বৈরাত

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৪/১০/২০০৭ - ১:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(২০০৭ এ বের হওয়া আমার গল্পের বই- ‌‌নিম নাখারা'র প্রথম গল্প এটি)

আমাকে ফোনে ডেকে তুলল পুলিশ- হ্যালো কিডা? অনন্ত বলতিছেন? পুলিশ ইস্টিশন থেইকে কথা বইলতেছি। নেন স্যারের সঙ্গে কতা কন

সকালবেলা। তখনো আমার সকাল হতে বহু বাকি। কিন্তু সংসারী মানুষদের সকাল হয়ে গেছে বহুক্ষণ। বন্ধুরা আমার এসব খবর ভালো করেই জানে। জানে যে কেনার পর থেকে আমার মোবাইল কোনোদিন বন্ধ হয়নি। কোনো এক বিশেষ ফোনের অপেক্ষায় আমি সারাক্ষণ ফোন খোলা রাখি। এজন্য অনেকেই আমার সকাল হবার আগেই বিভিন্ন ফোন থেকে ফোন করে আমার ঘুম ভাঙানোর মজাটা নেয়। মাঝেমাঝে নিজেদের ফোন থেকে নিজেরাই করে। মাঝেমাঝে অন্য কারো ফোন থেকে অন্য কাউকে দিয়ে কিংবা মজাদার কোনো ভাবী কিংবা বান্ধবী দিয়ে ফোন করিয়ে আমাকে কিছুটা কাবু করতে চায়। ...বিষয়টাকে আমি এরকমই কিছু একটা ধরে নিতাম যদি না পুলিশ অফিসার আমাকে আরো কিছু তথ্য দিতেন

বেশ দূর। বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর। যখন পুলিশ স্টেশনে গেলাম দেখলাম বকুল বসে আছে। তার মুখ ফ্যাকাশে। নিজের নাম বলতেই পুলিশি স্টাইলে অফিসার কিছু প্রশ্ন করলেন আমাকে। তারপর একটা চিরকুট বের করে দেখালেন- দেখেন। সুইসাইড নোটে আপনাদের দুজনের নাম আর ফোন নম্বর লেখা আছে। অবশ্য তেমন কিছু না। শুধু লেখা আপনাদের সাথে যেন যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু আপনারাতো কোনো রিলেটিভ নন। স্রেফ বন্ধু। অবশ্য তার এক চাচাকেও ফোন করা হয়েছে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে। তিনি দুপুরের মধ্যেই এসে পড়বেন। তাকে বলা হয়েছে তিনি যেন ছেলের বাবাকেও খবর দেন। তিনিও হয়ত এসে পড়বেন বিকেলের মধ্যে। ...কিন্তু ঘটনা হলো কেন সে সুইসাইড করল? আপনারা কী জানেন এ ব্যাপারে? ...অত মানুষ থাকতে আপনাদের নাম কেন সে লিখে গেলো সুইসাইড নোটে? বিষয়টা পুলিশ হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই ভাবতে হবে

জেরা- প্রশ্ন এবং জেরা। কবে থেকে পরিচয় থেকে শুরু করে বাড়ি কোথায়-ক’ ভাইবোন- কোনো প্রেম করি কি না কিংবা আগে করেছি কি না। আমার কোনো বান্ধবীর সাথে তার কোনো পরিচয় ছিল কি না। তার সাথে সর্বশেষ কবে দেখা হয়েছে। কী কথা হয়েছে। সব। সব... এবং হাবিজাবি সব। পরে জেনেছি বকুল আগে এসেছিল বলে এসব প্রশ্ন তাকে আগেই করে নেয়া হয়েছে

আমাদেরকে থাকার কথাও বলল না। যাবার কথাও বলল না। বলল ওর চাচা দুপুরের মধ্যেই এসে পড়বেন। বসেন। বসলাম। বসে থাকলাম। আমি আর বকুল। তাকেও ডেকে আনা হয়েছে ফোনে

নয়ন আত্মহত্যা করেছে। কমপক্ষে দুদিন আগে। বিষ খেয়ে। তার বাসায়। তার রুমে। সে সাবলেট থাকত সরকারি কলোনির একটি ঘরে। বাসাওয়ালা তার সবাইকে নিয়ে তিনদিন আগে বাড়ি গেছে তার কার যেন বিয়েতে। নয়ন ছিল একা। একাই সে মরার সিদ্ধান্ত নেয়। মরে। পুলিশের ভাষায় কমপক্ষে দুদিন আগে। মানে পরশু। হয়তবা দিনে। হয়তবা রাতে। পুলিশরা দিন দিয়ে দিনের হিসেব করে নাকি রাত দিয়ে করে আমি জানি না। কিন্তু পরশুর আগের দিন তার সাথে আমাদের দেখা হয়েছে। বলেছিল একটা সুসংবাদ আছে তাই আমাদেরকে মদের সাথে শিক খাইয়েছে। পুরো প্যাকেট বিড়ি কিনে খুলে রেখেছে- খা। নো প্রব্লেম। দরকার হয় আরেক প্যাকেট কিনব। পরে। যাবার সময় আমি আর বকুল দুটো করে বিড়ি পকেটে করে নিয়ে গেছি ওর প্যাকেট থেকে। সে পুরো প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে চাইলে বাকি যে আরো দু-তিনটা আছে সেগুলোও নিতে পারি। সেদিন সে এতই উদার ছিল। আমরা আর নেইনি। তার দেখাদেখি আমরাও কিছুটা উদারতা দেখিয়েছি। সম্ভবত মদ খেলে বেশ সহজেই উদার হওয়া যায়

কিন্তু সুসংবাদ কী তা বলেনি। বলেছে জানবি। অত তাড়াহুড়োর কী আছে। আমরাও আর কোনো উৎসাহ দেখাইনি। কী আর সুসংবাদ? হয় ঘুষ দিয়ে কোথাও কেরানি কিংবা ফেরিওয়ালার চাকরির খবর। নয় আমেরিকা থেকে আপা বলেছে কিছু টাকা পাঠাবে। এইতো। ব্যাস। ওর আবার এর বাইরে কী সুসংবাদ থাকতে পারে? আমরা বরং অন্য একটা খবরের মধ্যে গিয়ে বেশ আরাম পাই। আমাদের মদ জমে ওঠে। সেদিন উজ্জ্বলের বউকে নিয়ে রানা গিয়েছিল বকুলের বাসায়। বাসায় আর কেউ ছিল না। বকুল একা। বকুল তাদেরকে একটা রুম ছেড়ে দিয়েছিল সারা দিনের জন্য। কিন্তু সেই রুমের দরজায় একটা ফুটো আছে। বকুল সারাদিন-সারাক্ষণ সেই ফুটোতে চোখ দিয়ে বসেছিল। সব দেখেছে। উজ্জ্বলের বউকে ফুটো দিয়ে পুরোটা দেখেছে বকুল। এবং। এবং রানা আর উজ্জ্বলের বউ চলে যাবার পর তাকে সেই দেখার ঠেলা সামলাতে হয়েছে দু দুবার বাথরুমে গিয়ে- শালা মাইরে বাপ... বর্ণনা দিতে গিয়ে একবার পুরো একটা পেগ সে ফেলে দিলো- না শালা বলব না। বেশি বললে আমার আবার বাথরুমে গিয়ে ঠান্ডা হতে হবে

তবুও আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা জেনে নিচ্ছিলাম- তারা কী কী করল। ক’বার করল। রানা কেমন পারে। সব সময় শুয়েই করেছিল নাকি অন্য কোনোভাবে...। দারুণ। সিনেমায় অভিনয় দেখার চেয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা শোনাও অনেক মজার। তাছাড়া দুজনই যখন পরিচিত তখনতো বিষয়টা আরও হিট। এবং... এর পরে রানা যদি উজ্জ্বলের বউকে নিয়ে আবার যায় তবে যেন অবশ্যই আমাদেরকে খবর দেয়। সেজন্য আমরা কেউ এক প্যাকেট বিড়ি- কেউ বকুলকে মদের অফার দিলাম। ক্যামেরা ফিট করলে ভালো ব্যবসা করা যাবে; এ কথাও বাদ গেলো না। এবং এরকম আলোচনার মধ্যে নয়নের মতো একটা ব্যাটা ছেলের কোনো খবর শুনতে যে আমাদের আগ্রহ থাকবে না তাতো সূর্য পূর্ব দিকে ওঠার মতো চিরন্তন

