ইসলাম-পশ্চিম সংঘাত ও বাইবেল । শামসুদ্দোহা শোয়েব। প্রকাশক : শুদ্ধস্বর, আজিজ মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।
‘মুসলমানরা ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ কেন ? এর পেছনে কি নবী মুহাম্মদ অথবা কুরআন ? মদিনা থেকে ওদের বের করে দেয়া হয়েছিল ‘বিদ্বেষ’ থেকে, না নবগঠিত রাষ্ট্রটিকে বিশ্বাসঘাতকতার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ? ইসলামের নবী যা করেছেন, এছাড়া বিকল্প কিছু ছিল? বিভীষণদের ঘরে রেখে বাইরে লড়াই করা যায় না। যে খেসারত রাবণকে দিতে হয়েছিল, সেই ঝুঁকি মুহাম্মদ নেননি। এর নাম ‘বিদ্বেষ’?’ ( শামসুদ্দোহা শোয়েব, ২০০৮)
বছর খানেক আগের কথা। ‘সামহোয়ারইন’ ব্লগে ইসলাম ধর্মের কয়েকটি বিষয়ে আমার বেয়াড়া কৌতূহল থেকে উদ্ভূত কিছু প্রশ্ন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছিলাম। তাতে আমার অজ্ঞতার প্রতিফলনতো ছিলোই আর ছিলো ব্লগিং এর মাধ্যমে বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেয়ার চেষ্টা। বিতর্কিত বিষয়গুলো কেন বিতর্কিত তা একেবারে গোড়া থেকে জানার একটা আগ্রহ ছিলো আরো বেশি। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়ে ঐ ব্লগারদের গোঁড়ামি যে কী মারাত্মক তা কিছুদিনের বাক্য চালাচালিতেই আমি টের পেয়ে যাই। ধর্মীয়ভাবে অননুমোদিত কৌতূহলের জন্য আমাকে নানাভাবে তিরস্কার করা থেকে শুরু করে অভব্য মন্তব্য কোনটাই বাদ যায় নি। আমার বেশ কয়েকটি প্রশ্নের একটি ছিলো , ‘হযরত মুহাম্মদ (সঃ) মক্কা থেকে ইহুদীদেরকে বিতাড়িত করেছিলেন কেন, যখন তাদের সহযোগিতা নিয়েই তিনি মদিনায় অবস্থান করেছিলেন ? সেটা কি কেবল বিশ্বাসঘাতকতা নাকি এর পেছনে আরো কোন কারণ আছে যা রাজনৈতিক কৌশল বা দূরদর্শিতার পর্যায়ে পড়ে ?’ আমার এ প্রশ্নের যথেচ্ছ ব্যবচ্ছেদ শেষে সবাই শুধু এর পেছনে মুরতাদ/ কাফেরের যোগসূত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন। কেউ এর প্রকৃত ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি বা দিতে চান নি। কিন্তু আপাত সাদাসিধা এই প্রশ্নের আড়ালে যে এত বড় এক ইতিহাস, ইতিহাসের সাথে নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত সংঘাতের মিথ জড়িয়ে আছে তা আবিষ্কার করলাম শামসুদ্দোহা শোয়েবের বই ‘ইসলাম-পশ্চিম সংঘাত ও বাইবেল’ পড়ার পর।
তার প্রেরণার উৎস আর আমার সেই নির্বোধ প্রশ্নের গোড়াটা যে একই জায়গায় তা বুঝতে পেরে আমি বিস্মিত হয়েছি।
মানুষের জানা ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো উদ্বাস্তু জাতির নাম ইহুদি। হয়ত সবচেয়ে নিগৃহিত, ঘৃণিত জনগোষ্ঠির নামও ইহুদি। কিন্তু কেন ? যাত্রাপুস্তকের উদ্ধৃতি দিয়ে শামসুদ্দোহা শোয়েব লিখেছেন -
‘ইহুদিদের প্রতি মানুষের ‘ঘৃণা’ কেন ? গণহত্যার ভীতিই-বা কেন ওদের তাড়া করে ফেরে? কথিত গ্যাস চেম্বার কেন শুধু তাদের জন্যই? মিশর কেন তাদের চাবুক মেরেছিল? বেবিলনীয় শৃঙ্খল কেন তাদেরই ঘাড়ে? আশেরও কেন ওদের ধরে নিয়ে গেল? রোম-গ্রিস কোথাও তাদের শান্তি মিলেনি? শিকার-ভূমি আমেরিকায় কেন তৈরি হয় দ্য প্যাশন অব দ্য খ্রাইস্ট-বা এসবেরও আগে যে প্রশ্নটি তাহলো, স্বয়ং জেহোবা কেন ওদের প্রতি ক্রুদ্ধ? চল্লিশ বছর ধরে মরুভূমিতে কেন ঘুরে বেড়াতে হলো যাযাবর হয়ে ? যাত্রার পুরো প্রজন্মকেই বা কেন বিনাশ করে দেয়া হলো? মুসা নিজ জাতির মধ্যে কেন প্রাণশংকায় থাকতেন?.......... যে-ঈশ্বর নিজেই ঘোষণা দিলেন যে ওরা তার বাছাই-করা বান্দা, সেই তিনি নিজেই উদ্যত হলেন সমগ্র জাতটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ?’
চারশ বছর মিশরের গোলামি, চল্লিশ বছর উদ্বাস্তু আর সত্তর বছর ব্যাবিলন বন্দিত্ব- সবমিলিয়ে এক অভিশপ্ত জাতির প্রতিরূপ ইহুদি। অথচ সোনার বাছুর, আসমানি কিতাব ও গোত্র পিতার ঐতিহ্য নিয়ে তারা নিয়ন্ত্রণ করছে সারা বিশ্বের পুঁজিবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিন্তা-দর্শনের বিশাল অংশ। ইসরাইল-আরব সংঘর্ষ বা প্যালেস্টাইনিদের স্বাধীনতা আন্দোলন, একবিংশ শতাব্দীর ৯/১১ বা ইরাক আগ্রাসন, বুশ কর্তৃক ক্রুসেড ঘোষণা, ইসলামি জঙ্গি বা ধর্মীয় সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা - এ সবই ইহুদীবাদী চক্রান্ত বা তার ফল এমন প্রতীতির মধ্যে ধর্মীয় আবেগের প্রাবল্যই মুখ্য বলে মনে হয়। কিন্তু শামসুদ্দোহা শোয়েব নিজকে ইহুদিবিদ্বেষীদের দলভূক্ত করেও প্রাধান্য দিয়েছেন যুক্তি ও ইতিহাসকে। তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের শিকড় তিনটি শব্দজোড়ের মধ্যে প্রোথিত - ‘বান্দির বাচ্চা’ ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ এবং ‘ পছন্দের গোষ্ঠী’ (chosen people)। তাঁর মতে এগুলো ইহুদিবাদীদের প্রাচীন ষড়যন্ত্র। ‘ইহুদিবাদ ’ বা ‘জায়োনিজম’ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ আলোচনা শেষে লেখক বাইবেল এবং কুরআনের সাথে ইহুদি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও পুরাণ-কে পরীক্ষা করেছেন। মূলত পুরো আলোচনাকে ইহুদি জাতির ইতিহাস ও ইহুদিবাদের স্বরূপ বিশ্লেষণ বললে ভুল বলা হয় না।
আগ্রহী পাঠকের জন্য সূচিপত্রে উল্লিখিত অধ্যায়গুলোর শিরোনাম উপস্থাপন করছি, অবশ্য প্রতিটি অধ্যায় অনেকগুলো উপশিরোনামে বিভক্ত যা এখানে উল্লেখ করা হয় নি-
প্রথম অধ্যায় : ইহুদিবাদ ও ইতিহাস
দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইবেল পরিচিতি
তৃতীয় অধ্যায় : সৃষ্টি-পুরাণ থেকে রাজ্য
চতুর্থ অধ্যায় : গ্রিক ও ইহুদি/ রোম ও ইহুদি
পঞ্চম অধ্যায় : ফিলিস্তিন ও ইতিহাস
ষষ্ঠ অধ্যায় : পশ্চিম ও ইহুদি
