আমি রাবণের বাড়ি গেছিলাম রামের বার্তা নিয়া। সে কথা শোনে নাই; মরছে। তার আগে আমি বালির বিষয়ে সুগ্রীবের দূতিয়ালি করছি রামের কাছে; বালিও মরছে। এইবার রামের দূত হইয়া আমি আপনেরে এই কথা বলতে আসছি যে; রাম তার পিতৃসিংহাসনে রাজা হইতে চান; যদিও এইখানে মারামারির কোনো কথা নাই; কারণ ভাইয়ে-ভাইয়ে রক্তারক্তি বড়োই ঘিন্না করেন রাম…
জোড়বান্ধা হাত দুইটা কোলে লুকায়া বিনয়ে বিগলিত হনুমান এক শ্বাসে কথাগুলা ভরতের মুখের উপর ঝাইড়া দিয়া ঘাড় ফিরায় অযোধ্যার মন্ত্রী ও পুরোহিত মণ্ডলির দিকে। মণ্ডলির ভ্যাবাচেকা মুখগুলার উপর এক চক্কর দিয়া আইসা তার চোখ থামে অযোধ্যার প্রধান পুরোহিত বশিষ্ঠের মুখে…
মাথা নুয়াইয়া হনুমান দুই হাত কপালে ঠেকায়- রামচন্দ্র আপনের চরণে প্রণাম দিছেন ঋষি। তিনি কন আমি পিতৃহারা হইতে পারি কিন্তু অভিভাবক হারায় নাই অযোধ্যা। দশরথের অবর্তমানে অযোধ্যারে আগলাইয়া রাখছেন পিতৃবন্ধু বশিষ্ঠ। বিদ্যাবুদ্ধি গুণ আর বিশ্বস্ততায় তিনার কোনো তুলনা নাই। আর সবচে বড়ো কথা; রামেরে অত্যন্ত পছন্দ করলেও বিশ্বামিত্র-ভরদ্বাজ-বাল্মিকী-পরশুরাম কিংবা গৌতমের মতো ঋষিরাও এখনো আস্থা হারান নাই অযোধ্যা-কূলগুরু বশিষ্ঠের বিচক্ষণতায়…
হনুমান আবার ফিরে ভরতের দিকে- আমি নিশ্চিত স্বজনক্ষয়ের মতো জঘন্য কিছুর পরামর্শ বশিষ্ঠের মতো মুরব্বিও দিবেন না রাজারে…
ভরত কথা কয় না। মণ্ডলির সকলে এর তার মুখে তাকায়া নিজেদের চোখ আইনা স্থির করে বশিষ্ঠের উপর। বশিষ্ঠ গলা খাকারি দেন- রাজারে রাজাদের পতন কাহিনী শোনায়া যে দূত প্রতিপক্ষীয় মহাবলী ঋষিদের কথা ব্রাহ্মণদের শোনায়; প্রস্তাবনার বিস্তারিতে যাবার আগে আমরা সেই দূতের সম্পর্কে আরো কিঞ্চিত অবগত হইতে চাই। দয়া কইরা আপনের বিস্তারিত পরিচয় সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেন…
আরো কাচুমাচু হইয়া হাসিতে লজ্জা ছিটায় হনুমান- এত এত গুণী মানুষের সামনে নিজের কথা বলা তো শরমের কাম। কিষ্কিন্ধা নিবাসী পবনের পুত্র আমি হনুমান; জাতিতে মুণ্ডারি; বনে-জঙ্গলে বাস করি বইলা আপনারা অনেকেই আমাগো জাতিগুলারে বন-নর বা বানর বইলাও ডাকেন…
হনুমান কথা সংক্ষিপ্ত করতে চায় দেইখা সময় বাড়াইতে চান বশিষ্ঠ- আপনার বিনয়ের তুলনা নাই। নাম-পরিচয় তো আগেই দিছেন; গোত্রপরিচয় আপনের পোশাকেই দৃশ্যমান। তো এইবার যদি আপনের কাজকর্ম সম্পর্কে আমাদের কিছু আলোকিত করেন তবে কৃতজ্ঞ হই…
হনুমান আবারো বিনীত হয়- আমার আবার বিশেষ কী কর্মপরিচয় জনাব? বিশেষ তো কিছু বলার মতো নাই। এই ধরেন গিয়া আছিলাম সুগ্রীবের দোস্ত; সে রাজা হইবার পরে এখন তারে রাজ্যচালনার কিছু মন্ত্রণা দেই; দরকারে কিষ্কিন্ধ্যার সেনাবাহিনীটাও চালাইতে হয়…
হনুমান ফিরে ভরতের দিকে- সেই সূত্রে ধরেন গিয়া রাবণমারা যুদ্ধে লঙ্কায় যৌথ বাহিনী সমন্বয়ের কামটাও করতে হইছে আমারে। …তো আবার সেই সূত্রে ধরেন গিয়া লঙ্কার নতুন রাজা বিভীষণও কঠিন সিদ্ধান্তের আগে মায়া কইরা আমারে জিগান; নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তিনারেও কিছু পরামর্শ দিয়া তার মায়ার প্রতিদান দেওয়া লাগে…
হনুমান এইবার মুখ ঘোরায় তাব্দা খাওয়া অযোধ্যা মণ্ডলির দিকে- এছাড়া ধরেন গিয়া আমি লঙ্কায় রামের দূতিয়ালি করছি; এখন অযোধ্যায়ও করতেছি একই কাম। মানে কথা হইল রাজা হইবার পরে যদি রামের মনে হয় আমি কোনো কামের মানুষ; তবে ধরেন গিয়া অযোধ্যার আসন্ন রাজারেও তো আর পরামর্শ বঞ্চিত করা যাবে না। ঠিক কি না?