নয়ন বলছিল না কিছুই। শুনছিল। আসর শেষ করে বিল দেবার আগে শুধু বকুলকে জিজ্ঞেস করল- উজ্জ্বলের বউয়ের নাম শায়লা?
- মনে হয়। আমি জানি না
- ওর কোথায় কয়টা তিল আছে তা চোখ বন্ধ করলেই গুণে বলে দিতে পারি
- মানে?
আমরা সবাই নয়নকে ঠেসে ধরলাম। বকুল কিছুটা দমে গেলো। এরকম একটা মৌলিক আবিষ্কারের কৃতিত্ব আরেকজন নিয়ে গেলো? নয়ন বলল- শায়লাতো এখন অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় কন্টিনিউ এডুকেশন করছে রানার সাথে। কিন্তু ওর প্রাইমারিÑ হাই স্কুল আর কলেজ হচ্ছে এই নয়ন শিক্ষা নিকেতন
- কোথায়? কবে?
বকুল কিছুতেই তার কৃতিত্ব ছাড়তে চাইছিল না। কিন্তু নয়নের বর্ণনায় এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিলো। এবং এই প্রথম আমরা জানলাম নয়ন কেন মেসে থাকে না। কেন সে অনেক বেশি পয়সা খরচ করে সাবলেট থাকে। যদিও বাজারে একটা কথা প্রচলিত আছে যে বাসাওয়ালির সাথে নয়নের কী যেন কী একটা আছে। সে যাই হোক। আমরা শায়লার কথা ভাবতে ভাবতে আর রানাকে হিংসা করতে করতে সেদিন ফিরলাম টাল হয়ে। নয়নের সংবাদ কিংবা হঠাৎ করে মদ খাওয়ানো কিংবা উদার হয়ে যাবার কোনো খবরই নেয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। তারপরতো আজকের সকাল। পুলিশের ফোন- হ্যালো কিডা...

দুপুরে এলেন নয়নের চাচা। পুলিশ স্টেশনে আমাদের সাথে আলাপ হলো। পুলিশ কী যেন মনে করল। তারপর আমাদের ঠায়-ঠিকানা লিখে নিল। একটা মুচলেকা নিল এই বলে যে এই সংক্রান্ত বিষয়ে যে কোনো প্রয়োজনে আমরা পুলিশকে সাহায্য করতে বাধ্য থাকব। তারপর বলল আপনারা যেতে পারেন

খাওয়া হয়নি কিছু। না সকালে; না দুপুরে। না আমার; না বকুলের। চায়ের দোকানে গিয়ে পাউরুটিতে কামড় দিয়ে আমি আর বকুল দুজনেই এক সাথে দুজনকে প্রশ্ন করে বসলাম- জানিস কিছু?

জানি না। আমরা কিছুই জানি না। কেন আমাদের নাম আর ফোন নম্বর সে সুইসাইড নোটে দিয়ে গেলো জানি না। ওতে কী লিখেছে তাও জানি না। পুলিশ কাগজটা দেখিয়েছে কিন্তু পড়তে দেয়নি। বেশি বড়ো না। হাতে লেখা আট-দশ লাইন
- চল যাই শালাকে দেখে আসি

বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আমরা হাজির হলাম হাসপাতালে। নয়নকে খুঁজতে খুঁজতে মর্গে। নয়ন নয়। লাশ। লাশ নয়। কেটে ফালা ফালা করে ফেলে রাখা একটা মানুষের পচা ধড়। হা হয়ে আছে সমস্ত শরীর। একটা ভাঙা চাটাই দিয়ে ঢাকা। গরমে চর্বি গলে চিকচিক করছে
- আপনাদের লাশ? ডাক্তারের সার্টিফিকেট এনে নিয়ে যান। মুসলমানতো? যান জানাজা কইরা মাটি দেন। আল্লায় মাফ করব
নাভি পর্যন্ত দাড়ি। বসে পেশাব করলে নির্ঘাত তার দাড়িতে পেশাব লেগে যাবার কথা। গাট্টাগোট্টা চেহারার ডোম কথাগুলো বলল আমাদের দিকে তাকিয়ে
- আমাদের লাশ হবে কেন? আমাদের ফ্রেন্ড। ... কিন্তু এভাবেতো লাশ নেয়া যাবে না। সেলাই দেবেন না?
- ও আপনাদের না? তাইলে কথা বলেন ক্যান? গার্জিয়ান কই?
- গার্জিয়ান আসবে। কিন্তু কাটার পর সেলাইতো করবেন?
- সিলাই দিলে কি লাশ বেহেস্তে যাইব? সুইসাইডে মরার এমনিতেই জানাজা অয় না। জাহান্নামে যায়
- জাহান্নামের টিকিট আপনি দেন নাকি? লাশ সেলাই করেন
- ওইটা আমার ডিউটি না
- কার ডিউটি?
- অত কতা আপনাগোরে কইতে অইব? যান গার্জিয়ান নিয়া আহেন। যত্তোসব। এই সব কুসঙ্গের লাইগাই পোলাপান এই রকম আকাম করে। আবার আইছে ডিউটি শিখাইতে

বকুলের হাতে চাপ দিলাম- চল। ওর চাচা আসুক। আয় বিড়ি খাই

চার কাপ চা আর তিনটা বিড়ি শেষ হলো
- আচ্ছা শালা কি সত্যিই সুইসাইড করেছে নাকি বাসাওয়ালির স্বামী বিষ খাইয়ে ওর ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে? তোর কি মনে হয়?
- কে জানে? ...হারামজাদা যে শায়লার মতো একটা মেয়েকে...
বকুল ক্ষেপে গেলো
- শায়লারা আর গিয়েছিল তোর ওখানে?
- গতকাল
- শুয়োরের বাচ্চা। আমাকে ফোন করিসনি কেন?
- মাত্র ঘণ্টাখানেক ছিল
- তবুও
- লাভ হতো না। কালকে আর পুরো কাপড় খোলেনি। কিছুই দেখতে পারতি না
- তা শায়লার সাথে ছিলটা কে? রানা নাকি তুই?
- ওই খানকির ছেলে। শায়লাকে আমি ছোট বোনের মতো দেখি
- তাতো অবশ্যই। ফুটো দিয়ে ছোট বোনকে ছোটবেলার মতো ন্যাংটা-নাদুস দেখো

নয়নের চাচা আমাদের দেখলেন। আমরা বিড়ি ফেলে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়ে এসেছেন। নয়নের বাবা ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এসে পড়বেন। লাশ বহনের জন্য গাড়িও ঠিক করা হয়ে গেছে
- লাশ দেখেছেন?
- না। আমি সব ঠিকঠাক করে এইমাত্র এলাম। কোথায়?
- মর্গের বারান্দায় ফেলে রেখেছে। সেলাইও করেনি
তিনি চিন্তা করলেন
- চলো দেখি

মর্গের কাছাকাছি গিয়ে নাকে রুমাল চাপা দিলেন- আমার একটু সমস্যা আছে। তোমরা কেউ একজন গিয়ে লোকটাকে ডেকে নিয়ে আসো
আমি গেলাম। লাশের গার্জিয়ান এসেছে শুনে লোকটা তাকাল আমার দিকে- চলেন

নয়নের চাচা ঠিকাদার মানুষ। নরকের টিকিট বিক্রেতা লোকটির সাথে কথা বললেন। মানিব্যাগ বের করলেন। তারপর আমাদের ডাকলেন- তোমরা কিছু খেয়েছ? ...চলো ডাক্তারের ক্লিয়ারেন্সটা নিয়ে কিছু খাই
- লাশ?
- উনি দেখবেন। চলো
- যান অনেক দূর যাইতে অইব আপনাদের। কিছু খাইয়া লন। যা অইবার তাতো অইয়াই গেছে। বাকিটা আল্লা মালিকে দেখব ...চিন্তা কইরেন না। আপনারা খাইয়া আহেন আমি এই দিক দেখতাছি
লোকটা আমাকে আর বকুলকে উদ্দেশ্য করে বলল। বকুল কিছু বলতে যাচ্ছিল। চাচা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। লোকটা চলে যাবার পর বললেন- সব জায়গায় তর্ক করতে নেই। চলো

আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে এলেন। এর মধ্যে থানার সেই পুলিশও এল। তিনি কথা বললেন তাদের সাথে। বললেন- আমি যেতে পারছি না। তোমরা কিছু খেয়ে আসো। পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিলেন আমাদের। পুলিশ অফিসার মমতার সুরে বলল- প্যাথেটিক। ভেরি প্যাথেটিক। একটা বন্ধু হারানো আর ভাই হারানো সমান কথা। কী আর করবেন। সবই আল্লার ইচ্ছা। আল্লা যা করেন ভালোর জন্য করেন। যান মুখে কিছু একটা দিয়ে আসেন। আপনাদেরতো সকাল থেকেই কিছু খাওয়া হয়নি

