অন্তর্যান

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বুধ, ১০/১০/২০০৭ - ১:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রেল সড়ক থেকে রাস্তাটা নিচে নেমে গেছে বাম পাশে ধানের জমি আর ডানে গ্রামের মাঝখান দিয়ে। কাদামাখা পিচ্ছিল পথ। মানুষ নামার পথে বর্ষার পানিও নামে। এটাই নিয়ম পায়ের সাথে পানির। রেল সড়কের পেটে অনেকটা নালার মতো হয়ে তা মিশে গেছে গ্রামের সেই পথটাতে। চিনতে অসুবিধা হবার কথা নয়। জীবনে যে কমপক্ষে তিনবার এখানে এসেছে তার কাছ থেকে শোনা বর্ণনা

নেমে গেলাম। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই এখনো। হাঁটা শুরু করলাম। যাদের কোনো তাড়া নেই এবং যারা শিশু; বাড়ির আশেপাশে দৌড়াদৌড়ি করছে তারাই শুধু দ্বিতীয়বার আমার দিকে ফিরে তাকাল। হাতে একটা বাঁশের কঞ্চি- শরীরের উপরের অংশ খোলা এমন একটি ছ-সাত বছরের ছেলে মুখে আঙুল ঢুকিয়ে কঞ্চিধরা হাতটি মাজায় ঠেকিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে তার থেকে কম বয়েসি একটাকে বলল- দেখ দেখ লোকটা চশমা দিয়ে তাকায় না। তাকায় চশমার ফাঁক দিয়ে। হিঃ হিঃ হিঃ

প্রথম তিন পথের মুখে পৌঁছে ইচ্ছে হলো একটু যাচাই করে নেই পথ ঠিক আছে কি না
- ভাই নলীডোবা বাজারের পথ কোনটা?
- এই দিকে

লোকটা বামের রাস্তা দেখিয়ে চলে গেলো কাঁধে বাঁক আর খালি শিকা ঝুলিয়ে। রাস্তাটি বেড়ি বাঁধের। একটু বেশি পিচ্ছিল মাটির। বাম পাশে গ্রাম আর ধান ক্ষেত মিশে আছে। ডানে নদীর পাড়। কিছু অস্থায়ী দোকান মাঝেমাঝে। মাঝেমাঝে কিছু লাউর মাচান। যেখানে রাস্তার উপরে এসে নুয়ে গেছে গৃহস্থ বাড়ির বাঁশঝাড় কিংবা গাছ; সেখানে চপচপ কাদা। দেখে দেখে পা ফেলার জায়গা খুঁজে বের করতে হয়

গ্রাম শেষ হয়ে গেলো এক সময়। বাঁয়ে লাগাতার ধানী জমি আর ডানে বাঁধের পাড় বেয়ে নেমে যাওয়া বর্ষার নদী। রোদ হালকা হতে হতে এসে অন্য গ্রামে মিশে গেলো পথটা। গ্রামটার শুরু এক বাজার দিয়ে। গরু আর মাছের বাজার। এখানে অন্য কিছু পাওয়া যায় না। পথের বাম পাশের ধানের জমিতে নদীর মাটি তুলে উঁচু ভিটেতে তৈরি বাজারটি। চারপাশে পাকা দেয়াল। উপরে টিন। গরু আর মাছ এখানে একসাথে বিক্রি হয় একই ঘরের ভেতর। এই বাজার-ঘরটি ছাড়া ডান পাশে কয়েকটা চায়ের দোকান মাত্র। দুটো দরজা বাজার-ঘরের। একটি মাছ আর গরু বিক্রি করতে আনার জন্য। অন্যটি গরু আর মাছ কেনার জন্য। খালি হাতে মানুষের যাওয়া আসা দুদিকেই চলে। গ্রামের নাম গোলাভাঙা আর বাজারটিকে সবাই গোলামুখী বাজার নামে ডাকে। গোলামুখী বাজারে গরু আর মাছ কিনতে আসে অন্য গ্রাম আর শহরের মানুষ। কিন্তু বিক্রি করতে পারে শুধু গোলাভাঙা মানুষেরাই। বাজার ঘরের বেরোবার দরজাটি পথের সাথে। ঢোকার পথটি পেছনে

বাজার ঘরের দরজার সামনে একটা লোককে দেখে চিনলাম। তার কোমর থেকে উপরে টাইশুদ্ধ নাগরিক পোশাক। নিচে লুঙ্গি আর খালি পা। পায়ের আঙুলের ফাঁকে চপচপ করছে কাদা। কাঠের বাটওয়ালা ছাতা হাতে লোকটি বের হয়ে যাচ্ছিল মাছ কিংবা গরু ছাড়াই
- আপনার পতাকা কই?

ছাতা ধরা হাতের মুঠো থেকে রুমাল বের করে লোকটা দেখাল। জাতীয় পতাকা। লোকটি শহরে গাড়ি হাঁকিয়ে যখন যায় তখন এই পতাকাটি তার গাড়িতে দেখে সবাই তাকে মন্ত্রী হিসেবে চেনে
- কিছু কিনলেন না?
- গরু কিনতে এসছিলাম। পছন্দ হয়নি। এখন উজানঘাটে যাব ভাবছি
- সে তো অনেক দূর
- আর কোনো উপায় তো নেই
এক হাতে লুঙ্গির খুঁট ধরে লোকটি হাঁটতে শুরু করল আমার ফেলে আসা পথে

গোলামুখী পার হতেই হঠাৎ করে পুরো সড়ক জুড়ে গরু আর মানুষের মিছিল আসতে লাগল আমার দিকে। মাঝেমাঝে কেউ খাঁচা ভরা মাছ নিয়ে তেড়ে আসছে। একমাত্র আমিই যাচ্ছি উল্টো দিকে। বাকিরা যাচ্ছে বাজার ধরতে

গোলাভাঙা শেষ হতে হতে কিছু পাহাড়ি লক্ষ্মণ চোখে পড়া শুরু হলো। এপাশে গরু চরানো আর খড়ি খোঁজা ছাড়া কেউ আসে না খুব একটা। শুধু নলীডোবা বাজারের মানুষেরা এই রাস্তা পার হয়ে যায়। গ্রাম ছেড়ে দ্বিতীয় তেপথে এসে দাঁড়ালাম। নাক বরাবর যে পথ সেটি সোজা পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। বাম পাশেরটি চলে গেছে পাহাড়ের পেট বেয়ে আর ডানেরটি গেছে একপাশে ধানক্ষেত আর আরেকপাশে গ্রাম রেখে। তিনটি পথেই নলীডোবা যাওয়া যায়। তিনটি পথই বিপজ্জনক। মাঝেমাঝে কোনো একটি পথ কিছুটা নিরাপদ হয়। এই সংবাদটি আমাকে এখান থেকেই জেনে নিতে হবে

লোকজন নেই। জিজ্ঞেস করার উপায়ও নেই। মনে হলো ডানেরটা বেশি ঘুরপথ হবে। সোজা পথটাকে ভাবলাম ভালো নয়। বামে যাওয়াই ভালো। গোলাভাঙা গ্রামের পথ ছেড়ে বামে নিচে নেমে গেলাম। অন্যখানে যে রকম জমিকে ধানক্ষেত বলে সে রকম জমি এখানে অনাবাদি। পাড়ে সার সার বেত ঝোপ। তার নিচ দিয়ে পথ। শুরুতেই পথের উপরে নুয়ে আসা বেতের পাতায় ধাক্কা লেগে ডান কানের লতিতে একটা বেত কাঁটা ঢুকে গেলো। ছাড়িয়ে এগোতে থাকলাম। মাথা নিচু করে বেত কাঁটা বাঁচিয়ে একটু এগোতেই ডান পাশে গোলমতো বেশ বড়ো একটা ফাঁকা জায়গা। বামে সেই ঢালু জমি। সামনে পাহাড়ের পেটে রেল লাইনের টানেল। পত্রিকায় দেখেছি পাহাড়ের ভেতর দিয়ে রেল লাইন বিপজ্জনক বলে এখানে পুরো রেলপথটাকেই টানেলের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাজ শেষ হয়নি। স্বচ্ছ কাচের টানেল চলে গেছে পাহাড়রে পেট বেয়ে। কিন্তু তার সাথে সাথে বন্ধ করে দিয়েছে এদিক থেকে পাহাড়ে ওঠার পথ। বাম দিকের পথটা মিশে গেছে ডোবা জমিতে গিয়ে। আর ডান পাশটা মূলত পাহাড়েরই বর্ধিত অংশ; ঝোপঝাড়সহ বৃত্তাকারে ঘুরে এসে আমাকে ঘেরাও করে রেখেছে এখানে

কোনো পথ নেই বের হবার। জিজ্ঞেস করার মতোও নেই কেউ। হঠাৎ ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখলাম ডানপাশের বৃত্তাকার জঙ্গলের ওপাশে একটা ঘরের মতো কিছু দেখা যায়। দুয়েকজন মানুষের নড়াচড়াও যেন আছে। হয়ত ওখানে গেলে পথ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেখানে যেতে হলে যে পথ দিয়ে এসছি আমাকে আবার সে পথেই ফিরে যেতে হবে। কী আর করা। ফিরতি পথ ধরলাম গোলাভাঙা গ্রামের দিকে। গোলাভাঙা তেমাথায় এসে দেখলাম এখান থেকে বাড়িটা দেখা যায় না। মনে হয় সামনের পুরোটাই জঙ্গল- মিশে গেছে পাহাড়ে। কিন্তু ভালো করে তাকালে ছোট্ট একটা পায়ে হাঁটা পথ দেখা যায় ঝোপের ভেতর দিয়ে। এগোলাম। বাহ্ এখানেও আরেকটা বনের বৃত্ত। বৃত্তের ভেতরে চমৎকার এক উঠান। উঠানের বাউন্ডারি দিয়ে রেখেছে বেতবন। না জানলে বাইরে থেকে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় এখানে কিছু আছে। উঠানের উল্টো পাশে পাহাড়ের পেটে লাগানো সেই বাড়িটা। উঠান থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে একেবারে পাহাড়ে গিয়ে। বাড়িটা একটা চায়ের দোকান। দোকানবাড়িটা দালান দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে কুঁড়ে ঘরে। দালান অংশটা ডুপ্লেক্স। চমৎকার বারান্দা উপরে। কেউ থাকে বলে মনে হয় না। ডুপ্লেক্স থেকে বাড়িটা নেমে এসেছে একতলা দালানে। অবশ্যই সংযুক্ত। এরপর টিনের চালে ইটের দেয়াল। তারই সাথে লাগানো খড়ের চালের মাটির ঘর। চাল আর দেয়াল আলাদা আলাদা কিন্তু উঁচু দাওয়ার উপর সবগুলো ঘরের লাগাতার বারান্দাটি মাটির। এক বারান্দা। বারান্দাতেই চায়ের চুলা। উঠানে ছড়ানো বেঞ্চ। সবাই চুলার কাছে উঠে এসে চায়ের কাপ নিয়ে যায় আবার শেষ করে টিনের ঘরের সামনে রেখে আসে। ওখানে কাপগুলো ধোয়া মোছা হয়

নলীডোবা থেকে যারা বাইরে আসে অথবা যারা বাইরে থেকে নলীডোবা যায় সবাই যাওয়া আসার মাঝখানে এখানে চা খেয়ে নলীডোবা যাওয়া কিংবা ছেড়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে
- ভাই নলীডোবা যাবার রাস্তা কোনটা?
যে লোক চা বানাচ্ছিল তাকে জিজ্ঞেস করলাম
- চায়ে চিনি বেশি হবে না কম হবে?
লোকটা আমার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল
- আমি নলীডোবা যাবার রাস্তাটা জানতে চাইছি
- দুধ-চা হবে নাকি লাল-চা?

লোকটা কি কানে শোনে না নাকি? আমি আবার জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় একজন চায়ের কাপ রাখতে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে গেলো- আগে চা খান তার পরে সব হবে
- আমি নলীডোবা যাব
- এখানে যারা আছে তারা সবাই হয় নলীডোবা যাবে না হয় নলীডোবা থেকে আসছে। আপনি আগে চা খান
- চা খাব কিন্তু...
- চা না খেয়ে এখানে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না
- লিকার কড়াই দিলাম। দেখে মনে হচ্ছে আপনি কড়া চা খান। দুধ-চিনি মাঝারি। লাগলে নিয়ে নেবেন উঠানের ওই পাশে গামলায় আছে
দোকানি বিশাল মগে আমার সামনে চা এগিয়ে দিতে দিতে বলল
- ঠিকই আছে। আমি এরকমই চা খাই। আমার জন্ম চা বাগানে
- দেখেই বুঝেছি। আপনার চোখে চা পাতার কষ লেগে আছে। শরীর থেকেও চায়ের গন্ধ পাচ্ছি। আমার চা পাতাও বাগান থেকে তোলা। তবে এগুলো জংলি চা পাতা
- কোন বাগান?
- রাজার বাগিচা। পেছনে যে পাহাড়টা দেখছেন ওটাই। এক সময় এ-ক্লাস বাগান ছিল। কিন্তু এখন জঙ্গল। মালিক নেই। চা গাছগুলো বাড়তে বাড়তে বটগাছের মতো হয়ে গেছে। শুধু আমিই কিছু পাতা তুলে আনি। বাকিটা জঙ্গল
- কত আপনার?
চায়ের মগটা জায়গায় রেখে আমি দাম জিজ্ঞেস করলাম
- আপনি নলীডোবা কেন যাবেন?
- বলছি। চায়ের দামটা কত বলেন
- আপনি আগে গেছেন কখনো?
দোকানি তার প্রশ্ন করতেই থাকল
- চায়ের দাম কত?

