এইচ.এস.সি-র ফলসংকোচন এবং সৃজনশীল প্রশ্নকর্তার দায়

মাহবুবুল হক এর ছবি
লিখেছেন মাহবুবুল হক (তারিখ: সোম, ০৫/০৮/২০১৩ - ১২:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এইচ.এস.সি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে বেশ হা-হুতাশ চলছে চারদিকে। এরমধ্যে এবার রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেবও ঢুকে পড়েছে। অভিভাবক হতাশ, শিক্ষক হতাশ, শিক্ষার্থী বিমূঢ়। কিন্তু এটাকে ফলাফল বিপর্যয় কেন বলবো তা এখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি। অর্ধ লক্ষাধিক জিপিএ-৫ প্রাপ্ত সর্বোচ্চ মেধাবীদের নিয়ে আমরা কী করবো যখন তার এক দশমাংশও প্রত‌্যাশামত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না ? প্রতিবার ক্রমবর্ধমান এই অদ্ভুত পঞ্চপ্রাপ্তির খাতায় এবার খানিকটা কম জমা পড়েছে এতেই 'হায় হায় গেল-গেল' অবস্থা। পাশের হার বেশ কমে গেছে এ নিয়েও খানিকটা অস্বস্তিতে আছেন শিক্ষার বড়কর্তারা। তবে এই ফলাফল সংকোচন নিয়ে যতই রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া হোক না কেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী জানে এর মূল কারণ চারটি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা। গতবার, ২০১২-তে, যেটি ছিল দুটি। তা ছাড়া গতবার যেমন বাংলা প্রশ্নপত্রে বেশকিছু ভুল ছিল (এসব ভুল সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের গঠনগত) এবারও তা আছে। তবে গতবার প্রথমবার ছিল বিধায় প্রশ্ন ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। এবার বাংলা প্রশ্ন ছিল শিক্ষার্থীর স্তর বিবেচনায় অনেক কঠিন - ভুল তো ছিলই। যেমন একটি প্রশ্ন --

উদ্দীপক - পাকসেনাদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে কৃষক ফয়সাল। সবজি বিক্রয়ের ছলে সবার চোখ এড়িয়ে সে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিবহন করে -
১৪। উদ্দীপকের ফয়সালের কর্মকাণ্ড ‘কলিমদ্দি দফাদার’ গল্পের কোন লাইনের সঙ্গে ভাবগতভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ?
(ক) খালের জলে একটা ঝুপ শব্দ হয়
(খ) বিপরীত দিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়
(গ) আগুন দেয়ার মালমসলা, অস্ত্রও সঙ্গে আছে
(ঘ) ‘মুক্তি মুক্তি' বলতে বলতে পঁচা তক্তাসমতে নিচে পড়ে যায়

এই প্রশ্নের বিক্ষেপকগুলোর মধ্যে উদ্দীপকের ভাবগত সাদৃশ‌্য পাওয়া দুষ্কর। অসম্ভবই বলা যায়। জোর করে সাদৃশ্য খুঁজে পেলে ভিন্ন কথা।

আরেকটি প্রশ্ন--
উদ্দীপক :
“আমাদের পুর্বপুরুষগণ আরব্য, পারস্য, আফগানিস্তান অথবা তাতারের অধিবাসী হউন আর হিন্দুই হউন আমরা এক্ষণে বাঙালি, আমাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালা। ......... কেহ কেহ আবার বাঙ্গালার পরিবর্তে উর্দ্দুকে মাতৃভাষা করিবার স্বপ্নে বিভোর। এ অস্বাভাবিক স্বপ্ন।”
১৭। উদ্দীপকের ‘অস্বাভাবিক স্বপ্ন’ ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় মধুসূদন দত্ত কীভাবে দেখেছেন?
(ক) অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ
(খ) মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে
(গ) পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
(ঘ) পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে

'বঙ্গভাষা' কবিতার উল্লিখিত চারটি পংক্তির কোন্ টি উদ্দীপকের 'অস্বাভাবিক স্বপ্ন' ভাবকে নির্দেশ করে আমি বহু চেষ্টাতেও উদ্ধার করতে পারিনি আর উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী কী করে পারবে ?

