আন্ডুল

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বুধ, ১০/১০/২০০৭ - ১:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শহরটা সত্যিই আলাদা। কথাটা জেনেছিলাম ক্লাস এইটে নিজের শহর নিয়ে বই থেকে মুখস্থ রচনা লিখে স্যারের ঝাড়ি খাবার পর। স্যার শুরু করতেন বেকুবের দল বলে- বেকুবের দল চউখের হান্ড্রেড পার্সেন্ট ব্যবহার করে মাইয়াগো পিঠ আর বুক দেখতে... ছড়া কাটে- পাছাটা চল্লিশ। কিন্তু নিজেগো চউখে চাইলশা। বুঝিস? কুষ্ঠি হবে কুষ্ঠি। তোদের চউখে কুষ্ঠি হবে। সারাদিন টো টো করে ঘোরে কিন্তু দেখে না কিছু। খালি তাকায় গডগড কইরা। নিজের বাড়িতে গরু রাইখা আইসাও গরু নিয়া রচনা লিখতে কইলে বই বিছরায়। পঙ্গুর দল। লুলা ফকির হালারা

দ্বিতীয় স্যারের রাগ গেয়ার সিস্টেম। ট্রাকের মতো। শুরু করেন ফার্স্ট গেয়ারে বেকুব দিয়ে। টপ গেয়ারে উঠলে পৌঁছে যায় বাপ দাদায়। ইস্কুলে বাপ-দাদা তুলে গালি দেবার ঠিকাদারি তার একার। হোক সে ছাত্র অথবা শিক্ষক। তিনি অনেকের আগের জেনারেশনেরও দ্বিতীয় স্যার। এই শহরটা নাকি যখন জঙ্গল ছিল তখন থেকেই তাদের পরিবার এখানে বাস করে। আমরা অবশ্য বলি স্যারের পূর্ব পুরুষ জঙ্গলে শিয়ালের পায়খানা পরিষ্কারের চাকরি নিয়ে প্রথম এখানে আসে। তারপর সুবিধা বুঝে লুঙ্গি বিছিয়ে জায়গা দখল করে এখন শহর-কুতুব বনে গেছে। শহর-কুতুব হবার কারণে প্রায় সবারই বংশ লতিকা স্যারের মুখস্থ। মাঝেমাঝে সেগুলো টেনে রাগের গেয়ার বক্সে লুব্রিকেন্ট হিসেবে ব্যবহার করেন- তোর বাপেওতো একটা ছাগল আছিল। এখন হইছে বলদ। ইস্কুলে আসবি একটু ফিটফাট হইয়া আয়? না। তলপেটের নিচে লুঙ্গিটা কোনোমতে আটকাইয়া আইয়া পড়ল। তারপর হাঁটতে খোলে তো বসতে খোলে। ...এখনতো হেয় শিকল দিয়া বাইন্ধাও নাভির উপরে লুঙ্গি রাখতে পারে না। ঠিকাদারি কইরা পেটটারে এমন গামলা বানাইছে যে মিলিটারি বেল্ট দিয়া বানলেও লুঙ্গি পিছলাইয়া ধনের আগায় আইসা পড়ে। হের পোলা তুই। মানুষ হইবি কেমনে?

স্যারের ইঞ্জিনটা বেডফোর্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বার্মায় যুদ্ধ করতে এসে মিলিটারিরা যে ট্রাকগুলো ফেলে গিয়েছিল ওগুলো দিয়ে নাকি পরে মুড়ির টিন বাস বানিয়ে জেলা টু থানা ট্রিপ টানা হয়। ওগুলো যেমন টপে উঠলে কাঁপতে থাকে গোঁ গোঁ করে। স্যারও সমানে মুখ দিয়ে থুতু ছিটাতে থাকেন। তখন কার বাপ কী ছিল আর কার দাদা কী ছিল সেটা খেয়াল করার চেয়ে বরং হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকতে ব্যস্ত থাকি আমরা। বিশেষত সামনের তিন বেঞ্চে যারা বসে

স্যারের নাম কেউ জানে না। হেডস্যারও তাকে দ্বিতীয় স্যার বলেন। আমরা অনেকেই এই নামটা ইস্কুলে ভর্তির আগে বাড়িতে শুনেছি। বাংলা দ্বিতীয়পত্র পড়ান বলেই সারা শহর তাকে এই নামে জানে। ...রচনার খাতা দেখে স্যার থার্ড গেয়ারে উঠে আবার নিউট্রেল করলেন- টাউনে থাইক্কা- সারাদিন টাউনে চক্কর দিয়া সাইরাও যুদি নিজের শহর নিয়া রচনা বই থাইকা মুখস্থ কইরা লেখন লাগে। তয় হইবডা কেমনে? ঘর থাইকা বাইর অইবার সময় কি চউখ দুইডা বাইত রাইখা বাইর অও? ...শুনো। খালি তাকাবা না। দেখবা। ...ওই হালারা তাকানো আর দেখার মইধ্যে পার্থক্য বুঝস?

ডিরেক্ট থার্ড গেয়ার। কেউ বুঝলেও উত্তর দেয় না। উত্তর সঠিক না হলে এক লাফেই গেয়ার চলে যাবে টপে। স্যার একটু থেমে সেকেন্ড গেয়ারে নামেন- লুলা ফকিরের দল। লুচ্চামিতো শিখা ফালাইছ পুটকি থাইকা ফুল পড়ার আগে। নামতা পড়ো; না? ছেমড়ি কোঠার নামতা? পাছাটা চল্লিশ- বুকাটা ছত্রিশ- রানাটা ঊনত্রিশ? ছি ছি ছি। মাইনষে নামতা শিখে অংক করার লাইগা। আর তোরা নামতা করস মাইয়াগো শইল মাপতে? ...ওই হালারা মাইয়ার পাছা চল্লিশ হউক আর বিয়াল্লিশ ইঞ্চি হউক তোগের কী? ছুইতে পারবি? তোগো মতো পোলারে হেই মাইয়ারা ধনও মনে করে না। তোরা হেগোর কাছে নুনু। নুনু আর ধনের পার্থক্য বুঝস?

আমরা সবাই একসাথে হেসে উঠি। এইবার এক লাফে টপ উঠে যাবার কথা। কিন্তু স্যার গেয়ার নিউট্রেল করেন- হেইডাতো ঠিকই বুঝো ...শোনো তাকানো হইল চউখ বুলানো। আর দেখা হইল চউখের সামনের কোনো একটা বিষয়রে গভীরভাবে অনুভব করা। বিশ্লেষণ কইরা সেই জিনিসের অর্থ নিজের মতো কইরা নিজের ভিতরে ধারণ করা। যতদিন পর্যন্ত না কোনো জিনিসের নিজস্ব অর্থ নিজের মইধ্যে তৈরি করতে পারবা ততদিন পাঠাই থাকবা। মাইনষের পূজার কামে বলি হইবা। নিজে পাইবা ধনডা। ...স্যার থামেন। থামার দুটো অর্থ আছে। হয় আবার ছেমড়ি কোঠার নামতা ধরে এক লাফে উঠে যাবেন টপে। না হয় নিউট্রেল

ছেমড়ি কোঠার নামতাটা আমরা কেউ বানাইনি। স্কুলে এসেই শিখেছি। কে যে কার কাছ থেকে শিখেছে তা আবিষ্কারের জন্য গবেষণা দরকার। তবে আমাদের যাদের বাবারা এই স্কুলে পড়তেন তারাও এই নামতা জানতেন কনফার্ম। অন্য স্কুলের ছেলেরাও জানে। সুতরাং পল্লিগীতির মতো এর নামতাকারও অজ্ঞাত। সবগুলো বয়েজ স্কুলেই ছেলেরা নিজেদের উদ্যোগে এরকম নামতা শেখে আর শেখায়। কম্বাইন্ড অথবা গার্লস স্কুলে কী করে জানি না। কিন্তু আমরা করি। মাঝেমাঝে ক্রিয়েটিভ কেউ কেউ এটাকে অনুকরণ করে দুয়েক লাইন নামতা কিংবা ছড়া নিজেই বানায়। যেমন- মাইয়া একে মাইয়া/ বড়ি-কনডম লইয়া/ বাড়ি বাড়ি যাইয়া/ কাম খুঁজে কাম। ...এটা আমাদের একজনের মৌলিক রচনা; শিরোনাম- আত্মকর্মসংস্থান। কিন্তু এ ধরনের রচনা কেন জানি বেশি জনপ্রিয়তা পায় না। দুয়েকদিন চলে তারপর আবার বাদ পড়ে যায়। হয়ত আমাদের এইসব নামতাকাররা অত বেশি ক্রিয়েটিভ না। তাই

