আইনি ধর্মের উল্টাযাত্রা

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: মঙ্গল, ১০/০৯/২০১৯ - ১০:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলা পৌরাণিক সাহিত্যের একটা বড়ো সম্ভার কারবালার পুঁথি। এইগুলা পইড়া মাইনসে কান্দে; নিজেই নিজেরে ব্যথা দিয়া রক্তাক্ত করে; বুক চাপড়ায়…

কারবালা পুরাণের কেন্দ্রবিন্দু ইমাম হোসেনের মৃত্যু। হোসেন নবী মোহাম্মদের নাতি হইবার কারণে কারবালার ঘটনায় মুসলমানেরা সকলে হোসেনপক্ষ। আর পুঁথিগুলা মুসলমানদের সাহিত্য বইলাই গণ্য- হায় হোসেন হায় হোসেনা কান্দে মাতা ফাতেমায়…

এখন আমি যদি ইসলাম ধর্মের পুস্তকি মানদণ্ড দিয়া এইটা বিচার করতে যাই; তবে পুরা কারবালা সাহিত্যটাই কুফরি কালাম বইলা বিবেচিত হবে। কারণ ফাতেমা মারা গেছেন হোসেন মরার ৪৮ বছর আগে…

ইসলামি পুস্তকমতে মইরা যাবার পর দুনিয়াতে যা ঘটে তা নিয়া মরা মানুষের আর কোনো দায়দেনা নাই। সুতরাং মরা মানুষরে দিয়া বিলাপ করানো ইসলামের খেলাফ; পাক্কা ধর্ম অবমাননা…

তাইলে মুসলমানি সাহিত্য বইলা গণ্য কারবালার পুঁথিতে ফাতেমার অত কান্দন কেমনে পাই?
পাই ঘটনা দানা পাকাইয়া তুলতে কবিগো উপযুক্ত প্রেক্ষিত তৈরির শৈল্পিক মুন্সিয়ানা থাইকা; পাই কবিগো কবিত্ব শক্তি থাইকা…

কারবালা পুঁথির কবিরা সিদ্ধান্ত নিছেন হোসেন মরার বয়ান দিয়া মানুষরে কান্দাইবেন। কিন্তু তিনারা যদি ইতিহাসবান্ধা মানুষের মতো কইতেন- নির্বাচিত খলিফা এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়া মারা গেছে হোসেন; তয় মানুষ কানতো?

কানতো না। তাই কবিরা বাইছা নিছেন হোসেনের মায়ের কান্দন। কারণ পোলার মৃত্যুতে মায়ের কান্নার চাইতে বুকফাঁটা আর কিছু নাই। তাই ফাতেমারে কাব্যে পুনর্জীবন দিয়া কবিরা কান্দাইছেন; শত বর্ষ ধইরা মানুষের মাঝে ছড়াইয়া দিছেন মরুভূমিময় হাহাকার- হায় হোসেন হায় হোসেন; কান্দে মাতা ফাতেমায়…

কারবালার পুঁথি খালি ফাতিমার কান্দন দিয়া শেষ হয় না। এজিদ আর সীমাররে ভাঙচুর কইরা দিবার লাইগা একটা গোস্বাও আছে সেইখানে। এই ক্ষেত্রে পিতা আলী ছাড়া সেরা গোস্বা আর কার হইতে পারে?

“আলী বলে হারামজাদা এ্যাছা জানোয়ার/ আমারা বেটার পরে চালায় তলোয়ার/ লহু নদী বহাইব দুনিয়ার উপরে/ এলাহি এতেক দুঃখ দিয়াছেন আমারে”
এইটা পোলার দুঃখে হোসেন মরার ১৯ বছর আগে মইরা যাওয়া শের আলীর গোস্বার প্রকাশ…

খালি কি এইটা? ইসলাম মতে দেব দেবীর অস্তিত্ব স্বীকার করা ধর্মের লঙ্ঘন বইলা বিবেচিত হইলেও পুঁথিগুলায় আমরা শের আলীর লহু নদী বহাইবার ক্ষমতা বর্ণনা দিতে গিয়া দেখি কবিরা মুসলমান আলীর লগে হিন্দুর ধ্বংসাত্বক দেবী কালী কিংবা মাহদেব শিবেরও যুদ্ধ বাঁধাইয়া দিছেন…

এমনকি বহু আগে মইরা যাওয়া নবী মোহাম্মদরেও আইসা আমরা সন্তানহারা ফাতেমা আর আলীরে সান্ত্বনা দিতে দেখি পুঁথিগুলার ভিতর…

তো আমি যদি আইজ মোহাম্মদের মুখে সংলাপ দিয়া নিজের মতো একখান উপন্যাস লিখতে যাই তাইলে কী গতি হইবে আমার?