আরেকটি উদাহরণ--

উদ্দীপক : চৌধুরী সাহেবের দানের জায়গায় একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল। তাঁকে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি পদটিতে আজীবন থাকার অনুরোধ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন।
৩৩। ভাব বিবেচনায় উদ্দীপকের ‘দানের জায়গা’ ‘হৈমন্তী’ গল্পের কার সঙ্গে তুলনীয়?
(ক) অপু
(খ) হৈমন্তী
(গ) নারানী
(ঘ) বনমালী

'হৈমন্তী' গল্পের 'দানের মন্ত্রে তাকে যতখানি পাওয়া যায়' এই বাক্যাংশটি যেসব শিক্ষার্থী মনে করতে পারবে তারা হয়তো এ প্রশ্নের উত্তরে 'খ'-তে টিক দেবে অন্ধের মত। কিন্তু এতেই প্রশ্নটির যাথার্থ‌্য প্রমাণিত হয় না। উদ্দীপকের 'দানের জায়গা' কীকরে ভাববিবেচনায় হৈমন্তী তথা একটি চরিত্রের সাথে এক হল তা গুরুতর প্রশ্ন যার উত্তর একমাত্র প্রশ্নকর্তাই দিতে পারবেন।

গতবারের প্রশ্নে ৪০ শতাংশ ছিল অভিন্নতথ্যভিত্তিক যা ২০ শতাংশের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এবার ৫ শতাংশ মাত্র কমেছে যা এখনও অনেক বেশি। আসলে সৃজনশীল প্রশ্নে ত্রুটি-বিচ্যৃতি ঠিক করার জন্য যেমন ধরনের ওয়ার্কশপভিত্তিক যাচাই-বাছাই দরকার তেমনটি হয় কিনা আমার ঘোরতর সন্দেহ । আমি বাংলা বিষয়ের গত দুইবারের প্রশ্নেই গুরুতর বিচ্যুতি এবং দুর্বলতা লক্ষ করেছি। এ নিয়ে সচলায়তনে আমার আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২-র এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই। আমি ওই লেখার কপি দিয়েছিলাম সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণের সাথে জড়িত একাধিক কর্তাব্যক্তিকে। তাতে কারো কিছু যায় আসে না আমি জানি। কিন্তু বিপদে পড়ে এবং পড়তেই থাকে অসহায় পরীক্ষার্থীরা। এবার তো চারটি বিষয়ে ছিল এমন প্রশ্ন। অন্যান্য বিষয়ে, বিশেষ করে বিজ্ঞান-সমাজ-ভূগোল ইত্যাদির প্রশ্নে বিভ্রান্তির সুযোগ অনেক কম হলেও প্রশ্নকর্তার অদক্ষতা সবকিছুকে ওলটপালট করে দিতে পারে। হয়তো নীতিনির্ধারকরা বলবেন- শুরুতে এমন একটু-আধটু হতেই পারে, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। আমরাও তা মনে করি। কিন্তু এই হাত-পাকানোর সময়টায় যেসব শিক্ষার্থীর ফলাফলের বারোটা বেজে গেছে বা যাবে তারা কী ক্ষতিপূরণ পাবে ?


মন্তব্য

বিবর্ণ সময় এর ছবি

আমি ফিজিক্স পড়াতে গিয়ে যেই অবস্থা হতো কিছু সৃজনশীল প্রশ্ন দেখে...আপনার বাংলা নিয়ে সেই অবস্থা দেখি। বইয়েই উদ্ভট সৃজনশীল দেখতাম। কাউরে বলিয়া লাভ নাই। আমি এস এস সি এর বই পড়াইতে গিয়া বিরক্ত হইয়া একটা লেখা দিয়েছিলাম। লিখতে পারি নাই হয়তো। সকল সমস্য আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এতো মানুষ বাংলাদেশে। এই একবছরের স্টুডেন্ট এর ক্ষতি হলে কী আসে যায়।

মাহবুবুল হক এর ছবি

যার যায় সে বোঝে। সৃজনশীল প্রশ্ন পর্যায়ক্রমে সব বিষয়ে অন্তর্ভূক্ত হবে। প্রশ্নের দোষ নয়, প্রতিবছর নতুন কিছু প্রশ্নকর্তা এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শিক্ষার্থীদেরকে গিনিপিগ বানাবে। প্রতিবছরই কিছু ছাত্র-ছাত্রী এর বলি হতে থাকবে। ভাবতেই কেমন লাগে না!

--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।

Arif Al Haque এর ছবি

সব বোর্ড এর প্রশ্ন একই রকম হওয়া উচিত।

মাহবুবুল হক এর ছবি

সহমত।

--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।

সাকিন উল আলম ইভান  এর ছবি

যথার্থই বলেছেন, সৃজনশীল প্রশ্নে যথেষ্ট ভুল সেই সাথে এমন ও কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলো শিক্ষার্থীদের মনে যথেষ্ট সন্দেহর সৃষ্টি করে ।

নৈবক্তিকের এই সামান্য সময়ে হাই থট ও কনফিউসিং টাইপের প্রশ্ন উত্তরে তাদের এই ব্রেন কতটুকু ভুমিকা রাখবে সেটাই বড় প্রশ্নসাপেক্ষ ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনি যেসব প্রশ্নের উদাহরণ দিয়েছেন সেগুলো পড়ে আমি তো পুরাই "মাননীয় স্পীকার"! দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অবহেলা, অযোগ্যতা কতদূর গেলে এমন সব ঘটনা ঘটতে পারে!