হনুমানের কথায় মজা পান পুরোহিত জাবালি। মুচকি হাইসা তিনি মণ্ডলির কাছে হনুমানের কথা সারসংক্ষেপের দায়িত্ব নেন- বুঝা গেলো তো? ইনি এক রাজার মন্ত্রী; আরেক রাজার উপদেষ্টা; সম্ভাব্য আরেক রাজার পরামর্শক; তার উপরে সেনানায়ক। এর আগে দুইখান দূতিয়ালি করছেন তিনি; দুইটাতেই গদিনশীন রাজার মৃত্যু দিয়া পরিবর্তিত হইছে রাজ্যপট। এইবার তিনি রাজ্যপটের শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন প্রস্তাব নিয়া আসছেন অযোধ্যায়; যদিও তিনার প্রস্তাবনায় ভাইয়ে-ভাইয়ে রক্তারক্তি বর্জনীয় তবুও তিনার আগের দুই দূতিয়ালির ফলে এক ভাইয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়াই আরেক ভাই হইছেন রাজা। বোঝা গেলো? তো রক্তারক্তি এড়াইবার দায় কিন্তু ইনি আমাগো উপর ছাইড়া দিছেন। ঠিক কি না পবনপুত্র হনুমান?
মণ্ডলির কেউ কথা কয় না। মুনি জাবালি আবার মুখ খোলেন- বয়সে তরুণ হইলেও বহুত বিরল চরিত্র আপনের। বিশেষ কইরা কেউ যে অত বিনয়ের ভিতর দিয়া অন্যরে ডর দেখাইতে পারে তা আপনেরে না দেখলে বিশ্বাস হইত না আমার…
নন্দীগ্রামে আইস হনুমান পয়লা রামের লঙ্কা বিজয়ের সংবাদ জানায়। কুশল জানায় রাম লক্ষ্মণ সীতার। সেইটাতে সকলে আগ্রহী হইয়া উঠলে হনুমান জানায় অযোধ্যার রাজা ও মণ্ডলির লাইগা রামের কিছু বার্তা নিয়া আসছে সে। সেই সূত্রেই আয়োজন হয় এই সমাবেশের আর সেইখানেই কাউরে আগাম কিছু বুঝতে না দিয়া রামের সিংহাসন দাবির প্রস্তাবনা উত্থাপন কইরা বসে হনুমান। ফলে রাজা ভরতে যেমন না পাইছে কারো লগে এই বিষয়ে আলাপের সুযোগ; তেমনি প্রধান পুরোহিতও ভাবতে পারেন নাই সঠিক মন্ত্রণার কোনো দিক নির্দেশনা…
মুখরা জাবালি হনুমানরে ব্যস্ত রাখতেছেন দেইখা বশিষ্ঠ কানাকানির সুযোগ নেন ভরতের লগে। হনুমান তাগোরে সেই সুযোগ দিয়া খাজুরে সুরে আলাপ বাড়ায় জাবালির লগে- যদি অনুমানে ভুল না হইয়া থাকে তবে আমি নিশ্চিত আপনে নাস্তিক মুনি জাবালি। অধমের প্রণাম আপনের চরণে। বর্শার ফলার চাইতেও তীক্ষ্মধার কথায় আপনের দক্ষতার কথা আমি বিস্তর শুনছি রাম-লক্ষ্মণের মুখে…
জাবালি হাসেন- আমার কথায় ধারটার কিছু নাই। কথা হইল আমার কথা লোকজনের সহ্য হয় না তেমন। আপনের রামচন্দ্রেরও না। ওই যে বললেন; বড়ো বড়ো ঋষিরা রামেরে পছন্দ করেন; তাতে কিন্তু আমার বিশেষ কিছু আসে যায় না। কারণ আমি জানি আমার চিন্তাদর্শনের কারণে আগে থাইকাই আমারে পছন্দ করেন না তিনারা। তিনারা কারবার করেন মানুষের জন্মের আগের আর মরার পরের জগত নিয়া; আমার কারবার শুধু জেন্দা মানুষ নিয়া। সেই দিক দিয়া আমার কর্মক্ষেত্র তিনাদের থাইকা সংক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র; খালি এক মানুষের একটা জীবনই আমার কর্মক্ষেত্র। এইসবসহ আরো বিবিধ কারণে আপনের রামচন্দ্রও আমারে পছন্দ করেন না সেইটা নিশ্চয় আপনেও জানেন…
হনুমান কথা কাটে- রাম তার প্রয়াত পিতার বিবেচনায় সর্বোচ্চ আস্থা রাখেন। আপনে রাজা দশরথ নিয়োজিত পুরোহিত। আপনে নাস্তিক্যবাদের সমর্থক হইলেও আপনের বিচক্ষণতার লাইগাই রাজা দশরথ আপনেরে অন্তর্ভুক্ত করছিলেন উপদেষ্টা মণ্ডলির ভিতর। সেই সূত্রে আপনে রামের কাছেও শ্রদ্ধেয় এবং প্রণম্য…
জাবালি হাসেন- আহা মনে হইতেছে রাজা দশরথে যখন আমারে নিয়োগ দেন তখনো আপনে সেইখানে ছিলেন। তা যাউকগা; পরানটা ঠাণ্ডা কইরা দিলেন কথায়। তবে…
- ভাইজান এখন কোথায়?
ভরতের প্রশ্নে জাবালি থামেন। হনুমান মুখ ঘোরায়। একটা দম নিয়া জাবালির লগে চালানো হালকা কথার রাশ টাইনা আবার বিনীত হয়- কোথায় আবার? আসার পথে…
সকলের চোখে প্রশ্ন। হনুমান ফিরে মণ্ডলির দিকে- তিনারে কোথাও ধইরা রাখা যায় নাই। বিভীষণে কইল কিছুদিন থাইকা স্বর্ণলঙ্কা দেখো; তিনি কন না দেশে যামু। সুগ্রীবে কইল কিছুদিন আমার অতিথি হইয়া খাইদাই করো; বেড়াও। তিনি কন বাড়ির লাইগা মনটা কান্দে; আমারে থাকতে বলিস না ভাই…
হনুমান আবার ফিরে ভরতের দিকে- তো আসার পথে একটু জিরানোর লাইগা তিনি খাড়াইছেন ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে। আপনে তো জানেনই যে ভরদ্বাজ রামেরে খুবই মায়া করেন। আপনে যখন সেনাবাহিনী নিয়া চিত্রকূটে রামের লগে দেখা করতে গেছিলেন তখন ভরদ্বাজ মদ খাওয়াইয়া আপনের সেনাসৈনিকরে টাল বানায়া দিছিলেন যাতে কোনো মাইরদাঙ্গা না করতে পারেন রামের লগে। অবশ্য সেইটা ঋষির বোঝার ভুল আছিল। কারণ আপনে তো আর বড়ো ভাইর লগে মারামারির কথা স্বপ্নেও ভাবেন না। ঠিক কি না?