- চুৎমারানি
বিড়বিড় করে গাল দিতে দিতে বকুল টাকাটা পকেটে ভরল- চল
হাসপাতাল গেটের বাইরে এলাম আমরা
- আচ্ছা চাচা শালা কি আবার এই পাঁচশো টাকার চেঞ্জ নেবে আমাদের কাছ থেকে?
- কে জানে? চাইতেও পারে। শালা ঠিকাদার
- চাইলেই হলো? শালা ডোমকে টাকা দিতে পারে। পুলিশকে দিতে পারে। ডাক্তারও নিশ্চয়ই নেবে।... দেবো না ...শোন খুচরা করে আমার আড়াইশো টাকা দিয়ে দে
- তুই একটা চামার

আমরা হাঁটতে হাঁটতে সুইপার পট্টিতে ঢুকলাম। খাসির মাংস ভুনা আর পরোটা আনিয়ে দু-দুটো হাঁড়িয়া শেষ করে বাইরে এসে পান খেলাম সুগন্ধি দিয়ে। আফটার অল একটা মরার কাছে যাওয়া। বেরোবার পথে বকুল আটটা স্টিক নিল। কাজে লাগবে

টলতে টলতে যখন বেরোলাম তখন নয়নের বাবাও এসে গেছেন। দূর থেকে তার হাঁসফাঁস-দাপাদাপি দেখেই বুঝেছি নয়নের বাবা। ঠিকাদার চাচা আছেন কাছে। সাথে আরো দুয়েকজন লোক। আমরা তাদের কাছে যাবার আগে নিজেরা পরীক্ষা করে নিলাম আমাদের মুখ থেকে কোনো বদ গন্ধ বের হচ্ছে কি না। ...নাহ। কোনো গন্ধ পেলাম না বকুলের মুখে। শুধু সুগন্ধি পানের গন্ধ। তবে তাকে কিছুটা টাল মনে হলো আমার। বকুলও আমার মুখে কোনো গন্ধ পেল না। কিন্তু বলল আমি যেন ওখানে গিয়ে কোনো বাড়তি কথা না বলি

নয়নের বাবা চিৎকার করে বেড়াচ্ছেন- অসম্ভব। অসম্ভব। এ আমার ছেলে নয়। আমি একে চিনি না। তোমরা আমাকে কী বোঝাতে চাও? এই লাশ? এই কাটা ধড় আমার ছেলের? আমার নয়নের? না। ফজলু আমি তোর ভরসায় ছেলেটাকে পাঠিয়েছি এখানে। এখন... না তোর ভাবীকে কী বলব আমি। এ আমার ছেলে না। আমার ছেলে এখানকার সবার থেকে সুন্দর... ফজলুরে ফজলু..... আমার নয়ন...

এবার বসে পড়লেন বৃদ্ধ কিংবা ভেঙে পড়া মানুষটি। একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল তার কাছে। তাকে আস্তে করে কী যেন বোঝাতে লাগল। বকুল আমার দিকে তাকালÑ কুত্তার বাচ্চা ভালো করে তাকা। চোখ খুলে ফেলব। মরা বলে কথা। মনে হয় নয়নের বোন
- ভালো গুল্লি
- নয়নের বোন তোর বোন না?
- তা হলে তুই বল। আমি শুনি

কয়েকজন নয়নের বাবাকে ধরে তুলে নিয়ে গেলো একটা গাড়ির দিকে। ফজলু চাচা। মানে ঠিকাদার চাচা এলেন আমাদের কাছে। মুখোমুখি এসে একটু সরে গেলেন- মরার গাড়িতে নয়নের বাবার যাওয়া ঠিক না। উনি আপসেট হয়ে যেতে পারেন। আমার একটু সমস্যা... মরাকে একা রাখাও ঠিক না। মরার কষ্ট হয়
- আমরা যাব নয়নের সাথে
- হ্যাঁ মানে... আমার থাকা উচিত নয়নের বাবার কাছে। মানে যে কোনো সময়...
- গাড়ি এসে গেছে?
- হ্যাঁ আমরা রওয়ানা দেবো। সেলাই হয়ে গেছে। এখন চাটাই দিয়ে বেঁধে দেবে...

লাশকে সোজা রাখার জন্য চাটাইর ভেতর দুপাশে দুটো বাঁশ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তিন দিনের লাশ। গরমের দিন। অত দূর নিয়ে যাওয়া। এই দুটো বাঁশই নয়নকে চাটাইর ভেতর শক্ত করে রাখবে। নরকের টিকিট বিক্রেতা দাড়িওয়ালা ডোম আমাদের দিকে তাকাল- আপনেরা যাইবেন মুর্দার লগে?
- যাব
- আপনাগোর খুব নিকটের ফেরেন্ড আছিল না? ...কী আর করবেন। মনে কষ্ট আইনেন না। আল্লার মাল আল্লায় নিয়া গেছে। তার লাইগা দোয়া করেন
- উপদেশ লাগবে না চুৎমারানি। তুই গিয়ে হাত মেরে মাল বের করে তোর দাড়িতে মাখা
মনে মনে বললাম। কিন্তু বকুল কী যেন আধ্যাত্মিক কথাবার্তা শুরু করে দিলো লোকটার সাথে

রাত হয়ে গেলো হাসপাতাল থেকে বের হতে হতে। এর মাঝে কয়েকবার চোখ বুলালাম। কিন্তু নয়নের বোনকে আর দেখা গেলো না। ফজলু চাচাকে বকুল জিজ্ঞেস করল নয়নের বাবা কোথায়। বললেন তাকে এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার এখানে থাকা ঠিক না। যাবার সময় তাদেরকে নিয়ে যাবেন

বকুল আরো কয়েকটা স্টিক জোগাড় করে নিয়ে একটা ধরাল- লাভ নেই দোস্ত। গুল্লিটা ওর বাবার সাথেই যাবে। নে টান দে। হয়ত কোনো বুড়া- ধুড়াকে দেবে আমাদের সাথে দোয়া দরুদ পড়ার জন্য

কেউ না। শুধু আমরা দুজন। আর কেউ রাজি হলো না লাশের গাড়িতে উঠতে। গন্ধ। বিকট গন্ধ। সবাই সরে গেলো। নয়নের বাবা সমানে চিৎকার করছেন। আমাদের সামনে এসে বললেন- তোমরা নয়নের বন্ধু? আচ্ছা তোমরাই বলো এইটা কি নয়ন? মোটেই না। নয়ন তোমাদের সবার থেকে সুন্দর ছিল। তোমাদের মাঝে কেউ আছে ওর মতো?
- হ্যাঁ চাচা। আমাদের মধ্যে সব চেয়ে হ্যান্ডসাম ছিল নয়ন
- তাহলে? তাহলে তোমরা কিছু বলছ না কেন? কেন ওরা একটা পচা লাশকে আমার কাছে গছিয়ে দিচ্ছে। আমার নয়ন কোথায়? এ আমার ছেলে না। তোমরা কিছু বলো। এ নয়ন না। এই ফজলু। ফজলু। শোন এরা কী বলে। এরা নয়নের বন্ধু। এরা নয়নকে চেনে। দেখ এরা বলছে এ নয়ন না

মেয়েটাকে আবার দেখলাম। গোসল করে কাপড় বদলেছে। অন্য রকম লাগছে খোলা চুলে। এখন পরেছে আগাগোড়া সাদা পোশাক। বাতাসে উড়ছে যেন মেয়েটা

একটা বডি স্প্রে পুরো লাশের উপর শেষ করলেন ফজলু চাচা। আরেকটা আমার হাতে দিলেন- মাঝেমাঝে স্প্রে করে দিও

গাড়ি ছাড়ল। ড্রাইভার এক টুপিওয়ালা-দাড়িওয়ালা তাগড়া হুজুর। মাঝ বয়স। বকুল আমার দিকে তাকাল- স্টিক খাওয়া যাবে না মনে হয়। শালা হুজুর

রাজধানী শহর পার হয়ে গেলো গাড়ি। পেছনে আমরা তিনজন। বকুল আমি আর নয়ন। মাঝেমাঝে আমরা খোলা জায়গায় এসে জানালা খুলে দিচ্ছি। আবার বাজার কিংবা জনবসতিতে এলে বন্ধ করে দিচ্ছি। হুজুর ড্রাইভার এরকমই করতে বলেছে আমাদের। বকুল একটা সিগারেট বের করে আমার দিকে তাকাল। ধরাল। হুজুর ড্রাইভার তাকাল ফিরে- ফিলটারটা বাইরে ফেলবেন ভাইজান। ...বকুল সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সাথে সাথে ধরাল একটা স্টিক। ড্রাইভার তাকাল আবার। বলল না কিছুই। শুধু বলল- আল্লা মালিক। মাপ করো মাবুদ

