ঢাকা শহরের কোন এক তীব্র যানজটে পাবলিক বাসের গাদাগাদি-ঠাসাঠাসির মধ্যে নোংরা সিটে বসে অস্থির আর অধৈর্য হয়ে নিজকে বারবার তিরষ্কার করছি- কেন আমার ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও গতি হল না, কেন আমার বাবা বাংলাদেশের এত সুন্দর সুন্দর লোকেশান ছেড়ে ঢাকতেই আস্তানা গাড়লেন, আর আস্তানা গাড়লেনই যদি তবে কেন দূরে কোথাও হাঁফ ছাড়ার ব্যবস্থাটাও করতে পারলেন না, কেন আমি এত হতভাগা যে এই যানজটে অন্তত এ.সি গাড়ির ভেতর বসে পত্রিকায় চোখ রাখার মত ইদানিং সহজলভ্য বিলাসিতাটিও করার সামর্থ্য হয় নি? আমার আশপাশের মানুষগুলোর করুন-বিধ্বস্ত চেহারা আর কষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া মুখ দেখে নিজেরটা অনুমান করতে পারি। বাসের ভেতর এক লাবণ্যময়ী (লবণাক্ত অর্থে ব্যবহৃত) মাঝে মাঝে দ্যুতি ছড়াচ্ছিল কিন্তু ওষ্ঠাগত প্রাণ গরমে সেই শীতলতার দিকে কারো খেয়াল নেই। বহ্মতালু বিস্ফোরিত হয়ে মগজের কোষগুলো আগ্নেগিরির লাভার মত চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে কিনা এমনসব সম্ভাবনার কথা যখন ভাবছি তখনি হঠাৎ উল্টো দিকের রাস্তায় পুলিশের ছড়ি-ঘোরানো, দৌড়ঝাঁপ, ঘন ঘন বাঁশি বাজানো দেখে এই মহাযানজটের কারণ বুঝতে আর বাকি রইল না- কোন একজন ভিভিআইপি কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখান দিয়ে যাবেন। কিন্তু সেই কিছুক্ষণ কতক্ষণে শুরু বা শেষ হবে তা কেউ জানে না। রাস্তার এ পাশে হাজার হাজার গাড়ি, ওপাশ ফাঁকা । ফুটপাতের ওপর হাজার হাজার মানুষ, মানুষ আর মানুষ, মানুষ আর মানুষ । মানুষের ভারে মনে হয় ঢাকা শহরটা দেবেই যাবে।
এসময় পুরো ফাঁকা রাস্তার ওপর দিয়ে হঠাৎ করেই একটা শিশু দৌড়ে রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ডের ওপর চলে এলো। বছর পাঁচেক বয়স হবে। লিকলিকে গড়ন, উদোম শরীর, খালি পা । আইল্যান্ডের ওপর যেসব পুলিশ অধীর অপোয় তাকিয়েছিলো দূরে মহামান্য ব্যক্তির আগমনের দিকে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল ঘটনাটা। পুলিশ টের পাওয়ার আগেই বাচ্চাটি সম্ভবত এপাশের গাড়ির ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আমার চোখ আইল্যান্ডে ওঠা পর্যন্ত বাচ্চাটিকে অনুসরণ করছিলো , বাচ্চাটির চোখে-মুখে কী আনন্দ ! কিন্তু পরক্ষণেই চোখে পড়লো ওপাশে ফুটপাতে ধস্তাধ্বস্তি আর টানাহ্যাঁচড়ার দৃশ্য। এক মহিলা রাস্তায় নেমে পড়তে চাইছে আর একদল পুলিশ তাকে লাঠি দিয়ে, হাত দিয়ে টেনেটুনে নিরস্ত করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনা বুঝতে বাকি রইল না কারো। কিন্তু সেই বাচ্চা ততক্ষণে রাস্তার এপারে হাজার হাজার গাড়ির ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। মহিলার আর্তচিৎকারে ভ্রূক্ষেপ নেই পুলিশের, তাদের চাকরি বাঁচানোর দায় আগে। হাজার হাজার মানুষের অস্থিরতা, বিরক্তি আর অবরুদ্ধ প্রতীক্ষার অস্বাভাবিকতায় এ ঘটনা সামান্য।
জনতার মধ্যে মৃদু আলোড়ন, বাসের ভেতর মৃদু গুঞ্জন, বুকে কাঁপন লাগানো তীব্র সাইরেন, জরুরী বাতির লাল-নীল ভয়ার্ত চোখের ঘূর্ণন, কালোকাঁচের ভেতর থেকে আমাদের মহাপ্রতীক্ষিত ভিভিআইপির রূপকথার মত ছায়াচ্ছন্ন অবয়ব আর তার মহামূল্যবান সময়ের টিকটিক আমাদের টিকটিকির মত জীবনকে পরিহাস করে চলে যাওয়ার পর মুক্তির আনন্দে ফেটে পড়া মানুষের ভীড়ে রাস্তার ওপার থেকে ছুটে আসতে দেখেছিলাম সেই ক্রন্দনরত মা-কে, অসতর্ক মুহূর্তে যার হাত থেকে হয়ত মুক্তির আনন্দেই, হয়ত অন্যন্য দিনের অভ্যাসবশত, দৌড়ে রাস্তার এপারে চলে এসেছিলো একটি শিশু; বয়স মাত্র বছর পাঁচেক। বাস তখন চলতে শুরু করেছে।
বাকি রাস্তাটুকু আমি শুধু এক কল্পিত কাঠগড়ায় শিশু-শিশুর মা-পুলিশ সদস্য-জনতা-মহামান্য ভিভিআইপি প্রত্যেককে দাঁড় করিয়েছি, এ অপরাধের দায় কার কতখানি তার জবাব খুঁজেছি। কি লাভ তাতে? আমার তো কখনো জানা হবে না, মা তার সন্তানকে ফিরে পেয়েছিলো কি না, কিংবা কোনো অনুশোচনায় কেঁপে উঠেছিলো কিনা সেই নিরাপত্তারক্ষীর একান্ত কোন সময় - আমার কখনো জানা হবে না। আমার কল্পনার সেলুলয়েডে এক ‘সিনেম্যাটিক আ্যকশান হিরো’ বাস করে, আমি তার শরণাপন্ন হই। সে সুপারম্যানের মত উড়ে গিয়ে ভিভিআইপির কালোকাঁচঘেরা গাড়িটাকে দুহাতে তুলে আছড়ে ফেলে আর তার কান টেনে ধরে তাকে নিয়ে আসে সেই সন্তানহার মা এর কাছে মাফ চাইতে। তারপর সেই সুপারম্যান চোখের পলকে খুঁজে নিয়ে আসে ছোট্ট শিশুটিকে, জনতা করতালি দেয়। দিবাস্বপ্ন কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দেয় মানুষ হিসেবে আমার ব্যর্থতা, আমার লজ্জা।
মন্তব্য
হুম।
রাজধানী পরিবর্তন হয়তো সম্ভব না। সম্প্রসারন করা দরকার।
আর দরকার ঢাকার উপর অতি নির্ভরতা কমানো।
মন খারাপ করে দেয়ার মতো লেখা। তারপরও সত্যকে জানা দরকার, মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস দরকার। সেজন্যে অতি মূল্যবান আপনার এই লেখা।
এইসব দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন ভিআইপি আর দুর্ণীতিবাজ পুলিশদের প্রতি প্রবল ঘৃণা!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
কি জানি হযত এমন ধুকে ধুকে চলাই আমাদের নিয়তি। কাকে দোষ দেব?
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা
আমি তো বেকার পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
একদম মনের কথা বলেই মনে হলো; প্রিয় ঢাকার "প্রতিদিনের দৃশ্য" এটাই।
ভিভিআইপিদের ঘাড় ধরে জ্যামের মাঝে প্রতিদিন নামায় দিতে ইচ্ছা করে।
"Life happens while we are busy planning it"
ইচ্ছেপুরণ সম্ভব নয় বলেইতো সুপারম্যানের গল্পে আস্থা রাখি।
.........................................................
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা
আমি তো বেকার পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
নতুন মন্তব্য করুন