১। ভূমিকা
অনেক সময় বয়োজেষ্ঠ্যদের বলতে শোনা যায়, 'ছেলেটা কি ভাল ছিল, ধর্ম্ম কম্ম করত। আর যেই তাকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছি আর সেই সে শয়তান হয়ে গেছে। নামাজ কালামতো পড়েই না বরং উলটা পালটা কথা বলে।' কিংবা ভীষন তর্ক যুদ্ধে একজন দাবী করে বসে শিক্ষা দীক্ষা লাভ করে অপরপক্ষ মুরতাদ হয়ে গেছে। আমাদের আশেপাশেই এরকম ভুরি ভুরি উদাহরন আছে।
আসলে পার্থক্যটা কোথায়? উচ্চতর শিক্ষা আমাদের অনেক কিছু শেখায় বুঝলাম। কিন্তু মানুষের মধ্যে বুদ্ধির কি পরিবর্তন আনে যার জন্য একজন শিক্ষিত মানুষ অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে যায়? ব্যাপারটা নিয়ে গবেষনা শুরু করেন উইলিয়াম পেরী নামক এক ভদ্রলোক। তার লক্ষ্য ছিল, কেন কোন কোন ইউনিভার্সিটি অন্য ইউনিভার্সিটির চেয়ে ভালো সেটা যাচাই করা। সেটা করতে গিয়ে তিনি এক থিয়োরী আবিষ্কার করে ফেলেন।
পেরীর থিয়োরীর কোন প্রমান নেই। তবে পরবর্তী কয়েকটি গবেষনা এটাকে ঠিক বলে খুঁজে পেয়েছে। পেরী আসলে মানুষের বুদ্ধিভিত্তিক উন্নতির একটি ধারা চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। এই ধারা অনুযায়ী ছাত্রদের বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে ভাগ করে ফেলা যায়। এবং তাদের বুদ্ধির একটি মান পাওয়া যায়।
পেরী বলেন মানুষ বা আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে ছাত্রদের মানসিক উন্নতি একটি মানদন্ড অনুযায়ী বেড়ে ওঠে। একে পেরীর মানদন্ড বা পেরীর স্কেল বলে। এই মানদন্ডটা নয় ভাগে বিভক্ত এবং মানদন্ডের কয়েকটি ভাগ নিয়ে আবার বড় চারটি ধারা আছে।
২। ধারা ক. দ্বৈত মত বা ধার করা জ্ঞান
এ পর্যায়ে ছাত্ররা বা লোকে ভাবে পৃথিবীর সমস্ত প্রশ্নের ঠিক বা ভুল উত্তর রয়েছে এবং সেটা কোননা কোন গুরু জানেন। যেহেতু শুধু ঠিক বা ভুল এই দুয়ের মধ্যে তার জানা সীমাবদ্ধ তাই একে দ্বৈত মত বলা হয়।
আলোচনা
প্রথম কার্টুনটি দেখুন। একটি বাচ্চা ছেলে আরেকটি বাচ্চাকে বলছে সে অষ্টম শ্রেনীতে উঠলেই পৃথিবীর সবকিছু জেনে ফেলবে। তাদের মনে জ্ঞানের সীমাটা ওইটুকুই। এখানে আরও একটা উদাহরন দেয়া যায়, আপনি পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে যতই উপরে উঠবেন ততই আপনার সীমারেখা বাড়তে থাকবে।
দ্বিতীয় কার্টুনটি দেখুন। বাচ্চা ছেলেটি দাবী করছে যে বাঁদুড় নিয়ে যেহেতু তাকে রচনা লিখতে বলা হয়েছে তাই শিক্ষকের দায়িত্ব ছিল বাঁদুড় সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য তাকে দিয়ে দেয়া। রচনা লেখাটাই যে বাঁদুড় সর্ম্পকে জানার বা শিক্ষার একটা পদ্ধতি সেটা সে মেনে নিতে পারছে না।
তৃতীয় কার্টুনটিতে একটি গতানুগতিক ক্লাশরুম দেখানো হয়েছে। যেখানে ছাত্ররা ক্লাশ নোট তুলতেই ব্যাস্ত। শিক্ষক যে কত আলতু ফালতু বলছে সেটা নিয়ে কেউ টু শব্দ করছে না। কেননা তারা ধরেই নিয়েছে শিক্ষকরা সব জানে, সব সময় সঠিক কথাটি বলে।
আমরা আমাদের সমাজে কিভাবে দেখতে পাই এই মানদন্ডের মানুষগুলোকে? যারা ধরেই নেয় হুজুর বা আলেম ওলামা বা পীর ফকির সব জানে! আমি অনেক শিক্ষিত লোককে দেখেছি পীরের মুরিদ হিসেবে জীবন দিয়ে ফেলতে। শিক্ষা তাকে এই মানদন্ডের বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি। তাদের কাছে পৃথিবী ভাল-মন্দ, সাদা-কালো, আস্তিক-নাস্তিক এই দ্বৈততার বাইরে আর কিছু না। বাকিরা আস্তিক না হলে নাস্তিক, প্রশ্নের জবাব আমার কাছে না থাকলে কি হবে আমার গুরুর কাছে আছে।
চিন্তা করে দেখুনতো আপনি এই স্তরে কিনা?