সপ্তম অধ্যায় : ইসলাম ও ইহুদি
অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ অধ্যায় : বাইবেল ও ইহুদিবাদ
চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ অধ্যায় : কুরআন ও ইহুদিবাদ
অষ্টাদশ অধ্যায় : পরিশিষ্ট
ঊনবিংশ অধ্যায় : টিকা-ভাষ্য
অধ্যায়গুলোর শিরোনাম থেকে শোয়েবের আলোচনার ব্যাপকতা ও গভীরতা অনুমান করা যাবে না। কারণ শামসুদ্দোহা শোয়েব কেবল ধর্মগ্রন্থ গুলোতে বর্ণিত কাহিনীতে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। যেমন ইব্রাহিম, ফেরাউন, আদম-হাওয়া, হাবিল-কাবিল, খৎনা, নুহ ও প্লাবন ইত্যাদি চরিত্র-উপাখ্যানগুলোর আসল পরিচয় উদ্ঘাটনে প্রাচীন মিথ ও পুরাণ-বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। সুপ্রচলিত প্লাবন ও নুহের নৌকা সম্পর্কে শোয়েব লিখেছেন-
প্লাবন-গল্পটির মূল চরিত্র হচ্ছেন মহাকাব্য জিউসুদ্রার সুমেরীয় রাজা জিউসুদ্রা, যিনি ছিলেন শুরুপাক নামের নগর রাষ্ট্রের (বাগদাদ থেকে একশো পঁচিশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে) প্রধান নির্বাহী; এবং তিনি উত্তরাধিকার ছিলেন পিতা ও সুমেরীয় রাজা শুকুরলামের। আর সময়কালটি ছিল জেমদেত নাসার যুগের শেষ অধ্যায় ( খ্রি.পূ আনু. ২৯০০)। ............ বন্যা থেকে রক্ষা পেতে জিউসুদ্রা একটি সওদাগরি নৌকায় ওঠেন। সেটি ভসতে ভাসতে পারস্য সাগরের (আরবীয়) মুখে এসে আটকা পড়ে। জিউসুদ্রা বা নুহ নামের ব্যক্তিটি সেখানকার মাটিতে নেমে একটি ঢিবির ওপরকার মন্দিরে পশুবলি দেন; তবে সে জায়গাটি কোনওক্রমেই কোনও পাহাড় ছিল না। বাইবেল কাহিনীকারের ভুল অনুবাদে ঢিবি ( Hill ) পরিণত হয়েছে পাহাড়ে (Mountain)। প্রকৃতপক্ষে জিউসুদ্রার নৌকাটি বাইবেল উল্লিখিত পাহাড়ের ধারেকাছেও যায়নি। একইরকম আরেকটি ভুল অনুবাদ হচ্ছে ‘নদী’র বদরে ‘সমুদ্র’ শব্দের ব্যবহার। বন্যা শেষে উদ্ধারপ্রাপ্ত আরও অনেকের সঙ্গে নুহের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা হয়েছিল , সেসবই কিংবদন্তি ও পুরাণকাহিনীগুলোর বিষয়আখ্যান। আর শুরুপাক প্লাবনের মূল কথক হচ্ছে তিনজন। এদের উক্ত গল্পই ভুল অনূদিত হয়েছে পুরাণকাহিনীগুলোসহ হিব্রু বাইবেলে।
এভাবে, শোয়েব একে একে বর্ণনা করেন হাবিল-কাবিল, আদম-হাওয়ার কাহিনীর পৌরাণিক ভিত্তি। শরীয়ত বা ধর্মীয় আইনের উৎস, সৃষ্টিপুরাণ, মুসার সমুদ্র-পুরাণের সাথে কেনানীয় মায়া বা হিন্দু পুরাণের সাদৃশ্য, একেশ্বরবাদিতার উৎস, মহাকাব্যিক রাজা গিলগামেশ, সম্রাট আশুরবনিপালের পাঠাগার এবং এমন আরো অনেক বিষয় যেগুলো ধর্মগ্রন্থ বা সেগুলোর ব্যাখ্যা থেকে সামান্যই জানা সম্ভব।
শামসুদ্দোহা শোয়েবের আলোচনার মূল ক্ষেত্র বাইবেলে বর্ণিত সেমেটিক পুরাণ ও তার বিকৃতি বা বিবর্তন কিন্তু একাধারে ইঞ্জিল, তাওরাত, সুমেরীয় পুরাণ, ফিনিশীয় পুরাণ, সেমেটিক সংস্কৃতি, দানিকেন, আরব তথা মধ্যপ্রাচ্যের নৃতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস, পৌরাণিক উপাখ্যান বিশ্লেষণ করে প্রকৃতপক্ষে আরব ভূ-খণ্ডের ধর্মীয় উত্তরাধিকারের ভিত্তিমূলে পৌঁছে যাবার চেষ্টা করেছেন শোয়েব। যেমন বাইবেলের উৎস সম্পর্কে শোয়েব লিখছেন -
“এর পুরোটাই নিকটপ্রাচ্য থেকে আহরিত। হয় সুমেরীয় পুরাণের নকল, নয়তো মিশরীয় পুরাণের । প্লাবন ঋষি উৎনাপিশতিমকে নিয়ে যেমন আছেন গিলগামেশ, তেমনি আছেন হামুরাবি- তার আইনসংহিতা নিয়ে। এরও ওপর আছে পারস্য প্রভাব-আছেন জরস্ত্রুত। আছে গ্রিক-রোমানরাও। আছে কেনানীয়, ফিনিশীয় ঐতিহ্য, শ্রুতি-কিংবদন্তীর সমারোহ। মোয়াবের বাল পিয়োর পাহাড় তাকে যেভাবে মূর্তি দিয়েছে সেভাবে মাদিয়ানের তুর তাকে দিয়েছে একেশ্বরবাদ। ইতিহাসের নিরেট সত্য হলো : ‘সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এরকম হাজার হাজার পুঁথিগত-মূলপাঠ এবং শিললিপির আবিস্কার ঘটেছে যেসব থেকে পুরাতন নিয়ম বিশেষজ্ঞরা আরও পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেন যে, প্রতিবেশী জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে হিব্রু ধর্ম-দেবতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটির ধরন, যেসব অর্ন্তলীন হয়ে আছে ধর্মতাত্ত্বিকতার গঠন,প্রকাশসহ নানাস্তরে।’
আদি পুস্তকে আমরা পাই ‘বান্দির বাচ্চা’ শব্দদুটো। যেখান থেকে, শোয়েব মনে করেন, যাত্রা শুরু ধর্মীয় সংঘাতের। উদ্ধৃতিটি এরকম-
ছেলেসুদ্ধ ওই বান্দীকে (ইসমাইলজননী-হাজেরা) বের করে দাও। কারণ ওই ছেলে (আরব জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ ইসমাইল) আমার ইসহাকের (ইহুদি-খ্রিস্টানদের পূর্বপুরুষ) সঙ্গে বিষয়সম্পত্তির (ফিলিস্তিনের) ওয়ারিশ হতে পারবে না।
ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্ব যে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে থাকে তার শিকড় নিহিত বাইবেল ও তার ইহুদিবাদী ব্যাখ্যায়। বাইবেলে বর্ণিত ‘বান্দির বাচ্চা’ ‘প্রতিশ্র“ত ভূমি’ এবং ‘ পছন্দের গোষ্ঠী’ (chosen people) এই তিনটি ক্ষেত্রেই কোরআনের ব্যাখ্যা ভিন্ন। কোরআনে হাজেরা সম্পর্কে বিস্তারিত না থাকলেও ইসমাইলকে নবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, একইভাবে পূর্বাপর সকল একেশ্বরবাদীকে ঈশ্বরের অনুগামী, বিশ্বাসী ও আত্মসমর্পণকারী হিসেবে শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে কোরআনে। প্রতিশ্রুত ভূমি সম্পর্কে কোরআন নিশ্চুপ থাকলেও 'পছন্দের গোষ্ঠী' সম্পর্কে কোরআন স্পষ্ট জানায় মুসলমানরাই সেই পছন্দের জাতি ( অর্থাৎ প্রকারান্তরে মুসলমানগণই সেই ভূমির বৈধ দাবিদার) -
“ তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও, আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করো”