আমরা অপেক্ষা করছি স্যারের টপ গেয়ারের। কিন্তু স্যার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলে তিনি একেবারে চোস্ত বাংলায় কথা বলেন। আমরা বলি শান্তিনিকেতনি বয়ান- শোনো বাছারা; পর্যবেক্ষণের উপরে কোনো শিক্ষা নাই। কিন্তু পর্যবেক্ষণকে উপলব্ধিতে রূপান্তর করতে হয়। একেক মানুষের পর্যবেক্ষণ আর উপলব্ধি ভিন্ন বলেই মনুষ্য সমাজে উপলব্ধির এত তারতম্য। একই পুষ্পের দিকে তাকিয়ে কেউ দেখে কাঁটা কেউ দেখে পাপড়ি। কিন্তু সকল মৃগই পুষ্পকে খাদ্য হিসেবে দেখে। কেউ তাতে সৌন্দর্য যেমন খুঁজে পায় না। কোনো যন্ত্রণার উৎসও পায় না। সেজন্যই তাদের নিয়তি হলো মানুষের ইচ্ছার উপর জীবন ধারণ করা। মানুষের প্রয়োজন মেটানো। ...তোমরা মনুষ্য সন্তান। তোমাদের পিতামাতারা হাতের মুঠোয় প্রাণ ধারণ করে তোমাদের পাঠিয়েছে মানুষ হবার জন্য। তোমরা যদি ছাগশিশুই থাকো তবে আমরাইবা তাদের কাছে কী জবাব দেবো? ...মানুষ হতে হলে চেষ্টা লাগে। ...শুধু গতর-খাটনিরে চেষ্টা বলে না। মানুষের চেষ্টা মানে তার মস্তিষ্কের চেষ্টা। ...স্যার বন্ধ ইঞ্জিনে হঠাৎ থার্ড গেয়ার দিয়ে বসলেন- ওই হালারা এই শহরের বাইরে আর কে কোন টাউনে গেছিস হাত তোল

যারা যারা অন্য শহরে গেছে হাত তুলল। স্যার জানতে চাইলেন কে কীভাবে গেছে। কেউ বলল বাসে। কেউ বলল ট্রেনে। কেউ বলল লঞ্চে চড়ে গেছে। ...স্যার হাসলেন। ...তাইলে? তাইলে চুদির পুতেরা নিজের শহরের রচনা লিখতে কইলে বই দেইখা মুখস্থ কইরা লিখতে হয় ক্যান?

বুঝলাম না কিছুই। স্যার আবারও নিউট্রেল করলেন। অন্য টাউনের মানুষগো জিগাইয়া দেখিস তারা নিজের শহর থাইকা অন্য শহরে গেলে কেমনে যায়। দেখবি যে কইব লঞ্চে যায়। সেই শহরের অন্যরাও লঞ্চেই যায়। কিন্তু... আমাগো শহর। যাতায়াতের তিনটা ব্যবস্থাই বিদ্যমান। এইটা কি একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য না রে লুলা ফকিরের দল? বাংলাদেশে কয়টা টাউন আছে এমন? অই উচা হোটেলডার ছাদে গিয়া খাড়াবি। দেখবি ডাইনে লঞ্চঘাটে লঞ্চ আইতাছে। সোজা তাকাবি দেখবি ট্রেইন ছাইড়া যাইতাছে। তারপর তাকাবি বামে। বাস স্ট্যান্ড। ...খেয়াল করছস কোনোদিন?

আমরা খেয়াল করিনি কিন্তু তিনটা জিনিসই আছে তা জানি। বহুবার গেছিও। স্যার বলার পর খেয়াল করলাম। আর এও জানলাম যে বাংলাদেশে খুব কম শহরেই আছে এই জিনিস। স্যার যোগ করলেন- বাংলাদেশে অন্য কোনো শহরে যাতায়াতের এই তিন ব্যবস্থা থাকলেও এক জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে তিনটাকে দেখা যায় না। এটা একমাত্র আমাদের শহরেই সম্ভব

এরপর থেকে আমরা মনে মনে চাইতাম সবগুলো পরীক্ষাতেই শহর বিষয়ক রচনা আসুক। লেখা কাহাকে বলে আর কাহাকে বলে আমাদের শহর দেখিয়ে দেবো। কিন্তু এসএসসি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাতেই এই রচনাটি এল না। তারা হয়ত বুঝে গেছে যে আমরা সবচেয়ে বেশি নম্বর পাব। এইজন্য দেয়নি। যারা পরীক্ষার প্রশ্ন করে তারা সব বড়ো বড়ো নামকরা ইস্কুলের মাস্টার। তারা চায় তাদের ইস্কুলই ভালো রেজাল্ট করুক। এজন্য নাকি তারা প্রশ্ন করার আগে খোঁজ নেয় তাদের ইস্কুলের ছাত্ররা কোন কোন প্রশ্নের উত্তর ভালো করে লিখতে পারবে। সেভাবেই প্রশ্ন করে। হয়ত সারা বাংলাদেশেই হালারা খোঁজ করে দেখেছে নামীদামি কোনো ইস্কুলের ছাত্রই আমাদের শহর বিষয়ে রচনা লিখতে পারে না। তাই দেয়নি। ...অবশ্য সেদিনের পরে আমাদের অনেকেই বাংলা দ্বিতীয়পত্র বই থেকে রচনা অংশটি কেটে ফেলে দিয়েছিল। খামাখা মোটা বইয়ের বাড়তি ওজন টানার কী দরকার? রচনা পড়তে হয় না। রচনা শুধু লিখতে হয়। কারণ তখন স্যারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সবকিছু দেখার চেয়ে আমরা পর্যবেক্ষণ করি বেশি। স্যারের পূর্বপুরুষ যে শিয়ালের হাগু পরিষ্কার করত তাও আমাদের পর্যবেক্ষণেরই ফল। অবশ্য স্যারের আরো একটা সতর্কবাণী আছে- লিখতে হলে চাই সঠিক বাক্য গঠন

আমাদের ইস্কুল থেকে বছরে মেট্রিকে যতজন পাশ করে ফেল করে তার থেকে অনেক বেশি। কিন্তু যত কম নম্বর পেয়েই ফেল করুক না কেন বাংলা দ্বিতীয়পত্রে আজ পর্যন্ত কেউ পঞ্চাশের নিচে পায়নি। স্যারের বিভিন্ন গেয়ারের ঝাড়ি খেয়ে একেবারে পোকায় খাওয়া ছাত্রটিও সঠিক বাংলা বাক্য গঠনে পুরোদস্তুর কামেল। যদিও এই ইস্কুলের ইতিহাসে স্যারের হাতে বাংলা দ্বিতীয়পত্রে কেউ পাশ করার কোনো ইতিহাস নেই। ক্লাস সিক্স থেকে এসএসসির টেস্ট পরীক্ষা পর্যন্ত স্যারের হাতে কেউ পাশ করেনি কোনোদিন। এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথাও নেই। হেডস্যার কিংবা বাড়ির বড়োরাও যখন রেজাল্টের জন্য ঝাড়ি দেন তখন দ্বিতীয় স্যারের বাংলা দ্বিতীয়পত্র বাদ দিয়েই বলেন। কারণ ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে স্যারের হাতে যে ২০ পায় সে এসএসসিতে পায় ৫৫। ২১ পেলে ৬০। একবার স্যারের হাতে একজন ২৫ পেয়েছিল। সে এসএসসিতে সেকেন্ড ডিভিশন পেলেও বাংলা দ্বিতীয়পত্রে পায় লেটার মার্ক। সে এখন এই শহরেই একটা মুদি দোকান দেয়। আমরা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে তার দোকানের নাম দিয়েছি শেরে বাংলার দোকান। ...আমরা হিসাব করে দেখলাম স্যারের হাতে যদি কেউ ৩৩ পায় তবে এসএসসিতে তাকে ১০০র মধ্যে পেতে হবে দুইশো। ...থাক বাবা দরকার নেই। দ্বিতীয় স্যারের খাতায় আমাদের সর্বোচ্চ টার্গেট ২১

আমাদের ইস্কুল শেষ হয়ে গেলো। বাংলা দ্বিতীয়পত্রে ১১জন পেলো ফার্স্ট ডিভিশন নম্বর। এদের মধ্যে চারজন এসএসসিতে ফেল। তাতে আমাদের কিংবা ফেল করাদের কিছু যায় আসে না। ওরা যে যে বিষয়ে ফেল করেছে সেই সেই বিষয়ের স্যারদেরকে সামলাতে হবে দ্বিতীয় স্যারের বিভিন্ন গেয়ারের বয়ান। হেডস্যারও বাদ যাবেন না। সাধারণত প্রতিটি এসএসসির রেজাল্টের পরেই স্কুলে রেজাল্ট পর্যালোচনা মিটিং বসে। হেডস্যার চেষ্টা করেন এই মিটিং থেকে দূরে থাকতে। এই দিনে দ্বিতীয় স্যারের বেডফোর্ড ইঞ্জিন হেডস্যার-হুডস্যার মানে না- ফকিরনির পুতেরা কোর্টের প্যাদা হওনের যোগ্যতা নাই; হইছে মাস্টার। ...পোলারা যুদি নিজেরা পাশ করতে পারত তাইলে তোগো ধন চুষতে ইস্কুলে আহে? এইবার হেডস্যারের দিকে ফিরে- এগো জরিমানা করা দরকার। যার পেপারে একটা ছাত্র ফেল করব তার এক মাসের বেতন কাটা। তুমি এই মাসেই জরিমানা চালু করো। ...হালারা শিক্ষকের মর্যাদা চাইবা কিন্তু দায়িত্ব নিবা না?