- এখানে চায়ের দাম দিতে হয় না
আগের সেই লোকটা এগিয়ে এসে বলল- আপনি নলীডোবা যাচ্ছেন। ফেরার পথে যে কোনো একটা কিছু এখানে রেখে যাবেন
- আমি আর কতজনকে বলি। একা মানুষ। কত সাংবাদিককে বললাম আমার কথাগুলো কাগজে লিখে দিতে। কত প্রেসের লোককে বললাম একটা পোস্টার ছাপিয়ে দিতে। ডেকোরেটারের কতজনকে বললাম শহরে মাইকিং করে দিতে; আমি কিছু নেই না। আমি চা বানাই শখে। যারা শহর থেকে নলীডোবা যায় তারা এখানে বসে ঠিকানা নিয়ে যায়। আর যারা নলীডোবা থেকে শহরে যায় তারাও বসে। শহরের হরতাল- নতুন সিনেমা- নায়িকাদের সংসার ভাঙার খবর- বাজারদর সব তারা এখান থেকেই পেয়ে যায়। তাদের জন্য একটুখানি গরম পানিতে চায়ের পাতা ঢেলে আমি নেড়ে দেই। পাতা আমার কিনতে হয় না। রাজার বাগিচার পাতা। মাঝেমাঝে কিছু তুলে কোনো বাগানের ট্রাক্টরে দিয়ে দেই। তারা ফ্যাক্টরিতে নিয়ে পাতা বানিয়ে এসে দিয়ে যায় যখন তাদের কেউ নলীডোবা যায়।¬ আর এই এলাকার গোয়ালারা নিজেরাই খুশি হয়ে দুধ দিয়ে যায় প্রতিদিন। কিন্তু কেউই কোনো কাজ করে না। সেই যেইসেই। শহর থেকে যারা আসে তারা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করে চায়ের দাম কত। কী আর করব? তাই এখন এ সম্পর্কে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছি। কারো ইচ্ছে হলে আমার হয়ে বলে; না হয় যে জিজ্ঞেস করে সে ধরে নেয় আমি কানে শুনি না
বলতে বলতে দোকানি তার কাজ করে যাচ্ছিল- আপনি নলীডোবায় কী কিনতে যাবেন?
- কুমারী মায়ের ফুল দিয়ে বানানো হাওয়ার মিঠাই
- কষ্ট হবে খাঁটি জিনিস পাওয়া। এখন আবার পাইকাররা এক মা’কেই তিনবার কুমারী মা বানায় নিজেরা বিয়ে করে। পাবেন না যে তা নয়। দেখে নিতে হবে একটু
- চিনব কী করে?
- তেমন অসুবিধা নেই। যে মিঠাইটা আপনি দাম করার পর তিন চারজন সুপারিশ করবে ভালো বলে। ধরে নেবেন ওটাতে ভেজাল আছে। আর যে জিনিসটা দাম করার সাথে সাথে পুলিশ এসে আপনাকে জেরা করবে; ধরে নেবেন আপনি ঠিক জিনিসের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন
- পুলিশ সমস্যা করে নাকি?
- তেমন কিছু না। তবে সরকার তাদেরকে জুতো কেনার টাকা দেয় না। তারা পোশাকের সাথে নাগরা পরে ঘুরে বেড়ায়। রাবারের নাগরা। ফলে সারাদিনই তাদের মাথা গরম থাকে। মাথা ঠান্ডা করার জন্য ওরা মাঝেমাঝে কপালে টাকার পট্টি লাগায়
- নলীডোবা মানে জানেন?
সেই লোকটি আরেক কাপ চা নিতে নিতে বলল
- না
- নলী মানে ডগা বা মাথা। একবার বন্যায় এ অঞ্চলে সুপারি গাছের নলী পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিল। বন্যায় অনেক কিছু ভাসিয়ে যেমন নিয়ে গেছে তেমনি অনেক কিছুই ভাসিয়ে এনে বিভিন্ন গাছের ডগায় আটকে দিয়ে গেছে। সেই বন্যা নেমে যাবার পর দেখা গেলো আজকের নলীডোবা বাজারের উপর; তখন সেটা বাজার ছিল না; ছিল মাঠ; সেই মাঠের উপর অনেকগুলো ঘরবাড়ি ফেলে দিয়ে গেছে। পরে সেই ঘরবাড়িগুলোকে ঠিকঠাক করেই তৈরি করা হয় আজকের নলীডোবা বাজার
- বাজারে যাবার পথটা কোন দিকে?
- আপনি যে দিক থেকে ফিরে এসছেন সেদিকেই। রেল টানেলের নিচ দিয়ে একটা চোরা পথ আছে। অসুবিধা নেই। আমিও যাব। ...আপনার সাথে কোনো হাতিয়ার নেই?
- না তো
- হাতিয়ার লাগবে। বনের পথে হাঁটতে হলে অনেক ক্ষেত্রেই বন কেটে কেটে হাঁটতে হয়। তাছাড়া জন্তু জানোয়ারের ভয়তো আছেই। আপনি এখান থেকে একটা খাসিয়া দাও নিয়ে নিতে পারেন। খাসিয়া দাও হাতে দেখলে পুলিশরা আপনাকে ঘাঁটাবে না

- নলীডোবা কে কে যাবে?
একটা লোক এক কোনায় দাঁড়িয়ে চিৎকার দিলো- আমি রওয়ানা দিচ্ছি
- নেন কাজে লাগবে
দোকানি আমার হাতে একটা খাসিয়া দাও ধরিয়ে দিলো- ওদের সাথে চলে যান। চোখ বন্ধ করে যেতে পারবেন

আমি একেবারেই পেছনে। মোট সাতজন। এটাকে যে রাস্তা বলে কিংবা এখানে যে মানুষ চলাচলের রাস্তাও থাকতে পারে কেউ নিজে না গেলে বিশ্বাস করা কঠিন। সবাই হাঁটছে প্রায় চুপচাপ

- তা আপনি কি মনে করেন যা নিতে যাচ্ছেন তা পাবেন নলীডোবায়?
সবচে সামনের লোকটা আস্তে আস্তে পেছনে আসতে আসতে আমার কাছাকাছি এসে নিচু গলায় কথাটা বলল
- অন্য কোথাওতো সে সম্ভাবনাও নেই
- আহ্ অত জোরে কথা বলে না। পাহাড় এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। জোরে কথা বললে বিরক্ত হবে। কিন্তু যদি না পান?
- ফিরে আসব
আমিও তার মতো প্রায় ফিসফিস করে বললাম
- আপনি পেতেও পারেন
- কী রকম?
- আপনি একটা তক্তার মতো রসকষহীন মানুষ
- মানে?
- যেখানে কেউ এমনি এমনি যায় না। সেখানে যাচ্ছেন অথচ কী সহজে বললেন না পেলে ফিরে আসবেন
- এ ছাড়া আর কী করা?
- পাহাড় লোভী মানুষকে পছন্দ করে না। নিরিবিলি মানুষ তার খুব পছন্দ। লোভী মানুষেরা জোরে কথা বলে পাহাড়ের আড়াল ভেঙে দেয়। এ জন্যই পাহাড় বন্যা এনে সবাইকে তাড়িয়ে আবার নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছে নিজেকে

আস্তে আস্তে লোকজন কমতে থাকল। বাজার পর্যন্ত যাবে না কেউই। এরা নলীডোবার লোক। গিয়েছিল শহরে। বাড়ি ফিরছে। যার বাড়ি যেখানে সে সেখানেই বিদায় নিচ্ছে। সর্বশেষজন আমাকে বলল- ডানদিকে গিয়ে সোজা হাঁটলেই বাজার। বহুদূর থেকে মানুষজনের গমগম আওয়াজ শুনতে পাবেন। পুলিশের দিকে তাকাবেন না। সোজা মাছ বাজারের দিকে চলে যাবেন। তার পাশেই দেখবেন নিয়ে বসে আছে। থাকলে ওখানেই আছে। না থাকলে ফিরে চলে আসবেন। আর খোঁজার দরকার নেই। আসোল নকল চেনা না চেনা আপনার উপর

মাছ বাজারের শেষ মাথায় শুঁটকি বাজার; যা আবার মাছ বাজারে মাছুয়াদের ঢোকারও পথ। শুঁটকির গন্ধ আর মাছের পানি; মানুষের পায়ের কাদা; হাঁটতে হাঁটতে বারবার নিজের শরীরের গন্ধ পরীক্ষা করতে হলো আমাকে। ভাবলাম এখানে আসতে আসতে আমার শরীরে কোথাও পচন ধরেছে কি না

