• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

ভূমিলক্ষ্মী

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বুধ, ১০/১০/২০০৭ - ১:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাগলের সাথে সংসার করা যায়। কিন্তু ভূতে-ধরা মানুষের সাথে সংসার করা কঠিন। না হলে সায়বান বিবির স্বামী নয় বিঘা ধানি জমি আর তিন বিঘার বাড়িসহ ঘরজামাইগিরি ছেড়ে তালাকের পথ বেছে নিত না। একমাত্র ছেলে মোস্তফা আর বৌ নিয়ে শ্বশুরের জমি নেড়েচেড়ে তার দিন কোনোভাবেই খারাপ যাচ্ছিল না। তাছাড়া সায়বান বৌ হিসেবে একেবারেই আলাদা। বলতে গেলে বলতে হয় আরামের বৌ। তার কোনো চাহিদা নেই। আব্দার নেই। তার বাপের জমির ফসল থেকে আসা টাকা কিংবা বাড়ির আয়-ইনকাম স্বামী কোথায় খরচ করছে। বিড়ি টানছে কি জুয়া খেলছে সে বিষয়ে তার কোনো মাথা ব্যথাই নেই। বিয়ের অত বছরের মাঝে সায়বান বিবি স্বামী নিজামউদ্দিনকে কোথাও নিয়ে যেতেও বলেনি। নিজামউদ্দিনও বলেনি কোথাও যাবার কথা। কে আর নিজে থেকে ঝামেলায় জড়াতে চায়। বউ নিয়ে বেড়াতে যাবার চেয়ে নিজের মতো করে যাত্রা-টাত্রা দেখে কিংবা মাসে থানা সদরে গিয়ে দুয়েকটা বই দেখে ইয়ার বন্ধুদের সাথে দিন কাটানো ঢের ভালো। বন্ধু বান্ধবরা যখন নিজেদের সংসার আর বৌয়ের ঘ্যানঘ্যানানির কথা বলত তখন নিজামউদ্দিনের বরাবরই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হতো। কিন্তু ঝামেলাটা শুরু হলো শ্বশুর মরার পর থেকে। যদিও সে ঘরজামাই। কিন্তু তাকে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে এক বাড়িতে থাকতে হয়নি কোনোদিনই। শাশুড়ি মরেছে অনেক আগেই। আর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে; জামাইকে জায়গাজমি বুঝিয়ে দিয়ে আত্মীয় স্বজনের কাছে বিদায় নিয়ে শ্বশুর রহমত আলী চলে গেছে বর্ডার পার হয়ে তার বাবার ভিটায়। তার শেষ ইচ্ছে ছিল বাপ-দাদার ভিটেতে গিয়ে মরা। তার বাপ মরতে পারেনি বাপের ভিটাতে। তাই একমাত্র ছেলেকে বলেছিল পারলে যেন বাপের ভিটাতে গিয়ে মরে। এটা পরবাস। কোথায় কোন দিল্লিতে বসে কারা একটা আইন বানাল আর সাথে সাথে মানুষকে ভিটে মাটি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে হলো বৌ-বাচ্চা নিয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য। রহমত আলীর বাবা এ বিষয়টা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু ছেলে রহমত আলী আর অতি সুন্দরী বৌ চান বানুর কথা চিন্তা করে তাকে ভিটে ছেড়ে চলে আসতে হলো এ পারে। সে নিজের প্রাণের ভয়ের চেয়েও ভয় পেয়েছিল যদি কেউ এই সুযোগে চান বানুর কোনো অসম্মান করে। তাই সে দেশ বিভাগের শুরুতেই চলে এসেছিল। যদিও সে ওটাকে দেশ বিভাগ বলত না। বলত উচ্ছেদের বছর

