১.
যুগের সাথে সাথে টিনএজারদের মধ্যে একটা করে ক্রেজ ওঠে। ব্যান্ড করতে হবে, কিংবা পশ্চিমা সঙ্গীত করতে হবে এই ক্রেজটা উঠেছিল ৮০-২০০০ এর দশকে। তখন কান্ট্রি মিউজিক থেকে শুরু করে, রক, মেটাল এইসব উঠে আসছিল মূল ধারার মিউজিক হিসেবে।
বাংলাদেশের মিউজিক আশির দশক এবং পূর্ববর্তী সময়ে আসলে মূলত মাঝবয়সীদের দখলে ছিল। যেহেতু তখন মিউজিক সিস্টেম বা বাদ্যযন্ত্রের মূল্য এসব কিছু ছিল টিনএজারদের ধরা ছোয়ার বাইরে। পরবর্তীতে এসবকিছু অল্প বয়সীদের দখলে চলে এলে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির মোড় ঘুরতে শুরু করে।
নব্বইয়ের দশক ছিল ব্যান্ড গানের রমরমা অবস্থা। অনেক অনেক ছোট খাট ব্যান্ড ব্যাঙের ছাতার মত গজে উঠেছিল। কোন কিছুর আধিক্যই ভাল নয়, সেটাই হতে শুরু করল। পড়ালেখা ছেড়ে মিউজিকের পিছনে ছুটতে থাকা অনেকেই আছাড় খেয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে কমতে শুরু করল এই ক্রেজ।
আগের একটা পোস্টেই উল্লেখ করেছিলাম আমার মিউজিকের গুরু ছিল হাসান। তখন আমি বাংলা কলেজে। সাহিত্য নিয়ে আমি, প্রলয় আর জয় খুব লাফাচ্ছি। নিয়মিত কবিতা লেখালেখি, আবৃতি এইসব নিয়ে দিন কাটছে। হাসানের সাথে পরিচয়ের পর আমি গীটার শেখার আগ্রহ দেখালাম। একদিন মেলোডীতে গিয়ে পুরোনো হাওয়াইন গীটারটিকে স্প্যানিশ করে নিয়ে আসলাম।
এর মাঝে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলে আসল। আবার চলেও গেল। তারপর একদিন ভারতের সিগনেচার কোম্পানীর একটি গীটার কিনে নিয়ে আসলাম। এর মাঝে একদিন সকাল বেলা দেখি আমার গীটারটি ভেঙ্গে পড়ে আছে। আর আমার চিৎকার দেখে কে? ধারনা করলাম আমাদের কাজের ছেলেটার কাজ এটা, যদিও ব্যাটা কখনো স্বীকার করেনি।
গলা আমার কখনোই ভাল ছিল না। তার উপর মেটাল, ইনস্ট্রুমেন্টাল মিউজিকে দূর্বলতা দেখা দিতে লাগল। তাই গান গাওয়া বা গান তোলার চেষ্টার চেয়ে গীটার গ্রামার আর বিভিন্ন জটিল বিষয় নিয়ে চর্চা চলত বেশী।
২.