মাপ করলে করুক না করলে নাই। আমরা আরেকটা ধরালাম। কিন্তু হঠাৎ করে গাড়ি থামিয়ে দিলো ড্রাইভার। নেমে এল- আপনারা সামনে আসেন
- কেন?
- আসেন। সামনে বসতে পারবেন দুজনেই
- এখানেতো অসুবিধা নেই
- পারবেন না। এখনো শুকনার নেশায় আছেন। বুঝতে পারছেন না। আসেন

আমরা সামনে এলাম। গাড়ি আবার চলল- কিছু ধরালে দুয়েক টান দিয়েন
আমি তাকালাম বকুলের দিকে। বকুল একটা স্টিক বাড়িয়ে দিলো। সে না তাকিয়েই বললÑ ধরান আপনি
- আপনি না হুজুর
- লোকে তাই বলে
- এসব খান আপনি?
- এইসব কি আল্লা সৃষ্টি করেনি?
- কিন্তু আল্লাতো আবার নিষেধও করে দিয়েছে
- আল্লার আদেশ-নিষেধ শোনেটা কে?
- মানে?
- দেন। একটা টান দেই ...কে জানে ভাই আল্লা কী বলেছে আর কী বলে নাই। এই মুর্দার বাপ-চাচা অন্য গাড়িতে চলে গেলো গন্ধ সইতে পারবে না বলে। আর আপনারা বন্ধু মানুষ। একটা বন্ধু মরলে দশটা বন্ধু আছে আপনাদের। তাও যাচ্ছেন এই গন্ধওঠা মুর্দার সাথে। আমি জানি না আল্লা আপনাদের কারে কী বলেছে ...আমার চাকরি। আগে আমি রেন্ট এ কারের গাড়ি চালাতাম। কত বরযাত্রী নিয়া গেছি। আমার কাছে বরও যা মুর্দাও তা ...আল্লা মালিক। তিনি জানেন সব
- আমি কিন্তু মুসলমান না হুজুর। আমি আকাটা মানুষ
- যে মুর্দার সাথে তার বাপ যাবে না। সেই লাশের সঙ্গে যাবার জন্য হয়ত আল্লাই আপনাকে বানিয়েছে ...আমি জানি না এইসব... ধরান দেখি আরেকটা... গান জানেন? জানলে ধরেন। মুর্দা টানার গাড়ি। ক্যাসেট প্লেয়ার রাখতে পারি না

সে নিজেই ধরল- এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া/এত যতেœ গড়াইয়াছেন সাঁই...

গাঁজার নেশা জমেছে বেশ। তিনজন মিলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিন-চারবার গাইলাম গানটা। হুজুরের মুখে কথার খই ফুটছে- সিনেমা দেখেন?... আচ্ছা বাংলাদেশের নায়িকারা অত মোটা হয় কেন বলেনতো? এরা কি বোঝে না যে ঘরের বউ মোটা আর পরের বউ চিকন হওয়াটাই সুন্দর?
- হুজুর হয়ে আপনি সিনেমাও দেখেন?
- হাঃ হাঃ হাঃ ভালো বলেছেন। আমি হুজুর। আচ্ছা বলেনতো আমার এই লম্বা দাড়ি আর টুপি ছাড়া আপনার সাথে আমার তফাতটা কী? এই ভাইজানের সাথে না হয় কাটা আর আকাটা একটা পার্থক্য আছে। আপনি? আপনিও কি আকাটা?
- না
- হাঃ হাঃ হাঃ আপনি একটা হুজুর। হাঃ হাঃ হাঃ আপনারতো এ গাড়িতে যাবার কথা না। আপনি মুর্দার বাবার গাড়িতে যাওয়া উচিত ছিল। ওইখানে একটা মেয়ে আছে দেখেছেন? ভালো মেয়ে। টাইট শরীর। বিয়ে হয়নি মনে হয়। বিয়াতি মেয়েরা অত স্লিম থাকতে পারে না। সুন্দর সুন্দর মেয়েগুলা বিয়ার পর পিল খেয়ে বড়ো বাজে রকমের মোটা হয়ে যায়। দেখলে চোখে ব্যথা করে

গাড়ি থামাল আবার- আসেন একবার মুর্দারে দেখে আসি। দাফনের আগে মুর্দা একা থাকলে শয়তান এসে আসর করে। তাছাড়া এই মুর্দার এখনো জানাজা হয়নি

বডি স্প্রেটা নিয়ে হুজুর লাশের গায়ে স্প্রে করে দিলো- নে বাবা সুগন্ধি মেখে নে। তোর ডেটিং হবে আজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হইল ফেরেস্তা কিংবা শয়তান কোথাও কোনো মাইয়া নাই। সবাই পুরুষ। কী আর করবি। দোয়া করি তুই যেন মাধুরীর মতো একটা হুরি পাস। ...শালা মাধুরী... বুড়া হয় না শালি। হাঃ হাঃ হাঃ... চলেন ভাইজানেরা চা খাই। খানকির পোলারা ফেরিতে আমাদের অপেক্ষা করবে। চলেন চা খাই

চা খেয়ে গাড়ির গতি একেবারে কমিয়ে দিলো হুজুর- আপনাদের বন্ধুর কেইসটা কী? প্রেম পিরিতি?
- মানে?
- মরল কেন? ছ্যাঁকা?
- ও ছ্যাঁকা খেতো না। ছ্যাঁকা দিত
- কৃষ্ণঠাকুর? হাঃ হাঃ হাঃ। ধরান আরেকটা। তা মরল কেন?
- কোনো কারণ জানা যায়নি। লিখেও যায়নি কিছুই
- বুঝছি। জীবনানন্দ দাশ- ‘আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের রক্তের ভেতরে খেলা করে... আমাদের ক্লান্ত করে... ক্লান্ত... ক্লান্ত করে... লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই’ হাঃ হাঃ হাঃ জীবনানন্দ মরেছে ট্রামের তলায় গিয়া। আর জীবনানন্দের ভূত আইসা ডাইকা নিয়া গেছে আপনাদের কৃষ্ণঠাকুররে। হাঃ হাঃ হাঃ
- আপনি কবিতাও পড়েন?
- পড়ি না। এক পাগলের গাড়ি চালাইতাম এক সময়। পাগল সারাদিন কবিতা পড়ত। বলত আমাদের সবাইরেই নাকি কোনো না কোনো সময় একবার জীবনানন্দের ভূতে ডাক দেয়। কেউ সেই ডাকে সাড়া দেয়। কেউ দেয় না। কিন্তু সবাই ডাক পায়। কেউ একবার। কেউ বহুবার। হাঃ হাঃ হাঃ এই কবিটা মানুষের ভিতরের এত কথা জানল কী করে বলেনতো? আমার সেই পাগলা মালিক এই সব আমারে বুঝিয়ে দিয়েছে। একটা বইও দিয়েছিল। পড়ে বুঝতে পারিনি। কিন্তু সে যা বুঝিয়ে দিত তা বুঝতাম... আচ্ছা আপনাদের কারো কি কোনো কবির সাথে পরিচয় আছে? আমি কোনো কবি দেখিনি সামনা-সামনি। এরা নাকি মানুষের ভিতরের খবর বলতে পারে? ...আচ্ছা মানুষ মরার পরে কোথায় যায় এ সম্পর্কে কবিরা কিছু জানে না?
- জানলেতো আর শালারা রাস্তাঘাটে পড়ে মরতো না
- হাঃ হাঃ হাঃ ভালো বলেছেন। একটা উল্টাপাল্টা মরণ না হলে নাকি কবিদের সম্মান থাকে না। সেই জন্য জীবনানন্দ কলকাতায় ট্রামের নিচে পইড়া মরছে। হাঃ হাঃ হাঃ ট্রামের নিচে পড়ে পিঁপড়ারও মরার কায়দা নাই। কিন্তু সেই ব্যাটা গিয়ে মরেছে সেখানে। আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ কীভাবে মরেছে জানেন?
- বুড়া হয়ে। আশি বছর বেঁচে
- নাহ। পোষাল না। আচ্ছা আপনাদের এই বন্ধু কবিতা লিখত নাকি?
- মাথা খারাপ। ও ছিল বডি বিল্ডার। গতর চর্চা করত
- এইটাও পোষাল না। তাইলে হালায় মরল কেন?
- ওই যে বললেন জীবনানন্দের ভূত
- হতে পারে। হতে পারে। থাক এইসব। আসেন মুর্দার রুহের জন্য কিছু দোয়া দরুদ পড়ি
- আমিতো মুসলমান না
- হেমান না হলেই হয়। ...দোয়ার ভাষা লাগে না। দোয়ার ধর্ম লাগে না। দুনিয়াতে কত ধর্ম। সবাই সবাইরে বলে বাতিলের ধর্ম। আল্লা মালিকই জানেন কোনটারে তিনি পাশ মার্ক দিবেন আর কোনটা করাবেন ফেল। দোয়া করেন। দোয়া করেন। মাটির মানুষ মাটিতে ফিরে যাবে এর থেকে আর বড়ো কোনো ধর্ম নাই। জেন্দা বন্ধুর মায়ার টানে মরা বন্ধুর পচা লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন... ভাইজানরে আল্লা যদি থাকে তাহলে আপনাদের কথাই শুনব। ওই যে বাপ কুত্তার বাচ্চা কান্দে তার দোয়া কবুল করব না। কারণ সে হালায় পোলার দুঃখে কান্দে না। হালায় কান্দে পোলার কামাই খাইতে পারব না বইলা। করেন। দোয়া করেন। যে আশায় সে মরেছে তার সেই আশা যেন মাবুদ পূরণ করে

