প্রথমে ফেললাম বইগুলো। অনেক কষ্টে সংগ্রহ করেছিলাম। জ্যারেড ডায়মন্ড, রিচার্ড ডকিন্স, চেনা অচেনা অনেক ফিকশন। বুকে পাথর বেঁধে অনুজপ্রতীম খানসাপকে বইগুলো পাঠিয়ে দিলাম।
তারপরে ফেললাম কাপড় চোপড়। ফেলতে গিয়ে কত স্মৃতিময় টি-শার্ট বেরুলো। বাংলাদেশ লিনাক্স ইউজার গ্রুপ, গ্রাজুয়েট স্কুলের হরেক রকম শার্ট। বিভিন্ন চাকরী করতে গিয়ে পাওয়া টি শার্ট। কত কিছু। বুকে পাথর বেঁধে ফেললাম সেগুলো। কত কাপড় কিনেছি পরাই হয়নি। কত কাপড়ের চল উঠে গেছে। বস্তা বেঁধে ফেলে আসলাম গুডউইলে। ডু ইউ নিড আ রিসিট স্যার – আবার জিগায়।
তারপরে ফেললাম আসবাব পত্র, ম্যাট্রেস, শিশু জীয়নের আসবাব, খেলনা, কার সিট। বড় ঝামেলা হলো বড় আসবাবগুলো ফেলতে। ট্রাক আনতে হবে দেখে কেউ বিনামূল্যেও নিতে রাজি নয়। কিছু বিক্রী হলো, কিছু বিনামূল্যে দিলাম। ময়লা ফেলার লোকগুলো পর্যন্ত বিরক্ত।
ফেললাম ইলেকট্রনিক্স, কিবোর্ড, অ্যডাপ্টর। হাবি জাবি কতকিছু।
ড্রেইনে চলে গেলো পানীয় গুলো। কিছু নিলো বন্ধুরা।
তারপর ফেললাম বাড়িটাকে। বড় শখ করে কেনা। থাকবো বলেইতো এসেছিলাম। থাকবো বলেই সংসার পেতেছি এইখানে। কত শখ করে পর্দা বসিয়েছি, আসবাব কিনেছি, টুকটাক কত যত্ন করে সাজিয়েছি সংসার। চলে যাবো খালি বাড়িটা ফেলে। খালিই পড়ে থাকবে বিক্রী হবার আগ পর্যন্ত।
সবশেষে ফেললাম বন্ধুদের। এত বছরের বন্ধুগুলো। এত দিনের মেলামেশা। কেউ কাছে এসেছে, কারু সাথে দূরত্ব। বিপদে আপদে সবাই ছিলাম একসাথে। তাদের ফেললাম। কষ্ট হলো সবচে বেশী। কিন্তু ফেললাম একে একে সবাইকে।
বুকের মধ্যে শূন্যতা। শেকড় কেটেছে তো সেই কবেই। শেকড় ছাঁড়া টাম্বলউইড আমি। উড়ে যাচ্ছি নগর থেকে নগরে। আর পেছনে ফেলে যাচ্ছি বন্ধুত্বের শবদেহ।
মন্তব্য
প্রথমবার দেশ ছাড়ার সময় বই ফেলে আসার কষ্ট এখনো ভুলিনি। বিদেশে এসে আবার কিছু কিছু করে বইয়ের তাক ভরছিলো। দুইবছর পর আবার সব ফেলে দিতে হলো। এরপর আর পারতপক্ষে কাগজের বই কিনিনা!
নিয়ম করে পুরনো জিনিস ফেলে দেয়ারও অভ্যাস করেছি। অথচ দেশে থাকতে সব জমিয়ে রাখতাম!
পরবাসের জীবনটাই বোধহয় এমন!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ঢাকায় কত কত বই ফেলে আসলাম। ভাবলাম এই বেলা বোধয় থিতু হওয়া গেল।
আমি ব্যাচেলর+ছাত্র অবস্থায় এক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাসা পাল্টায়ে পাঁচ মিনিট ড্রাইভিং দূরত্বের আরেক অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার সময়ই টের পাইছিলাম যন্ত্রণা। সেই থেকে ঠিক করছিলাম যে, নিজে কোনদিন বাড়ি কিনলে তবেই বই কিনবো। তারপরও নাই নাই করে, অনেক বই কিনে ফেলছি। সামনের সপ্তাহে আবার বাসা পাল্টাচ্ছি। বইয়ের দিকে তাকাইলেই আতংক লাগে
অলমিতি বিস্তারেণ
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কাছাকাছি শহরে হলে বাক্সে করে নিয়ে যান। অনেক দূরে যাচ্ছি তায় আবার ছোট এক বাসায়। সেকারনে নেয়া হয়নি আমার।
প্রায় তিন দশক আগে বাড়ি ছাড়ার পর এই পর্যন্ত মোট ৬ বার নিবাস পাল্টেছি। আমার সৌভাগ্য যে, আমাকে শহর বা দেশ পাল্টাতে হয়নি। তাই আমার পক্ষে আপনার অনুভূতি ঠিকঠাক অনুধাবন করার দাবি সঠিক হবে না।
নিজেদের কাপড়চোপর, ইলেকট্রনিক্স ফেলে দেবার বা দিয়ে দেবার সময় কোন কিছু মনে হয় না। কিন্তু বাচ্চার একটা ভাঙা খেলনা ফেলতেও দশ বার ভাবতে হয়।
বাসা বা শহর বা দেশ না পাল্টালেও বেশিরভাগ 'বন্ধুত্ব' একটা সময় পর "বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়, নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি। তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য-ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।।" - নীতি অনুযায়ী মারা পড়ে। চাইলেও অনেকগুলো 'বন্ধুত্ব'র মৃত্যু ঠেকানো যায় না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
শিকাগো ছাড়ছেন!
আমরা গতবছর তিনঘন্টা টাইম জোন বদল করেছি (পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূল)। থিতু হবার কনসেপ্টটাই পরিষ্কার হল না আজ অবধি। কষ্ট করে কেনা জিনিস যখন খেলো/মূল্যহীন হয়ে অনাদরে আবর্জনার স্তুপে চলে যায় -সেটা একটা সূক্ষ্ম বেদনা তৈরি করে।
যেখানেই যান, ভাল থাকুন।
শুভ সূচনা হোক নতুন নিবাসে, শুভেচ্ছা
মন খারাপ করবেননা। সিয়াটলের বাংলাদেশীরা লোক ভালো।
ষষ্ঠ পাণ্ডবের ট্যাগ লাইনটাই বলতে লাগে - "তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।"
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন