আমার বাসার ৮ মাইলের মধ্যে চ্যান্ডলার শহরে ইন্টেলের অন্যতম বড় একটি অফিস। প্রায় দশ হাজার (সংখ্যাটা ভিন্ন হলেও হতে পারে) চাকুরিজীবি এখানে কাজ করে। বিশাল কমপ্লেক্স নিয়ে গঠিত এই অফিসটিতে প্রচুর বাঙ্গালী সহ অনেক ইঞ্জিনিয়ারদের আনাগোনা। সেখানেই আজকে (ডিসেম্বর ৬, ২০০৭) আমার একটি অন-সাইট ইন্টারভিউ ছিল।
এই লেখাটির উদ্দেশ্য হল, ইন্টেল এবং এরকম বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ইন্টারভিউ প্রসেস গুলি আলোচনা করা এবং আমি যা শিখলাম সেটা আপনাদের সাথে শেয়ার করা। চাকরী পাই বা না পাই, এখান থেকে পাওয়া শিক্ষা গুলি আমার ভবিষ্যতের পাথেয় হবে এবং আপনারা "হয়ত" লাভবান হবেন কোন ভাবে। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতে আমি অন্যান্য কোম্পানী নিয়েও আলোচনা করব যেগুলোতে আমি ইন্টারভিউ দিয়েছি বা দিচ্ছি।
প্রথম আমার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে কিছু বলা দরকার। আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর করেছি মোটামুটি ভাল একটা জিপিএ নিয়ে। আমার করা কাজগুলোর ডিটেইলস না গিয়ে বলা যায় সেগুলো ছিল মূলতঃ কন্ট্রোল, প্রোগ্রামিং, কম্পিউটার ভিত্তিক এনালাইসিস ধরনের।
আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মার্স্টাস প্রায় শেষ করে এনেছি, কাকতালীয়ভাবে ব্যাচেলরের মত ঠিক একই জিপিএ নিয়ে। আমার রিসার্চ, প্রজেক্ট এসব ছিল মূলতঃ কম্পিউটার ভিত্তিক, ডিজাইন, এনালাইসিস ধরনের কাজ।
তাছাড়া আমি প্রচুর সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট জাতীয় কাজে জড়িত ছিলাম। লিনাক্স লোকালাইজেশন প্রজেক্ট অংকুরের সাথে জড়িত ছিলাম বহুভাবে বহুদিন। বাংলাদেশ লিনাক্স ইউজারস গ্রুপের সাথে জড়িত ছিলাম বহুদিন। তাছাড়া প্রচুর এক্টিভিটি করতাম।
আচ্ছা নিজের ঢোল অনেক পেটালাম। আমার প্রগলভতা ক্ষমা করবেন। আপনাকে জিজ্ঞেস করলে আপনিও হয়ত এরকম আপনার কাজগুলো ঢেলে দিতে পারবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে আপনার স্কিলগুলো কিভাবে আইডেন্টিফাই করবেন? কিভাবে প্রমান করবেন যে আপনার একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ে দক্ষতা আছে?
ইন্টারভিউ প্রিপারেশনের একটা অংশ হিসেবে আমি প্রথমে আমার স্কিল গুলোকে আইডেন্টিফাই করলাম। তারপর খুঁজে খুঁজে বের করতে লাগলাম আমার জন্য উপযুক্ত চাকুরী কি হতে পারে। এ পর্যায়ে একটি কোর্সের প্রয়োজনে ইন্টারভিউ নিতে হল সুমন নামে একজন ইন্টেলের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার যিনি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাশ করে ইন্টেলে চাকুরী করছেন প্রায় সাত বছর। তার ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে আমি চাকুরীর ব্যাপারে আমার উৎসাহ প্রকাশ করলাম। কিন্তু পরবর্তীতে আমার থিসিস জনিত জটিলতায় আমি আগবাড়িয়ে আর এপ্লাই করিনি। এই ঈদের দিন সুমন ভাই আমাকে মৃদু বকা দিলেন এপ্লাই করিনি বলে।
প্রথম জব-ডেসক্রিপশন দেখে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করলাম কোন কোন স্কিল তারা খুঁজছে, এবং আমার সেটা আছে কিনা। দেখলাম তারা চায় -
১। সমস্যা সমাধান - রিসার্চের একটি দুর্বলভাবে সংজ্ঞায়িত করা সমস্যাকে সফলভাবে সমাধান করেছি, তাছাড়া বিভিন্ন প্রজেক্টে দুরুহ সব সমস্যার সমাধান করেছি সফল ভাবে।
২। কমিউনিকেশন - বিভিন্ন প্রেজেন্টেশন, লিনাক্স ভিত্তিক কাজে প্রেজেন্টেশন, বিভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ
৩। টিম পরিচালনা বা টিমে কাজ করা -টিম হিসেবে কাজ করেছি, টিম লীডার হিসেবে বেয়াড়া পোলাপাইনকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে কাজ করেছি। বিভিন্ন প্রজেক্টে টিমে কাজ করেছি।
৪। এছাড়া আরো কিছু বিষয়ে টেকনিক্যাল স্কিল - আমার আছে।
এইভাবে তারা যা চায় সেটা আইডেন্টিফাই করে, আমি যা করেছি তার সাথে জুড়ে দেয়া যায় কিনা সেটা যাচাই করলাম। এইতথ্যগুলো আপনার কাভার লেটার বা রেজিউমে ব্রাশ আপ করতে সাহায্য করে। এনালাইজ করা শেষে কাভার লেটার আর রেজিউমে ঠিকঠাক করে ইন্টেলের ইন্টারনেট ভিত্তিক চাকুরী প্রার্থীদের সিস্টেমে ঢুকিয়ে দিলাম। দুদুবার ফোন ইন্টার ভিউ শেষে ডাক পড়ল অন-সাইট ইন্টারভিউয়ের। ফোন ইন্টারভিউয়ের প্রথমটা ছিল আচার-ব্যবহার সর্ম্পকিত এবং দ্বিতীয়টি ছিল টেকনিক্যাল।
আমেরিকার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে অন-সাইট ইন্টারভিউ ছাড়া চাকুরী নিশ্চিত করে না। ফোনে কথা হয়েছে, কিংবা একবার অন-সাইট ইন্টারভিউয়ের পর ঠাস করে চাকুরী হয়েছে এমনটা খুব কম। এখানে লিখিত পরীক্ষা হবার কথা শুনিনি কখনও। ঢাকায় যখন চাকুরী খুঁজছিলাম তখন প্রায় সব প্রতিষ্ঠান (মেটাটিউড, লিডস বিডি, আকিজ গ্রুপস, ডাচ বাংলা ব্যাঙ্কস) চাকরী নিশ্চিত করার আগে একটা লিখিত পরীক্ষা আর একটা গ্রুপ ভাইভা নিয়েছিল। এখানে গ্রুপ ভাইভার কথা প্রায় শোনাই যায় না। বেশীরভাগই একে-এক ভাইভা হয়।
ইন্টারভিউ প্রস্তুতির জন্য কি করতে হয়? প্রচুর ওয়েবসাইট আছে এর উপর। আপনাকে যদি টেকনিক্যাল প্রশ্ন করা হয় সেজন্য আপনার টেকনিক্যাল জ্ঞান প্রয়োজন। কিন্তু যদি নন-টেকনিক্যাল হয়, তাহলে দরকার উপস্থিত সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। নন-টেকনিক্যাল প্রশ্ন সাধারন আচার-ব্যবহার ভিত্তিক হয়। বিভিন্ন অবস্থায় আপনি কি করবেন এগুলো জিজ্ঞেস করে। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে উদাহরন সহকারে আপনি একম পরিস্থিতিতে অতীতে কি করেছেন সেটা বলা এবং যুক্তি সহকার ভবিষ্যতে কি করবেন সেটা জানানো।
মূল ইন্টার ভিউ ছিল ৪ জনের সাথে। প্রত্যেকের সাথে এক ঘন্টা এবং শেষ জনের সাথে দুই ঘন্টা, সাথে লাঞ্চ। প্রথম জনের বেশীরভাগ প্রশ্ন ছিল আমি কি করেছি না করেছি সেটা বের করা, আচার-ব্যবহার ভিত্তিক ধারনা নেয়া। দ্বিতীয় জন ছিল এক চাইনীজ লোক। সে অন্য বিষয়ের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায় মূলত প্রেজেন্টেশন স্কিল নিয়ে প্রশ্ন করল। তৃতীয় জন আচার-ব্যবহার এবং কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করল। চর্তুথ জন আসলে লাঞ্চে নিয়ে গিয়ে ইন্টারভিউ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করল। আসলে যাচাই করল করোপোরেট পরিবেশে আমি কিরকম করব।
আচার-ব্যবহার ভিত্তিক প্রশ্নের বেশীরভাগই ছিল গতানুগতিক। আমি বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে একটা বড় লিস্ট করেছিলাম বিভিন্ন প্রশ্নের। সেগুলো বেশ কাজে লেগেছে। তবে প্রেজেন্টেশন স্কিলের বেশ কিছু প্রশ্নে আটকে গিয়েছিলাম। কারনটা আর কিছুই না করপোরেট পরিবেশ কাজ না করার অভিজ্ঞতা। এধরনের প্রশ্ন আমি আগে দেখিনি। কয়েকটা তুলে দেই -
১। কি করে তুমি টপ লেভেল ম্যানেজারকে প্রমান করবা যে সমস্যাটার সমাধান করতে পারবা এবং তার জন্য তারা খুশী হয়ে টাকা দিবে? তুমি কি বুলশীট টেকনিক্যাল জিনিস দেখাচ্ছো তা তারা বুঝে না। এখন কি করনীয়?
২। কি করে তুমি নিজের গ্রুপের কিছু তথ্য যে প্রকাশ করবা যাতে কনফিডেনশিয়ালিটি নষ্ট না হয় আবার তুমি কি করছ সেটা খানিকটা শেয়ারও করা যায়।
৩। প্রেজেন্টেশনের সময় কি করে তুমি একজন আক্রমন কারীকে প্রতিহত করবা?