কোন কোন গীটারিস্ট আছে যারা মিউজিকের তাত্ত্বিক বিষয় ততটা ভালো জানেন না, কিন্তু হাত খুব ভালো। এরা চট করে কোন গান তুলে ফেলতে পারেন, কিন্তু নতুন কোন ভ্যারিয়েশন বা এক্সপেরিমেন্টাল কিছু তৈরী করতে অতটা সাকসেসফুল নন।
আবার কোন কোন গীটারিস্ট আছেন যারা মিউজিকের তাত্তি্বক বিষয়গুলো খুব ভালো বোঝেন কিন্তু হাত অতটা ভালো না। তাই তারা এসব বিষয়ে কথা বলার সময় তাদের অনেক ভালো গীটারিস্ট মনে হলে বাজাতে গেলে তারা একটু বোকারামই মনে হয়।
ভালো গীটারিস্ট হতে হলে এই দুটো দিকেই ভালো হতে হয়। আমি মূলত দ্বিতীয় প্রকারের গীটারিস্ট ছিলাম। যতটা না বাজাতে পারতাম তার চেয়ে বেশী বলতে পারতাম। এতে করে মাঝে মাঝে কিছু অকওয়ার্ড সিচুয়েশনে পড়তাম।
একবার আমার রংপুর নিবাসী খালাতো ভাইয়ের প্রতিবেশী একটি ছেলের সাথে। তাকে বেশ কিছু আনইউজুয়াল ট্রিকস দেখালাম। দেখে সে মনে করল আমি নিশ্চয়ই একটা খাসা চিজ। আমাকে না জানিয়ে একদিন নিয়ে গেল এক আড্ডায়। সেখানে যাবার পর বুঝলাম সে কিছু একটা বলেছিল আমাকে নিয়ে। সেখানে যে ছেলেটি গীটার বাজাতে সে রীতিমত চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে আমার সাথে বসল গীটার নিয়ে। কিন্তু যথারীতি আমি তেমন চমক দেখাতে পারলাম না।
একই ভাবে পরিচয় হয় সবুজ নামে এক বন্ধুর সাথে। আমার ছোট ভাইয়ের সাথে পরিচয় ছিল সবুজের। আমার ছোট ভাইও মনে করত আমি খুব ভাল বাজাতে পারি। সবুজের কাছে কি বলেছিল জানি না। তবে সবুজ সেই আগারগাও থেকে আমাদের বাসায় এসেছিল আমার সাথে পরিচিত হতে। এসে অবশ্য হতাশ হয়েছিল। তবে সবুজের সাথে বন্ধুত্বটা তৈরী হল এইভাবে।
৩.
সবুজ ছেলেটা ছিল হার্ড কোর গীটারিস্ট। খুব ভাল হাত ছিল সবুজের। তবে সে ডেথ মেটাল, থ্র্যাশ মেটাল, ইনস্ট্রুমেন্টাল এই সব ধারার মিউজিকগুলো করত। সবুজই আমাকে বিভিন্ন রিসোর্স সরবরাহ করে সাহায্য করা শুরু করে। পরে আমি সবুজকে হাসানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তখন ওরা কিছুদিন এক সাথে বাজিয়ে ছিল।
সবুজের একটা সমস্যা ছিল, সহজে কারো সাথে ফ্রেন্ডশীপ গড়ে উঠত না। গীটার বাজানোর সময় উন্মাদের মতো বাজাতো। মিউজিকের পুরো ব্যাপারটা যে কো-অপারেশন সেটা মাথায় থাকত না। ফলে তার সাথে কেউ পরবতর্ীতে বাজাতে চাইত না।
এছাড়াও আরও অনেকের সাথে পরিচয় হল এই সুত্রে। বেলাল নামে খুব ভাল একটা ছেলের সাথে পরিচয় ছিল। তাছাড়া মোহাম্মদপুরে আরও অনেক অনেক ছেলের সাথে পরিচয় ছিল তখন।
আমি যখন বুয়েটে প্রথম সেমিস্টারে পড়ি। তখন আমি আর হাসান ঠিক করি সিরিয়াস কিছু করা দরকার। হাসান যদিও তখন খুবই ভালো বাজাত, তবু থিয়োরেটিক্যাল বেসিস ঠিক করার জন্য সেও ভাবল কারো কাছে শেখা দরকার।
আমরা ওয়ারফেজের কমল ভাইয়ের কাছে গীটার শেখা শুরু করলাম। আমি, হাসান আরেকটা ছেলে (নাম মনে পড়ছে না) একসাথে যেতাম কমল ভাইয়ের কাছে। আমাদের শিক্ষা শুরু হলো আরো থিয়োরীটিক্যাল বেসিস নিয়ে। বিভিন্ন স্কেল, তাদের ভেরিয়েশন, রান, এইসব শিখতে লাগলাম।
৪.
তখনও কিন্তু আমাকে একটা গান বাজাতে দিলে পারতাম না। কেননা তখনও আমি গীটার শিখছি গান নয়। একটা দুইটা গান বাজাতে পারি কিন্তু প্রথম একটা দুইটা প্যারার পর বাকি কথাগুলো আমি জানি না। কেউ গাইলে তার সাথে বাজাতে পারি কিন্তু নিজে গাইতে পারি না।
লোকের একটা ভুল ধারনা আছে গীটারিস্টদের নিয়ে। যারা বাজায় তারা গানও গায়। কিন্তু আসল ব্যাপারতো সেরকম নয়। আমি শুধুই বাজানোর জন্য গীটার শিখতাম। আর তার জন্য বেশ কয়েকবার আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
এরকম একবার বুয়েটের প্রথম সেমিস্টার শেষে এক পিকনিকে গিয়েছি। আমার বন্ধু বান্ধবরা জানে আমি গীটার বাজাই। লম্বা লম্বা চুল নিয়ে বেশ ভাবেই থাকি। সেই পিকনিকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া এক ছেলে গিয়েছে। সে ব্যাটা গীটার বাজিয়ে খুব ভালো গান গায়। সবাইতো হুমড়ী খেয়ে পড়েছে সে ব্যাটাকে নিয়ে। তো আমরা বন্ধুরা একটু আলাদা বসে আছি। আমাদের এক বান্ধবী খুব এন্থুজিয়েস্টিক ভাবে গীটারটা ওই ছেলের কাছ থেকে এনে আমাকে দিল বলল, নে গান গেয়ে শোনা। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। টুকটাক স্কেল টেল বাজাই, বিভিন্ন গানের লিড গুলো বাজাই। কিন্তু পোলাপান তো সেটা শুনতে চায় না তারা শুনতে চায় "গান"। খুবই এম্বেরেসীং সিচুয়েশন!
আরেকবার এক বন্ধুর বাসায় গেছি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। সে হঠাৎ একটা গীটার বের করে দিল গান গাইবার জন্য। আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম। তবুও কোনরকমে জেমসের একটা গান গাইলাম। শেষে আমার বন্ধুরা হাসতে হাসতে আমাকে পঁচাতে লাগল।
সে সময়টায় প্রথম সেমিস্টার শেষ, বুয়েটের ভাঙচুর হয়ে পরীক্ষা পিছিয়ে গেল। তিন মাসের উপর বুয়েট বন্ধ ছিল। পুরোটা সময় আমি সদ্য আবিষ্কৃত ইন্টারনেট আর গীটার নিয়ে সময় নষ্ট করলাম। তিনমাস পর যখন পরীক্ষা হল তখন বইয়ের ধুলো ঝেড়ে পরীক্ষা দিয়ে চরম চরম রেজালট খারাপ করলাম। সব দোষ গিয়ে পড়ল আমার ওই গীটার শেখার ওপর।
৫.
