২০১২ সালে প্রথমবারের মত সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল। এবার শুধু বাংলা প্রথম পত্রের মাধ্যমে সূচনা হলেও আগামীবার থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিষয়েও সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে । কিন্তু প্রথমবারের মত প্রণীত বাংলা প্রথম পত্রের সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের মান নিয়ে সচেতন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উত্থাপিত হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নে প্রশ্নকর্তাদের সৃজনশীলতার পরিচয় ফুটে ওঠেনি। বরং প্রশ্নের মধ্যে লক্ষণীয় দুর্বলতা ছিল একাধিক; কোন কোন ক্ষেত্রে এসব দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলা প্রথম পত্রের বহুনির্বাচনী অভীক্ষায় অভিন্ন তথ্যভিত্তিক প্রশ্নের সংখ্যা ১৬টি । যা মোট প্রশ্নের ৪০ শতাংশ। অথচ এ সংখ্যা ২০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বিকল্প বহুনির্বাচনী অভীক্ষার অন্তত ৫টি প্রশ্নে এবং বর্ণনামূলক (সৃজনশীল) অভীক্ষার উপন্যাস অংশের প্রশ্নে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে যার ভুক্তভোগী শেষপর্যন্ত শিক্ষার্থীরাই। তাছাড়া সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উদ্ভাবনী অংশ স্টেম বা উদ্দীপকগুলো ছিল একেবারেই আকর্ষণহীন।
এবার দেখা যাক প্রথমবারের মত প্রণীত উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রথম পত্রের সৃজনশীল প্রশ্নে কী ধরণের সমস্যা রয়েছে-
এক।
হেডমাস্টার কামাল হোসেন ‘ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। ছাত্ররা তাঁর উপদেশমূলক বইটি পড়ে না কিন্তু গল্পের বই পড়ে।
এ উদ্দীপক ব্যবহার করে ১৪ নং প্রশ্ন দেয়া হয়েছে-
ছাত্র-জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য’ শীর্ষক গ্রন'টি ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে উল্লেখিত কোন্ গ্রনে'র সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ?
i যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ
ii বাল্মীকি রামায়ণ
iii ভগবৎ গীতা
নিচের কোনটি সঠিক?
(ক) i
(খ) ii
(গ) i ও ii
(ঘ) ii ও iii
উপরের প্রশ্নটি বহুপদী সমাপ্তিসূচক প্রশ্নের (Multiple completion MCQ) অত্যন্ত দুর্বল একটি উদাহরণ। কারণ প্রশ্নটি সাধারণ এমসিকিউ পদ্ধতিতেই সহজে করা যায়, এজন্য বহুপদী সমাপ্তিসূচকের ব্যবহার বিস্ময়কর। উপরন্তু প্রশ্নটিতে ‘নির্দেশনা’ (Instruction) আছে দুটি - ‘কোন্ গ্রন্থ? এবং কোনটি সঠিক?’ যা বহুপদী সমাপ্তিসূচক প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট লঙ্ঘন। আবার যেহেতু প্রশ্নেই উল্লেখ রয়েছে ‘কোন গ্রন্থের সঙ্গে’ (অর্থাৎ একটি গ্রন্থই সঠিক উত্তর) সুতরাং একাধিক বিবৃতি সঠিক হবার সম্ভাবনা এখানে নেই বললেই চলে। ফলে (গ) এবং (ঘ) বিক্ষেপকের কার্যকারিতা কোথায় ? তাছাড়া বহুপদী সমাপ্তিসূচক বহুনির্বাচনী প্রশ্নের গুরুত্ব তখনই থাকে যখন একাধিক বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি বর্ণনা করার প্রয়োজন হয়। এ জাতীয় প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করার কারণ হল একাধিক বিবৃতির মধ্যে তুলনা বা সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষার্থীকে ভাবিয়ে তোলা। উপরের প্রশ্নটি সেদিক থেকেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
দুই।
১৭ নম্বর প্রশ্নটির বিকল্প উত্তরে যে চারটি ‘অপশন’ (সঠিক উত্তর ১টি, বিক্ষেপক ৩টি) আছে তার মধ্যে ‘(খ) আমার সোনার ধান কূলেতে এসে’ ভাবের দিক থেকে একটি অসম্পূর্ণ পংক্তি। আগের পংক্তির উদ্ধৃতি (‘শুধু তুমি নিয়ে যাও/ ক্ষণিক হেসে’) ছাড়া এটি বিক্ষেপক হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।
তিন।
উদ্দীপক থেকে সরাসরি প্রশ্ন করা বিধি বহির্ভূত হলেও ২৩ নম্বর প্রশ্নটিতে তাই করা হয়েছে। উদ্দীপকটি ‘জীবন বন্দনা’ বা ‘যৌবনের গান’ উভয়েরই উপযোগী।
চার।
২৭ও ২৮ নম্বর প্রশ্নের উদ্দীপকে রয়েছে গুরুতর বিভ্রান্তি। ‘অচলায়তন’ শব্দটি সাধারণত প্রতীকী অর্থেই ব্যবহৃত হয় কিন্তু উদ্দীপকে এটিই নাম। উদ্দীপকের দ্বিতীয় বাক্যটি কোন্ অর্থ বহন করে তা স্পষ্ট নয়। প্রতিষ্ঠাতা দাদাঠাকুর বিদ্যামন্দিরে থাকেন না সংস্কার ভাঙ্গতে না টিকিয়ে রাখতে? না থাকাটা কি তার ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত তাও অস্পষ্ট । আবার উদ্দীপক ব্যবহার করে যে প্রশ্ন দেয়া হয়েছে তাতেও ঘোর বিভ্রানি-। ২৭ নং প্রশ্নে আছে, ‘দাদাঠাকুরের মত নিচের কোন চরিত্রটি একই পরিস্থিতির শিকার?’ অথচ উদ্দীপকে দাদাঠাকুর কোন্ পরিসি'তির শিকার তা-ই স্পষ্ট নয়। ‘পরিসি'তির শিকার’ শব্দযুগল যে ব্যঞ্জনা বহন করে তা উদ্দীপকের কোথাও পাওয়া যায় না। ২৮ নং প্রশ্নেরও একই অবস্থা । ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’ এবং ‘বর্ণপ্রথা’- হিন্দু সমাজে এই দুটি ব্যবস্থা পরস্পর পরিপূরক। বিক্ষেপক হিসেবে এই দুটি শব্দ পরস্পর অন্তর্ভুক্ত (Mutually inclusive) যা বিক্ষেপক হিসেবে দেয়া যায় না।
পাঁচ।
পাঞ্জেরি কবিতা থেকে উদ্দীপকের সাহায্যে করা ৩৯ নং প্রশ্নটির বিক্ষেপকের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। (খ) মুসাফির এবং (গ) যাত্রী দুটি বিক্ষেপকই পাঞ্জেরি কবিতায় একই ধরনের রূপকার্থ বহন করে- ‘বিপদগ্রস্ত, পরিত্রাণকামী সাধারণ মানুষ’।এম
এমনকি পাঠ্যবইয়েও ‘মুসাফির’ অর্থে যাত্রী ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে কোন উত্তরটি সঠিক ?
