আমরা মানে আমরা। মনে মনে কবি এবং বাইরে আঁতেল পনেরো থেকে বিশের একদল তরুণ। নিজেকে প্রমাণ করার চেয়ে অন্যকে বাতিল করাই যাদের প্রধান কাজ। যতটা না পড়ি তার থেকে লিখি বেশি। বলি তারও বেশি। এবং ভাবি; খোলাখুলি বলিও- আমাদের আগে সাহিত্যে যা হয়েছে সব আবর্জনা। সব বাতিল। সাহিত্যের ইতিহাস শুরু হবে নতুন করে। নতুন করে নির্ধারিত হবে সাহিত্যের সংজ্ঞা। এবং তা করব আমরাই। আমরাই দেখিয়ে দেবো সাহিত্য কীভাবে করতে হয়
সেই নিহিলিস্ট সময়েও একটা মানুষ সম্পর্কে আমরা ছিলাম ব্যতিক্রম। কবি দিলওয়ার। পূর্বসূরি সব সাহিত্যকে বাতিল করে করে যখন আমরা নিজেদের মাঝে নিজেরা স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছিলাম। তখনও দিলওয়ারের নাম আমরা উচ্চারণ করতাম দেবত্ব সহযোগে। আমাদের হাতে উৎসর্গ করার মতো যা কিছু ছিল তার নিরানব্বই ভাগই করতাম তার নামে। আমাদের যত প্রকাশনা; সবক’টিরই প্রথম পাতা দিলওয়ারের জন্য বরাদ্দ। কোনোকিছু চিন্তা করলেও যতক্ষণ না তা দিলওয়ারের আশীর্বাদ পায় ততক্ষণ তাকে আমরা ভাবতাম অভিশপ্ত
তখন আমরা কিশওয়ারকে চিনতাম না। তাকে জানতাম দিলওয়ারের এক পাগল ছেলে হিসেবে
যখন আরেকটু বড়ো হলাম। যখন সাহিত্যের ইতিহাসকে একটু আধটু কল্কে দেবার কথা ভাবতে শুরু করলাম। যখন আমাদের গলার জোর একটু কমে এলো। যখন কেউ কেউ নিজেকে কবি হিসেবে পরিচয় দেয়া থেকে বিরত হয়ে গেলো। এবং যখন নিজেদের লেখায় দুয়েকটা ভুল ধরা আর মেনে নেয়া শিখে ফেললাম তখন আমরা কিশওয়ারকে চিনলাম। দিলওয়ারের ছেলে নয়; আলাদা এক কবি। কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। আমরা তাকালাম তার দিকে। পড়ে কিংবা না পড়ে; বুঝে কিংবা না বুঝে আমাদের যে মাথা অতদিন দিলওয়ারের দিকে ঝুঁকে ছিল তা এবার নুয়ে পড়ল কিশওয়ারের দিকে
এবং এই প্রথম। আত্মমগ্ন সিলেটে দিলওয়ারের রাজত্ব আর পীরত্বের বিরুদ্ধে না বুঝেই প্রথম বিদ্রোহ ঘটে গেলো আমাদের হাতে; আহমেদুর রশীদের সম্পাদনায় আমাদের পত্রিকা শুদ্ধস্বর পঞ্চম সংখ্যায় প্রকাশিত হলো কিশওয়ারের উপর ক্রোড়পত্র। ১৯৯৫ সালে। এবং এই প্রথম একটা ম্যাগাজিনে দিলওয়ারের কোনো লেখা না ছাপানোর ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ফেললাম আমরা কিশওয়ারকে চিনে
সত্যিই কি তাই? কবিতার জন্য কি কিশওয়ারকে চিনেছিলাম? নাকি বিস্ময় আর আতঙ্ক থেকে চিনেছিলাম তাকে?
তখন সে সম্পূর্ণ সিজোফ্রেনিক। ওষুধের জোরে টিকে আছে- দিলওয়ারের প্রভাবে বাস করছে আর দ্বিতীয় মা ওয়ারিসার তত্ত্বাবধানে বেঁচে আছে। কিশওয়ার কবিতার বাইরে কোনোদিন কিছু করেনি। এখন পাগলামির ফাঁকে ফাঁকে কবিতা করে
আমরা কি তার কবিতাকে সামনে আনতে চেয়েছিলাম সেদিন? নাকি কবিতার নাম করে তার কাছ থেকে জেনে নিতে চাচ্ছিলাম কী করলে সিজোফ্রেনিয়া হয় না? আর তার কবিতা নাড়াচাড়া করে প্রমাণ করতে চাচ্ছিলাম কিশওয়ার পাগল নয়। সে কবি। কারণ আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে আতঙ্ক ছিল- যদি আমরাও কিশওয়ার হয়ে যাই?
আমরা হতে চাই না। আমরা কবিতা করতে চাই কিন্তু কিশওয়ার হতে চাই না। কবিতার খাতাটা আমরা রাখতে চাই ঘর- সংসার আর স্ট্যাটাসের পাশে
পরিষ্কার বাংলায় এই কথাটি আমার মুখ থেকেই বের হয়ে এসেছিল প্রথম। ১৯৯২ এ। আর তখন থেকেই আমাদের কাছে না হতে চাওয়া মানুষের ঘনিষ্ঠ উদাহরণ হয়ে উঠে কিশওয়ার
আমাদের আড্ডা এবং নিজেকে জাহির করার জায়গা জিন্দাবাজারের সাথী লাইব্রেরি। সাহিত্য-বিরোধী আমাদের বন্ধু খালিক সাথী লাইব্রেরির মালিক। কী এক অদ্ভুত কারণে ব্যবসার বারোটা বাজিয়ে আমাদেরকে অ্যালাও করত সেখানে আড্ডা দিতে। আমাদের জন্য দোকানে কোনো লোক ঢুকত না। সে বিক্রি করত নোট বই। কিন্তু ক্রেতা এলে আমরা শেক্সপিয়র রচনাবলি কেনার জন্য লেকচার দিতাম। আড্ডায় সমস্যা হতো বলে তার বইয়ের রেকগুলো আমরা এমনভাবে দেয়ালে ঠেলে দিয়েছিলাম যে কোনো লোকের পক্ষেই আর বই দেখা সম্ভব নয়
খালিক আমাদের লাঞ্চের জন্য প্রতিদিন সকালে চিঁড়া ভিজিয়ে রাখতো এক গামলা। প্রায় দেড় বছর আমাদের দুপুরের খাবার ছিল খালিকের চিঁড়া। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতাম। কিছুই করতাম না। শুধু তর্ক করতাম। কারো কথা কেউ মানতাম না। কারো কথা মেনে নেয়াকে আমরা ক্রিয়েটিভিটির অপমান বলে জানতাম। কিন্তু এই প্রথম একটা বিষয়ে আমরা একমত হয়ে গেলাম কাঠখোট্টা খালিককে অবাক করে দিয়ে
কী এক প্রসঙ্গে...। প্রসঙ্গটা- এই করব সেই করব; অত সালে নোবেল পুরস্কার পাব। এই জাতীয় ভবিষ্যতের চাপা। ...যে এখন পর্যন্ত আমার কবিতাকে বলে পথুয়া প্রলাপ; সেই জফির সেতু আমার ঠিক সামনে। আমাকে চাপাবাজ হিসেবে এড়িয়ে চলা শাহ তোফায়েল আহমেদ ডানে। শহরের কিছু মেয়ের সাথে আমার পরিচয় আছে বলে যে আমাকে কিছু আলাদা খাতির করে সেই শামীম শাহান তোফায়েলের ডানে। বামপাশে শাহ শামীম। শাহ শামীম সরাসরি আমাকে বলে ফাউল। শাহ শামীমের পাশে শুদ্ধস্বর সম্পাদক আহমেদুর রশীদ; লেখক হিসেবে নয়; রশীদ এখন পর্যন্ত আমাকে গোনে অর্গানাইজার- প্রব্লেম শুটার এবং প্রিন্টিং কনসালটেন্ট হিসেবে
আমার লেখা সাহিত্যের কাতারে পড়ে না বলে দু হাজার ছয় সালেও যে আমার দশ-দশটা কবিতা নিয়ে না ছাপিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। সেই আহমদ মিনহাজ আমার ঠিক পেছনে। এবং আরো অনেকে। যারা এখন সাহিত্যে নেই। মোট ছাব্বিশজন। কবি-আধাকবি। ...খালিক তার কাউন্টারে। আমি কথা বলতে বলতে সেতুর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলাম- আর যাই হই; আমি কিশওয়ার হতে চাই না কোনোদিন
জফির সেতু তার আঙুলটা সোজা করে নিয়ে এলো আমার চোখের কাছে। চোখ বড়ো বড়ো করে মুখ ঝুঁকিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে সেতু জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মতো একবাক্যে আমার কথা সমর্থন করে উঠল- ঠিক লীলেন। কিশওয়ার হতে চাই না
- ঠিক ঠিক ঠিক। আর যা কিছু হই। কোনোভাবেই কিশওয়ার নই
একবাক্যে পুরো আড্ডা কোরাস করে উঠল আমার কথায়। ক্যাশ কাউন্টারে হা করে থাকল খালিক- চুৎমারানির পুয়াইন। অতদিনে অউ একটা বালা কতা হুনলাম তুমরার মুখো। হারাদিন তো বাল-চাল কিতা-কিতি লইয়া আমার গরটারে নাপাক করি ফালাই দেও। অউ অখন মানুষ অইলে অইতায়। বুদ্ধি বাড়ছে তুমরার
- বার-অ শুয়োরর বাইচ্চাইন। বার-অ আমার গর থাকি। চুরর চুর চুৎমারানির পুয়াইন। তুমরার লাখান পেলর তলর কবিনতরে খাওয়ানির থাকি রাস্তার কুত্তারে খাওয়ানি বউত বালা
এই বলে ৯৩ তে একদিন খালিক আমাদেরকে বের করে দিলো তার ঘর থেকে। সিলেটে এরপরে আর আড্ডা জমেনি। আমরা আরেকটু বড়ো হয়ে গেছি ততদিনে। কবিতার পাশাপাশি পেট এবং ভাতও একটু আধটু টানে ততদিনে আমাদেরকে। আমরা সবাই কিশওয়ার হতে না চাওয়ার প্রতিজ্ঞা মনে রেখে নিজেকে বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে লাগলাম বিভিন্ন বাজারে
আহমেদুর রশীদ ঢাকায় এসে ফ্ল্যাট-সিনেমা আর গাড়ি ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে ঘোষণা দিয়ে শুদ্ধস্বর বন্ধ করে দিলো। সে বলল এই বিলাসী জীবনের সঙ্গে শুদ্ধস্বর যায় না। এখন আর সে মাটির কাছাকাছি নেই। মাটি থেকে দূরে বসে লিটল ম্যাগাজিন করা মানে সাহিত্যের সঙ্গে বেইমানি করা। যদি কোনোদিন আবার মাটির কাছাকাছি আসতে পারে তবে আবার শুদ্ধস্বর বের হবে। না হলে বিদায় লিটল ম্যাগাজিন। বিদায় সাহিত্য। বিদায় শুদ্ধস্বর
মিনহাজ ব্যাংকার হয়ে চলে গেলো মৌলভীবাজার। সেতু মাস্টারি করতে লাগল সুনামগঞ্জে। অনেকে চলে গেলো দেশের বাইরে আর আমি উন্নয়নের দালালি করতে থাকলাম সারা বাংলাদেশ ঘুরে
মাঝেমাঝে আমাদের দেখা হতো। হঠাৎ। মাঝে মাঝে আমরা গিয়ে বসতাম কবি নাজমুল হক নাজুর মাহমুদ কম্পিউটারে। কিন্তু জড়ো হবার মতো যথেষ্ট আড্ডাবাজ আর তখন সিলেটে নেই। আমি স্থায়ী ঠিকানা ধরে আছি সিলেট; কিন্তু বছরের নয় মাস থাকি বাইরে
আমরা কেউ কেউ এখনও লিখি। কিন্তু লেখা নিয়ে আর কথা বলি না বিশেষ। অমরত্বের দাবি প্রায় ছেড়ে দিয়েছি সবাই। আমাদের এখন আর কোনো গোত্র নেই। আমরা একা একা
আর কিশওয়ার?