রহমত আলীর বাবা চলে এলেও তার ছোট ভাই রয়ে গিয়েছিল মাটি কামড়ে। সে তখনও বিয়ে করেনি। তাই উচ্ছেদের সময় দেশও ছাড়েনি। প্রথম কয়েকদিন আশেপাশে পালিয়ে থেকেছিল। পরে আস্তে আস্তে আবার বাড়ি ঘরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। রহমত আলীর বাবাও ভেবেছিল সব ঠিকঠাক হলে আবার নিজের দেশে ফিরে যাবে। কত কাল আর থাকা যায় বিদেশ মাটিতে। কিন্তু এক সময় দেখল ফেরাটা কঠিন। এমন ভাবে তারা আইন বানিয়েছে যে এখন নিজের দেশে যেতে হলেও পাসপোর্ট-ভিসা লাগে। তখন এখানে সে ছেলে রহমত আলীর জন্য কিছু জায়গা জমি আর ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করার দিকে মন দিলো। কিন্তু মনে মনে ইচ্ছে রইল বাপের ভিটেতে গিয়ে মরার। কেননা স্থানে মান আর অস্থানে অপমান। এই কথাটা সে জেনে এসেছে পরিবারের ইতিহাস থেকে। কিন্তু হঠাৎ করেই সে বড়ো বেশি কাহিল হয়ে পড়ল। স্বাভাবিক হাঁটাচলা করাও কঠিন হয়ে পড়ল তার। তখন কেউই আর তাকে বনে বনে চোরা পথে বর্ডার পাড়ি দেবার বিষয়ে সায় দিলো না। বলল ভালো হলে যাওয়া যাবে। কিন্তু আর ভালো হলো না রহমত আলীর বাবা। নিজের ভিটেতে যাওয়াও হলো না। যেতে হলো ভিনদেশের কবরে। কিন্তু যাবার আগে ছেলে রহমত আলীকে বলে গেলো যেন শেষ সময়টাতে অন্তত দেশে গিয়ে মরে। ওখানে এখনো তাদের জায়গা সম্পত্তি আছে। ভাইয়ের ছেলেরা ভোগ করছে। তারা ফেলে দেবে না। তাছাড়া একটা কবরের জায়গা ছেড়ে দিতে কারো আপত্তিও থাকার কথা না

বাপ মারা যাবার পর রহমত আলী উঠে পড়ে লাগে মেয়ে বিয়ে দেবার জন্য। অবশ্য তারও আগে সে চেষ্টা করেছে মেয়েকে বোঝাতে যে এই দেশটা আমাদের দেশ না। আমরা উচ্ছেদের বছর এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। চল আমরা দেশে যাই। কিন্তু মেয়ে সায়বান রাজি হয়নি। সে বলত নিজের দেশ হলে তা তোমার নিজের দেশ। আমার জন্ম এখানে। আমি কেন ইন্ডিয়া যাব? কথাটায় যুক্তি যে নেই তা নয়। আসোলে তারও ওই দেশটাকে অতদিন নিজের দেশ মনে হয়নি। মা-বাবার হাত ধরে সেই কোন কালে দেশ ছেড়েছে পুরোপুরি মনেও নেই। কিন্তু শেষ কয়টা দিন বাবা এমনভাবে সবকিছু বর্ণনা করেছে; এখন মনে হয় বাবা নয়; সে নিজেই যেন ধানক্ষেতে পাকা ধান রেখে আর গোয়ালে বাঁধা গরুর গলা থেকে দড়ি খুলে দিয়ে ভোররাতে পালিয়ে এসেছে এখানে। শেষদিকে বাবা প্রায়ই আবোলতাবোল বকত। প্রায়ই বলত দুধেল গাইটা বড়ো বেশি বেয়াদব। পাকা ধান দেখলে আশপাশে আর কিছুই দেখে না। সোজা গিয়ে ধানক্ষেতে নেমে পড়ে। যেন তার জন্যই ধানগুলো পেকেছে। বাবা আফসোস করত- দুধেল গাইটাও ছেড়ে দিয়ে আসলাম। সকাল হবার আগেইতো ক্ষেতের অর্ধেক শেষ করে দেবে। ছেলেকে নাম ধরে বলত- তুই গিয়ে প্রথমেই দুধেল গাইটাকে গোয়ালে তুলবি। না হলে ধানগুলো সব নষ্ট হয়ে যাবে