হেডস্যার এই মিটিং থেকে পালান। কোনোদিন পেটের অসুখ কোনোদিন বাচ্চা অসুস্থ বলে। হেডস্যারের চাচা আর বড়ো ভাই দ্বিতীয় স্যারের ছাত্র। ছোটবেলায় মা মারা যাবার কারণে হেড স্যারের স্কুল লাইফ কাটে মামা বাড়িতে। না হলে তিনিও দ্বিতীয় স্যারের ছাত্র হতেন। অবশ্য দ্বিতীয় স্যার হেডস্যারকে নিজের ছাত্রই ভাবেন। আর বংশের মুরব্বিদের স্যার বলে হেডস্যারও দ্বিতীয় স্যারকে তা ভাবতে বারণ করার সাহস করেন না। তাতে না আবার কোন সময় বংশের ছাগল আর গাধাদের তালিকা প্রকাশ হয়ে পড়ে কে জানে। থাক বাবা। সারা শহরের যিনি দ্বিতীয় স্যার। তিনি না হয় তারও স্যার হলেন

একবার দ্বিতীয় স্যার ছুটিতে থাকা অবস্থায় এই পর্যালোচনা মিটিং হয়েছিল। সেদিন হেড স্যারের পেটের অসুখ কিংবা বাচ্চার কোনো অসুখ ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় স্যার ফিরে এসে বললেন তিনি যদি জানতেন রেজাল্ট পর্যালোচনা মিটিং হবে তাহলে ছুটি নিতেন না। ওই মিটিংয়ে তার কিছু বলার আছে। সুতরাং মিটিং আবার হবে। ...হেডস্যার একবাক্যে মেনে নিলেন। গাইগুঁই করলে ফেঁসে যাবেন। স্কুলে রেজাল্ট পর্যালোচনা মিটিং হবে অথচ যার ছাত্ররা সবচেয়ে ভালো করল তাকে জানানো হয়নি কেন? এই প্রশ্ন যদি দ্বিতীয় স্যার করে বসেন? সুতরাং হেডস্যার আবার মিটিং ডেকে সেই দিন নিজের কিংবা বাচ্চার একটা অসুখ বাঁধিয়ে আর স্কুলে এলেন না

শুনেছি অনেক স্যারই এসএসসির রেজাল্টের আগে মিলাদ দিতেন যাতে দ্বিতীয় স্যারের পেপারে একটা ছাত্র হলেও ফেল করে। আর যখন অন্য স্কুলে পরীক্ষা ডিউটি পড়ত তখন খামাখাই তারা বাংলা দ্বিতীয়পত্রে যে কোনো একটা ছেলে বা মেয়েকে বহিষ্কার করার সুযোগ খুঁজতেন। একবার একজন এসে বেশ গর্ব করে বললেন- বাংলা সেকেন্ড পেপারে আজ তিনটাকে এক্সপেল করেছি। দ্বিতীয় স্যার আশেপাশে ছিলেন। সোজা ধরে বসলেন কলারে- খানকির পুত। খুব সওয়াবের কাম করছ না? ওই তিনডা পোলার একটা কইরা বছর ফিরাইয়া দিবার পারবি? ...পোলারা নকল করে কেন? করে তোগো মতো খানকির পুতেরা মাস্টার এই কারণে; করে তোগো মতো শিক্ষিত চুদির পুতেরা এমন সাউয়ামারানি সিস্টেম কইরা রাখছে এই কারণে। ...আরেকদিন শুনলে বিচি দুইটা খুইলা হাতে ধরাইয়া দিমু। ...আমার কোনো পোলা নকল করে?

স্যার জীবনে কোনো ছাত্রী পড়াননি। ছাত্র বলতেই পোলারা বলেন। পরীক্ষার হলে তার ডিউটির সময় কাউকে নকল করতে দেখলে কাছে গিয়ে বলেন- পুতেরা। পাশতো করা লাগবই। কিন্তু আমাদেরও যে ডিউটি করা লাগবে সেইটাও একটু মাথায় রাইখো

মার্কশিট দেবার দিন দ্বিতীয় স্যার সেজেগুজে আসতেন। ফেল করা ছাত্রদেরও খবর দিতেন এসে মার্কশিট নেবার জন্য- নিজেরই সবার আগে দেখা দরকার কোন জায়গায় দুর্বলতা আছে। আসিস। পরীক্ষায় একবার ফেল করলে দশবার পাশ করা যায়। আসোল পাশ-ফেল জীবনে। সেইখানে চান্স মাত্র একবার

পাশ করা ছাত্ররা মার্কশিট নিতো হেডস্যারের হাত থেকে। আর ফেল করা ছাত্রদের মার্কশিটগুলো খুব যতœ করে তুলে দিতেন দ্বিতীয় স্যার। এই সময় দ্বিতীয় স্যার ছাড়া কেউ কোনো কথা বলত না। ছোট হেডস্যার একটা একটা করে মার্কশিট তুলে দিতেন হেডস্যার কিংবা দ্বিতীয় স্যারের হাতে। তিনি দ্বিতীয় স্যারের সরাসরি ছাত্র। পাশ করাদের মার্কশিট দেয়া শেষ হয়ে গেলে দ্বিতীয় স্যার একজন একজন করে ডাকতেন- বাংলা দ্বিতীয়পত্রে সেভেনটি টু। সাবাস। তারপরেই জিবে কামড় দিতেন- সাধারণ গণিতে ছাব্বিশ; ...খানকির পোলা যে কোন বালটা পড়ায়। তারপর হয়ত আরেকজন- ইস আর দুই পাইলেইতো কাম বানাইছিলি। লেটার মার্ক। ইংরেজিতে খারাপ; ...শোন ডিসি ফুডে চাকরি করে রতন। আমার ছাত্র। ওরে গিয়া আমার কথা কইবি। তোরে ইংরেজি দেখাইয়া দিবো। হেয় ইংরেজি খুব ভালো পারে। তার অফিসাররাও তারে দিয়া ইংরেজি চেক করায়

এইদিন দ্বিতীয় স্যার ক্লাস নিতেন না। সারাদিন থাকতেন ছাত্রদের সাথে। ছাত্রদের সামনে স্যারের বেডফোর্ড ইঞ্জিনটি বন্ধ থাকত সারাদিন। শুধু যে যে বিষয়ে ছাত্ররা ফেল করেছে সেই টিচারদের সামনে পেলেই একলাফে চলে যেত টপ গেয়ারে। ক্লাসে ক্লাসে নিয়ে গিয়ে জুনিয়রদের সামনে বিদায়ি ছাত্রদের বিভিন্ন গুণের কথা বলতেন। যারা ফেল করেছে তাদেরও। স্কুলের পিওন দপ্তরিদের ডেকে বলতেন- এরা যে পাশ করছে তাতে তোমাদেরও অবদান আছে। পোলাগোরে দোয়া করো; ...বাচ্চা পোলাপান। কোনোদিন কোনো কারণে কষ্ট দিলে মনে রাইখ না। পেছনে বদ-দোয়া নিয়া যেন আমার পোলারা সামনে না যায়

মার্কশিট আনার দিন ছুটিরও অনেক পর পর্যন্ত দ্বিতীয় স্যার আমাদের সাথে আড্ডা দিলেন। আড্ডাইতো। পাশ করা ফেল করা সব ছাত্র একসাথে। স্যার হাসছেন। বললেন- ছাত্ররা বাসায় গেলে তোদের ভাবী খুশি হয়। ভাবী? স্যারের বৌকে কী ডাকা যায় তা নিয়ে আমরা কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। না ঘামিয়েই ধরে নিয়েছিলাম হয় চাচি না হয় নানি হবেন তিনি। কিন্তু স্যার বললেন ভাবী। ...দ্বিতীয় স্যার সত্যিই বদলে গেছেন

আমরা স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করলাম স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে। স্যারকে কেমন মনমরা দেখাল- পুতেরা। একটা কথা মনে রাইখো। ইস্কুল কলেজ থাইকা মানুষ মূলত কিছুই শিখে না। ইস্কুল কলেজে শুধু কেমন কইরা শিখতে হয় সেই রাস্তাটা শিখে। চউখ কান খোলা রাখবা। দেখবা শিখার লাইগা বই মুখস্থ করতে হয় না। প্রতিটা জ্যান্ত মানুষই একেকটা বিশ্বকোষ; ...মানুষ দেখবা। যে যত বেশি মানুষ দেখার ক্ষমতা অর্জন করতে পারবা সেই তত বেশি শিক্ষিত হইবা। যাও পুতেরা; ...সামনে যাও

