটা কথা মোটামুটি নিশ্চিত যে রামায়ণ কাহিনিটা বাল্মিকী বানাইয়া লিখেন নাই। শোনা ঘটনাই লিখছেন তিনি। কিন্তু কথা হইল কার মুখে তিনি ঘটনাটা শুনছেন? আন্ধা ভক্তিটক্তি না থাকলে রামের কাহিনি তিনি নারদের মুখে শুনছেন এইটা বিশ্বাস করবে না কেউ। আবার সীতার মুখ থাইকা শুইনা লিখলে এর নিশ্চিত কিছু চিহ্নসূত্র থাইকা যাইত কাব্যের পাতায়; সেইটা কিন্তু নাই। সীতা বহুত মুখরা নারী হইলেও দরকারি কথায় কিন্তু সীতা নির্বোধের মতো নিশ্চুপ। তবে বাল্মিকী কোথায় শুনছেন এমন কাহিনি; যেইটারে জোড়া দিয়া তিনি পৌলস্ত্য বধ কাব্যখান বানাইছেন? এমন তো হয় নাই যে পৌলস্ত্য বধ বা রামায়ণের মূল কাহিটা আসলে বাল্মিকীর নিজের মায়ের কিংবা ঠাকুমারই কাহিনি; সীতার মধ্য দিয়া যেইটাতে প্রাণ সঞ্চারিত হইছে বাল্মিকীর কাব্যে ও মেধায়?
ভারতীয় পুরাণে পয়লা যে বিবাহিত নারী অপহরণ এবং অপহরণের পরে স্বামীর ঘরে ফিরা আসার কাহিনি পাওয়া যায় সেইটা স্বয়ং চ্যাবন জননী পুলমার কাহিনি। বৃহস্পতির শিষ্য চন্দ্রের লগে তার স্ত্রী তারার চইলা যাওয়ারে অনেকে অপহরণ কইয়া চালাইতে চাইলেও সেইটা মূলত আছিল প্রেমিকের হাত ধইরা ঘর ছাড়ার ঘটনা; অপহরণ না। নিখাদ অপহরণের পয়লা ঘটনাটা পুলমার। অদ্ভুত বিষয় হইল যেই লোক বা রাক্ষস চ্যাবনের মা বা ভৃগুর স্ত্রী পুলমারে হরণ করছে তার নামও কিন্তু আছিল পুলমা। এই নামের মিল দেইখা মনে হয় পুলমা ব্যক্তির নাম না; গোত্র বা বংশনাম। ভৃগুপত্নী পুলমা আছিলেন অপহরণকারী পুলমার বাগদত্তা। কিন্তু কইন্যা পুলমার বাপ বিখ্যাত পাত্র পাইয়া পুরানা সম্বন্ধ ভাইঙা মাইয়ারে ভৃগুর লগে বিবাহ দিয়া দেন। অপহরণকারী পুলমার লগে চ্যাবন জননী পুলমার সামাজিক বিবাহ সাব্যস্ত হইবার কাহিনি থাইকা অন্তত এইটা অনুমান করা যায় যে তারা একই গোত্রের বা জাতের মানুষ...
পুলমা কাহিনীর লগে সীতা কাহিনির অদ্ভুত অনেকগুলা মিল আছে। পুলমা অপহৃত হইবার পর কিন্তু পুলমার মহাঋষি আর মহাবীর স্বামী ভৃগু; যারে দাবি করা হয় তীর ধনুকের আবিষ্কারক হিসাবে; তিনি কিন্তু কিছুই করেন না প্রায়। তিনি খালি ঘটনার সাক্ষী বা পুলমার পাহারাদার অগ্নির উপর হম্বিতম্বি করেন। রামায়ণে সীতা হরণের সময় অগ্নির মতো ধমকডান্ডা সাক্ষী হইল জটায়ু। অপহরণকারীরে মাইরা পুলমারে উদ্ধার করে তার গর্ভের সন্তান চ্যাবন। পুলমা কতকাল সেই রাক্ষস পুলমার ঘরে ছিলেন তার বর্ণনা নাই; কিন্তু পুলমার সন্তান চ্যাবনের জন্ম হয় ভৃগু পরিবারের বাইরে। ঠিক রামায়ণের লব আর কুশের জন্মের মতো। পুলমা ঘরে ফিরা আসার পর কিন্তু ভৃগু তারে গ্রহণ করেন না; রামায়ণে যেমন সীতারে গ্রহণ করেন না রাম...
অপহরণের পর কিংবা স্বামীর প্রত্যাখ্যানের পর পুলমার দুঃখের বিশদ কোনো বর্ণনা কোথাও না থাকলেও অতি সংক্ষিপ্ত একটা কথায় তার দুঃখের পরিমাণ অনুমান করা যায়। সেই অতি সংক্ষিপ্ত কাহিনি অনুযায়ী দুঃখিনি পুলমার চোখের পানিতে তৈয়ারি হয় বধূসরা নদী। পুরাণমতে স্বয়ং ভৃগুপিতা ব্রহ্মা পুলমারে সম্মানের সহিত স্বামীর ঘরে ফিরাইয়া দিবার লাইগা উকালতি করেন; রামায়ণে সীতারে রামের ঘরে ফিরাইয়া দিবার লাইগা আমরা পিতৃস্থানীয় বাল্মিকীরেও দেখি ব্যর্থ উকালতি করতে। পুলমা কাহিনিতে ব্রহ্মা পুত্রবধূ পুলমার চোখের পানি দেইখাই একখান নদীর নামকরণ করেন বধূসরা; পুরাণ কাহিনিমতে যা তৈরি হইছে স্বয়ং পুলমার চোক্ষের জলে...
