আমি যখন ছুটতে ছুটতে শের-এ-বাংলা নগর সেকেন্ড গেটের দিকে যাচ্ছি তখন জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারের ভেতর থেকে তোপধ্বনির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করার প্রক্রিয়া চলছে সেখানে। কাল থেকে টিভিতে বটমস্ক্রিন নিউজ দিচ্ছে- যারা শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদেরকে সকাল দশটায় প্যারেড স্কোয়ারে উপস্থিত থাকতে বলা হল।
আমি অফিসে ছুটি নিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সাত সন্তানের একজনকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ছুটছি। দেরি হয়ে গেছে- জানাজা বোধ হয় শেষ। গেটের কাছে এসে দেখি পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর সদস্যরা গেট ঘিরে আছে। আমাকে আটকে দিল। জানতে চাইলাম- জানাজা কি শেষ?
জবাব এলো- হ্যাঁ, গেট থেকে সরে দাঁড়ান।
আমি মরিয়া হয়ে আবেদন করলাম- কোন মতেই কি ভেতরে যাওয়া যাবে না?
রুষ্ট কণ্ঠে জবাব এলো- জানাজা শেষ, ডোর ক্লোজ, ব্যাস। এবার সরে দাঁড়ান।
হতাশ হয়ে আরেকজনকে জিগ্যেস করলাম- ভাই, কোন দিক দিয়ে যাবে?
পুলিশ সদস্য পাল্টা প্রশ্ন করলো - কি?
মনটা কুঁকড়ে এলো, কষ্ট সংবরণ করে বললাম - ভাই আমি এখানে প্রেসিডেন্টের মুখদর্শন করতে আসিনি, এসেছি বীরশ্রেষ্ঠের কফিন দেখতে।
নির্বিকার পুলিশ জানালো, দূরে গিয়ে দাঁড়ান দেখবেন।
রাস্তার ওপাশে ফুটপাতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম আরও অনেক লোক এসে ফিরে যাচ্ছে। কঠোর নিরাপত্তার আবেষ্টনে স্বাধীন বাংলাদেশে বীরশ্রেষ্ঠর শেষকৃত্য আয়োজন চলছে। কত রথী-মহারথী,কেউকেটা, রাজাকার আমলা এখানে আছে ! আমার মত একজন সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকবে কেন ? এক ভদ্রলোক আমার মতই ছুটতে ছুটতে এসে জানতে চাইলেন, জানাজা কি শেষ ? আমি আমার অভিজ্ঞতা বলে গেলাম। ভদ্রলোক খুব হতাশ হলেন। তিনিও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন- সেই সাভার তার অফিস। বললেন, এখানে যারা এসেছে মনের টানে এসেছে, এখানে নিরাপত্তার অজুহাতে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা ঠিক হল না।
কেউ কেউ এসেছে বই মেলা দেখতে। তাদেরকেও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তারা হতাশ বই মেলায় না ঢুকতে পারার কারণে।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার গেলাম গেটের কাছে। উদ্দেশ্য, কফিনটা কোন দিক দিয়ে নিয়ে যাবে অন্তত সেটুকু জানা। জানলাম ভি.আই.পি গেট দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বীরশ্রেষ্ঠর কফিন। তাতো বটেই, ভি.আই.পি গেট ছাড়া সেনাপ্রধান-রাষ্ট্রপ্রধান-দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের নিষ্ক্র মণ কি সম্ভব নাকি সম্ভব হওয়া উচিত ? বীরশ্রেষ্ঠর আত্মাকে যদি জিগ্যেস করা যেত, তিনি কেমন চান ?
কফিনের আশায় থাকাটাও বৃথা গেল। ছুটলাম মিরপুর বুদ্ধিজীবী সমাধিস্থলে। বাসা থেকে নিয়ে নিলাম ক্যামেরা। পথে তাড়াহুড়োতে বাসের ভাড়া দিলাম দুবার, রিকশা ভাড়া দিয়ে ফেরত টাকা নিতে ভুলে গেলাম। দৌড়ে গেলাম গোরস্থানের গেটে। হায় ! সেখানেও একই দৃশ্য। কড়া নিরাপত্তা, কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। অন্যদিক দিয়ে ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, লাভ হল না। চারদিকে কড়া নিরাপত্তা। কষ্টটা এবার ক্ষোভে রূপ নিতে লাগল।
এক পুলিশ সদস্যকে বললাম, ভাই বীরশ্রেষ্ঠর কফিন দেখতে এসেছিলাম । মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি আমার নেই তাই ভেবেছিলাম আমার সন্তানকে অন্তত বলতে পারবো সাত বীরশ্রেষ্ঠর একজনের কফিন দেখেছি, যে মুক্ত-স্বাধীন মাতৃভূমি তিনি চেয়েছিলেন তাঁকে সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে শুইয়ে দেয়ার অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম। হল না।
আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই পুলিশ সদস্য বললেন, খোলা জায়গায় সবাইকে দেখতে দেয়া উচিত ছিল। ১৪ই ডিসেম্বর থেকে এ জায়গা উন্মুক্ত থাকবে সবার জন্য।
ততক্ষণে পোশাকধারীদের তত্ পরতা শেষ। বাইরে বিশাল গাড়ী বহরের ইঞ্জিনগুলো সচল হচ্ছে একের পর এক। হঠাত্ দেখলাম ফুল দিয়ে সাজানো একটি সামরিক পিকআপ চলে গেল। এটাতে করেই বহন করা হয়েছিল বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ। দুচোখ ভরে সে পিক-আপ টি দেখে নিলাম যতদূর পারা যায়। কি হতো শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কফিনটিকে উন্মুক্ত জায়গায় রাখলে। বীরশ্রেষ্ঠর কফিন কি বাংলাদেশে এতই নিরাপত্তাহীন ?
আমার এ লেখার মাধ্যমে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কফিনকে দূর থেকে শ্রদ্ধা জানালাম ।
বাংলাদেশের একজন অতিসাধারণ মানুষের মন তোমাদের জন্য কতটা হন্যে হয়েছিল তোমরা পরকাল থেকে তা দেখতে পেয়েছ কি ? আমাদের সমস্ত অজ্ঞতা, অবিমৃষ্যকারিতা, বিস্মৃতি-বিবিক্তি, আত্মপরায়ণতা, কৃতঘ্নতা তোমরা ক্ষমা করো।
মন্তব্য
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো...
জানি না কেন...আজকাল মনে হয় কেউ যেন গলা চেপে ধরে আছে...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান…
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
এরা সাধারন মানুষের সাথে যে কোন কিছু শেয়ার করতে ভয় পায় ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আমার মাথায় আসেনা। একেবারেই আসেনা। কেন এত নিরাপত্তা? কোন জুজুর ভয়? ৬ ডিসেম্বর সারাদিন মহামান্য রাস্ট্রপতির নিরাপত্তার অজুহাতে আমাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এইটার সাথে । অবশ্য আপনার অভিজ্ঞতার সাথে আমারটা বলাই অনুচিত। খুব কষ্ট লাগল আপনার কথা পড়ে। এদের জন্য করুনা...
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নতুন মন্তব্য করুন