গত রাতে একুশে টিভিতে ‘একুশের রাত’ টক শো তে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশিদ তথাকথিত সিপাহী-জনতার বিপ্লব অর্থাত্ ৭ই নভেম্বরসহ বিভিন্নসময় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সংঘাত-ষড়যন্ত্র নিয়ে এমন কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন যা এতদিন কেবল গুজব বা কানকথার মতো শুনেছি। অনুষ্ঠানে আফরোজা হক রীনা এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুও আলোচনা করেছেন। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল প্রেরণা থেকে দেশকে সরিয়ে নেয়ার যে ষড়যন্ত্র চলছিলো তার প্রতিবাদ হল না কেন ? -এমন একটি প্রশ্নের আলোচনায় সাবেক সেনাপ্রধান বললেন-( মূল বক্তব্য ঠিক রেখে ভাষ্যটি বর্ণনা করছি।)
‘প্রতিবাদ হয় নি কথাটি ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই সারাদেশে সামরিক বাহিনীর ফরমেশন কমান্ডার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে দিয়ে অমুক্তিযোদ্ধাদের বসানো হয়। ৩ নভেম্বরে জেলহত্যা, ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান এর সবকিছুতেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা জিয়া এবং রাজনীতিবিদ জিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি। আমি বলবো রাজনীতিবিদ জিয়া মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার সাথে বিট্রে করেছে। জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনের স্বল্প সময়ে ২৬ টি অভ্যুত্থান কেন হয়েছিল তার কারণ হয়তো একদিন ইতিহাসসন্ধানীগণ বের করার চেষ্টা করবেন। জিয়া হত্যার অপরাধে মাত্র ১৭দিনে ১৪জন সামরিক অফিসারকে ফাঁসি দেয়া হয়। যা পৃথিবীর কোন কোর্ট মার্শাল আইনেই পড়ে না, এর জন্য অন্তত এক থেকে দেড় মাস সময় দিতে হয় , অভিযুক্তের বক্তব্য শুনতে হয় যার কিছুই এক্ষেত্রে করা হয় নি। এসব অভ্যুত্থানের কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে যাদের তারাও মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। জিয়ার পাশের রুমে থেকেও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কিছুই হল না অথচ পাঁচ রুম পরের মেজর মুশফিককে ( নামটি ভুল হতে পারে ) ফাঁসি দেয়া হলো। এমনকি জেনারেল এরশাদের সময় যেসব অভ্যুত্থান হয়েছিলে তাতেও প্রাণ দিতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের। জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেলা হয়েছিলো । পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উল্লেখ আছে, তার মাথার পেছনে একটি মাত্র বুলেটের আঘাত আছে । অথচ প্রচার করা হয়েছিলো জনগণের হাতে ধরা পড়ে পালানোর সময় সে মারা গেছে। জেনারেল মঞ্জুর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন, তাকে আটক করেছিলো পুলিশ অথচ তাকে সেন্ট্রাল জেলে নেয়া হয় নি।’
সাবেক সেনাপ্রধানের বক্তব্যে আরো কিছু তথ্য ছিলো যা সাধারণ মানুষের কাছে এতদিন গল্প হিসেবে পরিচিত ছিলো। খুব অল্প কথায় ৭ই নভেম্বরের যে মূল্যায়ন তিনি করেছেন তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। বঙ্গভবনে আলোচনায় খালেদ মোশাররফের ঘন্টার পর ঘন্টা কালক্ষেপনের সুযোগ নিয়ে একটি প্রতিবিপ্লবী দল ২ দিনের মধ্যে সংগঠিত হয়ে তাদেরকে হত্যা করে, তারা তখন তাদের ব্যাটালিয়নের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই ২২ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিলুপ্ত করা হল কেন, কেন সেই গোলমেলে সময়েও 'বাংলাদেশ বেতার'কে রেডিও বাংলাদেশ' আর বাঙালির প্রেরণা আর উদ্দীপনার আওয়াজ, মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের শ্লোগান 'জয় বাংলা' রাতারাতি বদলে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' করার প্রয়োজন পড়ল এমন প্রশ্নও তিনি তুলেছেন। এসব কথার মধ্য দিয়ে একটি সত্য উঁকি দেয়, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সামরিক বহিনী থেকে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিলো অনেক আগ থেকেই । মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি এবং সামরিক বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ক্ষমতালিপ্সার সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত দলটি ( জামাতে ইসলামি, নেজামে ইসলামি, মুসলিম লীগ, আলবদর, রাজাকার, আল শামস) বহুদিন ধরেই এভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এভাবে বাঙালি জাতির প্রবল দেশপ্রেম, স্বাধীকার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ও প্রাণনা সবকিছু শুষে নিয়ে আমাদেরকে চেতনাগত দিক থেকে এতটাই দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে যে, এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজাকার আলবদরদের ধৃষ্টতাপূর্ণ উচ্চারণও আমাদের সহ্য হয়ে যায়। বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধকে “গৃহযুদ্ধ” আখ্যা দেয়ার পরও আমাদের ঘুম ভাঙে না। সুন্দরী নারীর লোভে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গেছে কতগুলো বেজন্মার এমন কদর্য মন্তব্য শুনেও সামান্য চুলকানি অনুভব করে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ি আমরা।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম যে জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করেছে তাতে খুব স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। তারা দেশবাসীকে সম্পৃক্ত করে নতুন প্রজন্মের চেতনা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে যে নতুন সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন তাতে আমাদের সবার, যারা দেশকে ভালোবাসি, বাংলাদেশি এবং বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিই সবার অংশগ্রহণ করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা সকল রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে যখন একমঞ্চে বসলেন (একুশে টিভি সরাসরি সম্প্রচার করছিলো) আরো অনেকের মতো আমিও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম। এই কনভেনশেন থেকে বলা হল, ৭৫-এর ৩১ শে ডিসেম্বর ( যেদিন দালাল আইন বাতিল করা হয়) থেকে জাতির পুনর্যাত্রা শুরু হবে। যদিও জেনারেল হারুন মনে করেন এ যাত্রা শুরু হওয়া উচিত ৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে। আমিও তাই মনে করি। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। শুনেছি। আমার সামনে আরেক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ডাক এসেছে, আমি তো এ যুদ্ধে যাবোই । আপনাদেরও আমন্ত্রণ জানাই।
মন্তব্য
গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো ভাবেই বিলীন করা সম্ভব নয়। আমরা করতে দেবো না।
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
যাত্রা শুরু হওয়া উচিত ৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে। এই উইকেট পরার পর থেকেই খেলার নিয়ন্ত্রণ ওদের হাতে।ওরা ইচ্ছা মতো খেলে আর খেলায়।
---------------------------------------------------------
আমাকে ডাকে আকাশ, বোঝে মাটি হাওয়া জল
বোঝে না মানুষ আর বিনাশী মুদ্রার ছল
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আমরা আজো সেটা বুঝতে পারছি না কেন?
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখা প্রজন্ম, তারা চিরকাল সেই যুদ্ধের জয়গান করি। আপনারা না দেখেও উদ্বেলিত ও উদ্বুদ্ধ বোধ করছেন জেনে মনে হয়, সবই বৃথা যায়নি। যাবে না।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
সম্পূর্ণ সহমত।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
যাত্রা শুরু হওয়া উচিত ৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে।
..হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দার জলে...
উইকেট পড়বেই কিন্তু রানের চাকা সচল রাখতে হবে। নতুন এক
সেঞ্চুরি পার্টনারশিপের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
নতুন মন্তব্য করুন