স্যার স্কুলেই থাকলেন। ছাত্ররা বাড়ি গেলে স্যারের বৌ খুশি হন জেনেও আর যাওয়া হলো না স্যারের বাড়িতে। সম্ভবত স্যারের শেষ কথাটাই সত্য। সামনে যাও। এখন আর দ্বিতীয় স্যার কিংবা স্কুল নিয়ে বছরে একবারও ভাবি না আমরা

আমরা সবাই একটা কলেজেই ভর্তি হয়েছি। এখন পরিবারের লোকজনের দৃষ্টিও বদলে গেছে। এলাকার লোকজনেরও। কলেজে পড়ি কথাটা জানার পর পাবলিক আমাদের কিছুটা বাড়তি দাম দেয়। আগে যেখানে আড্ডা দিতে গেলে পাড়ার লোকরাই ধমকে বাড়ি পাঠাতো তারাই এখন আমাদের দেখলে অন্যদিকে তাকিয়ে পাশ কেটে যায়। আমাদের যাতায়াতও বেড়ে গেছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। সঙ্গে বিড়ি

কলেজটা কো-এডুকেশন। বিশ-পঁচিশটা মেয়েও পড়ে আমাদের সাথে। মেয়েদের সাথে আমাদের খাতির ঠিক জমে না। বন্ধুবান্ধবও বাড়ে না। আমরা যারা এক স্কুল থেকে এসেছি ঘুরে ফিরে তারাই একসাথে থাকি। অবশ্য মেয়েদের সাথে মেশার কিংবা প্রেম করার চেষ্টা যে করিনি তা নয়। ভালোভাবেই করেছি। ...ক্লাসের কয়েকটা মেয়ে আছে নাটক-ফাটক করে। ওরা বেশ ফ্রি। আড্ডা টাড্ডা দেয়। তাদের সঙ্গে খাতির জমাতে গিয়ে দেখলাম আরেক বিপদ। প্রায় সব ক’টাই প্রেম করে। এবং তাদের প্রতিটা প্রেমিকই হয় হারমোনিয়াম বাজানো জানে। না হয় গলাকে মোটা করে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে কবিতা পড়তে পারে

কেউ কেউ হারমোনিয়াম শিখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাস্টাররা সহজে হারমোনিয়াম শেখায় না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে বসিয়ে সারেগামা করতে বলে। আরে শালা আমরা শিখব হারমোনিয়াম বাজানো। সেখানে সারেগামা গাওয়ার দরকারটা কী? ...কয়েকজন নাটকে ঢোকার চেষ্টাও করেছে। সেটাও একই রকম। ওরা নতুন কাউকে পেলেই লোকজনের সামনে উচ্চারণের ভুল ধরে। টিটকারি মারে। স্বরে-অ স্বরে-আ এইসব পড়তে বলে। তার উপর আছে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে পিটি করানো। তাতেও অসুবিধা ছিল না। না হয় বাংলা বর্ণমালা আবার শিখব। পিটি করব। সারেগামাও শেখা যাবে। ...আমরা মোটামুটি প্লান অনুযায়ী আগাচ্ছিলাম। প্রথম টার্গেট ক্লাসের বিশ্ব সুন্দরী সুমি। আমাদের কথা হলো আমাদের যে কারো সাথে যদি সুমির ইয়ে হয়ে যায় তবে বাকি মেয়েগুলো আপনাতেই আমাদের খাতির করবে। মেয়েরা এমনিতে কাউকে পাত্তা দেয় না। কিন্তু যদি দেখে কারো সাথে অন্য কোনো মেয়ে প্রেম করে তাহলে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ...সুমি নাটক করে। একদিন টিকিট কিনে আমরা ওর নাটক দেখলাম

এগুলোর নাম নাকি নাটক। মানুষও পয়সা দিয়ে এসব দেখে। যে জায়গায় রাজবাড়ি সেই জায়গাতেই রাস্তা। সেখানেই কাঠের কুড়াল নিয়ে কাঠুরিয়া কাঠ কাটতে যায়; সেটাই জঙ্গল। আজব সিস্টেম। চিৎকার করে করে কথা বলে। ছেলেগুলোর ঠোঁটেও লিপস্টিক; মুখে ফেস পাউডার। লাইট একবার জ্বলে আরেকবার নেভে। একবার এক কোনার লাইট জ্বললে আরেক কোনার লাইট নিভে যায়। মানুষতো পয়সা দিয়ে সব কিছু দেখার জন্যই টিকিট কেটেছে। কিন্তু এই যন্ত্রণার কারণে একসঙ্গে স্টেজের এক কোনার বেশি দেখা যায় না। হালাদের চৌদ্দ গুষ্টির কেউ কারেন্টের বাতি জ্বালায়নি মনে হয়। একটা ইলেকট্রিশিয়ানকে ডাকলেওতো হয়। ...শালাদের অবশ্য বুদ্ধি আছে। লাইট নিভে গেলে লোকজন যাতে ক্ষেপে না যায় সেজন্য ভেতর থেকে ঢোল বাজায়। বাঁশি আর হারমোনিয়াম বাজায়

এরকম অত্যাচারও মানুষ নিজের উপর করে? কিন্তু কী আর করা। সুমির নাটক। ...সুমি আসল অনেক পরে। সে কাঠুরিয়ার মেয়ে। বনে কাঠুরিয়ার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। জঘন্য। শাড়ি একটা পরেছে মনে হয় ওর পেটের উপরে শাড়িটাকে জড়ো করে গিঠঠু মেরে দিয়েছে কেউ। ওর বুকের সাইজ থেকে নাভির উপরে শাড়ির গিঁট অনেক বেশি বড়ো। এদের মধ্যে মনে হয় শাড়ি পরাও জানে না কেউ। সুমির শাড়ি পেছন দিকে উঠে আছে আধ-হাত। আর সামনের দিকে কলা পাইকারদের লুঙ্গির খুঁটের মতো মাটিতে গড়াচ্ছে আরো আধা হাত। মাড় দেয়া সুতি শাড়ি। শাড়িটা চারদিকে এমন ভাবে ছড়িয়ে আছে যে মনে হচ্ছে সুতা দিয়ে বানানো মুরগির খাঁচার মধ্যে সুমি ঢুকে বসে আছে। ...আর অভিনয়...। বাপের দিকে যখন কথা বলে তখনও তাকায় দর্শকদের দিকে। ...শালি এই অত্যাচারও সহ্য করছি তোর জন্য। ...কথাটা বুঝলেই হয়

প্লানিং অনুযায়ী নাটকের শেষে সুমিকে কংগ্রেচুলেট করতে গেলাম তার দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য। ...বাট। ...কিন্তু। ...না গেলেই ভালো ছিল। ...সুমি ম্যারিড। ...ও তার স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। মিলিটারি অফিসার। টাইয়ের সাথে দারুণ একটা কোট লাগানো। পরে জেনেছি ওই ধরনের কোটকে নাকি ব্লেজার বলে। বুঝলাম বেইল নাই। আমরা কেউই টাই পরা জানি না। ...আমরা কোনোমতে ফিরে আসার ধান্দা করতে না করতেই মিলিটারিটা সবার সাথে হ্যান্ডশেক করল। মনে হলো যেন ঝাঁকিয়ে হাতটাই ছিঁড়ে ফেলবে। তারপর- সি ইউ অল। বাই। বলে সুমির হাত ধরে একটা গাড়িতে উঠে গেলো

বাদ। নাটক হারমোনিয়াম আর মেয়েদের সঙ্গে খাতির। বাদ

আমাদের প্রত্যেকেরই বাইসাইকেল ছিল। প্রথম প্রথম সাইকেলে করেই কলেজে যেতাম। কিন্তু দেখলাম সাইকেল চালানো ছেলেদেরকে মেয়েরা গাঁইয়া ভাবে। এজন্য আর সাইকেল নিয়ে কলেজে ঢুকতাম না। সাইকেলগুলোকে দূরে একটা দোকানের সামনে রেখে নোটবুকটা হাতে নিয়ে হেঁটে কলেজে ঢুকতাম। তার পরেও টাউনের লোকরা আমাদের বলত গাঁইয়া। তাদের কথা হলো পৌরসভার বাসিন্দা হলেই টাউনের লোক হওয়া যায় না। টাউনের লোক হতে হলে অনেক মডার্ন হতে হয়। আমরা গ্রামের লোক কথাটা না মানলেও আমরা যে মডার্ন না তা কিন্তু ঠিক। আমরা বিদেশি পোশাকের ব্রান্ডের নাম জানি না। পারফিউম চিনি না। হলিউডের নতুন সিনেমা দেখি না...। আরো অনেক ঘাটতি আমাদের। সবচেয়ে বড়ো ঘাটতি হলো ফাস্টফুডের দোকানের প্রায় কোনো আইটেমেরই নাম জানি না আমরা। দোকানে গেলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে এটা দেন ওটা দেন বলে চালাতে হয়। ...তো কী আর করা? আমরা কলেজে গিয়েও আমরা-আমরাই থেকে গেলাম

