ঘটনাটার সময়কাল ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন হবে। সম্ভবতঃ ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছি তখন। আমার ছোট ভাইও সম্ভবতঃ মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। একসাথে তাই ছুটি কাটাতে গিয়েছি সেজ খালার বাসায় রংপুরে। সেজ খালার আমাদের সমবয়সী দুটো ছেলে আছে। বড়টা করিম, আমার সমবয়সী। ছোটটা রহিম, আমার ছোটভাইয়ের সমবয়সী। বলাবাহুল্য আসল নাম বদলে রহিম আর করিম ব্যবহার করা হয়েছে এখানে।
অল্পবয়সী চার বান্দর এক সাথে হলে কি হয় বোঝেনই তো! রাত-দিন আড্ডা। ঘুর ঘুর এদিক থেকে ওদিকে। টাংকি মারার চেষ্টা। আমাদের সাথে আরও ছিল রিপন আর আম্মান। এর মাঝে করিম একদিন আড্ডা মারতে মারতে দাবী করে বসল এক সুন্দরী মেয়ে তার আবেদনে সাড়া দিয়েছিল।
করিম এমনিতে একটু বোকাসোকা। তাই সমস্ত রকম পঁচানোর কর্মকান্ড আমরা তারউপর দিয়ে চালাতাম। মনে করেন, সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। বাইরে থেকে আমাদের কেউ একজন আসল, তো করিমের মাথায়ই চাঁটি মেরে বলতাম, "এই সাঁওতাল যা সরি বস"। করিমের মিশমিশে কালাহ্ গায়ের রং আর ভাঙ্গা চোয়ালের জন্য আমরা সাঁওতাল ডাকতাম। সরি, নো অফেন্স টু রিয়েল সাঁওতাল।
তো এই করিম নাকি প্রেম করে! করিমের দাবী শুনে আমরা হেসেই বাঁচিনা।
রিপন বলে, "সাঁওতাল নাকি পেরেম করিচ্ছে। হি হি হি..."
আমি বললাম, "যাহ শালা চাপা মারিস না! হা হা হা..."
রংপুর জেলা স্কুল মাঠে বসে ছিলাম আমরা। বাকিরা হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ল। করিম খুব আহত একটা চেহারা নিয়ে বসে থাকল। হাসতে হাসতে আমরা যখন একটু ধাতস্থ হলাম তখন করিম বলে,
"বিশ্বাস করিস না? চল আমার সাথে, দেখা করাব।"
আমরা তখন একটু একটু নড়ে চড়ে বসলাম।
"দেখা করাবি মানে? থাকে কোথায়"
"দিনাজপুর", করিম একটু ভাব মেরে বলে।
"দিনাজপুর?" আমরা এর ওর দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
করিম জানে সে দিনাজপুরের কথা বলায় কেউ তো আর যাচাই করতে যাচ্ছে না। সুতরাং সেইফলী চাপাটা মারা যাবে।
"তোর সাথে এখনও যোগাযোগ আছে?", আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"আছে মানে? সেদিনই তো কথা হল", করিম বলে।
"হামরা গেলি চিনবু?", রিপন জিজ্ঞেস করে।
"না চিনার কি আছে?"
"তাহলে চল দেখা করে আসি", আমি প্রস্তাব করলাম। অনেকটা সত্যতা যাচাই, অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারের উদ্দেশ্যে। করিমের কালো মুখটা যেন আরো কালো হয়ে এলো।
তা দেখে আম্মান বলে ওঠে, "এরে মিত্যা বলিচ্ছু কেঠে রে?"
করিম ডেসপারেট হয়ে উঠে, "মিথ্যা? বললাম তো, যাবি তো চল!"