- বগলের গন্ধ কেন? পচা মানুষের গন্ধও শুঁটকি বাজারে পাবেন না। দেখেন না পোস্টমর্টেম শেষে পচা লাশ শুঁটকি দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে যায় গ্রামে?
লোকটা পেছন থেকে কথা বলল। বুঝলাম কোনো কারণে সে আমাকে ফলো করছে বেশ অনেকক্ষণ
- আমি হাবিলদার গজম্বর আলী। বহু বছর পুলিশে আছি। আজ পোশাকটা ধুয়ে দিয়েছি তাই সিভিল পোশাকেই আসতে হলো। অবশ্য আমার ফোর্সের বাকিদের পোশাক পরাই আছে। আমরা প্রতিদিন একজন করে পোশাক ধুয়ে দেই। একটাই পোশাকতো আমাদের? প্রতি পনেরো বছর পরপর আমাদেরকে এক সেট করে পোশাক দেয়া হয়। আমারটার বয়স চলছে তেরো বছর। আরো দুই বছর পর আমার নতুন পোশাক পাওয়ার কথা। অবশ্য দেড় বছরের মাথায় আমার রিটায়ারমেন্ট হয়ে যাবে

একটানে কথাগুলো বলে গজম্বর আলী থামল শ্বাস নেয়ার জন্য
- এক সেট পোশাক অত দিন পরেন কীভাবে?
- সব একসাথে পরি না তো। একটা একটা করে পরি। কোনো দিন শুধু প্যান্ট পরি। কোনো দিন শার্ট। কোনো দিন বেল্ট কিংবা টুপি। মাঝেমাঝে শুধু ব্যাজটাকেও পরি। যেদিন ঝড়-বৃষ্টি হয় সেদিন। পিতলের ব্যাজ বৃষ্টিতে কিছু হয় না। অবশ্য সবগুলোকেই আমরা ফুল ইউনিফর্ম বলি। এই বাজারে আমার পরনে কিছু না থাকলেও অবশ্য সবাই আমাকে হাবিলদার আর সরকারি লোক বলে চেনে। আমার অসুবিধা হয় না। আর নতুন কোনো লোক এলে নিজেই পরিচয়টা দিয়ে দেই। আগে থেকে পরিচয় দেয়া সুন্নত। নবীজী যে কোনো নতুন মানুষ দেখলে সালাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করতেন। অবশ্য সালাম দেয়ার অভ্যাসটা তৈরি হয়নি আমার। পুলিশে চাকরি করি বলে আমাদের দেখলে সবাই আগে সালাম দিয়ে দেয়। কাউকে সালাম দেবার সুযোগ হয় না আমাদের। উত্তর দিতে দিতেই মুখে ব্যথা করে। তবে পরিচয়টা দেই। একটা দায়িত্ব আছেতো। কী বলেন? আফটার অল সরকারি দায়িত্বে আছি; এবং দায়িত্বটা হলো জনগণকে সাহায্য করা। আমাকে যদি কেউ চিনতেই না পারে তবে আমার সাহায্য নেবে কী করে? কথাটা ঠিক কি না? কী বলেন আপনি?

গজম্বর আলী বলেই চলেছে- আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি আপনি এখানে নতুন। না হলে আমাকে অন্তত একটা সালাম দিতেন। অসুবিধা নেই। সালাম দিলে সওয়াব হয়; না দিলে কোনো গুনা হয় না। কিন্তু সালামের উত্তর না দিলে গুনা হয়। উত্তর দেয়া ওয়াজিব

হাঁটতে হাঁটতে শুঁটকি বাজার প্রায় ফেলে চলে এলাম। গজম্বর আলী কথা বলতে বলতে আমার পেছন পেছন আসছে - বয়স হয়ে গেছে; আগের মতো আর জোরে হাঁটতে পারি না। এক সময় দৌড়ে ঘোড়সওয়ার ডাকাতকে পর্যন্ত ধরে ফেলেছি। এখন আর পারি না। একবার আমার অলিম্পিকে দৌড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু দেশে চোর ডাকাত বেড়ে যাওয়ায় আমাকে আর যেতে দেয়া হয়নি। বিদেশে ফাঁকা মাঠে দৌড়ে মেডেল জেতার চেয়ে দেশে একটা চোর ধরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কথাটা ঠিক কি না? কী বলেন আপনি? সে জন্য আর গেলাম না। না হলে আমার পোশাকের সাথে কমসে কম দুটো সোনার মেডেল থাকত আজ। একটু আস্তে হাঁটেন। অবশ্য আমার ফোর্সে একটা ছেলে আছে; দুই বছর হয় জয়েন করেছে। সে আপনার সাথে হেঁটে পারবে। জোয়ান ছেলে। হাঁটে ভালো। কিন্তু আমার মতো না। আমি আরো ভালো হাঁটতে পারতাম

ভিড়ের মধ্যে আমি যে খুব একটা জোরে হাঁটছি তা নয়। তবু গজম্বর আলী প্রায় দৌড়াচ্ছে আমার পেছনে- আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনি শুঁটকি পাইকার নন। এখানে শুঁটকি কিনতে আসেননি। আপনি ফুল মিঠাই কিনতে এসেছেন
- ফুল মিঠাই?
- মেয়েদের ফুল দিয়ে তৈরি হাওয়ার মিঠাই। সংক্ষেপে সবাই ফুল মিঠাই বলে
- কী করে বুঝলেন?
- বুঝি বুঝি। মানুষকে বোঝাই আমাদের পেশা। বহু বছর থেকে আছি এই পেশায়। আমার সাথের অনেকে কনস্টেবল থেকেই রিটায়ার করেছে। আর আমি তিন তিনটা প্রমোশন পেয়েছি। এসবতো আর এমনি এমনি হয়নি। হয়েছে আমার যোগ্যতায়। কথাটা ঠিক কি না? কী বলেন আপনি?

ভালো করে তাকালাম লোকটার দিকে। গজম্বর আলীর এক চোখ নেই। অন্য চোখটা প্রায় গর্তের ভেতরে। সে আমাকে অতক্ষণ ফলো না করলে আমি বিশ্বাসই করতাম না যে সে তার অন্য চোখটা দিয়ে দেখতে পায়। তাল-ঢ্যাঙ্গা শরীর। কথা বললে সামনের একটা দাঁত নড়বড় করে। আশপাশের বাকিগুলো আগেই পড়ে গেছে
- আসেন আমার সাথে। একমাত্র আমিই আপনাকে খাঁটি জিনিসটা দেখিয়ে দিতে পারব

শুঁটকি বাজার পার হয়ে চলে এসছি। এখানে পরপর কয়েকটা চায়ের দোকান। তারপর লাগোয়া অনেকগুলো ঘর। দরজা বন্ধ। আমি নিশ্চিত এটিই সেই জায়গা। কিন্তু গজম্বর আলী আমাকে যেভাবে পেঁচিয়ে ধরেছে; তাকে এড়ানো কঠিন মনে হলো

- আসেন আমার ফোর্সের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। ওরা তাহলে আপনাকে যে কোনো সময় সাহায্য করতে পারবে। টাউট বাটপারেরতো অভাব নেই। বলা যায় না কখন কী ঘটে। আসেন
আমি একটু হেসিটেট করছি দেখে গজম্বর আলী আবার মুখ খুলল- আরে আসেন। ফোর্সের সাথে অতিথির পরিচয় করানোটাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলে গার্ড অব অনার। গার্ডরা যাতে অতিথির মুখ চিনে রাখতে পারে সেজন্য কোনো রাষ্ট্রীয় অতিথি এলে তাকে গার্ডদের সামনে দিয়ে হাঁটিয়ে নেয়া হয়। অবশ্য সেরকম কিছু হবে না আপনার বেলায়। আপনিতো আর রাষ্ট্রীয় অতিথি নন। তাছাড়া আপনি এসেছেন এমন একটা কাজে যেটার আবার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। আমাদের ভাষায় যাকে আমরা বলি বেআইনি কাজ

