সৃজনশীল প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের কাছে কোন ভীতি নয়। ভীতি অভিভাবকদের কাছে আর ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের কাছে। শিক্ষার্থীরা এসব প্রশ্নের চমৎকার উত্তর দিতে জানে। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি যেসব শিক্ষার্থী চিন্তাশীল-সৃজনশীল ও ভাষায় দক্ষ তারা খুব সহজে এর উত্তর দেয়ার কৌশল বুঝে ফেলতে পারে। অর্থাৎ যাদের মধ্যে কোন বিষয়কে সংক্ষেপিত বা বিশ্লেষিত করার দক্ষতা তৈরি হয়েছে বা যারা বিষয়ের সারমর্ম বা মর্মার্থ সহজে উপলব্ধি করতে পারে তারা সৃজনশীল প্রশ্নের যেকোন সমস্যার সমাধান করতে পারে খুব দ্রুত। আমি প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নের কথা বলছি। প্রথম দুটি, অর্থাৎ জ্ঞান ও অনুধাবনমূলক, সরাসরি পাঠ্যবইয়ের অনুসরণে হয় বিধায় এটি সব মানের শিক্ষার্থীর জন্য একই। কিন্তু সমস্যা হল প্রশ্ন করা নিয়ে। এই প্রশ্নের নির্মাণ কলায় শিক্ষকের মনোযোগ এবং দক্ষতা এতটাই জরুরী যে, বস্তুত এই জাতীয় পরীক্ষাপদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। সৃজনশীল প্রশ্নের উপযোগী করে শিক্ষার্থীকে তৈরি করার দায়িত্ব শিক্ষকের। শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকের নিজকেও সেই মানে নিয়ে যেতে হবে-- ক্লাসরুমে পড়ানোর পদ্ধতিই পাল্টে ফেলতে হবে। প্রশ্ন তৈরির জন্য অনেকটা সময় দিতে হবে। এ জাতীয় প্রশ্ন তৈরি করতে হলে, একই বিষয়ের কয়েকজন শিক্ষককে পারস্পরিক মতবিনিময় অত্যন্ত প্রয়োজন। সেটা করার জন্য যে মানসিক উদারতা বা চর্চা প্রয়োজন তা আমাদের দেশের কতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আছে ভেবে দেখা প্রয়োজন । অবশ্য এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, এই প্রশ্ন করা ও উত্তরপত্র পরীক্ষণের জন্য যে অভিনিবেশ ও সতর্কতা প্রয়োজন, অধিকাংশ শিক্ষকই তা দিতে পারেন না বা দেন না। কারণ কোন প্রতিষ্ঠানই সে অনুযায়ী সম্মানী দেবে না। আগের পদ্ধতিতে একটি প্রশ্ন করলে একজন শিক্ষক যদি ১০০ টাকা (উদাহরণ) পেতেন তো সৃজনশীল প্রশ্নের জন্যও একই বা কোন ক্ষেত্রে হয়তো সামান্য বেশি পাবেন। কিন্তু এই প্রশ্ন নির্ভুলভাবে সবরকম মান অক্ষুণ্ন রেখে করতে হলে তাকে যে শ্রম ও সময় দিতে হবে তা বহুগুণ বেশি, বলা যায় সেটি আর্থিক মানে নির্ধারণযোগ্য নয়। উত্তরপত্র পরীক্ষণের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নমালা তৈরি ও তা পরীক্ষা করার জন্য যে সফটওয়্যার ও ডিভাইস রয়েছে তা আমাদের কোন প্রতিষ্ঠান এখনও ব্যবহার করছে বলে শুনিনি। ফলে পুরো চাপটি গিয়ে পড়ছে শিক্ষকের ওপর। তার ওপর শিক্ষকের প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া পর্যন্ত ভাবছে যে রাষ্ট্র সেখানে তো এই শিক্ষক হাতে-ভাতে সবদিকেই মারা যাবে। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, শ্রেণি শিক্ষকদের অনেকটা নিরাসক্ত ভূমিকার মধ্য দিয়ে চলছে এই পদ্ধতি (এটা অনুমান নয় বাস্তবতা)। মূ্ল্যায়ণ পদ্ধতির ক্লেশ ও অপ্রতুল সম্মানীও শিক্ষককে মানসিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখে । সবমিলিয়ে যে কথাটি এখন ভাববার সময় হয়েছে তাহল, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির প্রয়োগ-জটিলতা দূর করতে হবে দ্রুত। তা না হলে এটি মেধাশূন্য প্রজন্ম তৈরি করতে