আমরা সিরিয়াসলী প্ল্যান করে ফেলি যে দিনাজপুর যাবো। যাবোই যখন একই সাথে কান্তজীর মন্দির আর দিনাজপুর রাজার বাড়ী দেখা হবে। আগে এসব দেখব, তারপর বিকেলে মেয়ের সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরব।
পরদিন সকালে আমরা রওনা দেই। আমরা দুই ভাই, করিমরা দুই ভাই, রিপন আর আম্মান; মোট ছয়জন। রিপন জানালো বাসে করে মূল দিনাজপুর নামার আগের একটা স্টপেজে নামতে হবে। তারপর ভ্যানে করে মাইল দুয়েক গেলে একটা নদী পড়বে। সেই নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে মাইলখানেক হাঁটলে পরে কান্তজীর মন্দিরে পৌছে যাবো আমরা। নিজেদের গাড়ী না থাকলে নাকি এটাই বেস্ট রাস্তা।
আমরা টিকিট কেটে চটপট উঠে পড়লাম বাসে। বাস থেকে নেমে ভ্যানে করে নদী তীরে যখন পৌছলাম তখন পেটে চোঁ চোঁ খিদে। নদী পাড়েই ছোট হোটেল, পানের দোকান ইত্যাদি ছিল। হোটেল থেকে শিঙ্গাড়া খেয়ে নিলাম আমরা। এর মাঝেই আমাদের হো হো হি হি চলছিল। বিকেলে মেয়ের সাথে দেখা হলে কার কি প্রতিক্রিয়া হবে এইসব নিয়ে আলোচনা। আর বয়সটাই এমন যে কোন বিষয় লাগে না, সবকিছুতেই হাসি আসে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা নদী তীরের দিকে যাচ্ছি। দেখি যে নদীর পাড়টা কেমন যেন সন্দেহজনক। কাদা থাকতে পারে ভেবে আমরা এদিক ওদিক তাকিয়ে সংর্কীণ একটা হাঁটা পথ দেখে সেদিকে রওনা দিলাম। আমরা পাঁচজন একই দিকে গিয়েছি দেখে করিমের কি যেন মনে হল। সে স্মার্টলী কাদা আছে বলে আমরা যেখানটায় সন্দেহ করেছিলাম সেদিকে রওনা হল।
ব্যাস আর যায় কই! ঘ্যাঁচ করে হাটুঁ পর্যন্ত কাদায় ডুবে গেল করিম। তাই দেখে আমাদের হাসি আর দেখে কে? হা হা হা হা, হো হো হো হো, হি হি হি হি চলছেই... এরমাঝে একজন বলে, "ভাই জলদি টানি তোলেন, নায় তো আরো ডাবি যাবে"। আমরা হাসি চাপতে চাপতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে টেনে তুললাম ব্যাটাকে।
নদী তীরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি যে নদীটা ঠিক ওই জায়গাটাতেই বাঁক খেয়েছে। বাঁক খাবার কারনে নদীটা প্রচন্ড খরস্রোতা। জায়গায় জায়গায় দেখি জলঘুর্নি দিচ্ছে। উল্টো দিকে লক্ষ্য করলাম পারাপারের যে একমাত্র নৌকা সেটা ডুবে গেছে। খানিকটা উত্তেজনা লক্ষ্য করলাম। তবে ঐ পারের কাছে গিয়ে ডুবেছে বলে পটাপট মানুষগুলো পাড়ে উঠে পড়তে দেখলাম।
এইসব দেখে আমরা একটু ভয় পেয়ে নদীর পাড় থেকে খানিকটা দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আলাপ করছি। ভাবছি ফিরে যাবো কিনা। রিপন অভয় দিচ্ছে যে সে বেশ কয়েকবার এসেছিল। কোন সমস্যা হবে না।
এই সময়টায় করিম তার কালো প্যান্টে লেগে থাকা ধুসরে কাদা পরিষ্কার করছিল। কোত্থেকে একটা কাঠি জোগাড় করেছে সেটা দিয়ে চেঁচে তুলে ফেলছিল কাদাগুলো। নদী যে ভয়াবহ খরস্রোতা, ওপারে যে মানুষ ডুবে যাচ্ছিল এতসব খেয়াল করেনি। হাজার হোক প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে! হঠাৎ তার মনে হল আরে সামনেই তো নদী। পানি দিয়ে একটু পরিষ্কার করলে মন্দ হয়না।
যেই ভাবা সেই কাজ। নদীর তীরে একটা ঝুলন্ত অংশ মত ছিল। সে সেখানটায় গিয়ে পা বাড়িয়ে ধরল পানিতে। নদীর সেই ঝুলন্ত অংশটা ছিল ভেতর থেকে খয়ে যাওয়া একটা বাড়তি পাটাতন। অর্থাৎ উপর থেকে শক্তপোক্ত প্ল্যাটফর্মের মতো মনে হলেও আসলে ফাঁপা ছিল সেটা। করিম দাঁড়ানোর সাথে সাথে হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে গেল পানিতে।
বুক পর্যন্ত পানিতে চলে যেতে যেতে করিম কোন রকমে পাড়টা আঁকড়ে ধরল। পাড় ধরে ভয়াবহ আতঙ্কে, হতভম্ব হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে করিম। এই দৃশ্য দেখে আমাদের হাসি আর থামায় কে? হাসতে হাসতে আমাদের পেদে ফেলার দশা।
হাসতে হাসতেই আমরা গিয়ে করিমকে টেনে তুললাম পানি থেকে। আমাদের লাল্টু ব্রাদার কাদা মেখে, পানিতে ভিজে আজকে যাবে শ্বশুর বাড়ি! এই নিয়ে আরও কয়েক দফা হাসাহাসি চলল আমাদের।