গতবারের প্রশ্নে ৪০ শতাংশ ছিল অভিন্নতথ্যভিত্তিক যা ২০ শতাংশের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

- অভিন্নতথ্যভিত্তিক মানে কী? একটু বুঝিয়ে বলুন।

আমি ওই লেখার কপি দিয়েছিলাম সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণের সাথে জড়িত একাধিক কর্তাব্যক্তিকে। তাতে কারো কিছু যায় আসে না আমি জানি।

- আপনি হাল না ছেড়ে যুদ্ধটা চালিয়ে যান। সম্ভব হলে আরো কিছু মিডিয়ায় আপনার বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করুন। পরিবর্তন একসময় আসবেই।

শিক্ষার্থীদের ক্ষতি নিয়ে কেউ ভাবে না। গত বেয়াল্লিশ বছরে পাঠ্যপুস্তক, কারিকুলাম, পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ণ পদ্ধতি, নির্দেশনা - এ'সব নিয়ে কত খেলাই না চললো। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বই পাতলা হতে হতে চাপাতিরুটি হয়ে গেল। কারিকুলামে কত সাপব্যাঙ ঢুকলো আর বের হলো। পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কাটাগোল্লা খেলা হলো। মূল্যায়ণের আকাশ থেকে তারকাবৃষ্টি হলো। এতসব ঘটনায় শিক্ষক আর অভিভাবকদের হেনস্থা বেড়েছে, শিক্ষার্থীরা বলি হয়েছে আর দেশ নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

জস্মিন দেশে যদাচার! সর্বক্ষেত্রে যেখানে সমন্বয়হীনতার চুরান্ত, সেখানে প্রশ্নপত্র রচনায় শতভাগ সুশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করবে এটা আশা করাই বোকামী। তবে আরেকটা দিকও ভেবে দেখার মত- এই প্রশ্ন বিভ্রাট সত্বেও অনেক ছেলেমেয়ে তো পাশ করেছে, অনেকে চুরান্ত ভাল রেজাল্ট করেছে। তারা পারলো, অন্যরা পারলো না কেন?

অর্ধ লক্ষাধিক জিপিএ-৫ প্রাপ্ত সর্বোচ্চ মেধাবীদের নিয়ে আমরা কী করবো যখন তার এক দশমাংশও প্রত‌্যাশামত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না ?

এক্ষেত্রে এক দশমাংশ মানে যদি পাঁচ হাজার হয়, তাহলে কেমনে কি? শুধু সরকারী মেডিক্যাল/ইঞ্জিনিয়ারিং/এগ্রিকালচার শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতেই সংখ্যাটা এর চেয়ে বেশী, আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হিসেবের মধ্যে আনলে সংখ্যাটা তো অনেকে বেশী।

আব্দুল্লাহ এ এম

শাফায়েত এর ছবি

"প্রত‌্যাশামত" শব্দটা আপনি মিস করছেন। মেডিকেল অনেক হলেও বেশিভাগ স্টুডেন্টের প্রত্যাশা বেশি থাকে প্রথম কয়েকটার দিকে, সেগুলা বাদ দিয়ে অন্যগুলোতে পড়তে হলে তারা হতাশ হয়, বিশ্ববিদ্যালয় অনেক হলেও ম্যাক্সিমাম ছাত্র যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সাবজেক্টে ভর্তি হতে চায় তার সংখ্যা অনেক কম। কয়জন বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাস্ট ইত্যাদি জায়গায় ভর্তি হতে পারবে? (কোন ভার্সিটি কার থেকে ভালো সেটা আমি বলছিনা, কোন কোন ভার্সিটিতে পড়ার ইচ্ছা স্টুডেন্টদের বেশি থাকে সেটার কথা বলছি)। নিজের পছন্দমতো জায়গায় এক দশমাংশও ভর্তি হতে পারবেনা।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও আপনার সাথে একমত। সমস্যা পদ্ধতিতে নয়, সমস্যা হচ্ছে এর প্রয়োগে। ধন্যবাদ চমৎকার একটা লেখার জন্য।

-এস এম নিয়াজ মাওলা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।