হুজুর বকবক করেই চলেছে। ধরেছে। ভালো করেই ধরেছে তাকে। ধরেছে বকুলকেও। কয়েকবার বকুল হুজুরকে আর হুজুর বকুলকে ধমক লাগাল। তারপর দুজন মিলে আবার সেই গানটি ধরলÑ এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া/ এত যতেœ গড়াইয়াছেন সাঁই... হঠাৎ বকুল থেমে গেলো- ওই মিয়া এটা সিনেমার গান
- সিনেমাও আল্লার পয়দা। গাও

যখন আমরা ফেরিতে পৌঁছালাম তখন মাঝরাত পার হয়ে গেছে। বকুল আর হুজুর ভাববাদী গান গাইতে গাইতে শেষ পর্যন্ত ঝাকানাকা গান শুরু করেছে। আমার ভালোই লাগছিল। দুজনেরই তাল জ্ঞান চমৎকার। সুরও ভালো। গাড়ির ঝাঁকুনির সাথে আমি দেখছিলাম নয়নের বোন নেচে চলেছে আমার সামনে। এক সময় মনে হলো মেয়েটা যেন আমার পাশে এসে বসেছে। নাহ। আমারও বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটা সত্যিই সেক্সি। আর টাইট। মানে টানটান

হুজুর আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামতে দিলো না। বলল ঝিম মেরে পড়ে থাকো গাড়ির মধ্যে। নামলেই শুকনার গন্ধে লোকজন হৈ চৈ করে উঠবে। ...সব শালাই খায়। কিন্তু চান্স পেলে বলতে ছাড়ে না কেউ। কী দরকার

নিয়ম মাফিক একবার ঠিকাদার চাচা এসে জিজ্ঞেস করে গেলেন কোনো সমস্যা আছে কি না। হুজুর উত্তর দিলো- মাশাল্লা সব ঠিক আছে কোনো চিন্তা করবেন না। একটু পর একটা ছেলেকে দিয়ে ঠিকাদার চাচা ছয়টা কলা আর কিছু ব্রেড পাঠিয়ে দিলেন। হুজুর গাড়িতে রেখে দিলো- এখন এইগুলা খাওয়া ঠিক না... এই ডিম...
হুজুর একাই চারটা ডিম খেলো- খাও আল্লার রহমত। বকুল কয়টা খেলো জানি না। আমি খেলাম একটা। খাওয়াল হুজুর
- ভাইজান। এই যে মাত্র একটা মুর্দা নিয়া আমরা এত মাতামাতি করি। একটা মুর্দা টানতে আমাদের অত ঝামেলা। কিন্তু নদীটারে দেখছেন? কী চুপচাপ অতগুলা লাশ নিয়া যায় অথচ টেরই পায় না?
- ওই মিয়া। লাশ কই পাইলা?
- ওইতো মানুষইতো লাশ। এখানে কোন শালা আছে যে একদিন লাশ হবে না? সব শালাই লাশ। সব শালাই নিজেরে পাইলা পুইষা বড়ো করে একেকটা সুদর্শন লাশ হবার লাইগা। হাঃ হাঃ হাঃ সুদর্শন মানে নাকি কাউয়া। সেই পাগলই আমারে বুঝাইয়া দিছিল। হাঃ হাঃ হাঃ হালার জীবনানন্দই নাকি শব্দটা ব্যবহার করত। আচ্ছা কাউয়ারে সুদর্শন নামটা কি জীবনানন্দই দিছে নাকি আগে থেকেই ছিল?
- আমি বাংলার ছাত্রও না মাস্টারও না
- হাঃ হাঃ হাঃ কাউয়ার নাম সুদর্শন। এর থেকে বড়ো চুতিয়ামি আর কী হতে পারে। হাঃ হাঃ হাঃ সুদর্শন যুবক মানে কাউয়া যুবক। আর সুদর্শনা মানে কাউয়ানি। ...নাহ। মেয়েদের নামের সঙ্গে শব্দটা যায় না। ...বুঝলা সুদর্শন মানে যেমন কাউয়া। মানুষ মানেও কিন্তু লাশ। নদী এইটা জানে। তাই জিন্দা-মুর্দা সবাইরে সে একই সাথে টেনে নিয়ে যায়। নদীর কোনো ঘেন্না নাই। কোনো পিরিত নাই কারো লাইগা

হুজুর আবার একটা গান প্রায় ধরতে যাচ্ছিল। আশপাশের লোকজন এরমধ্যে তার দিকে তাকানো শুরু করে দিয়েছে। বকুলের বোধহয় হুশ হলো। হুজুরকে ঠেলা দিলোÑ ওই মিয়া। তুমি না মুর্দার গাড়ি নিয়ে যাচ্ছ?
- হুজুর সামলে নিল। গলা থেকে গুনগুন করে যে সুর বের হতে যাচ্ছিল হুজুর তাকে মুহূর্তের মধ্যে দোয়ায় পরিণত করল। আমাদেরও বলল দোয়া পড়তে। আমরা বিড়বিড় করে তার সাথে সুর মিলালাম। ফেরির আরো কিছু মানুষও এসে যোগ দিলো দোয়ায়। দোয়ার শেষে হুজুর একটা মোনাজাতও করল। লাশের জন্য নয়। দুনিয়ার সব মানুষকে যেন আল্লা মাফ করে দেন সেজন্য আল্লার কাছে প্রার্থনা করল সে। আমি হাত উঠিয়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম নয়নের বোনকে কোথাও দেখা যায় কি না। কোথাও দেখলাম না। একবার দেখলাম নয়নের বাবাকে তার চাচা ধরে নিয়ে যাচ্ছেন পেশাব করাতে। কিন্তু... মেয়েটার কি পেশাবও পায় না? একবার গাড়ি থেকে নামলে কী হতো? আমি আল্লাকে বললাম তিনি যেন একবার অন্তত মেয়েটার পেশাব ধরিয়ে দেন...

আল্লা আমার কথা শুনলেন না। ফেরি ঘাটে ভিড়ল। সকাল হয়ে গেছে। আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। বকুল উঠে বসেই বলল- মেয়েটাকে দেখে এলাম। ওড়নাটা মাথায়। শরীর খালি। জোস
- হাঃ হাঃ হাঃ হেসে উঠল হুজুর। তুমিতো শালা একখান সরেস মাল। বুড়া হবে না কোনোদিন
বকুল কোন ফাঁকে ওদের গাড়ির কাছে গিয়ে মেয়েটাকে দেখে এসছে আমি জানিও না। আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। বললামÑ কাজটা ঠিক হয়নি। আমরা একটা মুর্দা নিয়ে যাচ্ছি। সে নয়নের বোন। ভাই হারানোর কষ্টে তার কাপড়চোপড় এলোমেলো হতেই পারে। এই সুযোগ নেয়া তোর উচিত হয়নি
- হাঃ হাঃ হাঃ। সুযোগের অভাবে চরিত্রবান
হুজুর আবার হেসে উঠল। আমি কিছু বললাম না। হুজুর বকবক শুরু করল- করতে দে রে ভাই। করতে দে। মানুষ এইগুলা করেই ভুলে থাকে যে সেও একটা জিন্দা লাশ। করতে দে। পারলে নিজে কর। না পারলে যে করে তারে আটকাবি না

গান আর হুজুরের বকবক। একটার পর একটা স্টিক। মাঝখানে এক জায়গায় থেমে হুজুর বেশ কতগুলো স্টিক কিনল। বলল- এরকম জম্পেশ সওয়ার পাব জানলে কিছু পাগলা পানিও নিয়ে আসতাম। বকুলও সমান তালে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে তার সাথে। মনে হচ্ছে যেন ওরাই নিজেদের পরিচিত। আমি বাড়তি মানুষ। মাঝেমাঝে দয়া করে আমার সাথে কথা বলছে দুজন

দুপুরের দিকে একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি থেমে গেলো। সামনে খাল। গাড়ি আর যাবে না। নৌকা দিয়ে পার করে তারপর কাঁধে করে নিয়ে যেতে হবে লাশ। আমরা নামলাম। মেয়েটাও নামল। কিন্তু দূরে। হুজুর কানে কানে বলল- অসুবিধা নেই। মেয়েটা হাঁটবে সামনে সামনে আর তোমরা তার পাছা দেখতে দেখতে যাবে

গাড়ি যেখানে থামানো হলো সেটা একটা বাজারমতো জায়গা। বোঝা গেলো নয়নের পরিবার এখানে পরিচিত। লোকজন এসে ঘিরে ধরল নয়নের বাবা চাচা আর অন্য লোকজনকে। হুজুর তাড়া দিলো- আমাকে বিদায় করে দেন গো ভাইজান

তখনও লাশ গাড়িতে। জানালা বন্ধ। কেউ কেউ জানালার কাছে এসে দেখার চেষ্টা করছে। আবার সরে যাচেছ দূরে। ঠিকাদার চাচা এগিয়ে এলেনÑ একটু অপেক্ষা করেন ভাই। এখানে নামালেতো সমস্যা হবে। নেবার একটা বন্দোবস্ত করে...
- কেমনে নিবেন?
- নৌকা দিয়ে খাল পার করে কাঁধে করে নিয়ে যেতে হবে
- ভ্যান রিকশা নাই?
- আছে কিন্তু ওপারেতো ভ্যান চলে না
- এক কাজ করেন। এখনতো জমি শুকনা। এখান থেকে একটা ভ্যান নৌকায় তুলে পার করে নেন। তারপর জমির উপর দিয়া ঠেইলা নিয়া যাবেন। কষ্ট কম হবে

কথাটা ঠিকাদার চাচার মনে ধরল। তিনি ছুটে গেলেন লোকজনের কাছে। হাত-পা নাচিয়ে কী যেন আলাপ করলেন। দুয়েকজনকে দুয়েক দিকে পাঠালেন। ফিরে এসে বললেন- বুদ্ধিটা ভালো। নৌকায় করে ভ্যান পার করলে ঠেলে নেয়া যাবে... কিন্তু ভাইজান...
- টাকা পয়সা নাই। এইতো?
- না না। টাকা আছে। আপনার সব টাকাই আমি দিয়ে দেবো
- তা হলে?
- গন্ধটার কী করব?... মানে আপনিতো অনেক লাশই টানেন। আপনি বলতে পারবেন
- শুঁটকি মাছ পাবেন? পুরানা শুঁটকি না। একদিনের রোদ লাগা শুঁটকি। গন্ধওয়ালা শুঁটকি?
- পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সময় লাগবে
- যদি শুঁটকি আনতে পাঠান তাহলে আমি অপেক্ষা করতে পারি। না হলে মুর্দা নামিয়ে আমারে বিদায় করে দেন

ঠিকাদার চাচা আবার দৌড়ে গেলেন জনতার কাছে। কিছু বললেন। হুজুর একটা বিড়ি ধরাল। দুয়েকজন লোক হুজুরের সাথে কথা বলতে এসছিল। আমাদের দিকেও তাকাল সন্দেহের চোখে। কিন্তু হুজুর ওদেরকে প্রায় তাড়িয়েই দিলো

ঠিকাদার চাচা ফিরে এসে বললেন লোক পাঠানো হয়েছে। যে যেখান থেকে যত শুঁটকি পায় নিয়ে আসবে। আমাদেরকে তিনি কিছু খেয়ে নিতে বললেন। আমরা না করলাম। হুজুরকে কিছু টাকা দিলেন খাওয়ার জন্য। হুজুর আমাদেরকে ডাকল। আমরা গিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলাম। চা বিস্কুট ছাড়া কিছু নেই। হুজুর দোকানিকে টাকা দিয়ে ডিম আনালো দুই হালি। সেদ্ধ করালো। ...লবণ দিয়ে আমরা যখন ডিম খাচ্ছি তখনই দেখলাম একেক দিক থেকে একেকজন ব্যাগে কিংবা পোঁটলায় করে শুঁটকি নিয়ে এসে হাজির হচ্ছে। একটা ভ্যানও দেখতে পেলাম গাড়ির কাছে। ঠিকাদার চাচা এগিয়ে এলেন- শুঁটকি আনা হয়েছে। যদিও কাঁচা শুঁটকি তেমন পাওয়া যায়নি। তবু মনে হয় হয়ে যাবে

লাশ নামানোর জন্য যখন এগোলাম তখন আমরাই হাঁটতে পারছিলাম না লোকজনের ভিড়ে। কিন্তু গাড়ির পেছনের ডালা খোলার সাথে সাথে ভিড় পাতলা হয়ে গেলো। হুজুর বলল- দুয়েকজন ভেতরে যান গো ভাইজানরা। মুর্দাকে তুলে নামাতে হবে। ...কেউ এল না। ঠিকাদার চাচা একে তাকে ডাকাডাকি শুরু করলেন। কিন্তু তখন লোকজন সরতে শুরু করেছে গন্ধে। বকুল লাফিয়ে উঠল গাড়ির ভেতর। নয়নের মাথার দিকে ধরে ডাক দিলো- অনন্ত...

আমি ধরলাম নয়নের পেট। গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে লাশের পায়ের দিকে ধরল হুজুর। তিনজনে নামিয়ে আনলাম নয়নকে। ভ্যানের কাছে এসে দেখি ভ্যানওয়ালাও নেই। হোগলার চাটিতে প্যাঁচানো নয়নকে নামিয়ে রাখলাম রিকশা ভ্যানের উপর। লোকজন দূরে নাক চেপে দাঁড়িয়ে দেখছে। ঠিকাদার চাচা এগিয়ে এসে কয়েকটা শুঁটকির পুঁটুলি তুলে দিলেন আমাদের হাতে। হুজুর শুঁটকিগুলো খুলে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিলো নয়নের উপর- যা বাবা বডি বিল্ডার কৃষ্ণঠাকুর। বেঁচে থাকতে ডেটিংয়ের আগে গতরে মাখতি সুগন্ধি। আর শেষ ডেটিংয়ে মাখলি শুঁটকি

শুঁটকি মাখাতে মাখাতে হুজুর ভ্যানওয়ালার খোঁজ করল। সারা নাকমুখ গামছায় মুড়ে এসে দাঁড়াল ভ্যানওয়ালা। হুজুর তার কাছে দড়ি চাইল। দড়ি নেই। আবার ঠিকাদার চাচা কাউকে পাঠালেন দড়ি আনতে। হুজুর বলল- পানি আনতে। শুঁটকির উপর পানি ছিটিয়ে দিলে গন্ধ বেরোবে

দুই পাশে দুটো বাঁশসহ আমরা নয়নকে বাঁধলাম ভ্যানের সাথে। তার উপরে এখন ছোট-বড়ো শুঁটকি মাছ। হুজুরই ভ্যান টানা শুরু করল। খালের সামনে একটা নৌকা দাঁড় করানো ছিল। হুজুর কয়েকজনকে খালের অন্য পাড়ে পাঠাল সাঁকো দিয়ে। তারপর ডাক দিলো- তিনজনে হবে না। লোক লাগবে আরো। ভ্যান তুলে নৌকায় নামাতে হবে

আমরা তিনজন। ভ্যানওয়ালা। ঠিকাদার চাচা। আরো দুজন। এর বেশি পাওয়া গেলো না। এই সাতজনে মিলে ভ্যানটাকে নামালাম নৌকায়। হুজুর উঠে এল। আমরা দুজন ছাড়া বাকিরাও নেমে এল নৌকা থেকে। উঠে ওরা পাড়ে দাঁড়িয়েছিল। হুজুর তাদেরকে তাড়িয়ে সাঁকো দিয়ে অন্য পাড়ে পাঠাল। নৌকা ছাড়লে মাঝি ছাড়া নৌকায় নয়নের সাথে থাকলাম আমি আর বকুল

হুজুর আগেই পৌঁছে গেছে অন্য পাড়ে। একই কায়দায় তোলা হলো ভ্যান। টেনে একটু দূরে নিয়ে রাখা হলো। হুজুর ঠিকাদার চাচার সাথে লেনদেন শেষ করে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আঙুল তুলে দেখাল- ওই দেখো
দেখলাম আরো অনেকের সাথে মেয়েটাও হাঁটতে শুরু করেছে গ্রামের রাস্তা দিয়ে। হুজুর বলল- যাও। ওই জিন্দা মাইয়াটারে দেখে দেখে বন্ধুরে ডেটিংয়ের ঠিকানায় পৌঁছাইয়া দিয়া আসো। পকেট থেকে চারটা স্টিক বাড়িয়ে দিয়ে ঠেলে ভ্যানটা চালু করে সাঁকোর দিকে এগিয়ে গেলো হুজুর। কড়া দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে আমরা চলতে শুরু করলাম নয়নের সাথে

এর আগে বোধ হয় এ রাস্তায় কোনো ভ্যান বা রিকশা যায়নি। মূলত ফসল কাটা জমি। মাঝেমাঝে পায়ে হাঁটা রাস্তা। সম্ভবত বর্ষায় পুরোটাই পানির নিচে থাকে বলে এখানকার লোকজন রাস্তার কথা ভাবে না। কিংবা রাস্তা দিয়ে ভ্যান বা রিকশা চলার কোনো দরকার নেই বলে ব্যবস্থা করার কথাও ভাবেনি তারা। সবাই-ই আগে আগে। আমি আর বকুল ভ্যানের পেছনে। ঠেলছি এবং ধরে আছি। ঠিকাদার চাচা কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন আমাদের পাশাপাশি হাঁটার। তারপর
- তোমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো ভাতিজারা? বলে আমাদের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকালেন। আমরা কোনো উত্তর দিলাম না। তিনি সামনে হাঁটা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে- আমি একটু দেখি ভাইজান কী করছেন। বলে প্রায় দৌড়ে চলে গেলেন নয়নের বাবা আর সবাই যেখানে হাঁটছেন সেখানে

বকুল এর মধ্যে সবার সামনেই একটা স্টিক ধরিয়েছে। নয়নের গন্ধ- স্টিক আর শুঁটকি। এক অদ্ভুত আবেশ। আমার নিজেকে কেমন নির্লিপ্ত মনে হলো। কোনো গন্ধই আর আলাদাভাবে আমার নাকে আসছে না

ভ্যানওয়ালা মাঝেমাঝেই থেমে গামছা ফাঁক করে ওয়াক করে থুতু ফেলছে আর ঘেন্নায় তাকাচ্ছে আমার আর বকুলের দিকে- হুনছি টাউনে লাশেরে মজবুত কইরা বাইন্ধা দেওনের কী একটা কায়দা আছে। আপনেরা সেইটা করতে পারলেন না?
- গাঁজা খাবেন?
- নাউজুবিল্লাহ

ভ্যানওয়ালা আরেকবার থুতু ফেলল- পোলাপানগো টাউনে পাঠানের কামটাই বা কী? পড়ালেখা করব। পড়ালেখা যে কয়জন করে তাতো জানাই আছে। বেশিরভাগই টাউনে যাইয়া শিখে গু-মুত খাওন আর মাইয়াগো পিছে দৌড়ান। এর লাইগাই এইগুলান অয়। বুড়া বাপের কান্ধে লাশ অইয়া আবার ফিরতে অয় গ্রামে। ...ক্যান টাউনে কোনো মাইয়ার বাপ কবরের জায়গা দিলো না?
- ও মেয়েদের জন্য মরেনি
- জানা আছে। কী জন্য মরছে তা কি আর কেউ কয়? শরমের কথা। কইলে ময়-মুরব্বিগরই বেইজ্জতি
- যা সত্য না তা বলবেন কেন?
- হুনেন মিয়া। বেশি কতা কইয়েন না। উল্টাপাল্টা কিছু কইরা না মরলে ওরে কাটাছিরা করব ক্যান? দেশে কি মানুষ কম মরে? কই তাগোতো আর এমুন কইরা কাটে না? ...এমুন করলে অইব না। জোরে ঠেলা দেন। শইলে শক্তি থাকব কেমনে? খানতো মদ-গাঞ্জা আর গু-মুত

ভ্যানের চাকা একটা গর্তে ঢুকে গেছে। এরজন্য ভ্যানওয়ালা আমাদেরকে নাকি নয়নের শহরে যাওয়াকে দায়ী করছে বোঝা না গেলেও তার সমস্ত রাগ যে এখন আমাদের উপর তা বোঝাই যাচ্ছে। দুজনে ভ্যানের পেছন দিকটা শূন্যে তুলে গর্তটা পার করলাম। বকুল আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আমি তাকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভ্যান আবার একটু স্মোথ জায়গায় পড়তেই বকুল ফুসে উঠল - লাশ টানতে পারবেন না বললেই হতো। এখন মুর্দার সামনে এমন বকবক করেন কেন?
- এ্যাঁ লাশ। এরে লাশ কয়? লাশ অইলে পোলার বাপÑআত্মীয়কুটুম এমুন দূরে দূরে হাঁটতো না... আপনেরা কারা?
- মানে?
- আপনেরা লাশের কী হন?
- বন্ধু
- ইশ্রে। দোস্ত। কুসঙ্গ দিয়া দোস্তরেতো শুঁটকির নিচে ঢুকাইছেন। আবার এখন কোন মতলবে অতদূর আইলেন?
- মতলব আবার কিসের?
- টাউনে থাকেন বইলা নিজেরে অত বুদ্ধিমান মনে কইরেন না। অবশ্যই কোনো মতলব আছে। নাইলে এই কষ্ট করার ঠেকা পড়ছে ক্যান?

বকুলকে বললাম রেস্ট নিতে। আমি একাই ঠেলব। বকুল একটু পেছনে স্টিক ধরিয়ে হাঁটতে থাকল। আমি ঠেলছি। একটা জমির আল পার হতে গিয়ে ভ্যানটা কাৎ হয়ে গেলো। আমি ঝট করে ভ্যান ছেড়ে ঠেলে ধরলাম নয়নকে। কিন্তু... কিন্তু... হোগলা পাতার চাটাই ভেদ করে আমার আঙুলগুলো ঢুকে পড়ল নয়নের দেড়-দুই ইঞ্চি ভেতরে। অন্য হাত দিলাম। সেটিও। ভ্যান কাৎ হয়ে আছে। আমি ঠেলে ধরে আছি ভ্যানেবাঁধা নয়নকে। থিকথিক করছে নয়নের শরীর। আমার আঙুল ডেবে যাচ্ছে আরো। চেষ্টা করছি ঠেলে তোলার। কিন্তু আমার হাত বেয়ে নেমে আসতে শুরু করেছে ঘন পচা চর্বির স্রোত। কনুই পর্যন্ত পচা চর্বি আসতেই চিৎকার করে বকুলকে ডাকলাম। বকুল দৌড়ে এসে নয়নকে ধরল। দেখলাম হোগলার চাটাই ভেঙে ওরও দশটি আঙুল ঢুকে গেলো নয়নের ভেতর। বললাম- ভ্যানে ধর। ভ্যানে ধর। বকুল ভ্যান ধরে ঠেলা দিলো। আমি নয়নকে। ভ্যান আবার উঠে চলা শুরু করল। দেখলাম নয়নের চর্বি থিক থিক করে আমার কনুই পর্যন্ত চলে গেছে। কেমন যেন চুলকাচ্ছে। বকুলের অবস্থাও এক। তার হাতে চামড়ার বেল্টের ঘড়ি ছিল। ঘড়ি খুলল। ঘড়ির বেল্টে নয়নের চর্বি। বকুল ঘড়ির বেল্টটা মাটিতে ঘষে শুকিয়ে আবার পরল। আমি কিছু খড় নিয়ে হাত মুছলাম। কিন্তু হাতে দাগ লেগেই থাকল নয়নের গলা চর্বির
- শালা অত ব্যায়াম করলি তাও তেল কমলো না? একেবারে মালের মতো বেরোচ্ছে

লাশটা ফুলে হোগলার চাটাইয়ের সাথে একেবারে খাপেখাপ হয়ে গেছে। আরো দুয়েকবার আমাদের আঙুল ঢুকে গেছে নয়নের ভেতর। ঠিকাদার চাচা কিংবা অন্য কেউ আমাদের কাছে আসেনি। পাশ কেটে যারা গেছে তারা জমির মধ্যে নেমে দূরে দূরে হেঁটে চলে গেছে