হনুমান তাকায় বশিষ্ঠের চোখে- আর রামে যে লঙ্কার যুদ্ধটা জিতছেন; সেইগুলার অস্ত্রপাতি কিন্তু ঋষি ভরদ্বাজের দেওয়া। এক্কেবারে বিনা পয়সায়। তো আসার পথে রাম কইলেন; লগে তো অনেক মানুষ। তাগো কিছু জিরানো দরকার। আবার ঋষির দয়ার লাইগা ধন্যবাদ দিয়া রাজা হইবার আগে তিনার আশীর্বাদ নেওয়টাও জরুরি…
বশিষ্ঠ চোখাচোখি করেন ভরতের লগে। তিনারে সুযোগ দিয়া হনুমান ফিরে মণ্ডলির দিকে- তো সেই চিন্তায় সকলে জিরাইতে বসল ভরদ্বাজের গ্রামে আর রামচন্দ্র আমারে কইলেন যাওতো গিয়া ছোট ভাই ভরতরে সংবাদটা দেও; আর তার মতামতটাও বুইঝা আসো। যত যাই হউক সিংহাসনে সেই তো হইল গিয়া বর্তমান গদিনশীন…
জাবালি জিগান- মতামত মানে কীসের মতামত? তিনার আসার বিষয়ে না সিংহাসনের বিষয়ে?
হনুমান জাবালির কথার উত্তর দিবার আগে শোনা যায় ভরতের গলা- আপনে কইলেন ভাইজানের লগে অনেক মানুষ। অত মানুষ কারা?
হনুমান কয়- না বিশেষ কেউ না জনাব; অযোধ্যা থাইকা যে তিনজন নির্বাসনে গেছিল তারাই। …তার লগে ধরেন গিয়া লঙ্কা আর কিষ্কিন্ধার নতুন রাজারা আছেন পরিবার পরিষদ নিয়া। …আর মনে করেন লঙ্কা যুদ্ধের বিজয়ী বাহিনীটাও আসতেছে পিছে পিছে। …না না যুদ্ধমুদ্ধ কিছু না। নতুন রাজার অভিষেক দেখতে শখ কইরা আসতেছে তারা। …আর ধরেন গিয়া অযোধ্যার ভবিষ্যৎ রানি সীতাও মায়া কইরা তাগোরে নিমন্ত্রণ দিছেন। তারা আসবে; অভিষেক দেখবে; কয়দিন খাবেদাবে ঘুরবে আর তারপর যাবে গা নিজ নিজ দেশে…
- হ। খাবেদাবে ঘুরবে। যুদ্ধ হইলে খাবে লুইটা আর শান্তি হইলে খাবে পাইতা। ঘটনা যাই হউক খাওনের খর্চাটা কিন্তু যাবে অযোধ্যার কোষাগার থাইকা; সেইটা নিশ্চিত…
জাবালির কথায় পাত্তা দেয় না কেউ। সবাইরে শোনায়া ভরত বশিষ্ঠের দিকে চোখাচোখি করে- মনে তো হইতেছে বহুত লোক…
হনুমান কয়- তা কইতে পারেন। চরে গিয়া মাত্র দশ দিনে রাবণরে হুতায়া ফেলতে লোকজন তো লাগছেই। তারা সকলেই আসতেছে। তবে মানুষ কিন্তু আরো কিছু বাড়তে পারে…
- আরো বাড়বে? কারা?
সরল প্রশ্ন রাখেন জাবালি। হনুমান তারে ব্যাখ্যা দেয়- বনবাসে যাবার আগে সীতার কিছু প্রতিজ্ঞা আছিল যে অযোধ্যায় ফিরতে পারলে ঋষি বামুনগো মাঝে ব্যাপক দান খয়রাত করবেন তিনি। তো সেইগুলা নেওয়ার লাইগা হইলেও হইতে পারে ঋষি ভরদ্বাজের যুদ্ধবিদ্যার শিক্ষার্থীরাও মেলা দিতে পারে রামের পিছনে…
- যুদ্ধবিদ্যার শিক্ষার্থীরা ক্যন?
জাবালির আরেক সরল প্রশ্নে হনুমান হাসে- না মানে অন্যরাও আসতে পারে। তবে মনে করেন লঙ্কাযুদ্ধে ওরাইতো খাটাখাটনি করছিল বেশি; তাই রাম হয়ত তাগোরে আলাদা কইরাই পুরস্কার দিবেন। তাই বললাম আরকি…
হনুমান আবার ফিরে ভরতের দিকে- তাছাড়া মনে করেন দেশে ঢোকার আগে শৃঙ্গবেরপুরে নিষাদ রাজ গুহকের লগে রামের তো দেখা হইবই। আমিই আসার পথে তিনারে সংবাদ দিয়া আসছি; যাতে নদী পার হইবার বন্দোবস্তটা তিনি কইরা রাখেন। তো হইলে হইতে পারে নিজের অভিষেকে দোস্ত রাজারে রাম নিমন্ত্রণ দিবেন আর গুহকও হয়ত চইলা আসবেন লোক-লস্কর নিয়া। আর ধরেন গিয়া আমি তো আইসাই পড়ছি। কালকে আপনের লগে গাঙপাড়ে গিয়া তাগোরে স্বাগত জানাব আর সকলের লগে পরিচয় করায়া দিব আপনেরে। এই তো; এর বেশি কেউ না…
ভরতের গলা শুকায়- কালকেই আসবেন? কোন সময়?