চল্লিশ বছর আগে ছেড়ে আসা গাই নিয়ে এখনো ভাবে তার বাপ। চল্লিশ বছর আগে রেখে আসা পাকা ধান এখনো গোয়ালে তোলার কথা ভাবে তার বাপ। রহমত আলীর প্রথম প্রথম হাসি পেত। কিন্তু বাপ মরে যাবার পরে সে প্রায়ই স্বপ্নে দেখত সেই ধানক্ষেত। সেই বেয়াদব দুধেল গাই। মাঝেমাঝে দিনের বেলায়ও খেই হারিয়ে ফেলত সে। মনে হতো যেন তার ভেতরে তার বাবার আত্মা ভর করেছে। আর তখন থেকেই সে তার নিজের দেশে ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু মেয়ে রাজি না। মেয়ে বলে ওটা ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়াতো আমার জন্য বিদেশ। আমি কেন যাব

কথাটা সত্য। রহমত আলী পাত্র খুঁজতে শুরু করে। বলা যায় না দেরি করলে বাবার মতো সেও না আবার চলা ফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তার চেয়ে মেয়ের একটা ব্যবস্থা করে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় চলে যাওয়াই ভালো। পাত্র পাওয়াও গেলো। পাত্র জোগাড়ের পর তার কাজ হলো দুটো। এক- কিছু জমি বিক্রি করে নিজের দেশে গিয়ে বাকি কয়টা দিন থাকার ব্যবস্থা করা। আর দুই- বাকি জমিজমাগুলো মেয়ের নামে লিখে দেওয়া। এখানে সে কোনো পিছুটান কিংবা দায়িত্ব রেখে যেতে চায় না। মেয়ের বিয়ের টাকা তার আলাদা করে জমানোই ছিল

সবকিছু হয়ে গেলো খুব অল্প সময়েই। বিয়ের পর নয় দিন রহমত আলী ঘুরে বেড়াল আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বাড়ি। বিদায় নিল। তারপর মেয়ের বাড়িতে একবেলা ভাত খেয়ে রওয়ানা দিলো নিজের দেশের উদ্দেশ্যে

চিঠি লিখত রহমত আলী। মাসে দুমাসে তার চিঠি আসত। সায়বান বিবিও লিখত বাবাকে। মাঝেমাঝে সায়বান বিবির চিঠির ভেতর নিজামউদ্দিনও শ্বশুরের জন্য আলাদা একটা চিরকুট লিখে ভরে দিত। তেমন কিছু না- আমরা আল্লার রহমতে আর আপনাদিগের দোয়ায় ভালো আছি। আমাদিগের জন্য চিন্তা করিবেন না। শরিলের দিকে নজর রাখিওন। মুরব্বিগণকে সালাম আর ছোটদিগকে আদর দিওইন

রহমত আলী চলে যাবার কিংবা দেশে যাবার পর বেঁচেছিল এগারো বছর। ওখানে সে একটা চায়ের দোকান দিয়েছিল। বলেছে তার গ্রামে এখন মানুষ চা কিনে খায়। বেশ বড়ো একটা বাজারও হয়ে গেছে। সে তার বাপের ভিটাতে একটা ঘর তুলে থাকে আর বিকেলে বাজারে চা বিক্রি করে। একা মানুষ। বেশ চলে যায়

এই এগারো বছরে সায়বান বিবির ছেলে মোস্তফার বয়স হয়ে গেছে দশ বছর। প্রাইমারি ইস্কুল ছাড়ি ছাড়ি করছে। স্বামী নিজামউদ্দিনও কাটাচ্ছে নিশ্চিন্ত জীবন। এর মাঝে বৌ আর সংসার নিয়ে সে অন্য সবার থেকে ভালোই ছিল। কিন্তু যেই শ্বশুর মরার খবর এল তখন থেকেই সায়বান বিবির মাথাটা বিগড়াতে শুরু করল। অবশ্য প্রথম প্রথম এটাকে নিজামউদ্দিনের কাছে খারাপতো নয়ই বরং ভালো লক্ষ্মণ বলেই মনে হয়েছে। শ্বশুর মরার খবর আসার পরপরই একদিন সায়বান বিবি তাকে বলল তার বাপ নাকি একবার লিখেছে যে সে তার বাবার বর্ণনা অনুযায়ী গ্রামে কিংবা বাড়িতে একটা জিনিসেরও মিল পায়নি। গ্রামের কাঁচা রাস্তা এখন পাকা হয়ে গেছে। সেই গরু আর ধান ক্ষেতেরও কোনো হদিস নেই। ধানক্ষেতে অনেকগুলো কাঁচা ঘর তুলে তার ওয়ারিশানরা ঘরভাড়া দিয়েছে। গ্রামের পাশেই একটা কারখানা হওয়াতে অনেকেই এখন ভাড়া ঘরে থাকে। ধানক্ষেতে ধান চাষের চেয়ে ঘরভাড়া দেয়া লাভজনক। বাপের বর্ণনার কোনো কিছুতে মিল না পেলেও সে নিজের একমাত্র স্মৃতিকে পেয়েছে অত বছর পরেও। বাড়ি থেকে রাস্তায় ওঠার মুখে যে বটগাছটা ছিল। সেটা অবিকল আছে আগের জায়গায়। একটু শুধু বড়ো আর বুড়ো হয়েছে। সেই বটগাছের লতায় ঝোলার স্মৃতিটাই তার ফেলে আসা ভিটের একমাত্র স্মৃতি; যেটা অত বছর পরও সে মনে করতে পারে। এ থেকেই তার মনে হয়েছে যে একমাত্র গাছই শুধু অবিকল থাকে পুরোনো মানুষকে ভিটে চিনিয়ে দিতে। মানুষ সব ভুলে গেলেও গাছের স্মৃতি ভোলে না। তাই সে ওখানে চা দোকান দেবার সাথে সাথে সারাদিন গাছ লাগায়। কী গাছ। কার মাটিতে লাগাচ্ছে। কে ফসল খাবে সেটা কোনো কথা নয়। কথা হলো গাছ লাগানো আর গাছকে বড়ো হতে দেয়া। ...সে নিজের টাকায় বীজ কিনে চারা করে রাস্তার পাশে কিংবা মানুষের বাড়িতে লাগিয়ে দিয়ে আসে। মেয়েকেও সে বলেছে বাড়িতে গাছ লাগাতে। যদি এখান থেকেও তাকে কোনো দিন উচ্ছেদ হতে হয় তাহলে ফিরে এসে গাছ দেখেই সে চিনতে পারবে তার ভিটে