অন্যদের কথা জানি না। আমার এবং সেতুর কথা জানি। দু হাজার ছয়ের সেপ্টেম্বরে লেখা সেতুর উপন্যাস; অকাল বোধন’এর বিশাল অংশ জুড়ে কিশওয়ার। একই সময়ে লেখা আমার গল্প আর নাটক; আন্ডুল’এ উদ্ধৃতিসহ কিশওয়ার আর তার কবিতা। বাইরে না থাকলেও আমাদের ভেতরে কিশওয়ার আতঙ্ক রয়ে গেছে অবিকল
কিশওয়ারের সাথে আমার দেখা হয় একটু বেশি। ...কবি দিলওয়ার এক জীবন্ত বিশ্বকোষ। শয়তানের মতো স্মরণশক্তি লোকটার। পঞ্চাশ বছর আগে পড়া কবিতার লাইন কিংবা ইতিহাসের তারিখ নির্ভুলভাবে বলে যেতে পারেন। আমার এখনও ধারণা দিলওয়ার সারা জীবনে যা পড়েছেন সবই তার মুখস্থ। নিজের সমগ্র রচনাবলি মুখস্থ তার। এই বিশ্বকোষের প্রতি আমার লোভ ছিল। আমি প্রায় প্রতিদিনই গিয়ে হাজির হতাম তার বাড়িতে নিজেকে আপডেট করার জন্য। নিয়মিত। এ নিয়ে সেতু কিংবা রশীদরা আমাকে খোঁচাও মারতো। কেউ বলত দিলওয়ারের চ্যালা। কেউ বলত দালাল। বলার যে একেবারে কারণ নেই তা নয়। অনেক দিলওয়ার ভক্ত অনেক হাসির খোরাক জুগিয়েছে সিলেটে। তখনকার কবি আর বর্তমানে সাংবাদিক ইখতিয়ার উদ্দিন এর মধ্যে একজন। কবি হয়ে উঠার প্রথম যুগে তিনিও নিয়মিত যেতেন দিলু ভাইর বাড়িতে। আশীর্বাদ আর সার্টিফিকেট নিতে। দিলু ভাই সবাইকেই আশীর্বাদ দেন। সার্টিফিকেট দেয়াতেও অকৃপণ। কিন্তু ইখতিয়ার ভাইকে তিনি আশীর্বাদ আর সার্টিফিকেটের বাইরে একটা বিড়ালের বাচ্চা ধরিয়ে দিলেন। বললেন- যতদিন এই মার্জার শাবকটি তোমার কাছে থাকবে ততদিন ভাববে আমার আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে আছে
ইখতিয়ার উদ্দিন তো হাতে আকাশ পেলেন। মুসা নবী আল্লার দেখা পেয়ে যত খুশি হয়েছিলেন তার থেকে বেশি খুশি ইখতিয়ার উদ্দিন। স্বয়ং কবি দিলওয়ার নিজ হাতে একটা জীবন্ত আশীর্বাদ তুলে দিয়েছেন। এই ভাগ্য পৃথিবীতে ক’জনের হয়?
ইখতিয়ার ভাই থাকতো বোনের বাসায়। একটা ভাড়া বাসা; যেখানে মানুষকে থাকতে হয় গাদাগাদি করে; সেরকম একটা বাসায় নাচতে নাচতে বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন হাজির। ইখতিয়ার ভাই ঘোষণা দিলো এই বিড়ালকে বাসায় থাকতে না দিলে সেও থাকবে না। কী আর করা। বড়ো বোন আর দুলা ভাই মিন-রাজি হলেন। উপায়ও নেই। সিলেটে অনেকেই দিলওয়ারকে পীর মানে। দিলওয়ারের আশীর্বাদকে অপমান করলে সমাজে মুখ দেখানো কঠিন হয়ে যাবে। থাক। ইখতিয়ার উদ্দিনের সাথে তার বিড়াল বাচ্চাও থাক
তো... ইখতিয়ার ভাই কবিতা ছেড়ে বিড়াল ধরল। কিন্তু বিড়ালটা তার মতো কবি কিংবা বোন-দুলাভাইর মতো ভাড়া বাসায় থাকার কৌশল শিখল না। বাসাটিকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে লাগল হাগু আর মুতু পারপাসে। কিন্তু এ নিয়ে কথা বলবে কে?
একদিন ইখতিয়ার ভাই যখন বাসায় নেই তখন আপা বিড়ালটাকে ব্যাগে ভরে এক রিকশাওয়ালাকে দশ টাকা দিয়ে বললেন- এই টাকায় যত দূরের ভাড়া হবে। ঠিক তত দূরে গিয়ে বিড়ালটাকে ফেলে দিয়ে আসো
ততদিনে ইখতিয়ার ভাইর বিড়ালপ্রেম শেষ। বাসায় ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক বাবা। কবির আশীর্বাদের সাথে বেয়াদবি করে তাকে অভিশাপ কুড়াতে হয়নি। অভিশাপ যদি লাগে তবে আপার উপর দিয়েই যাবে। আপা সাহিত্য করে না। সুতরাং দিলওয়ারের অভিশাপে তার কবিত্ব বিনাশের কোনো আশংকা নেই। মাঝখান থেকে বেঁচে গেলো কবি ইখতিয়ার উদ্দিন
ইখতিয়ার উদ্দিন তখন তরুণ ছিলেন। কবি হতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু কবিতা করেন না এবং ঘোরতর সংসারী কিছু মানুষের দিলওয়ারের প্রতি আনুগত্য দেখে এখনও তাজ্জব বনে যেতে হয় আমার। কবি শহীদ সাগ্নিক। প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার। শমশের নগরে প্রতি বিষুদবার দুপুরে স্কুল ছুটি দিয়ে চার ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে এসে বসে থাকেন ভার্থখলায় দিলওয়ারের বাড়ি। দিলওয়ারের বাড়ি থেকে সুরমা নদী পার হলেই সিলেট শহর। একদিন সাগ্নিক ভাই বললেন তেরো বছরের মধ্যে তিনি সিলেট শহরে যাননি। অথচ একটা বিষুদবারও তিনি মিস করেননি দিলওয়ারের বাড়ি আসতে। ...তাও না হয় মানা গেলো। তিনি কবি। কবিরা সংসার করুক আর মাস্টারিই করুক তার মধ্যে উলটাপালটা থাকতেই পারে। কিন্তু ঘোরতর বামপন্থী গণসংগীত শিল্পী ভবতোষ চৌধুরী আর কট্টর মৌলবাদী এবং জামাতের পত্রিকা দৈনিক জালালাবাদের সম্পাদক মুকতাবিস উন নূর যখন দিলওয়ারকে মাঝখানে রেখে সোফার দুই পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেন তখন আমাকে বোবা হয়ে যেতে হয়। ...এই দুই বিপরীত মানুষের দিলওয়ারকে নিয়ে কীর্তিও কম না। ভবতোষ চৌধুরী তার বিয়ের আসরে দাবি করে বসে যে তার বিয়েতে পুরোহিতের কাজ করবেন দিলওয়ার। ...খান মঞ্জিলের মৌলভীর ছেলে দিলওয়ার খান করবেন ব্রাহ্মণের দায়িত্ব পালন? অসম্ভব। ...কিন্তু ভবতোষ চৌধুরী অনড়- পৃথিবীতে যদি ব্রাহ্মণ বলে কেউ থেকে থাকে তবে একমাত্র কবি দিলওয়ারই আছে। বাকিরা ভণ্ড। কারণ সংজ্ঞা মতে যার ভেতরে স্বয়ং ব্রহ্মা বাস করেন তিনিই ব্রাহ্মণ
ভবতোষ চৌধুরী ঠাকুরদেরকে প্রশ্ন করে বসেন- এই চোরের দল; ব্রহ্মা আছে তোদের ভেতরে?
সবাই নিরুত্তর। ভবতোষ চৌধুরীই সমাধান দেন- ব্রহ্মা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা আছে একমাত্র কবি দিলওয়ারের ভেতরে। সুতরাং এখানে কবি দিলওয়ারই একমাত্র ব্রাহ্মণ। একমাত্র তারই অধিকার আছে বিয়ের পৌরোহিত্য করার
আর মুকতাবিস উন নূর? ঘোরতর ভিন্নমতের এই সংসারী লোকটা ঈদের নামাজ পড়ে সোজা চলে আসে দিলওয়ারের বাড়িতে। দিলওয়ারকে সালাম করে বাসায় গিয়ে সালাম করে তার বাবাকে। ...তাও না হয় গেলো। এরা দুজনই শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু শেখ মুজিবের বাকশালি শাসনের সময় লাল বাহিনীকে পিটিয়ে তক্তা বানানো মানুষ; রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী; ব-কলম নোয়াব আলী যখন এসে টানা বসে থাকে দিলওয়ারের সামনে তখন তার পীরাকির বিষয়টি মানতেই হয় আমাকে। ...পয়লা জানুয়ারি দিলু ভাইর জন্মদিন। একজন অ্যাডভোকেট আছেন। অরুণ ভূষণ দাস। বছরে মাত্র একটি কবিতা লেখেন তিনি। কবিতাটা দিলওয়ারকে নিয়ে। অ্যাডভোকেট অরুণ ভূষণ দাস প্রতি বছর পয়লা জানুয়ারিতে কবি দিলওয়ারকে নিয়ে লেখা বছরের একমাত্র কবিতাটি তাকে পড়ে শোনান। ...পার্টি ল্যাডি শিরিন ওসমান। কবিতা করেনও না। পড়েনও না। ধারে-কাছে দিয়ে যেতেও চান না। কিন্তু পারলে আঁচল দিয়ে দিলওয়ারের জুতা মুছে দেন...
দিলু ভাইর আজব ভক্তদের মধ্যে মাদ্রাসার হুজুরের সংখ্যাও কম নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে এরা দিলওয়ারের ঝাড়ি খায়। একদিন দেখি চারজন মাঝারি হুজুর বসে আছেন। দিলওয়ার বয়ান করছেন- বলোতো ইসলাম ধর্মে প্রথম নাস্তিকের নাম কী?
একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে
দিলওয়ার উত্তর করেন- মহানবী হজরত মোহাম্মদ সল্লাললাহু আলাইহিওস সল্লাম
হুজুররা আবার নিজেদের মুখগুলো ভালো করে দেখে নেয়। দিলওয়ার বলে চলেন- মোহাম্মদের ধর্মের প্রথম বাণী কী? লা ইলাহা। মানে হলো কোনো আল্লা নাই। তাহলে আল্লাকে অস্বীকারকারী প্রথম লোক কে? ...মোহাম্মদ
- জ্বি কবি-সাব
- তার পরে কী? ইল্লাললাহু। আছে একজন। কে সে? সেই আল্লা; মোহাম্মদ যার কথা বলে। ...ধর্মের শুরু হয় নাস্তিকতা দিয়ে। বুঝছ? সব ধর্মের ইতিহাসেই নাস্তিকতার অস্তিত্ব বিদ্যমান। ইসলাম ধর্মেও তাই
- জ্বি কবি-সাব
যে কোনোভাবেই হোক দিলওয়ারের এই পীরাকির মুরিদানার বাইরে থেকে গিয়েছিলাম আমি। দিলু ভাই সেটা জানতেন। এও জানতেন তাকে আমি বিশ্বকোষ ভাবলেও আমার বিস্মিত চোখ কিশওয়ারের দিকে। একবার নয়। বহুবার বহুভাবে দিলু ভাই আমাকে সতর্ক করেছেন- লীলেন। তোর মাঝে আমি কিশওয়ারের ছায়া দেখি। সাবধান যুবক...
আজ পর্যন্ত দিলওয়ারকে নিয়ে আমার একটা অক্ষরও প্রকাশিত হয়নি। একটা মাত্র কবিতার খসড়া আছে তাকে নিয়ে। কিন্তু কিশওয়ারকে নিয়ে আমার গদ্যের সংখ্যা বারো। কবিতার সংখ্যা আট। এ যাবৎকালের সবচেয়ে পরিশ্রমী আর দীর্ঘতম বইয়ের আলোচনা করেছি আমি কিশওয়ারের- সংঘর্ষ আলো অন্ধকার’ বইয়ের। আমি জানতাম না। অজান্তেই আমি ক্রমাগত লিখেছি কিশওয়ারকে নিয়ে। দু হাজার ছয়েও আমার গল্পে সরাসরি উঠে এসেছে কিশওয়ার। আমার প্রথম নির্দেশিত নাটকের সংলাপে কিশওয়ারে কবিতা আর তার বিবরণ। ...কেন? মূলত কাকে নিয়ে লিখেছি আমি?
আমি কিশওয়ারকে নিয়ে লিখিনি। আমার সব লেখাই আমার অনিবার্য আত্মপাঠ। আমি আমাকে নিয়েই লিখেছি। উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছি কিশওয়ারকে। কিশওয়ারের লাশ দেখতে এসে সবার হাতে হাতে ঘুরেছে আমার- মাংসপুতুল’এর ৪৩ নম্বর পাতা। একটি কবিতা- কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। অনেকেরই বিস্মিত ফোন ছিল- ২০০৪ সালের এই কবিতায় কী করে আমি কিশওয়ারকে এঁকেছি। কবি দিলওয়ারের প্রশ্নটাও ছিল তাই। আমি কাউকে কিছু বলিনি। আমি বলতে পারিনি ওই কবিতার নাম কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। কিন্তু কবিতাটা আমার নিজেকে নিয়ে। আমি কী কী হতে চাই না তার তালিকা এই কবিতা
আমার কিশওয়ার পাঠ শুরু তার সংঘর্ষ আলো অন্ধকার বই আলোচনা করতে গিয়ে ১৯৯২ সালে। আমার ভয় ছিল। কিশওয়ার অসুস্থ হবার আগে মাস্তান ছিল। একদিন কিশওয়ার বাড়ি থেকে বের হয়ে সামনে যাকে পেলো তাকে কিলঘুষি মেরে আমাকে বলল- তুমি আমার সেই সময়টা দেখোনি। তাই একটু নমুনা দেখালাম। ...দিলু ভাই সাবধান করেছেন যদি আমি কিশওয়ারের কবিতাগুলো ধরতে না পারি তবে একটা বিতিকিচ্ছি ঘটে যাবে। তিনি বলেছিলেন ছাপানোর আগে তাকে লেখাটা দেখাতে। আমি দেখাইনি। সোজা ছাপিয়ে দিয়েছিলাম। দীর্ঘ আলোচনা। প্রায় ছয় হাজার শব্দের লেখা। ...একদিন তার বাড়িতে কিশওয়ার আমার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলো- চাচা। তুমি আমার কবিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছ
- কেন?
- কোনো কবির কবিতা যদি কেউ ১০ পার্সেন্টের বেশি বুঝে ফেলে তবে সেই কবি ব্যর্থ। তুমি আমার অনুভূতি ৭০ ভাগ ধরে ফেলেছ
আর আলোচনাটি পড়ে দিলু ভাই আবারও আমার দিকে তাকালেন- লীলেন। সাবধান পুত্র। তুমিও কিশওয়ারের দিকে যাচ্ছ
তারপর থেকে কিশওয়ারের সাথে আমার একটা আলাদা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে যায়। অন্যদেরকে কিশওয়ার যা বলত না; আমার সাথে বলত সেসব বিষয়। তার কথা বলার অন্য কোনো বিষয় ছিল না। ছিল তার অসুস্থতা। ...কিশওয়ার গায়েবি আওয়াজ শুনত। কেউ যেন বাতাসে ভেসে ভেসে তার সাথে কথা বলে। ২০০৬ এর বই মেলায় ঢাকায় এসেও কিশওয়ার কয়েক ঘণ্টা বলেছে সেই বিবরণ। বলেছে- তুমি হয়তো এর একটি সমাধান দিতে পারবে। আমি কিশওয়ারকে তার কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছি- আমাকে হত্যা করো/প্রভুর আদেশে/ প্রত্যাদেশে প্রভুকে হত্যা করো/ আমার আদেশে/ আমি প্রভু/ প্রভু আমি/ প্রেমের পালক... বলেছি- লালন ফকির যেমন নিজেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুই সত্তায় ভাগ করেছিলেন। একটি ফকির লালন অন্যটি সিরাজ সাঁই। অন্তরাত্মার সিরাজ সাঁই সব সময় পথ দেখায় রক্ত মাংসের ফকির লালনকে। তোমার সেই অলৌকিক আওয়াজটিও তোমার। তোমারই অন্য সত্তা। যে মানুষ-কিশওয়ারের দুঃখ ও সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে থেকে অন্য কথা বলতে চায়
যাবার আগে আমি তাকে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলাম- তোমার ঔষধ হচ্ছে তোমার পুরোনো কবিতা পড়া। তিনদিন পরে ফোনে কিশওয়ার বলে- চাচা পারছি না। আমার পুরোনো লেখা আর ধারণ করতে পারছি না আমি। পুরোনো লেখা পড়লে অসুস্থ হয়ে যাই
মিনহাজ ব্যাংক ছেড়ে সিলেটে ফিরে কম্পিউটার ব্যবসা শুরু করে। আমাদের যত দলছুট উৎসবে-ছুটিতে নিজের শহরে ফিরে যাই তাদের এখন যাবার একমাত্র জায়গা মিনহাজের দোকান। ফোকাস আইটি। বছরে দেড় বছরে আমার যাওয়া পড়ে দুয়েক দিনের জন্য। সারাদিন ঘুমাই। বদলে যাওয়া শহরে আমার মানুষেরা বেশিরভাগই আর নেই। যারা আছে তারা ঢুকে গেছে সংসারে। ...আমি হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হই মিনহাজের দোকানে। সেখানে মিনহাজকে ঘিরে একদল তরুণ লেখকের আড্ডা হয়। এই তরুণরা লেখক হিসেবে আমাকে গোনে না। গোনে মিনহাজের ফ্রেন্ড হিসেবে। গেলে দুয়েকটা কথা বলে। সাহিত্য নিয়ে নয়। সাহিত্য নিয়ে তারা আলাপ করে আহমেদ মিনহাজ কিংবা মোস্তাক আহমাদ দীনের সাথে। আমার সাথে রাজনীতি কিংবা সমাজ-টমাজ নিয়ে কথা বলে। সেখানে কিশওয়ারও হাজির হয় মাঝে মাঝে। গত রোজার ঈদে। ঈদের বন্ধ আর অবরোধ মিলে একটানা নয়দিন থেকেছি সিলেটে। প্রতিদিন গেছি মিনহাজের ওখানে। আমার কোনো ঈদ নেই। লম্বা বন্ধে মা-বাবাকে দেখতে যাই আমি। দেখতে যাই কথাটাও ঠিক নয়। গিয়ে আমি সারাদিন ঘুমাই। এতেই তারা অনুভব করেন তাদের ছেলে বাড়িতে এসেছে। আর আমি মনে করি মা-বাবার কাছেই থাকলাম। ...ফিরে আসার বাসের টিকিট করা ছাড়া সিলেটে কিংবা বাড়িতে আমার কোনো কাজ নেই আর। আমি ঘুম থেকে উঠে চলে আসি মিনহাজের দোকানে। তারও ঈদ নেই। এই শহরে ঈদের দিন একটা মাত্র দোকান খোলা থাকে। মিনহাজের ফোকাস আইটি। কখনো মিনহাজ একা বসে থাকে। কখনো তার শিষ্যরাও থাকে। ...এবার প্রতিদিনই কিশওয়ার ছিল। আড্ডার অন্যদের থেকে একটু দূরে এসে আমার সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলেছে কিশওয়ার- চাচা; কী মনে করো তুমি? আমি কি নবুয়ত পেয়ে গেছি?
মিনহাজ তখন ভেতরের ঘরে শিষ্যদেরকে তার উপন্যাস- উল্টোরথের মানুষ’ পড়ে শোনাচ্ছে। আমি কবি কিশওয়ারকে মনে করিয়ে দেই কোন কোন কবিতা সে লিখেছে। দু আঙুলে প্রচণ্ড চাপে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে কিশওয়ার শিশুর মতো তাকিয়ে থাকে- হয়তো বা সত্য। হয়তো আমি এসব লিখেছি। কিন্তু... আমি আর এখন লিখতে পারি না। লেখা ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই। মাথার ভেতরে কী যেন হয়। যন্ত্রণা হয়। এই যন্ত্রণা ভুলতে আমি লিখতে বসি। লেখা হয় না; লেখার সাথে কুস্তি করি। যতক্ষণ এই শব্দগুলোর সাথে থাকতে পারি ততক্ষণ সুস্থ থাকি। লেখা শেষ হয়ে গেলে আবার অসুস্থ হয়ে যাই। তোমরা সবাই ব্যস্ত। শুধু আমার কোনো কাজ নেই; যাবারও জায়গা নেই। মাঝেমাঝে মিনহাজের এখানে আসি। মিনহাজের সাথে গল্প করি। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাল্লাগে না। এখানে যারা আসে তারা আমাকে কবি বলে ভাবে কি না সন্দেহ আছে। আমি জানি তারা আমার কোনো লেখা পড়েনি। তারা শুধু শুনেছে আমি কবিতা লিখি। ...ভাল্লাগে না আমার
কিশওয়ার স্পষ্ট করেই জানতো মস্তিষ্কক্ষয়ি রোগটি তার কবিতাকে আক্রমণ করেছে। একেবারেই স্পষ্ট। শেষবার যখন তার সাথে দেখা হয় তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অসুস্থতার লক্ষ্মণ আমি দেখিনি। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের মতো কিশওয়ার তার অসুস্থতা নিয়ে কথা বলেছে। ২০০৬ এ যখন তার কবিতা সমগ্র বের হয় তখনও তাকে সুস্থই মনে হয়েছে আমার। বইটা বের করতে তাকে নিষেধ করেছিলাম। তার বাড়িতে গিয়ে বলেছিলাম কবিতা সমগ্র যেন বের না করে। বরং নতুন একটা কবিতার বই করতে বলেছিলাম তাকে। কিন্তু কবি দিলওয়ারের কবিত্বধ্বংসী অনুচর চক্রের কাছে কিশওয়ারকেও হার মানতে হয়েছে। দিলওয়ারের মুরিদরা তাকে দেবতার মতো পূজা করে। তাকে মাথায় তুলে রাখে। কিন্তু তারা কেউ সাহিত্যের লোক নয়। সাহিত্য তারা পড়ে বলেও মনে হয় না আমার। এরকম সাহিত্যবিবর্জিত দিলওয়ার পূজারিদের সমন্বয়ে তৈরি কবি দিলওয়ার পরিষদ। তারা ব্যক্তি দিলওয়ারকে বাঁচিয়ে রাখে কবিতার জন্য। কিন্তু আমার ধারণা দিলওয়ারের সবচে বেশি ক্ষতি করে তারাই। তারাই দিলওয়ারকে কবিতা থেকে পীরত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই পরিষদই সিদ্ধান্ত দেয় কবি দিলওয়ারের কোন বই বের হবে। কে বের করবে সেই বই। ...জঘন্য। জঘন্য তাদের রুচি। তারা না বোঝে কবিতা না বোঝে প্রকাশনা। তারা বোঝে টাকা জোগাড় করা আর দিলওয়ারের নামজপ। দিলওয়ারের এ পর্যন্ত যত বই প্রকাশ হয়েছে তাতে ভুল এবং আনাড়িপনার পরিমাণ এত বেশি যে পড়তে গেলে লজ্জা লাগে। আমি একবার দিলু ভাইকে বলেছিলাম তার একটা বই আমি বের করতে চাই। তার একশোটি অপ্রকাশিত কবিতা দিতে বলেছি আমি। সেখান থেকে বাছাই করব চল্লিশটি কবিতা। আমিই ছাপাব। দিলওয়ার রাজি হয়েছিলেন। খুশি হয়েছিলেন। ...কিন্তু সময়মতো জানতে পারলাম দিলওয়ারের বই বের করতে হলে আমাকে কবি দিলওয়ার পরিষদের পারমিশন নিতে হবে। কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও মানতে হবে তাদের মতামত
দিলওয়ার জীবিত থাকা অবস্থায় অন্য কারো কাছ থেকে তার কবিতা প্রকাশের পারমিশন নেয়া আমার কাছে অপমানজনক মনে হয়েছে। আমার জন্য নয়। কবি দিলওয়ারের জন্য। আর সাহিত্যের ধারে কাছে নেই এমন কোনো মানুষকে কবিতা নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত করা লজ্জাজনক মনে হয়েছে আমার
দিলওয়ারের বাড়ি থেকে সবুজ পত্র নামে নিয়মিত একটা পত্রিকা বের হয়। বহুবার বলেছি আমি। আমাদেরকে দিন; পত্রিকাটা আমরা করে দেই। বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে ভালো প্রকাশনা করে শুদ্ধস্বর। দিলওয়ার সেটা জানেন। প্রতিবার শুদ্ধস্বর থেকে বের হওয়া বইগুলো দেখেন আর শুদ্ধস্বরের সম্পাদককে অভিনন্দন জানান অকৃপণভাবে। বহুবার বলেছি পত্রিকার লেখাগুলো কুরিয়ারে তুলে দিলেই হবে। ...কিন্তু না। আমাকে কিংবা আমাদেরকে দেয়া হয়নি
কবি দিলওয়ার পরিষদই বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে কিশওয়ারের প্রকাশনাগুলো দেখে। দিলওয়ার যেমন সারা জীবন মার খেয়েছেন প্রকাশনায়। কিশওয়ারও তাই। ...কবি দিলওয়ার পরিষদই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কিশওয়ারের সমগ্র বের করবে। ...আমার নিষেধ আর কে শোনে?
আমার আপত্তির কারণ আমি কিশওয়ারকে বলেছি। কিশওয়ারের বর্তমান লেখাগুলো বেশিরভাগ তার অভ্যাসের শব্দ বিন্যাস। কবিতায় তার শক্তির প্রকাশ দুর্লভ পর্যায়ে এখন। আমি চাইনি কবিতা সমগ্র ছাপানোর নামে দুর্বল কবিতাগুলো ভালো কবিতার সাথে ছাপা হোক। কিন্তু তারা কিশওয়ারের কবিতা সমগ্রই বের করলেন। বই প্রকাশনা উপলক্ষে কিশওয়ার ঢাকায় এলো বইমেলায়। কিশওয়ার একা দূরে কোথাও চলাফেরা করতে পারে না। সাথে থাকে ছোটভাই কামরান ইবনে দিলওয়ার। এক অদ্ভুত ছেলে কামরান। আক্ষরিক অর্থে সে কবি দিলওয়ারের সেক্রেটারি। দিলওয়ার এখন আর হাতে লিখতে পারেন না। মুখে বলেন আর কামরান কাগজে লেখে। প্রতিদিন দিলওয়ারের জন্য বিভিন্ন পত্রিকা কিনে আনা। তার লেখা পোস্ট করা। চিঠির অনুলেখন। সব। সব করে কামরান। ...নিজেও সে লেখে। চাকরি করে ব্যাংকে। কিন্তু তার নিজস্ব কোনো সময় নেই। সবগুলো সময় সে ছেড়ে দিয়ে দিয়েছে দিলওয়ার আর কিশওয়ারের জন্য। কামরান ছাড়া দিলওয়ার এখন ঘরের বাইরে একটাও পা দেন না। তার সমস্ত লেখা এবং চিঠির তত্ত্বাবধান করে কামরান। পাশাপাশি কিশওয়ার কোথাও গেলে সেখানেও গাইড কামরান
কবিতা সমগ্রে পুরোনো কবিতার সাথে তার নতুন অনেকগুলো কবিতা ছাপা হয়েছে। ফিরে যাবার পরে কিশওয়ার একবার বলেছিল- তোমার যদি ইচ্ছে হয় তবে কিছু একটা লিখতে পারো
- না চাচা আমি তোমার এই বইটা নিয়ে কিছু লিখতে চাই না। ...তোমার লেখা নিয়ে আমি যেভাবে আলোচনা করতে চাই এই বই আলোচনা করলে আমি তা পারব না। থাক চাচা
কিশওয়ার দ্বিতীয়বার আর বলেনি কিছু। আমিও না। আমি কিশওয়ারকে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া উন্মাদ হিসেবে বিচার করতে চাই না। কিন্তু কিশওয়ারকে নিয়েই আমার লেখার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। তার মতো কবিদের প্রতি কোথায় আমার অন্য রকম এক টান আছে। তারই সমসাময়িক তার বন্ধুরা প্রায় সবাই একই রোগে আক্রান্ত। আশির দশকের কবিদের এই এক বিস্ময়কর মিল। পুরো দশকটাই সিজোফ্রেনিক। অনেককেই এর কারণ জিজ্ঞেস করেছি আমি। অনেকে অনেক রকম উত্তর দিয়েছেন। কবি মোহাম্মদ রফিকের উত্তরটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে আমার। একবার তার একটা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্নটি করে বসেছিলাম আমি
মোহাম্মদ রফিক একটু ভাবলেন। বললেন- ষাটের দশকে পুরো জাতিটাই মানসিকভাবে ছিল উদ্বাস্তু। মানসিকভাবে সবাই ছিল রাস্তায়। তাই কবিরাও ছিল রাস্তার মানুষ। আশির দশক ছিল জাতির জন্য ঘর গোছানোর সময়। অথচ তখনকার তরুণ কবিরা নেমে এলো রাস্তায়। হয়তো এই কারণেই তারা এমন...
এই দশকের অন্য দুই কবি শোয়েব শাদাব আর বিষ্ণু বিশ্বাসও এই রকম। শোয়েব শাদাবকে বাড়িতে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। বিষ্ণু বিশ্বাস ঘুরে বেড়ায় কলকাতায় ট্রেন থেকে ট্রেনে। এদের কোনো বই আমার কাছে নেই। প্রতি বছর বই মেলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে গাণ্ডীবের স্টলে শোয়েব শাদাব আর বিষ্ণু বিশ্বাসের একটি করে বই প্রদর্শন করা হয়। বিক্রি করা হয় না। কাউকে দেয়া হয় না। শুধু প্রদর্শন করা হয়। দুহাজার ছয়ের মেলায় আমি গাণ্ডীব সম্পাদক তপন বড়–য়ার পায়ে ধরতে বাকি রেখেছি শোয়েব শাদাব আর বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতার বইগুলোকে ফটো কপি করতে দেয়ার জন্য। তিনি আমাকে বিশ্বাস করেননি। বললেন মেলার শেষে শাহবাগ থেকে যেন নিয়ে যাই। তিনি দাঁড়িয়ে থেকে ফটো কপি করাবেন। কিন্তু বহু দিন। বহুদিন... তার পেছনে ঘুরেও বই দুটোর একটা কপি করতে পারিনি। তিনি বললেন কে নাকি নিয়ে গেছে। ...এইবার। দুহাজার সাতেও গাণ্ডীবের স্টলে বই দুটো আছে। তিনি আমাকে ডেকে বললেন আমার কথা তার মনে আছে। মেলার পরে মার্চে যেন শাহবাগ থেকে বইগুলো ফটোকপি করাই
কে জানে হয়তো এবারও তিনি বলবেন বইগুলো কোথায় তিনি জানেন না। হতে পারে। তিনি গম্ভীর মানুষ। তার সাথে বেশি কথা বলা যায় না। তার আশেপাশে সবাই গম্ভীর এবং বিশিষ্ট চেহারার ভাবুক এবং বোদ্ধা মানুষ। আমার চেহারাটা চাষা মার্কা। আমি যে কবিতা পড়তে পারি সেটাও হয়তো তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। হয়তো তিনি ভেবেছেন আমি শোয়েব আর বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা পড়লে বাংলা সাহিত্যের ওজু নষ্ট হয়ে যাবে। ...হতে পারে। তিনি বিশুদ্ধবাদী মানুষ। যারা আধাশুদ্ধবাদী তারাও আমাকে কবিতার পাঠক হিসেবে মানতে আপত্তি তোলেন। লেখক হিসেবে তো প্রশ্নই উঠে না। আমার অনেক দোষ। আমি লিখি দৈনন্দিন শব্দে; তাতে সাহিত্যের সতীত্ব থাকে না। আমি পশ্চিম বাংলার কবিতা পড়ি না; ওগুলো দেখলে আমার কাঁটাচামচ দিয়ে ইলিশমাছ খাওয়ার চেষ্টা বলে মনে হয়। ওসব কবিতায় অভিধানের বাইরে কোনো বাংলা শব্দ নেই। ওরা মেশিনের মধ্যে অভিধান থেকে শব্দ ঢেলে কবিতা বানায়
এই কারণে আমাকে অনেকেই নমশূদ্র হিসেবে ধরেন। অনেকেই জাতে উঠার পরামর্শ দেন। জীবনানন্দের কবি কিংবা না-কবি যে কোনো একটা জায়গায় আমাকে দাঁড়াতে বলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি সেই ডায়লেকটিক থেকে যাই। শব্দ নয়; ফর্ম নয়; বিষয় নিয়েই আমি কবিতা করি মুখের ভাষায়
আরো দোষ আছে আমার; আমার বইয়ের ফ্ল্যাপে- এই লেখক ধেয়ে আসছেন’ ‘তেড়ে আসছেন’। কিংবা- ফাটিয়ে দিচ্ছেন’ জাতীয় কোনো লেখা থাকে না। আমার ফ্ল্যাপে আমি নিজের কথা নিজে লিখি। প্রথম ফ্ল্যাপে ‘অন্দরঘাট’ নামে থাকে একটি কবিতা। এই কবিতাটি বই সম্পর্কে আমার ভাবনা। আর শেষ ফ্ল্যাপে ‘সদরপাট্টা’ নামে থাকে আমার নিজের সম্পর্কে কথা। ...আমার বইয়ে সিনিয়র কারো সার্টিফিকেটও ছাপাই না আমি। আমি বলি- অত বড়ো বই যখন লিখতে পারলাম তখন কয়েক লাইনের ফ্ল্যাপ লিখতে কি হাতে কুষ্ঠ হয়? তাছাড়া আমার থেকে আমার বই কিংবা আমার সম্পর্কে বেশি জানে কোন হালা?
সিনিয়রদের ব্যাপারে আমার কিছু আপত্তিও আছে। তারা বেশিরভাগই ক্লান্ত মানুষ। তাদের পরের জেনারেশনের কারো লেখা তারা পড়েন কি না আমার সন্দেহ আছে। যদিও সাক্ষাৎকারে অনেক তরুণের নাম তারা বলেন। বলেন যে অমুক অমুকের লেখা সম্ভাবনাময়। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে তারা যেসব তরুণের নাম বলেন সেইসব তরুণের সবাই হয় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক না হয় কোনো লিটল ম্যাগাজিনের কর্ণধার। সম্পাদনা করেন না এমন কোনো তরুণ লেখকের নাম আমি কোনো সিনিয়র লেখকের মুখে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। হয়তো যারা সম্পাদক নয় তাদেরকে সিনিয়র কবিরা কবিতার কল্কে দিতে নারাজ
আমি সিনিয়র কবিদের একটু এড়িয়েই চলি। তারা কাউকে পেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত স্মৃতিকে সাহিত্যের ইতিহাস বলে চালিয়ে দিতে চান। ...আমি দূরে থাকি। নিজের কথা নিজেই লিখি। এবং দুয়েকজন যদি সেগুলো পড়ে তবে তাদের গালাগাল শোনার জন্য প্রতিটা বইয়ে-উড়োসংযোগ’ নামে আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে দেই। ব্যাস
- থুতনির দাড়িতে পাক ধরে গেলে স্বপ্ন দেখার আর থাকে না সময়
এই লাইনটি লিখে আমি সিলেট ছেড়ে এসে স্থায়ী হয়ে যাই উদ্বাস্তু নগরে। একটা পাক্কা গোলাম হোসেন। বন্ধুরা খুশি হয় আমার হুশ হয়েছে বলে। একমাত্র কিশওয়ারই আমাকে বলে- তুমি ফিরে এসো মাতৃক্রোড়ে। এই স্বার্থপর নগরীতে তুমি ক্রমাগত একা হয়ে যাবে লীলেন
কিশওয়ারের কথাটা এবারের বইমেলায় আবারও মনে পড়ল ক্যামেলিয়ার একটা কথা শুনে। ক্যামেলিয়া আলম আমার নাটকের ফ্রেন্ডদের মাঝে একমাত্র মানুষ যে লেখক ফ্রেন্ডদের সাথে অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে। সাধারণত লেখক আর নাটকের লোকরা কোনোদিন অ্যাডজাস্ট করতে পারে না। লেখকরা নাটকের লোকজনকে ধান্দাবাজ আর মূর্খ বলে এড়িয়ে চলে আর নাটকের লোকরা লেখকদেরকে বলে পাগল-ছাগলের দল। কিন্তু ক্যামেলিয়া আলাদা। বইমেলায় শুদ্ধস্বরের স্টলে কথা বলতে বলতে সে বলল বিশ বছরের পুরোনো দুই ফ্রেন্ডের ফোন নম্বর সে ফেলে দিয়েছে। বলল তাদের সাথে তার আর কোনো দরকার নেই
দরকার শেষ হয়ে গেলে বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যায়। দরকার নেই তাই বন্ধুদের নম্বর ফেলে দিতে হয়। বন্ধুত্ব করতে হয় দরকার বুঝে...। অপ্রয়োজনীয় কোনো মানুষের বন্ধু হিসেবে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই...। এটাই নাগরিক নিয়ম
৯৭ তে ডাসের উল্টোদিকে টিএসসির দেয়ালে বসে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে ক্যামেলিয়াকে বলেছিলাম উইলিয়াম জোন্সের- দুর্বলতার জন্য ভালবাসার থিওরি। এক ছেলে শহরে এসে স্টার হয়ে যায়। সবার মনোযোগ তার দিকে। সে হঠাৎ আবিষ্কার করে কেউ তাকে ভালবাসে না। তার দুর্বলতাকে ভালবাসে না শহরের কেউ। সবাই তার গুণকে ভালবাসে। গুণের জন্য তাকে সমাদর করে। এমনকি তার প্রেমিকাও তাই। ...ছেলেটি কাউকে কিছু না বলে ফিরে যায় গ্রামে। গিয়ে চিঠি লিখে তার প্রেমিকাকে- এই গ্রাম আমাকে আমার শৈশবের দুর্বলতম মুহূর্ত থেকে চেনে। এই গ্রাম আমার দুর্বলতাকে স্নেহ দিয়ে পূরণ করে দেয়। কিন্তু তোমাদের শহর কারো দুর্বলতাকে সহ্য করে না। সমাদর করে গুণের। ...আমার ভয় হয় আমার গুণ একদিন আর তোমাদের মুগ্ধ করতে পারবে না। তখন তোমাদের চোখে পড়বে আমার ক্ষমাহীন দুর্বলতাগুলো। তখন তোমরা সবাই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তা হবে আমার জন্য অনেক বেশি কষ্টের। তাই তোমাদের সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া সত্ত্বেও আমি ফিরে এলাম গ্রামে। যে গ্রামে আছে দুর্বলতার জন্য স্নেহ; ভুলের জন্য প্রেম
দশ বছর পরে ধ্বক করে মনে পড়ল সেই ঘটনা। মনে পড়ল কিশওয়ারের কথা- জন্মান্ধ হয়ে/ মহানগরীর বুকে/ ছাইভষ্ম ছাড়া কিছুই পাবে না... ফিরে এসো গণ্ডগ্রামে/ মহানগরীর চাতুরী, ছেনালী,
ছুঁড়ে ফেলে দাও... ফিরে এসো মাতৃক্রোড়ে
নাহ। না হতে পারলাম নাগরিক মানুষ; না হতে পারলাম আধুনিক। তাহলে? তাহলে কি কুমকুম আপার ক্যালেন্ডার মেনেই নিজেকে ফিরিয়ে নেবো আমি? ...কুমকুম আপা নাটকের দল- কথাকলি’র মানুষ। আমাদের নাটকের ছোটবেলায় একবার আমি বলেছিলাম চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে যদি কিছু না করতে পারি তবে একচল্লিশ নম্বর জন্মদিনে আত্মহত্যা করব। নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবো। অনেকেই শুনেছে এরকম কথা আমার মুখে। কিন্তু কুমকুম আপা মনে রেখেছে কথাটা। যখনই তার সাথে দেখা হয়। হোক তা দু তিন বছর পরে পরে। যখনই দেখা হয়; কুমকুম আপা বছর মাস দিন ধরে বলে দেয়- আর অত বছর অত মাস অতদিন বাকি তোমার। দেখি তুমি তোমার কথা রাখো কি না
আমার প্রতিটা বইয়েই সরাসরি মানুষের নামে একটা না একটা কবিতা থাকে। সরাসরি মানুষ। মাংসপুতুল’এ একটা কবিতার নাম শফিক আহমেদ জুয়েল। নাটকে আমার প্রথম শিক্ষক। প্রথম পাঠ তার কাছে পাওয়া- পা ভেঙে দাঁড়াতে হয় না ছেলে। মঞ্চে পা আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হয়
জুয়েল ভাই মারা গেলেন ২০০৬ এর অগাস্টে। একই বইয়ে আরেকটি কবিতার নাম কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। কিশওয়ার মারা গেলো ডিসেম্বরে। ...৯১ এর অগাস্টে মারা গেলো লোপা। যে বলত কাঠ কাটতে কাটতে যেমন কাঠুরে হওয়া যায়। লিখতে লিখতেও তেমনি লেখক হওয়া যায়। লেখালেখি অলৌকিক কিছু নয়। লেখালেখি একটা প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হতে হয়। সেই লোপা মারা গেলো। ...পায়েল চলে গেলো কয়েকদিন পরে। আর আমি ধর্ম খুঁজতে খুঁজতে ৯২ তে দেড় মাস হাসপাতালে থেকে ফিরে এসে হয়ে উঠলাম ঈশ্বরহীন। লোপা- পায়েল এবং ঈশ্বরের অভাব যখন পূরণ করতে যাচ্ছিলাম নিজেকে ক্ষয় করে। তখন টানা তিন বছর একটু একটু করে আমাকে আবার ফিরিয়ে আনলেন শামীমা আপা। নিজের হাতের উল্টো পিঠের মতো করে আমাকে চেনেন তিনি। আর আমি অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করলাম আমার ঈশ্বরের জায়গাটি তারপর থেকে তার হয়ে গেছে। অন্য মানুষ ঈশ্বরের কাছে যা চায়। মনে মনে আমি তার কাছে তা-ই চাই
আমার প্রথম বইয়ের শেষ কবিতার নাম শামীমা চৌধুরী। কিশওয়ার মারা যাবার পরে তিনি মোবাইলে মেসেজ পাঠালেন- হু ইজ নেক্সট ফ্রম ইউর বুক? ইজ শি শামীমা চৌধুরী?
আমি কোনো উত্তর করিনি। কোনো উত্তর নেই। খবরটা শোনার পরে কী করা উচিত তা খুঁজে বের করতে পারিনি আমি। খবরটা প্রথম দিলো জফির সেতু। সেই সেতু। যে সর্ব প্রথম আমার কথা সমর্থন করে বলেছিল- ঠিক। কিশওয়ার হতে চাই না
সেতুও কি অপরাধবোধে ভুগছিল এই প্রতিজ্ঞা করার জন্য? সেজন্যই কি তার লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে কিশওয়ার? সেজন্যই কি সর্বপ্রথম সে আমাকে জানায়- কিশওয়ার নেই লীলেন
সেতুর গলা কাঁপছিল টেলিফোনে- কিশওয়ার নেই
কিসের কাঁপন? কষ্টের নাকি দুঃস্বপ্ন কেটে যাবার উত্তেজনা? কিশওয়ার নেই মানে আমাদের না হতে চাওয়া একমাত্র আদর্শ আর নেই। সেজন্যই কি জফির সেতু আমাকে ফোনে খবরটা দিলো? আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য?
ঈশ্বরহীন হয়ে যাবার পরে আনন্দ আর দুঃখ কাটানো বেশ কঠিন আমার জন্য। অন্যরা যা করে আমি তা করতে পারি না। আমি হাঁটি। একা একা হাঁটি। আমার প্রথম বই বের হবার পর ফোন বন্ধ করে টানা এক ঘণ্টা হেঁটেছি একা একা। একা একাই আমি উদযাপন করি আমার উচ্ছ্বাস আর কষ্ট। কবি শামসুর রাহমান মারা যাবার খবর শুনে হাসপাতালে গিয়ে দেখি জনসমাবেশ। সবাই সবাইকে দেখাতে ব্যস্ত কে কত বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। আমি কিছুই করার পেলাম না। ক্যামেলিয়াকে বললাম- হাঁটবি?
রাজধানীর ইতর যানজটের ভেতর দিয়ে একেবারে নিঃশব্দে আমরা দুঘণ্টা হেঁটেছি। আমি আর ক্যামেলিয়া। শামসুর রাহমান অনেকের ছিলেন। না হলে অন্য কাউকে আমি হাঁটতে বলতাম না
সেতুর মুখে খবর শুনে আমার কষ্ট হয়নি। অবাক হইনি আমি। শুধু মনে হচ্ছিল ভেতরে কোথাও কিছু একটা হচ্ছে। কাউকে বলা দরকার। কাকে বলব? এই উদ্বাস্তু নগরীতে যাদের আশেপাশে আমি থাকি তাদেরকে কিশওয়ারের কথা বলা মানে তার কবিতাকে অপমান করা। কিন্তু... আমার অসুস্থ লাগছে...
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে বললাম- তোমার না হতে চাওয়া আতঙ্কের উদাহরণ কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার আর নেই। তুমি খুশি? ...এবার হাঁটো। প্রায় কবি হয়ে উঠা বস্তু ও বাস্তববাদী মাহবুব লীলেন হাঁটো
তিন ঘণ্টা হেঁটে নিজেকে ক্লান্ত করলাম। কিশওয়ারের একটা কবিতাই মনে হচ্ছিল সারাক্ষণ- অংক করো/অংক করো/ অংক মেলে না/ তুমি তো মানুষ ছিলে/ দেবতা ছিলে না
তিন ঘণ্টা পর মোবাইল খুলে চা খেতে খেতে নিজেকে প্রশ্ন করলাম- কিশওয়ার নেই। এবার কি তোমরা তোমাদের অংকগুলো মেলাতে পারবে লীলেন?
শিমুলকে বলা যায়। এ পর্যন্ত আমি যতকিছু লিখেছি সব সে শুনে নিয়েছে ফোনে। কেন শোনে জানি না। কিন্তু শোনে। প্রতিদিন। যতগুলো অক্ষর লিখি তার সবগুলোই শুনে ফেলে শিমুল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রাতের পর রাত। আমার সবগুলো ঘনিষ্ঠ মানুষের নাম সে জানে। জানে তাদের সাথে আমার সম্পর্কের সুতা। ...কিশওয়ারের খবর শিমুলকে দেয়া যায়। ফোন করলাম- আরেকজন গেলো। কিশওয়ার
শিমুল বলল না কিছু। একমাত্র শিমুলই ফোনে কিছু বলে না। আমাকে দিয়ে বলায়। আর বাকি সব ফোন আমি শুনি অন্যরা বলে। শিমুল ফোন ধরে বসে থাকল অনেকক্ষণ। একটাও প্রশ্ন না। একটাও কথা না। অনেকক্ষণ পরে বলল- খারাপ লাগছে?
- জানি না
ফোন রেখে দিলাম। রাতে গিয়ে হাজির হলাম হালকা আড্ডার কলাবাগানে। আড্ডাটি নাটকের। হঠাৎ মনে হলো একটা ছেলেকে কথাটি বলা যায়। বলা দরকার। ... ছয়ের সেপ্টেম্বরে চাঁদপুরে আমি আমার আন্ডুল নাটকটি শ্যুট করি। নাটকটিতে একটা পাগল আছে। সারাদিন বসে বসে হাবিজাবি অংক করে। যখন মেলাতে পারে না তখন লোকজন ধরে নিয়ে আসে অংক মিলিয়ে দেবার জন্য। কেউই তার অংক মেলাতে পারে না। তখন সে পাবলিককে কিশওয়ারের কবিতা শোনায়। তারপরেই প্রশ্ন করে- বলোতো কবিতাটা কার লেখা? ...উত্তরটা সে নিজেই দেয়- কিশওয়ার। কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। সেও অংক পারে না। মাথায় গণ্ডগোল
এই চরিত্রটি করেছে শুভ্র মাসুদ। নাটকের চরিত্র নিয়ে মিডিয়ায় কেউ দু-এক ইঞ্চির বেশি কিছু ভাবে না। সেটে গিয়ে ঝেড়ে দিয়ে আসে। কিন্তু কাস্টিং পাওয়ার পর শুভ্র কেমন যেন লাইনগুলোর মাঝে ডুবে গেলো। ...শুভ্রকে বললাম- তোমার সংলাপের কিশওয়ার মারা গেছে আজ বিকেলে
শুভ্র তাকিয়ে থাকল। অনেকক্ষণ পরে বলল- এখন রওয়ানা দিলে কি গিয়ে তাকে পাওয়া যাবে?
রাত প্রায় এগারোটা। সিলেটে সে পৌঁছাবে মাঝরাত কিংবা ভোরে। নিষেধ করলাম। শুভ্র আরো অনেকক্ষণ চুপ থাকল- ভাবছিলাম পরীক্ষাটা শেষ হলেই সিলেট গিয়ে এই কবিকে দেখে আসব... মারা গেলো...
আমি অনুমান করতে পারিনি কয়েকটা লাইন পড়ে কিশওয়ারকে এভাবে ধারণ করে আছে ছেলেটি। না হলে ফোন বন্ধ করে হাঁটা শুরুর আগেই খবরটা জানাতাম তাকে
আমি সিলেট গেলাম এক সপ্তা পরে। বহুদিন পরে গিয়ে হাজির হলাম কবি দিলওয়ারের বাড়িতে। দিলু ভাই আমার দিকে তাকালেন। স্থির। আমার মুখের উপর দুই চোখ স্থির করে বসলেন সোফায়- তোর যদি উপরে কেউ থাকে প্রার্থনা করার মতো। যদি তুই আমার শুভাকাক্সক্ষী হয়ে থাকিস তবে প্রার্থনা কর আগামী ছয় মাসের মধ্যে যেন আমি চলে যেতে পারি। আমার মৃত্যু কামনা করা ছাড়া এখন আমার জন্য আর কোনো শুভাকাক্সক্ষা নেই। আমি এখন দায়মুক্ত। ভারমুক্ত। চুয়াল্লিশ বছর বয়সের এই শিশু পুত্রটিকে রেখে যদি আমাকে চলে যেতে হতো তবে পিতৃত্বের কাছে দায়ী হয়ে থাকতাম আমি। তার জননী নয় বছর বয়সে তাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নিয়েছেন। ...আমি তাকে বলেছি। এই সোফায় মুখোমুখি বসে বলেছি- পুত্র তুমি আগে যাও। আমার আগে তুমি যাও পুত্র। তোমাকে যেন তোমার পিতা নিজের হাতে কবরে শুইয়ে রেখে যেতে পারে। এইটুকু দয়া আমাকে তুমি করো পুত্র। না হলে তোমার মায়ের কাছে আর আমার কবিতার কাছে আমি অপরাধী হবো। ...আমার পুত্র আমার অনুরোধ রেখেছে লীলেন
ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বললেন কিশওয়ারের পিতা দিলওয়ার- তার মৃত্যু প্রত্যাশিত ছিল। আমি দুঃখিত নই। এক ফোঁটাও কাঁদিনি... পুত্র আমার যাবার সময় কাউকে কষ্ট দেয়নি। সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছে যার যার মতো তখন সে তার যাবার বন্দোবস্ত করে সবার অজ্ঞাতে...। এইবার আমার জন্য প্রার্থনা কর। আমি যেন চলে যেতে পারি পুত্রের কাছে
এই বাড়িটাতে কোনো নারী নেই। কিশওয়ার আর কামরানের মা মারা গেছেন বহু আগে। তাদের মায়ের ছোট বোন এর পরে ছিলেন তাদের মা। ছিলেন বাড়ির অভিভাবক। তিনিও মারা গেছেন কয়েক বছর। বাড়ির এখন একমাত্র অভিভাবক কামরান। কামরানকে তার অবস্থা জিজ্ঞেস করতে অপরাধীর মতো হাসল- তুমিতো সবই জানো চাচা। বাড়ির যা অবস্থা...। আমার বিয়ের কথা শুনলেই কিশওয়ার ভাই মন খারাপ করে ফেলতেন। ...এখন...
ছোটবেলায় টিলার পেটে একটা গর্তকে আমি পিঠেপিঠি ছোট ভাই হিরণের কবর বলে জানতাম। আর নানা-বাড়ি যাবার পথে জবা ফুলের গাছ লাগানো বেড়া দেয়া একটা জায়গাকে জানতাম নানার কবর হিসেবে। কিন্তু কবরে কোনোদিনও কিছু করিনি আমি। শাহজালালের কবরের কাছে যেতাম গাঁজা খাওয়ার জন্য। সেই আমি আজ জীবনে প্রথম একটা কবর দেখতে গেলাম। কবরে আমার কোনো কাজ নেই। কবরে গেলে অন্যরা যা যা করে সেসব করার নেই আমার। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। কাঁচা মাটি বাঁশ দিয়ে ঘেরা। এটা কিশওয়ারের কবর। কিছু একটা ভাবতে চাইলাম। পারলাম না। একটা সিগারেট ধরিয়ে ছুঁড়ে দিলাম কবরের মধ্যে- নাও চাচা। বিড়ি খাও
হাঁটতে হাঁটতে কিন ব্রিজ পেরিয়ে ফিরে এলাম শহরে। কিশওয়ার পর্ব শেষ। শেষ কি? দিলু ভাই আজও মনে করিয়ে দিয়েছেন- নিজেকে দেখে রাখিস লীলেন...
কামরানের বিয়ের কার্ডটি এখন আমার টেবিলে। আজ ৯ ফেব্র“য়ারি। কিশওয়ারের মৃত্যুর অপেক্ষায় আটকে ছিল কামরানের বিয়ে। কিশওয়ার নেই তাই আজ কামরান বিয়ে করছে। কিশওয়ারের মৃত্যুর অপেক্ষায় আটকে ছিল দিলওয়ারের মৃত্যু। কিশওয়ার নেই এখন দিলওয়ার নিশ্চিন্তে মরতে পারবেন
আমার জন্য কোথাও কিছু আটকে নেই। আমি কিশওয়ার হইনি। হতে চাইনি। কিন্তু যদি দিলওয়ারের সতর্কবাণী ফলে যায়? ...কিশওয়ার এক পিতা পেয়েছিল; যিনি নিজের মৃত্যুকে আটকে রেখেছিলেন সন্তানের জন্য। কিশওয়ার এক বড়ো ভাই শাহীনকে পেয়েছিল; যে দেশান্তরি হয়েছে ছোট ভাইর জন্য। কিশওয়ার এক ছোটভাই কামরানকে পেয়েছিল; যে তার সংসার আটকে রেখেছিল বড়ো ভাইর জন্য
কিন্তু আমি? আমি যদি কিশওয়ার হয়ে যাই এই নগরীতে? যদি প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলি সবার কাছে?... হয়তো ক্যামেলিয়া এবং অন্যরা তাদের মোবাইল থেকে আমার নম্বর ফেলে দেবে অদরকারি মানুষ হিসেবে। ...কুমকুম আপাকে ফাজলামি করে বলা কথাগুলো স্মরণ করলাম আমি- কারো ঘরে কিংবা ঘাড়ে ভার হয়ে থাকব না আমি/ অদরকারি হবার আগেই প্রত্যাহার করে নেবে নিজেকে লীলেন
বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বাসে উঠে বসলাম। নিজেকে বললাম- আর পাঁচ বছর আট মাস এগারো দিন বাকি একচল্লিশতম জন্মদিনের। চলো
বাস ছেড়ে দিলো। মাঝরাতের মধ্যেই আমি পৌঁছে যাব ঢাকা। আর সকাল থেকে কাজে
# # #
২০০৭.০২.০৯ শুক্রবার- ২০০৭.০২.১২ সোমবার
মন্তব্য
তোমার গল্প বলার স্টাইলটা কোথায় যেন পাল্টেছে,ঠিক ধরতে পারছি না।তবে এই স্টাইলটিও খুব ভালো লাগছে।
লেখার প্রায় সবগুলো চরিত্রকে চিনি বলেই হয়তো অনেক বেশি একাত্ম হয়ে পড়লাম।
কবি দিলওয়ার পরিষদ সম্পর্কে তোমার ভাবনা গুলো সিলেটে প্রকাশ করা দরকার।
হাই লীলেন!! অতিথি লেখক হয়ে লিখছি। এখনো সচল হই নি। তোমার এই লেখাটা পুরো পড়ি নি। পড়বো সময় করে। নস্টলজিক প্রসঙ্গে এখানে আরেকটি চরিত্র সারওয়ার চৌধুরী তোমার সেই দিনগুলোতে জড়িয়ে ছিলেন না?
ভালো লিখেছো। হ্যাপি ব্লগিং।
সারওয়ার চৌধুরী
আবুধাবী
হোয়াজ দ্যা হেল, লীলেন ভাই?
শফিক ভাই মারা গেলো কেনো? ফাজলামী নাকি? এই লোকটা এতো তাড়াতাড়ি মারা গেলো লীলেন ভাই!
মান্নানহীরা আমাকে সিলেটের মঞ্চে তুলেছিলেন,কিন্তু তার আগের প্রথম পাঠ পেয়েছি এই লোকটার কাছে । মোনা আপা?
মোনা আপা কি সিলেটে?
এতো মৃত্যু,এতো চলে যাওয়া-অসহ্য!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
খুব সহজেই ভুলে যাওয়া কতোশতো প্রিয় মুখ...
দিলওয়ারের বাড়িতে কোনোদিন ঢুকিনি। পোড়োবাড়ি মনে হতো, মনে হতো ভুতুড়ে। কিশওয়ারকেও কখনও দেখিনি। যদিও সিলেট শহরে দু' বছর টো-টো ঘুরে বেড়িয়েছি।
এখানে বিভিন্ন ব্যক্তির একটা নিজস্ব বিশ্লেষণ আছে বা চরিত্রের ভিন্ন বর্ণনা আর পরিণতির উল্লেখ আছে। একারণেই কি এটা রোজনামজা বা আত্মজীবনী না হয়ে এটা গল্প?
