অ্যারিজোনার রূপ: সেডোনা ও পেট্রিফায়েড ফরেস্ট

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
লিখেছেন এস এম মাহবুব মুর্শেদ (তারিখ: শুক্র, ২৭/০৭/২০০৭ - ৩:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্যাডোনার রুপ দেখিয়াছি আমি তাই...
গত উইকএন্ডে হঠাৎ ঠিক হল আশেপাশে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হবে। উদ্যোক্তা গাইজার ভাই। অনেকের সাথে কথা বলে ঠিক হলো আমি, মৌটুসী, রাব্বী, ওয়ালী আর গাইজার ভাই এই পাঁচজন যাওয়া হবে। মাঝারী সাইজের একটা প্যাসেঞ্জার কার ভাড়া করে ফেললাম আমি আর গাইজার ভাই মিলে।

ঠিক হলো আমাদের বাড়ি থেকে দুই ঘন্টা দুরে সেডোনা নামের একটা সিনিক বিউটি আছে ওখানটায় যাব। সেখান থেকে আরো দুঘন্টার রাস্তা পেট্রিফায়েড ফরেস্ট নামে একটা জায়গা আছে সেখান হয়ে ঘরে ফিরব। পুরো একদিনের ঝটিকা সফর।

ছবি ১। রেড মাউন্টেন পার্কে আমিছবি ১। রেড মাউন্টেন পার্কে আমি

ছবি ২। আমি ও মৌটুসী রেড মাউন্টেন পার্কেছবি ২। আমি ও মৌটুসী রেড মাউন্টেন পার্কে
ঘন্টা দুয়েকের ড্রাইভিং শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম রেড মাউন্টেন পার্কে (ছবি ১,২)। শুধু লাল পাহাড়ের রাজত্ব সেখানে। এতো টকটকে লাল রঙ দেখে রাব্বী তো মন্তব্য করেই বসল, "খাইছে কেউ ডেইলী লাল রঙ ঢালে নাকি এইখানে। পুরা লালমাই পাহাড় মনে হচ্ছে।"

রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আর অতীতের যেন আমার কানে কানে কথা বলে যাচ্ছে। স্তরে স্তরে জমে ওঠা পাহাড় কোন এককালের অগ্নুৎপাতের সাক্ষী রয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন পাহাড়ের গায়ে সাদার মাঝে লাল রঙের পোজ দেয়া স্তর গুলো যেন আমাকে কোন গল্প বলতে চাইছিল। গাড়ীর গতির সাথে না পেরে সরে সরে যাচ্ছিল তারা।

সেই লালমাই পাহাড় পার্কে এসে আমরা ছবি টবি তুললাম। আমেরিকানদের দেখলাম এইখান থেকে শুরু হওয়া ট্রেইল ধরে হাইকিং এ যাচ্ছে। কিন্তু আমদের মূল টাগের্ট সাইট দেখা। তাই পটাপট ছবি তোলা হতেই শুরু করলাম চলা।

ছবি ৩। স্কাল্পচার বিক্রির দোকানের সামনে একটি ব্রোঞ্জের মুর্তি ও আমিছবি ৩। স্কাল্পচার বিক্রির দোকানের সামনে একটি ব্রোঞ্জের মুর্তি ও আমি

ছবি ৪। আমি ও মৌটুসী আরো কিছু মুর্তির সামনেছবি ৪। আমি ও মৌটুসী আরো কিছু মুর্তির সামনে

মাঝখানে শহরের মাঝে কিছু যায়গা পেলাম আর্টিস্টিক স্কালপচার আর ছবি বিক্রি করে। একেকটা স্কাল্পচারের দাম ২৬-৩০ হাজার ডলার। দেখে আমাদের মাথা ঘুরে উঠল। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। কিন্তু বাইরে ব্রোঞ্জের মুর্তির কাছে খায়েশ মিটিয়ে ছবি তোলা হল। (ছবি ৩,৪)

ছবি ৫। আমরা ছোট্ট একটা পাহাড়ী নদীতেছবি ৫। আমরা ছোট্ট একটা পাহাড়ী নদীতে
কিছুদুর যেতে একটা ছোট্ট জলাশয় পড়ল। সেখানে নেমে কিছুক্ষন আমরা আড্ডা দিলাম। (ছবি - ৫) তারপর পথে বিভিন্ন জায়গায় সিনিক বিউটি থাকলেও সময় সল্পতার জন্য আমরা শুধু আর মাত্র একটি স্পটে নামলাম। ছবি (৬-৮)।

ছবি ৬। গাড়ী থেকে ক্যামেরা বন্দী করার অপচেষ্টাছবি ৬। গাড়ী থেকে ক্যামেরা বন্দী করার অপচেষ্টা
ছবি ৭। একটা স্পটে আমরা সবাইছবি ৭। একটা স্পটে আমরা সবাই
ছবি ৮। আমি আর টুসী - পিছনে সর্পিল রাস্তার একাংশ দেখা যাচ্ছে।ছবি ৮। আমি আর টুসী - পিছনে সর্পিল রাস্তার একাংশ দেখা যাচ্ছে।
এই সময়টা আমি ড্রাইভিং এ ব্যাস্ত ছিলাম বলে ঠিক মত উপভোগ করতে পারিনি। এই বিশালত্ব পর্বত, গভীর খাদের পাশ দিয়ে রাস্তা, হাজার ফুট খাদের নীচে বয়ে চলা বরফ গলা নদী এসব দেখে মনে হচ্ছিল ঝটিকা সফরে আসা উচিৎ হয়নি। হাতে সময় নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। প্রকৃতির মাঝে আরো কিছুটা সময় দিলে মন্দ হত না।