শেষমেষ নৌকা এলে পরে ভয়ে ভয়ে উঠলাম আমরা। তবে খরস্রোতা হলেও এইবারে ঠিকঠাক মত পার হলাম। তারপর মাইল খানেক হেঁটে পৌঁছলাম কান্তজীর মন্দিরে। মন্দির টা সুন্দর। প্রচুর টেরাকোটা নিদর্শনে মোড়ানো দামী একটা ঐতিহ্য আমাদের। অথচ যত্নের অভাবে করুন দশা।
এরপর সেখান থেকে রিক্সায় করে রাজবাড়ী দর্শনে গেলাম। সেখানেও প্রাচীন নির্দশনগুলোর একই রকম হতদরিদ্র অবস্থা দেখতে পেলাম। ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে। তাই দিনাজপুরের এক হোটেলে খেয়ে নিলাম আমরা চটপট। হোটেলের বাথরুমে একটু পরিষ্কার হবার চেষ্টা করলাম আমরা। চুলটা একটা পরিপাটি করে, কোমরে শার্টটা গুঁজে ভদ্রস্ত হবার চেষ্টা আরকি।
আমাদের ধারনা ছিল করিম হয়ত শেষমেষ স্বীকার করবে যে মেয়েটির কথা ভুয়া। আমি আর আম্মান তাকে কয়েক বার বলেছি, "স্বীকার কর যে তোর কারো সাথে কিছু নাই, আমরা বাড়ি ফিরে আর কাউকে কিছু বলব না"। কিন্তু করিম অনড়।
খেয়ে দেয়ে যখন বেরিয়েছি তখন প্রায় দুপুর তিনটা হবে। বেরিয়ে দেখি করিম ঠিকই রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বলছে। আমরাও মনে মনে লজ্জ্বিত হয়ে পড়লাম ওকে সন্দেহ করেছি দেখে। রিকশা গিয়ে থামলো এক বাড়ির সামনে।
রিকশা থেকে নেমে দেখি করিম আম্মানের কানে কানে কি যেন বলছে। শুনে আম্মান বলে, "ওরে চো×ন, আগে কবি তো! তুই দরজায় বাড়ি দে যা। আমি কিছু করতে পারব না।"
করিম একটু কাচুমাচু ভঙ্গিতে দরজায় বাড়ি দেয়। এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলেন। করিম সালাম দেয়, "স্লামালেকুম খালাম্মা। রফিক আছে?"
"না বাবা রফিক তো বাসায় নাই। তুমরা কুন্ঠে আচ্চো বাবা?"
"আমরা রংপুর থেকে আচ্চি চাচীআম্মা। রফিকের বন্দু", করিম জবাব দেয়।
"অ রফিকের বন্দু তুমরায়? তা আসো আসো ভিতরে আসো", ভদ্রমহিলা আমাদের ভিতরে ডাকেন। আমরা ছয় বান্দর লেজ গুটিয়ে ভিতরে গিয়ে বসি।
"তোমাদের কার নাম কি যেন? অনেকদিন তো, চেহারা মনে আছে। নাম ভুলি গেছি", রফিকের মা জিজ্ঞেস করেন। আমরা পরিচয় দেই। তিনি করিম আর আম্মানকে চিনতে পেরেছেন বলে দাবী করেন।
"চাচীআম্মা সুপ্তী কেমন আচে?", এতক্ষনে করিম গুটি চালে।
"সুপ্তি তো ভালই আচে। এই সুপ্তি কুন্ঠে গেলি। রফিকের বন্দু করিম, আম্মান এরা আচ্চে। এদিক আয়।", চাচী আম্মা ভিতরের দিকে হাঁক দেন।
এতক্ষণে আসলে আমরা ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করেছি। করিম আর আম্মানের রফিক নামে একটা বন্ধু ছিল রংপুরে। তার একটা ছোট বোন ছিল। কাহিনী তাকে নিয়েই। এই বন্ধুরা পরে দিনাজপুরে চলে আসে। কিন্তু ঠিক কদ্দুর কি সেটা বুঝা যাচ্ছে না এখনও।
সুপ্তির মুখ দেখা গেল। আমাদের দেখে যারপরনাই অবাক। কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে "কেমন আছেন" জাতীয় প্রশ্ন করে ভেতরে চলে গেল। আমাদেরও হঠাৎ করে নিজেদের কেমন যেন বেকুব মনে হতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছে বিষয়টা ভাল হয়নি।
চাচীআম্মা এসে চা দিবেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমরা না কোন দরকার নাই, বাস ধরতে হবে এইসব বলে বেরিয়ে আসলাম। বেরিয়ে এসেই হাফ ছাড়লাম আমরা। স্পষ্টতঃ বোঝা যাচ্ছে যে বন্ধুর বোনটাকে করিম হয়ত পছন্দ করত। মেয়েটাও হয়ত কিঞ্চিত মধুর কথা বলে থাকবে। কিন্তু বিষয়টা কখনই প্রেম বলার মত গভীর কিছু ছিল না। পরে তারা সপরিবারে দিনাজপুরে চলে আসলে বিষয়টাও চাপা পড়ে যায়। আমাদের পিয়ার প্রেসারে করিম বেচারাকে এই কান্ড ঘটাতে হয়েছিল।
এরপর রিক্সা ধরে বাসে ওঠা পর্যন্ত করিম একটা কথাও বলেনি। বাসে ওঠার আগে ছয়টা বেনসন কিনে একটা করিমের হাতে দিয়ে বললাম, "ব্যাপারনা। প্রেমে মরা জলে ডোবেনা।" করিম ফিক করে একটা হেসে দিয়ে সিগারেটটা হাতে নিল।
মন্তব্য
হা হা হা
মজা পেলাম খুব।
আসলেই ওই বয়সটা ভীষণ অন্যরকম, না?
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
নতুন মন্তব্য করুন