থাকবে। শিক্ষার্থীরা এটি দ্রুত আয়ত্ত করতে পারবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক ফলাফল-সংকোচনরে জন্য বা নবম-দশম শ্রেণির গণিতের ফলাফলে বিপর্যয়ের ( দৈনিক সমকাল) জন্য পুরো ব্যবস্থাতেই দোষারোপ করা যায় না। এই পদ্ধতিতে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী বাছাই করতে আরো কিছুটা কঠোরতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে, সে বিষয়ে আরেকটি লেখা দেয়ার ইচ্ছে রইল। কিন্তু জিপিএ-৫ পাওয়ানোর জ্বরে আক্রান্ত অভিভাবকের জন্য একমাত্র পরামর্শ সন্তানকে পুরো পাঠ্যবই তন্নতন্ন করে পড়তে বলুন। তার মধ্যে নিজে লেখার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলুন, ভাষা ব্যবহারে দক্ষ হতে সাহায্য করুন-- এমনিই ভাল ফল হবে। আর একটা কথা বলতেই হচ্ছে, দ্রুত সিজিপিএ-৫ (সবধরণের) -কে ৯৫ শতাংশের উপরে নিয়ে যাওয়া উচিত এবং আবারও প্রবর্তন করা উচিত মেধাস্থান, তবে ২০ জন না করে অন্তত ১০০ জন।
মন্তব্য
আবারো মেধাস্থান চালুসহ গোটা গ্রেডিং পদ্ধতিকেই সাজানোটা জরুরি। তবে আমার কাছে মনে হয়, হায়েস্ট গ্রেডেরক্ষেত্রে নির্ধারক মান না রেখে কোনো বছরের সর্বোচ্চ মানের থেকে পেছন দিকে একটা রেঞ্জকে ঘোষণা করা যেতে পারে। ঘোলাটে লাগছে নিজের কাছেই। ভেঙে বলি, ধরা যাক ২০১৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বাংলায় সর্বোচ্চ নাম্বার উঠল ৭৬, সেকষ্ত্রে ৭৬-৭০ পর্যন্ত লিমিটে যারা নাম্বার পেয়েছে তারা এ-প্লাস পেয়েছে বলে ধরা হবে। এবং এরকমভাবেই ঐ বিষয়ের জন্য গ্রেডের বিণ্যাশ করা হবে। অর্থাৎ পূর্ব ঘোষিত একটা নিধৃারিত মান না রাখা। এই পদ্ধতির কথা বলছি এই কারণে যে, এতে করে জোর- জবরদস্তি নাম্বার দেয়ার জন্যে যে এক ধরনের নির্দেশ রয়েছে তা থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। এর পাশাপাশি চোথাভিত্তিক পড়াশোনার যে কালচার তৈরি হয়েছে তাও থামতে বাধ্য। সর্বোচ্চ রেজাল্টের জন্যে সর্বোচ্চ শ্রমের বিষয়টিই আবারো সামনে এসে দাঁড়াবে। এটা একেবারে ব্যাক্তিগত অভিমত। কোথাও এরকম পদ্ধতি আছে কিনা আমার জানা নেই।
স্বয়ম
-একমত।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
শিক্ষকদের কাছেই সৃজনশীল পদ্ধতি মুর্তিমান আতংক হিসাবে দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষকই রুটিন ক্লাশ করা,মুখস্ত করানো, পড়া ধরা এই সিস্টেমে অভ্যস্ত। বাজারে যদি "সৃজনশীল গাইড" বইগুলো না থাকতো এরা বিপদে পড়তো। এখনও ক্লাসে পরিস্কার করেই বলা দেয়া হচ্ছে কোন গাইড কিনতে হবে। ওগুলো থেকেই মুখস্ত করানো হচ্ছে, প্রশ্নপত্র তৈরী হচ্ছে। সুতরাং সৃজনশীল পদ্ধতি এখন সৃজনশীলতার চিপায় পড়ে গেছে। পুরোনো সিস্টেমই পড়ালেখার মানটা কিছুটা হলেও ধরে রেখেছিল।
সৃজনশীল গাইড বইগুলো তৈরি করে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে শিক্ষকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এমন কি এনসিটিবি-র একজন শিক্ষক তো গাইড বইএর পক্ষে সারাদেশে সেমিনারের নামে হকারি করে বেরিয়েছেন।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