কথাটা নাকি অনেকদিন আগে লিখেছিল রহমত আলী। সায়বান বিবির তখন এটাকে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে মনে হয়নি। কিন্তু যখন রহমত আলী মরার খবর এল। সায়বান বিবি একটুও কাঁদল না। সে গিয়ে খুলে বসল বাবার চিঠির বান্ডিল। নিজামউদ্দিন একটু অবাক হলেও ভাবল বউ হয়ত বাবার শোক ভুলতে চাইছে তার চিঠিগুলো বারবার পড়ে। থাকুক সে তার মতো। একেকজনের তো শোক প্রকাশের ধরন একেক রকম হতেই পারে। সে নিজে থেকেই শ্বশুরের আত্মার শান্তির জন্য মৌলবি ডেকে মিলাদ পড়াল। মিলাদের রাতেই সায়বান বিবি স্বামীর কাছে জীবনের প্রথম আব্দার করল। বলল তাকে কিছু গাছের চারা এনে দিতে হবে। বাড়িতে গাছ লাগাবে। নিজামউদ্দিন মনে মনে খুশিই হলো। জীবনে এই প্রথম বৌ তার কাছে আব্দার করল। খারাপ কী। সে পরের দিনই অনেকগুলো ফসলি গাছের চারা এনে দেয়। বাড়িতে এমনিতেই অনেক গাছ ছিল। তার পরও সায়বান বিবি নিজের হাতে লাগাল বাড়ির চারপাশে। তিন বিঘা বাড়ি। অনেক জায়গা। সায়বান বিবি আরো চারা চাইল। নিজামউদ্দিনও এনে দিলো। সায়বান বিবি ছেলে মোস্তফাকেও বলে দিলো যেখানে যত চারা পায় যেন নিয়ে আসে। মোস্তফাও মায়ের সাথে বেশ উৎসাহে গাছের চারা আনা আর লাগানোতে মনোযোগ দিলো। নিজামউদ্দিন তাতেও আলাদা কিছু ভাবল না। ভাবল বাপের শোক ভুলতে সায়বান বিবি গাছের চারা লাগাচ্ছে। লাগাক না। গাছ বড়ো হলে তো ক্ষতি নেই। পয়সাও আসবে

যে সায়বান বিবি নিজের জন্য কোনোদিন কিছু চায়নি সে এখন নিয়মিত গাছের চারার আব্দার শুরু করল। নিজামউদ্দিন একটু আপত্তি করল। চারা কিনতেতো পয়সা লাগে। তাছাড়া কয়েকশো চারা এর মধ্যে লাগানো হয়ে গেছে। এগুলো বড়ো হলেই পুরো বাড়ি জঙ্গল হয়ে যাবে। সায়বান আর কিছু বলল না নিজামউদ্দিনের আপত্তির মাথায়। কিন্তু পরের দিন থেকে সে ছেলেকে নিয়ে গ্রামে বের হয়ে গেলো। যার বাড়িতে যে গাছের চারা পাওয়া যায় তাই নিয়ে আসতে শুরু করল বোঝা করে। ফসলি- অফসলি- জংলি কোনো বাছ বিচার নেই। গাছের চারা আনা- লাগানো আর তাতে পানি দেয়া; এই হয়ে পড়ল সায়বান বিবির নিত্য রুটিন

গাছগুলো বড়ো হতে শুরু করল। কিন্তু সায়বান বিবির আর চারা লাগানো শেষ হয় না। তিন বিঘা বাড়ির পুরোটা জুড়ে সে চারা লাগাতে শুরু করল। তাতেও অসুবিধা নেই। কিন্তু সঙ্গে সে আরেক কাণ্ড শুরু করে দিলো। সে নিজামউদ্দিনকে আর কোনো আগাছাও কাটতে দিতে রাজি না। বলে ওগুলোওতো গাছ। কাটবে কেন? থাক

বাড়ির একটা বড়ো উঠান ছিল। এখন ঘর থেকে বের হবার একটা রাস্তা ছাড়া আর কিছু নেই। গাছ আর গাছ। নিজামউদ্দিন একদিন কড়া করে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু তাকে থেমে যেতে হয়। সায়বান বিবি শুনিয়ে দিয়েছে বাড়িটা নিজামউদ্দিনের নয়। তার নিজের। তার বাপ ইন্ডিয়া যাবার আগে তার নামে লিখে দিয়েছে

বন্ধু বান্ধবরা হাসাহাসি শুরু করল। গ্রামে জানাজানি হতে বাকি থাকল না বিষয়টা। আর এও সবাই জেনে গেলো যে নিজামউদ্দিন বৌকে কিছু বলতে পারে না ঘরজামাই বলে। এ তো মহা মুশকিল। শ্বশুরের সম্পত্তি নিয়ে বিয়ে করে যে খোঁটা শুনতে হয়নি। সেই খোঁটা এখন শুনতে হচ্ছে। নিজামউদ্দিন তার ছেলেকে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ছেলেও মায়ের মতো। তাকেও পেয়েছে গাছের নেশায়