কলেজে সাহিত্য ফাহিত্য সবই টাউনের ছেলেদের দখলে। পলিটিক্সের কিছু লোক ছড়া আমাদের কেউ পাত্তা দেয় না। স্যাররাও না। পলিটিক্সের লোকজন আমাদের খাতির করার কারণ হলো এক গ্র“পে আমরা অনেকজন। কিন্তু আমরা অনড়- না ভাই পলিটিক্স পয়সাওয়ালাদের জন্য। তাছাড়া কে জানে পলিটিক্সের নামে আবার কোথায় নিয়ে গিয়ে সারেগামা কিংবা স্বরে-অ স্বরে-আ পড়াবে। ...সুতরাং বাদ। বাদ। ...আমরা ঘুরি। ঘুরি সাইকেলে। সারা শহর। মাঝেমাঝে শহরের বাইরেও চলে যাই। যখন বসি তখন গিয়ে বসি হয় রেল স্টেশন; না হয় বাস স্ট্যান্ড; না হয় লঞ্চঘাটে। দ্বিতীয় স্যারের ভাষায় টাউনের যে বৈশিষ্ট্য অন্য সব টাউন থেকে আলাদা সেই স্থানগুলোই হয়ে উঠে আমাদের আড্ডার জায়গা। প্রতিদিন যাই। কেউ না গেলে একাই যাই। এসব জায়গায় একা বসে থাকলেও একা মনে হয় না। সব সময়ই আশেপাশে প্রচুর লোক। রং বেরংয়ের মানুষ। কত কিসিমের আচরণ। একেকজনের হাঁটা চলা কথা বলা আরেকজন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেউ একটুতেই ভয় পায় আবার কেউ অন্যকে ভয় দেখায়

ক্লাস এইটে দ্বিতীয় স্যার বলেছিলেন শহরের এই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তাতে কী হয় তা বলেননি। আমরাও খুঁজিনি। এইসব বিষয় খোঁজ না করেও নিজের শহর বিষয়ক রচনা লেখা যায়। অথবা এর যে কোনো মানে থাকতে পারে তাও মাথায় ঢোকেনি আমাদের। ঢুকিয়ে দিলেন শাহাবুদ্দিন ভাই

তিনি পলিটিক্স করেন। ছাত্র নন; ছাত্রনেতা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল। সংক্ষেপে বাসদ। বাসদ লিখে ব্রাকেটে মাহবুব লিখতে হয়। মাছুয়াদের মতো চেহারা আর ডাকাতের মতো চোখ হলেও লোকটাকে পছন্দ করার মতো কী যেন একটা আছে। পাতি নেতাদের কাছে আমাদের খবর শুনে তিনি একদিন এলেন কথা বলতে। সরাসরি তুমি দিয়ে কথা শুরু করলেন। গলাটা ক্যাটক্যাটে কর্কশ এবং কাউকাউ করে কথা বলে লোকটা। কিন্তু প্রতিটা শব্দ একেকটা বুলেট। গেঁথে যায়- আমি তোমাদেরকে আমার দলে যোগ দেবার কথা বলতে আসিনি। বলতে এসেছি তোমরা কোন কোন দলে যোগ দেবে না
- তাতে আপনার সমস্যা কী?
- তোমরা আমার দেশের ছেলে। আমাকে পছন্দ করো আর নাই করো তোমাদের বাঁচিয়ে রাখা আমার দায়িত্ব
- আমরা পলিটিক্স করব না
- কেন জানতে পারি?
- ওটা বড়োলোকদের বিষয়
- এরকম বিশ্বাস থাকার কারণেই সবার চোখ তোমাদের দিকে। তোমাদের মতো গ্রামের ছেলেরা কম টাউট হয়। যা করে বিশ্বাস থেকে করে। ...তোমাদেরকে ভুল কিছুও যদি বিশ্বাস করিয়ে দেয়া যায় তোমরা সেটাকেই ধরে থাকবে
- আমাদের ধারণা ভুল?
- একশো ভাগ। ...আমাদের দেশে বড়োলোকরা মন্ত্রী হয়- এমপি হয়। এটা দেখে যারা হতাশ তারাই এরকম কথা বলে। কিন্তু রাজনীতিতে বড়লোকদের যায় আসে না কিছু। যায় আসে আমাদের। তোমাদের। চেঞ্জটা বড়োলোকদের জন্য দরকার নেই। দরকার তোমার আমার মতো মানুষদের

লোকটা একবারও তার দলে যাবার কথা বলল না। কিন্তু অনেক কথা বলল। কথাগুলো নতুন। আসোলে আমাদের কারো পরিবারে রাজনীতি করা লোক নেই। আমরাও ব্যাপারটাকে নিয়ে ভাবিনি এর আগে। ইলেকশনের সময়- তোমার ভাই আমার ভাই; অমুক ভাই তমুক ভাই। এসবকেই রাজনীতি ধরে নিয়ে দূরে থাকতাম। দ্বিতীয় স্যারও এই বিষয়ে কোনোদিন কিছু বলেননি। নাহলে নিশ্চয়ই বিষয়টা নিয়ে ভাবতাম

তিনি কিছু বিষয় খেয়াল করতে বললেন। বললেন মূর্খ বন্ধুর চেয়ে জ্ঞানী শত্র“কে বেশি পছন্দ তার। আমরা যদি কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে তার দলের বিপরীত কোনো দলও করি তাতেও তিনি খুশি। কারণ তিনি ধরে নেবেন আমরা যা করছি তাতে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিছু নেই

আরেকদিন এলেন। সরাসরি বললেন আমাদের টাউনের কোন জিনিসটি অন্য শহর থেকে আলাদা? আমরা লঞ্চঘাট- রেলওয়ে স্টেশন আর বাস স্ট্যান্ডের কথা বললাম। তিনি হাসলেন- ভালো। কিন্তু এটা হলো জিওগ্রাফিকাল অ্যাডভান্টেজ। এটা কেউ ইচ্ছা করে বানায়নি। শহরটাকে অন্য শহর থেকে আলাদা প্রমাণ করার জন্যও করেনি। ভৌগলিকভাবেই শহরটা আলাদা অবস্থানে হওয়ার কারণে আস্তে আস্তে এই তিনটা যোগাযোগ গড়ে উঠেছে অটোমেটিক্যালি। কিন্তু এর ফলাফল কী?
- স্থল জল আর রেল। তিন পথেই আমাদের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে পারে; যা অন্য শহরের লোকজন পারে না
ঠা ঠা করে হেসে উঠলেন শাহাবুদ্দিন ভাই- শিশুদের রচনা প্রতিযোগিতায় কথাগুলো লিখলে প্রথম পুরস্কার পাবে তোমরা। ...কিন্তু এর কারণে কী পরিবর্তন চোখে পড়ে?

মূলত কিছুই পড়েনি চোখে। পড়তে যে হবে তাই বা কে জানত? তিনি এর আগে আমাদের যে যে বিষয় খেয়াল করতে বলেছেন তার মধ্যে এই জিনিসটি নেই। না হলে আমরা খেয়াল করে রাখতাম। ...তিনি নিজেই উত্তর দিলেন- পাগল; ঠিকানাবিহীন পাগল। একটা সমাজে মানুষ কী অবস্থায় আছে তা বিচার করার জন্য মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের সংখ্যা আর ধরন হচ্ছে একটা প্রধান মানদণ্ড। ...একটা দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো জনগণের কতটা বন্ধু তা বিচারেরও একটা বড়ো মানদণ্ড হলো ঠিকানাবিহীন পাগল। ...আমাদের শহরে অন্য যে কোনো শহরের তুলনায় পাগলের সংখ্যা বেশি। এরা এই শহরের লোক নয়। বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে এই শহরে আসে। আসে আমাদেরই সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে। যাতায়াতের ব্যবস্থা বেশি বলে পাগলের সংখ্যাও বেশি আমাদের শহরে। ...বাস-ট্রেন আর লঞ্চের সাথে যে এরকম একটা রাজনীতি জড়িয়ে আছে তা জীবনেও আমাদের মাথায় ঢুকতো না যদি না শাহাবুদ্দিন ভাই ধরিয়ে দিতেন

তার দলে আমরা যোগ দিয়েছিলাম কি না এখনও পরিষ্কার নয়। আমরা কোনো কাগজপত্র পূরণ করিনি। মিছিলেও যেতাম না। কিন্তু শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সাথে থাকতাম। তিনি কলেজে আসতেন না তেমন একটা। আমরা সাইকেল চালিয়ে গিয়ে পার্টি অফিসে হাজির হতাম। কখনও তিনি বলতেন। কখনও আমরা প্রশ্ন করতাম। লোকজন আমাদেরকে বাসদের ছেলে বলত। শাহাবুদ্দিন ভাই কিছুই বলতেন না

