বৌদ্ধিক নিঃসঙ্গতা
ব্যক্তি না গোষ্ঠী এই নিয়ে অনেক তর্ক হয়ে গেছে ইতিহাস ও পুরাণের পৃষ্ঠায়। গোষ্ঠীটাই সব সময় প্রধান বিষয়- এই তত্ত্বে ভর করে পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সমাজ আর রাষ্ট্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষ রয়ে গেছে ব্যক্তি মানুষ। নিজের শ্রমে-ঘামে ও রক্তে গড়ে ওঠা সমাজ ও রাষ্ট্রেও মানুষ বারবার নিজেকে আবিষ্কার করেছে একাকিত্বের ভেতর এক নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন অধিবাসী হিসেবে। ফলে আবারো বিপ্লব- বিদ্রোহ। আবারো নতুন কিছু করা এবং আবারো নিঃসঙ্গতা ও ক্ষোভ
মূলত মানুষের কিছু করার নেই শুধু নিজের সভ্যতাকে প্রমাণের একঘেঁয়ে ঘোড় দৌড় ছাড়া। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানের অবস্থান মানুষের এই কর্মহীনতা ও একাকিত্বের ঠিক মাঝখানে
আধুনিক রাষ্ট্রের চেহারা প্রকট হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত মানুষের ব্যক্তি পরিচয় চাপা পড়ে ছিল তার গোষ্ঠী পরিচয়ের নিচে। গোষ্ঠী কার্যক্রম ও আনুষ্ঠানিকতার ভেতরে কোনো মানুষকে আর আলাদা করে চেনা যেত না- তার প্রয়োজনও হতো না এবং ব্যক্তি মানুষও তখন গোষ্ঠী ব্যস্ততায় নিজেকে আলাদাভাবে আবিষ্কারের সুযোগ পেত না। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন দানা বাঁধতে থাকল আধুনিক রাষ্ট্র- পাশাপাশি বিবর্ণ হতে থাকল গোষ্ঠী সংস্কৃতি, তখনই ধীরে ধীরে মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করল একদম নিজের মতো করে। তখনই আবিষ্কার করল সে একা এবং তার মূলত করার কিছুই নেই। যুগ যত আধুনিক হল- সময় যত এগোতে থাকল- ব্যক্তি মানুষ ততই আবিষ্কার করতে থাকল সে মূলত পৃথিবীর প্রথম মানুষের মতোই একা
সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানে সব সময়ই গোষ্ঠীর চেয়ে প্রধান ব্যক্তি মানুষ- তার চেয়ে প্রধান ব্যক্তির ভেতরের ভাঙা আর গড়া।
ক্ষুদ্র মানুষ বড়ো অনুভূতি
সকল গণসংগীতেই মার্ক্সবাদ ও সমাজতন্ত্রের ছায়া খুব স্পষ্ট। ফলে গণসংগীতের স্থানও মার্ক্সবাদের মতো রয়ে গেছে জীবনের একটা প্রান্ত ছুঁয়ে। মার্ক্সবাদ যেমন মানব সমাজ থেকে নামতে নামতে গোষ্ঠী পর্যন্ত এসে থেমে গেছে; ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। গণসংগীতও তাই। এই গোষ্ঠী পর্যন্ত থেমে থাকার কারণেই মার্ক্সবাদ গোষ্ঠীর কাছে প্রিয় হয়েও ব্যক্তির কাছে প্রিয় হতে পারেনি। মার্ক্সবাদের প্রবক্তা হয়েও যেমন আজীবন মার্ক্সবাদী সংজ্ঞার বাইরে থেকে যান স্বয়ং কার্ল মার্ক্স। কায়িক শ্রমের নিচে বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম ও শিল্পকে কবর দিয়ে যিনি নিজেই সারা জীবন করে যান বুদ্ধিবৃত্তিক রোম্যান্টিক শ্রম
একই পরিণতি গণসংগীতের। গণসংগীত শুধু শারীরিক ক্ষুধার কথাই বলেছে- বলেনি মানসিক ক্ষুধার কথা। ফলে ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়া মানুষের কাছে গণসংগীত হয়ে উঠেছে গোষ্ঠী শ্লোগান। আর অন্তরঙ্গ সময়ে সে বেছে নিয়েছে অন্য কিছু