গজম্বর আলী আমাকে ছাড়বে না। তার সাথে যেতেই হবে। আশপাশটা দেখে নিলাম। লোকজন কোনো কোনো জায়গায় জটলা করে আছে। আমাকে দেখছে। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসছে না। বুঝলাম এর কারণ গজম্বর আলী। একটা বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে মুখে একটা পাতা আলতোভাবে চিবোতে চিবোতে একটা মেয়ে আমাদের দেখছিল। মেয়েটা কিশোরী। তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। গজম্বর আলী আবার ডাক দিলো। তার সাথে চললাম
- এই যে এরা আমার ফোর্সের লোক

কারো পরনে সরকারি শার্টের সাথে স্থানীয় লুঙ্গি। কারো পরনে স্যান্ডো গেঞ্জির সাথে সরকারি প্যান্ট। কেউ শুধু ব্যাজ পরে আছে। গজম্বর আলী সাথে না থাকলে আমি নির্ঘাত এদের শুঁটকি পাইকার বা অন্য কিছু ধরে নিতাম। কোনোভাবেই পুলিশের লোক নয়। কিন্তু গজম্বর আলীসহ সবার পায়েই রাবারের নাগরা। তারা যে এক দলের লোক এটাই এখানে তাদের চেনার একমাত্র ইউনিফর্ম

- লম্বু মিয়া। আজকেতো ঝড় বৃষ্টি নেই। আজ তুমি ব্যাজ পরে এসেছ কেন?
শুধু ব্যাজ পরে আসা তাগড়া জোয়ান একটাকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলল গজম্বর আলী
- আজকে ওস্তাদ প্যান্ট পরেই আসছিলাম। কিন্তু রাস্তায় একজনের গাই ছুটে গেলো। আমাকে বলল ধরতে। আমি দৌড়ে গিয়ে ধরলাম গরুটার লেজে। আর তখন সে পেশাব করে আমার প্যান্টটা নষ্ট করে দিলো ওস্তাদ
- গরুটা ধরে দিতে পেরেছ মালিককে?
- জ্বি ওস্তাদ
- যাক একটা সরকারি কাজ করেছ বলে তোমাকে আজ ক্ষমা করে দিলাম। পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি আমার পরিচিত লোক। শহরে থাকেন। এখানে এসেছেন একটা ফুল মিঠাই নিতে। গবেষণা করবেন তিনি। তিনি ব্যবসা করেন না। ছাত্র মানুষ। আমাদের উচিত তাকে সাহায্য করা। কথাটা ঠিক কি না? কী বলো তোমরা?

যেখানে গজম্বর আলী আমাকে নিয়ে এল সেটা একটা চায়ের ছাপড়া দোকান। কোনো দিকে কোনো বেড়া নেই। বাঁশের খুঁটির উপর সুপারি গাছের টুকরো বসিয়ে কয়েকটা বেঞ্চ বানানো চারপাশে। মাথার উপরে খড়ের চাল। খেয়াল করে দেখলাম সেই মেয়েটা একইভাবে পাতা চিবোতে চিবোতে এইবার চায়ের দোকান থেকে বেশ দূরে আমার মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছে। পাতাটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। ওর দিকে আমার চোখ যেতেই মনে হলো হাতের পাতা নেড়ে কিছু একটা নিষেধ করছে আমাকে
- আমরা চা খাই কী বলেন? অনেকদূর থেকে আসছেন। চা খেলে শরীর চাঙ্গা হবে। তারপরে আমি আপনাকে নিয়ে যাব। কথাটা ঠিক কি না? কী বলেন আপনি?

গজম্বর আলীর কথার মাঝখানে তাকে লুকিয়ে আবার তাকালাম মেয়েটির দিকে। এবার সে স্পষ্ট মাথা নেড়ে আমাকে কী যেন নিষেধ করে হাতের পাতাটি তার ডান দিকে ছুঁড়ে ফেলল। আবার তা তুলে যে জায়গায় পাতাটি পড়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে বাম দিকে ছুঁড়ে দিলো। তারপর আবার পাতাটি ছুঁড়ল ডান দিকে। এবার পাতাটি যেখানে পড়ল সেখানেই মাটি আলগা করে পুঁতে দিলো
- চা খান। ঠান্ডা হলে চায়ের মজা থাকে না

দোকানি সবার জন্যই চা বানিয়েছে। মোট সাত কাপ। চা দিতেই গজম্বর আলী আর তার দল নিজেদের ইচ্ছেমতো বিস্কুট নিয়ে নিতে থাকল বয়াম থেকে- খালি খালি চা খাওয়া ঠিক না। পেটে গ্যাস হয়। নেন বিস্কুট চুবিয়ে খান
একটা টোস্ট বিস্কুট আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বলল গজম্বর আলী

চা খেতে খেতে আবার তাকালাম মেয়েটির দিকে। মেয়েটি আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে সে প্রথম যেদিকে পাতাটি ছুঁড়েছে সেদিকে এক দৌড়ে চলে গেলো