তাছাড়া বাইবেলে বর্ণিত কুরবানির কাহিনী থেকে ইব্রাহিম-ইসহাক কথোপকথন উদ্ধৃত করে শোয়েব জানাচ্ছেন ইসমাইল ও ইসহাকের বয়সের পার্থক্য এবং বাইবেলের বর্ণনায় ব্যাপক গোঁজামিল ও মিথ্যাচার রয়েছে। বিষয়টি উল্লেখযোগ্য-
‘ ইব্রাহিমের ছিয়াশি বছর বয়সে জন্ম নিয়েছেন ইসমাইল। আর ইসহাকের জন্ম হয় একশ বছর বয়সে। সে অনুযায়ী, ইসহাক ইসমাইলের চেয়ে চৌদ্দ বছরের ছোট এবং দেখা যায়, কুরবানির নির্দেশকালে ইসহাক সবেমাত্র মায়ের দুধ ছেড়েছেন। তার মানে, ইসহাকের বয়স তখন দু-বছরের কমবেশি। এদিকে ইব্রাহিম নিজের যে সন্তানকে কুরবানগাহে নিয়ে যাচ্ছেন, সে ভালোমন্দ বোঝে। বাপের সঙ্গে ঠিকমতো কথা চালিয়ে যেতে পারে। কাজেকর্মেও পটু এবং বাপকে যথাসাধ্য সাহায্য করছে। প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, দু-বছরের ছেলের পক্ষে কি তেমনটি সম্ভব? ’
ইহুদিরা যেখানে যিশুকে ‘জারজ’ আখ্যা দেয়, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় মৃত হিসেবে উপস্থাপন করে সেখানে কোরআন যিশুর জন্মকে ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং পবিত্র বলে ঘোষণা করে, যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়াকে নাকচ করে কুরআন। যিশুকে ঈশ্বরের কাছে তুলে নেবার কথা বলে একেশ্বরবাদিতার বিজয় ঘোষণা করে কোরআন। অথচ বাইবেলে বর্ণিত যিশুর বাণী আমাদেরকে পীড়িত ও বিস্মিত করে, এগুলো কোন এক মহাপুরুষের বাণী বলে বিশ্বাস হয় না-
আমি দুনিয়াতে শান্তি দিতে এসেছি এই কথা মনে করো না। আমি শান্তি দিতে আসিনি বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি; ছেলেকে বাবার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, স্ত্রীকে শাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে এসেছি। একজন মানুষের নিজের পরিবারের লোকেরাই তার শত্রু হবে। (মথি ১০:৩৪-৩৬)
কিন্তু বিস্ময় অন্যত্র। শামসুদ্দোহা শোয়েব বিভিন্ন উৎসের সন্ধান দিয়ে জানিয়েছেন যিশু এক কল্পিত চরিত্র হওয়াও অসম্ভব নয়। যেমন, মুসাও ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্থের এক হেঁয়ালি চরিত্র, ইব্রাহিমের পূর্বপুরুষও এক রহস্যাবৃত অধ্যায়। শোয়েব জানাচ্ছেন,
‘ মানব জাতির লক্ষ বছরের ইতিহাসকে সামনে রেখে এই দ্বিধাহীন ঘোষণা উচ্চারিত হতে পারে যে, শাম নামের কেউ কখনও ছিলেন না। শামীয় বংশধর বলে কথিত কোনও ইব্রাহিমের কেনান আগমন ঘটেনি।’
আদি, যাত্রা, লেবীয়,ও গণনা পুস্তকের লেখক হিসেবে হযরত মুসা (আ.)এর নামোল্লেখ করে শোয়েব প্রথমে সেগুলোর ইহুদিবাদী ভাষ্য ও পরে নিজস্ব বিশ্লেষণ সংযুক্ত করেছেন। এ পর্যায়ে তিনি ব্যাপক তথ্যসূত্র ও গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন প্রকৃতপক্ষে এক প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইহুদিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করাই বাইবেল ও তৎপূর্ববর্তী সবগুলো ঐশ্বরিক গ্রন্থের লক্ষ্য, যা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বাইবেল লেখকগণ তথ্যবিকৃতি ও ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছেন। মনগড়া কাহিনী উপস্থাপনও বাদ যায় নি। আসলে বাইবেল আদি পুস্তকের ইহুদিবাদী ভাষ্য।
অন্যদিকে কোরআনের মূল প্রক্ষেপণ একেশ্বরবাদিতার দিকে; ইব্রাহিমের একেশ্বরবাদিতা ও একটি সৎ-ধর্মপরায়ণ পুত্রের জন্য প্রার্থনাই এখানে গুরুত্ব পায়। তাই নুহ থেকে মুহম্মদ (স.) পর্যন্ত সকল একেশ্বরবাদীকে নবী হিসেবে উপস্থাপন করে কোরআন এবং পূর্ববর্তী সকল ধর্মগ্রন্থের অসংগতি ও ত্র“টিগুলো পরিমার্জনা করে নতুন রূপ দেয়। প্রার্থিত সন্তান হিসেবে হযরত মুহম্মদ (স.) কে প্রতিষ্ঠিত করে কোরআন। যার পূর্বপুরুষ একেশ্বরবাদী নবী ইসমাইল (আ.)। বিরোধ এখানেই। হাজার বছর ধরে ‘বান্দির বাচ্চা’ গাল দেয়া আরবীয় ইসমাইল কোরআনে হয়ে ওঠেন ঐশ্বরিক ধর্মের আদি পুরুষ। ইহুদিরা যেখানে কেনানকে কণ্টকমুক্ত রাখতে বাইবেলের বিকৃতি ঘটিয়ে ইসহাককেই ইব্রাহিমের একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে এমনকি বংশধরদের চরিত্র হরণেও পিছপা হয়নি সেখানে কোরআনের মধ্য দিয়ে ইসমাইলের উত্থান ইহুদিবাদীদের কাছে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতই ব্যাপার। এভাবে ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে মানুষের মুক্তির বদলে পৃথিবীর সবচে পুরোনো জাতিগত বিদ্বেষের বীজ বপন করা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন শোয়েব। এ কারণেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ইসলাম-পশ্চিম সংঘাতকে ‘ইসহাক ও ইসমাইলের লড়াই’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন (শামসুদ্দোহা শোয়েব অবশ্য এ তথ্যের পক্ষে কোন সূত্র দিতে পারেন নি)। অথচ ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ছিলো খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। খ্রিষ্ট ধর্মমতে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে ইহুদিরাই। পরবর্তীতে ইহুদিবাদকে নিশ্চিহ্ন করার যাবতীয় উদ্যোগ ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্ব থেকেই গৃহিত হয়েছিল যার বিপুল তথ্যসংশ্লেষ রয়েছে আলোচ্য গ্রন্থের ‘পশ্চিম ও ইহুদি’ অধ্যায়ে ( খ্রিষ্টীয় ৩১৪ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ইউরোপে ইহুদি নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংযোজিত হয়েছে এ অধ্যায়ে)। কিন্তু কালক্রমে ইহুদি-খ্রিষ্টান একাট্টা হয়ে যায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এতে রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাব তো ছিলই, সাথে ছিল জায়োনিজমের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা- একটি ইহুদিরাষ্ট্রের জন্ম ; সেই প্রতিশ্রুত ভূমির অধিকার।