হনুমান কয়- আসতে তো সময় লাগার কথা না। অযোধ্যা থাইকা আপনে নিজেও তো বাহিনী নিয়া গেছেন ভরদ্বাজের আশ্রমে। মাত্র তিন যোজন পথ। তবে আমার হিসাবে আপনার যাত্রার চাইতে বরং সময় কমই লাগবে রামের। কারণ গুহক রাজা যেমন নৌকা সরায়া আপনেরে আটকায়া দিছিলেন; রামের ক্ষেত্রে তো আর সেইটা হবে না। বরং দোস্তের বাহিনীর লাইগা গুহকেই নদী পারাপারের বন্দোবস্ত কইরা দিবেন। মানে ঋষির আশ্রম থাইকা ভোরে রওয়ানা দিলে পদাতিকেরাও আইসা পৌছাইবে দুপুরের ভিতর…
তিন যোজন মানে মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার পথ। নন্দীগ্রামের দূরত্ব আরো এক ক্রোশ বা আড়াই কিলো কম। ভরদ্বাজের আশ্রম থাইকা এই পর্যন্ত আসতে পদাতিগোই লাগব মাত্র সাত ঘণ্টার মতো। সকলে মনে মনে হিসাব করে। গলা খাকারি দেন জাবালি- অর্থাৎ যা বোঝা গেলো তা হইল; পদাতিশুদ্ধা রাম আইসা অযোধ্যায় পৌঁছাইবেন কাইল দুপুরের ভিতর। তার মানে এই সময়ের মইধ্যে কেকয় রাজ্যে সংবাদই পৌঁছানো যাবে না। আর অযোধ্যার ভূপতিগো সংবাদ দেওয়া গেলেও তারা বড়োজোর নিজেরা সাইজা গুইজা উপস্থিত হইতে পারব সংবর্ধনায়; কিন্তু এই অল্প সময়ে অন্য কাউরে নিয়া আসা সম্ভব না তাদের পক্ষেও…
জাবালির চোখ পড়ে হনুমানের চোখে। তিনি কথা কাটান- না মানে কোনো সেনাসৈনিকের কথা বলতেছি না আমি। আমি বলতেছি গাঙপাড়ে বড়ো সংবর্ধনার আয়োজন করতে হইলেও তো মানুষ লাগবে। সেইটা আরকি….
বশিষ্ঠ সেনাসৈনিকের কথা কাটায়া যাইতে চান। তিনি কন- লঙ্কার রাজা রাবণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আমাদের কিছু বলেন তো দেখি দূত?
হনুমান কয়- সংক্ষেপে কইতে গেলে তো বলতে হয় পয়লা আমি তিনার এক ভাগনিরে বিবাহ করায় তিনি হইছিলেন আমার মামাশ্বশুর। পরে আরেক ভাতিজিরে বিবাহ করায় তিনি আমার চাচাশ্বশুরও বটেন…
জাবালি কন- এমন গুণধর জামাই যে পায় তার না মইরা আর কী উপায়? বেচারা রাবণ…
হনুমান কয়- নগণ্য বানরের উপর পুরোহিতের অত রাগের কি বিশেষ কোনো কারণ আছে জনাব?
জাবালি কথা উড়ায়া দেন- আরে না। রাটগটাগ কিছু না। খোঁচা মাইরা কথা বলার বামুনি খাইসলত আর কি। গুণী মানুষরে খোঁচাইতে ব্রাহ্মণেরা বিশেষ পছন্দ করেন। তর্কে জিতলে বামুনের মর্যাদা বাড়ে; যদিও আপনের লগে সেই সুযোগ নাই…
বশিষ্ঠ বোঝেন হনুমান অন্য কোনো প্রসঙ্গে যাইতে নারাজ। কিন্তু ভরতের লগে তার কিছু নিরালা কথা বলা দরকার। আবার জাবালির মতো হনুমানের লগে তর্ক জুইড়া দেওয়াও ঠিক না। তিনি জাবালির কথা কাইটা হনুমানের দিকে তাকান- আপনের সম্পর্কে তো শুনছি আমরা। এইবার দয়া কইরা রাজা রাবণের কিছু কথা আমাদের বলেন যাতে তিনার সম্পর্কে আমরা কিঞ্চিত ধারণা পাই পারি। তবে বেশি ভয়টয় দেখাইয়েন না আবার…
বশিষ্ঠ ফিরেন ভরতের লগে কানাকানিতে। হনুমান শুরু করে রাবণবন্দনা- রাবণরে ভয় করার কিছু নাই। তিনি আছিলেন একজন ব্রাহ্মণ। বিদ্ব্যান মানুষ। সংগীত আর স্থাপত্যসহ এক লগে দশখান বিদ্যায় পারদর্শিতার লাইগা মানসে তিনারে দশমাথা বা দশানন কইয়া সম্মান দিত। আর তিনার যে রাবণ নাম; সেইটা কিন্তু তার সংগীতের সুমধুর গলার লাইগা। আর স্থাপত্যকলায় তার রুচি আর বিদ্যা দেখতে হইলে একবার লঙ্কা ঘুইরা আসতে হবে আপনাদের। সেইটা বর্ণনার ক্ষমতা আমার নাই। বহুত দয়ালু মানুষ আছিলেন তিনি। আস্ত ভাদাইম্যা এক বেবুতা ভাইরে সংসারসহ বসাইয়া পালতেন। মহাকাশবিদ্যা বিষয়ে রাবণ সংহিতা নামে একখান পুস্তকও লিখছেন তিনি…
জাবালি কন- যেইসব কথা বলতেছেন; মনে হইতেছে কোনো মুনিঋষির বিবরণ দিতেছেন আপনে…