বেশ দূর থেকে বাড়িটা দেখা যায়। দেখেই চিনলাম। নয়নের বিয়েতে এ বাড়িতে আমাদের সবার আসার কথা ছিল। চারপাশে ধানক্ষেতের মাঝখানে গোল করে একটা উঁচু জমি। জমির চারপাশে গাছ আর বাঁশ। উঠানের চারপাশ ঘিরে নয়নের সাত বাপ-চাচার ঘর। একপাশে
রাস্তা। পেছনে পুকুর। বাড়িটা নয়নের বর্ণনার সাথে একেবারে মিলে যায়। রাস্তাটি সোজা উঠে গেছে বাড়ির উঠানে। আমরা যখন বেশ দূরে তখন পুরো উঠানেই ছিল অসংখ্য লোক। আমরা যত এগোতে থাকলাম লোক তত দূরে সরে যেতে থাকল। অবশেষে যখন পৌঁছালাম বাড়ির ভেতর; ভ্যানওয়ালাও ওয়াক করে থুতু ফেলে দাঁড়িয়ে থাকল পাশে

উঠানে একটা খাটিয়া ছিল আগে থেকেই। ভ্যানওয়ালা আর আমরা নয়নকে নামিয়ে রাখলাম খাটিয়ায়। ঠিকাদার চাচা জানালেন লাশের গোসল হবে বাড়ির বাইরের জমিতে। কিন্তু খাটিয়া ধরার জন্য অন্তত চারজন মানুষতো লাগে। তিনি নিজে দিলেন একটা কাঁধ। ভ্যানওয়ালাকে লাগালেন সওয়াবের কথা বলে। আমি আর বকুলকে বললেন না কিছুই

বেশ দূরে জমিতে খাটিয়া রেখে আমি আর বকুল হাঁটতে শুরু করলাম বাড়ির দিকে। বাড়ির লোকজন আমাদের দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না কেউ। ভেতর বাড়িতে কান্না। সব ঘরেই মানুষের আসা যাওয়া। আমরা নয়নের বর্ণনা মনে করে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেলাম হাঁটতে হাঁটতে। পুকুর পাড়ে। বকুলকে বললাম- স্টিক আছে?
বকুল পকেট থেকে বের করে দিলো- একটাই। ধরা

পড়ন্ত বিকেলে শেষ স্টিকটা শেষ করলাম দুজন। পুকুর ঘাটে এই পর্যন্ত আর কাউকে আসতে দেখলাম না। বকুল উঠে গেলো। পুকুর পাড়ে শুকানোর জন্য একটা লুঙ্গি- দুটো শাড়ি- দুটো শার্ট আর কয়েকটা পেটিকোট ব্লাউজ ছিল। বকুল লুঙ্গি আর একটা শাড়ি নিয়ে এল। শাড়িটা আমাকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল- এটা পরে গোসল করে ফেল। নিজে লুঙ্গিটা পরে নেমে গেলো পুকুরে। আমিও শাড়িটাকে লুঙ্গির মতো করে পেঁচিয়ে নেমে গেলাম। সাঁতার কাটলাম। বকুল তার ঘড়ি খুলল। নাকের কাছে আনল। গন্ধে নাক সরিয়ে নিল আবার- দোস্ত। তোর বিয়েতে আসলেতো কিছু না কিছু দিতেই হতো। যা এটাই আজ তোকে গিফট করলাম

ঘড়িটা পুকুরের মাঝখানে ছুঁড়ে ফেলল বকুল

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গেছে। গোসল করে আমরা আর বাড়ির দিকে গেলাম না। কারো কথাই ভাবলাম না। থেকে থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম একটা নারীকণ্ঠের কান্না। এই কণ্ঠ সেই নারীর। লাশ নিয়ে বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে যে নারী সবাইকে ডিঙিয়ে আছড়ে পড়েছিল নয়নের উপর। একমাত্র যে মানুষটি নয়নের শরীরে কোনো গন্ধ পায়নি আজ। তিনি নয়নের মা

আমি আর বকুল হাঁটতে থাকলাম শহরে ফিরে যাবার রাস্তায়
২০০৫.০৬.২১


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মাহবুব লীলেন
+৮৮ ০১৭১১৩১৮৩০৩

আরিফ জেবতিক এর ছবি

সাধারনত: ইন্টারনেটে এতো দীর্ঘ লেখা পড়তে পারি না।কিন্তু এটা বেশ তারিয়ে তারিয়েই পড়লাম।
এটাকে উপন্যাস করে ফেলা যায় বোধ হয়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মাহবুব লীলেন
+৮৮ ০১৭১১৩১৮৩০৩

উপন্যাস লিখছি
৯০ এর ছাত্র আন্দোলনের পটভূমিতে

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

চমৎকার লাগল ....মুগ্ধ হবার মতো বর্ণনা
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

খুব ভালো লাগলো।
একটা প্রশ্ন: প্রতি প্যারার শেষ বাক্যের শেষে কোনো যতিচিহ্ন নেই কেনো?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মাহবুব লীলেন
+৮৮ ০১৭১১৩১৮৩০৩

কথার শেষে দাঁড়িটা হলো সন্তুষ্টির প্রতীক
আমার মনে হয় আমাদের কোনো কথাই যেন শেষ হয় না
অথবা বাকি থেকে যায়
একেবারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মতো
অন্তত আমার

বাড়িতে গেলে মনে হয় যেন কোথাও যাবার কথা
আবার কোথাও গেলে মনে হয় উঠে যাবার কথা
উঠে গেলে মনে হয় কেন উঠে এলাম

মনে হয় অনেক কিছু কিংবা সব কিছুরই যেন শুধু শুরু হয়। শেষ হয় না

এই কারণেই আমার কোনো লেখার প্যারার শেষে মনে হয় যেন দাঁড়ি হবে না। ফাঁকা থাকাই ভালো

আর কবিতার কোনো লাইনের শেষেই আমি দাঁড়ি ব্যবহার করি না। একই কারণে

আর কমা (,) এই বস্তুটাকে জীবনেও ব্যবহার করি না আমি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ইন্টারেস্টিং!

নিঘাত তিথি এর ছবি

ভালো লেগেছে।
শিমুলের প্রশ্নটা আমারও, প্রতি প্যারার শেষে দাঁড়ি-কমা নেই, এটা কি ইচ্ছা করেই?

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

সৌরভ এর ছবি

"নিম নাখারা" পুরোটা পড়তে ইচ্ছে করছে।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মাহবুব লীলেন
+৮৮ ০১৭১১৩১৮৩০৩

নিম নাখারায় মোট সাতটি গল্প আছে
আজ আরেকটি দেবো
আশা করছি সবগুলোই দিয়ে দেবো
যদি না ওয়েবের কর্তারা বিরক্ত হয়ে ফেলে না দেন
আর পুরো বই কী করে দিতে হয় এখনও বুঝে উঠতে পারিনি

দ্রোহী এর ছবি

সেইরকম গল্প। পুরোটা পড়লাম - একটানে।

"সৌরভ" এর মতো করে বলতে হচ্ছে। "নিম নাখারা" পুরোটা পড়তে ইচ্ছা করছে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

হাসান মোরশেদ এর ছবি

মনে হলো যেন অনেকদিন পর সন্দ্বীপন'কে পড়লাম ।
না গল্প সন্দ্বীপনের নয়, মাহবুব লীলেনরই । মাহবুব লীলেন এর লেখার সাথে পরিচিত অবশ্য সন্দ্বীপনকে চেনার আগেই ।
গল্পের বই ও হয়ে গেলো । জানতাম না । বৈদেশ,কতো কিছু কেড়ে নিলো ।

-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মাহবুব লীলেন
+৮৮ ০১৭১১৩১৮৩০৩

(আমার প্রথম কবিতার বই ‌‌'কবন্ধ জিরাফ'এর একটা কবিতা আছে ‌অভিবাসন' নামে
কবিতাটা আমি শুধু লিখিনি। বিশ্বাসও করি
আর সেই বিশ্বাস নিয়েই আছি)

ক্ষয়ের ভাঙনে যায় কেউ; কেউ যায় জীবনের টানে
যাওয়া ও না যাওয়ার মাঝখানে যায় কেউ বিব্রত হয়ে

যারা যায় যেভাবেই যাক বড়ো সত্যভাবে তারা যায়
যারা যায় যতই পেছনে ফিরুক বড়ো নির্মমভাবে আর ফেরে না তারা
যারা যায় যতই জ্বলুক বড়ো তাড়াতাড়ি পরবাসী হয়ে যায় তারা

পুরনো ভিটায় মানুষ বেড়াতে আসে; আসে অবসরে
পুরনো ভিটায় আর কেউ তোলে না নতুন বসত

স্বপ্নের টানে কেউ ঘর ছেড়ে যায়; স্বপ্নের টানেই কেউ দুঃস্বপ্নে খুলে বসে
ঘর-সংসার

তাপস শর্মা এর ছবি

'বৈরাত' গল্পটা পড়া হয়েছিল 'নিম নাখারার' বই-এ।

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টানা জেরবার হয়ে যাই। চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।