সুমন রহমানের গল্প: প্যাটার্ন খোঁজার অপপ্রয়াস

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি
লিখেছেন এস এম মাহবুব মুর্শেদ (তারিখ: শুক্র, ০৩/০৮/২০০৭ - ৭:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভুমিকা

লেখা পড়ার এক অদ্ভুত পদ্ধতি আমার। অন্য অনেকের মতো ছোট বেলা থেকে প্রচুর পড়তে পড়তে লেখা পড়ার চেয়ে চোখ বুলিয়ে যাবার অভ্যেস গড়ে উঠেছে। বেশীর ভাগ লেখার ক্ষেত্রে আমার এটা ঘটে। পাঠক হিসেবে আমি হয়ত তাই সেরা নই।

কিন্তু কিছু লেখা চট করে আমার মনোযোগ কেড়ে নেয়। তখন রস আস্বাদী শেকড়ের মতো ঢুকতে থাকি লেখা নামক ভুমির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পরম আনন্দে শুষে নেই যতটুকু পারি। বৃক্ষের বর্জ্য প্রানদায়ী অক্সিজেনের মতো আমার বর্জ্য হয় মন্তব্য।

কোন কোন লেখার থেকে যা পাই তা শুধু সাধারন রস নয়। বরং কঠোর পানীয়ের মতো নেশার বস্তু। ঘোর লেগে থাকে পান করবার অব্যবহিত পরে, অনেক্ষন। ঘোর লাগায়, ভাবায়, উত্তরন ঘটায় কোন এক নতুন বোধে।

তবে হালকা ভাবে চোখ বুলাই আর গভীর ভাবে পড়ি - যাই করিনা কেন, আমার চোখ বিশেষ কিছু খুঁজতেই থাকে। সেই বিশেষ কিছুটা হচ্ছে লেখার প্যাটার্ন। লেখার মাঝে থেকে আমার চোখে ফুটে উঠে আঁকিবুঁকি, আল্পনা, তৈলচিত্র - কতকিছু। তাই এই প্যাটার্নিক বৈশিষ্ঠ্য খোঁজার চেষ্টা আমার প্রায় সব বিশ্লেষণেই পাওয়া যায়।

এ লেখাটিতে সুমন রহমানের গল্পের একটা প্যাটার্ণ এবং সেটা কিভাবে তার গল্পগুলোকে প্রভাবিত করে সেটা আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমি নিজেই ক্ষুদে একটা ব্লগ লিখিয়ের বেশী কিছুনা, সেটুকুর ব্যাপারে সচেতন থেকেই আমার চেষ্টা থাকবে বিশ্লেষণ দাঁড়া করবার।

সচলায়তনে তিনি ছয়টি ছোট গল্প এবং একটি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। আর বেশ কিছু সমালোচনা ধরনের রিভিউ ছিল। এ সবের আলোকেই আমি আলোচনা করব।

সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশের মূল ধারার সাহিত্যের সাথে আমার সংযোগ অতটা শক্ত নয়। তাই সুমন রহমানের গল্প পড়া হয়ে উঠে নাই আগে। তাই আমার বিশ্লেষনে যেমন সাহিত্য কেন্দ্রীক রাজনীতির প্রভাব থাকবে না, থাকবে না ব্যক্তি পরিচয়ের প্রভাব তেমনি এটি হয়ে উঠবে না চুলচেরা বিশ্লষনে টপ-নচ কোন লেখা। এ আমার বিনয় নয়, বরং আমি যে আমার অবস্থান সর্ম্পকে যথেষ্ট সচেতন তার কৈফিয়ত।

এইটুকু আলাপচারিতার পর আমি শুরু করতে পারি।

হাইপোথিসিস

একাডেমিক লেখার প্রচলিত একটি পদ্ধতি হল: কোন হাইপোথিসিস আগে ব্যাখ্যা করা, তারপর তার সার্পোট যুক্তিগুলো দেখানো, পরীক্ষামূলক ফলাফল থাকলে উপস্থাপন করা এবং উপসংহার টানা। এই বিশ্লেষনে আমি এই ধারাটাই অনুসরন করব।