হনুমান কয়- তা বলতে পারেন। বলতে পারেন রাবণ মুনিঋষিই আছিলেন। বলতেন বঞ্চিত মানুষের লাইগা দেইখো একদিন স্বর্গে যাবার একখান সিঁড়ি বানায়া ফেলব আমি। তিনি মূলত আছিলেন শিবপূজারি; আবার ব্রহ্মারও সাধাণা করছেন বহুত বছর…
মণ্ডলির সদস্যরা রাবণের গুণে একেবারে মুগ্ধ হইয়া যাইতাছে দেইখা বশিষ্ঠ হনুমানরে খোঁচান- রাবণ এই রকম মুনিঋষি হইলে তো আর যুদ্ধমুদ্ধ করার কথা না…
হনুমান এইবার পাল্টা খোঁচা লাগায় বশিষ্ঠরে- এইটা কী বললেন ঋষি? বিশ্বামিত্র গোষ্ঠীর লগে তো লাগাতার যুদ্ধ করছেন আপনের গোত্রের মহামান্য ঋষিরা; ভার্গব ঋষিরা তো পুরোহিতের কামই করেন না প্রায়; যুদ্ধমুদ্ধই তিনাগো বৃত্তি। আবার ধরেন গিয়া ভরদ্বাজ; অঙ্গিরাবংশজাত হইলেও অস্ত্রপাতির দিকেই তাগো বেশি ঝোঁক। তো সাধারণ মাইনসে হয়ত ভাবতে পারে যে যুদ্ধশাস্ত্রের লগে পুরুতশাস্ত্রের কোনো মিল নাই; কিন্তু আপনে তো জানেন যে একটার লগে আরেকটার সম্পর্ক কতটা গভীর। বিশেষত ঋষিরাজা কিংবা রাজর্ষি এইগুলা যখন এখন অতি সাধারণ বিষয়…
খোঁচাটা হজম করেন বশিষ্ঠ। নিজের বিদ্যাশিক্ষার বিষয়ে হনুমান কিছু না কইলেও তিনি অনুমান করেন যেইসব শাস্ত্র বেইচা তিনারা খান সেইসব বিদ্যা এই লোকের নখের ডগায়। তিনি কন- ঠিকাছে। মানে আমরা আসলে রাবণের রাজকীয় জীবন সম্পর্কে আগ্রহী। সেই বিষয়ে যদি সংক্ষেপে কিছুটা বলেন…
হনুমান কয়- সংক্ষেপে রাবণের রাজকীয় জীবন তো মাত্র এক বাক্যেই বইলা দেওয়া যায়। সেইটা হইল- ‘যা চাই যেন জয় করে পাই’ নীতি তিনি মাইনা চলতেন তিনি…
বশিষ্ঠ বোঝেন ভরত সিংহাসন ছাড়ব কি না সেই বিষয় ছাড়া অন্য কিছুতে যাইতে রাজি না হনুমান। সে মণ্ডলির সামনে রাবণের বিদ্যার বিবরণ দিয়া তিনারে সুযোগ দিছে ভরতের লগে নিরালায় কথা বলার। এখন সে আর ওই বিষয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি না। সে শুধু সেইটা শুনতে চায় যেইটা সে শুনতে আসছে অযোধ্যায়…
প্রসঙ্গ পাল্টাইতে ব্যর্থ হইয়া বশিষ্ঠ কিছু যুক্তি উত্থাপন করেন- রামের ঘনিষ্ঠ মানুষ হিসাবে আমার ধারণা আপনে অযোধ্যার কিছু পুরানা ইতিহাসও জানেন। আপনে নিশ্চয় জানেন যে রাজকুমারি কৈকেয়ীরে বিবাহ করার পূর্বেই রাজা দশরথ কেকয়রাজ অশ্বপতিরে কথা দিছিলেন যে; তার কন্যার গর্ভজাত পুত্রই হবে অযোধ্যা সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকার। সেই কথামতে দশরথ পুত্রদের মাঝে জ্যেষ্ঠ না হইলেও ভরতই হইলেন অযোধ্যা সিংহাসনের প্রতিশ্রুত উত্তরাধিকার। সেই ক্ষেত্রে রামের দাবির তো কোনো বৈধতা নাই দূত…
হনুমনা কয়- বিবাহপূর্বে রাজা দশরথের প্রতিশ্রুতি বিষয়ে আপনে যা বললেন তা আমিও জানি; সব কিছু স্বাভাবিক চললে পিতার মৃত্যুর পর রাজকুমার ভরতেরই রাজা হইবার কথা আছিল। কিন্তু জনাব; রাজা দশরথ যে মৃত্যুর আগেই পুত্রসমেত রানি কৈকেয়ীরে ত্যাজ্য কইরা গেছেন। অযোধ্যা নগরীর সাড়ে তিনশ পরিবারের নারী পুরুষ সাক্ষী রাইখা পুত্রসমেত রানি কৈকেয়ীরে ত্যাগের ঘোষণা দিছেন তিনি। আপনে নিজেও সেইখানে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত আছিলেন এই মণ্ডলির অনেকেই। তো রাজা দশরথের সেই ঘোষণার ফলে রানি কৈকেয়ীর লগে লগে তার পুত্র ভরতও যে দশরথের ত্যাজ্য পুত্র হিসাবে গণ্য হইয়া পড়ছেন ঋষি। যদিও সেই ঘোষণার কালে রাজপুত্র ভরত উপস্থিত আছিলেন না সেইখানে; আছিলেন না রাজকুমার শত্রুঘ্নও…
মণ্ডলি স্তব্ধ মাইরা গেছে। কেউ কোনো কথা কয় না দেইখা হনুমান কথা বাড়ায়-শাস্ত্রমতে যেইখানে ত্যাজ্যপুত্র পিতার সম্পত্তির কানাকড়ি পর্যন্ত পায় না; সেইখানে সিংহাসনের দাবি কেমনে টিকে আপনেরাই বলেন?
