হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে

মাহবুবুল হক এর ছবি
লিখেছেন মাহবুবুল হক (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০৭/২০১২ - ৬:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার বন্ধু এবরার হোসেন গতকাল দুপুরে ফোন দিয়ে জানতে চাইলো " হুমায়ূন আহমেদের কী খবর ?" এবরার সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছে প্রায় সতের বছর ধরে। তবে এককালের এই তুখোড় ছড়াকার আর মেধাবী সাহিত্যকর্মী এখনও যখন অনর্গল ছড়া-কবিতা-সংলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলে তখন তার পরিচিতজনেরা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতেই পারবে না যে মানসিক অসুস্থতা কত ভয়াবহ হতে পারে। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। এবরারের মুখে হুমায়ূন আহমেদের নাম শুনে চমকে গেলাম। এ কী কথা শুনি আজ রাবণের মুখে ! স্মৃতি ফিরে গেল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে। একের পর এক হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো পাঠক মাতাচ্ছে আর আমরা আমাদের সাহিত্যসভাগুলোতে গম্ভীরভাবে হুমায়ূনের বদনাম করে যাচ্ছি। নাক সিটকে যাচ্ছি। এসব কী ছাইভস্ম লিখছে আর নির্বোধ পাঠক তাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আমাদের জ্ঞান-গরিমায় হুমায়ূন আহমেদ 'নন্দিত নরক' পর্যন্তই আলোচ্য। তারপর 'বাজাইরা লেখক'। এসব আলোচনায় এমন চটুল লেখকের দফারফা করতে পটুভাষ এবরার হোসেন হুমায়ূনের নাম দিল - হনুমান আহমেদ। আমরা তখন এবরারের পাণ্ডিত্য ছাড়িয়ে নতুন কোন বিশ্লেষণ হাজির করতে সমর্থ নই। জনপ্রিয় লেখক আর মানসম্পন্ন লেখকের কাঠগড়া ঠিক কী দিয়ে তৈরি এই হিসেব মেলাতে আমার লেগেছে অনেকগুলো বছর । এমনকি আজো এসব বিষয় এলে আমি খেই হারিয়ে ফেলি। কিসে শ্লীল আর কিসে অশ্লীল, কিসে শিল্প আর কিসে দায়বদ্ধতা এসব বিতর্ক আজো আমাকে অসহায় করে তোলে। হুমায়ূনকে আমি তবু পড়ি, এবরারের বক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাঝেমধ্যে আলোচনাও করি। আমার মাসুদ রানার পোকাটা ধীরে ধীরে হুমায়ূনের তথাকথিত সস্তা উপন্যাসের পাতায় চলাফেরা করতে থাকে। ক্লাসে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল শিক্ষকেরা ইঙ্গিতে কটাক্ষ করে ফিবছর বেহিসাবী জন্মদেওয়া এক লেখকের রুগ্ন সন্তানগুলোকে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের প্রতি পৃষ্ঠায় ক'টা লাইন আর ক'টা সংলাপ এবং বইয়ের দাম কত? ছাপা খরচ কত আর লাভ কত? এমন হিসেব মেলাতে আমরা যখন ব্যস্ত তখন কিন্তু তিনি নাকমুখ ডুবিয়ে কেবল লিখেই যাচ্ছেন। আর বই মেলায় তার সেসব বই কিনতে তার স্বাক্ষরযুক্ত বই হাতে পেতে রীতিমত হুলুস্থূল কারবার প্রতিবছর। সে সময় এত চ্যানেল নিউজ আর একফুটি মাইকের বকবকানি থাকলে কী জানি কোথাকার পানি কোথায় গড়াতো !