সায়বান বিবি একদিন নিজামউদ্দিনকে বলল বাড়ির উঠানের উপর চলা-ফেরার জন্য বাঁশের মাচান করে দিতে। কারণ উঠানের উপর দিয়ে হাঁটতে গেলে ঘাসের ক্ষতি হয়। নিজামউদ্দিন সরাসরি না করে দিলো এই প্রস্তাবে। পাশাপাশি এও বলে দিলো যে এইসব ফাজলামি বন্ধ করতে হবে

কিন্তু পরের দিন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হলো নিজামউদ্দিনকে। সায়বান বিবি পানির দরে আধ বিঘা ধানের জমি বিক্রি করে বাঁশ কিনে কামলা এনে সারা উঠানে বাঁশের মাচা করছে। এইবার নিজামউদ্দিনের মনে হলো কিছু একটা করা দরকার। সে পরামর্শ করল বন্ধু বান্ধবদের সাথে। কেউ কোনো সুরাহা দিতে পারে না। সবাই বলে বোঝাতে। কেউ কেউ নিজেই এল সায়বান বিবিকে বোঝাতে। কিন্তু তার এক কথা- খারাপ কী কাজ করছি আমি?

এবার আরেক কাজ করে বসল সায়বান। এক বিঘা জমি বিক্রি করে পুরো বাড়িতে কাঁটা তারের বেড়া দিলো। ঘরের পেছনে বেশ বড়ো একটা দাওয়া ছিল। সায়বান বিবি সেখানেও কিছু গাছ লাগিয়ে দিলো

নিজামউদ্দিনের সংসার করা শেষ। সায়বান বিবি কোনো কথা বলেও না আর। কোনো দিকে তার কোনো মন নেই। পাঁচ পাঁচটা বছর কাটল। বাড়িটাকে এখন আর বাইরে থেকে দেখলে কোনো মানুষ বসবাস করে বলে মনে হয় না। ...আর সম্ভব নয়। কোথায় কোন গাছে ফুল ফুটেছে। কোন গাছে ফল ধরেছে। কোন গাছ কত বড়ো হলো। কোনটার ডাল ভেঙে গেলো এই নিয়ে সংসার করা যায় না। ছেলে মোস্তফার দিকেও সায়বানের কোনো খেয়াল নেই। রান্না হলো কি না কিংবা ছেলে ভাত খেলো কি না তার চেয়ে বড়ো হয়ে উঠল কোন গাছে পানি দিতে হবে আর কোন গাছের ডাল বেঁধে দিতে হবে। এই

নিজামউদ্দিন হাল ছাড়ল। কিন্তু তালাকের কথা চিন্তা করেনি সে। কথাটা সায়বান বিবিই তুলল। বলল আমার সাথে যখন তোমার হবে না। তখন তুমি একেবারেই যাও। নিজামউদ্দিন কথাটাকে তেমন পাত্তা না দিলেও তার এক বন্ধু বলল এটাই সবচে ভালো। কারণ সায়বান বিবি যা করছে তা মানুষের কাজ না। নিশ্চয়ই কোনো জ্বিন-ভূতের কাজ। যেহেতু সায়বান বিবি এখন নিজামউদ্দিনকে শত্র“ মনে করে। সেহেতু সেই জ্বিন দিয়ে নিজামউদ্দিনের যে কোনো ক্ষতিও করাতে পারে সে। অবশ্য শত্র“ মনে করার কারণ হলো একদিন সকালে সায়বান বিবি দেখে তার উঠানের অনেকগুলো গাছ কাটা। গাছ কাটা দেখে সে এর জন্য কোনো দোষারোপ করে না নিজামউদ্দিনকে। বরং সোজা বলে দেয় এই বাড়ি আমার। আমার বাবা এই বাড়ি আমাকে দিয়ে গেছে। তুমি আর এ বাড়িতে থাকতে পারবে না। তুমি তোমার বাপের বাড়ি যাও। আমার ছেলেকে নিয়ে আমি থাকব এখানে