তো পুলমাপুত্র চ্যাবন কিংবা চ্যাবনবংশজাত কেউ সেই পুলমার চোখের জলে নদী হইবার কাহিনটারেই সীতা আখ্যানে রূপান্তর করে নাই তো? যেখানে আদি পুলমারে উদ্ধার করছিল তার পুত্র চ্যাবন আর এইখানে আমরা দেখি সীতার কাহিনি বয়ান করতে আছে তার পুত্র লব আর কুশ? পুলমা কাহিনিতে পুলমা স্বামীর কাছে আশ্রয় না পাইলেও প্রশ্রয় পায় পিতৃস্থানীয় ব্রহ্মার কাছে আর সীতা আশ্রয় পায় পিতা বাল্মিকীর কাছে...
আরেকটা কথা। রামায়ণের আদি পুস্তকখানের নাম পৌলস্ত্যবধ কাব্য। পুরাণমতে পুলস্ত মুনির বংশধর বইলা রাবণের নাম পৌলস্ত্য। আর দেখেন চ্যাবনের মায়েরে যে রাক্ষস অপহরণ করে তার নাম পুলমা; চ্যাবনের মায়ের নামও পুলমা। আমি এই বিষয়ে কোথাও কোনো সূত্র পাই নাই; কিন্তু কেন যেন মনে হয় পুলমা-পুলমা কাহিনির লগে পুলস্তের জাতিগত একটা সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। হইলে হইতে পারে নিজের মায়ের অপহরণের প্রতিশোধ নিতে গিয়া চ্যাবনের হাতে যে পুলমা বধ ঘটছিল; কবি হইবার পর সেই ঘটনারেই তিনি কাব্যরূপ দিছেন পৌলস্ত্য বধ নামে; আর সেইটারেই আইজ আমরা রামায়ণ নামে জানি...
২০১৬. ০৯. ০২ শুক্রবার
তথ্যসমর্থন:
কাহিনিসূত্র: প্রচলিত বাল্মিকী-প্রাদেশিক-আঞ্চলিক এবং উপজাতি রামায়ণ আখ্যান। কালীপ্রসন্ন মহাভারত। রাজশেখর বসুর সংক্ষিপ্ত মহাভারত ও রামায়ণ। প্রচলিত বেদ এবং পুরাণ সংগ্রহ;
যুক্তিসূত্র: রামায়ণের সমাজ- কেদারনাথ মজুমদার। ভারতবর্ষের ইতিহাস-রোমিলা থাপার। বাল্মিকীর রাম ও রামায়ণ-নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী। বাল্মিকী রামায়ণে রাম আদিবাসী রামায়ণে রাম- বিপ্লব মাজি। ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়- অতুল সুর। বাল্মিকী রাম: ফিরে দেখা- সুকুমারী ভট্টাচার্য
মহাভারতের কথা- বুদ্ধদেব বসু;
ভীল জাতির শেষকৃত্যের তথ্য: বিবিধার্থ সংগ্রহ ১৮৫১- মাসিক পত্রিকা। ভার্নাকুলর এডুকেশন সোসাইটি। কলকাতা
......
রামায়ণের শোলক সন্ধান ২: সীতার সতীত্ব পরীক্ষা
রামায়ণের শোলক সন্ধান ১: সীতা কার মেয়ে?
........
সহজিয়া রামায়ণ ৪
সহজিয়া রামায়ণ ৩
সহজিয়া রামায়ণ ২
সহজিয়া রামায়ণ ১
..............