সরে যাবার পথ পাচ্ছি না। গজম্বর আলী আমাকে আটকে ফেলেছে- আচ্ছা আপনারাতো এখানে অনেকক্ষণ থাকবেন তাই না?
- আমরাতো সারা দিনরাত্রিই থাকি। অনেক দায়িত্ব না আমাদের? ভয় পাচ্ছেন? কোনো ভয় নেই। বাজারের সব লোক আপনার সাথে আমাকে কথা বলতে দেখেছে। কেউ কিছু করার সাহস পাবে না
- ভাবছিলাম যেহেতু গবেষণার কাজে এসেছি সেহেতু আমাকে বাজারের একটা বর্ণনাও দিতে হবে বইয়ের প্রথম পাতায়
- তাতো হবেই। আমাদের এসপি স্যার একবার জাপানে একটা ট্রেনিংয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে ওই ট্রেনিংয়ের উপর আশি পৃষ্ঠার একটা বই লেখে। আমাদের প্রত্যেকের বেতন থেকে একশো বিশ টাকা কেটে রেখে সে বইয়ের একটা করে কপি আমাদের সেলারির সাথে দেয়া হয়েছিল সেবার। স্যাররা বলেছে বইটা আমাদের জন্য খুব শিক্ষণীয় ছিল। সে বইয়ের প্রথম চল্লিশ পৃষ্ঠা জুড়ে টোকিও শহরের দর্শনীয় বস্তু- খেলার মাঠ- পার্ক আর মার্কেটের ছবি এবং কীভাবে কোথায় যাওয়া যাবে; ভাড়া কত লাগবে তার বর্ণনা। এছাড়া জাপানি মেয়েরা কেন আমাদের দেশের ছেলেদের পছন্দ করে তার উপর স্যারের একটা গবেষণাও আছে তাতে। ...অসুবিধা নেই আমি বলে দিচ্ছি আপনি লিখে নিন। আপনার সাথেতো ক্যামেরা নেই। ক্যামেরা থাকলে ভালো হতো। ছবি নিতে পারতেন। যেখানেই যান অ্যাটলিস্ট একটা ক্যামেরা সাথে করে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাহলে অনেক কিছুই আর লিখে বর্ণনা করতে হবে না। বিশ পাতা লেখার চেয়ে একটা ছবি অনেক বেশি শক্তিশালী। কথাটা ঠিক কি না? কী বলেন আপনি? আমাদের এসপি স্যারকে দেখেছি সব সময়...
- আপনার কাছ থেকে বর্ণনা শুনতেই হবে আমাকে। তবে আমি ভাবছিলাম তার আগে নিজে একবার দেখে নেব
- অবশ্যই দেখবেন। কানে শোনার চেয়ে নিজের চোখে দেখা একশো গুণ বেশি শক্তিশালী। এজন্যই আমাদের ডিপার্টমেন্টে সুরতহাল রিপোর্টের উপর এত গুরুত্ব দেয়া হয়। সুরতহাল মানে হাল সময়ে সুরত। মানে বিষয়টা পুলিশ আসার সময় কী অবস্থায় আছে তার বর্ণনা। আপনি লম্বু মিয়াকে নিয়ে যান সাথে। যা যা দেখতে চান তাকে বলবেন সে দেখিয়ে দেবে। আরে আমরাতো আছিই এ জন্য। জনগণকে সাহায্য করার জন্য। কথাটা ঠিক কি না? কী বলেন আপনি?
- কিন্তু আমি ভাবছিলাম নিজে আবিষ্কার করে দেখার কথা। আপনি অভিজ্ঞ মানুষ। বিষয়টার মর্ম আপনি বুঝবেন। একটা রহস্য আবিষ্কারের মধ্যে আলাদা আনন্দ আছে
- তা ঠিক তা ঠিক। শুনেছি পর্যটকরা নতুন আবিষ্কারের নেশায় বাড়ি থেকে টাকা পয়সাও সঙ্গে নেয় না। এমনি এমনি বেরিয়ে পড়ে। একবার অবশ্য আমি ছোট বেলায় বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে মামার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম মাইরের ভয়ে। কিন্তু গিয়ে আবিষ্কার করলাম মামার বাড়িতে তালা। মামা তার শালির বিয়েতে চলে গেছে সবাইকে নিয়ে। পরে সেই টাকা খরচ করে বাড়িতে ফিরে এসে আবার সেই বাবার হাতেই মার খেতে হলো। হাঃ হাঃ হাঃ ছোটবেলার দুষ্টামি আরকি। এতে কোনো পাপ নেই। কথাটা ঠিক কি না? কী বলেন আপনি? হাঃ হাঃ হাঃ ...অসুবিধা নেই। আমরাতো এই বাজারেই আছি। দেখা হবেই। তাছাড়া কেউ কিছু বললে আমার নাম বলবেন। ...তবে মানুষের মন তো? বলা যায় না পরে হয়ত আমিও ভুলে যাব আর আপনি একজন গবেষক মানুষ। ভুলোমন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও নাকি সবকিছু ভুলে থাকতে থাকতেই অত বড়ো হয়েছেন। এতে কোনো দোষ নেই। তিনি সবকিছু ভুলে গেলেও আমরা তাকে মনে রেখেছি। এটাই বা কম কিসে। আপনিও তার মতো... তার মতো না হলেও তারইতো জাতের লোক। গবেষক... তাই বলছিলাম কি লোকটা গরিব মানুষ। চা বিক্রি করেই সংসার চালায়। এখন পর্যন্ত চায়ের বিলটা দিয়ে দিলে ভালো হয়। পরেরটা পরে দিলেও চলবে
- একশো বাইশ টাকা
গজম্বর আলীর কথা শেষ হবার আগেই দোকানি বলল
- একশো বাইশ টাকা? সাতকাপ চা আর কয়েকটা বিস্কুট? এখানে চায়ের কাপ কত?
- আসোলে চায়ের দাম খুবই কম। শহরের কাছেতো দামই বলা চলে না
গজম্বর আলী বলল- ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা ফোর্সের লোকরা এখান থেকে নিয়মিত চা বিস্কুট খাই। আমরা জানি যারা সমাজের গণ্যমান্য মানুষ তারা ফোর্সের লোককে খাতির যতœ করেন। খাওয়াতে চান। আফটার অল আমরা জনগণের জন্যইতো। কিন্তু অনেকেই সময়ের অভাবে আমাদেরকে খাওয়াতে পারেন না। তাই আমরা যখন নিজেরা নিজেরা খাই তখন আর টাকা দেই না। দোকানি লিখে রাখে। তারপর যেদিন কেউ এসে আমাদের চা খাওয়াতে চায় সেদিন সে একসাথে টাকাগুলো নিয়ে নেয়
- এই নিন
আমি একটা একশো টাকার নোট আর একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলাম দোকানির হাতে
- এক কাজ করো; তুমি একশো ত্রিশ টাকা রেখে দাও
গজম্বর আলী দোকানিকে বলে আমার দিকে ফিরল- আপনার আসতে কমসে কম এক ঘণ্টা লাগবে। এর মধ্যে আমরা আরো দুয়েক কাপ চা তো খাবই। সে যদি পয়সা রেখে দেয় তাহলে একটু ভালো দুধ-চিনি দিয়ে আমাদের চা বানিয়ে দিতে পারবে। এখানে আবার টাকা বাকি থাকলে চায়ে বেশি চিনি দেবার নিয়ম নেই
- ভাংতি নেই। দশ টাকা আছে
- দশ টাকাই উনাকে দাও। বাকি টাকা থাকুক। আমরাতো বিস্কুটও খাব
এবার লম্বু মিয়া বলল দোকানিকে। দোকানি একটা পুরোপুরি ছেঁড়া দশ টাকার নোট আমার হাতে দিলো। আমি এর দিকে তাকাতেই বলল- আর নাই। থাকলে দিতাম। অসুবিধা নেই। আপনিতো আবার আমার দোকানে এসেই চা খাবেন। তখন বিল হিসেবে দিয়ে দিয়েন
- ঠিক আছে এখনই আগাম হিসেবে দিয়ে গেলাম। রাখেন ফিরে এসে খাব
আর কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বের হলাম- ফিরে আসার পর কিন্তু আপনাদের সবার সাহায্য আমার লাগবে
কথাটা বলতে বলতে বের হলাম। পেছনে গজম্বর আলী কী বলল পুরোপুরি শুনতে পেলাম না। শুধু শুনলাম যেন বেশি দেরি না করি

ডানে গিয়ে বামে। তারপর আবার ডানে। কিন্তু সবার আগে গজম্বর আলীদের চোখের আড়াল হতে হবে আমাকে। আমি বাম দিকে গেলাম। ঘন বাজার। মানুষজন আমাকে দেখছে কিন্তু গজম্বর আলীরা আমাকে দেখার কথা না। একটু ঘুরলাম। শুঁটকি দাম করালাম। গজম্বরদের কেউ আসছে না
- ভাইজান কি ফুল মিঠাই কিনতে এসছেন?
পেছন থেকে একটা লোক প্রশ্ন করল
- আমি শুঁটকির ব্যবসা করি
- ও আচ্ছা