ওল্ড টেস্টামেন্ট, তাওরাত বা আবেস্তাঁর পথ ধরে যদি আমরা পেছনের দিকে যেতে থাকি তাহলে মিশরীয় সভ্যতার আদিপিতাদের আমলের ১৮০ খণ্ডের ‘Book of Dead’ নামে প্যাপিরাসে লেখা যে গ্রন্থটির বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে পরকাল, বিচার দিন, পাপীর শাস্তিভোগ, নিষ্পাপের স্বর্গবাস ছাড়াও ভাল ও খারাপ কাজের তালিকা প্রথম পাওয়া যায়। আবেস্তাঁয় পাওয়া যায় পুল সেরাত, শয়তানের ধারণা। কিন্তু সবক্ষেত্রেই একটা বিষয় ব্যতিক্রমহীন- সবগুলোই ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ হিসেবে দাবি করা হয়েছে আর এ কাজটি সম্পন্ন হয়েছে ধর্মীয় পুরোহিত এবং রাজশক্তির ( কিংবা গোত্রপিতা ) যৌথপ্রযোজনায় । কখনো থঠ, কখনো জিহোবা, কখনো গড (সদাপ্রভু) বা ব্রহ্মা নামে সর্বশক্তিমান তাঁর প্রেরিত পুরুষের কাছে পাঠিয়েছেন মানবমুক্তির বাণী। এগুলো রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করার পথ দেখায়। ‘Code of Laws’ ( হাম্বুরাবির কাছে সূর্যদেবতা শামাস প্রেরিত অনুশাসন), `Ten Commandments’ (মুসা নবীর কাছে জিহোবা প্রেরিত অনুশাসন) ' Four Gospels’ ( নিউ টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত যিশু খ্রিষ্টের জীবনী ও বাণী যা ঈশ্বরের কথা বলে মনে করা হয়) বা ‘মনু সংহিতা’ ( মনুর স্মৃতি বা মনু কর্তৃক নির্দেশিত অনুশাসন যা ভগবান স্বয়ং মনুকে দান করেছিলেন। ভগবতগীতাও শ্রীকৃষ্ণের মুখে উচ্চারিত ভগবানের প্রত্যাদেশ) - সবগুলোই একের পর এক অনুশাসনের কথা বলে যা সর্বশক্তিমান কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের মাধ্যমে নির্দেশিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। ধর্মের এই সমধর্মিতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে পুরাণই অব্যর্থ আশ্রয়। কারণ ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, জীবনজিজ্ঞাসা আর সৃষ্টি-রহস্য সম্পর্কে প্রাচীন মানুষের স্বনির্মিত কল্পকাহিনীই পুরাণ। পুরাণস্রষ্টা মানুষই প্রকৃতিবাদী দর্শনের জন্মদাতা যার হাত ধরে এগিয়েছে ধর্মদর্শন। শামসুদ্দোহা শোয়েব বাইবেলের সাথে পুরাণের যোগসূত্র সন্ধানে লক্ষ্যভেদী। তার আলোচনার সবচেয়ে প্রাণবন্ত দিকই হল এটি। এজন্য তিনি প্রায় একশো পৃষ্ঠাব্যপী টীকাভাষ্য সংযোজন করেছেন, আক্ষরিক অর্থেই যা তার আলোচনার প্রাণ এবং ব্যাপক তথ্য সমাবেশে ঋদ্ধ।
‘ইসলাম-পশ্চিম সংঘাত ও বাইবেল’ বইয়ের আলোচনাকে যদি দুটো ভাগে ভাগ করা হয় তবে তার এক ভাগে থাকবে আদি পুস্তক-বাইবেল-কোরআনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ অন্য ভাগে থাকবে বিশ্লেষণের পৌরাণিক যোগসাজশ বা ভিত্তি। শোয়েব মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক বিশ্ব-রাজনীতি সম্পর্কে বিক্ষিপ্তভাবে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা এই গ্রন্থ সম্পর্কে তার চিন্তার ভিত্তি হলেও আমি মনে করি এ আলোচনা স্বতন্ত্র প্রবন্ধ হিসেবে আরো উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ হত। এছাড়া কয়েকটি বিষয় আমার কাছে অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়েছে। যেমন-
১. ‘হাজেরা ছিলেন ইব্রাহিমের বৈধ এবং প্রথম স্ত্রী ’ (শোয়েব,২০০৮,পৃ. ২৩) এমন ধারণার পক্ষে কোন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ বা যুক্তি লেখক উপস্থাপন করেন নি। টিকাতে কেবল হাজেরার জন্মস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্যের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। তবে হাজেরাকে ‘বান্দি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ইব্রাহিমের মিশর অভিগমন ও ফেরাউনের সঙ্গে সাক্ষাত পর্বটি যে ইতিহাস অসমর্থিত বা ব্যাপক গোঁজামিল তা স্পষ্ট।
২. স্ত্রী সারার প্রতি ইব্রাহিমের আনুগত্যের তিনটি ঘটনা উল্লেখ করার কথা লিখলেও দ্বিতীয় ঘটনাটি কোন কারণে বাদ পড়েছে।
৩. বাইবেলে অনুপস্থিত কিছু বিষয় যা কুরআনে উল্লেখ আছে সে সম্পর্কে লেখক নিরপেক্ষ থাকতে পারেন নি। কারণ বাইবেল রচনার কাল কুরআনের অনেক আগে। তা ছাড়া লেখক নিজেই যুক্তি দিয়েছেন ব্যাবিলনের বন্দিত্ব যুগেই পুরোহিতদের হাতে বাইবেলের কাহিনীগুলোর ইহুদিকরণ হয়েছিল। সেক্ষেত্রে মুহম্মদের (স.) নবুওত মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বাইবেলের দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা যুক্তি সমর্থিত হতে পারে না। একজন আরবীয় নবির জন্য পিতা-পুত্রের প্রার্থনা বাইবেলে থাকারও কোন যুক্তি নেই। বরঞ্চ এটি কুরআনে থাকাই যুক্তিসঙ্গত।
৪. প্রথম অধ্যায়ে মূল আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে আকস্মিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য ‘সমাধান কোন পথে?’ , আগামী পঞ্চাশ বছরের অনুমিত বিশ্ব-রাজনীতি (পঞ্চাশ বছর - হ্যাঁ, পঞ্চাশ বছর) আলোচনার লক্ষ্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে, অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই এ অংশটি সন্নিবেশিত হয়েছে। বিষয়টি একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধে স্থান পেতে পারে।
৫. ‘পরবর্তী সময়ে ইহুদিরা যখন মুসলিম শাসনাধীনে আসে তখন স্পেন থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত অঞ্চলে তারা ইসলামি পুরাণেরও সাহচর্য পায়।’ ( শোয়েব ২০০৮, পৃ. ১৬৭) এখানে ইসলামি পুরাণ বলতে লেখক কোন পুরাণের কথা বলছেন স্পষ্ট নয়।