মন্তব্য
অসাধারন অনুসন্ধানী প্রয়াস। মুগ্ধতা নিয়ে পড়লাম লীলেন ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অনেক ধন্যবাদ
তোমার এই লেখাটি অনবদ্য ছিল। লেখায় প্রমিত আর অপ্রমিতের (শব্দটা ঠিক হইলো তো!) মিশেলে দারুণ একটা স্টাইল নিয়ে এসেছ। প্রমিতের প্রতি তোমার ভালোবাসা কিন্তু লুকাতে পারো নি। এই সিরিজের অন্য লেখার চেয়ে অনেক সাবলীল এবং সিরিয়াস মনে হয়েছে আজকের প্রয়াস।
-----মোখলেস হোসেন
কী আর করব জ্ঞানী পাঠকদের সামনে লুজ লুথা কিছু লেইখা পার পাইবার উপায় নাই যে
০২
প্রমিতের প্রতি কিন্তু আমার বাড়তি কোনো ভালোবাসা নাই; আবার অপ্রমিতের প্রতিও বাড়তি আকর্ষণ নাই। আমার খালি মনে হয় যেই প্রমিতটা আমরা শিখে লিখি তাতে বহুত কিছু আরোপিত মনে হয়; সাবলীল না। আমি একটা স্মুথ ভাষার সন্ধান করছি নিজের জন্য; এর কোনোটাতেই আমার সেইরকম দখল না থাকায় হাতড়াই; কারণ আমার মতো সিলেটি বাঙালের কাছে রামেন্দু মজুমদার আর মুশাররফ করিম দুইজনের ভাষাই প্রায় বিদেশি
তুমি নিঃসন্দেহে দারুণ সাবলীল একটি প্রকাশভঙ্গী খুঁজে পেয়েছ (নির্মাণ করেছো বললে বোধহয় ভুল হবেনা)। আমি অনেকদিন বাংলা লেখা পড়িনি। একটা সময় রাইসু ভাইদের দেখতাম এধরনের চেষ্টা করতে। ভালো লাগতো না। এই যে কিছু কিছু জায়গায় তুমি 'অথচ' শব্দটি ব্যাবহার করেছো, অনেকেই হয়তো জোর করে 'মাগার' চালিয়ে দিতেন। এমন অনেক কিছুই বলা যায়, তবে আসল কথা হোল তোমার একটা নিজস্ব স্টাইল দাঁড়িয়েছে। এবং তুমি এই স্টাইলে দারুণ স্বচ্ছন্দ।
---মোখলেস হোসেন
সহমত
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আগ্রহ উদ্দীপক আলোচনা। পুরান সামাজিক ইতিহাসের খনি, অগাধ সৌন্দর্যের আধার । তবে এর মধ্য থেকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি খোঁজে বের করে আনার প্রয়াস আসলে আধুনিক পুরানের জন্ম দেয়।
বাল্মিকী কি ভিল জাতির মানুষ? আপনি প্রশ্ন রেখেছেন। এক জায়গায় নিশ্চিতি নিয়ে লিখেছেন, 'মানুষটা অনার্য বংশজাত মহাকবি বাল্মিকী।' তারপরে ব্যাক্ট্রিয়ার চ্যাবনের সম্ভাব্যতা আলাপ করে মুন্ডা, ভিলদের দাবি নিয়ে বলেছেন।
কিন্তু শেষমেশ ফিরে গেছেন ব্যাক্ট্রিয়ার ভৃগুর পোলা চ্যাবনের কাছে। এ আলোচনাগুলোর পরিণতি আমি ভিন্ন কিছু আশা করি না। তবে আপনার শিরোনাম যে তালাশ আপনি করবেন বলে ভাবায় আপনার তালাশ শেষমেশ ভিন্নতর হয়ে গেছে।
বাল্মিকী হিসেবে ব্যাক্ট্রিয়ার চ্যাবনরে বেশি ফিট মনে হচ্ছে আপনার আলোচনার নিরিখে। অন্তত নিশ্চিত হয়ে বলার সুযোগ নেই যে, 'মানুষটা অনার্য বংশজাত মহাকবি বাল্মিকী।'
রব
পয়েন্টটা এক্কেবারে সঠিক জায়গায় ধরেছেন। লেখার পর মনে হয়েছে দুয়েকটা লাইন মাঝখানে যোগ করা দরকার...
০২
বাল্মিকী তথাকথিত আর্য বামুন ছিলেন না তা মোটামুটি নিশ্চিত। তার মধ্যে অনার্য আচার আর অভ্যাস এবং ঐতিহ্য পুরাটাই আছে। তিনি ভিল হতে পারেন আবার অর্ধেক ভিলও হতে পারেন। হতে পারে তার জননী পুলমা মূলত ভিল নারী; যদি তিনি অশ্বঘোসের দাবি অনুযায়ী ভার্গব হয়ে থাকেন। আবার ভিল নারী পুলমার সন্তান হয়ে ভিল অপহরণকারী পুরুষ পুলমার সন্তান্ও হতে পারেন। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী সকল ক্ষেত্রজ সন্তান যেহেতু নারীর বিবাহিত স্বামীর সন্তান হিসাবে গণ্য হতো; সেহেতু তিনি ভৃগুর পুত্র হিসাবে পরিচিত হতে বাধা নেই; ভার্গব হতে বাধা নাই....
০৩
বাল্মিকী নামের জন্য মাটির ঢিবি জাতীয় ঘরে বসবাসকারী ব্যক্তি হিসাবেই সব সূত্র সমর্থন আমি পেয়েছি। ব্যাকট্রার কথাটার পাশে পরিষ্কার উল্লেখ করছি কিন্তু যে এটা আমার অনুমান; কোথাও সূত্র পাইনি; ব্যাকট্রায় এই বংশের মানুষ বাস করত। আপনার পয়েন্ট থেকে মনে হচ্ছে ব্যাকট্রা এখানে হয়ত তেমন কোনো সূত্র যোগ করে না; বরং আগের সূত্রগুলারে ঝাপসা করে দেয়...