সায়বান বিবির চোখে এমন এক রোশনাই ছিল যে নিজামউদ্দিন সে দিনই বাড়ি ছাড়ল। তারপর সালিশ এবং হুজুর দুটোই করে দেখেছে। সায়বান বিবি তার কথা কিংবা কাজ থেকে এক চুলও নড়ে না। নিজামউদ্দিন ভাবল হয়ত এর একটা বিহিত হবে। কিন্তু এর মধ্যে সায়বান বিবি নিজেই পাঠাল তালাকের প্রস্তাব। সত্যি কথা বলতে কি এ প্রসঙ্গটি নিয়ে পরিচিতজনদের সাথে আলাপ করে নিজামউদ্দিন কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেলো। যদি সত্যি সত্যিই সায়বান বিবির উপর ভূতের আসর থাকে তাহলে সে ভূত তারই ক্ষতি করবে। কারণ মোস্তফা সায়বান বিবির নিজের ছেলে। ভূত হলেও তো সে মা। পেটের ছেলের ক্ষতি করবে না। সুতরাং মোস্তফাকে নিয়ে এখন চিন্তা না করলেও চলে

সাক্ষী ডেকে নিজামউদ্দিন তালাক দিলো সায়বান বিবিকে। সায়বান বিবি অবশ্য দেনমোহরের যাবতীয় দাবি সাক্ষীদের সামনেই ক্ষমা করে দিলো। এক দিক থেকে সুবিধেই হলো নিজামউদ্দিনের। না হলে দেনমোহরের নামে যে জায়গাটা ছিল সেতো এখন আর নেই। ওটা বহু আগেই নিজামউদ্দিন বিক্রি করে দিয়েছে। ভূতের আরেকটা গুণ আবিষ্কার করল নিজামউদ্দিন

তালাকের পর ছেলেকে নিয়েই সংসার সায়বান বিবির। ছেলে পড়া ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছু দিন। মায়ের কাণ্ডকারখানা সে উপভোগই করে বলতে হয়। বাপের অবর্তমানে ধানের জমিগুলো নিজেই দেখে। মা ছেলের সংসারে মানুষ কম। অত ঘরের কী দরকার? তাই একপাশের ঘর ভেঙে সে ভিটায় কিছু গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করল সায়বান বিবি। এক সময় নিজে যে ঘরে থাকে সে ঘরেও কিছু গাছের চারা লাগাল। কিন্তু চারাগুলো ছায়ায় থেকে থেকে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিল। ঠিকমতো বেড়ে উঠতে পারছিল না। তাই সায়বান বিবি শাবল নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একপাশের চালের টিন খুলে ফেলল। এইবার ছেলে কিছুটা আপত্তি করল। বলল ঘরের ভেতরের গাছগুলো কেটে ফেলতে। কিন্তু সায়বান বিবির একটাই কথা- গাছ তো তোর কোনো ক্ষতি করে না বাজান। থাক। আমার জন্য আর কত জায়গা দরকার? গাছগুলা থাক

কিছুদিন পর ছেলে মোস্তফার থাকার ঘর আর রান্না ঘর ছাড়া সায়বান বিবির ঘর পুরোটাই হয়ে উঠল গাছের ভিটে। সায়বান বিবি তার ঘরের সম্পূর্ণ চাল খুলে নিজে থাকার জন্য এসে আশ্রয় নিল রান্নাঘরে। কিন্তু একদিন মোস্তফা দেখে তার মা রান্নাঘরেও কিসের যেন চারা লাগিয়েছে। মোস্তফার ঘোর আপত্তির মুখে সায়বান বিবি বলে- এই দেশে আমার কোনো ভাই বেরাদর নেই। যদি আমাকেও উচ্ছেদ হয়ে যেতে হয় তবে অনেক দিন পর ফিরে আসলে কে আমাকে চিনবে? তাই গাছ লাগাই। গাছ থাকলে গাছ আমাকে চিনবে