তো আমার সেই বন্ধু এবরার হঠাৎ করে হুমায়ূন আহমেদের কথা জিজ্ঞেস করাতে আমি একটু অবাক হই । আরো অবাক হই যখন ও জানালো যে, হুমায়ূন আহমেদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন চ্যানেলের উপর্যুপরি সম্প্রচার সে ছয় ঘন্টা ধরে দেখছে। এবরার সিজোফ্রেনিয়ার রোগী; এক মিনিট এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। সে কি না .... হিসেবটা মেলে না। তবে কিছুক্ষণ কথা বলেই আমি বুঝে যাই ছয় ঘন্টা না হলেও অনেকক্ষণ ধরে সে বিভিন্ন চ্যানেলের এসব অনুষ্ঠান দেখেছে। তারপর এবরারের কণ্ঠে শুনি সেই বিখ্যাত উপেক্ষার ভাষা যার ভার এবং ধারে আমরা হুমায়ূনকে অবহেলায় ফেলে রেখেছিলাম। আজ অবশ্য বিনা তর্কে তাকে ছেড়ে দেই না। সোজাসুজি বলে ফেলি, জনপ্রিয়তাও সাহিত্য বিচারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড এটা শুদ্ধতাবাদীরা না মানলেও পাঠকের রুচিকে অবজ্ঞা করার কোন যুক্তিই তারা দিতে পারবে না। হুমায়ুনের ম্যাজিক রিয়েলিজম বা অ্যান্টি ক্যারেক্টার নির্মাণের অসাধারণ কুশলতা আমাদের প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শুধু আমাদের বলছি কেন প্রায় চারদশকের পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন তিনি। এই মুগ্ধতাটা কিসের তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে তবে আমি যে শহীদ মিনারে তার কফিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম তা ঠিক কিসের জন্য তা আমি নিজেও বলতে পারবো না। হয়তো কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে তার পিঁপড়া বা খেলোয়াড় গল্পের মধ্যে নিজকে হারিয়ে ফেলার জন্য, হয়তো নন্দিত নরকের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়েটির অসহায়ত্ব দূর করতে না পারার কষ্টটাকে প্রথমবারের মত অনুভব করতে পারার আনন্দের জন্য, কিংবা হতে পারে শঙ্খনীল কারাগারের রাবেয়া বা হলুদ হিমুর জন্য, আবার অসাধারণ সারল্যে তার আত্মকথার মধ্যে নিজকে খুঁজে ফেরার জন্য। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমার আসলে যা মনে হয় তা হলো আমাদের উত্তাল সাহিত্যচর্চার দিনগুলোতে প্রতিচরিত্রের মত হাজির হতেন হুমায়ূন আহমেদ, বইমেলার জৌলুস আর ব্যস্ততার অপর নাম হুমায়ূন আহমেদের উপস্থিতি এসব থেকে এক বিশাল শূন্যতার দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। আমরা হুমায়ূন আজাদকে আগেই হারিয়েছি, এবার গেলেন আহমেদ। আমাদের প্রকাশকেরা হয়তো চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন কিন্তু আমরা দেখছি রুচি আর দেশাত্মবোধের এমন আকালের দিনে আকাশের শেষ চিলটিও আজ পড়ে গেল মাটিতে।

আমার লম্বা বক্তৃতায় এবরার খানিকটা ভড়কে গেল। হু হু করতে করতে সে হারিয়ে ফেললো তার বিখ্যাত উপেক্ষার ভাষা।


মন্তব্য

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একজন অসুস্থ ব্যাক্তির মূল্যায়ণকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার কারণ কি?

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

আলী হায়দার এর ছবি

আমদের সমাজ খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এক সময়ের হাতে লেখা চিঠির স্থান করে নিয়েছে ইমেইল,চ্যাট ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবরতন এনেছে ইন্টারনেট। এর সাথে সাহিত্যের ভাষা ও বদলেছে। হুমায়ুন আহমেদ সেটি অনুধাবন করে ছিলেন। তাই তার ভাষা পাঠকেরা সাদরে গ্রহন করেছে। আর তাঁর গল্প লেখার যাদুকরি ক্ষমতা ছিল। যে যাদুতে তিনি পাঠককূল কে মোহিত করেছেন। তবে তিনি বড্ড বেশী লিখেছেন। বেশী লিখতে গিয়ে নিজের ক্ষমতার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।

মাহবুবুল হক এর ছবি

রিটন ভাই, মূল্যায়নটা অসুস্থ ব্যক্তির না, আমার । মূল্যায়ন বলাটাও ভুল হবে, আসলে খানিকটা স্মৃতিচারণ আর কিছুটা উপলব্ধির বিবর্তন। এবরার এর কথাগুলো এখনকার এবরারের না, ৮৭-৮৮ সালের এবরারের।

--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।

মেঘা এর ছবি

বরাবর এমন উপেক্ষাই করা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদ কে। কিন্তু জনপ্রিয়তা কমে নি একটুও। সাহিত্য বোদ্ধাদের কাছে তিনি বাজারি হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তেমন ছিলেন না।

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

অতিথি লেখক এর ছবি

সাহিত্য কেন রচনা করা হয়?? কেউ বলবেন জীবনের কথা বলতে, কেউ বলেন নিজের পর্যবেক্ষন তুলে ধরতে, কারো মতে সাহিত্য সমাজের দর্পন, কারো কাছে সাহিত্য মনের ভাব প্রকাশের একটা মাধ্যম। সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী?? মানুষের বোধকে নাড়া দেওয়া। মানুষের চিন্তায় নিজের অনুভব তুলে ধরা কিংবা নিছক মানুষকে আনন্দ দেওয়া। একটা দুটো বছর নয়- ৪০ টা বছর একটা মানুষ যখন সমকালীন প্রজন্মকে বা প্রজন্মের একটা বড় অংশকে নিজের লেখনির মাধ্যমে আনন্দ দিয়ে যেতে পারেন তবে তাকে সফল সাহিত্যিক বলাই যায়। বাজারি লেখক যারা বলেন তাদের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, জনাব, সাহিত্যের মানদন্ড ঠিক করার নিয়ামক কতগুলো এবং তার মাপকাঠি কি?? সাথে কারা এটা নির্ধারণ করেন??? পাঠক সমাজ না বিদগ্ধ পন্ডিত গন??