৬. সমৃদ্ধ টিকা-ভাষ্য থাকলেও সেগুলো সংযোজনের ক্ষেত্রে লেখককে পরবর্তী সংস্করণে আরো যত্নবান হওয়ার অনুরোধ জানাবো। টিকা-ভাষ্যগুলো অধ্যায় শেষে সংযোজন করলে বা পাদটিকা আকারে দিলে মূল পাঠ অনুসরণ করতে যেমন সুবিধা হত, পড়ার প্রতিবন্ধকতাও অনেকটাই দূর হয়ে যেত বলে মনে হয়।
৭. অসংখ্য পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রের উপস্থিতির কারণে বইটিতে একটি পরিশিষ্টের (তথ্যসূচী সংবলিত) অপরিহার্যতা বোধ করেছি। বাইবেলীয় বংশলতিকার একটি ছক ( আমি একটি সংযোজন করলাম যা ঠিক বাইবেলীয় না হলেও অনুরূপ) এবং সেসাথে প্রাচীন আরবভূমির মানচিত্র (একটি মানচিত্রের লিংক দেয়া হল) থাকলে অনেক নবীন পাঠক উপকৃত হতেন।
আশা করবো বইটির পরবর্তী সংস্করণে লেখক উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখবেন। এমন একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে শামসুদ্দোহ শোয়েব যে ব্যাপক পঠন ও গবেষণার স্বাক্ষর রেখেছেন তা প্রশংসাযোগ্য। তবে আমার কাছে কখনো কখনো মনে হয়েছে তিনি আলোচনার ক্ষেত্রে আরো বেশি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারতেন তাতে গবেষণামূল্য বাড়ত বৈ কমত না। তার আলোচনার ভাষা থেকে প্রায়ই একজন কট্টর মুসলিম এবং ইহুদিবিদ্বেষীর আক্রোশের ছবি ভেসে আসে। তবে এ গবেষণার জন্য ব্যাপক তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে লেখকের যে শ্রম ও নিষ্ঠার পরিচয় পাঠক পাবে তা যতটা একজন মুসলিমের তারচেয়ে বেশি একজন অনুসন্ধানী গবেষকের এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ বিষয়ে আগ্রহী পাঠকেরা বইটি পড়ে উপকৃত হবেন সন্দেহ নেই।
এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী বই প্রকাশনায় সাহসী উদ্যোগের জন্য বইটির প্রকাশক শুদ্ধস্বর-কে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। এসব বই প্রকাশের নৈতিক বল আমাদের দেশে খুব কম প্রকাশকেরই আছে।
মন্তব্য
সহমত ।
ধর্মীয় পরিচয়ের গন্ডি থেকে বেরিয়ে "মানুষ" হওয়ার জন্য এরকম আলোচনা-সমালোচনা আরো বেশি বেশি করা দরকার । বইয়ের লেখককে চমৎকার গবেষণার জণ্য সাধুবাদ জানাচ্ছি ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
শুদ্ধস্বর তার কাজ করেছে , এবার পাঠকের কাজ নিজের কাজটি করা।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
প্রি প্রোডাকশনে যুক্ত থাকার কারণে বইটা আমাকে পড়তে হয়েছে বহু বহু বার
লাইনকে লাইন শব্দকে শব্দ ধরে লেখকের সাথে ঝগড়া করতে হয়েছে- এখানে রিপিটেশন এটা বাদ দেন। ওখানে গ্যাপ ওটা পূরণ করেন। এটার দরকার নেই ওটা যোগ করেন...
আমার অত্যাচারে লেখক সন্ন্যাসী হবার সিদ্ধান্ত নিয়েও বইটাকে আরেক নজর দেখায় ২২ ফর্মার বই নেমে এসেছিল ১৫ ফর্মায়
বইটা একটা ভয়ানক খাটনির ফসল তাকে কোনো সন্দেহ নেই আর রেফারেন্স হিসেবে এক জায়গায় এক অসাধারণ সংগ্রহ এই বই
সঙ্গে অনেকগুলো বিশ্লেষণও অনেক নতুন চিন্তার ইঙ্গিত দেয় তাতেও কোনো সন্দেহ নেই
কিন্তু
০২
বইটা উপস্থাপনায় লেখক ইহুদিদের প্রতি অবিচার করেছেন যা আমি সমর্থন করি না
পৃথিবীতে হত্যার শিকার হওয়া এবং অত্যাচরিত হওয়ার তালিকায় ইহুদিদের কাছাকাছি কেউ নেই
এতো বেশি মরেছে তারা। এতো বেশি পালিয়েছে তারা এতো বেশি মার খেয়েছে তারা চার হাজার বছর ধরে
আর মার খেতে খেতেই আবিষ্কার করে নিয়েছে মার দেবার কৌশল। মরতে মরতেই শিখে নিয়েছে বেঁচে থাকার উপায়
এটা কি তাদের দোষ?
গত চার হাজার বছর ধরে কে মারেনি ইহুদিদেরকে? কার হাতে ইহুদিরা মার খেয়েছে কম?
০৩
শোয়েব ইব্রাহিমকে নবী হিসেবে না দেখিয়ে গোষ্ঠীপিতা হিসেবে দেখিয়েছেন
আমি নিজেও তাকে ওভাবেই দেখি
আজকের যুগে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই ধর্মের দিক থেকে ইব্রাহিমের তিন বংশের ঠিকাদারির আওতায় পড়ে। কিন্তু তিনটার বৈশিষ্ট্য একেবারেই আলাদা
০৪
সেমেটিক নবী কিংবা গোষ্ঠীপিতা ইব্রাহিম বংশের তিন ধারা। প্রথম ধারা মুসার অনুসারী ইহুদি; স্বভাবে যাযাবর এই ধারার কোনো নিজস্ব ভুখণ্ড না থাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরগাছা ও উদ্বাস্তুর মতো থেকে থেকে চার হাজার বছর ধরে শিকার হয়েছে মানব ইতিহাসের সব চেয়ে জঘণ্য আর দীর্ঘমেয়াদি নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। পরদেশে পরগাছার মতো থাকতে থাকতে তারা অস্তিত্ব রক্ষার কৌশল হিসেবে আত্মস্থ করে নিয়েছে অতি সূক্ষ্ম কূটনীতি আর বাণিজ্যবিদ্যা। এবং হাজার হাজার বছর ধরে পরদেশী আর মাইনরিটি থাকার কারণে নিজেদের বিশ্বাসে এরা ক্রামগত হয়ে উঠেছে গোঁড়া থেকে গোঁড়াতর
দ্বিতীয় ধারা যিশুর অনুসারী খ্রিস্টান। বিদেশের মাটিতে যারা তাকে হত্যা করেছে পরবর্তীতে তারাই হয়ে উঠেছে তার মিশনের উত্তরাধিকার। তারাই নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিয়েছে তার আদর্শ ও ইতিহাস। যিশুর প্রচারে যিশুর বংশ কিংবা অঞ্চলের কোনো লোক না থাকায় এই ধারাটিতে যুক্ত হয়েছে সর্বমুখী ফ্লেক্সিবিলিটি এবং এ্যাডপটিবিলিটি। মানুষের পক্ষে যা যা করা সম্ভব সবকিছু কো-অপ্ট করে নেবার অফুরান সুযোগ থাকায় এই ধারাটি দুর্দান্ত হয়ে উঠেছে শাসন ও বিস্তারে
আর তৃতীয় ধারা মোহাম্মদের ইসলাম। নিজেদের মাটিতে থেকে এবং শুরু থেকেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি বিস্তৃত হবার কারণে কঠোরতা, আপোষহীনতা এবং রিজিডিটি হয়ে উঠেছে এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যুদ্ধ এবং রাজ্যজয় এদের ইতিহাসের মূল উপাদান