চ্যাবনের শারিরীক যে বর্ণনা পাওয়া যায়; তার সাথেও কিন্তু ভিলদের দাবি সমর্থিত হয়। অথচ ভৃগুর অন্য দুই সন্তান ঋচিক আর শুক্রের শরীর বর্ণনা ভিন্ন...
০৪
ঋষিরা কিন্তু শুধু পিতার বংশে পরিচিত হতেন না। গুরুর নামে/স্কুলের নামেও পরিচিত হতেন। বশিষ্ঠ/বিশ্বামিত্র/বেদব্যাস/পরশুরাম নামে যাদের পাওয়া যায় তাদের বেশিরভাগই কিন্তু একই ঘরানার/স্কুলিংএর মানুষ। একই বংশের না
আসলেই তাই। এমনকি চ্যবন-জননীকে ভিল নারী ধরে নিলেও দূরত্বগতসহ কিছু সমস্যা থেকেই যায়।
মধ্যপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিমে হালের রাজস্থানে ভিলদের দেখা মিলে- এটা মনে রেখেও দূরত্ব এক্ষেত্রে একটা সমস্যা। কারণঃ
১। রাজরাজড়াদের বিয়েতে (গান্ধারীর বিয়ে বিষয়ে অতিপ্রচলিত ধারণাটি স্মর্তব্য) দূরত্ব ক্ষেত্রবিশেষে লঙ্ঘনযোগ্য হলেও আম বিয়ে তেমন ছিল না।
২। ভৃগু আর্য, চ্যবন-জননী এক্ষেত্রে অনার্য। এমন বিয়ে সে সময়ের বাস্তবতায় অস্বাভাবিক ঠেকে। এত দূরত্ব ডিঙ্গিয়ে এমন বিয়ে তাই ঠিক সম্ভবপর মনে হয় না।
তবে হ্যাঁ, চ্যবনের মা ভিল নারী হলে, ভৃগুদের বাড়িঘর আরেকটু এদিকে হলে বাল্মিকী হিসেবে চ্যবনই বেস্ট ক্যান্ডিডেট হবেন। তবে খটকার জায়গা একটা থেকেই যাবে- চ্যবন-জননীর বিয়ে। শান্তনুর সাথে সত্যবতীর বিয়ে মাথায় রেখেও আমি এমনটা ভাবছি।
আর চ্যবনের জন্মের বিষয়টা মাথায় রেখে বলতে হয়, চ্যবন অপহরণকারীকে বধ করার মতো বড় হওয়া পর্যন্ত তার জননীকে সে অপহরণকারীর ঘর করতে হয়েছে। বেশ লম্বা সময়ই, কি বলেন?
চ্যবনকে একজন বিবাহ সস্কারক ভাবা হয়। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কেমন?
রব
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাবনার অনেকগুলা পয়েন্ট যোগ করার লাইগা
আসলে একটা প্রাথমিক সিন্ধান্তজাতীয কিছুতে না গেলে লেখা আগানো কঠিন। তবে আমি কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে যাই নি। বিশেষত অত ঝাপসা বিষয়ে সিদ্ধান্তে যাবার হয়ত ক্ষমতাও আমার নেই। এখানে ড্রাফট প্রকাশ করার মূল উদ্দেশ্যই কিন্তু নিজের নোট আর হাইপোথিসিসগুলারে ঝালাই করে নেয়া। সাথে গ্যাপগুলা আবিষ্কার করা
০২
আগের যুগে বরং আর্য-আনার্য বিয়ে অতি স্বাভাবিকই ছিল। রাজা রামের বাপেরো কিন্তু বহু অনার্য স্ত্রী আছেন। আর ঋষি ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে কিন্তু বাধা ছিলই না। আমি খুব কম ঋষিরে সরাসরি কোনো বামুন কন্যা বিয়ে করতে দেখেছি। ঋষিরা বরং পুরাই স্বাধীন ছিলেন স্ত্রী গ্রহণ করতে। বিয়ের ক্ষেত্রে জাতপাক কাস্ট এগুলা আরো বহু পরের সংযোজন। চ্যাবনের ভাই শুক্র নিজের মেয়েকে (বামুন ঋষিকন্যা) ক্ষত্রিয়র সাথে বিয়ে দেন
০৩
আর্যবংশগুলার সবারই কিন্তু মায়ের দিক থেকে অনার্য রক্ত। তাদের বাবা বিদেশি মা স্থানীয়। এক্কেবারে অপ্সরারাো স্থানীয় নারী
০৪
পুলমার সাথে ভৃগুর আর কোনো সংসারের কথা আমি জানি না। হয়ত তার ফিরে আসা মানে শুধুই সন্তানের পিতৃপরিচয় নিশ্চিত করাটাই ছিল। মানে চ্যাবনের ভার্গব হিসাবে পরিচিতি...
০৫
চ্যাবনের বিবাহ সংস্কার নিয়ে আমার তেমন জানাশোনা নাই। তবে বহুব বয়সেও তিনি নিজে বিবাহ করছেন আর অশ্বনীকুমারদের মতো নিচু জাতের মানুষকে দেবতাদের কাতারে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সেইটা জানি। তবে চ্যাবনের মূল কারিশমাটা ছিল মেডিসিন। যেখানে তার ছোট ভাই শুক্র ছিলেন সার্জারিতে বিশেষজ্ঞ
০৬
ভূগোল আপাতত ছেড়ে যাই। বহুত ভজঘট আছে সেইটা নিয়া। পরে আলাদা একটা অধ্যায় করব
ভালো লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অস্ট্রেলয়েডদের মধ্যে সব আদিবাসীরা কথা বলে হয় কোন একটা মুন্ডারী ভাষায়, নয়তো কোন একটা দ্রাবিড় ভাষায়। কিন্তু ভিলেদের ভাষা ইন্দো-এরিয়ান ভাষা-পরিবার ভুক্ত, সেদিক থেকে এরা এক আশ্চর্য ব্যাতিক্রম। ভিলদের ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, সেটুকু গভীরভাবে অনুধাবন করলেই বোঝা যায় কিভাবে প্রাচীন কাল থেকে ধীরে ধীরে আধুনিক ভারতীয় জাতি সমূহ গড়ে উঠেছে। ভিল একটি দ্রাবিড় শব্দ, এর অর্থ ধনুক। কিছুদিন আগে পর্যন্তও প্রায় সকল ভিল পুরুষের হাতে সার্বক্ষণিকভাবে থাকতো তীর-ধনুক। আগে এরা হয়ত কোন এক মুন্ডারী ভাষাতেই কথা বলতো, কিন্তু সুদীর্ঘ কাল ধরে ইন্দো-এরিয়ান ভাষাভাষীদের সাথে একই ভুমিতে সৌহার্দ এবং সংঘাতময় সহ অবস্থানের ফলশ্রুতিতে তারা এখন ইন্দো-এরিয়ান ভাষায় কথা বলে, অনেকে তাদের নিজস্ব সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম পরিত্যাগ করে হিন্দু কিংবা মুসলিম ধর্ম গ্রহণও করেছে, কিন্তু তবুও তারা উপমহাদেশের বৃহত্তম আদিবাসী গোষ্ঠী।
আর যেহেতু বৈদিক যুগ থেকে পৌরাণিক যুগে এসে হিন্দু ধর্মে স্থানীয় চরিত্র এবং দর্শন ব্যাপকভাবে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে, সুতরাং ভিলেদের কোন চরিত্র, গাঁথা, বা দর্শন হিন্দু পুরাণের অংশ হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
মুন্ডা উপজাতিদের দুইটি দাবীর ব্যাপারে যা বলেছেন, সে বিষয়ে খানিকটা দ্বিধা আছে। মুন্ডাদের জ্ঞাতি ভাই সাঁওতালদের ধর্মীয় মাইথোলজি অনুযায়ী রামের লঙ্কা অভিযানের সময় তাঁরা রামকে সহায়তা করার জন্য রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মুন্ডারা যদি রাবনের বংশধর হয়ে থাকে, সাঁওতালদেরও হওয়ার কথা, তার বিরুদ্ধে কেন অস্ত্রধারণ করবে? রামকে সহায়তা করার সাথে হনুমানেরও কোন সম্পর্ক নাই, কারনটা পুরোপুরি গোষ্ঠীগত স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট। অনেককাল থেকেই দিকুদের(ইন্দো-এরিয়ান) সাথে ভূমি বিরোধ চলছিল, এই পদক্ষেপের কারনে রামের বিজয়লাভ ঘটলে দিকুদের সাথে সাঁওতালদের সুদীর্ঘকালের ভূমি বিরোধের অবসান ঘটে।
অতুল সুরের হিসাব অনুযায়ী মুণ্ডা সাওতাল কেউই ভারতের আদিবাসী না। মুণ্ডা সাওতাল গোত্রের সব দ্রাবিড় জাতীয় মানুষই ভারতে প্রথম অনুপ্রবেশকারী/বহিরাগত। এরা এসেছে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল থেকে। তার হিসাবে একমাত্র নিষাদ বা বৈদিক পনিরাই ভারতের মূল ভূমিপুত্র। দ্রাবিড়দের পরে ধীরে ধীরে অন্যরা এসছে ভারতে
০২
ভিলদের দাবি এবং তীর ধুনকের সংস্কৃতিরে সাথে তাদের ভার্গব হবার পক্ষে আরেকটা পৌরাণিক দাবির মিল পা্ওয়া যায়। পুরাণমতে ভৃগু (যিনি ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা) তিনিই তানি তীর ধনুকের আবিষ্কারক
০৩
সাওতালদের দাবি অনুযায়ী তারা রামের বাহিনিতে ছিল। আর মুণ্ডাদের দাবিমতে তাদের দুই গোত্রের এক গোত্র হনুমানের বংশধর আরেক গোত্র রাবণের
হিসাবটা কি অতুল সুরের? নাকি অন্য কারও, যেমন রাখালদাস বন্দোপধ্যায় বা অন্য কেউ? আমার কাছে ১৯৭৭ সনে প্রকাশিত অতুল সুরের "বাঙ্গালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়" নামে একটি বই আছে, যেখানে তিনি বলেছেন আদি অস্ত্রালরা(প্রোটো অস্ট্রেলয়েড) ভারতের আদিমতম অধিবাসী, তাঁরা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলতো।
আধুনিক নৃতত্ত্ববিদদের আর এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই যে প্রোটো অস্ট্রেলয়েডরা ভারতের আদি অধিবাসী। সংশয় শুধু এই বিষয়ে যে তাঁদের উদ্ভব এখানেই, নাকি ভারতের বাইরে কোথাও। যাই হোক, এই অস্ট্রেলয়েডদের মধ্যে এখনও কিছু মানুষ আদিবাসী হিসেবেই রয়ে গেছেন, যেমন- মুন্ডা, সাঁওতাল, ভূমিজ, হো, খাড়িয়া ইত্যাদি। তারা কথা বলে কোন একটি অস্ট্রিক ভাষায় মুন্ডারি গোত্রের কোন একটি ভাষায়। অস্ট্রেলয়েড আদিবাসীদের মধ্যে কেউ কেউ কোন একটি দ্রাবিড় ভাষাতেও কথা বলে, যেমন- গোন্ড, কুর্কু, বাইগা, ইত্যাদি। বলাইবাহুল্য যে অধিকাংশ দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষ আদিবাসী নয়, তারা কোন একটি দ্রাবিড় জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
বস্তুতপক্ষে দ্রাবিড় কোন নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্বা নয়, এটি একটি ভাষা ও সাংস্কিতিক গোষ্ঠী, যারা বিভিন্ন ভারতীয় জাতিসত্বার ধারক।
আমি যদ্দুর জানি বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই বিষয়েও এখন আর খুব বেশি সংশয় নেই। আমার জানামতে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব আধুনিক মানুষের (হোমো স্যাপিএন্স) উৎস হিসেবে তারা আফ্রিকাকেই গণ্য করেন। অন্তত বিজ্ঞানীদের মধ্যে (মলিকিউলার এন্থ্রপোলজিস্ট, প্যালিওএন্থ্রপোলজিস্ট, আর্কিওজেনেটিসিস্ট ইত্যাদিদের মধ্যে) বর্তমানে সর্বাধিক গৃহীত "আউট অফ আফ্রিকা" মডেলে সেটাই বলা হয়। উইকি থেকে কোট করছি -
তো এই ২য় ডিসপার্সালের মানুষরাই মনে হয় ভারতের প্রথম মানুষ বা হোমো স্যাপিএন্স। এরা কারা এবং কিভাবে গেল সেখানে? উইকিতে সেটা দেখছি এভাবে -
বা -
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের "দ্য জেনোগ্রাফিক প্রোজেক্ট"-এর পৃষ্ঠায় দেখছি -
স্পষ্টতই, ভারতে আসা এই মানুষগুলি আফ্রিকার কালো মানুষ ছিল এবং এরা "বৈদিক যুগের" মানুষের থেকে কমপক্ষে অর্ধলক্ষাধিক বছর আগে ভারতে এসেছিল। এরাই সম্ভবত মূল "প্রোটো-অস্ট্রোলয়েড" বা "অস্ট্রোএশিয়াটিক"। সুনীতিকুমারের মতে এই আদি-অস্ত্রালদের বংশধরদের একটি শাখাকেই প্রায় অর্ধলক্ষাধিক বছর পরে বহিরাগত আর্যরা "নিষাদ" বলে আখ্যায়িত করেছিল। তার মতে এই আদি-অস্ত্রালদের বংশধরদের অন্যান্য শাখার মধ্যে আছে - 'পুলিন্দ', 'ভিল্ল', 'কোল্ল' (আধুনিক 'ভীল' ও 'কোল'), 'মুণ্ডা', 'খেরওয়াল', 'খাসিয়া', 'নিকোবরী' প্রভৃতি। সে হিসেবে এরাও ভারতের আদি-অধিবাসীদের বংশধর। [সূত্র]
বাংলাপিডিয়ার মতে -
Your browser does not support iframes.
[সূত্রঃ http://www.bradshawfoundation.com/journey/]
দ্য জেনোগ্রাফিক প্রোজেক্টের হিউম্যান মাইগ্রেশন ম্যাপঃ এখানে।
****************************************
মাঝিভাই,
আউট অব আফ্রিকা তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতে যে সকল মানুষ প্রথম এসেছিল তাঁরা অস্ট্রেলয়েড নয়,তাঁদের বলা হয় নেগ্রিটো। নেগ্রিটো মানে হল আফ্রিকার বাইরের নিগ্রো। তাঁরা যে শুধু ভারতে প্রথম এসেছিল তাই নয়, এই ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তাঁরা বসবাস করতো। সেই হিসাবে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ(হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স) আসলে নেগ্রিটোরাই। পরে প্রথমে অস্ট্রেলয়েড, ক্রমান্বয়ে অন্যান্য আধুনিক মানুষেরা ভারত থেকে নেগ্রিটোদের নির্মূল করে দেয়। এখনও নির্ভেজাল নেগ্রিটোদের ছিটেফোঁটা রয়ে গেছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের(নিকোবার নয়) চারটি আদিবাসী গোত্রের মধ্যে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডেও রয়েছে কিছু মিশ্র রক্তের নেগ্রিটো। এ ছাড়া চীন সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রয়েছে কোন এক সময় তাঁদের অবস্থানের প্রমান।
পরে বহু সহস্র বছর ধরে ভারতে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে অস্ট্রেলয়েডরা। প্রথমে মনে করা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী এবং ভারতের মুন্ডারী ও দ্রাবিড় ভাষাভাষী আদিবাসী, শ্রীলঙ্কার ভেদ্দা আদিবাসীরা বোধ হয় একই রেসের মানুষ, সে কারনেই ভারতের এই আদিবাসীদের নামকরন করা হয়েছিল অস্ট্রেলয়েড, পরে অবশ্য সেটা ভুল প্রমানিত হয়েছে। এই অস্ট্রেলয়েডদের সাথেই বিভিন্ন ধরনের মঙ্গলয়েড ও বিভিন্ন ধরনের ইউরোপয়েড মানুষের ক্রমাগত মিশ্রণের ফলই হল আধুনিক ভারতবর্ষের জনগোষ্ঠী(এবং আমরা বাঙ্গালীরাও)। যাই হোক, প্রশ্ন হল ভারতের এই অস্ট্রেলয়েডদের উদ্ভব কি ভারতেই? নাকি অন্য কোথাও? এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে ভিন্নতম আছে, কারও মতে তাঁরা ভারতেই বিবর্তিত হয়েছে, কারও মতে চীন বা অন্য কোথাও।
আব্দুল্লাহ ভাই,
হতেই পারে। এই বিষয়ে মোল্লার মতো আমার দৌড়ও গুগল, উইকি থেথে ঘাঁটা দু-চার পাতার বেশি না। আপনার এই কমেন্ট আর সেই সূত্রে পরে আরও দুই-চার পাতা পড়ে মনে হচ্ছে ( এখানে একটু পেঁচকি খেয়ে গেছি বোধহয়) এই অস্ত্রালরাও হয়তো আসলে একক কোনো গোষ্ঠী না, বরং কিছু বাহ্যিক আপাত-সাদৃশ্য দেখে কোন কোন পণ্ডিত হয়তো ভুল করে একাধিক এথনিসিটির মানুষকে একসাথে lump করে দিয়েছেন। অন্তত এমন একটা অভিযোগ কোথায় যেন দেখলাম। যাইহোক, আসল প্রশ্ন আমার কাছে মনে হচ্ছে আসলে আপনি যেমন বলেছেন -
এই প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। কারন, এর উত্তর যদি হ্যাঁ-বাচক হয়, তাহলে বোধহয় আধুনিক নৃতত্ত্বের "আউট অফ আফ্রিকা" ও 'আফ্রিকায় হোমো স্যাপিএন্সের উদ্ভব' - সহ কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যপকভাবে গৃহীত তত্বই বাতিলের খাতায় চলে যাবে। ভারতে যদি অস্ত্রালদের তথা হোমো স্যাপিএন্সের উদ্ভব হয়, তাহলে তার মানে কি এই দাঁড়ায় না যে আফ্রিকায় এদের আদি ও একক উদ্ভবত্বের তত্ত্বটা ভুল এবং সেই যুক্তির ধারাবাহিকতায় "আউট অফ আফ্রিকা" আফ্রিকা তত্ত্বটাও ভুল? আমি শুনেছিলাম কিছু চীনা পণ্ডিত হোমো স্যাপিয়েন্সের আফ্রিকায় মূল বা একক-উদ্ভব তত্ত্ব বা আউট অফ আফ্রিকা তত্ত্ব মানতে চান না বরং একধরণের প্যারালেল বা একাধিক-কেন্দ্রিক বিবর্তন তত্ত্বে উৎসাহী এবং মনে করেন চীনেও হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভব হয়েছে। আর পশ্চিম বাংলা থেকে বেরুনো একটা বইয়ে পড়েছিলাম ভারতেও একদল বিশেষজ্ঞ ভারতের আদি মানুষ বাইরে থেকে এসেছে এটা মানতে চান না বা উল্টোটা প্রতিপাদন করতে চান। ঐ বইটার মতে এরা মূলত বিজেপি / আরএসএস ঘরাণার বা দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী ঘরাণার বিশেষজ্ঞ, যারা ভারতের আদি মানুষও বহিরাগত - এইরকম তত্ত্বকথা তাঁদের অতি দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভের জন্য ক্ষতিকর ও হুমকিস্বরূপ বিবেচণা করে এর বিরোধিতা করে ভারতেই মানুষের উদ্ভব-তত্ত্ব দেন। ঐ বইয়ে এই ঘরাণার কিছু কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদের বিরুদ্ধে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এমনকি প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-প্রমাণ জালিয়াতিরও অভিযোগ আনা হয়েছে!
যাহোক, ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা ছিল এইসব চীন-ভারত ভিত্তিক তত্ত্বগুলি মূলত বিজ্ঞানের বেশে বিজ্ঞান-বহির্ভূত এজেন্ডাচালিত ফ্রিঞ্জ তত্ত্ব যার খুব একটা গুরুত্ব নেই। আমি সামান্যই জানি, তাই আপনার কমেন্ট পড়ে এখন মনে হচ্ছে - তা হয়তো না।
ভারতে প্রথম প্রবেশকারীরা
****************************************
অস্ট্রেলয়েডদের উদ্ভব ভারতে নাকি ভারতের বাইরে, তার সাথে "হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স" প্রজাতির উদ্ভব এবং তাদের একাংশের আউট অব আফ্রিকা কার্যক্রমের সত্যাসত্য নির্ভর করে না। অস্ট্রেলয়েডদের উদ্ভবের স্থান নিয়ে যে মতবিরোধের কথা বলেছি, সেই মতভেদ বিজ্ঞানীদের, বিজেপি পণ্ডিতদের আপাততঃ এই আলোচনায় আনতে পারছি না, দুঃখিত । আউট অব আফ্রিকা মতবাদ নিয়ে কোনই সন্দেহ নাই, কারন এটা জেনেটিক বিজ্ঞান কর্তৃক প্রায় সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত। আর নেগ্রিটোরা ছাড়া অস্ট্রেলয়েডরা যে ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন জনগোষ্ঠী, এটাও জেনেটিক ভাবে প্রমানিত। জেনেটিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় এই প্রমানও পাওয়া গেছে যে অস্ট্রেলয়েডদের উদ্ভব ৪০-৪৫ হাজার বছর আগে, তবে সেটা অবশ্যই বিবর্তনের মাধ্যমে নেগ্রিটো জনগোষ্ঠী থেকে(জেনেটিক্যালি প্রমানিত)। হতে পারে নেগ্রিটো থেকে অস্ট্রেলয়েডে উত্তোরনের এই বিবর্তনটা ভারতের মাটিতেই সংঘটিত হয়েছে, কিংবা ভারতের বাইরে, তাতে কিই বা আসে যায়? ভারতে মুন্ডারী ভাষাভাষী সকল মানুষ(আদিবাসী) এবং দ্রাবিড় ভাষাভাষী সকল আদিবাসী নিরঙ্কুশভাবে অস্ট্রেলয়েড জিন বহন করছে। আর এখনকার ভারতীয় বিভিন্ন জাতির মানুষও (বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, তামিল, মারাঠি ইত্যাদি)কম কিংবা বেশী মাত্রায় এখনকার পরিচিত আদিবাসীদের মাধ্যমে সেই অস্ট্রেলয়েডদের জিন(এবং পরে আগত অন্যান্য রেস যেমন বিভিন্ন রকমের ইউরোপীয় বা বিভিন্ন ধরনের মঙ্গোলীয় রেসের জিন) বহন করে চলেছে। এ সবই আধুনিক জেনেটিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমানিত।
ওক্কে, এবার বুঝতে পারছি। আমি আসলে, কেন জানি না, অস্ত্রালদের উদ্ভব ভারতেই কিনা - আপনার এই প্রশ্নের অর্থ করেছিলাম মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্সেরই উদ্ভব ভারতে কিনা - আপনি এই কথা বলতে চাইছেন। এই সামান্য ভুল বোঝার কারনেই এত-এত কথার অবতারণা করেছিলাম (এবং আপনাকেও আরও টাইপ করার কষ্ট দিলাম)! স্যরি
****************************************
আমার রেফারেন্সটা তার ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বইয়ের। আমি গুলিয়ে ফেলছি নাকি? আমার পয়েন্টটা ছিল অতুল সুরের মতো দ্রাবিড়রা আদিবাসী নন; মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল থেকে আগত মানুষ
০২
গোন্ডরা্ও কিন্তু দাবি করে তারা রাবণের বংশধর। এবং সীতা তাদের জাতের মেয়ে। অভাবের সময় তারা মেয়েদের মাঠে ফেলে দিয়ে আসত। এরকম এক খরার সময় ফেলে দেয়া সীতারে খুজে পান জনক
১- জী ভাই, এখন ঠিক আছে। অনেকেরই মত হল দ্রাবিড়ভাষী ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে বহু বছরের পরিক্রমায় এক সময় ভারতে এসে থিতু হয়। পরে তাঁরা ভারতে দ্রাবিড় সভ্যতার বিস্তার ঘটায়। অবশ্য অনেক ভারতীয় স্কলার(বিশেষত দ্রাবিড় ভাষাভাষী) এরকমটা মানেন না। তাঁদের মতে দ্রাবিড় সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ ভারতেরই বুকে।
২- গোন্ডদের দাবী ফেলে দেওয়ার মত নয় অবশ্যই।
চমৎকার লেখা।
পৌলস্ত্য বধ বইটা কোন ভাষায়? কোথায় পাওয়া যাবে?
ধন্যবাদ
পৌলস্ত্য বধের আদি অস্তিত্ব বোধহয় এখন আর কোথাও নাই
এত কিছু জানতাম না। আপনে খাটতেও পারেন সেইরকম!
নতুন মন্তব্য করুন