৩। ধারা খ. যৌগিকগুন বা বৈষয়িক জ্ঞান
কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর একে অপরের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরী করে। সুতরাং নিজের অন্তরকে ছাড়া কারো কথা বিশ্বাস কোরো না। যেহেতু এ পর্যায়ে মানুষ যৌগিক বিষয়গুলো নিয়ে নাড়া চাড়া করতে পারে তাই একে যৌগিক গুন বলা হয়।
আলোচনা
প্রথম ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একটা শিশু রান্না বাটি খেলবে বলে বসে আছে। আরেকটি শিশু তাকে একটি আগাছা আগিয়ে দিয়ে বলছে সেটা রান্নার উপকরন হিসেবে চলবে কিনা? এটা হচ্ছে মানদন্ডে ৩ অবস্থানের ঘটনা, যেখানে ধরে নেয়া হচ্ছে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা, বাকিগুলোর উত্তর অজানা। এবং মানুষের কাজ হচ্ছে সঠিক উত্তরটা খুঁজে বের করা।
দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক ছাত্র আরেকছাত্রকে জিজ্ঞেস করছে, কিভাবে সে এত কঠিন একটা প্রশ্নের উত্তর দিত পারল? উত্তরে সামনের ছাত্রটা বলছে, "বানায়ে লিখলাম"। পিছনের ছাত্র আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছে, "এটা করলা কি বুদ্ধিতে?" তখন সামনের ছাত্র বলছে, "আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে দেখি আমার জানার উৎসগুলো ঠিক আছে কিনা?" এটা মানদন্ডে ৪ এর একটি ঘটনা, যেখানে ছাত্রগুলো ধরে নিচ্ছে সমস্যার সমাধানই নাই, তাই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে দেখা যাক।
তৃতীয় ও চতুর্থ ছবিতে জীবন গণিতের মতো সাদা-কালো না গদ্য রচনার মতো ধুসর সেটা নিয়ে একটি দোনোমনা দেখানো হয়েছে।
পঞ্চম ছবিতে দেখানো হয়েছে, এক ছাত্র শিক্ষককে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে দুয়ে দুয়ে যোগফল পাঁচও হতে পারে, কেননা বেশীরভাগ সমস্যার একাধিক সমাধান রয়েছে।
ষষ্ঠ এবং সপ্তম ছবি কিছু পরিচিত প্রতিক্রিয়া যেটা মানদন্ডে ৩/৪ ধরনের ছাত্রদের মধ্যে দেখা যায়।
কি ঘটতে পারে?
এই মানদন্ডের অবস্থানে ছাত্রদের যে সমস্ত সমস্যা হতে পারে থাকে সাধারন ভাবে "নিজেকে দুরে সরিয়ে দেয়া" বা এলিয়েনেশন বলা যেতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে মানুষ নিজেকে হয় আগের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যায় (যেমন সাহিত্য না পড়ে গনিত পড়া, যেখানে সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর আছে।) অথবা পালিয়ে যায় (যেমন আমাকে দিয়ে পড়া শুনা হবে না, তারা খালি সঠিক উত্তর চায় বা কেউই তোমাকে ঠিক উত্তরটা দিতে পারবে না।)
ছবি আট আর নয় এই ব্যাপারটাকে ফুটিয়ে তুলেছে।
আমার দুই পয়সা
অনেক সময় অনেক তর্কে কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, দুই পক্ষের যুক্তিই সই, এ ব্যাপারে কোন সমাধান নেই তাই আর তর্ক চলতে পারে না। এরা না পারে প্রথা ভাঙ্গতে না পারে প্রথার সাথে চলতে। এরা সাধারনত সব কিছু এড়িয়ে নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চায়।
৪। ধারা গ. আপেক্ষিক মনোভাব বা প্রথাগত জ্ঞান
এ পর্যায়ে ছাত্ররা বুঝতে পারে বিভিন্ন বিভাগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন যৌক্তিক পদ্ধতি আছে।
তারা বুঝতে পারে জ্ঞানকে বিভিন্ন ভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত করা যায়। এভাকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে জুড়ে জুড়ে সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা যায়। যেসমস্ত প্রশ্নে ছাত্রদের পারদর্শী দেখা যায় তার মধ্যে কিছু হল: 'কেন তুমি এই জিনিসটিতে বিশ্বাস কর তার যুক্তি দাও?', 'এই কবিতা থেকে কি বুঝতে পারলে?'।
তারা এও বুঝতে পারে জ্ঞানকে ভেঙ্গে আলাদাও করা যায়। এটাকে বলা যায় অবজেক্টিভ এনালাইসিস। যেমন: 'কি যুক্তি খাটিয়ে আমি সমস্যাটির সমাধান করতে পারি?'