সকলে উসখুশ করে। বিনয়ে গইলা হনুমান আরো ঠাইসা ধরে মণ্ডলিরে- আপনাদের সামনে শাস্ত্র নিয়া কথা বলা আমার বেয়াদবি হবে; মাফ করবেন। তবে আমার অল্প বিদ্যায় ত্যাজ্যপুত্রের সিংহাসন পাওয়ার কোনো ইতিহাস আমি অন্তত কোনো পুঁথি-পুস্তক-সংহিতায় পাই নাই। যদি এই বিষয়ে আপনেরা ভিন্নমত করেন তবে ঋষি ভরদ্বাজ- বিশ্বামিত্র- গৌতম- পরশুরাম- বাল্মিকীদের ডাইকা সালিশ বসাইতে পারেন। তিনারা যে বিধান দিবেন রামচন্দ্র তা মাথা পাইতা নিবেন…
বশিষ্ঠ বোঝেন রাম শুধু কয়েকটা বাহিনীর সেনাসৈনিক নিয়াই আসতেছে না। বেশ কয়েকজন মহাবলী ঋষিরেও হাত কইরা ফেলছে সে। কিন্তু মুখে কিছুই কন না তিনি…
সকলের নিস্তব্ধতার সুযোগে হনুমান আসে উপসংহারে- দশরথের ত্যাজপুত্র হিসাবে অযোধ্যা সিংহাসনের দাবি থাইকা ভরত বাদ পড়ার পর বৈধ দাবিদার থাকেন বাকি তিন রাজকুমার; রাম-লক্ষ্মণ আর শত্রুঘ্ন। আর সেই ক্ষেত্রে রীতি আর প্রথা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামচন্দ্রেরই অধিকার সর্বাগ্র…। আশা করি যুক্তি দেখাইতে গিয়া বিজ্ঞ পুরোহিত মণ্ডলির সামনে কোনো মূর্খতা দেখাই নাই আমি। যদি তা কইরা থাকি তয় মাফ কইরা দিবেন…
কথা খুঁইজা পায় না কেউ। ভরত বিভ্রান্ত। এইবার ভরতের দিকে তাকায়া মমতা ঢালে হনুমান- রাম কিন্তু দয়ালু মানুষ; আপনে নিশ্চয় জানেন রাজপুত্র। রাগের মাথায় মায়ের লগে বাবায় আপনেরে ত্যাজ্য করায় আপনে রাজবাড়ির সব কিছুর উপর অধিকার হারাইছেন সত্য। তবে রাম কিন্তু আপনেরে নির্বাসনে পাঠানোর পক্ষপাতি না…
এইবার সকলে কান খাড়া করে ভরতের ভাগ্য শুনতে। হনুমান ফিরে মণ্ডলির দিকে- রাজকুমার ভরতের তো কোনো দোষ নাই। ঠিক কি না? বিনাদোষে ত্যাজ্যপুত্র হওয়া একটা দুর্ভাগ্য; না মাইনা উপায় নাই। কিন্তু ত্যাজ্য তো ত্যাজ্যই। রাজা দশরথ যদি আইজ জীবিত থাকতেন তবে হয়ত আমরা সকলে তিনারে মিনতি কইরা বলতে পারতাম বিনা দোষে দেওয়া ভরতের শাস্তিটা ফিরায়া নিতে। কিন্তু সেই সুযোগ তো আমাদের নাই; ঋষি জাবালির সূত্রমতে এক মানুষের এক জীবন শেষ কইরা ফেলছেন রাজা দশরথ। তাই কষ্ট হইলেও মাইনা নিতে হবে যে রাজা দশরথের চাইর পুত্র থাকলেও একজনরে তিনি ত্যাজ্য কইরা গেছেন…
কেউ কোনো দ্বিমত করে না; কথাও বলে না কেউ। হনুমান গলা বাড়ায়- তবে ভরতের লগে কিন্তু রামের কোনো বিরোধ নাই; আপনেরা এই বিষয়ে আরো ভালো বলতে পারেন। আবার এই দিকে দেখেন রাজা দশরথ রানি কৈকেয়ীরে ত্যাগ করলেও রামে কিন্তু তিনারে জননী হিসাবেই গণ্য করেন; ঠিক কি না?
ভরতের বিষয়ে হনুমান পরিষ্কার কইরা এখনো কয় নাই কিছু। সকলে অপেক্ষা করে। হনুমান কথারে এলায়া সকলের মনোভাব বোঝে। সে কথারে আরো রসায়- কথা হইল স্বামী বা স্ত্রী ত্যাগের কথা আমরা বিস্তর শুনি। পুত্রকন্যা ত্যাগের কথাও মাঝে মাঝে শোনা যায়। কিন্তু জননী কিংবা ভাই ত্যাগের ঘটনা তো দুনিয়াতে নাই। ঠিক কিনা? …আমার জানাশোনায় যদি মূর্খতা থাকে তয় অযোধ্যার বিচক্ষণ মণ্ডলি আমারে সংশোধন করেন। আমি কিন্তু জীবনেও ভাই কিংবা জননী ত্যাগের ঘটনা কোথাও শুনি নাই। আর সেই উদাহরণ তৈরির কোনো ইচ্ছাও রামের নাই…
সকলের বুক থাইকা একটা ভার নামে। তারপরেও সকলে চুপ। ভিন্নমত বিহীন মণ্ডলির দিকে তাকায়া এইবার ভরতরে অভয় দেয় হনুমান- একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে রাম কোনোভাবেই তার কোনো দুর্গতির লাইগা তার কোনো ছোট ভাইরে দায়ী ভাবেন না। ভরতের উপর যেমন তিনার কোনো রাগ নাই; শত্রুঘ্নর উপরও নাই। তিনি মনে করেন যা ঘটছে তা পিতা-মাতার ভিতর ঘটছে। সেই কারণে বড়োপোলা হিসাবে কিছু বঞ্চনা হয়ত মাইনা নিতে হইছে তিনার। তাতে কিছু কষ্ট হইলেও এর পরম্পরায় যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও অর্জিত হইছে তার। এর লাইগা ছোট ভাইয়ের উপর তিনার কোনো রাগ-অভিমান নাই। বিরোধের তো প্রশ্নই উঠে না…
হনুমান তাকায় ভাইঙা পড়া বশিষ্ঠের দিকে- রাম যদি বিরোধই যদি চাইতেন তবে সেনা নিয়া উপস্থিত না হইয়া একলা নিরস্ত্র আমারে কেন কথা বলতে পাঠাইবেন; ঠিক কি না ঋষি?