গত চার হাজার বছর ধরে ইব্রহিম বংশের এই তিনটি ধারাই কোনো না কোনোভাবে লড়াই করছে একের বিরুদ্ধ্যে অন্যে। হত্যা করছে একে অন্যকে। আর সবক্ষেত্রেই হত্যার সহায়ক কিংবা ঢাল কিংবা অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করছে একই ঈশ্বর এবং একই গোষ্ঠী ইতিহাসর তিনটি উত্তরাধিকার বা ধর্মকে
গত চার হাজার বছর ধরেই রাজনৈতিক ইতিহাসের ধর্মীয় ব্যাখ্যা এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের রাজনীতিকরণের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে সেমেটিক ইব্রাহিমের এই তিনটি উত্তরাধিকার
এবং তৈরি করছে নতুন নতুন সংকট, সংঘাত আর শত্রুতা
আর এরই বিশ্লেষণ এই বই
০৫
এই বইটাতে বিশ্লেষণগুলো খুবই চমৎকার। ছাপার আগে শোয়েব ভাইকে বারবার বলেছিলাম- বইটা পড়ে যেন আপনাকে ইহুদি বিদ্বেষী মনে না হয় তাহলেই বইটা একটা ক্লাসিক্যাল পর্যায়ে চলে যাবে। লেখক আমার কথাটাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন- আমি ইহুদি বিরোধী নই। আমি ইহুদিবাদ বিদ্বেষী
কিন্তু মার খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য অস্তিত্বের লড়াই করতে করতেই যে ইহুদিরা ইহুদিবাদ তৈরি করেছে সেটা হয়তো তিনি পাত্তা দিতে চাননি
এইজন্য সারা বইটা ইহুদিদের নির্যাতিত হবার বর্ণনা দিয়েও যেন একপেশে হয়ে গেছে কোথাও
০৬
বর্তমান ইহুদিবাদ সারা পৃথিবীরই অশান্তির একটা কারণ এতে কোনো সন্দেহ নেই
কিন্তু এই মানবজাতিই তাদেরকে হত্যা এবং অত্যাচার করেছে চার হাজার বছর ধরে
মানব জাতির অংশ এবং উত্তরাধিকার হয়ে সেটা অস্বীকার করলে বোধহয় কিছুটা চোখ বন্ধ করে সত্যকে অস্বীকার করার মতো হয়ে যায়...
০৭
বইটা নিত্যদিনের সংগ্রহে রাখার মতো একটা বই
আপনার সাথে একমত- লেখককে প্রায় সময়ই ইহুদিবিদ্বেষী মনে হয়।ইহুদিদের হাজার বছরের উদ্বাস্তু জীবন আর অত্যাচারিত হওয়ার ইতিহাসকে তিনি উপেক্ষা করেছেন। যে ধারায় তিনি বাইবেলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন একই ধারায় কোরআনকেও দাঁড় করানো যায় কিন্তু সেটা তার আলোচ্য নয় বলে প্রাসঙ্গিকও নয়। তবে যতটুকু একপেশে তার আলোচনা তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় তার তথ্য-প্রমাণের ভাণ্ডার। তাই দুর্বলতাটুকু মেনে নিয়েই বলতে হয় অসাধারণ কাজ। বইটির প্রি-প্রোডাকশনের কাজে যুক্ত ছিলেন বলে ধন্যবাদ আপনারও প্রাপ্য।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
বইটা পড়তে হইব
মাহবুবুল হকের আলোচনা আর লীলেনদার মন্তব্যে (বিপ্লব)
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
একটা ব্যাপার আমি বলতে পারি, যে ইহুদীবাদ ব্যাপারটা ইহুদীদের বর্তমান সাফল্যের চাবিকাঠি বললে ব্যাপারটার অতি-সরলীকরণ হয়। বর্তমান বিজ্ঞানে ইহুদীদের যা অবদান, তার ধারে কাছে আর কোনো জাতিগোষ্ঠী আসতে পারে বলে মনে হয় না। এর জন্য ইহুদীদের প্রশংসা প্রাপ্য ... অত্যাচারিত বলেই হয়ত তারা একটা ব্যতিক্রমী পথ সহজে খুঁজে নিতে পেরেছে।
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ঠিক।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
জ্ঞান চর্চা এবং বাণিজ্য কৌশলই তাদেরকে টিকিয়ে রেখেছে
এই দুইটা জিনিস তারা চর্চা না করলে আজকের পৃথিবীতে ইহুদি নামে কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত কি না সন্দেহ
কোথাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না অস্ত্র দিয়ে লড়াই করে টিকে থাকা
তারা টিকে থেকেছে বিশ্বের কাছে নিজেদেরকে প্রয়োজনীয় এবং অনিবার্য প্রমাণ করে
০২
ওপেনহেইমার কিংবা আইনস্টাইন ইহুদি না হলে নিজেদের কোনো দেশের নাম আজও হয়তো তারা বলতে পারতো না
জনাব শোয়েবের কিছু রচনা আমি অন্যত্র পড়েছি। তাঁর লেখনী ধারালো কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ বলছে, তিনি অনেকসময় ঘটনাকে সঠিক ঐতিহাসিক আর্থ-সামাজিক মাত্রা দিতে ভুলে যান এবং অতিমাত্রায় বিদ্বিষ্ট হয়ে থাকেন। তিনিও অন্য অন্য ধর্মবিদ্বেষী বা ধর্মীয় রক্ষণশীলদের মতো ধর্মকে কেবল তার বাণী দিয়েই বুঝতে চান। এবং আন্তঃ ধর্মের তুলনার মতো একটা অকার্যকর পদ্ধতি বেছে নেন। কেননা তুলনায় কেউ শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হলে কি সেই ধর্মকে আমরা গ্রহণ করবো।
তবে, আমি এ বিষয়েও একমত না যে, অত্যাচারিত হয়েছে বলেই আজকে অপরকে অত্যাচার করায় ইহুদিদের দোষ হয় না। যেমনটা লীলেন ভাই বলেছেন,
তবে তাঁর বাকি মন্তব্যে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার হয়।
আমার কথা এই যে, ইহুদি রাষ্ট্র না হয়ে সেটা যদি এক নিপীড়িতদের মুক্তিকামী রাষ্ট্র হতো, তাহলে কি ইহুদবাদের বর্তমান চেহারা দেখতে পেতাম? একসময় তো ইহুদিদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা প্রাধান্যেই ছিল। সেই সম্ভাবনাকে রদ করেই কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ব্রিটিশদের পাহারাদার রাষ্ট্র স্থাপন করা হয়েছে।
ধরা যাক, এই রাষ্ট্রটি আরবে না হয়ে আমেরিকার কোনো এক অঙ্গরাজ্যে হলো, তখন কি এরকম সামরিক রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারতো? আমার মোদ্দা কথা এই যে, ইসরায়েলের আজকের চেহারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সাম্রাজ্যবাদী বন্দোবস্তের ফল, এর সঙ্গে ইহুদি বা মুসলমান ধর্মের প্রণোদনার সম্পর্ক এতটুকুই যে, সেখানকার ঘৃণার উপাদান এই বন্দোবস্তের প্রয়োজনে আবার চাঙ্গা করা হয়েছে আর দাবিয়ে রাখা হয়েছে উভয় ধর্মের মধ্যকার মৈত্রীর উপাদান।
বিশ্বাসের রূপ যতই গোঁড়া হোক ইহুদিদের মধ্যে অনেক সেরা মানুষ জন্মেছে। জাতিগতভাবে বা সংস্কৃতিগত ভাবে কোনো জাতি বা ধর্ম অন্য কোনো জাতি বা ধর্ম থেকে বেশি খারাপ কিংবা ইনফেরিয়র এমন চিন্তায় আমি ভয় পাই। কে কেমন, তার আগে কেন এমন আর কীভাবে এমন, সেই প্রশ্নটা বেশি জরুরি।