পরের সেমিস্টার থেকে মোটামুটি জোর দিলাম পড়াশুনায়। গীটার শেখার ফ্রিকোয়েনসী কমে আসল। দ্বিতীয় সেমিস্টারে আবার আমার জীবনে খানিকটা প্রেমের জটিলতাও শুরু হল। আরো শুরু হল প্রোগ্রামীং কনটেস্ট নিয়ে দৌড়দৌড়ি। সব মিলিয়ে গীটারে আর সময় দেয়া হত না। পরীক্ষার আগে আগে একদিন ঠাস করে চুলটা কেটে ফেললাম আমি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে কিভাবে যেন রেজালটটা ভাল হয়ে গেল। অতটা খাটাখাটনি করিনি তবুও বেশ ভালো হয়েছে দেখে আমি আরও উৎসাহিত হলাম পড়াশুনায় আরও বেশী সময় দেবার। দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার থেকে আরও আরও ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম পড়াশুনা, প্রোগ্রামিং কনটেস্ট, পত্রিকায় লেখালেখি নিয়ে। ততদিনে সাহিত্য আর গীটার দুটোই খোদা হাফেজ জানিয়েছে আমাকে।
বুয়েটের কোন অনুষ্ঠানে কেউ আমাকে কখনো ডাকতোও না যেহেতু কখনো তাদের কিছু বাজিয়ে শোনাইনি। তাদের কাছে আমি ফেইক গীটারিস্ট।
গীটারটা আবার ধরলাম চতুর্থ বর্ষে এসে। মাশিদরা জোরেসোরে বাৎসরিক মেকানিক্যাল দিবসের অনুষ্ঠান করছে। আমার মনে হল আহা বুয়েট ছেড়ে চলে যাবো কোন কন্ট্রিবিউশন ছাড়াই! হঠাৎ করেই আগিয়ে আসলাম আমি ও আমার তৎকালীন প্রেমিকা (এখন স্ত্রী)। সবাই একটু অবাক হলেও ট্রাই করতে দিল আমাদের। সে অনুষ্ঠানে আমি অনেক বছর পর আবার আবৃতি, জীবনে প্রথমবারের মত অভিনয় আর আমার স্ত্রীর গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে গীটার বাজালাম।
সবার ফিডব্যাক থেকে মনে হল যে নাহ লেগে থাকা যায় আবার। তবে এবার সাধারন মানুষ যা খায় সেই গানই, থিয়োটিক্যাল গীটার নয়। সেটা আর সম্ভবও নয়।
এর মাঝে আমেরিকা চলে আসলাম। বছর দেড়েক আর কিছু হয়নি। দেশে ফিরে গিয়ে এইবার একটা গীটার কিনে নিয়ে আসলাম। তারপর থেকেই চলছে। প্রতিদিন কিছু না কিছু বাজাচ্ছি। যেন আবার ফিরে পেয়েছি হারিয়ে যাওয়া মনি মানিক্য। যত্নের শেষ নেই।
আর হয়ত সেই ক্রেজি দিন গুলোতে ফিরে যেতে পারবনা। পারবনা গীটারের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে। ব্যর্থ সেই গীটার শেখা, ব্যর্থ আমার গীটার সাধনা। কিন্তু তবু গীটারের জন্য ভালোবাসা নিয়ে বাস করব বাকিটা জীবন।
মন্তব্য
আগে পড়েছিলাম একবার পুরোটা।
আপনাদের নতুন এক্সপেরিমেন্ট কই? আগেরটা পছন্দ হইছিলো খুব।
-যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
করা হচ্ছে না। দেখি বসব একদিন।
====
মানুষ চেনা দায়!
মেলোডি কি চিটাগাং-এর?
বহুত শখ আছিলো গীটার শিখনের, শেখা হইলো না। বহুত দৌড়াদৌড়িও করছি, লাভ হয় নাই। লাইগা থাকতে পারি নাই। দেশ ছাড়নের সময় আম্মা কয় এই আপদটাও দূর কর। আমি কইলাম থাউক, ফিরা আইসা আবার শুরু করুম। মায়া পইড়া গেছে জিনিটার উপর।
_______________________________________
পোড়াতে পোড়াতে ছাই, ওড়াতে ওড়াতে চলে যাই . . .
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
মেলোডী চিটাগাংয়েও দেখছি মনে হয়। তবে এখানে ঢাকারটার কথা বলেছি।
====
মানুষ চেনা দায়!
আমিও তো একদা গীটার শিখিতাম, মাগার কিছুই শিখা হয় নাই।
লেখতে হইবো অই কাহিনী নিয়া খাড়াও।
_________________________________
<স্বাক্ষর দিমুনা, পরে জমিজমা সব লেইখা লইলে!>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
লিখা ফালাও আর শিখা ফালাও।
====
মানুষ চেনা দায়!
পুরা ইতিহাস দেখি এইখানে।
কিন্তু পুরাটাই পড়ে ফেললাম।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
ইতিহাস তুমি ভুবনে ভুবনে
কাজ করে যাও গোপনে গোপনে
====
মানুষ চেনা দায়!
নতুন মন্তব্য করুন