এখানে এসে গল্প আর উপন্যাসের একটা সংজ্ঞা দরকার। ভাবছিলাম সদ্য কেনা স্টিফেন কিংয়ের অন রাইটিং থেকে খানিকটা তুলে দেবো। আপাতত হাতের কাছে নেই বইটা। পরে এ অংশটুকু আপডেট করতে পারি।

ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা রবীন্দ্রনাথের একটি কথা আমার মাথার ভিতর গেঁথে গ্যাছে। কথাটা একজাক্ট কি ছিল মনে নেই। তবে সেটা অনেকটা এরকম। আমাদের জীবনকে যদি একটা নদীর সাথে তুলনা করা যায়, যেটা সাগর নামের কোন এক লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলছে তাহলে উপন্যাস হল সেই নদীকে ধারনের একটা চেষ্টা। আর ছোট গল্প হল সেই নদীর কয়েকটি স্রোত ধারা।

কথাটি আসলে অনেক ব্যাপক। আমাদের বক্তব্য, কথা মালা এইগুলো আসলে কি? কয়েকটি প্যারাগ্রাফের সমষ্টি। প্যারাগ্রাফকে যদি বিল্ডিং ব্লক বলা যায় তাহলে লেখাগুলো হচ্ছে এই বিল্ডিং ব্লক গুলো নিয়ে তৈরী করা গল্প, উপন্যাস। দালান বানানোর বিল্ডিং ব্লক যেমন ইট ঠিক তেমনটাই। সেকারনেই ইটের পরে ইট রাখলে যেমন মহৎ ইমারত গড়ে উঠে না, তেমনি প্যারাগ্রাফের পর প্যারাগ্রাফ চাপালে গড়ে উঠে না গল্প বা উপন্যাস। লেখক তাই কথ্য শিল্পের আর্কিটেক্ট। সুচারু ভাবে গল্প বা উপন্যাস বানানোই তার লক্ষ্য।

এতো গুলো কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই প্যার্টানটা আপনাদের দেখানো। সবার লেখাতেই প্যাটার্ন থাকে। কেউ বুঝে প্যাটার্ন নির্মান করেন কেউ করেন না বুঝে। আমি জানিনা সুমন রহমানের প্যাটার্ন তিনি বুঝে করেছেন কিনা। কিন্তু ব্যাপারটার আলোচনাটা গুরুত্বপূর্ণ। এটাই একজন লেখকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে। আবার একই নিজের প্যাটার্ন ভেঙ্গে আগিয়ে যাওয়া তাকে করে মহত্তর।

সুমন রহমানের গল্পে দ্বিধারার ব্যাবহার প্যার্টার্ন হিসেব প্রথমেই চোখে পড়ে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সংজ্ঞা ভেঙ্গে দুটি স্রোত নিয়ে আগানো। উপন্যাসকে যদি অসীম স্রোতের সমষ্টি বলা যায়, গল্প সেখানে একটি স্রোত। উপন্যাস যদি অনেক সুতা বুনে তৈরী করা জামা হয়, তাহলে গল্প কি জামার ছোট্ট একটি পকেট?

সুমন রহমানের গল্প যেন দুটো গল্পের ধারা একসাথে। একস্রোতধারা নয় একসাথে দুটি ধারা। জামার ছোট্ট একটি পকেট শুধু নয় সঙ্গে জামার হাতাটাও। কিন্তু প্রশ্ন হল দুটি কেন? তিনটি নয় কেন? এ প্রশ্নর উত্তর আমরা পরে আবার খুঁজব। এখন বরং আরো কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা যাক।

এইযে দুটি ধারা নিয়ে তিনি আগান, সেখানে একটি ধারা প্রচ্ছন্ন থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ড ছবির মতো। অর্থাৎ সামনে একটা ছবি আমাদের দেখান কিন্তু দ্বিতীয় গল্পটা পিছনে চলে। চাইলে আপনি সেটাকে অগ্রাহ্য করতে পারেন, আবার দেখতে চাইলে দেখতেও পারেন।