অবস্থা দেখে আর বাবা নিজামউদ্দিনের কথায় মোস্তফারও একদিন মনে হলো তার মায়ের আসোলে জ্বিনের আসর। থাকা যাবে না। কিংবা থাকা উচিত হবে না তার সাথে। একদিন মোস্তফা কথা তুলতেই সায়বান বিবি বলল তুই তোর বাপের সাথে গিয়ে থাক। ধানের সাড়ে সাত বিঘা জমির মধ্যে পাঁচ বিঘা তোর নামে লিখে দেবো। বাকি আড়াই বিঘা জমি আর বাড়ি থাকবে আমার নামে। আমি মরলে তুই পাবি। এই আড়াই বিঘা জমিতে যা ধান হবে তার অর্ধেক তুই আমাকে দিবি যতদিন বাঁচি। তাছাড়া বাড়িতে এখন অনেক ফল হয়। আমার চলে যাবে

ছেলে মোস্তফা যাবার পর সায়বান বিবি আর এক মুহূর্তও দেরি করে না। শুধু রান্নাঘরটি রেখে পুরো বাড়িটাই ভেঙে ফেলে। পুরো ভিটা জুড়ে লাগিয়ে দেয় নানান জাতের গাছ

এর পরে পাঁচ বছর গেছে। মাঝেমাঝে মাকে খাই খরচ দিতে আর বাড়ির ফল নিতে আসত মোস্তফা। এর মধ্যে সায়বান বিবির রান্নাঘরও জঙ্গল হয়ে গেছে। শুধু এক পাশে একটা চাল কোনোমতে টিকে আছে। তাও কোনো খুঁটির সাথে নয়। সায়বান বিবি জ্যান্ত গাছকেই ঘরের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। ঘরের দৈনন্দিন ঘটি বাটি সব ঝুলিয়ে রাখে গাছের ডালে। শুধু একটু ফাঁকা জায়গা আছে। সেটি চুলার। যদি গাছের উপরে চুলা বানানো যেত তাহলে হয়ত সায়বান বিবি তাই করত। এখন সে ঘুমায় গাছে হেলান দিয়ে

গত পঞ্চাশ বছরে নাকি এরকম ঝড় হয়নি। সকালে উঠেই নিজামউদ্দিন ছেলে মোস্তফাকে ডেকে অনেক বছর পর রওয়ানা দেয় সায়বান বিবির বাড়ির দিকে। বাড়িতো নয়। গহিন জঙ্গল। এখন উঠান কিংবা রাস্তা বলতে কোনো কিছু বাকি নেই। গাছের ডাল ধরে ধরে ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে পৌঁছাতে হয় সায়বান বিবির থাকার জায়গায়। অবশ্য মোস্তফা তা জানে। সে মাঝে মধ্যে আসে

মোস্তফা ডাকাডাকি করেও কোনো উত্তর পায় না সায়বান বিবির। এগিয়ে যায়। ঝড় আর বৃষ্টিতে লেপ্টে আছে গাছগুলো। অনেক গাছের ডাল ভাঙা। চুলার কাছে গিয়ে পাওয়া যায় সায়বান বিবিকে। একটা গাছ জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। নিজামউদ্দিন এগিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে ঠেলা দেয়। ঠেলা খেয়ে সায়বান বিবি তার শক্ত আর ভেজা দেহটা নিয়ে গড়িয়ে পড়ে আরেকটা গাছের শেকড়ের উপর
২০০৫.১০.২৮


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এটা নিয়ে একটা মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানো যায়। এই গল্পের লেখক নিজেই একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি নিজেই ভেবে দেখতে পারেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ummehasina এর ছবি

কেমন একটা নাড়া লাগল মনে। গল্পের নামকরণ এবং গল্প নিজে। অনেকদিন পরে পড়লাম এত অসাধারণ গল্প। নামটি পড়েই মনের মধ্যে এক ছবি আঁকা হয়ে যাচ্ছিল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।