পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ না হয় এক দীর্ঘ ও গৌরবময় কর্মসূচির ইতিহাস রয়েছে। যা পরবর্তীতে সেই দেশের ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে সংস্কৃতির অংশে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এবং দেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গটিকে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হিসেবেই উদযাপন করে।
কিন্তু বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গটিকে যেন আমরা সচেতনভাবেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রূপান্তরিত হতে দিতে নারাজ। আমরা কেউ কেউ এটিকে রাখতে চাই কাটখোট্টা ইতিহাস বানিয়ে। আর কেউ কেউ স্বাধীনতা প্রসঙ্গটিকে উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে চাই রাজনীতির বাজারে। এবং আরো বিস্ময়কর হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই উচ্চ প্রায়োগিক যুগে যখন বাংলাদেশেই মহাস্থান গড়ে আবিষ্কৃত হচ্ছে দেড় হাজার বছরের প্রাচীন রাস্তা এবং সেখান থেকে গবেষণা করে তুলে আনা হচ্ছে প্রাচীন সভ্যতার অজানা অথচ সুনির্দিষ্ট ইতিহাস। ঠিক সেই সময়েই আবার আমরা মাত্র ৩৪ বছর আগেকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং তার রূপ নিয়ে একেকজন কথা বলছি নিজের মনের মতো কিংবা সুবিধামতো। এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার হাতিয়ার হিসেবে সময়ে সময়ে ইচ্ছে মতো পরিবর্তন করে চলেছি তার স্বরূপ কিংবা প্রেক্ষাপট।
যার ফলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো আলোচনা কিংবা অনুষ্ঠানে যাবার আগে আয়োজকদের ব্যানার দেখে যেতে হয় কিংবা না গিয়ে ফিরে যেতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো বই পড়ার আগে জেনে নিতে হয় লেখক কোন শিবিরের চোখ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে দেখেন। তিনি কোন গোত্রের লোক। এ যেন অনেকটা প্রাচীন গোত্র প্রথার মতো। কোন গোত্র কোন আচার মেনে চলবে তা আগে থেকেই জানা। এবং হয়ও তাই। ব্যানার দেখেই বাংলাদেশের যে কোনো সাধারণ লোক বলে দিতে পারে কোন জায়গার বক্তারা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কী বলবেন। অথবা লেখকের গোত্র-পরিচয় জেনে গেলেই বলে দেয়া যায় যে তিনি তার বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কী লিখবেন। বাংলাদেশের স্কুলে একই ঘরের বড়ো ভাই এক সরকারের আমলে পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস পড়ে। ছোট ভাই হয়তো পরের সরকারের আমলে একই ক্লাসে উঠে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে আরেকটা। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধতো একটাই। একবারই হয়েছিল। এবং আমরা সবাই। বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষ। সবাই সেই যুদ্ধের ফসল স্বাধীনতা ভোগ করছি এখন। তাহলে কেন আমাকে লেখকের গোত্রপরিচয় জেনে মুক্তিযুদ্ধের বই পড়তে হয়। কেন অনুষ্ঠানের ব্যানার দেখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প কিংবা বিশ্লেষণ শুনতে হয়?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সরাসরি সবচে বেশি লাভবান হয়েছেন রাজনীতিবিদ- আমলা এবং সেনা কর্মকর্তারা। স্বাধীনতা পরবর্তী পদ খালি থাকা সাপেক্ষে যাদের অনেকে নিচু স্তরে থেকেই ক্যারিয়ার শেষ করার কথা তারাও উঠে এসেছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এবং এই তারাই স্বাধীনতা প্রসঙ্গটিকে বিকৃত ও বিতর্কিত করার প্রকল্প বাস্তবায়ন সূচনা করেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন
তাদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়েছেন এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ছিলেন তাদের অবস্থান অনেক বেশি স্পষ্ট। তাদের ব্যানার দেখলে বোঝা যায় তারা কী বলবেন। কিন্তু আরেক দল আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের সংশোধিত ইতিহাস বাস্তবায়ন করতে চান। মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংযোজন করতে চান নিজেরদের বর্তমান পরিবর্তিত রূপের যৌক্তিকতা। ভয় তাদেরকে নিয়েই
মুক্তিযুদ্ধ সময়ের মুক্তিযুদ্ধ-পক্ষের এক ছাত্রনেতা এই মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হয়ে যখন পরিবর্তিত রাজনীতিতে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী ছাত্রনেতা অন্য আরেক মন্ত্রীর সাথে একই মঞ্চে বসেন তখন রাজনৈতিকভাবে এর দায় তার উপরই ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তার এই অবস্থান মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের সংস্কৃতি হয়ে উঠার পথে আঘাত করে। আর তারও চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা যখন এরকম পরিবর্তিত কিংবা বিবর্তিত রাজনৈতিকদের বর্তমান অবস্থানকে লিগেলাইজ করার জন্য এদেশেই কেউ কেউ যুক্তি কিংবা তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তখনই আমাদেরকে আরো বেশি বিভ্রান্ত হয়ে যেতে হয়। এবং তখনই ব্যানার দেখেও আমারা নিশ্চিত হতে পারি না যে কোথায় মুক্তিযুদ্ধের কোন বিশ্লেষণ কারা দেবেন। কারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্ততাকে হাতিয়ার করে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গটিকে কৌশলে সংশোধন করার চেষ্টা করবেন
এবং তখনই। আমাদেরকে আতঙ্কে থাকতে হয় যাতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানের সামনে না পড়ি। আমাদেরকে সচেতন থাকতে হয় যাতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো রচনায় আমাদের চোখ না পড়ে
গ্রামে একটি প্রবাদ আছে। ‘পতিতাও এককালে সতী ছিল!’ এই প্রবাদটি বর্তমান অনেক রাজনীতিবিদ কিংবা বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বর্তমান ... অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! এই কথাটি বলে না হয় রাজনীতিবিদ কিংবা সেই সকল বুদ্ধিজীবীদেরকে সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসা যায়
কিন্তু সাধারণ মানুষের কী হবে। কী হবে আজকে যে প্রজন্ম তার শৈশবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার প্রথম পাঠ গ্রহণ করছে? সে কি সপ্তম শ্রেণীতে এসে মুক্তিযুদ্ধের এমন ইতিহাস পড়বে যে ইতিহাস তারই তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে আসা ইতিহাসের বিপরীত?
