গতরাতে বনানীর ওই বাড়িটির কলিং বেলে হাত দিতেই বুকটা কেঁপে উঠল, কি হবে, কি বলবো, কি করবো এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজা খুললেন প্রয়াত মুহম্মদ জুবায়েরের ছোট বোন। মুখমুখী দাঁড়াতেই স্বভাবতই চোখাচোখি হলো। আমি ঠিক আপার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, চোখ সরিয়ে নিলাম। কেন যেন এটা আমার হয়। সদ্য স্বজন হারানো কারও চোখে আমি চাইতে পারিনা। মনে হয় শোকাতুর চোখগুলি আমাকে ভৎসনা করে বলছে, “পারবে আমার স্বজন কে ফিরিয়ে দিতে, যদি নাই পার তবে কি দেখতে এসেছো?”
আপা বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন, আমিও কিছু বললাম না, উনিও তাই। দুজন দুজনের অনুভূতিগুলি পড়তে পারছিলাম। “ও লীনা ” শুনে চমকে তাকালাম, আনিস ভাবী (মুহম্মদ জুবায়েরের ছোট ভাইর বউ ) আমাকে দেখে ছুটে আসলেন। অস্বস্তি থেকে কিছুটা মুক্তি, মানে চোখটা অন্য দিকে তাকানোর কাজ পেল। বসার ঘরে ওনাদের মুখমুখি, তেমন কোন কথাও বলতে পারছিলাম না। অনেক সাহস করে খালাম্মার কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললো "ভিতরে আছেন", ভাবী ভিতরে খালাম্মাকে ডাকতে গেলেন। আমি বিবশ হয়ে বসে আছি, আবার একটা অসস্তিকর সময়ের অপেক্ষায়, কি বলব খালাম্মাকে, কতটা কষ্টই বা লাঘব করতে পারব ওনার, নাকি কিছুটা সামলে উঠা শোকের ক্ষতটা বাড়িয়ে দিতে এসেছি- কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
খালাম্মা এলেন, আমার দেখা অনেক বুদ্ধিমতি ও ভীষণ দৃপ্ত হৃদয়ের মানুষটি তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হেঁটে আসলেন, অনেক দৃঢ় পায়ে। কিন্তু বেশিক্ষন পারলেন না, আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, মা আমার অনেক বড় একটা সবর্নাশ হয়ে গেছে, আমি চিন্তাও করতে পারিনি এমন কিছু হবে আমার । আমি স্বভাবতই কিংকতব্য বিমুঢ়। কি বলব, কি করব বুঝতে পাচ্ছিলাম না। খাল্লামার হাত ধরে আমার পাশে বসালাম, শুধুই তার হাতটি ধরে থাকলাম, তার অর্থ হয়তো এমন- আপনাকে সান্তনা দেবার ভাষা আমার জ়ানা নাই, তবু বলি আপনি শক্ত হন ধর্য্য ধরুন।
এই পরিস্হিতি থেকে বাঁচালো আনিস ভাই (মুহম্মদ জুবায়েরের ছোট ভাই)। উনি তখুনি অফিস থেকে ফিরলেন । সঙ্গে এলেন অভিনেতা আফজাল হোসেন। খালাম্মার সামনে এসে বসলেন আফজাল ভাই। ওনারও চোখে মুখে আমার মতই অস্বস্তি- কি বলবেন, কি করবেন এই জ়াতীয়। অত ভালো একজন অভিনেতা হয়েও উনি পারছিলেন না সেই পরিস্হিতি অভিনয় দিয়ে সামাল দিতে। আসলে আমরা মানুষ, এই একটি জায়গায় কত যে অসহায় তা মনে হয় এরকম কাছের কারো চলে যাবার পর বেশি অনুধাবণ করি। আলাপ সুত্রে বুঝতে পারলাম উনি মুহম্মদ জুবায়েরর ঘনিস্ঠ বন্ধু। এক সময় তারা অনেক আড্ডা দিয়েছেন, ভাল সময় কাটিয়েছেন খালাম্মার বাড়িতে। খালাম্মা তার প্রাণবন্ত আর বন্ধু সুলভ স্বভাবের কারনে তার সব ছেলে মেয়ের বন্ধুদের খুব কাছের একজন হয়ে যান। অতীতের সেই মধুর স্মৃতি মনে হয় উনাদের দুজনকেই ত্বারিত করছিল। আফজাল ভাই বলছিলেন মুহম্মদ জুবায়েরর স্মৃতি শক্তি প্রখরতার কথা। কোন বন্ধুর ফোন নাম্বার নাকি উনি লিখে রাখতেন না, একবার শুনলেই মনে রাখতে পারতেন। এমনকি অনেক খানি দূরে বসেও নাকি টেলিফোনের ডায়াল ঘুরানো দেখে বুঝতে পারতেন কত নাম্বারে ডায়াল করা হচ্ছে। খাল্লামার সব ছেলে মেয়েগুলাই নাকি এমন প্রখর স্মৃতিশক্তির। এটা নাকি খালাম্মার কাছ থেকেই পাওয়া। আলাপচারিতায় আরও মনে হল খালাম্মার ছেলে মেয়েরা সবাই খুবই দৃঢ় মনের অধিকারী। মুহম্মদ জুবায়ের পাঁচ বছর ধরে অসুস্থ কিন্তু উনি কাউকে জানতে দেননি ব্যাপারটা। হয়তো উনি চাননি কাউকে দুশ্চিন্তার মধ্যে রাখতে কিম্বা হয়তো কারো সহানুভূতি পেতে। হয়তবা অভিমানী মানুষটি চাইতেন নিরবে নিভৃতে চলে যাবেন। কিন্তু সবাইতো এক সময় ভুলে যাবে, খালাম্মা কি ভুলতে পারবেন ? এত লোক, এত কথার মাঝেও আমি লক্ষ্য করছিলাম উনি মাঝে মাঝেই চোখ মুছছেন, বুক থেকে বেরিয়ে আসছিল দ্ঘদীর্ঘশ্বাস। সমৃতিচারিতার মাঝখানে হঠাৎউনি আফজাল ভাইর হাতটি ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন, বললেন তোমরা তো সবাই আছ, আমার ছেলে কেন এমন করে চলে গেল , এর ঊত্তর কি দেবেন আফজাল হোসেন বা আমরা। কেউ কি তা আমরা জানি এর উত্তর ? এই প্রশ্নে কিংকতব্যবিমুঢ় হয়ে ছলছল চোখে এদিক ওদিক তাকানো ছাড়া কিইবা বলতে পারি আমরা? এই প্রশ্নের উত্তর আছে কি কারও জানা , সেই উত্তর- যে উত্তর ফিরিয়ে আনবে মায়ের সেই গুণী অভিমানী, দৃঢ় হৃদয়ের ছেলেকে।
মন্তব্য
বাড়ির প্রায় সামনে থেকে ফিরে এলাম সেদিন । ভেতরে যাওয়ার সাহস হল না ।
ট্যাগে ছড়া লেখা কেন ?
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
এমন পরিস্থিতিতে বলার কিছু থাকে না।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন... ...সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
এখনো দীর্ঘশ্বাস বড় গাঢ় হয়ে আসে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
লীনা আপনার বর্ণনায় খালাম্মাকে যেনো চোখের সামনে দেখতে পেলাম।আহারে!
পুত্র হারানোর শোক সইবার শক্তি মায়েরা কোথায় পাবেন?আমাদের শান্তনার ভাষা তো এক্ষেত্রে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
আপনি সামনা সামনি গিয়ে দেখা করেছেন, অসীম সাহস আপনার। আমার স্কুলের এক বারোয়ারী দোকানদার, নিয়মিত তার দোকানে যাওয়া পড়ে বলে খাতির হয়ে গিয়েছিলো, তার দুই ছেলেকেও চিনি। উনি হঠাৎ হুট করে চলে গেলেন কয়েক হপ্তা আগে। সেই থেকে আমি দোকানেই যেতে পারি না তার দুই ছেলের সাথে দেখা হয়ে যাবে সেই ভয়ে। কি কষ্ট!
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
জগতের একটা মাত্র জায়গা কখনোই প্রতিস্থাপন করা যায় না বা কেউ পূরন করতে পারে না , সেটা হচ্ছে সন্তানের জন্য মায়ের চিরায়ত শোক।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আহারে...
--------------------------------------------------------
কারা যেন চলে গেছে দূরে...বহুদূরে..আর ফিরবে না জানি । কোন কারন ছাড়াই , কোন যুক্তি ছাড়াই চুপচাপ হয়ে গেছে সারিবদ্ধ প্রাণ গুলো । জানি , আমাকেও আসতে হবে এই বিষন্ন নগরীতে..একদিন.. কোনদিন --মলাগোফরুমা
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন
আছে কি কারও জানা , সেই উত্তর- যে উত্তর ফিরিয়ে আনবে মায়ের সেই গুণী অভিমানী, দৃঢ় হৃদয়ের ছেলেকে।
---
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
বনানীর ঐ বাড়িটাতে যাওয়ার আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু ............
বুকের ভেতর, গলার মাঝে কেমন যেন ব্যাথা ব্যাথা লাগে, যখন এইসব লেখা পড়ি।
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নতুন মন্তব্য করুন