সুমনের গানকে অনেকেই সংজ্ঞায়িত করেন জীবনমুখী গান হিসেবে। আবার অনেকেই বলেন গণসংগীতেরই আধুনিক সংস্কারের নাম জীবনমুখী গান। কিন্তু সুমনের গান মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক গান। যেমনটা রবীন্দ্রনাথের গান। সুমনের গানে জীবনের যে চিত্র তা ব্যক্তির জীবনের চিত্র। ব্যক্তি এখানে তার নিজস্ব অস্তিত্ব নিয়ে গোষ্ঠীতে খুঁজে বেড়ায় অবস্থান। আর সাধারণ গণসংগীতে গোষ্ঠীই নির্ধারণ করে দেয় ব্যক্তির অবস্থান ও গতি। ব্যক্তি সেখানে পরাধীন কিন্তু ক্ষমতাময় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। আর সুমনের গানের মানুষ ক্ষমতাহীন অথচ স্বাধীন- যে ক্ষমতাহীন অবস্থায় থেকে ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও অক্ষমতাকে উপভোগ করে। ফলে সুমনের গান যতটা না গোষ্ঠীকে আলোড়িত করে তার চেয়ে বেশি আলোড়িত করে ব্যক্তিকে
মহান একাকিত্ব
আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড়ো ইতিবাচক ও নেতিবাচক আবিষ্কার হলো মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিঃসঙ্গ ঘোষণা করা। আজকের সমাজজীবন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিজ্ঞান নির্ভর। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছাতে মানুষ প্রতিদিনই অনুসরণ করে চলেছে বিজ্ঞান নির্ধারিত পথ। আর ক্রমাগত একা থেকে আরো একা হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি মানুষ। মানুষ তার এই একাকিত্ব কাটাতেই আরোপিতভাবে ফিরে দাঁড়াচ্ছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নামে হারানো সুখ ও স্বপ্নের খোঁজে। এমনকি কখনও আদিম ও হিংস্র গোষ্ঠীসাম্প্রদায়িকতায়। এর প্রধান কারণ বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যেকার বিপরীত বাস্তবতা
বিজ্ঞান মানুষকে একা করে দিয়েই তার পাঠ চুকায়। কিন্তু দেয় না তার একাকিত্বের সমাধান। বরং সভ্যতার ভারে মানুষ আরোও ক্লান্ত হয়ে ওঠে। সমাজবিজ্ঞান সেই ক্লান্ত মানুষকে আপোষ করতে বলে অন্য আরেক ক্লান্ত ও বিরক্ত মানুষের সাথে। যে মানুষ দৃশ্যত তার মতো- কিন্তু অদৃশ্যে অনেক তফাত। আধুনিক সভ্যতার এই দোটানার মাঝে বিশাল আকারে উপভোগ্য একাকিত্ব ও অসহায়ত্ব নিয়ে যার প্রবেশ তিনি রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ এখনও একা মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কিন্তু বাস্তবতা হলো- রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান মানুষের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় শতাব্দী দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান। আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথের অনেক চিত্রকল্প ও উপমাই অপরিচিত অথবা অস্পষ্ট। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে ক্রমশই দূরত্ব বাড়ছে রবীন্দ্রনাথের। ব্যবধান বাড়ছে জীবন বোধের। এবং নতুন প্রজন্ম ও রবীন্দ্রনাথের দূরত্বের এই ফাঁকটুকুতেই সুমনের অবস্থান। সুমন সাম্প্রতিক। তার চিত্রকল্প- বাণী সরাসরি চেনা যায়