ছয়।
বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ছাড়াও বর্ণনামূলক প্রশ্নের উপন্যাস অংশে প্রশ্নকর্তার অঙ্কণ দক্ষতার পরিচয় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয়। পরিতাপের বিষয় হল এসব ছবির নিচে পরিচিতি না দিলে ছবিগুলো কিসের তা বোঝাই মুশকিল হত। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও ’তিতাস একটি নদীর নাম’ দুটি উপন্যাসের ৩টি প্রশ্নেই চিত্রযুক্ত উদ্দীপক ব্যবহার করা হয়েছে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র জন্য ব্যবহৃত ছবির ক্যাপশন তো রীতিমত একটা উদ্দীপকের সমান। ছবি ব্যবহার সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে আলাদা মাত্রা এনে দেয় তবে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রশ্নে চিত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিণত চিন্তার পরিচয় দেয়া উচিত ছিল যেমনটি এনসিটিবির নমুনা সংযোজন অংশে দেখা যায়।
সৃজনশীল প্রশ্নের মান নিয়ে নানা মত থাকলেও প্রশ্নসংক্রান্ত মৌলিক রীতিপদ্ধতি ও বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে মতভিন্নতার সুযোগ যত কম হয় ততই ভাল। কারণ নিয়মগুলো অনেকটাই সুনির্দিষ্ট এবং সারাদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তা শেখানো হয়েছে । তাই এরপর থেকে এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ আরো সতর্ক হবে বলে আশা রাখি।
মন্তব্য
ইন্টারেস্টিং! এটি কি ক্রিটিকাল রিজনিং টাইপের প্রশ্ন নাকি?
আপনি বলেছেন:
বিস্ময়কর হবার কারণ বুঝলাম না। এমসিকিউ পদ্ধতি ছাড়া অন্যান্য পদ্ধতির বাঁধা অতিক্রম করে যে ছাত্র প্রশ্নটি সমাধাণ করতে পারবে সে অন্যদের চেয়ে যোগ্যতর। প্রশ্নের জটিলতা বাড়ানোর জন্য এটা একধরণের লেয়ারিং পদ্ধতি।
দুঃখিত লেখাটিকে আরো কিছু সংশোধন করতে হল। তাছাড়া ইংরেজি শব্দগুলো হোমপেজে দেখাচ্ছিল না তাই আবার এডিট করলাম।
বহুপদী সমাপ্তিসূচক প্রশ্ন তিনটি স্টেটমেন্ট বা বিবৃতি দিয়ে শুরু হবে। ইন্সট্রাকশনে থাকবে কোনটি সঠিক। এ ধরণের প্রশ্নের ভিত্তি হচ্ছে , কখনও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যে একটি বিবৃতি যথেষ্ট নয় বা একাধিক বিবৃতি বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শিক্ষার্থীকে তুলনা করতে হবে। তাই যে প্রশ্ন সহজেই সাধারণ এমসিকিউ দিয়ে করা যায় সেটাকে জোর করে বহুপদী বানানোটা যাকে বলি 'মশা মারতে কামান দাগানো'র মত।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
হুমমম!
আপনার বিশ্লেষণ চমৎকার হয়েছে। প্রশ্নপত্রটি আসলেই ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে।
বহুপদী সমাপ্তিসূচক বহুনির্বাচনী প্রশ্নটি একেবারেই হয়নি।
অন্যান্য প্রশ্নগুলোও দূর্বল শক্তির।
সেটাই। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, জাফর ইকবাল স্যারেরা নতুন একটা যুগের শুরু করে দিয়ে গেলেন, পুরো স্রোতের বিপরীতে লড়াই করে একরকম। বাকিটা অবশ্যই এগুবে, ঠিক পথেই এগুবে এবং স্বল্পতম সময়েই এগুবে-- সেটাই আশা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
৯৭ পরীক্ষা দিয়ে বাংলায় প্রথম পত্রে ৪৪ পাইছিলাম। কিছু প্রশ্ন মুখস্ত করে খাতায় বমি করতে হতো। এখন তো যথেস্ঠ জটিল পরীক্ষা হয়। কিছুই তো ধরতে পারলাম না।
প্রথমবারের মত সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও প্রশ্নের এসব দুর্বলতা নিয়ে যে চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া উচিত ছিল তা কোথাও দেখতে পাই নি বলে নিজেই লিখলাম। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে প্রথম প্রয়োজন সৃজনশীল শিক্ষক- প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেয়ে প্রশ্ন করা এখানে কঠিন।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
নতুন মন্তব্য করুন