খ্রীস্টান ধর্ম বিশ্বাসে এত মানবিক কিন্তু গত ২ হাজার বছরে ইওরোপে ও উপনিবেশে তার নামে যত নিপীড়ন হয়েছে তত তো আর কোনো ধর্মের নামে হয় নাই।
এত গোঁড়া ও পরবিদ্বেষী ইহুদি ধর্ম কেন, ১৯৪৮ সালের আগে তাদের সেই বিদ্বেষের চর্চা ও প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই।
তৃতীয়ত, ইসলাম কোরান দিয়ে এত বিধিবদ্ধ হলেও কেন দেশে দেশে, সময়ে সময়ে তার এত বৈচিত্র্য ও সৃজনশীলতা ঘটতে দেখা গেল। কেন দুনিয়ায় এক ও অভিন্ন চরিত্রের ইসলাম নাই। আবার মতবাদ হিসাবে এত বৈপ্লবিক হওয়া সত্ত্বেও কেন তার নামে ও তাকে দিয়ে জুলুম চলল। আবার তার নামেই চলেছে মুক্তির সংগ্রাম।
এ যদি সত্যি হয়, তাহলে ইসলামের ইতিহাসের ১৪ শ বছরে কোনো দেশেই কোরানিক শাসন ও আইন প্রতিষ্ঠা করা গেল না। কেন যেখানেই তা গেছে স্থানীয় সংস্কৃতি ও প্রয়োজন মেটাতে তা নমনীয়তা ও আত্মীকরণ ক্ষমতা দেখাতে পেরেছে। কেন তরবারির চাইতে, তার সাংস্কৃতিক ও মানবিক দাওয়াতই মানুষ বেশি গ্রহণ করেছে। খলজি বা কাসিমদের তুলনায় কেন মুসলিম অমুসলিম উভয়ের মধ্যে খান জাহান আলী, চিশতি, বাবা ফরিদ প্রভৃতি সুফি-পীর তথা সমাজ-সংস্কারকদের জনপ্রিয়তা বেশি।
পরিশেষে শামসুদ্দোহা শোয়েবের পরিশ্রম এবং তাঁর বইয়ের ওপর মাহবুবুল হকের পরিশ্রমী নিরীক্ষা এবং মাহবুব লীলেন-এর বিশদ পর্যালোচনাকে অভিনন্দন জানাই।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
একেবারে লাগসই মন্তব্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মবোধ এ ফর্মুলাতে চলে। বিশেষ করে রক্ষণশীল পরিবার বা পরিবেশে যারা বড় হয় তারাতো অবধারিতভাবে এই রাস্তার পথিক। ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে ধর্মাচার সবক্ষেত্রেই 'আমারটা ভাল তোরটা খারাপ' মার্কা 'পোলাপাইন্যা ফ্যাসাদ' করতে তারা অভ্যস্ত।
শোয়েব সম্পর্কে আপনার অনুধাবন কতটা ঠিক জানি না। আমার আশংকাও সেই রকম তবে ভরসা একটাই , ধর্মগ্রন্থের এতটা গোড়াতে হাত দেয়ার পর এর ভেতরকার জারিজুরি তার কাছে পরিস্কার হয়ে যাওয়ার কথা।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
১০০% একমত
আমি সোজা বাংলায় বলি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল একটা দাবার গুটি ছাড়া কিছুই নয়
যাদের মূলত আমরিকা আর ইউরোপের শত্রু হবার কথা ছিল এই ইসরায়েল দিয়ে ইউরোপ আর আমেরিকা সেগুলোকে ইসরাইলের শত্রু বানিয়ে নিচ্ছে
নিজের সুবিধার জন্য
০২
ঝামেলার একটা মূল সূত্র এখানেই
এই ধরনের লোক নিজেদের মতো করে উদারনৈতিক ধর্ম প্রচার করেছিলেন এবং সেই কারণেই জনপ্রিয় হয়েছিলেন কিংবা এখনও আছেন
কিন্তু ধর্ম প্রচারের পর পরেই যারা মুসলমান হিসেবে এসে ক্ষমতায় বসেছে তারা কিন্তু তাদরে মত কিংবা পথ অনুসরণ করেনি
শাসকরা কিংবা রাজনৈতিকরা বরাবরই হয়েছে তলোয়ারি ইসলামের অনুসারী
আমরা মনে হয় এখানে ধর্মের বিভক্তি রেখার পাশাপাশি ভিন্ন আর ও একটি বিভক্তি রেখা দেখতে পাচ্ছি ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
উদ্ধৃতি
আমরা মনে হয় এখানে ধর্মের বিভক্তি রেখার পাশাপাশি ভিন্ন আর ও একটি বিভক্তি রেখা দেখতে পাচ্ছি ।
ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো না এনকিদু।
আপনার পরবর্তী একটা পোস্ট উপরের বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করতে পারে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
একমত @ মাহবুব লীলেন। অপিচ, শাসক যখন চিন্তা বা আদর্শ দিয়ে শাসনের অধিকারে জনগণের সম্মতি আদায় করতে পারে না অর্থাত শাসক যখন হেজিমনি বাদ দিয়ে কেবল ডমিন্যান্স রাখতে চায়, তখন তাকে দাপট দেখাতেই হয়। কিন্তু ইসলাম ও খ্রীস্টবাদে দেখা যায়, শাসকবৃত্তের বাইরে মতাদর্শের একটা হেজিমনিক প্রচারাভিযান চলেছে প্রচারকদের মাধ্যমে। কোথাও তারা মিশনারি, কোথাও তারা সেইন্ট বা পীর বা সুফি। তা ক্ষেত্রবিশেষে শাসককে সহায়তা করেছে আবার কোথাও কোথাও বিদ্রোহও করেছে। সেকারণে শাসক-ধর্মের আর শাসিতর-ধর্মের একটা বিরোধ থেকেই যায়। পরের যুগের শাসকেরা এটা আড়াল করতে কাঁটার মুকুট পরা যিশুকে সোনার সিংহাসনে বসায়, তাদের হাতে পেটে পাত্থর বান্ধা নবী হয়ে যায় সম্রাটতুল্য।
কথা হচ্ছে, এই দুই মূর্তিই নির্মাণ_ইতিহাস নয়।
এর বাইরেও বাংলার সুলতানরা বা দিল্লির আকবর আধুনিক শাসকের মতোই প্রশাসনিকতা (গভর্নেন্স) দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করার দৃষ্ঠান্ত রেখেছেন। ইওরোপের আগেই তারা রাষ্ট্রকাজে ধর্মকে পৃথক করার চর্চা করেছেন, সে যুগে যতটা করা যায়।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
খানিকটা ভিন্নমত আছে। মিশনারি, সেইন্ট, পীর বা সুফি শাসকদের শাসনব্যবস্থা বিস্তৃত করতেই সহায়তা করেছে বেশি যদিও প্রথমটা আর শেষটা এক নয় - মিশনারির উদ্দেশ্যই তাই, সুফিবাদ সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। হয়ত কিছু ক্ষেত্রে মতাদর্শের শক্তি শাসকের নিয়ন্ত্রণকেও ছাড়িয়ে গেছে। যে কারণে বিদ্রোহ আর দমন চলেছে পাল্টাপাল্টি। মধ্যযুগে ধর্ম ও ক্ষমতা যে হাত ধরাধরি করে চলেছে তা আমরা জানি। আজো চলছে - কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে। শাসক আর শাসিতের ধর্ম তো আলাদা হবেই - তবে এই ধর্ম কোন ধর্ম বুঝলাম না। শ্রেণীর ধর্ম হলে ঠিক আছে।
অনেকদিন আগে ফরহাদ মাজহারের একটি লেখায় ইসলামের নবীকে মার্কসের দৃষ্টিকোণ থেকে শোষিত/ব্রাত্য মানুষের নেতা হিসেবে এবং ইসলামকে সে যুগের প্রলেতারিয়েতের ধর্ম হিসেবে দাঁড় করানোর চাতুর্যপূর্ণ চেষ্টা দেখেছিলাম। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর চেষ্টা আর কি!
আপনার আর লীলেনের আলোচনায় প্রসঙ্গটি বারবার আসায়
মনে পড়ল । ইসলামের খেলাফত যুগে আরবের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও রাজ্যগুলোর রাজারা ইসলাম গ্রহণ করতেন নির্দিষ্ট অঙ্কের
মুদ্রা খলিফার কোষাগারে জমা করে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই এই আনুগত্য ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে প্রদর্শিত হত। বলা বাহুল্য,
ইসলাম শব্দের অর্থ 'আনুগত্য' । মধ্যযুগে এই আনুগত্য প্রকাশ
কতটা রাজার প্রতি আর কতটা আল্লাহর প্রতি তা আজকে আমাদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
ধর্মের অখণ্ড সাম্রাজ্যের মধ্যেও শাসক আর শাসিতের ভিন্ন ভিন্ন পরগনার কথা বলবার বেলায় আমার বিবেচনা ছিল তিনটা জিনিষ।
প্রথমত: চেতনার উদয় আর আদল নেয়ার ক্ষেত্রে শ্রেণী ও প্র্যাক্সিসের একটা প্রভাব থাকে। যেকারণে গরিবের ধর্মবোধ আর বড় লোকের ধর্মবোধের চরিত্রগত ভিন্নতা অর্থাত উভয়ের রাজনীতিটা আলাদা হয়ে যায়। বড় লোকের ধর্মবোধ আধিপত্যকামী এবং নিয়মের নিগড়নিষ্ঠামুখী। অর্থাত এক্সক্লুসিভ। এখান থেকেই পোপতন্ত্র বা শরিয়তবাদের দেখা মেলে। গরিবের ধর্মবোধ ইনক্লুসিভ। সেখানটায় নিয়ম খোলামেলা, আইনের থেকে নৈতিকতার ওপর তার জোর থাকে বেশি। নিজ শ্রেণীর চেতনায় তা ধর্মের বিশ্বাসকে রঞ্জিত করে।
দ্বিতীয়ত: দাসদের মধ্যে মুক্তিকামী খ্রীস্টধর্ম, বেদুঈনদের মধ্যে সাম্যকামী ইসলাম আর বাংলার ব্রাত্যদের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার দিয়েই প্রমাণিত হয় ধর্মগুলো গোড়ায় বৈপ্লবিক ডাক নিয়েই এসেছিল (ইহুদি ও হিন্দু ধর্মের প্রসঙ্গে এই সাধারণীকরণ খাটে না সম্ভবত)। পরে তা ক্ষমতার দ্বারা আত্মীকৃত হতে হতে শাসকশ্রেণীর ধর্মে পরিণত হয়। দরিদ্ররা কিন্ত তাদের ধর্মকে অত সহজে ছিনতাই হতে দেয় নাই। ইতালি ও স্পেনে মরমি খ্রীস্টধর্ম তথা এংলিকান, ফ্র্যান্সিসকান প্রভৃতি মধ্যযুগীয় ধারা ক্যাথলিকবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। মার্টিন লুথারের মতবাদ কৃষকশ্রেণীর মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। হালের লিবারেশন থিওলজির কথাও আমাদের আমলে নেয়া দরকার।
আমাদের দেশে ময়মনসিংহ জংয়ে পাগলপন্থিরা তাদের ধর্মীয় বোধ থেকেই জমিদার ও ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তীতুমীরের বিদ্রোহে তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া কিংবা সিপাহি যুদ্ধে চিশতিয়া তরিকার সমর্থনের বেলায় কিংবা সাঁওতাল বিদ্রোহে ঠাকুরের ডাক আর লালনের মতবাদে নিম্নবর্গের নিজস্ব ধর্মচৈতন্যের দিশা মেলে।
রাজরাজড়াদের বিষয়ে যা বললেন, তার সঙ্গে একমত। সম্রাট কন্সট্যান্টিন যেকারণে খ্রীস্টধর্মের পূজক হয়ে সন্তু কন্সট্যান্টিন হয়ে যান, অনেক মধ্যযুগীয় আরব শাসকও সেপথেই মুসলিম হন। কিন্তু এ দিয়েই বোঝা যায় প্রজাকুলের মধ্যে ইসলামের জনপ্রিয়তাই তাদের মুসলিম হতে প্ররোচিত করেছিল, আবার নতুন উদিত শক্তির সঙ্গে আপসের জন্য তো বটেই।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
সত্য সকলি সত্য।
মাহবুবুল হকের পর্যবেক্ষনটি বইয়ের পাঠ সহায়ক হিসাবে কাজে দিবে।
এই ধরনের পর্যবেক্ষন নিয়মিত প্রত্যাশা করি।
---------------------------------------------------------
আমাকে ডাকে আকাশ, বোঝে মাটি হাওয়া জল
বোঝে না মানুষ আর বিনাশী মুদ্রার ছল
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
আমার পক্ষে লেখক শামসুদ্দোহা শোয়েব কে ধন্যবাদ পৌঁছে দেবেন যদি কিছু মনে না করেন। আর নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়মিত এ ধরনের ভালো ভালো বই প্রকাশিত হওয়া উচিত।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
১...
লেখা আর মন্তব্য পড়ে বইটা পড়ার খুব শখ হছে। কিন্তু এই প্রবাস জীবনে কবে সুযোগ পাবো কে জানে?
২...
আপনাদের লেখা পড়ে বোঝাই যাচ্ছে সবাই এই বিষয়ে ভালোই জানেন। অর্বাচীনের কথা, সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নাই, আমার মনে হয়, ধর্মের মধ্যে অধর্ম ঢুকেছে ধর্ম প্রচারকদের হাতে, সবাই তো কিছু করে খেতে চায় আরকি। কথা প্রসঙ্গে, আমি আস্তিক এবং নিজের সাথে ধর্মের বনিবনা না হলেই খালি আমি এই থিয়োরিতে সান্ত্বনা খুঁজি। সুতরাং, এই থিয়োরিকে আপনারা বিশ্বাস ও যুক্তির ছিটমহল ধরতে পারেন।
--- লাইঠেল
ঠিকই ধরেছেন। এ জন্যই তো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের আন্দোলনে আমাদের দেশের মাদ্রাসাকেন্দ্রিক মুসলমানদের এত আগ্রহ।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
সবাইকে ধন্যবাদ।
বইটির প্রতি এত সময়, শ্রম ও মনোযোগ দেয়ায়। পরবর্তী সংস্করণ ও খণ্ডের জন্য আলোচনা-সমালোচনাগুলো কাজে লাগবে।
শোয়েব ভাই, সচলে লেখা শুরু করা যায়?
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
খুব ভালো একটি পোস্ট। লীলেন ভাইয়ের দীর্ঘ মন্তব্য পোস্টটিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। মাহবুব ভাই, লীলেন ভাই, দুজনকেই অনেক ধন্যবাদ। গ্রন্থকার এবং শুদ্ধস্বরকেও অভিনন্দন।
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]
নতুন মন্তব্য করুন