বাংলা গানে সুমন যে জায়গাটা দখল করেছেন তার একটা অংশ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রসংগীতের গৎবাঁধা শ্রোতা যারা অন্য শিল্পীর গান শুনলে কান বন্ধ করে রাখতেন তারা আজ রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি সুমনের গান শুনছেন। তার কারণ কয়েকটি থাকতে পারে:
প্রথমত- সুমন রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী। তার সুরে ও কথায় রবীন্দ্রনাথের বিশাল নিঃসঙ্গতার ছাপ খুবই স্পষ্ট
দ্বিতীয়ত- জাতিগতভাবে বাঙালিরা রুদ্র রসের বিরোধী। বীরের বীরত্ব থেকে পতন শুনতেই বেশি আগ্রহ তাদের। রবীন্দ্রনাথের যেমন ক্ষোভ ছিল- কিন্তু তিনি বিপ্লবী ছিলেন না। সুমনও তাই। সুমনের ক্ষোভ আছে বিক্ষোভ নেই। আক্রোশ নেই। তার গানে বীর রস আছে কিন্তু পুরোপুরি অনুপস্থিত রুদ্র রসের ছোঁয়া
তৃতীয়ত- গানের অন্তর্মুখিতা। রবীন্দ্রসংগীতের মতো সুমনের গানও ঘরের গান। ব্যক্তিকে ঘর থেকে বাইরে নয় বরং বাইরে থেকে ঘরের নিভৃত কোণে টেনে আনে সুমনের গান
চতুর্থত- শ্রুতি এবং ভাবনা। রবীন্দ্রনাথের গান যেমন শেষ হয়ে যাবার পর তার আবেশ দিয়ে শ্রোতাকে ব্যস্ত রাখে ভাবনায়; সুমনের গানও অনেকটা তাই। গান শেষ হয়ে যাবার পরই শুরু হয় গানের বিষয় অনুভব ও উপভোগ। এ সমস্ত সামঞ্জস্যের কারণেই সম্ভবত রবীন্দ্রসংগীতের শ্রোতারা অবচেতনভাবে সুমনের প্রবেশাধিকার দিয়েছেন নিজেদের মাঝে
নাগরিক বৈরাগ্য
আজকের গ্লোবাল ভিলেজের যুগে পৃথিবী আক্ষরিক অর্থেই হাতের মুঠোয়। জোর করে চাইলেও আর নিজেকে নিজের মাঝে ধরে রাখা সম্ভব নয়। সব সময়ই একেকটা মিশ্রণের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হচ্ছে প্রত্যেককে। প্রাচ্যের প্রতিটি মানুষই অবচেতনে প্রাচ্যের উত্তরাধিকার বহন করেও সচেতন কিংবা অচেতনে চর্চা ও অনুসরণ করছে পাশ্চাত্যকে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। ক্রমে পাশ্চাত্যও হয়ে উঠছে তার অভ্যাসের এক অচ্ছেদ্য অংশ। তার স্বপ্ন ও বাস্তবেও সে ধারণ করছে একই সাথে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দুটোকেই
সুমনের গানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণ খুবই স্পষ্ট। তা অনেক দিক থেকেই। সুমনের যে সুর তা এ অঞ্চলের সুরের সাথে মেলে না। যেন একটুখানি আলাদা- একটু নতুন- কিন্তু একেবারে অপরিচিত নয়
প্রাচ্যের গান ধ্বনি নির্ভর। পাশ্চাত্যের প্রধান বাহন বাণী। কিন্তু পৃথিবীর সব লোকসংগীতই বাণী প্রধান এবং মহাকাব্যিক। বাংলা গানে বাণী-প্রধানতা এসেছে অনেক আগেই। কিন্তু লোকসংগীতের মতো তা মহাকাব্যিক ঢংয়ে নয়; বরং খণ্ডচিত্র হিসেবে। সুমনের গান এইসব বিষয়গুলোকে সংকলন করেছে চমৎকারভাবে। আধুনিক বাণী প্রধানতাকে পাশ্চাত্যের ছাঁচে ঢেলে তাতে সংযোজন করেছে লোকসংগীতের মহাকাব্যিক রূপ। বাংলা গানে এই বৈশিষ্ট্য নতুন। মহাকাব্যের কাহিনীর মতো যার সূচনা ও উপসংহার সবচেয়ে স্পষ্ট
সুমনের গানের আরেকটা প্রধান দিক হল এর বাউলিয়ানা। সবগুলো গানের আড়ালেই যেন কোথাও একটা বাউল সুর বেজে ওঠে। একটা দুঃখী ছিন্নমূল বৈরাগীর চেহারা ভাসে
মধ্যবিত্ত দোলাচল
আধুনিক বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রধানতম সংকট তার পরিচয় সংকট। না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা তার। উপনিবেশের উচ্ছিষ্ট এই নতুন প্রজাতি একই সাথে ধারণ করে আধুনিকতা ও আদিমতা। সে না পারে পুরোপুরি আদিম হতে- না পারে আধুনিক হতে। সে আদিমতাকে যেমন পছন্দ করে তেমনি ভয়ও পায়। আবার আধুনিকতাকে যেমন ধারণ করতে চায় ঠিক তেমনি আধুনিক হওয়ার ক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধতাকেও সে একটা মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারে না
দুশো বছরের উপনিবেশ ও উপনিবেশ-উত্তর অভ্যাসে উপরে ওঠার লোভ এবং পদচ্যুতির আশঙ্কা শ্রেণিহীন বাঙালি মধ্যবিত্ত প্রজাতিকে করে তুলেছে এক জটিল মনস্তত্ত্বের অধিকারী- যার মূলত কোনো স্থায়ী পরিচয় নেই। সে অমুক পদের চাকুরে কিংবা তমুক জনপ্রতিনিধির আত্মীয়। এ সমস্ত পরিচয়ের ধরনটাই এমন যে; কিছু সময়কাল পরপরই একেকটা পরিবার ও ব্যক্তির এ সকল পরিচয় মুছে গিয়ে অন্য পরিচয় যুক্ত হয়। হয়তো সেটা আগের পরিচয় থেকে উচ্চ পর্যায়ের- নয়তো আরো নিম্ন পর্যায়ের। এই পরিচয় সংকটের কারণেই বাঙালি মধ্যবিত্তরা একই সাথে খুব বেশি উচ্চাভিলাষী ও নৈরাশ্যবাদী কিংবা হতাশ
সুমনের গান সার্বিকভাবেই বাঙালি মধ্যবিত্তের গান। ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের গান। আধুনিক মধ্যবিত্তের সংকট-দোলাচল ও স্ববিরোধীতার সার্বিক চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় সুমনের গানে। মধ্যবিত্তরা একই সাথে শিল্পী ও সংগ্রামী। সন্ন্যাসী ও গৃহী। সুমনের গানের চরিত্রগুলোও তাই। যারা সংসার ও সন্ন্যাসী মাঝে দুলতে থাকে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয় না কোনো পাশেই
জীবনচিত্র
আধুনিক বাংলা গানের সাথে সুমনের গানের পার্থক্যরেখা খুবই স্পষ্ট। আধুনিক বাংলা গান মূলত প্রেমের গান। ‘তুমি’ থেকে ‘তুমি’ পর্যন্ত এর যাতায়াত। প্রেমের খণ্ডচিত্রগুলোই সাধারণত এ সমস্ত গানের বিষয়। প্রেমের সাথে জীবন- জীবনসংগ্রাম- ক্ষয় এবং অর্থনীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। কিন্তু বাস্তব জীবনে প্রেমের নীতি নির্ধারক হলো অর্থনীতি আর সমাজনীতি। ফলে আধুনিক বাংলা গান এক সময় একঘেঁয়েমিতে পরিণত হয়। সুমন এখানে ব্যতিক্রম। প্রেমের সাথে আংশিক জীবন নয় বরং সার্বিক জীবনের সাথে প্রেম উঠে আসে তার গানে। শ্রোতার পক্ষেও সহজ হয় জীবন বাস্তবতায় মিলিয়ে প্রেম কিংবা বিরহকে উপভোগ করা। আর এ কারণেই আধুনিক বাংলা গানের তুলনায় সুমন একটু বেশি রকম টানে মানুষকে। ধরে রাখে বেশিক্ষণ। ভাবায় অনেকটা সময়
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ; আধানাগরিক পল্লি
বাংলাদেশে সুমনের মূল শ্রোতা তরুণ এবং তরুণোত্তীর্ণ প্রায় প্রৌঢ়রা। যাদের সাথে তরুণ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংকট ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের মূল সংকট- বিশ্বমানচিত্রে পরিচয়ের স্থিরতা ও অস্থিরতা। তৃতীয় বিশ্বের এক ক্ষুদ্রতম দেশ হিসেবে বিশ্বসমাজ ও মানচিত্রে বাংলাদেশের যতটুকু স্থান পাওয়ার কথা ততটুকুতে সন্তোষ্ট নয় আধুনিক যুগের সাথে পরিচিত বাংলাদেশের মানুষ। তারা আরো চায়। কিন্তু বাস্তবতায় সম্ভব হয়ে ওঠে না অনেক কিছুই। আর যা পায় তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আগেই মুক্তবাজারের সুবাদে হাতের কাছে এসে পৌঁছায় উন্নত বিশ্বের নতুন অনেক দরজা। কেউ কেউ অভ্যস্ত হয় নতুন জীবনে। কেউ পারে না- নিজেকে আবিষ্কার করে এক পিছিয়ে পড়া মানুষের দলে
গতি ও গতিহীনতায় আক্রান্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে সুমন এক অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ। সুমনের চরিত্রগুলোর অনেক কিছুই আছে তবু যেন অনেক কিছু নেই। অনেক কিছু পেয়েও যেন অনেক হারিয়েছে তারা। অথবা পাবে না কোনো দিন
বাণিজ্য নির্ভর উন্নয়নের সুবাদে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও লেগেছে নাগরিক হাওয়া। খুব দ্রুত মানুষ রপ্ত করে নিচ্ছে যান্ত্রিক নাগরিক জীবন। কিন্তু তারই সরাসরি অংশ এখনও যুক্ত গ্রামীণ জীবনে। ফলে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে প্রতিনিয়তই চলছে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের তুলনা- প্রতিতুলনা। গ্রামীণ আবহে বেড়ে ওঠা মানুষ যারা বেছে নিয়েছে শহরের জীবন; তাদের মানসিকতা ভরে আছে এক বিশাল নস্টালজিয়া। কোথাও কোনো এক ছেড়ে আসা গ্রামে সে ফিরে যেতে চায় কিন্তু ভালো করেই জানে সে ফিরবে না কোনোদিন
সুমনের গানগুলো শুনলে মনে হয় কোথাও একটা দেশ ছিল। ছিল একটা জীবন। যে জীবন ফেলে এসেছে সবাই অথচ ফেলে আসতে চায়নি কেউই
বাংলাদেশে সুমনের জনপ্রিয়তার সাথে এই প্রচ্ছন্ন নস্টালজিয়া এক প্রধান যোগসূত্র
.................
২০০১.০৩.১২ সোমবার
মন্তব্য
২০০১ সালে কলকাতার কোথাও সুমনকে একটা সংবর্ধনা দেবার আয়োজন করা হয়। সেই সংবর্ধনার স্মারকে বাংলাদেশে সুমনের গান বিষয়ে লেখার জন্য একতরফাভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন কবি- গবেষক এবং আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্য্য
আমি একজন সুরহীন-তালহীন মানুষ। ঘটনাটা শুনে অনেক চেষ্টা করলাম পিছলে যাবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জেদে লিখতে হলো
সংবর্ধনাটা হয়নি শেষ পর্যন্ত। পরে আয়োজকরা আমার এই লেখাটা কলকাতার কোনো একটা পাত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছেন শুনেছি
হঠাৎ করেই মনে হলো এই লেখাটা সচলায়তনে দিয়ে দেই। তবে সাবিনাকে বিয়ে করার পরে কবীর সুমনের সুবিধাবাদী গানগুলো আমার এই আলোচনার বাইরে..
ওরে খাইছে। গিট্টু লাইগা গেল। এখন তো আর সুমনের গান এতো মজা কইরা শুনতে পারুম না!
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এটা কিন্তু লেখা হয়েছিল সুমনের গানকে প্রশংসা করার জন্য
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সুমনের গানের শ্রোতা কমে যাবে এটা পড়ে
ওরে খাইছে। গিট্টু লাইগা গেল। এখন তো আর সুমনের গান এতো মজা কইরা শুনতে পারুম না!
আমি কইলাম আগে কইছি !!!!
দৃশা
যাহ! এখন তাহলে কি হবে গো দৃশা আফা!! ক্ষ্যামা কইরা দিয়েন গো আফাজান।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
বাহ্। সুমনের গান নিয়ে এতো গবেষণা! আমি অবশ্য আগে থেকেই সুমনের ভক্ত ছিলাম। এখন তেমন শোনা হয় না।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
একেবারে ব্যক্তিগত পাঠ
নো গবেষণা
"তবে সাবিনাকে বিয়ে করার পরে কবীর সুমনের সুবিধাবাদী গানগুলো আমার এই আলোচনার বাইরে.."
... "সুবিধাবাদী" মানে কবি এখানে কি বুঝাইতে চাহিয়াছেন?
সুমন মুসলমান হিসেবে এই দেশের শ্রোতাদের জন্য কিছু গান তৈরি করেছেন
গানগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে
এগুলো শুনলেই বোঝা যায় ধান্দাবাজী গান
(এর মধ্যে একটা মনে পড়ছে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে)
একজন শিল্পীর ব্যক্তিসত্ত্বা আলাদা হতে পারে। শিল্পীর মূল্যবোধ ও অনেক সময় বদলে যায়। আমরা তাঁকে কিভাবে বিচার করবো? একসময়ের আপোষহীন চরিত্রের গান দিয়ে না বর্তমানের সুবিধাবাদী চরিত্রের গান দিয়ে?নাকি তা*র সামগ্রিক ভাবমূর্তি দিয়ে?
মানুষের জন্য যদি তার কাজকে ঘৃণা করতে হতো তাহলে এই লেখাটাও আজ আমি ফেলে দিতাম
কিন্তু ব্যক্তি মানুষ যদতি জীবিত থাকে ততদিন মাঝে মাঝে তার ভক্তদের কষ্টও দেয়
ঘৃণার তৈরিও করে
এর আগে ইম্ইল করে আমি একবার খুব অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেছিলাম ভূপেন হাজারিকাকে
যখন বিজেপির হয়ে সে ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিল
ভূপেনকে আমি ঘৃণা করলেও তার গানগুলো কিন্তু এখনও আমার প্রিয় তালিকায়
মনে হচ্ছে ভক্তরা বেশ অসহায়। একজন শিল্পীর কাজকে পছন্দ করে ফেল্লে শিল্পী যদি তা বুঝতে পারেন তাহলে তো থোড়াই কেয়ার করবেন। মানে তার মনে হবে -যা খুশি করি না কেন আমার সৃষ্টিকে তো কেউ ঘৃণা করবে না । এতে আমার মতো সাধারন মানুষরা শুধু কষ্ট ই পাবে। আমার সবসময় মনে হয় একজন মহান শিল্পীকে তার সৃষ্টির পাশাপাশি অন্য ক্ষেত্রে ও মহত্বের পরিচয় দেয়া দরকার । মানুষ নিজে যা খুশি করুক তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু শিল্পীকে অনেক বড় মানুষ ভাবতে চায়। হয়তো আপনি আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন।