বশিষ্ঠ কথা কন না। কথা ধরেন বৌদ্ধ জাবালি- যেই মানুষ একলা গিয়া রাবণরে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিতে পারে; তারে একলা পাঠানো যে কয়েক হাজার সৈনিক পাঠানো থাইকাও বেশি; এই বুদ্ধি নিশ্চয় হইছে রামের…
হনুমান কয়- শরম দিয়েন না মুনি। বড়োই নগন্য মানুষ আমি…
জাবালি কন- সেইটাতো দেখতেছি। এখন পর্যন্ত কথা বলার কোনো ফাঁকই পাইতেছি না আমরা…
বশিষ্ঠের সাথে চূড়ান্ত কানাকানি কইরা উইঠা খাড়ায় ভরত- রামচন্দ্র আমার বড়োভাই; পিতার অবর্তমানে আমাদের অভিভাবক তিনি। অযোধ্যায় তিনার প্রত্যাবর্তন সকলের লাইগাই আনন্দের বিষয়; জননীরাও নিশ্চিত খুশি হইবেন এই সংবাদে। কাইল আমরা তিনারে সংবর্ধনা জানাব রাজ্যের সীমানায়…
শত্রুঘ্নরে সংবর্ধনা আয়োজনের দায়িত্ব দিয়া হনহন কইরা সভা ছাড়ে ভরত। হনুমানের কানের কাছে আইসা ফিসফিসান জাবালি- আপনের তৃতীয় দূতিয়ালি তবে সত্যি সত্যিই শেষ হইল রক্তপাত ছাড়া…
নোট:
মুণ্ডারি কাহিনীমতে হনুমান মুণ্ডাজাতির মানুষ; ল্যাঞ্জা ঝুলায়া মুণ্ডারি স্টাইলে হনুমানের ধুতি পরার ঘটনাও এই দাবিরে সমর্থন দেয়। কিন্তু সেই কালে মুণ্ডাগো জাতিগত নাম পরিচয় কী আছিল তা বাইর করতে পারি নাই। ফলে শেষমেশ হনুমানের এই মুণ্ডারি পরিচয়টা রাখব কি না এখনো ঠিক কইরা উঠতে পারি নাই। তবে এইটা নিশ্চিত যে রাম-সীতা আর হনুমান নৃতাত্ত্বিকভাবে আলাদা আলাদা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ…
হনুমান আর রাবণ একই জাতির মানুষ মোটামুটি নিশ্চিত। সীতা আর রামায়ণের শেষ বাল্মিকী রত্নাকর ভালিও (পয়লা বাল্মিকী খুব সম্ভবত চ্যাবন মুনি) একই জাতের মানুষ হইবার সম্ভাবনা প্রচুর। খুব সম্ভবত তারা আছিলেন ভিল জাতি কিংবা ভিল জাতির কোনো পূর্বতর গোষ্ঠীর মানুষ…
সীতা শুধু রত্নাকর বাল্মিকীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ই পায় না; রত্নাকর সীতার শেষকৃত্যও করেন ভিল রীতি অনুসারে। আগেকার দিনে ভিল জাতি পুরুষের মরদেহ পোড়াইত আর নারীর মরদেহ দিত কবর। সীতারে বাল্মিকী কবরই দেন…
রামায়ণের মূল চরিত্রগুলার কিছু কিছু পরিচায়ক পাওয়া গেলেও মুশকিল হইল পুরানাকালে সেইসব জাতিগোষ্ঠীর নাম কী আছিল তা উদ্ধার করতে পারি নাই। যার লাইগা হনুমান-রাবণরে মুণ্ডা কিংবা সীতা-বাল্মিকীরে ভিল বলা ঠিক হইব কি না তা এখনো বুইঝা উঠতে পারি নাই…
ঋষি জাবালিরে বনবাসের শুরুতে রামেই বৌদ্ধ কইয়া গালি দেয়। কিছু বিবরণে জাবালিরে বৌদ্ধর পাশাপাশি চার্বাক অনুসারী নাস্তিক হিসাবেও পাওয়া যায়। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়- মহাভারত বা রামায়ণে নাস্তিক বলতে সর্বদাই চার্বাকপন্থী বা বৌদ্ধ বোঝানো হয়েছে। মহাভারতে চার্বাক আছে। কন্ব মুনী কিন্তু চার্বাক পন্থী। আর রামায়ণে আছে বৌদ্ধ; রাজা দশরথের উপদেষ্টা জাবালি বৌদ্ধপন্থী মানুষ…
এইসব সংযোজন নিয়া বিতর্ক আছে প্রচুর; বিশেষত স্থান আর সময়ের হিসাবে। হিসাবমতে রাবণের আদি লঙ্কা আছিল মধ্য আফগানিস্তানের হররুদ নদীর একটা চর; রামায়ণের বাকি সব রাজ্য হররুদেরই আশেপাশের এলাকা…
পার্শিয়ান গবেষকগো দাবিমতে গৌতম বুদ্ধ আছিলেন মধ্য আফগানের কাবুলের বাসিন্দা বা কাবুল (কপিল) মুনি। আবার আরেক হিসাবে আদি বাল্মিকী চ্যাবন মুনি আছিলেন কাবুল থাইকা প্রায় সাড়ে চার শ কিলোমিটার দূর বলখের বাসিন্দা। বৌদ্ধ রামায়ণ মতে রাবণও একজন বৌদ্ধ…
এইসব দিক বিবেচনা করলে ওই অঞ্চলের বৈদিকগো লগে বৌদ্ধ সংঘাত রামায়ণে উপস্থিত হইতেই পারে। কিন্তু তখন প্রশ্ন আইসা হাজির হয়- সেই সংঘাতটার সময়কাল কী আর কোন রাবণ কিংবা কোন রাম কোন কালের মানুষ? কারণ বর্তমান রামায়ণে যেইসব ঘটনা সংকলিত আছে তা মোটামুটি খিপূ ৮০০ থাইকা খ্রিস্টিয় ৪র্থ শতক পর্যন্ত রচিত ঘটনা…
আবার রাজেশ কচারের ভাষায় এই বারোশো বছর ধইরা কাহিনীগুলা রচিত হইছে ‘স্থানান্তরিত মানচিত্রের’ উপর। যেইখানে বর্ণিতের ভূগোল আর সংস্কৃতির চাইতে বর্ণনাকারীর ভূগোল আর সংস্কৃতি হইয়া উঠেছে মুখ্য…
ফলে এখনো ঠিক কইরা উঠতে পারি নাই চূড়ান্তভাবে সহজিয়া রামায়ণের ভূগোল আর সময় কোনটা ধইরা আগাব। আর সেইটার উপরেই নির্ভর করবে জাবালির লগে তার বৌদ্ধ পরিচয়টা থাকবে কি থাকবে না…
মন্তব্য
রামায়ণের আদিভূমি নিয়ে রাজেশ কোছারের যুক্তি আর অনুমানগুলো নিয়ে একটা লেখা সময় পেলে লেইখেন।
এই বিষয়ে একটা অধ্যায় যুক্ত করব। নোট কইরা রাখছি কিছু। এখনো গোছানো হয় নাই। গল্পে অত ভেজালে যাব না। তবে ভণিতায় যুক্ত করব ওইসব
০২
আচ্ছা আপনে লিখছেন 'কোছার' ইংরেজিতে Kochharআমি এর সঠিক উচ্চারণ কোথাও খুইজা পাই নাই। আমার মনে হইছে বোধহয় 'কচার'। তবে কিছু জায়গায় 'কশার' কথাটাও শুনছি
ভরৎ না রামের খড়মরে সিংহাসনে বসাইছিল? সেই খড়মজোড়া কৈ গেল? নাকি এই খড়মের কাহিনী পরবর্তী সংযোজন?
খড়ম আছে। পাইবেন। মূলত রামের পায়ে খড়ম পরায়া দিয়া সে আনুগত্য মাইনা নেয়
শিরোনামে কি "হনুমানের দূতিয়ালি" হওয়া উচিৎ না?
হ। হনুমানের দূতিয়ালি। শিরোনামে ভুল হইছিল আগে। ঠিক করছি
হনুমানের মুখে রামের দূতিয়ালি (ভরতের নয়, তাই ত ) ভালৈ হৈছে
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
খাইছে। নাকের ডগায় অত বড় ভুল কইরা রাখছি। এইটা হবে হনুমানের দূতিয়ালি। অনেক ধন্যবাদ
তাই কি? তাইলে প্রথম প্যারাটার ঐ লাইনটার কি হইবে - "তার আগে আমি বালির বিষয়ে সুগ্রীবের দূতিয়ালি করছি রামের কাছে; বালিও মরছে।" তার মানে হনুমান সুগ্রীবের দূতিয়ালি করে, অর্থায় সুগ্রীবের বক্তব্য জানায় রামের কাছে। এই কাঠামো মাইনা এইবার সে রামের বক্তব্য জানাচ্ছে ভরতের কাছে। অর্থায় রামের দূতিয়ালি করছে ভরতের সাথে। এর বদলে আপনি যদি এইবারে এইটারে হনুমানের দূতিয়ালি কন, তাইলে ঐ প্রথম প্যারাতেও ঐ দূতিয়ালি সুগ্রীবের বদলে হনুমানের দূতিয়ালি হওয়াই সমীচীন হয়, তাই না?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
গ্রামারের প্যাচালে ফালায়া দিলেন। পয়লা প্যারায় হনুমান কইতেছে (ফার্স্ট পার্সন) আমি সুগ্রীবের দূতিয়ালি করছি রামের কাছে। আর শিরোনামে অজ্ঞাতজন (লেখক) বলতেছে হনুমান (থার্ড পার্সন) দূতিয়ালি করতেছে রামের সিংহাসন উদ্ধারে। এইবার ঠিকাছে বোধহয়
হেঃ হেঃ, সমাধান্ডা আরো সহজ আছিল। এই লন।
"তার আগে আমি বালির বিষয়ে সুগ্রীবের হৈয়া দূতিয়ালি করছি রামের কাছে; বালিও মরছে।" "হৈয়া" কইতে পারেন, "তরফ থিকা" কইতে পারেন, আপনের চয়েস।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে কাজ করা মানে একটা অসম্ভব বিশাল পাহাড় প্রমাণ তথ্যের স্তুপের মধ্যে হাবডুবু খাওয়া। আমি লিলেনদা আপনার সাহস দেখে ভিমরি খাই। মনে হচ্ছে দারুণ হবে সিরিজটা (যদি অবশ্য দয়া করে তাড়াতাড়ি দেন)।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
সাহস এখন জ্বালায় পরিণত হইছে। এইটা না পারতেছি শেষ করতে না পারতেছি বাদ দিয়া যাইতে। বহুত খাটনি দেওয়া হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিছি এই বছর অন্তত ড্রাফট শেষ করব। তারপর ফাইনাল না করতে পারলে ফালায়া রাখব
শাস্ত্র এবং অস্ত্র - উভয় বিদ্যায় সমান পারদর্শী মহাবলী ঋষি (warrior-sage/warrior-monk/warrior-priest)-কে কি এক শব্দে "যোদ্ধার্ষি" (রাজর্ষি বা দেবরশি-র অনুকরণে) বলা যেতে পারে?
"যোদ্ধার্ষি" বললে ভুল হবে। ওরা কিন্তু গুরু। এরা যুদ্ধ আর অন্যান্য শাস্ত্রের উপর স্কুল চালান
জনক রাজা একই লগে ঋষি বইলা রাজর্ষি। বিশ্বামিত্র রাজর্ষি। পরশুরাম ঋষিরাজা। কিন্তু শুক্র-ভরদ্বাজ এরা শাস্ত্র এবং অস্ত্র - উভয় বিদ্যায় সমান পারদর্শী ঋষি
বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ!
আমার বোঝামতে রামায়ণের ঘটনা ঘটেছিল বিহার-উত্তর প্রদেশ সন্নিহিত এলাকায়; আর মহাভারতের ঘটনা ঘটেছিল ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে রামায়ণের পটভূমি আফগানিস্থান, অর্থাৎ বৃহত্তর ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম। ভূগোলের ব্যাপারটা এখানে কিছুটা জটিল মনে হচ্ছে!
জ্যোতির্বিদ রাজেশ কোছারের পাঠ, রামায়ণ ঋগ্বেদের সমকালিক(কিছু টুকিটাকি সূত্র আছে, যেমন রামায়ণে কোনো লোহার অস্ত্র নেই, শুধু তির-ধনুক আছে, যেটা নির্দেশ করে যে এই গল্প লৌহযুগের আগের)। ঋগ্বেদের শ্লোকে দিন আর রাতের দৈর্ঘ্যের অনুপাত নিয়ে কিছু কথা ছিলো, সেখান থেকে তিনি অক্ষাংশের হিসাব নিয়ে ধারণা করেছেন, ঐ শ্লোকের রচয়িতা তখন দক্ষিণ আফগানিস্তানে ছিলো। এ ছাড়া নদীর ভৌগোলিক ক্রম ধরে তিনি আফগানিস্তানের পূর্ব থেকে পশ্চিমে রামায়ণের গল্পের যাত্রাকে সাজিয়েছেন। কৌম মারপিটের গল্পে পরবর্তীকালে নানা দেবত্ব আরোপিত যেমন হয়, গল্পের সাথে আত্মীয়তা-অনুভব-করা জনগোষ্ঠীও গাঙ্গেয় অববাহিকায় চলে আসে, সেইসাথে গল্পের পটভূমিরও দেশান্তর ও ভূসজ্জীকরণ ঘটে। আপনার হাতে যদি সময় থাকে, এই লেখাটা পড়তে (সচলায়তনে অনুবাদের অনুরোধও করছি) পারেন।
সেকালের গেমফথ্রোন্স?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন