গত কয়েকটি দিন ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইলিশের ফেরিওয়ালারা পাঁচ মিনিট পরপর হাঁক দিয়ে গেছে । বাতাসে ইলিশের গন্ধ, রাস্তার মোড়ে মোড়ে গলি-ঘুপচিতেও রুপালি ইলিশের হাতছানি। ফেরিওয়ালাকে দাম জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় না। তবু মাঝে মাঝে দলবদ্ধ মানুষের উৎসাহে সামিল হয়ে মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায় - কত করে কেজি? পরক্ষণেই নিজের ভুল শুধরে নিয়ে জাটকা-অতিক্রান্ত একটা ইলিশের দাম জানার সাহস করে ফেলি। তার আগেই ফেরিওয়ালার মুখ দিয়ে কেজির দর জানতে চাওয়ার উত্তর বেরিয়ে আসে। আমি সমবেত জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অস্ফূট আওয়াজ তুলি যেমনটা আমার মত বহু অক্ষম মধ্যবিত্ত তোলে প্রতিমুহুর্তে । আক্ষেপ-আক্রোশকে বুকের বাতাসে ভরে রেখে জিজ্ঞেস করি - কেমন বিক্রি হচ্ছে ?' ফেরিওয়ালার জবাব আসে, - হইতাছে ভালই। দিনে দুইবার মাল আনি। ঠিক একই প্রশ্ন আমি চাকচিক্যময় মিনা বাজারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর ছিল - 'দারুণ' । মুখে ছিল হাসি আর কর্পোরেট অফার। ইলিশের কেজি কত সেখানে তা জিজ্ঞেস করতে হয় না। করাটা অভদ্রতা । আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবি এতগুলো ইলিশ এখান থেকে আজই বিক্রি হবে, প্রতিটি কেজি খানেক ওজনের ইলিশ এ শহরের অনেকগুলো রান্নাঘরে গৃহিনীর গর্ব আর তৃপ্তির উজ্জ্বলতা ছড়াবে, পাড়ার বিড়ালগুলো জানবে পহেলা বৈশাখ সমাগত। আমি আর রাস্তার বা মিনা বাজারের ইলিশের সামনে দাঁড়াই না। আমার ছায়া তবু দাঁড়িয়ে থাকে। কোন এক অদৃশ্য বিত্তশালী ইলিশ ক্রেতাকে হয়ত দেখে নিতে চায়। এভাবে সংকোচ আর ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ওই দুবার আমি ইলিশের জন্য মানে পহেলা বৈশাখের ইলিশের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। পহেলা বৈশাখ শেষ হয়ে গেছে তবু আমার মৎসপ্রীতি আমাকে বারবার ইলিশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মনে পড়ে ১৯৮৮'র ভয়াবহ বন্যায় সারাদেশ যখন ডুবে আছে, ঢাকার রাস্তায় চলছে নৌকা, আমাদের বাড়িতে বুক সমান পানি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, বাড়ির সবাই চলে গেছে নানার বাড়ি শাহজাহানপুর। আধডোবা বাড়িঘর দেখে রাখার দায়িত্ব নিয়ে কাছাকাছি চাচার বাড়ির চালের মাচায় আশ্রয় নিয়েছি। একদিন দুপুরে কোমর সমান পানি ভেঙে এক মাছ বিক্রেতা হেঁকে যাচ্ছিল-- ইলিশ!ইলিশ! আমি চালের মাচা থেকে দামদর করে কিনে নিলাম এক হালি ইলিশ ৫০ টাকায়। হায় ইলিশ !
আজো আমি ইলিশের ফেরিওয়ালার কাছে দাম জানার আগ্রহ প্রকাশ করি না। কিন্তু আমি জানি, আমার মা বিগত কয়েকদিন ধরে ঘরের কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে ইলিশের ফেরিওয়ালাকে দরজায় দাঁড়াতে বলেন। কিনতে পারবেন না জানেন, তবু দামদর করেন, যেন দামে বনে গেলেই কিনবেন। ইলিশের ফেরিওয়ালা এটা বোঝে, তাই বেশিক্ষণ দামাদামিতে উৎসাহ বোধ করে না। মা খাবারের সময় ইলিশের প্রসঙ্গ তুলে আস্ফালন করে। আর স্মৃতিচারণ করে পুরোনো ইলিশের অতুলনীয় স্বাদ ও গন্ধের । আমার মধ্যে তোলপাড় চলে, মার রান্নার কড়াইয়ে ইলিশ ভাজার শব্দ আর ঘ্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারিনা বলে আমি কুঁকড়ে যাই। যে উৎসাহ নিয়ে বাবা মাছের সদাই করতেন তা মনে করে আমি পায়ের আাঙুলে মেঝে ঘষতে থাকি আর বাবার দীর্ঘশ্বাস শোনার আগেই অন্যমনস্ক হওয়ার ভাণ করি। হায় ইলিশ !
মন্তব্য
সত্যিকারে হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব করাবার মতো একটি লেখা।
২০০৭ সালে ভোলার এক ফেরিঘাটে ফেরির অপেক্ষায় পায়চারি করতে করতে ঘাটের ভাতের হোটেলোলাকে ইলিশ কাটতে দেখছিলাম চাক চাক করে। কেজি ধরেই দর জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিলো, ওখানে বিক্রি হয় জোড়া বা হালি ধরে। কেজি আবার কী? হালি কত জানতে চাইলাম। জানলাম, দাম বেড়ে গেছে, সত্তর টাকার নিচে হালি পাওয়া যায় না। পরিকল্পনা করেছিলাম, শুধু ইলিশ মাছ খাওয়ার জন্যেই আরেকবার ভোলা যাবো। জীবনের অন্য সব পরিকল্পনার মতোই সেটা অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
আপনি যেই সময় ৫০ তাকে হালি ইলিশ কিনেছিলেন সেই সম সময় এ আমি সবে মাত্র একা একা স্কুল যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের বাসা ছিল বাজার এর বেশ কাছে। স্কুল এ যাত্রা পথে বাজার এর কাছ দিয়ে যেতে হত। তখন প্রতিদিন দুই পাচ মনি ট্রাক ভর্তি ইলিশ মাছ আসতো বাজার বাজারে। প্রতি দিন! সেই ট্রাক থেকে বরফ আর ইলিশ মাছ এর আষ্টে মিলে এত্ত বাজে দুর্গন্ধ বের করত যে বলার মত না। প্রতিদিন ই খুব ই রাগ লাগত এই ইলিশ এর ট্রাক এর জন্যে। মনে হত কেন আসে এই ট্রাক। জোড়া ইলিশ বিক্রি হত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকায়।
এখন এই কথা মনে পড়লে মনে হয় যেন আজব এক স্বপ্নের কথা ভাবছি। দেশ ই শুধু ইলিশ এর দাম ই শুধু নয় সব কিছুর ই দাম এত্ত বেশি যে কি বলব।
বহুব্রীহি নাটকের একটি অংশ মনে পরে গেল। সবাই ভাত খেতে বসেছে। আবুল হায়াত টেবিলে এসে বললেন আজ কি দিয়ে ভাত। শুনলেন যে ইলিশ মাছ আর বললেন "আজও ইলিশ মাছ। প্রতিদিন আর এক মাছ খেতে খেতে ভালো লাগে না!!" আমরা মনে হয় না আর সেই দিনে ফেরত যেতে পারব।
আপনার লেখাটা খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
লেখাটা দারুণ লাগলো। সচলায়তনে নিয়মিত লিখবেন আশা করছি।
ফেসবুকে এক জায়গায় দেখলাম এক জোড়া ইলিশ ২৮ হাজার টাকা ! ঘটনা কি সত্যি?
ভাল লেগেছে..
এবার ইলিশের দাম যেমন বেশি ছিল, তেমন ঠিকঠাক দামেরও ছিল। কথাটা বুঝিয়ে বলি। মীনাবাজারের মতো জায়গায় ইলিশ ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা কেজি করে ছিল। কাওরানবাজারেও কিছু ইলিশ ৯০০০ টাকা বা ১২০০০ টাকা হালি হিসেবে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু তার সাথে বাজারে ও ফেরিওয়ালাদের কাছে কম দামের ইলিশও ছিল। আমার স্ত্রী ৮০০ টাকা হালি হিসেবে এবং আমি নিজে ১২০০ টাকা হালি হিসেবে ইলিশ কিনেছি (ওজন ৮০০ গ্রামের ওপর)। এই বছর কোল্ডস্টোরগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ হিমায়িত করে রাখায় এটা সম্ভব হয়েছে।
আপনার অনুভূতির প্রতি সম্মান রেখেই বলি, ১৯৮৮ সালের যে উদাহরণটা দিলেন সেখানে যে জিনিসটা বিবেচনায় আনেননি তা হচ্ছে - পদ্মা-মেঘনা-বরিশাল থেকে ধরা ইলিশ ঢাকা পর্যন্ত এনে কোমর সমান পানি ঠেলে ২৫ টাকা হালি করে বিক্রি করলে জেলে থেকে শুরু করে ফেরিওয়ালা পর্যন্ত সবাইকে মোট কী পরিমাণ লোকসান বহন করতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
জনাব ষষ্ঠ পাণ্ডব, আপনি বা আপনার স্ত্রী ২০০/৩০০ টাকা দরে ইলিশ কিনে থাকলে এটা এই বাজারের তুলনায় অস্বাভাবিক সস্তাই ছিল । আপনি ভাগ্যবান। আর আমি ৫০ টাকায় ১ হালি ইলিশ কিনেছিলাম প্রবল বন্যার সময়। অর্থনীতির হিসেব-নিকেশ স্মৃতিচারণের সময় আমরা কতটুকু ভাবি ? তাহলে তো শায়েস্তা খানের শাস্তির কথা ইতিহাসে লেখা থাকতো । মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
লেখাটা খুব ভাল লাগলো । ধন্যবাদ ।
বৈশাখ মাসে জাটকা ছাড়া আর যা পাও্য়া যাবে সেগুলো আগের বছরের ইলিশ হবার সম্ভাবনা বেশী। ফেব্রুয়ারির দিকে কিছু বড় ইলিশ নদীতে ঢুকলেও সাগর থেকে ইলিশমাছের বড় ঝাঁকগুলো নদীতে আসতে শুরু করে মে মাসের দিকে।
বৈশাখ মাসে ইলিশ মাছ খাওয়ার 'ঐতিহ্য়' তাই কোন্ডস্টোরেজের চাইতে পুরাতন হবার কথা নয়।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
নতুন মন্তব্য করুন