এই বিষয়টা খুবই জটিল
একজনের সৃষ্টি থেকেই আসোলে আমরা তার প্রতি আকৃষ্ট হই
তারপরে তা ভক্ততে পরিণত হই
যখন সেই লোটিই উল্টাপাল্টা করে তখন তার সাথে সাথে মাঝেমাথে তার সৃষ্টিতেও ঘৃণা তৈরি হয়
পাঠ টি ভালো লাগলো।
আমার কী মনে হয় জানেন- একজন শিল্পীর যদি আপাদমস্তক শিল্পী হতে হয় তবে তার এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে অন্তত তার সৃষ্টির প্রতি কোন ঘৃণা তৈরী হয়। কারন সৃষ্টি টা একজন শিল্পীর কাছে নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ন। শিল্পী সত্ত্বা আর ব্যক্তিসত্ত্বার মাঝে যেন পরস্পরবিরোধী কোন উপাদান না থাকে। খুব প্রতিভাবান জ্ঞানপাপীর জন্য কী শ্রদ্ধা রাখা যায়? এরা এত কিছু বোঝে এই সহজ বিষয়টা কেন বুঝতে আর মানতে চায় না- বুঝতে পারি না।
দ্বিতীয় বাক্যটির বক্তব্য মেনে নিতে পারলাম না। আমার ধারণা, পশ্চিমা সঙ্গীত (ক্লাসিক বা আধুনিক - ড়্যাপ বা হিপ-হপ ধর্তব্যে নয়) মূলত সুর- আর ধ্বনি-নির্ভর। তবে বক্তব্য বা শব্দের ভারে নুয়ে পড়া সঙ্গীতের চর্চা থাকলেও তা মেইনস্ট্রীম নয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
"একজনের সৃষ্টি থেকেই আসোলে আমরা তার প্রতি আকৃষ্ট হই
তারপরে তা ভক্ততে পরিণত হই
যখন সেই লো(ক)টিই উল্টাপাল্টা করে তখন তার সাথে সাথে মাঝেমাথে তার সৃষ্টিতেও ঘৃণা তৈরি হয়"
এ ব্যাপারটি আমাকে বেশ ভাবায়। এটি কি আমাদের আকাঙ্খার সমস্যা? আমরা মানুষ হিসেবে প্রায় ক্ষেত্রেই সবকিছুতে সুন্দর বা পারফেকশন খুঁজি। আমাদের ভালবাসা বা অন্যান্য পজেশনকে খুঁতহীনভাবে চাই।
আমার এব্যাপারে একটি নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। আমার একসময়ের দেবতা যাকে অন্ধভাবে অনুসরন করতাম.. যখন তার কাছে এসে তার ওপিঠ দেখলাম তখন খুব ধাক্কা খেয়েছিলাম। পরে উপলব্ধি হলো তিনি তো দেবতা নন মানুষ। চাঁদেরও কলন্ক আছে এবং এটিকে স্বীকার করে নেয়াই ভাল। এবং সেই কলন্ক চাঁদের জ্যোতিকে কলুষিত করে না। আমরা কি চাঁদের কলন্কের জন্যে চাঁদের আলোকে আপন করে নেব না?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
কিছুদিন আগে কোন এক চ্যানেলে সৈয়দ শামসুল হকের সাথে এক সাক্ষাৎকারের একটি অংশে সেলিম আল দীনের একটি পূর্ব গৃহীত মন্তব্য ভিডিওতে দেখান হয়েছিল। সেলিম সৈয়দ হকের অনেক গুণের প্রশংশা করেও নাটকে তাঁর চরিত্রদের উচ্চগ্রামের সংলাপের সম্পর্কে নিজের মতের ভিন্নতা জানিয়েছিলেন।