আমরা হয়ত তার দল পুরোপুরিই করা শুরু করে দিতাম। হয়ত মিছিলও করাতাম। ...একদিন শাহাবুদ্দিন ভাই কলেজে এলেন। দলের লোকজনের সাথে একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে মিটিং করলেন। আমাদেরকে বললেন তার সাথে কথা না বলে যেন চলে না যাই। মিটিং শেষে আমাদের সাথে বসলেন। কে কী করতে চাই। কী ভাবছি; কী পড়ছি জানলেন। বললেন- কলেজে এমনভাবে ঢুকবে না যেন একটা পিঁপড়াও টের পেলো না তুমি এলে। আবার এমনভাবে ঢুকবে না যেন মাটি কাঁপে। ...দ্বিতীয় স্যারের একটা কথার সাথে মিলে গেলো কথাটা- এমন বড়ো হইও না ঝড়ে ভাঙব মাথা/ এমন ছুডু হইও না ছাগলে খাইব পাতা

দুদিন পর শুনলাম শাহাবুদ্দিন ভাই আমেরিকা চলে গেছেন

আমরা আমাদের সাইকেলে ফিরে এলাম। এবার সাইকেলগুলো চলতে লাগল পাগলদের পেছনে। ...একটা অদ্ভুত বিষয় দেখলাম। বাড়িঘর ছেড়ে যে পাগলরা এই শহরে এসেছে তারাও সব সময় থাকে মানুষেরই আশেপাশে। নির্জন জায়গায় একটা পাগলও নেই। ব্যাপারটা সত্যিই আজব। পাগলও একা থাকতে পারে না। ...শহরের লোকজন আমাদের চিনে গেলো। কোনো নতুন পাগল দেখলেই খবর দিত। অনেকের সাথেই আমাদের খাতির জমে গেলো। আবার অনেকে আমাদেরকে দেখতে পারত না। অনেকের কাছ থেকেই ঠিকানা উদ্ধার করা যেত। কয়েকজনের ঠিকানায় আমরা যোগাযোগও করেছি। লোকজন এসে তাদেরকে নিয়েও গেছে। অনেকের বাড়ি থেকে কোনো উত্তর কিংবা মানুষ কেউ আসেনি। কেউ অনেকদিন ধরেই এখানে আছে। কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে হঠাৎ করে অন্য কোথাও

আমরা পাগলদের নাম দিতাম। একজনের নাম ছিল প্রফেসর লিয়াকত। সে তার নাম বলত না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ বক্তৃতা করত। কাপড়চোপড় বেশ সাফসুতরো। কিন্তু প্রায় সময়ই পরনের প্যান্ট থাকত খোলা। কোনো কোনো সময় প্যান্ট খুলে মুঠো করে ধরে মাইক বানিয়ে রাস্তায় বক্তৃতা করত। বক্তৃতার বিষয় অর্থনীতি। তার নাম প্রফেসর লিয়াকত হবার কারণ হলো আমাদের অর্থনীতি পড়াতেন লিয়াকত স্যার। যতটুকু না পড়াতেন তার চেয়ে বেশি বলতেন শিক্ষক পলিটিক্সের কথা। কী কারণে তিনি ফুল প্রফেসর হতে পারেননি। অনেক আগেই তার প্রমোশন হয়ে যেত যদি তেল মারতে পারতেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ...তাকে প্রফেসর বললে তিনি খুব খুশি হতেন। সেই স্যারের নামে এর নাম প্রফেসর লিয়াকত। আমরা প্রায়ই প্রফেসর লিয়াকতের বক্তৃতা শুনতাম। মাঝেমাঝে প্যান্ট পরিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েও দেখেছি। কী করে যেন সে আবার খুলে ফেলে। তার বক্তৃতার মূল কথা ছিল- যে জাতি অর্থনীতি বোঝে না; সেই জাতি মরা জাতি। ...একটানা অনেকক্ষণ বক্তৃতা করার পর সে বজ্রকণ্ঠে তার পরবর্তী কর্মসূচি জানিয়ে আলটিমেটাম দিত- আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সবাই যদি অর্থনীতি না বোঝে তাহলে...। তা হলে...। তাহলে সে কী করবে আর বলতে পারত না। ...তাহলে ...পরবর্তী কর্মসূচি পরবর্তীতে জানিয়ে দিতে বাধ্য হব। তারপর লোকজনের দিকে ফিরতো- যাও বাড়ি যাও। মিটিং শেষ। আর কত? নিজে কিছু বুঝতে পারো না? যাও বাড়ি গিয়ে ঘুমাও

একজন ছিল চেম্বার সভাপতি। টেলিফোনে বড়ো বড়ো বিজনেস ডিল করত। হাতের মুঠো কানের কাছে নিয়ে ফোনে কথা বলত সে। সব বড়ো বড়ো কথা- হ্যাঁ এক কোটি টাকার চেকতো দিলাম। আর দিলে ব্যবসা থাকে কই? হ্যাঁ হ্যাঁ... তারপর নিজেই মুখে আরেকটা ফোনের রিং বাজাতো- ক্রিং ক্রিং। এরপর- রাখেন ভাই আমার একটা ফোন এসেছে বলে অন্য হাতে পাশের ক্রেডল থেকে ফোন তোলার ভঙ্গি করে ওই ফোনে আবার কথা বলা শুরু করত। আবারও সেই বড়ো বড়ো ব্যবসা- না না শিপমেন্ট হয়নি। এলসি তো আগেই করেছি। এই সব

কাব্যাঙ্কবিদের নাম দিতে গিয়ে মুশকিলে পড়তে হয়েছে আমাদের। প্রথমে ভাবছিলাম পিথাগোরাস। কিন্তু এই পিথাগোরাসের অঙ্ক কখনও মিলে না। সে লোকজনকে ধরে আনে অঙ্ক মিলিয়ে দেবার জন্য। তার সব অঙ্কই দুই সংখ্যা নিয়ে। ইটের টুকরো দিয়ে রাস্তায় অঙ্ক করে। দুই যোগ দুই সমান চার। দুই যোগ দুই সমান তিন। দুই যোগ দুই সমান দুই। দুই যোগ দুই সমান এক। ব্যাস। এই তার অঙ্ক। পরপর লাইনগুলো লিখে একা একা কথা বলে- এটা ঠিক হলে ওটা কী? ভুল? কিন্তু কেন? তাহলে কি সবগুলো ঠিক? নাকি সবগুলো ভুল? ...তখনই আশেপাশে তাকায়। লোক ধরে এনে বলে- এই শিক্ষিত ভাই। আমার অঙ্কটা করে দে। কেউ তার অঙ্ক করতে পারে না। তখন কবিতা শুনতে হয়। তাও একটা নির্দিষ্ট কবিতা- ‘অঙ্ক করো। অঙ্ক করো/ অঙ্ক মেলে না/ তুমিতো মানুষ ছিলে/ দেবতা ছিলে না।’ এরপরেই জিজ্ঞেস করে- বল তো শিক্ষিত ভাই এটা কার কবিতা? বেশিরভাগই বলতে পারে না কবির নাম। সে নিজেই বলে- কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। সেও অঙ্ক পারে না। মাথায় গণ্ডগোল...

চা- চায়ের দোকান আর বিড়ি। আড্ডার তিন উপাদান। ...বাস স্ট্যান্ডে চা খাচ্ছি। কারো শেষ কারো বাকি। হঠাৎ এক পাগলি দোকানের দিকে এগিয়ে এল। কিছু বুঝে উঠার আগেই চায়ের কাপ- পানির গ্লাস- জগ সব একটা একটা করে টেবিলে উপুড় করে রেখে আবার দ্রুত বের হয়ে গেলো। কোন দিকে গেলো দেখার সুযোগ রইল না। জগের পানি- কাপের চা টেবিলে গড়িয়ে কাপড়চোপড় মিসমার হয়ে গেছে ততক্ষণে। একটু সামলে নিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করতে বলল গতকাল থেকে দেখা যাচ্ছে। একা একা কী যেন বিড়বিড় করে আর সামনে যা পায় তাই উল্টো করে রাখে

পাগলিটা আজব। তরুণী। কারো সাথে কথা বলে না। হাঁটে আর বিড়বিড় করে- একলা কেমনে অতকিছু ঠিক রাখি। সব উল্টা। কেউ কিচ্ছু দেখেও না। বুঝেও না। ...আমাদের চায়ের কাপও সে উল্টায়নি। ঠিক করে রেখেছে। কারণ কাপগুলো মূলত উল্টো ছিল। কিন্তু লোকজন কি আর তার মতো অত বুদ্ধিমান? মোটেই না। ফলে তাকে দেখলেই লোকজন নিজের জিনিসপত্র সামলাতে শুরু করে অথবা লাঠি নিয়ে তাড়ায়। তাড়া খেলে গালাগাল দেয় গুষ্টি তুলে -বেক্কলের গুষ্টি। নিজেতো কিছু বুঝেই না; আবার বুঝাইতে গেলে মারে। ...খালি চোখ থাকলেই হয় না। চোখের মধ্যে মণিও থাকতে হয়। বেক্কলের ঘরের বেক্কল