কখনও কখনও মূল গল্পের চেয়ে এই দ্বিতীয় গল্পের বিষয়টা বড় হয়ে উঠে। এইটা হয়ত ইচ্ছাকৃত। এই পর্যায়ে এসে লেখকের দর্শন, মনস্তত্ত্ব এই সমস্ত বিষয় সামনে চলে আসে। কিন্তু অল্প পরিচয়, অল্প পাঠ আর অল্প জ্ঞান নিয়ে বিষয়টাতে আর আগানোর প্রবৃত্তি আমার নাই।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে ছোটগল্পের নিয়ম মেনে সুমন রহমানের গল্পের চরম পরিনতির অভাব থাকে। পাঠকের কল্পনার উপর তিনি সেটা ছেড়ে দেন, যেমনটা হয় প্রায় সব ছোট গল্পে। কিন্তু দ্বিতীয় গল্পটার কোন কিছু হয় না। সেটা যেমন কোন ক্লাইমেক্সে পৌছায় না, তেমনি কোন পরিনতিতেও পৌছায় না। দ্বিতীয় এই ধারাটাই তার একটা গভীর একটা ম্যাসেজ প্রদানের মাধ্যম পাঠকের কাছে।

আরেকটা ব্যাপার আছে তার গল্পে। কখনও কখনো বর্ণনা গুলো কবিতা প্রবন হয়ে উঠে। সুমন রহমান মনে প্রানে একজন কবি। সেই কবি সত্ত্বা গদ্য সত্ত্বাকে ঠেলে বেরিয়ে আসেত চায়। আবার সামলে নেন নিজেকে।

তো এই ব্যাপারগুলোই আমার চোখে পড়েছে। আর কিছু কি ভেবেছিলাম? এই মুর্হুতে মাথায় আসছে না। আসলে পরে তুলে দিবোখন।

পরের লেখায় আসবে গল্পগুলো একে একে বিশ্লষন করে দেখানো যে এই হাইপোথিসিস মোটামুটি ভ্যালিড।

(চলবে)


মন্তব্য

ঝরাপাতা এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। এ্টাও একটা রিসার্চ হয়ে গেলো।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আপনে রিসার্চ প্রপোজাল ভালোই লিখবেন,বোঝা গেলো হাসি

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

রিসার্চ মনে হলে তো সমস্যা! ইয়ে, মানে... বিনোদনের জন্য লেখা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ঝরাপাতা এর ছবি

বিনোদনের জন্য লেখা !!!! আমি তো মোহিত লাল মজুমদারের মতো কঠিন আলোচনা আশা করেছিলাম।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

অমিত আহমেদ এর ছবি

সুমন ভাই একটা জিনিস!
পর্ব না করে একসাথে দিয়ে দিলে ভাল হতো।
একজন লেখকের বিশ্লেষণ খন্ডাকারে করার কি দরকার??


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আসলে যতটুকু লিখছি সেটা পাবলিম করে দিচ্ছি। তাই অনেক খন্ড হয়ে গেছে। দেখি আপডেট করে দেই।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অমিত আহমেদ এর ছবি
অমিত আহমেদ এর ছবি

সুমন নামক অনেকেই আছেন, এটা খেয়াল করিনি। পূর্ব মন্তব্যে "সুমন ভাই" = "এস এম মাহবুব মুর্শেদ ভাই"


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

অতিথি এর ছবি

আপনার এই গভীরে ঢুকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাটা ভাল লাগে, উপকার হয়। মাঝে মাঝে যে বিষয় গুলি বুঝতে পারিনা বা অসুবিধা হয় সেগুলো আপনার মত করে ভেবে উদ্ধার করার চেষ্টা করি।

মনের কথা

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মনের কথা। কষ্ট করে পড়েছেন জেনে ভাল লাগল।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

Sumon Rahman এর ছবি

Bah bah! Mahbub Murshed dekhchi amar samne ritimoto ekta kingsize mirror-er samne daar koriye dilen. Convinced hoye jachchi kintu!

Onno jaigai achi, ekhane log in korte parchi na, tai ei form-ei likhlam.

Dhonnobad, apnar bishleshon ebong obodharon duitai akorshoniyo.

Sumon Rahman

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

যাক আমি ভাবছিলাম মৌচাকে ঢিল মেরেছি বোধহয়। খাইছে

কাল লিখব বাকিটা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

sumon rahman এর ছবি

ha ha ha... mouchak-e dhil to merechen botei চোখ টিপি tobe kamor khan nai temon, bhagya bhalo apnar!

??? এর ছবি

পরের লেখা কৈ? হাসি

...................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।