যাদের কথা আছে তাদের মধ্যে শহীদ সাগ্নিককেই একমাত্র চিনি আমি। বারুদের শব্দ নামের এক বইয়ের খসড়া হাতে নিয়ে প্রকাশনার জন্য অনুদান চাইছিলেন আমার কাছে, মামার বন্ধু হিসেবে। বললেন, এই বই প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে একটা বিশাল সাড়া পড়ে যাবে। আমার মামা তখন প্রকাশনার জন্য টাকা তুলছেন নানা জনের কাছ থেকে। আমি খসড়া পড়ে বললাম, অনেক সম্পাদক তাদের পত্রিকায় এই বইয়ের একটা কবিতাও ছাপবেন না। শুনে আমার মামা খুব বিস্মিত হলেন। আহতও হলেন। সাগ্নিক মন খারাপ করলেন।
বই প্রকাশ হলো। যথারীতি কোথাও কোনো হুলস্থুল হলো না। মামা এসে আমাকে ধরলেন, আমি কীভাবে বুঝলাম এটা আলোড়ন তুলবে না। সাগ্নিক ও কবি দিলওয়ার তো সেরকম একটা ধারণাই তাকে দিচ্ছিলেন প্রতিদিন। আমার কিছু বলার ছিল না। বললাম, কবিতা বা কাব্যগ্রন্থও একধরণের বাস্তবতায় বাস করে। অনেক কবিরা সেই একই বাস্তবতায় বাঁচেন না।
ভন্ড নবী হয়। যাদের ওহি বাকীরা মস্তিষ্কের প্রলাপ বলে রায় দেয়। ভুল কবিও কি হয়? যারা গ্রাহক-যন্ত্রে ঠিকঠাক ওহিগুলো ধরতে পারে না, ঠিকঠাক শব্দে-বাক্যে-ছন্দে ওহিগুলো লিখে উঠতে পারে না।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
সেটাই।
মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। অপেক্ষায় রইলাম...
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
আমি গল্প লেখা আর কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি
এখন আমি গল্প করি
আর কবিতা করি
কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানি না
কিন্তু মনে হচ্ছে বলতে পারছি... যা বলতে চাই
আমার জীবনী জাতীয় কিছু একটা হবে এক সময়। ওটাতে আমার কোনো জীবনী থাকবে না। ওটাতে থাকবে শুধু বিভিন্ন সময়ে আমার আশেপাশের মানুষ আর সময়ের দৃশ্য। এর একটা গল্প নাটাঙ্গি এখানে দিয়েছি কয়েকদিন আগে। আজ আরেকটা দিলাম। ছায়ামুখ। এরকমই একেকটা গল্প আর ঘটনা ধরে তৈরি হবে সেই বইটা। এরকম একেকটা লেখা ওই বইয়ের এককেটা অধ্যায়
ওই বইটার এখন পর্যন্ত দুটো নাম মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ১. চিত্রল প্যাপিরাস। ২. হলুদ আদম
কয়েকদিন আগে একটা হলিউডী মুভি দেখছিলাম ।নাম সম্ভবত :"সিটি অব গড "।
কোন নির্দিষ্ট নায়ক নায়িকা জাতীয় কিছু নেই। শহরের বিভিন্ন ঘটনা একই সাথে প্যারালাল চলে।
হঠাৎ একটি চরিত্রের ওপর ক্যামেরা স্থির হয়,তারপর কেউ একজন বলে :"এটা অমুক।আসুন তার গল্পটি দেখি " তার গল্প শেষ হওয়া মাত্র সেই গল্পের অন্য কোন চরিত্রে ক্যামেরা স্থির। চলে অন্য গ ল্প ।
যতবার পড়ি ততবার গড়িয়ে পড়ে জল।
যতবার পড়ি ততবার ফ্ল্যাসব্যাকে জড়ো হয় স্মৃতি।
তোমার এই গল্পগুলো আমাদের অনেকের জন্য ইতিহাসের সূত্র।
ব্র্যাভো লীলেন ব্র্যাভো।
**হলুদ আদম -জফির সেতুর গল্পের নাম।
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
এই লেখাটা আমি কী করে আগে পড়লামনা?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
মহাকালে বিছিয়ে রাখলাম কিছু শব্দ কিছু সময়
হয়তো কোনোদিন কেউ না কেউ উঁকি দেবে বলে...
দুঃখিত হয়েছি, এ লেখাটা আগে পড়া হয় নি আমার। বিষণ্ন হয়েছি, কিছু কিছু চরিত্রকে চিনতাম বলে। অস্থির হয়েছি, লেখাটিতে ভাঙনের প্রবল শব্দগুলো ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো বলে। আত্মস্থ হয়েছি, সিলেটের একটা কালকে একটা সময়কে গভীর থেকে বহির্মূখী ধাক্কায় কম্পিত হতে দেখছি বলে। আর প্রসন্ন হয়েছি, পঠন তালিকায় আরেকটা ভালো লেখা যুক্ত হলো বলে।
আপনার গভীর বৃত্তের বাইরে থেকে আউটসাইডারের মতো কিছু কিছু বোধ করি দেখেছি আমিও।
ভবজব্বার দা মানে ভবতোষ চৌধুরীকে উদীচীতে পেয়েছি মিরাবাজারের সেই দোতলায়। ইখতিয়ার উদ্দীন আমার ব্যাচমেট এমসি-তে ছাত্রইউনিয়নের সহযোদ্ধা, বন্দর বাজারে অস্থির মিছিলে ঢিল খেয়ে তার উপরের পাটির দাঁত দুটো উড়ে যায় যখন আমি পাশেই।ছাত্র ইউনিয়নের তাপস ভট্টাচার্য, এরশাদ আমলে সামরিক আইনে সিলেটের প্রথম সাজাপ্রাপ্ত রাজবন্দী, সেও আমার ব্যাচমেট, এসব আরো অনেক অনেক।
আপনার কলমকে ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সে কব্জি আমার নেই। আছে স্মৃতি বিড়ম্বনা, যাকে ডাক্তাররা বলেন থাইরয়েড কমপ্লেক্স।
অভিনন্দন রইলো, মাহবুব লীলেন ওরফে লীলেন ভাই। সাথে শুভ কামনা। উদ্দিষ্ট সফল হোক।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আমার ধারণা আমার সব লেখাই আবর্জনা স্তূপে চলে যাবে শুধু একটা সংকলন ছাড়া
সেই সংকলনটা হবে আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন সময়ের কিছু চিত্রের গ্রন্থনা
এই লেখাটা সেই সংকলনেরই একটা অংশ আমি নিশ্চিত
যেই সংকলনটার নাম মনে মনে বলি- চিত্রল প্যাপিরাস...
অনেক দেরীতে হলেও অসাধারণ লেখাটি পড়লাম। প্রিয় পোস্টে যুক্ত হলো আরো একটি নক্ষত্র। ...জানি, এই মুগদ্ধতার ঘোর অনবরত আমাকে তাড়া করে ফিরবে। সেল্যুট!
--
অপ্রসঙ্গ: ইশ, যদি এমনি ভাষা শৈলিতে লিখতে পারতাম!...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
এরকম পাঠক লোভ যেমন জাগায় ভয় জাগায় তারও চেয়ে বেশি...
কি আশ্চর্য ! এই লেখা এতদিন আমার চোখ এড়িয়ে ছিলো !
অনেকটা ভাষাহীন হয়ে পড়েছি লেখাটা পড়ে। এত বড় একটা লেখা, এত সময় নিয়ে পড়লাম, তবু একটা অক্ষরও বাদ দিয়ে পড়ি নি। মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে গিয়েছি।
লীলেন ভাই, এই লেখার জন্য আপনাকে জাঝা
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
লেখার পরিমাণ বেশি হলে যা হয় আর কি
নিজেরই মনে থাকে না কোনটা কোন সময় লিখেছি কী নিয়ে
তবে এখন চিন্তা করছি
একটা রিপোস্ট উৎসব করব সচলায়তনে
প্রতিদিন দুইটা দু্ইটা পুরোনো লেখার লিংক দিয়ে একেকটা নতুন পোস্ট দেবো
হঠাৎ করে লেখাটা চোখে পড়লো। পড়ে ভালো লাগলো। ভালো লাগা জানালাম। ভালো থাকুন।
এই গল্পটি গতকাল রাতে পড়েছি। ঠিক এই সময়ে, কিংবা একটু আগে পরে হবে! ঘণ্টাখানেক ধরে এই লেখাটা নিয়েই পড়ে ছিলাম। চুপচাপ। একাএকা! পড়ছি একটা অংশ, আবার নীচে নেমেই উপরের দিকে উঠে আবার পড়ছি আগের অংশটা। পড়ছি, আবার আবার আবার... একই রকম পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। একটা গল্প। এই গল্পে কি আছে যদি আমাকে বলতে বলা হয়, কিংবা যদি বলি আমি কি পেয়েছি লেখাটাতে তাহলে বলব - এই গল্পটাতে আমি কিছুই পাইনি। কেননা গল্প তো পড়তে হয় উপলব্ধির জন্য। কিন্তু... এখানে তো উপলব্ধিই গল্প হয়ে উঠে এসেছে!! শরীরের পশমগুলি কাঁটা দিতে দিতে মিইয়ে গেছে। ... বলা যায় - একটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আবার উঠে এলাম বাস্তবতার নীল খাতায়... এখন ঘরে ফেরার পালা। জানিনা মাহবুব লীলেন এর নাম কয়জন সাহিত্য-পড়া মানুষ ইয়াদ রাখবেন, জানিনা কতজন পাঠক মাহবুব লীলেন এর কোন বই পড়েন, তাঁর কোন লেখা পড়ে কোন পাঠক অক্ষর হয়ে যেতে চেয়েছেন কিনা! ... জানিনা মাহবুব লীলেন বাংলাদেশের আবহমান কাল থেকে শব্দ খোঁজে এনে যে গদ্যের পীঠস্থান গড়ে তোলেন, সেই কাল এবং আঙিনাকে কেউ অনুভব করেন কিনা!! জানিনা! কিন্তু আমি হয়তো করতে শিখে গেছি।
শুধুই বাক্যহারা, স্তব্ধ, নীরব, কাঠপুতুল এবং বিধ্বস্ত...
ডাকঘর | ছবিঘর
তাপস শর্মা আমার মনের অনুভূতিগুলো বলে দিয়েছেন।
আমি রাস্তায় দাড়িঁয়ে আছি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে।
নতুন মন্তব্য করুন