তাছাড়া যে সমস্ত টেকনিক্যাল প্রশ্ন করেছে তাতে উপস্থিত বুদ্ধি বেশী কাজে লেগেছে। আরেকটা বিষয় হলো পড়াশুনার গভীরে গিয়ে আমরা কাজ করি, কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আরো উপর থেকে জিনিস গুলোকে দেখার ক্ষমতা থাকতে হবে। নইলে টেকনিক্যাল বিষয়, জানা বিষয়ের প্রশ্নও অনেক অজানা মনে হবে।
যে বিষয়ে আমার সমস্যা হতে পারে মনে হচ্ছে। সেটা হল আগে ইন্টেলে একটা প্রজেক্ট করেছিলম। সেটার ফলাফল তখনকার ইন্টেল কোরাসপনডেন্সের পছন্দ হয় নাই। প্রসঙ্গক্রমে এই প্রজেক্টের তথ্য দিতে হয়েছে আমাকে। এইখানে একটা আশংকা আছে, যদি সেই প্রাক্তন কোরাসপনডেন্স উল্টো পাল্টা কিছু বলে!
যাই হোক অভিজ্ঞতাটা পথের পাথেয় হয়ে থাকল।
মন্তব্য
ভালই বকর বকর করছি।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
কইছিলাম আগেই, ইন্টেল ওয়েইট করতেছে গুড লাক।
========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"
ধন্যবাদ।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
প্রেজেন্টেশনের সময় প্রশ্নকারীকে প্রতিহত করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, তাকে নির্দিষ্ট প্রশ্ন করতে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করা। প্রস্তুতির সময় নিজেকে দর্শকের আসনে বসালে দর্শক কোন বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করবে, তা মোটামুটি বুঝতে পারা যায়। অনেক সময় 'টোপ' ফলে দর্শককে নির্দিষ্ট লাইনে প্রশ্ন করতে বাধ্য করা যায়। তবে প্রশ্ন যা-ই হোক, আক্রমণকারীর প্রতি কো-অপারেটিভ হওয়া উচিত, উলটা পালটা প্রশ্ন করলেও বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না।
এরকম জব ইন্টারভিউর মূল অংশ সম্ভবত পারসোনালিটি টেস্ট। টেকনিক্যাল বিষয় ইম্প্রুভ করা যায়, যেহেতু ডিগ্রী আছে, সেহেতু টেকনিক্যাল সাইডে কাজ করতে গেলে কিছু না জানা থাকলে সহজেই শিখে নেওয়া যায়; কিন্তু পারসোনালিটি জোর করে পরিবর্তন করা যায় না। টীম-ম্যান হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
প্রথম অংশটা এই প্রথম শুনলাম। কিন্তু এর খারাপ দিকটা কি লক্ষ্য করেছেন? এটা একধরনের ম্যানিপুলেশন। যদি ইন্টারভিউয়ার আইডেন্টিফাই করতে পারে তাহলে বিরক্ত হতে পারে। অথবা এপ্রিশিয়েট করতে পারে - আপনার অন্যের চিন্তাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে দেখে।
বাকিটা জানতাম। সেভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
কলেজ ফুটবল, এনএফএল। এই দুইটা নিয়ে কম করে হলেও আধা ঘন্টা প্যাঁচাল পারা যায় খাবার টেবিলে। এদেশীদের আগ্রহের ব্যাপারগুলো জানা থাকলে সুবিধা হয় অনেক।
আমি খেলাধুলায় অতটা পারদর্শী নই। তবু এবিষয়ে খানিকটা জেনে নিয়েছিলাম একজনের কাছ থেকে। খেলাধুলার কথা উঠলে আমেরিকানরা দেওয়ানা হয়ে যায় জানতাম। কিন্তু আমাকে লাঞ্চে নিয়ে গিয়েছিল এক চিঙ্কু।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এর পর কোথাও ইন্টারভিউ দিতে যাবার আগে স্টেট/সিটির নাম জানিয়েন। একদম চোথা বানিয়ে সচলে পোস্ট করে দিবো নে!
তাহলে টেবিলটেনিস ...
হাঁটুপানির জলদস্যু
চিঙ্কু হইলে অলিম্পিক ২০০৮
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
অগ্রীম অভিনন্দন ভ্রাতঃ
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আসলে এইরকম একটা পোস্টের ধারা তৈরী করা যায়। কোন দেশে কে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। পদ্ধতি কেমন। এইসব। তাহলে অনেকে উপকৃত হত।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
সহমত। ই-বই খুলে ফেলুন।
ইন্টেলে আপনার কাম পাক্কা হয়ে গেলে তো নতুন অভিজ্ঞতা সচলবাসি মিস করবে, কি বলেন??
-------------------------------------
জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
প্রথম পেইজে একজন লেখকের দুটির বেশী পোস্ট থাকতে পারবেনা - এই নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটাকে প্রথম পেইজ থেকে সরিয়ে দিলাম।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
নতুন মন্তব্য করুন