তারপর আমরা সেডোনা ছেড়ে রওনা দিলাম পেট্রিফাইড ফরেস্টের উদ্দেশ্যে।

পেট্রিফাইড ফরেস্ট - পাথর হয়ে যাওয়া বনভুমি
ছবি ৯। লং উডস নামের একটা সাইটেছবি ৯। লং উডস নামের একটা সাইটে

সেডোনা ছেড়ে যেতে যেতে আমাদের খিদে পেয়ে গেল। এক শহরে নেমে আমরা তাই খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। তারপর পেট্রিফাইড ফরেস্ট শহর পৌছতে পৌছতে বিকাল ৪টা বেজে গেল। আমরা একটু চিন্তিত ছিলাম - যদি পার্ক ৫টায় বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তেমন কিছু দেখে ফেরা হবে না। গেটে টিকেট কেটে দেখলাম পার্ক ৭টা পর্যন্ত খোলা। সস্তির নিশ্বাস ফেলে ঢুকে পড়লাম পার্কে।

ছবি ১০। pubelo নামের যায়গাটায় যেখানে মানুষের নির্দশন পাওয়া গেছেছবি ১০। pubelo নামের যায়গাটায় যেখানে মানুষের নির্দশন পাওয়া গেছে
নাম শুনে যতটা এক্সাইটিং মনে হয় ভেতরে ঢুকলে হঠাৎ করে ততটা ভাল লাগে না। এই উঁচু শুষ্ক মালভুমি একসময় বিস্তৃত সমতল ভুমি ছিল, যার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলত বেশ কয়েকটি স্রোতস্বীনি। লম্বা পাইনের মত গাছ জন্মাত এখানে। বিভিন্ন প্রজাতির ফার্ন, সাইকেড, আর অন্যান্য উদ্ভিদের মাঝে কুমির সদৃশ সরীসৃপ, বিশাল আকৃতির উভচর প্রানী, আর ছোট ছোট ডাইনোসর বাস করত।

ছবি ১১। কিছু পেট্রোগ্লিফসের সামনে আমি - র‌্যাটল স্নেকের ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে আছে যদিওছবি ১১। কিছু পেট্রোগ্লিফসের সামনে আমি - র‌্যাটল স্নেকের ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে আছে যদিও

ছবি ১২। ক্রিস্টাল ফরেস্টের ফলকছবি ১২। ক্রিস্টাল ফরেস্টের ফলক
বড় বড় গাছ - Araucarioxylon, Woodworthia আর Schilderia - ভেঙ্গে পড়ত আর নদীতে ভেসে যেত। পলি, কাদা আর অগ্নুৎপাতের ছাই গাছের গুঁড়িগুলোকে ঢেকে ফেলত। এই জমে ওঠা আস্তরন গুঁড়িগুলোকে বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে বাঁধা দিত আর ক্ষয়রোধ করত।

সিলিকা-মিশ্রিত পানি মাটি থেকে চুইয়ে চুইয়ে ঢুকে পড়ত গাছের গুঁড়ি গুলোতে আর গাছের টিসু্য গুলোকে সরিয়ে নিজেরা জমাট বেঁধে বসত সেখানে। এইভাবে সিলিকা দানাবেঁধে রূপান্তিরিত হত কোয়ার্টজে এবং গুঁড়ি গুলো পেট্রিফায়েড উড হিসেবে সংরক্ষিত হতে শুরু করে।

ছবি ১৩। ক্রিস্টাল ফরেস্টে আমি ও আমার স্ত্রী মৌটুসীছবি ১৩। ক্রিস্টাল ফরেস্টে আমি ও আমার স্ত্রী মৌটুসী
ছবি ১৪। ওখানকার একটি মিউজিয়ামে পলিশড একটা গাছের গুঁড়িছবি ১৪। ওখানকার একটি মিউজিয়ামে পলিশড একটা গাছের গুঁড়ি
প্রায় ২২৫ মিলিয়ন বছর আগে ট্রায়াজিক সময়ের শেষদিকে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে ধারনা করা হয়। সে সময়ের পরে এই এলাকা পানিতে ডুবে যায়, বন্যাগ্রস্ত হয়, আর পলির আস্তরে ঢাক পড়ে যায়। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক ভাবে এই এলাকা সামুদ্রিক সমতল থেকে ভেঙ্গে উপরের দিকে উঠে আসে। আর এই প্রবল চাপে বিশাল বিশাল গাছের গুঁড়ি গুলো ভেঙ্গে উপরে উঠে আসে।