এক্ষেত্রে আমার একটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব আছে সকল রাজনীতিবিদ- সরকার এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে। এ প্রস্তাবটির যুক্তি আমি পেয়েছি কিছুদিন আগে ১৮-২০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের একটি আড্ডায়। তারা সবাই এ প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাদের সবারই বক্তব্য একটা। ‘স্বাধীনতা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। স্বাধীনতাকে আমরা উদযাপন করতে চাই সাংস্কৃতিকভাবে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা বিতর্ক শুনতে রাজি নই। আমাদেরকে জানানো হোক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের কোন ঘটনাকে আমরা আমাদের উত্তরাধিকার হিসেবে মেনে নেব। এর জন্য প্রয়োজনে পাঁচ বছর আইন করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সব রকম আলাপ-আলোচনা বন্ধ রেখে গবেষণা করা হোক। আবিষ্কার করা হোক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ঘটনা। এই পাঁচ বছর কিংবা তারও বেশি সময়ও যদি লাগে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তার পরে আমরা জানতে চাই সঠিক ইতিহাস। যে ইতিহাস সবাই একই রকম জানবে-বলবে- পড়বে।’
আমি সম্পূর্ণ একমত এই তরুণদের সাথে। কিছুদিনের জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সব আলোচনা- অনুষ্ঠান- লেখালেখি প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়া হোক। বন্ধ করে দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা করা হোক সঠিক ইতিহাসের। তারপর আমাদের বলা হোক এই হলো আমাদের ইতিহাস। সে ইতিহাসে যাদের অবদান আমরা পাবো; সে যেই হোক। যেই রাজনৈতিক পরিচয়ই হোক তার আমরা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস পড়তে গেলে তাদেরকে স্যালুট করবো। আর যারা সেখানে চিহ্নিত হবে বিরুদ্ধপক্ষ মানুষে। আমরা জানবো তারা আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিরুদ্ধপক্ষ। তাদের সাথে আমাদের কোনো সাংস্কৃতিক সংযোগ নেই
আমি সেই দিনের অপেক্ষায় থাকতে চাই। যেদিন মঞ্চের ব্যানার দেখে স্বাধীনতার অনুষ্ঠানে যেতে হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সিভিল ও মিলিটারি দুটি আলাদা ইতিহাস থাকবে না। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো রাজনৈতিক বিভাজনে বিভক্ত হবেন না। যেদিন লেখকের রাজনৈতিক পরিচয় জেনে পড়তে হবে না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সরকার বদলে গেলেও পাঠ্যপুস্তকে বদলাবে না মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে যার যতটুকু অবদান তাকে ততটুকুর জন্য আমার সবাই স্যালুট করব এক সাথে। সারা বাংলাদেশ জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের যত আলোচনা হবে; আমি দেখতে চাই তার মূল সূত্র এক। এই উত্তরাধিকার বহন করি আমরা সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। সঠিক। অভিন্ন। সত্য। আর সুস্পষ্ট।
২০০৫
মন্তব্য
২০০৫ এ লেখা
দৈনিক সংবাদের জন্য
হঠাৎ করেই চোখে পড়লো লেখাটা। মনে হলো মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে এই লেখাটিই আমি আরো ২০০০ বার ছাপাতে চাই
এবং লক্ষ লক্ষবার বলতে চাই
তাই এখানে দিয়ে দিলাম
জটিল বিশ্লেষন
ভুল বলেন নাই
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
ডাকঘর | ছবিঘর
নতুন মন্তব্য করুন