তিনজনকে তিনটা মিথ্যে বলে। কয়েকজনকে ধাক্কা মেরে যখন পৌঁছালাম তখন মেয়েটা একটা কাপে করে ছাগীর দুধ দোয়াচ্ছে। আমার দিকে না তাকিয়েই বলল- তুমিতো চা খাও। আমাদের এখানে গরুর দুধ অন্য কাজে লাগায়। তাই তোমাকে ছাগলের দুধ দিয়েই চা খেতে হবে। দোকানে যে চা তোমাকে দিয়েছে ওটা কোনো দুধ নয়। বাজারের গুঁড়ো দুধের সাথে গরুর গায়ের গন্ধ মিশিয়ে ওরা গরুর দুধ বলে চালায়। এখানে বোতলের মধ্যে গরুর গায়ের গন্ধ কিনতে পাওয়া যায়। তবে চা পাতা দিয়ে তোমাকে চা খাওয়াতে পারব না আমি। এখানে চা খুব দামি আর চোরাবাজারে আসে। ফুল ব্যবসায়ীরা লুকিয়ে এনে চায়ের দোকানগুলোতে বিক্রি করে। আমরা পাই না। আমরা পাট শাকের পাতা শুকিয়ে তাতে চায়ের গন্ধ মাখাই। আর তামাক পাতা পিষে লিকার মাখাই চায়ে। ভালো লাগবে তোমার। তোমারতো আবার তামাক পাতার সাথে বহু দিনের বংশগত সম্পর্ক। তোমার অসুবিধা হবে না
- ডেকেছ কেন?
- ফুল মিঠাই কিনতে এসেছ তুমি
- তোমাকে কে বলেছে?
- মা আমাকে শিখিয়েছে মানুষের চোখ পড়তে। তোমার চোখের কোনার ঘূর্ণি দেখেই আমি বুঝে গেছি তুমি শুঁটকি কিংবা অন্য কিছু কিনতে আসনি অতদূর। তাছাড়া তুমি এখানে নতুন
- কী করে বুঝলে?
- এখানে যারা যাতায়াত করে তারা গজম্বর আলীদের সাথে মিশে না। বাজারে ঢোকার মুখে গজম্বর আলীদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বাজারে ইচ্ছামতো ঘোরার অনুমতি নিয়ে নেয়। তুমি ওদের সাথে বসে চা খেয়েছ। এখানে কেউ তাদের সাথে বসে চা খায় না। চায়ের দোকানে গিয়ে ওদের খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিয়ে আসে। তারা বসে বসে চা খায় আর তখন ব্যবসায়ীরা শুঁটকির নিচে নকল ফুল লুকিয়ে ফেলে
- ফুল নকল হয় কী করে?
- চা না খেলে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে?
- আমি কি বলেছি যে চা খাবো?
- কিন্তু তোমার জন্য আমাকে চা বানাতে হবে। এখানে অতিথির জন্য চা বানাতে গেলে কিছু সুবিধা পাওয়া যায়
- কী রকম?
- তোমার কাছে কি টাকা আছে?
- কত?
- তুমি কিছু তামাক পাতা আর একটা দেশলাই কিনে বাজারের বাইরে চলে যাও। তামাক পাতা আর দেশলাই এমনভাবে রাখবে যাতে সবাই দেখতে পায়। তাহলে কেউ তোমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আমি তোমার পেছনে শুকনো খড় আর ছাগীর দুধ নিয়ে আসছি। এই বাজারের মধ্যে তামাক পাতা পোড়ানো নিষেধ
- আমাকে ডেকেছ কেন?
- আর শোনো। খাসিয়া দাও এখানে এভাবে ধরে না কেউ। এভাবে ধরে যারা নতুন তারা। এখানকার লোকজন বাজারের মধ্যে ঢুকে গেলে দাও আর হাতে রাখে না। বগলে রাখে। তুমিও রাখো। তাহলে কেউ আর তোমাকে নতুন লোক ভাববে না। যাও তাড়াতাড়ি করো
- কিন্তু আমি কেন করব এসব?
- তোমার চেয়ে আমার গায়ে জোর কম। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারব না

এখানে এক মণের নিচে কোনো তামাক বিক্রি হয় না। এটা পাইকারি বাজার। আমাকে লোকটা এক বস্তা তামাক গছিয়ে দিলো। তামাকের বস্তা মাথায় আর দেশলাইটা হাতে নিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম বেশ দূরে মেয়েটি হাতে দুধের বাটি আর খড়ের একটা বোঝা মাথায় নিয়ে এমনভাবে আসছে যেন আমাকে আপ্যায়নে তার খুব তাড়া আছে

বাজারের বাইরে এসে খোলা জায়গায় তামাকের বস্তাটা নামিয়ে রাখলাম। মেয়েটা কাছে এসে বলল- তুমি যে এতটা বোকা তা কিন্তু অনুমান করিনি
- মানে?
- তোমার কাছে খুচরা পয়সা আছে?
- কেন?
- আমাকে কয়েকটা টাকা দাও। খুচরা যাই থাকে দাও। এখানে কাজের আগে মজুরি দেবার নিয়ম
- কিসের মজুরি?
- এই খড়গুলো দিয়ে তাড়াতাড়ি মশালের মতো কয়েকটা আঁটি বানাও। একটাতে আগুন ধরিয়ে হাঁটতে শুরু করো
- আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না। কী বলছ এসব?
- টাকা দাওতো

পকেট হাতড়ে কয়েকটা টাকা পেলাম খুচরা। তার হাতে দিতেই সে আঁচলে গিঁট দিয়ে রাখল- তুমি এখন তামাক ব্যবসায়ী। এই তামাকের বস্তা বয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে মজুর রেখেছ। আমি তোমাকে রেল লাইন পর্যন্ত বস্তাটা দিয়ে আসব। রেল লাইনের ওপারে তোমার লোক থাকবে
- মানে?

তামাকের বস্তাটা মাথায় নিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটা- বোকারাম। তুমি কি আবারো বাজারে ফিরে যাবার চিন্তা করছ?
- তাহলে?
- আমরা পালাচ্ছি
- ফুল মিঠাই?
- খড়ের একটা গোছায় আগুন ধরিয়ে সামনে হাঁটো। লোকজন দেখলে আমাকে জোরে জোরে হাঁটার জন্য তাড়া দেবে। ...এই তামাকের নাম জানো তুমি?
- তামাকের নাম?
- বসুন্ধরা পাতা। লোকজন তোমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে কী তামাক কিনলে। জানা থাকা দরকার

খড়ের একটা গোছায় আগুন ধরিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম
- বাকি খড়গুলো মাফলারে বেঁধে পিঠের সাথে ঝুলিয়ে রাখো। আর দাওটা রাখো ডান হাতে। খোলা। আমরা বাজারের বাইরে চলে এসছি এখন
- কিরে মজুরি দিয়েছে ঠিকমতো?
একটা লোক উল্টো দিক থেকে যেতে যেতে মেয়েটিকে প্রশ্ন করল। মেয়েটি আঁচলে রাখা পয়সাগুলো বাজিয়ে শোনাল। সাথে সাথে সে প্রশ্ন করল- সামনে আরো দুটো লোক দেখলে তামাকের বস্তা মাথায়?
- না তো?
- বোধ হয় ওদের আগুন নিভে গেছে। কোথাও আগুন জ্বালানোর জন্য থেমেছে তাই দেখতে পাওনি
- হবে হয়ত। সাবধানে যাবি। পথ কিন্তু পিছলা
বলতে বলতে লোকটা পাশ কেটে চলে গেলো। আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না আর
মেয়েটা আমাকে ডাক দিলো- তোমার মাথায়তো আর এক মণ তামাকের বস্তা নেই। অত জোরে হাঁটো কেন? এই বস্তা নিয়ে হাঁটতে বুঝি কষ্ট হয় না আমার?
- তাহলে আমার কাছে দাও
- না। তাহলে চেয়ারম্যানের লোকরা রাস্তায় আটকাবে। এখানে যারাই কিছু কিনতে আসে তাদেরকে মুটে নিতে হয়। এটা এলাকার নিয়ম। এটাই এ এলাকার লোকদের একটা বড়ো পেশা। ...দেখি তোমার খড়গুলো নামাওতো

খড় নামালাম। সে বস্তা খুলে অর্ধেকের বেশি তামাক ফেলে দিয়ে বস্তার মধ্যে খড় ভরে নিল। বাকি খড়গুলো আবার আমার কাছে দিয়ে বলল- এখন বেশ হালকা। চলো