তারপর সময়াবর্তনে বাতাসে, বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যায় গাছের গুঁড়িগুলোকে ঢেকে রাখা শক্ত পলিস্তর। বের হয়ে আসে পাথর হয়ে যাওয়া গাছ পালা আর প্রানীর ফসিল। ভবিষত্যে হয়ত আরো পলিস্তর সরে বেরিয়ে আসবে লুকানো ফসিল।

ছবি ১৫। কিছু ডাইনোসরের নির্দশনের সামনেছবি ১৫। কিছু ডাইনোসরের নির্দশনের সামনে

এই পেট্রিফায়েড ফরেস্ট ঘিরে অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে। প্রাচীন মানুষের পেশার ধরন কি ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রমান গুলো দেখলে। পার্কে বিভিন্ন জায়গাগুলো প্রায় ১০,০০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস ধারন করে রেখেছে। পুরো গল্পটা যদিও বের করা সম্ভব হয়নি, সেখানে যে বিভিন্ন পেশার বিস্তার ঘটেছিল সেটা বোঝা যায়। সেখানে বাসা বেঁধেছিল ঘুরে বেড়ানো প্রজাতি থেকে বেরিয়ে আসা কৃষি ভিত্তিক জনপদ - pubelos। তাদের অস্তিত্বের প্রমান যদি ১৪০০ সাল নাগাদ হারিয়ে যেতে থাকে তথাপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাসন পত্র, পেট্রোগ্লিফস এদের পরিচয় বহন করে।

ছবি ১৬। আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া পেট্রিফায়েড গাছের ধরন দেখিয়ে একটা তুলনামূলক চিত্রছবি ১৬। আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া পেট্রিফায়েড গাছের ধরন দেখিয়ে একটা তুলনামূলক চিত্র

বিশাল এই জায়গার এক মাথা থেকে ড্রাইভ করে আরেক মাথায় পৌছতেই প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে যায়। আমরা বেশ কিছু স্পটে নেমে পেট্রিফায়েড গাছের গুঁড়ি, প্রাচীন লোকদের থাকবার জায়গা, পেট্রোগি্লফস এগুলো দেখলাম। যদিও একটা ছোট্ট পেট্রিফায়েড গাছের টুকরোও নেয়া নিষেধ, আশেপাশের এলাকার ব্যাক্তি মালিকানাধীন জমিতে পাওয়া টুকরো গুলো পলিশ করে খুব সুন্দর গিফট আইটেম হিসেবে বিক্রি হয় কিছু দোকানে। আমরা সবাই ছোট বড় আইটেম কিনলাম সেখানে।

ততক্ষনে সন্ধ্যা ৭ টা বেজে গেছে। পার্ক রেঞ্জার দেখলাম ঘুরঘুর করছে আশেপাশে। আর সবাইও পার্ক থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তাই আমরাও আর দেরী না করে রওনা দিলাম ঘরের দিকে, সঙ্গে নিয়ে কিছু স্মৃতি আর পলিশড পেট্রিফায়েড গাছের একটুকরো।

বি:দ্র: তথ্যগুলো টিকিটের সাথে দেয়া এক ব্রশিওর থেকে সংগৃহীত। বিস্তারিত পাবেন এখানে:
http://www.nps.gov/pefo/pphtml/nature.html

(সামহোয়্যারইনে প্রথম প্রকাশিত ২০০৬-০৬-১৭ ২২:০৬:০০)


মন্তব্য

??? এর ছবি

সুন্দর। আচ্ছা, যে শহরে থাকেন তাকে নিয়ে কোনো লেখা ছিল আপনার?

আপনার ল্যান্ডস্কেপ স্টাডি পড়তে পড়তে মাথায় নতুন আইডিয়া আসতেছে। চোখ টিপি

...............................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আমার মাথায় এখন দুইটা চমৎকার আইডিয়া মাছির মত ভনভন কইরা ঘুরতেছে। কিন্তু অন্যেরা এতো চুপচাপ যে আমি লাফাইতে পারতেছি না। মন খারাপ

আমার শহরের কিছু অবজার্ভেশন আছে। ওইগুলা পোস্ট করব কিছুদিন পরে। এই কিন্তু শহর থেকে খানিক দূরেই।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

??? এর ছবি

সমস্যা নাই, আপনার কনভিনিয়েন্ট সময়েই লেখেন। অন্যরা চুপচাপ কেন?চোখ টিপি

...................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

সবাই ব্যস্ত মনে হয়। ফ্রী হইলে লিখবে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অমিত এর ছবি

পেট্রিফায়েড ফরেস্ট থেকে আমার পেইন্টেড ডেসার্ট অনেক সুন্দর লেগেছিল।
______ ____________________
suspended animation...

আরশাদ রহমান এর ছবি

সেডোনা আমার খুব ভালো লেগেছিলো। লাল মাটি লাল পাহার লাল রাস্তা। আমি গিয়েছিলাম ২০০১ এ।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

দিলাম একটা লাফ। ঝারেন এবার আইডিয়া! দেঁতো হাসি

jaltorongo এর ছবি

সেড্না যাওএর প্লান করসি।আপ্নি কি এখনও আরিজনাতে?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।