"সত্যের সন্ধান বরং শুধু-সত্যটার চেয়ে অনেক মূল্যবান"
- আইনস্টাইন
৫। ধারা ঘ. দায়বদ্ধতা বা পরিনত জ্ঞান
এ ব্যাপারে একটি উক্তি:
"গনিত এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা অথরিটির কাছে না বরং আমরা নিজেই নিজের বিশ্বাসের কাছে দায়বদ্ধ"
- আর ডাবি্লউ হ্যামিং (1998)
(কম্পিউটার বিজ্ঞানী)
এ ব্যাপারে একটি উক্তি:
"আমরা জ্ঞানের একটি দ্বীপে বাস করি যার চর্তুপাশে অজ্ঞানতার সাগর। যতই আমাদের জ্ঞানের দ্বীপ বড় হতে থাকে ততই আমাদের চারপাশের অজ্ঞানতার বালুচর বাড়তে থাকে।"
- জন এ হুইলার (ফিজিসিস্ট)
৬। সারসংক্ষেপ
শিক্ষা মানুষের মধ্যে বুদ্ধির কি পরিবর্তন আনে যার জন্য একজন শিক্ষিত মানুষ অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে যায়? ব্যাপারটা নিয়ে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউনেসলিং এর প্রধান উইলিয়াম পেরী একটি মানদন্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন।
উপরের ছবিতে এ বুদ্ধিভিত্তিক উন্নতির একটি গ্রাফ দেখতে পাবেন।
ধারা ক. দ্বৈত মত বা ধার করা জ্ঞান
সমস্ত প্রশ্নের ঠিক বা ভুল উত্তর রয়েছে।
ধারা খ. যৌগিকগুন বা বৈষয়িক জ্ঞান
কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর একে অপরের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরী করে।
ধারা গ. আপেক্ষিক মনোভাব বা প্রথাগত জ্ঞান
বিভিন্ন ধরনের সমস্যার জন্য ভিন্ন ভিন্ন যৌক্তিক পদ্ধতি আছে।
ধারা ঘ. দায়বদ্ধতা বা পরিনত জ্ঞান
"আমরা জ্ঞানের একটি দ্বীপে বাস করি যার চতর্ুপাশে অজ্ঞানতার সাগর। যতই আমাদের জ্ঞানের দ্বীপ বড় হতে থাকে ততই আমাদের চারপাশের অজ্ঞানতার বালুচর বাড়তে থাকে।"
- জন এ হুইলার (ফিজিসিস্ট)
সংযুক্তি
১। উইলিয়াম রেপাপোর্টের ওয়েবসাইট
২। পেরী নেটওর্য়াক
এই লেখাটি এখানেই শেষ। তবে জনমতের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন মানদন্ডের মানুষের একে অপরের সাথে যোগাযোগ কিভাবে ঘটে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
মন্তব্য
টার্গেট ক্লাস এইট। বিসমিল্লাহ বইলা শুরু কইরা দেই।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
লোকে মনে হয় পালায় লেখাটা দেখলে।
====
মানুষ চেনা দায়!
কমপ্লিট? সামনে উইকএন্ড। আশাকরি, পুরোটা মনোযোগের সাথে পড়া যাবে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
আলহামদুলিল্লাহ। সহানুভুতি থাকল।
====
মানুষ চেনা দায়!
সুমন ভাই, আমার মাথার স্ক্রু দুটো তাহলে আপনার কাছে... আর আমি মিছেই এখানে সেখানে খুঁজে মরছি!
আগে স্ক্রু ফেরত দেন, মাথায় টাইট দেই, এর পর এই ভাব গম্ভীর লেখা পড়া যাবেখন।
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
ফেরত দিতে তো গেছিলাম টরেন্টোতে। আপনি তখন স্ক্র বিহীন এলোমেলো ঘুরিতছিলেন। আচ্ছা যান, ইমেইল কইরা দিমুনে।
====
মানুষ চেনা দায়!
হ, ইমেইলে অ্যাটাচ কইরা দিয়েন। স্ক্রু ছাড়া বিশেষ মনকষ্টে আছি।
************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
সুউউউপার লাগলো। ওয়াও। পোস্টটা সেরকম এপ্রেশিয়েশন পায় নাই দেখছি, কিন্তু আপনার কষ্টের জন্য ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই।
প্লিজ, প্লিজ, লেখেন! আর থাকলে, লিংক দেন।
সিরাতের লেখা থেকে লিঙ্ক পড়ে এলাম অসাধারণ লেখা। আমার যে যে বন্ধুরা শিক্ষকতায় আছে তাদের অবশ্যই পুরোটা জানা দরকার।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
নতুন মন্তব্য করুন