হাঁটতে থাকলাম আমরা। অন্ধকার এখন বেশ ঘন। মেয়েটা তামাকের বস্তা থেকে আরো তামাক ফেলে দিয়ে পুরোটাই খড়ের বস্তা করে নিল। বলল- এসব রাস্তা আমি রাতেও চিনি। আগুন নিভিয়ে দেশলাইটা পকেটে রাখো। কেউ জিজ্ঞেস করলে তার কাছে আগুন চেয়ে বলবে বাতাসে খড় নিভে গেছে। আর তোমার কাছে আগুনও নেই। এসো
অন্ধকারের মধ্যে মেয়েটা আমার হাত জড়িয়ে ধরল- তুমি ফুল নিতে এসেছিলে তাই না?
- হ্যাঁ
- না নিয়ে চলে যাচ্ছ যে?
- তুমিইতো নিতে দিলে না
- তুমি যা চাও তা ওখানে নেই
- খুঁজেইতো দেখিনি। জানব কী করে যে আছে কি নেই
- আমি জানি। ওখানে নেই। ওখানে মা ছাড়া কেউ আমার বয়স জানে না। ওরা জানে এখনো আমার বয়স হয়নি
- কিসের?
- আমি যাতে ওরা জানার আগেই পালাতে পারি সেজন্য মা সব সময়ই আমার বয়স লুকিয়েছে। বলেছে এখনো বহু দেরি। আর আমিও সব সময় ছোটদের পোশাক পরে থেকেছি আর ছোটদের মতো ফুল-পাতা-লতা দিয়ে খেলেছি। যাতে সত্যি সত্যিই আমাকে ছোট দেখায় আর সবাই ছোট মনে করে
- তুমি পালিয়ে কোথায় যাবে?
- যাব কেন? যাচ্ছিতো। তোমার সাথে
- আমার সাথে?
- এখানে আর কেউ আছে নাকি?

একেতো রাত। তার উপর আমরা যাচ্ছি ঘুরপথে; যাতে কারো সাথে দেখা না হয়। কিন্তু তারপরও দুয়েকবার আমাদের দেখা হয়ে গেছে কারো কারো সাথে। হয়ত আরো কেউ কেউ ঘুরপথে যেতে পছন্দ করে। তাদের সাথে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে হয়েছে। আমি বলিনি। যা বলার মেয়েটিই বলেছে। দেখা হবার সাথে সাথে সে আগ বাড়িয়ে তাদেরকে পথ জিজ্ঞেস করেছে যাতে তারা ভাবে সত্যিই আমরা অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছি। তাতে সময় আর কষ্ট দুটোই বেড়েছে দুয়েকবার। কারণ তারা পথ দেখানোর পর আমাদেরকে তাদের সাথে মূল পথে ফিরে যেতে হয়েছে। তারপর তারা চলে গেলে আবার কষ্ট করে ফিরে আসতে হয়েছে ঘুরপথে

যখন রেল টানেলের কাছে এলাম মেয়েটি খড়ের বস্তাটা ফেলে দিয়ে আমাকে টিলার দিকে উঠতে বলল- এদিকে গেলে চা দোকানের পেছন দিক দিয়ে একেবারে উঠানে বের হওয়া যাবে

ভোর হয়ে গেছে। আমরা যখন টিলার মাথায় উঠলাম তখন ওপাশের দেশওয়ালি গ্রামের লোকজন কাউকে গাই দোয়াতে আবার কাউকে দুধের পাতিল মাথায় করে নিয়ে যেতে স্পষ্ট দেখা গেলো। আমরা নামতে শুরু করলাম। পাশের একটা ঘন ঝোপের ভেতর থেকে এক মহিলা একটা দুধের পাতিলসহ হাজির হলো আমাদের সামনে। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু মেয়েটি সাথে সাথেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করে বসল- তোমাদের দুধ লাল না সাদা গো?
- লাল দুধ। আমরা গরুকে আলাদা পানি খাওয়াই না। ঘাসের সাথে গরু যে পানি খায় তাতেই আমাদের গরু দুধ দেয়
- কোথায় বিক্রি করবে?
- বিক্রি করব না। চাওয়ালার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন আমরা দশ ঘর লোক দশ পাতিল দুধ দিয়ে যাই তাকে চা বানাবার জন্য
- আমরা তার সাথে নেমে এলাম বাড়ির পেছন দিকে। সে আমাদের উঠানে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলো- তোমরা ওদিকে যাও। আমি পাকঘরে দুধগুলো পৌঁছে দিয়ে বাড়ি যাব। তারপর মেয়েটির কাছে গিয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল- তোমার সাথের মরদটা বোবা নাকি?
- কেন?
- কোনো কথা বলে না যে?
- ও বিদেশের লোক। এই এলাকার ভাষা বোঝে না বলে লজ্জায় বেশি কথা বলে না সে
- ও আচ্ছা। তাই হবে বুঝি

আমরা যখন সামনে এলাম তখন দোকানি চায়ের কাপ আর মগ সাজিয়ে বসে আছে। আমাদের দেখেই বলল- কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি আজ আমি জোড়া কাপ চা দিয়ে দিন শুরু করব। বহুদিন হয় জোড়া কাপ চা দিয়ে দিন শুরু করতে পারি না। প্রতিদিনই বেজোড় লোক থাকে। আপনারা হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমার পানি বহু আগে থেকেই গরম হয়ে আছে। দুধটাও চুলায় বসিয়েছে আমার মেয়ে। আপনাদের দিয়েই আজ শুরু করব

মেয়েটি আমাকে রাস্তা দেখাল। বাড়ির ডানপাশে একটু ঝোপের মতো। সেদিকে এগিয়ে গেলেই ঠিক নিচে একটা ঝরনা। ঝরনার পাড়ে পাথর বিছিয়ে সিঁড়ি করা। আমরা দুজন হাতমুখ ধুয়ে যখন উঠলাম মেয়েটি বলল- তোমার সাথেতো গামছা নেই। মুখ মুছবে কী করে?
- লাগবে না। বাতাসে শুকিয়ে যাবে
- তা হয় না। এলাকার বদনাম হবে। অতিথি ভেজা মুখে বাড়ির উঠানে দাঁড়ালে গৃহস্থের অপমান হয়
- এটা তোমার বাড়ি না
- আমার এলাকা
- ঠিক আছে আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি। মুখ শুকালে উঠব
- তুমি আমার সাথেই উঠবে। এই নাও
মেয়েটি তার আঁচল বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে- নাও মুখ মুছে নাও
ওর আঁচল যখন মুখে ছোঁয়ালাম তখন কড়া লিকারের চা পাতার সাথে ঘন করে জাল দেয়া দুধ মিশিয়ে চা বানালে যে ঘ্রাণ পাওয়া যায় সেই ঘ্রাণে ভরে গেলাম আমি। আমি মুখ মোছা রেখে ওর আঁচল শুঁকতে থাকলাম। এ গন্ধ শৈশবের পরে আর পাইনি। আমি ওর আঁচল মুখে চেপে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল- আমার আঁচল এভাবে আটকে রাখলে আমাকে যে খোলা বুকেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে

আঁচলটা মুখে চেপে রেখেই তাকালাম তার দিকে। চা পাতার মতো কড়া সবুজ এক নির্জন প্রকৃতি আমার সামনে। আমি আঁচলটা তাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম- নলীডোবা নয়। আমার নিজেকে বলা উচিত ছিল আমি ঝরনায় যাব
২০০৪.০৩.১৯


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

নলীডোবা ফিরে যাবার নকশাটাই তো হারিয়ে গেলো ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।