গতি অবধারিত। চাপাতির কোপ থাইকা কল্লা বাঁচাইতে পারলেও পুরানা আইসিটি আইনের নতুন ভার্সন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ নম্বর ধারায় ধর্ম অবমাননার দায়ে দশ বচ্ছর চৌদ্দ শিকের ভাত…

এমন না যে লেখক-শিল্পীরা আগে বাধা পান নাই। চর্যাপদের বাঙাল কবি ভুসুকুপাদরে নির্বাসিত হইবার ঘটনা আমরা জানি। লালন থাইকা শাহ আব্দুল করিমের উপর ধর্মীয় খড়গের সংবাদ আমরা রাখি। কিন্তু সেইগুলা আছিল ছোট ছোট গোষ্ঠীর বিধান; যারা বিধান দিত তারা কেউ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী আছিল না দেইখা সেইসব নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করতে পারত মানুষ…

কিন্তু আমরা এখন বাস করি জাতিরাষ্ট্রে। তার উপরে প্রযুক্তির যুগে; কিছু কইলে যেমন তা মুহূর্তে সারা বিশ্ব ছাড়াইয়া যায়; তেমনি আজকের আন্তর্জাতিকতার যুগে মানুষের পালানোর মূলত কোনো জায়গা নাই…

সব চেয়ে বড়ো কথা দুনিয়াতে এখনো টিকা থাকা ধর্মের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। একজনে যেইটারে কয় ধর্ম অন্যজনে সেইটারেই কয় অধর্ম। তো সেই হিসাবে একজনের ধর্মের কথা আরেকজনের কাছে গণ্য হইতে পারে অন্য কোনো ধর্মের অবমাননা হিসাবে…

এর বাইরে আছে ধর্ম কিংবা ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন মানুষ। আছে ইতিহাস চর্চার মানুষ। আছে বিজ্ঞানচর্চার মানুষ; যাদের কথাবার্তা মোটাদাগে সব ধর্মেরই বিপক্ষে যায়; আর বিপক্ষে যাওয়া মানেই কি অবমাননা আর শাস্তি?

সামাজিক উদারতার উদাহরণ আমি বৈদেশে খুঁজি না; আমাগো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মইদ্যেই যা আছে তা রক্ষিত হইলে আমরা বরং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় অন্যগো উদাহরণ হইতে পারতাম…

কিন্তু কারবালার পুঁথিকাররা যেইরকম সিন্ধান্ত নিছিলেন মানুষরে কান্দানোর; তেমনি আমাগো সরকার সিদ্ধান্ত নিছেন গলা চাইপ্পা ধইরা মানুষের কথা বন্ধ কইরা দিবার…


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

অনেকদিন পর আপনার নাম দেখে ভাবলাম একটা বড় সড় লেখা পাওয়া গেলো। লিখছেন এই বা কম কি এই ভেবে মনকে সান্তনা দিলাম।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

লেখার ডিব্বা মনে হয় খালি হয়ে গেছে। কিচ্চু বাইরায় না

হাসিব এর ছবি

কারবালা পুরাণের কেন্দ্রবিন্দু ইমাম হোসেনের মৃত্যু। হোসেন নবী মোহাম্মদের নাতি হইবার কারণে কারবালার ঘটনায় মুসলমানেরা সকলে হোসেনপক্ষ। আর পুঁথিগুলা মুসলমানদের সাহিত্য বইলাই গণ্য- হায় হোসেন হায় হোসেনা কান্দে মাতা ফাতেমায়…

সকলে না। শিয়া ফার্সি টেক্সটের প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে কারবালা নিয়ে এতো লেখা, গান তৈরী হয়েছে একসময়। এখন শিয়া ধারা ক্ষীণকায় হওয়ায় এবং সে সাথে সালাফি মত শক্তিশালী হওয়ায় আসতে আসতে এসব বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। তাও ঠিক। কারবালার পুথিগুলা সত্যি সত্যি অসাধারণ ক্রিয়েটিভ কাজ। কবিগো যখন যারে ইচ্ছা নিয়া আইসা মারামারি করাইছেন কিংবা কান্দাইছেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।