আমার আব্বা আমাদের ছোটবেলার অনেকটা সময়, অর্থাৎ তার চাকুরীর শুরুতে বগুড়া আর রংপুরের দিকটায় ছিলেন। বদলির চাকরী তার, সেই সুবাধেই। আমার মনে পড়ে আমাদের ঈদ কেনাকাটা গুলি হত রোজার শেষের দিকে। আব্বা, আম্মা বোনাসের টাকা পেতেন, আব্বাও আসতেন ঈদের ছুটিতে। তারপর আমাদের দুই পিঠাপিঠি ভাইকে হাত ধরে সারাদিন জুড়ে কেনাকাটা। সারাদিন ধরে সেই কেনাকাটায় আনন্দের চেয়ে কষ্টই হত বেশী।
আমার ছোট ভাইটার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কাপড় কেউ দেখে ফেললে পুরোনো হয়ে যাবে। তাই সে জীবন দিয়ে হলেও চেষ্টা করত যাতে কেউ না দেখে। বলাই বাহুল্য সে চেষ্টা রক্ষা করা সম্ভব হতো না তার। বিকেলের মধ্যে আমাদের প্রায় সমবয়সী ফুপাতো ভাইবোন আসলে গল্পের ফাঁকে বেরিয়ে আসত তথ্য। কিংবা প্রতিবেশী বাচ্চাগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলেও কাপড় দেখিয়ে ফেলতাম আমরা।
আমাদের দুভাইয়ের বয়সের ফারাক দু বছরের মত। লম্বায়ও প্রায় সমান। তাই বিচিত্র কোন কারনে আমাদের বাবা মা আমাদের দুজনের জন্য একই পোশাক দিতেন। হুবুহু একই রকম। কেবল এক সাইজ ছোট বড়। এই প্রথাটা অনেক দিন চলে এসেছে। ঈদের দিন আমরা দুই ভাই একই ইউনিফর্ম পরে ঘুরে বেড়াতাম। তখন খুব বিরক্ত হয়ে এই প্রথার বিরুদ্ধে লেগেছিলাম। এখন এতদিন পরে দুরদেশে বসে ঈদের দিন ভাইটার মতো একই পোশাক পড়তে ইচ্ছে করছে। আহারে ভাইটা আমার, সব সময় আমাদের মধ্যে যুদ্ধ লেগে থাকত; অথচ আমেরিকা আসবার আগেরদিন হঠাৎ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে সে কি কান্না!
আমার আম্মা সবসময় ঈদের পোশাক কিনে দেবার ব্যাপারে সাথে যাবেই। যে ভাবেই হোক। এমনকি যখন বুয়েটে পড়ি, বন্ধুরা মিলে একসাথে কেনা কাটা করতে যাবো; আম্মাকে বললাম টাকাটা দাও কেনাকাটা করি। কোনভাবেই পুরোটাকা দিল না। বলল কিছুটা কিনে নিয়ে আয়, বাকিটা আমাদের সাথে কিনবি। প্রবল আপত্তি করতাম প্রথমে, পরে মেনে নিয়েছি। আসার আগ পর্যন্তও ঈদে আব্বু আর আম্মুর হাত ধরে শপিংয়ে গিয়েছি। আম্মুর নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ হয় এখন!
তবে চাঁন রাতের কেনাকাটা সত্যিই খুব মিস করি। আর সেই সাথে যদি কারো কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু কেনা বাকি থাকে তাহলে তো কথাই নেই। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে আড্ডা দিতে দিতে, টাংকি মারতে মারতে শপিং করার সেই মজাটার কোন তুলনাই হয় না। এক সময় দেখা যায় কেনা কাটা বাদ দিয়ে কোন সুন্দরীর পিছনে পিছনে শাড়ীর দোকানে দোকানে ঘুরছি আমরা।
ঈদের ঈদি খুব মিস করি আমি। ছোট বেলায় টাকা কামানোর অন্যতম সোর্স ছিল এই ঈদ। ঈদের বহু আগে থেকে প্ল্যান হয়ে থাকত কি করব। তবু ঠিক ফিক্স করতে পারতাম না শেষ পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত আম্মুর কাছে গচ্ছিত রাখতাম টাকাটা। সবচেয়ে বেশী সম্মানী দিত ছোট কাকা। তিনি ছিলেন ছোটদের মহলে ফেভারিট। তো ঈদ হলেই মোটা অংকের ঈদি পেতাম তার কাছে। উপরি হিসেবে তার যখন ভাংতি শেষ হয়ে যেত তখন ৮০/৯০ টাকা দিয়ে একশটাকা হাতিয়ে নিতাম আমরা। সেই লোভে তার সাথে সাথে ঘুরতাম সারা সকাল।
দেখতে দেখতে একটা সময় চলে আসল যখন দেখি পোলাপাইন আমারেই ঠুস ঠাস সালাম করে বসে। সালামী না দিলে আমরা যে একখান গালি পাড়তাম পিছনে সে কথা মনে করে সালামী না দিয়েও পারি না। তো মোট লাভের চেয়ে মোট খরচাই বেশী হয়ে যেতে লাগল। তখনও ছাত্র আমি। টিউশনি পড়াই না, ভাল লাগে না বলে। পত্রিকায় লেখে টুকটাক আয় করি, জমে না মোটেই। তাই ঈদ আসলেই টুকটাক জমিয়ে রাখতাম সম্মান বাঁচাবার জন্য। তখন গাইল পাড়তাম এই সিস্টেমটার।
২০ শে অক্টোবর ২০০৬
(চলবে)
মন্তব্য
চলুক...
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
আমাদের ছেলেবেলা সবার একই রকম। সেই নতুন জামা, ঈদ, আনন্দ, লুকিয়ে একদিন সিগরেট খাওয়া। সেকি অনুভুতি! এখনও ভাবি। আমি যদি আবার ছোট হতে পারতাম।
ভাল লাগলো। চলুক।
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
পড়ছি। আরো চলুক-
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
পড়লাম। চলুক।
ধুর, কেন যে বড় হয়ে যাই সব্বাই।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
বড় হয়ে যাই কষ্ট পাবার জন্য ।
এখন সালাম করলে ঈদি দেননা ভাইয়া? দিলে বলেন, ঈদ কিন্তু ১০ দিন চলে(টিভিতে এমনই তো বলে)
উড়ে গিয়ে সালাম করি তা'হলে
নতুন মন্তব্য করুন