আমি জানি না লীলেন 'রুদ্র রস' বলতে কি বোঝাতে চান। আমি নজরুলের অনেক রুদ্র (আমার মতে) কবিতা ও গানে সেটুকু আনন্দ পাই না, যা রবীন্দ্রনাথের নাগরিক মৃদুতর বাণীতে পাই। মৌসুমী ভৌমিকের জীবনমুখী গানেও তাই। অঞ্জন দত্তের শিশুসুলভ চেঁচামেচির চাইতে তা আমার কাছে অনেক বেশি নান্দনিক মনে হয়। উচ্চগ্রামের কন্ঠ আমাকে বিকৃষ্ট করে। কোলকাতার নাটকেও আমি ঢাকার টিভি নাটকের স্বাভাবিকতার চাইতে যাত্রাঢংগী সংলাপ বেশি দেখে চ্যানেল বদলে ফেলি।
সুমন সুবিধাবাদী কি না, আমি জানি না। রোকেয়া প্রসঙ্গে মনে হলো , কিছুদিন আগে এ,টি,এন -এ দেখা এক ইসলামী প্রোগ্রামে মৌলানা সাহেবের ক্ষেদোক্তি - রোকেয়া নাকি বিবি খাদিজার পায়ের নখের হাজার ভাগের এক ভাগেরও সমান নন, কারণ খাদিজা ছিলেন আদর্শ স্বামী অনুগত স্ত্রী। রোকেয়ার মত মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত হয়ে বেলেল্লাপনা করা শেখান নি তিনি। 'তারা' টিভি যখন এদেশে নিষিদ্ধ ছিল না, সুমনের এক টক শো আমি নিয়মিত দেখতাম। সেখানে কেউ তাঁকে সুমন ভট্টাচার্য বললে তিনি হাত জোড় করে বলতেন, 'আমি কবির সুমন,এ নামেই অনুগ্রহ করে ডাকবেন। যদিও বাংলাদেশে 'তারা' টিভি তখন একটা জনপ্রিয় চ্যানেল ছিল , এর বিজ্ঞাপনদাতা ও অধিকাংশ দর্শক ওপারেই ছিলেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমার কাছে শুধু অদ্ভুত মনে হয়েছে সাবিনার এই মারাত্মক অসুখের সময় সুমনের উপস্থিতির খবর না পাওয়া,এবং ভালো হয়ে ফেরার পরে এক সাথে কন্সার্ট।
এই টার্মগুলো বাংলা সাহিত্যের রস বিচারের একেবারে টেকনিক্যাল টার্ম
বীর, রুদ্র, করুণ, ভয়ানক, বীভৎস, শৃঙ্গার (কাম+ বাৎসল্য)
এই ছয়টি রস
রুদ্র রসের সাথে চেঁচামেচির সম্পর্ক নেই
মূল ব্যাপরটা হলো যে বিষয়ে/ বক্তব্যে কিছুটা হিংসা এবং অহংকারের মিশ্রণ আছে সেটাকেই সাধারণত রুদ্র রস বলে
আর বীর রস একেবারে আত্মম্ভরীতা (নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার প্রথম অংশ)
০২
সাবিনার অসুখের সময় সুমন কিন্ত বাজে কমেন্ট করেছেন
তিনি বলেছেন- একটা মানুষ অসুস্থ হয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে অত মাতামাতির কী আছে?
ব্যাক্তি সুমন এবং গানওলা সুমনকে আমি বারবার ভিন্নভাবে আবিষ্কার করেছি। উনার গান হয়তো এখনো আমাকে বেঁচে থাকার রসদ দেয়, উনার জীবনের কিছু উত্তালতা উনার কাছে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু উনার কিছু চাটুকটা, যুক্তিহীন ভন্ডামি বারবার কষ্টও দেয়, খানিকটা বিরাগের জন্মও দেয়। কিন্তু তবুও সুমন টানে স্রোতের মতো। হয়তো স্রোতের বিপরীতে চলেন বলেই সেই স্রোত বেশী টানে।
লীলেন ভাই, সুমনকে এইভাবে ভেঙ্গে গানকে তুলে এনেছেন যে দুর্ধর্ষ লেগেছে। এককথায় অসাধারণ। এই কথাটাই মূল সত্য যে - ''সুমনের গান যতটা না গোষ্ঠীকে আলোড়িত করে তার চেয়ে বেশি আলোড়িত করে ব্যক্তিকে''...... সেই টানেই এখনো ভাসি।
ডাকঘর | ছবিঘর
নতুন মন্তব্য করুন