আলোকিত- মন

আইলসা এর ছবি

বাজারি লেখক যারা বলেন তাদের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, জনাব, সাহিত্যের মানদন্ড ঠিক করার নিয়ামক কতগুলো এবং তার মাপকাঠি কি?? সাথে কারা এটা নির্ধারণ করেন??? পাঠক সমাজ না বিদগ্ধ পন্ডিত গন??

ধন্যবাদ আলোকিত-মন। একদম আমার মনের প্রশ্নগুলো।

প্রান্তিক রহমান এর ছবি

অনেক অনেক হুমায়ূন পাঠক আছে যারা হুমায়ূনের বই গোগ্রাসে গিলেছে। অনেকে না কিনে বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে অথবা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে পড়েছে। কিন্তু প্রিয় লেখক কে এই প্রশ্নের জবাবে আস্তে করে হুমায়ূনকে পাশ কাটিয়ে বিদেশী লেখক অথবা পশ্চিম বঙ্গের লেখকের নাম অবলীলায় বলে দিয়েছে। কারন হুমায়ূনকে সাহিত্যিকের কাতারে ফেলতে পাঠকেরও অনেক কুন্ঠা ছিল। কিন্তু হুমায়ূনের মৃত্যুর পর সেই পথ খুলে গেছে। এখন আর কেউ যদি বলে আমি হুমায়ূনের লেখা পছন্দ করি তাহলে তাকে হেনস্থা অথবা যুক্তি তর্কের মুখোমুখি হতে হবে না বলেই বিশ্বাস। একটা স্থুল যুক্তি দেই। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। কারন সব বেলায় আমরা ভাত খেতে বাধ্য। কিন্তু মানুষের প্রিয় খাবার তো পোলাও মাংশ হয়ে থাকে। হুমায়ূন ছিল সেই ভাতের মত। একবেলা ভাত না হলে যেমন আমারা বুঝে যাই ভাত ছাড়া আমাদের চলে না। হুমায়ুন নামক সেই সাহিত্য ভাত এখন আর আমরা পাবো না। তিনি ছিলেন আসলেই আমাদের প্রধান লেখক। আগে বুঝতে পারি নাই। মৃত্যুর পরে প্রতিটা মুহূর্তে এই সত্য উপলব্ধি করতে পারতেসি।

পাগলা_আতেল এর ছবি

হুমায়ূন ছিল সেই ভাতের মত। একবেলা ভাত না হলে যেমন আমরা বুঝে যাই ভাত ছাড়া আমাদের চলে না। হুমায়ুন নামক সেই সাহিত্য ভাত এখন আর আমরা পাবো না।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

যাদের লেখা কেউ পড়ে না তাদের গা জ্বলবে; এটা নতুন কিছু না। হুমায়ূনের জন্ম না হলে আজ আনন্দবাজারীদের লেখা পড়েই আমাদের বড় হতে হতো।

আশরাফুল কবীর এর ছবি

আমি হুমায়ূন আহমেদের সময়ে জন্মেছিলাম, এটা আমার নিকট অনেক আনন্দের-প্রিয় হুমায়ূন মনের প্রকোষ্ঠে থাকবেন চিরটাকাল

অতিথি লেখক এর ছবি

ব্যক্তি হুমানয়ূন আহমেদকে আমি ২০০৩ সালের পর থেকে একটুও পছন্দ করিনা, কিন্তু সাহিত্যিক, নির্মাতা, নাট্যকার হুমানূন আহমেদকে ভালোবাসি, ভালবাসবো---------- । ওনার বই দিয়ে বই পড়া শুরু এবং এখন যে বই পড়ার অভ্যাসটা তৈরি হয়েছে সেটা সাহিত্য আকাশে হুমায়ূন নামের ধ্রুব তারার জন্যই। আল্লাহ যেন ওনাকে বেহেস্ত নসিব করেন, আমিন।

কামরুজ্জামান স্বাধীন

অতিথি লেখক এর ছবি

তরুণদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করতে পারার বিশাল ক্ষমতা সবার থাকে না, উনার ছিল।
ইসরাত

গোলাম মোহাম্মদ  এর ছবি

আমরা জীবিত গূণীজনকে সম্মান তো করিই না, পারলে অপমান করে ধুলায় লুটাই।
মারা গেলে চলে হায় হা।
সত্যিই হায় হায়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।