পঁচিশে মার্চ রাত ১১.৪৫ মিনিটে শুরু হল আমাদের অপারেশন। মুখর প্রত্যয়ে সারারাত জেগে থাকার প্রাণবন্ত আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ-স্মৃতি বেদিতে সেই কালরাত স্মরণে আমরা শ’দুয়েক তরুণ-যুবা-প্রৌঢ় জড়ো হয়েছিলাম। আমাদের প্রত্যয় ও উদ্যমের সাথে একাত্ম হতে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক, এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক প্রফেসর রফিকউল্লাহ খান, প্রফেসর ভীষ্মদেব চৌধুরী, প্রফেসর বায়তুল্লাহ কাদেরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান-সহ কালরাতের দুজন প্রত্যদর্শী এবং সিদ্দিকুর রহমান নামে খুলনার একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমরা জেগে ছিলাম অর্ধশত মশালের আগুনরাঙা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে , ‘কালোরাতের পাশে জ্বলতে এসেছি’ এই প্রত্যয়দৃপ্ত পরিক্রমায় গান-পাঠ-স্মৃতিচারণ-তথ্যচিত্র-চলচ্চিত্র নিয়ে। আমরা যারা ‘মনন’ -সমাজ ও সংস্কৃতির কর্মী, আমরা মনে করি ২৬শে মার্চে আনন্দ-উদযাপনের সময় এখনো আসেনি- আসবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হলে। তার আগেই ২৫শে মার্চের বিভীষিকাময় রাত আমাদের গ্রাস করে ফেলে। সেই রাতের ভয়াবহতা আমরা দেখিনি কিন্তু অনুভব করতে পারি। আমাদের মধ্যরাতের আয়োজনে আমরা এমন কয়েকজনের কথা শুনেছি যারা সেরাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিলেন। তারা যখন আঙুল তুলে বিভিন্ন স্থান নির্দেশ করে দেখাচ্ছিলেন কোথায় কোথায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন, উদভ্রান্ত মানুষ স্বজনের সন্ধানে কীভাবে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটেছে, ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) কোথায় কীভাবে লাশ পড়েছিল, পেট্রল পাম্পের কর্মচারী কেমন নিশ্চিন্ত ঘুমের ভঙ্গিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল, ইউনিভার্সিটি প্রেসের সামনে দরিদ্র উদ্বাস্তু এক পরিবারের চারজন কেমন জড়াজড়ি করে লাশ হয়ে গিয়েছিল, সূর্যসেন হলের সামনে কেমন বিভৎসতায় শকুন টানছিল একটি লাশ-তখন আমরা বারবার শিহরিত হচ্ছিলাম আর তাকাচ্ছিলাম এদিক-ওদিক; যেন পাকিস্তানি বর্বরদের ট্যাংক এদিকেই আসছে। দুদিকে সোডিয়াম আলোর নিচে কালো পিচের রাস্তা যেন আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে চল্লিশ বছর আগে ঠিক এ জায়গাতেই একটি কুকুরও বাঁচার জন্য ছুটছিলো হন্যে হয়ে। সর্বত্র পৈশাচিক হিংস্রতাকে হার মানানো এক গণহত্যা চলছিল সেদিন এখানে। জুট মিলের শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমানের আবেগঝরা স্মৃতিচারণ আর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটুমাত্র সম্মানের জন্য আকুতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তার প্রাণময় আবেদন আমাদেরকে বিহ্বল করে। তাদের কথা আর নানাপাঠের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে থাকা রোকেয়া হলের ছাত্রী রওশন আরার অসীম সাহসে শরীরে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ার কাহিনী (দুশ ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা গ্রন্থ থেকে) শুনতে শুনতে আমাদের চেতনায় পূর্বপুরুষের অসীম সাহসিকতা আর দেশের জন্য তীব্র ভালবাসার অনন্য উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সারারাত ধরে অন্তত একটি কোকিল আমাদের সাথে জেগেছিল। কতক্ষণ পরপরই তার ডাকে আমরা সচকিত হয়ে উঠেছি ভোরের প্রত্যাশায়। আযানের সুরে ভর দিয়ে ভোর হলো যেমন হয়েছিল আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও কিন্তু সেই ভোর এমন ছিল না। সেই ভোরের আলো ছিল বাঙালির রক্তে লাল। সেই ভোরের জন্য ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষা, যেমন আমরা আছি স্বাধীনতার ভোরের প্রতীক্ষায়। সেদিনের মানুষগুলোর কাছে ২৬শে মার্চের ভোর ছিল এমন যা তারা দেখতে চায়নি । আমাদের কাছে ২৬শে মার্চের ভোর আমাদের সত্তার জাগরণ, পরম কাঙ্ক্ষিত। তাই ২৫শে মার্চ দীর্ঘরজনী আমাদের এতটা জাগিয়ে রাখতে পারে।
মন্তব্য
২৯ মার্চ, ১৯৭১, ২৫শে মার্চের গণহত্যার ওপর বিবিসির মাইকেল ক্লেটনের রিপোর্ট
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
মর্মস্পর্শি লেখা !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
কতকাল আর কালোরাতের পাশে জ্বলতে হবে? জ্বলতে জ্বলতে এক সময় ছাইভষ্ম হয়ে যাবো কী? সেই ছাইভষ্ম ভেদ করে কোনো এক স্বাধীন ভোরে আগুনমুখো পাখিটি ডানা মেলে উঠে আসবে কী? আসেও যদি, সেদিন আর কত দূরে???
দূর থেকেই নতশির হই, কিন্তু ক্ষতগুলো মনে করিয়ে দেয় কেন আজকের প্রজন্ম এতো স্মৃতিবিভ্রান্ত হয়ে?
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
যতদূর জানি রওশন আরার কাহিনীটি ভারতীয় মিডিয়ার বানানো মীথ, সত্য নয়। বাস্তবটা হচ্ছে এই মীথের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আমাদের এক একজন শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস এক একটা মহাকাব্য।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
রওশন আরার কাহিনীটি 'দু'শ ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা' গ্রন্থ থেকে নেয়া।বিষয়টি বিতর্কিত হলে সূত্র জানানোর অনুরোধ রইল।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
এই ধরেন রেফারেন্স।
একটু চোখকান খোলা রেখে পড়ুন।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করার সময় একজন পাকিস্তানী সহকর্মী ১৯৭১ এর গণহত্যার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "লেট আস ফরগেট এন্ড ফরগিভ"। নম্রভাবে তাঁকে জানিয়েছিলাম, "উই মে ফরগিভ ইউ বাট ইট ইজ বেটার ফর বোথ অব আস নট টু ফরগেট"। আজ বুঝি, 'ফরগিভ' কিম্বা 'ফরগেট' কোনটিই নয়। কস্মিন কালেও না।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নতুন মন্তব্য করুন