আধ্যাত্মিক গালি। হারমোনিয়াম কিংবা নাটক থেকেও কঠিন। আমরা বুঝি না। শহরে অন্য কেউও বোঝে বলে মনে হয় না। কেরোসিনের টিন- দুধের বালতি- জিনিসপত্র উল্টো করে রেখে এমন আধ্যাত্মিক বিষয় শেখার ইচ্ছাও শহরে কারো নেই। কিন্তু এর মধ্যেই সে একটা নাম পেয়ে যায়। কারা যেন তার উল্টি পাগলি নামটা চালু করে দেয়। এই নামটা আমাদের দেয়া না। সবকিছু উল্টায় কিংবা সব কিছুকেই সে উল্টা অবস্থায় দেখে বলে এই নাম। দারুণ নাম। অন্য কোনো নাম দিতে আর গেলাম না আমরা। আমরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম তার সাথে কথা বলতে। বলে না। কোত্থেকে এসেছে- কে কে আছে না আছে কিচ্ছু বলে না। আর ভাষা বিষয়ে আমাদের এত দখল নেই যে তার ভাষা শুনে বুঝব সে কোন এলাকার লোক। কিন্তু সে থাকে কোথায় তা তো জানা দরকার

শহরটা ছোট হলেও মানুষ খুঁজে বের করার জন্য বহু বড়ো। তার উপর পাগল। ...সারাদিন গেলো। অদরকারি পাগলদের পাই কিন্তু উল্টিকে পাই না। আমাদের সাইকেল শহর থেকে বের হয়ে পড়ে বাইরে। আবার শহরে। বাস স্ট্যান্ড থেকে লঞ্চঘাট। লঞ্চঘাট থেকে রেল স্টেশন। নাহ। আবার চক্কর দেই আগের জায়গায়। নেই। কেউ বলে আজ একবার দেখেছে। কেউ বলে- না। ...সন্ধ্যায় তাকে স্টেশনে পেলাম। এক কোনায় বসে একটা বোতল ওলট পালট করছে আর কাঁদছে- শান্তিতে থাকতে পারবি না। কাউরে শান্তিতে থাকতে দিমু না। আমার সবকিছু উল্টাইয়া দেওনের সময় মনে ছিল না?

আমরা যে তাকে দেখছি সে খেয়ালই করে না। আপন মনে বোতলটা একবার উল্টাচ্ছে আবার সোজা করছে। অথবা একবার সোজা থেকে উল্টা আবার উল্টা থেকে সোজা করছে। বিড়বিড় করছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একটাই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছে বিভিন্নভাবে- শান্তিতে থাকবি? থাক না দেখি কেমনে থাকস। আমি থাকতে দিলেতো?

কে তার শান্তি নষ্ট করল; কে তার কী উল্টা করে দিয়েছে? কিছুই মাথায় ঢোকে না। আমাদের একজন বোতলটা চেপে ধরে। উল্টি তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলে- ছাড়ো
- এটা এভাবে থাকবে
- ছাড়ো। এইভাবে থাকব না
- এইভাবেইতো সোজা
উল্টি একটা মরণ চিৎকার দেয়। আমাদের বন্ধুটি ছেড়ে দেয়। পাগলি আবার বোতল ওলটপালট করতে থাকে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। তাকায়। তার গলা ঠান্ডা- তোমরাও কি তাদের লোক?
- কাদের লোক?
উল্টি কোনো উত্তর দেয় না। তার কাজ সে করতে থাকে। আবার চোখ তুলে তাকায়- ওদের লোক না হইলে আমার লগে লাগো ক্যান?

এ তো আরেক সক্রেটিস। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। কিন্তু নিজে একেকটা কথা বলে যায় বাণী চিরন্তনীর মতো

ওর সাথে আমাদের খাতির হয়ে গেলো। ছেলেরা তাকে তাড়া করলে এসে আমাদের কাছে দাঁড়ায়। ক্ষিদে পেলে এসে বলে। আবার যাবার সময় কিছু না কিছু একটা উল্টো করে দিয়ে যায়। আমরাও সাবধান। তাকে দেখলে সবকিছু সামলে রাখি। কাপের তলানির চা ফেলে দিয়ে তার সামনেই উল্টে রাখি টেবিলে। মাঝেমাঝে ওর সামনে আমরা বিভিন্ন জিনিস রাখি। সে একটার পর একটা উল্টায় আর বকবক করে- আমি একলা মানুষ। অত কাম কেমনে করি। কেউ বুঝে না। ...একদিন তার সামনে একটা টেনিস বল রাখলাম। সে প্রথমে বলটাকে উল্টে রাখল। উল্টানোর পরও টেনিস বলটা দেখতে একই রকম। সে আরো কয়েকবার ওলটপালট করল। তারপর দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো- দুর এইডা আবার কী জিনিস? এইডার উল্টাও নাই সোজাও নাই

মাঝেমাঝে সে তার সবকিছু ঠিকঠাক-করণ কর্মসূচিতে আমাদেরকে দিয়ে এসিস্টেন্টগিরি করায়। বড়োসড়ো কিছু উল্টাতে হলে দৌড়ে এসে হাতে ধরে সমানে টানতে থাকে- আসো না। আসো। ...আমরাও যাই। তার সাথে অনেক কিছু উল্টাই কিংবা সোজা করি। একবার ট্রেনের একটা কম্পার্টমেন্ট দেখিয়ে বলালাম- উল্টাবে? ...অনেকক্ষণ করুণ চোখে তাকিয়ে থাকল- দরকার তো। কিন্তু অনেক বড়ো। তোমরাও পারবা না

আমাদের পরিবারগুলোতে বিএ পাশ করাকে অনেক বড়ো পাশ মনে করা হয়। ধরা হয় বিএ পাশ করলেই অফিসে লেখাপড়ির চাকরি পাওয়ার জন্য যথেষ্ট পাশ হয়ে গেছে। সুতরাং বিএটাই আমাদের পড়াশোনার শেষ পর্যায়। এই শহরে এর বেশি পড়া যায়ও না। এর বেশি পড়তে হলে বড়ো শহরে গিয়ে হোস্টেলে থাকতে হয়। সেইসব পড়ে মানুষ ডিসি-এসপি হয়। আমাদের কারো পরিবারের অত খরচ করে ছেলেকে হোস্টেলে রেখে জজ-বারিস্টারি পড়ানোর ক্ষমতা নেই। আর লোকজন আমাদেরকে অত বড়ো অফিসার বানানোর কথা ভাবেও না। বড়োজোর সরকারি অফিসে একটা কাঠের চেয়ার পাওয়ার মতো চাকরি কিংবা কোনো এনজিওতে মটর সাইকেল পাওয়া যায় এরকম সাইজের অফিসার পর্যন্ত ভাবে। এর জন্য বিএ পাশই যথেষ্ট। এইটুকু পাশের চাকরি হলেই শহরের লোকজন তার নামের সাথে সাহেব যুক্ত করে ডাকে

কলেজে মেয়েদের পেছনেও ঘোরা হয়নি আর। তাছাড়া মেয়ে বলতে আর নেইও। মেয়েরা প্রায় সবাই বিএতে ভর্তির আগেই বিয়ে করে সংসার শুরু করে দেয়। কেউ কেউ বিয়ের পর চোখে মুখে ঝকমকে ভাব আর গলায়-ঠোঁটে লাল লাল ফোলা দাগ নিয়ে কয়েকদিন কলেজ করে। কিন্তু পরীক্ষা প্রায়ই দেয় না। পরীক্ষার আগেই তাদের কোলে একটা করে বাচ্চা চলে আসে। ...দেখতে ভালো না বলে যাদের সহজে বিয়ে হয় না তারা ভর্তিও হয় ক্লাসও করে। মেয়ে পড়াশোনায় থাকলে তার বয়স বেশি মনে হয় না। তাই এরা পড়াশোনা চালিয়ে যায়। পাত্রী এখনও স্টুডেন্ট কথাটা অভিভাবকরা বলতে পছন্দ করেন। তাতে মেয়ের অতদিন ধরে কেন বিয়ে হচ্ছে না তার কোনো যুক্তি দেখাতে হয় না। কিন্তু এদেরকে কোনো ছেলেই তুমি বলে না। প্রথম থেকেই তুই বলে। তারাও ছেলেদের সাথে তুই-তোকারি করে। কাউকেই তুমি বলতে যায় না। সুতরাং...

পরীক্ষা একেবারে কাছে। ফেল করলে হয় দুবাই চলে যেতে হবে না হয় মুদি দোকানে বসতে হবে। ...আড্ডা কমে এল। বেড়ে গেলো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পড়া। যেখানে বিএ পাশ লোক চায় সেসব জায়গায় শুরু হলো বিএ পরীক্ষার্থী বলে দরখাস্ত করা। কিছু কিছু ডাকও এল। উল্টি কিংবা অন্য পাগলদের সাথে দূরত্ব বেশ বেড়ে গেলো। পরীক্ষা শেষে হতে না হতেই পরিবারের চোখ বদলে গেলো আমাদের দিকে। দরকারি টাকা চাইলেও বড়োরা কেমন যেন তাকায়। যার অর্থ হলো- দামড়া পোলা বাড়ি থেকে টাকা নিতে লজ্জা করে না? কামাই করো। অনেক তো হলো এবার নিজে কিছু করো

অনেকেই করে। টিউশনিও করে অনেকে। কিন্তু আমাদের কারোই ওই জিনিসটা করার ইচ্ছেও নেই। যোগ্যতাও নেই। সুতরাং আমাদের আর কিছু করা হয় না। শুধু দরখাস্ত করার পর খুঁজি কার জানাশোনা আছে। সে যদি একটু বলে দেয় কিংবা টেলিফোন করে...

পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই আমাদের দুজন শহর ছাড়ল। নিজের শহরে বিএ পাশ করা গেলেও বিএ পাশের চাকরি পায়নি ওরা। আমরা একজনকে ট্রেনে আর আরেকজনকে বাসে তুলে দিতে দিতে নিজেরা কবে বাস-ট্রেন অথবা লঞ্চ চড়ব সে চিন্তা করতে লাগলাম। ...আড্ডাটা ভাঙা শুরু হলো। যাদের চাকরি হচ্ছে না তারাও চলে যেতে লাগল। চাকরি পেতে হলে যেখানে চাকরি পাওয়া যায় সেখানে গিয়ে চেষ্টা করা ভালো। কেউ রাজধানীতে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে উঠল। কেউ গিয়ে উঠল মেসে

আমরা সবাই আমাদের শহর ছাড়লাম। যাতায়াতের তিনটা পথেই ছেড়ে গেলাম আমাদের শহর। একা একা। বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে। তিনটা জায়গাই আমাদের খুব চেনা। কিন্তু এখন যখন কাউকে তুলে দিতে যাই তখন কেমন অচেনা লাগে। একজনকে বিদায় দেবার পর একটা মিনিটও সেখানে থাকতে ইচ্ছে হয় না। নিজেদের দল থেকে একজনকে কমিয়ে আমরা দ্রুত ফিরে যাই ঘরে

সর্বশেষ কে শহর ছেড়েছে জানি না। তবে আমাদের এই শহর-কুতুবের দলের একটা মানুষও আর থাকেনি নিজের শহরে। ছড়িয়ে পড়ে সবাই। বাইরে। আমাদের আড্ডা- দ্বিতীয় স্যার- শাহাবুদ্দিন ভাই আর উল্টি পাগলির শহরে আর থাকা হয় না আমাদের। শহর বিষয়ক রচনা লেখার শহরে আমরা আর থাকলাম না কেউ। অথবা সবই থাকে ঠিকঠিক জায়গামতো শুধু আমরাই ছিটকে পড়ি বাইরে

আমাদের কারো কারো নিজস্ব অফিস হলো। কারো ছোটখাটো ব্যবসা হয়ে গেলো। কেউ সত্যি সত্যি অফিসার হয়ে গেলো আরো কিছু পাশ দিয়ে। কেউ জায়গা কিনল। বাড়ি বানাল কেউ। বৌ আর বাচ্চা হলো সবার। সবই অন্য শহরে। আমাদের শহরে শুধু আমাদের জন্য থাকল বছরে একটা উৎসব। উৎসবে আবার সবাই গিয়ে জড়ো হই আমাদের রচনা লেখার শহরে। ...প্রফেসর লিয়াকত এখনও প্যান্ট খুলে অর্থনীতি করে। কাব্যাঙ্কবিদ মানুষকে ধরে এনে এখনও অঙ্ক আর কবিতা করায়। চেম্বার সভাপতির ল্যান্ড ফোনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোবাইল। ...দ্বিতীয় স্যার মারা গেছেন। উল্টির খবর জানে না কেউ

আমাদের চোখে চশমা। চুলে কলপ। চেহারায় মেনে ও মানিয়ে নেয়া মানুষের মুখ। ...আড্ডায় আমরা স্মৃতিচারণ করি। হাসা যায় কিংবা হাসানো যায় এমন স্মৃতি। দ্বিতীয় স্যার বা উল্টির কথা নিয়ে তখন হাসতাম। ভাবতাম অর্থহীন আবোলতাবোল। এখন মনে হয় কথাগুলোর হয়ত কোনো অর্থ আছে। এমন অর্থ যাতে নিজেকে দায়ী করার মতো লুকোনো দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তাই দ্বিতীয় স্যার কিংবা উল্টির কথা ভুলেও বলি না কেউ। শুধু অবাক হয়ে খেয়াল করি কখন যেন আমরা নিজেদের চায়ের খালি কাপগুলো রেখে দিয়েছি উল্টো করে। তখন কোথাও যেন উল্টির সাথে কোরাস করে দ্বিতীয় স্যার চেঁচিয়ে উঠেন টপ গেয়ারে- হালার পুতেরা কানা ফকিরের গুষ্টি; লুলা ফকিরের দল। বোঝেও না কিছু; দেখেও না কিছু। বেক্কলের ঘরের বেক্কল
২০০৬.৬.১৫


মন্তব্য

সবজান্তা এর ছবি

গতকাল থেকে আমাকে আপনার লেখায় পেয়েছে। এই বিশাল বিশাল সাইজের লেখাগুলি কোন রকম পজ ছাড়া একটানে পড়ে যাচ্ছি।

একটা ব্যাপার আমিও লক্ষ্য করেছিলাম। আপনাদের সময় তো তাও স্কুলের শিক্ষক একজন হলেও কিছু জানতেন, এই সময়ে স্কুল শিক্ষকদের সবাই-ই কিছুই জানে না, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলা। তবু স্কুল টিচারদের একটা অন্যরকম আবেদন থেকে যায়। ভার্সিটির শিক্ষকরা বড় বেশি প্রফেশনাল, কেউ বলে না কিরে পড়িস না কেন, কিংবা পড়া না করার জন্য কেউ ধরে মার লাগায় না, কিংবা লুকিয়ে হোমওয়ার্কে সাহায্য করার জন্য কেউ মেরে হাতের তালু ফাটিয়ে দেয় না কিংবা কেউ লুইকিয়ে লুকিয়ে আদি রসাত্মক কথা বলে না। এখানে সবাই ভদ্রলোক। সবাই বোঝে প্রেজেন্টেশন, গ্রেড আর প্রোজেক্ট। সবাই কথা বলে আপনি আর তুমি করে। তুই করেও কেউ বলে না।

মাঝে মাঝে মনে হয় এটুকু আপন করে নেওয়াটাকেই এখন বড় বেশি মিস করি।


অলমিতি বিস্তারেণ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই দ্বিতীয় স্যারটা আমার দেখা কয়েকজন টিচারের একটা সংকলিত রূপ

তবে কিছু কিছু টিচার আমি পেয়েছি
যারা সত্যি মনে রাখার মতো

তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের সাবজেক্ট আমার ছিল না
কোনোদিনও তারা আমাকে ক্লাসে পড়াননি

কিন্তু আমার টিচার বললে তাদের কথাই মনে পড়ে প্রথম সারিতেই

০২

সবজান্তা দেখি আমার লেখার উপর একটা লংমার্চই চালিয়ে দিলো...

রূপক কর্মকার এর ছবি

সাবলীর ভাষায় জটিল সমাজচিত্র। তারই মধ্যে নস্টালজিয়া। এক কথায় আসাধারণ! সবজান্তা ভাইয়ের মতো আমিও মুগ্ধ!!!! কিছু অংশ কোট করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না :
"কলেজে সাহিত্য ফাহিত্য সবই টাউনের ছেলেদের দখলে। পলিটিক্সের কিছু লোক ছড়া আমাদের কেউ পাত্তা দেয় না। স্যাররাও না। পলিটিক্সের লোকজন আমাদের খাতির করার কারণ হলো এক গ্র“পে আমরা অনেকজন। কিন্তু আমরা অনড়- না ভাই পলিটিক্স পয়সাওয়ালাদের জন্য। তাছাড়া কে জানে পলিটিক্সের নামে আবার কোথায় নিয়ে গিয়ে সারেগামা কিংবা স্বরে-অ স্বরে-আ পড়াবে। ...সুতরাং বাদ। বাদ। ...আমরা ঘুরি। ঘুরি সাইকেলে। সারা শহর। মাঝেমাঝে শহরের বাইরেও চলে যাই। যখন বসি তখন গিয়ে বসি হয় রেল স্টেশন; না হয় বাস স্ট্যান্ড; না হয় লঞ্চঘাটে।"
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]

____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]

অতিথি লেখক এর ছবি

আরেকটা লেখায় এইটার লিংক পেয়ে পড়তে আসা, পড়তে শুরু করার পরে মুগ্ধতা জাগানিয়া অনুভূতি আর সবশেষে একটা জড়তা নিয়ে বসে থাকা।
অসাধারণ একটা লেখা। বিশাল একটা লেখায় পাঠককে ধরে রাখার যে "কেরামতি", সেটা আপনি এখানে প্রয়োগ করছেন।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই লেখার জন্য।

- মুক্ত বয়ান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।