সবার আগে টিটি কলেজগুলোতে সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে, শিক্ষকদেরকে নতুন পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রশিক্ষণ না দিয়েই সে পদ্ধতি হঠাৎ করে চালু করলে এইরকম হওয়াই স্বাভাবিক। সত্যি কথা বলতে গেলে কোচিং বা প্রাইভেট এসব আসলে সেই অর্থে সমস্যা না, বরং এইসব আসলে দেশের আর্থ-সামাজিক অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ভুত উপসর্গ মাত্র। ভর্তি পরীক্ষা/পাব্লিক পরীক্ষার জন্য কোচিং বা এই ধরণের ব্যপার-স্যাপার পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেও আছে। তাই এইসব বন্ধ করার উদ্দেশ্যে নতুন পদ্ধতি চালুর বদলে, কেন শিক্ষক/অভিভাবক এইসব দিকে বেশী ঝুঁকছেন সেই কারণ বের করা জরুরী। আর আমার ধারণা সেই কারণ কারো কাছেই তেমন অস্পষ্ট নয়, দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে "নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা/সার্টিফিকেট" সরাসরি "জীবিকা"র সাথে সম্পর্কযুক্ত, ৬০এর দশকেও দেশের মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া ছাত্র/ছাত্রীরা অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান বা গণিত পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত, এখন এরকম নেই বল্লেই চলে (মনে হয় একদমই নেই) -- তখন "শিক্ষা"ই যে জীবন বাঁচানোর জন্য একমাত্র অবলম্বন, এরকম ধারণা তেমন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। তাই এখন "যে কোন মূল্যেই হোক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সার্টিফিকেট" বাগানোই শিক্ষার্থী/অভিভাবকের মূল লক্ষ্য, কি শিখলাম, না শিখলাম তাতে কিছুই এসে যায় না।
আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্কুল/কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের কাছে বেশী কিছু আশা না করাই উচিৎ, বিশেষ করে তাঁদের জীবন যাত্রার মান (গুটি কয়েক প্রাইভেট ব্যবসায়ী বাদে) এতই মানবেতর যে তাঁদের কাছে সৃজনশীলতা আশা করাটা অন্যায়, দেশের অধিকাংশ স্কুল শিক্ষক (এবং তাঁদের পরিবার) চরম হতাশা, দারিদ্র আর অনিশ্চয়তার মাঝে জীবনযাপন করেন। আর আমি প্রাইভেট ব্যবসায়ী শিক্ষকদেরও তেমন দোষ দিতে পারি না, এখনকার পরিস্থিতিতে তাঁদের যে বেতন ভাতা, ঐ যায়গায় আমি থাকলে আমিও একই কাজ করতাম, এবং যত রকম নতুন সিস্টেমেই চালু করুক, আমি আমি আমার প্রাইভেট ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টাই করতাম। তাঁরা যে নিয়মিত/অনিয়মিত স্কুল/কলেজে গিয়ে যে ক্লাস নেন, এইই আমার কাছে অনেক বেশী মনে হয়।
স্কুল/কলেজের হিসাব না হয় বাদ দিলাম, দেশের অনেক পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও যথোপযুক্ত সম্নানী, ভাতা, গবেষণা/প্রশিক্ষনের পরিবেশ/অবকাঠামো পান না, তারপরো গুটি কয়েকজন স্কুল-কলেজ শিক্ষক/অধ্যাপক যে নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন, তা চিন্তা করতেই আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে।
আমার ধারণা ইউরোপ-আমেরিকায় শিক্ষা/গবেষণা যদি বাজেট বাংলাদেশের মত করা হয়, তাহলে কয়েক বছরের ভিতরেই হার্ভার্ড, ক্যাম্ব্রিজ আর ই.টি.এইচ. জুরিখের শিক্ষার মান বাংলাদেশের পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে নেমে যাবে।
একমত।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
একমত, অপেক্ষায় রইলাম
কথা সত্য, তবে কেবলই অরণ্যে রোদন... "জ্বর" এখন "মহামারী"... আরেক প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় আছে কিনা জানিনা... সেজন্যই ভাবি বাছাইটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন